#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৭)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
মেহজা ঘাবড়ে যায় অনেক। কোনোমতে ভয় লুকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বলে,
“শাস্তি মানে কীসের শাস্তি?”
“যা করেছ তা মোটেও ঠিক কর নি।”
“ঠিক বেঠিক আপনাকে বলে করব নাকি? আর আপনি কে যে আপনার কথা আমার রাখতে হবে।?”
“আমি কে সেটা নাহয় পরেই জানবে। আগে পানিশমেন্টটা পুরো করে যাও।”
“নেভার এভার!”
“ইউ হ্যাভ টু মিসেস ইয়াজিদ।”
“নো!”
“ওকে! তোমার কাছে দুইটি অপশন আছে। এক. হয় আমার সাজা মেনে নেওয়া আর দুই. সবাইকে বলে দিতে হবে যে তুমি আমার স্ত্রী আমি তোমার স্বামী। আর তুমি যদি না বল তো আমি তো আছি। একেবারে কাবিনা নামা সহ সবাইকে দেখিয়ে বলে দিব যে তুমি আমার বউ। নাও! ডিসিশন ইজ ইউর!”
মেহজা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিয়ের ব্যাপারটা কেউ জানুক তা সে চায়না। এতে সম্পর্কের মার প্যাচে সে আরো বেশি তলিয়ে যাবে। সাজা টা যেমনই হোক নিয়ে নেওয়া উচিত।
মেহজা কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলে,
“ঠিক আছে। আপনি যা শাস্তি দিতে চান দিন।”
“শিউর তো?”
“হুম।”
“ওয়াদা?”
“পাক্ক!”
“আচ্ছা। তাহলে সাজাটা বলি, কাল সারাদিন তুমি আমার সাথে থাকবে। ফার্স্ট টু লাস্ট অনুষ্ঠানের সবকিছুতেই আমার সাথে থাকবে এন্ড মোস্ট ইমপোর্টেন্ট থিং ইজ আমি যা করতে বলব তুমি তা-ই করবে। আদেশ করলে পালন করবে, নিষেধ করলে তা মেনে চলবে আর উপদেশ দিলে বুঝে নিবে। গট ইট!”
মেহজা ক্রুদ্ধ নয়নে চেয়ে আছে ইরফানের দিকে। এটাও কোনো সাজা! ইরফান তাকে যে এমন মারপ্যাচে ফেলবে সে ভাবতেই পারেনি। তাও এখন সে ওয়াদাবদ্ধ তাই চুপচাপ ভাথা নাঁড়িয়ে সায় দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। তবে সেটা সন্ধ্যা পর্যন্তই।”
“আমি কী রাত বলেছি? বেশি বেশিই এক্সপেক্ট করছ তুমি। আর বেশি চিন্তা করা ঠিক নয়। ইটস্ বেড বর হেল্থ!”
“মানে?”
“মানে জানতে হবেনা। বাসায় যাও এখানে আর এক মুহূর্ত থাকেবনা।”
“আপনি এখনই হুকুম দেওয়া শুরু করছেন কেন?”
“আচ্ছা তুমি থাকো আমি গেলাম। সুন্দর মেয়ে দেখলে এখন জ্বীনেরা এসে ঘুরঘুর করবে তোমার আশেপাশে। তারপর আর কী? চুল টেনে নিয়ে তালগাছের মাথায় বেঁধে দিবে।”
“আপনি খুব বেশিই….
“ভালো! আমি সেটা জানি। তোমার থেকে আর নতুন করে জানা লাগবেনা।”
“ভালো না ছাই। আস্ত অসভ্য একটা লোক।”
“তোমারই তো।”
“না আমার না।”
“তাহলে কার?”
“পেত্নীর।”
“ফাইনালি নিজেকে চিনেছ।”
“দূষিত পুরুষ মানুষ একটা!”
রাগে গিজগিজ করতে করতে মেহজা বাসায় চলে যায়। পেছন থেকে ইরফান চেঁচিয়ে বলে,
“নয়টায় আমার বাসায় চলে আসবে। মনে থাকে যেন!”
মেহজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তাকে যেতেই হবে আর কিছু করার নেই।
—————————————–
দরজা খুলে মেহজাকে দেখে ইমা বিস্মিত হয়। ইমা এখানে এসেছে গোটা একটা দিন গেল মেহজা এবারের জন্যও আসেনি। এখন এত বড় হঠাৎ! ব্যাপারটা তাকে ভাবায়। মেহজা ইমার দিকে চেয়ে আদুরে কন্ঠে “আপু” বলতেই ইমা কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“এখন এত আহ্লাদী হতে হবে না। এখন আসার সময় হলো? আর এত জলদি রেডি হওয়ার কারণ কী? কণিউনিটি সেন্টারে তো বারোটায় যেতে বলেছে।”
“এসেছি এমনেই আর রেডি হতে ইচ্ছে করছিল তাই রেডি হয়েছি। গাউনটা সুন্দর না?”
“হ্যাঁ সুন্দর।”
“রাদিফ ভাইয়া দিয়েছে।”
“তাই নাকি!”
“হুম।”
—————-🍁——————
ইরফানের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে মেহজা উঠে দাঁড়াতেই ইমা মেহজাকে তার রুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে বলে,
“আমি কিছু জরুরী কথা বলতে চাই তোমার সাথে। শোনার টাইম হবে?”
নয়টা অনেক আগেই বেজে গেছে ইরফানের সাথে এখনও দেখা হয়নি মেহজার। ইমাকেও না করতে পারছেনা তাই সে মাথা নাঁড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ। ইমাও চশমার গ্লাসটা মুছে নেয়। ডিভাইনে বসে হাতের ইশারায় মেহজাঈএও পাশে বসতে বলে। মেহজা বসতেই সে বলে ওঠে,
“সেদিন তুমি রান্না করেছিলে সবাই প্রশংসা করলেও ইরফান করেনি। তাতেই তুমি রাগ করেছিলে খুব। কারণটা অবশ্য মন্দ নয়। এত কষ্ট করে যার জন্যে রেঁধেছো তার তাচ্ছিল্য ভরা কথায় কষ্ট পাওয়া আর রাগ করাটাও স্বাভাবিক। তবে এখানিই একটা জিনিস তুমি ধরতে পারো নি। আমাদের কিছু খারাপ লাগলে আমরা হয়তো তা আর খাইনা বা কোনোমতে খেয়ে উঠি। সেক্ষত্রে ক্ষুদার টাইম তো দূরে থাক ইরফানের খাবার ভালো না লাগলেই সে খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়। খারাপ লাগছে তো লাগছে। আর ইরফান ক্ষিদে সহ্য করে নিলেও সেই খাবার খায়না যা অপছন্দের। আর ওর টেস্ট খুবই ভালো। সব অবস্থায় ও খাবারের টেস্ট ধরতে পারে। এখন তুমি হয়তো বলবে আমি সেটা কেন বলছি! তাহলে শুনো! তুমি খেয়াল করেছো কি না জানিনা আমি দেখেছি সে প্রতিটা আইটেম দুইবার করে নিয়েছে। পেটপুরে তৃপ্তি করে খেয়েছিল। মানে তার খুবই পছন্দ হয়েছে তোমার রান্না। তবে সে সেটা স্বীকার করবেনা। ছোট থেকেই সে ইগোইস্টিক। আর আরেকটা কথা মেহজা! হলুদের যে লেহেঙ্গা পড়েছিলে আর আজ যে গাউন আর কাল যে ড্রেস পড়বে এরমধ্যে একটিও রাদিফ দেয়নি তোমায়। জুয়েলারী সেট এবং দরকারী সামগ্রী থেকে শুরু করে সবটা ইরফান কিনেছিল। আর রাদিফকে মানা করেছে তোমাকে জানাতে। সেদিন ইরফান শপিং এ আমাকে নিয়েই গিয়েছিল। তার পছন্দ বরাবরই প্রশংসনীয়। তুমিও তার পছন্দের। একটা কথা কী জানো মেহজা? ইরফান যদি তোমাকে পছন্দ না করত তাহলে এতদিনে যে কোনো ভাবে তোমাদের ডিভোর্স হয়ে যেত। সে কোনোভাবে তোমাকে তার জীবনের সাথে জঁড়াত না। আমার মনে হয় আসলে পছন্দ নয় ও তোমাকে ভালোবাসে। তোমাকে সেদিন আমি কি বলেছিলাম মনে আছে? ইরফানের বুক ফাটলেও মুখ ফুটেনা। নিজের অনুভূতি প্রকাশে সে বরারবরই ব্যার্থ। রাগ, জেদটাই বেশি। তাই তোমাকে নিজের মতো করে তার মনের কথা বুঝে নিতে হবে। তার মুখেই প্রকাশ করাতে হবে। আর একটি উপদেশ মাথায় রাখবে। সে রাগের বশে কখনো যদি কিছু বলে মাথায় নিও না। সে রাগের কারণে অনেক কিছুই বলে ফেলে যা আদৌ সে করবেনা।”
মেহজা হতবাক। ইমার প্রত্যেকটির কথার যুক্তিতে তারও এমনটি মনে হচ্ছে। ইশ! আগে কেন সে এতসব ভাবেনি! কেন একটু ঘাটিয়ে দেখেনি ইরফানের মনটা! বড্ড দেরি হয়ে গেছে। রাগ, অভিমানের কারণে ভালোবাসা টাই চাপা পড়ে গেছে। এখন সে সব সরিয়ে যা সত্য তা জানতে চায়। ইরফান তাকে ভালোবাসে কিনা সেটা জানতেই হবে। যেকোনো ভাবেই!
ইমা সবসময় বেস্ট! তার বোঝানোর ধরনটাই আলাদা। আরো আগেও সে ইঙ্গিত দিয়েছিল মেহজাই বুঝেনি। আসলে সে বোকা। তাও খুব বড় মাপের। মেহজা আনন্দিত হয়ে ইমার একটি হাত টেনে নিয়ে উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে বলে,
“অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। আমি তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি।”
ইমা মৃদু হাসে আর মেহজা দ্রুত পায়ে ইরফানের রুমের দিকে পা বাঁড়ায়। মাঝপথে কী মনে করে থেমে যায়। লোকটি তাকে সাজা দিয়েছে কারণ সে জেলাস ফিল করেছে। আর জেলাসিটাকেই এখন কাজে লাগাতে হবে। উহু এত সহজে সেও ধরা দিবেনা। ফিরে যেতে নিলে আবার মনে পড়ে সে ওয়াদাবদ্ধ। তারপরেই মাথায় আসে সে তো নয়টায় ঠিকই এসেছে। ইরফানেরই তো খবর নেই। সো তার কোনো দোষ নেই। এখন সে মেকআপ করবে। মন মতো সাজবে। আহ্! আনন্দে মনটাই নাঁচছে।
বারোটা বেজে গেছে। ইরফান পার্কিং লোটে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। মেহজা ওয়াদাভঙ্গ করেছে। এখন অব্দি তার কোনো দেখা নেই। এতবড় বাটপারি মেহজা ছাড়া আর কেই বা করতে পারে। ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে আছে ইরফান। তখনিই পেছন থেকে কে দুইবার করে ভাইয়া ডাকল,
“ভাইয়া,,,, ভাইয়া!”
ইরফানের মনে হলো তাকেই কেউ ডাকছে। সে ভ্রু কুঁচকাতেই পেছন থেকে আবারও আওয়াজ এলো;
“ইয়াজিদ ভাইয়া?”
মেহজাকে ভাইয়া বলে ডাকতে দেখেই সে বিষম খায়। মেহজাও দৌঁড়ে এসে বলে,
“বিষম খাচ্ছেন কেন ভাইয়া? নিন পানি খান।”
“ওহ্ পানিই তো নেই। এখন কী খাবেন আপনি!”
ইরফান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“তোমাকে!”
পাশ থেকে তানজীব বলে,
“ইয়াজিদ ভাই! ওকে খাবেন মানে?”
তানজীবকে দেখে ইরফানের কান গরম হয়ে যায়। দুদিন আগেও তানজীব আর তার গলায় গলায় ভাব ছিল এখন সে খুব বিরক্ত হচ্ছে তানজীবের প্রতি। তার বউয়ের দিকে সে কোন সাহসে নজর দেয়! ইরফান গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,
“ও পানি এনে দিবে সেটাই বলতে চাইছিলাম।”
“ওহ্! আমার গাড়িতে আছে পানি। এনে দিব?”
“না এখন আর লাগবেনা। তৃষ্ণা মিটে গেছে আমার।”
“আচ্ছা তাহলে আর কী করার! মেহজা লেটস্ গো!”
“লেটস্ গো মানে?”
“মানে হলো চল যাই। এটাও জানেন না ইয়াজিদ ভাইয়া! এমনিতে তো সারাক্ষণ ইংরেজীতে ফটর ফটর করেন।”
মেহজার করা অপমানটা খুব বেশিই গায়ে লাগল ইরফানের। চোখ বন্ধ করে রাগ সংবরণ করে সে তানজীবকে বলে,
“মেহজা আমার সাথেই যাবে তানজীব। আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা আছে।”
“আগে থেকেই ঠিক করা? কোথায় মেহজাতো বলেনি একবারও!”
“সেটা ও কেন বলেনি তা আমি জানিনা।”
“মেহজা তাহলে ইয়াজিদ ভাইয়ের সাথেই যাচ্ছো!”
“জ্বি না! আমি আপনাদের কারো সাথেই যাচ্ছিনা। বিয়েটা আমার ভাইয়ের সেই হিসেবে আমি তার সাথে তার গাড়িতে যাব। বায়!”
মেহজা এক ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। বাহিরে এসে দাঁড়াতেই রাদিফ গাড়িতে উঠতে বলে। মেহজা তড়িৎ গতিতে উঠে বসলেই গাড়ি সাই সাই করে চলে যায়। আর ইরফান আর তানজীব অবাক নয়নে সেদিকে চেয়ে থাকে।
#চলবে।
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৮)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
কমিউনিটি সেন্টারের সাজানো দুর্দান্ত হয়েছে। এইখানের কালার থিমটাই হচ্ছে মূল আকর্ষণ। একপাশে কালো আর সোনালী রঙের ঝলকানি তো একপাশে সাদা গোলাপীর প্রেম প্রেম পরিবেশ, আবার একপাশে নীল আর হলুদের অন্য রকম ছোঁয়া। বর বধূর আসনের পেছনটা লাল আর রুপালী রঙ। এটাই মূল আকর্ষণ। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এই দৃশ্যটা মেহজার কাছে। সে যখন শুরুতে ওয়েডিং প্ল্যানারদের থেকে এই আইডিয়া সম্পর্কে জেনেছে তখন সে ছিঃ করেছিল একপ্রকার। কিন্তু এখন! এখন তো সে চোখ ফেরাতেই পারছেনা। অসাধারণ লাগছে।
মেহজা হেঁটে গিয়ে গোলাপী আর সাদার সেই প্রেমময় পরিবেশের একটি সোফায় বসে পড়ে। এদিকটায় মানুষ খুব কম। কম বললে ভুল হবে। আপাতত কেউ নেই। তাছাড়া সকল অতিথিকে দেড়টায় আসতে বলা হয়েছে। বিল্ডিংয়ের কিছু পরিবার এসেছে এখনও অনেকেই বাকি আছে। তারা আগেই এসেছে কারণ রাদিফ আর রিমি তৈরি হবে। তারপর ফটোসেশন হবে অনেক ব্যাপার সেপার আছে। একসময় নিজের বিয়ে নিয়ে কতটা আনন্দই না কাজ করত মেহজার। শাড়ি নয় লেহেঙ্গা পড়বে, লাল নয় পার্পেল পড়বে, স্টিলেটো নয় প্লাটফর্ম পড়বে! কিন্তু হলো কী? সে এক রাতে দাওয়াত খেতে গিয়ে সেই রাতেই বিয়ে করে নেয় তাও আবার একপ্রকার মেরে ধরে বিয়ে দিয়েছে। বাসর নিয়েও ছিল কতটা উত্তেজনা, চাঁদ দেখবে তারা স্বামী-স্ত্রী, তারপর একটা কড়া লিকারের দুধ চা খাবে। শীতের রাতে তাদের বাসর হবে। চারিদিকে কুয়াশা থাকবে আর ঠান্ডা থাকবে আর সে তার প্রিয় মানুষটির বুকে মুখ লুকোবে। তা আর হলো না! বিয়ে বাসর সবই হয়েছে কিন্তু একটাও তার পছন্দ হয়নি। শুধু মানুষটাই পছন্দ হয়েছে আর বাকিসব বিশ্রী। মেহজা সোফায় হেলান দিয়ে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে। তখন গাউনটা পরিবর্তন করে সে পাতলা সিল্কের শাড়ি পড়েছে। কেন পড়েছে সে জানেনা তবে তার মনে হয়েছে এমনটা করা দরকার। বেটা ইরফানকে কিছুটা নাঁচানো যাক! মেহজার ঘুম আসছে আরাম করে হেলে শোয়ার ফলে ঘুমটা নাড়া দিচ্ছে। আশপাশটা আরেকবার দেখে নিয়ে ভাবে ঘুমালে মন্দ হয়না।
ঘুম ঘুম চোখে মেহজা দেখতে পেল কেউ তার উপর ঝুকে আছে। মস্তিষ্কে ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়তেই সে সটান করে উঠে বসে। আকস্মিক উত্তেজনায় তার বোধ শক্তিটাও সে হারিয়ে ফেলে। ইরফান মেহজার হাব ভাব দেখে ভ্রুঁ কুঁচকায়। হালকা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
“ঘুমানোর কি আর জায়গা পাও নি? পাব্লিক প্লেসে ঘুমিয়ে কী বোঝাতে চাও মানুষকে? যে তুমি কত জোরে নাক ডেকে ঘুমাও! ঘুমানোর সময় তো তোমার দিকে তাঁকানও দায়। বিভৎষ লাগে তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।”
“বিভৎষ লাগে তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায়” এই কথাটিই মেহজার কর্ণগোচর হয়নি। রাগে মাথা দপদপ করা শুরু করেছে তার। ইরফানের কলার চেপে ধরে বলে,
“বিভৎষ লাগে আমাকে? যদি তা-ই হয় তাহলে এমন ঝুকে আছেন কেন? বিভৎষ চেহারাটার দিকে তাঁকিয়ে আছেন কেন?”
“চোখ চলে যাচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে! কলার ছাড়ো মেহজা। এটা একধরণের অসভ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
“না ছাড়ব না। কি করবেন না ছাড়লে! আমি বিভৎস! আমি!”
ইরফান ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। কলারে থাকা মেহজার হাতগুলো নিজে থেকে ছুটিয়ে নেয় তারপর মেহজার চুলের এক অংশ তার হাতে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে। তারপর দুইহাত দিয়ে তার মাথাটা উঁচু করে কপালে একটি পবিত্র স্পর্শ এঁকে বলে,
“ঘুমালে মোহনীয় লাগে তোমায়। সুন্দর বা মায়াবী এমন কিছুই আমি বুঝিনা। আমি বুঝি তোমাকে দেখতে আমার ভালো লাগছে। আর সেটিও খুব বেশিই।”
মেহজা মৃদু হাসে। ইরফানকে অবাক করে সে ইরফানের ঠোঁটে নিজের ঠোঁটটি ছোঁয়ায়। তারপর সেখান থেকে চলে আসে। হাতে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে একটা বেজে গেছে। সে কম করে হলেও ত্রিশ পঁয়ত্রিশ মিনিট তো ঘুমিয়েছেই।
এতক্ষণ মেহজা আর ইরফানের একান্ত মুহূর্তগুলো দূর থেকে দেখে তানজীব। তার বিশ্বাসই হচ্ছেনা সে এমন কিছু দেখেছে। মেহজা নিজ থেকে ইরফানকে স্পর্শ করেছে। মস্তিষ্ক মেহজাকে নানান কথা বলছে কিন্তু মন বারবার বলছে এটা ভুল। এমন কিছুই সে দেখেনি মেহজা এমন কিছুই করবেনা। তাছাড়া ইরফান তার থেকেও বয়সে ছোট মেহজাকে এভাবে! না! কিছু ভালো লাগছেনা তার। এলোমেলো পায়ে হেঁটে গোল রাউন্ডের টেবিলগুলোর একটিতে গিয়ে বসে। অতিথিরা আসছে, গল্প করছে, যার যার মত করে আনন্দ করছে। সে পারছেনা এসবের কিছুই করতে। তার চোখ তো আর ভুল দেখেনি। মেহজাকে সে ভালোবাসে না এমনটা নয়। সে মেহজাকে পছন্দ করে এবং ভালোওবাসে। তবে সেটা কতটা গভীর তা সে জানেনা। তার মা তো এই মাসের শেষেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে ভেবেছিল। আর এখন কীনা সে মেহজাকে অন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছে!
“আরে মি. ইরফান ইয়াজিদ যে!”
সিনানের হঠাৎ আগমনে ইরফান কিছুটা অসন্তোষ হয়। তবু হালকা হেসে বলে,
“সিনান সাহেব! আপনি কখন এলেন?”
“মিনিট দশ হয়েছে বটে। আপনার কী খবর ভাই? দিনকাল কেমন যায়?”
“এইত যাচ্ছে ভালোই। আলহামদুলিল্লাহ্! আপনার?”
“আমারও আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই। তা মেহজাকে দেখেছেন কোথাও?”
“মেহজা! দেখেছি তো। আমার সাথেই ছিল এতক্ষণ একটু আগেই সে ওদিটায় গেছে। ফ্রেন্ড সার্কেলকে রিসিভ করতে গেছে হয়তো।”
“তাই নাকি! আগে বলবেন তো!”
একপ্রকার ছুটেই সিনান গমন করে ইরফান দেখানো পথে। ইরফান কিছুটা হকচকিয়ে যায় সিনানের উল্লাসিত মুখ দেখে। সেও পিছু নয় সিনানের লোকটির পেশা অনুযায়ী তার হাব ভাব একেবারেই ব্যাতীক্রম। সে নাকি মেজর না কি! যাই হোক! আস্ত মেয়েবাজ এই সিনান লোকটি— এসব ভাবতে ভাবতে সেও উপস্থিত হয় সেই জায়গায় যেখানে মেহজা তার বান্ধবীদের নিয়ে গল্প করছে। সিনান গিয়েই কিছুটা চিৎকার করেই বলে,
“হাই লেডিস্!”
সবাই কিছুটা চমকায় হুট করে অপ্রত্যাশিত কারো গলার আওয়াজে। অনা আর প্রথি সাথে মেহজার কলেজের আরো দুটি মেয়েও এসেছে আজ। অনার চোখে সিনান পড়তেই সে ফোঁস করে ওঠে বলে,
“আপনি এখানেও?”
“হ্যাঁ। কেন? থাকতে পারিনা বুঝি।”
“না। আপনি এই পরিবেশের সাথে বেমানান।”
“বেমানান মানে কী বলতে চাইছ তুমি? আমি কী মানুষ না! গরু ছাগল যে মাঠে ঘাস খাব পার্টি এটেন্ড করতে পারব না।”
“হ্যাঁ, গরু ছাগল না হলেও আপনি একটা ব ল দ। তাই আপনি আসতে পারেন না।”
“এই মেয়ে লিসেন! বয়সে আমি তোমার থেকে অনেক বড় তাই সে দিক থেকে সম্মান করবে আমাকে কিন্তু তুমি সেটা করছ না উল্টো অপমান করছ! আর তাছাড়া এটা তোমার পরিবার বা তোমার আত্নীয়র বিয়ের অনুষ্ঠান না। তুমি যেমন গেস্ট আমিও তেমন গেস্ট। তোমার কোনো অধিকার নেই আমাকে কিছু বলার। গট ইট!”
“আপ….
“জাস্ট বিকজ তুমি মেহজার ফ্রেন্ড তাই বেঁচে গেলে। অন্যকেউ হলে একেবারে বুঝিয়ে দিতাম আমি কে।”
অনার চোখের কোণে পানি জমে। মুখ লুকিয়ে সে জায়গাটি থেকে প্রস্থান করে। মেহজা অসহায় দৃষ্টিতে সিনানের দিকে তাঁকিয়ে দৌঁড়ায় অনার পেছনে। হুট করে ঝগড়া হবে তার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না। কিছু বলতেও পারেনি কারণ সিনান তার জায়গায় সঠিক ছিল। কিন্তু এখন তো তার কলিজার বান্ধবীটা মনে কষ্ট পেয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত সই এর কাছে গিয়ে তাকে আস্থা দিতে হবে। দুঃখীত বলা লাগবে। মেহজা জানে অনা বড্ড সেনসিটিভ মেয়ে। বড্ড সেনসিটিভ!
ইরফান অবাক নয়নে চেয়ে আছে সিনানের দিকে। সিনানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে তার সম্পর্কে যা ধারণা ছিল তা হুট করেই ভুল প্রমাণ করে দিল সিনান নিজেই। সে এমন স্ট্রিক্ট তা বাহির থেকে দেখলে কেউ বলতেই পারবেনা। ছোট্ট একটি কথাতে সে এতটা রেগে গেল? নট গুড! ওহ্! ইরফানের মনে পড়ল সে নিজেও তো শর্ট টেম্পার্ড!
তানজীবের ফোন কল আসায় সে করিডোরে গিয়ে দাঁড়ায়। কথা বলে পেঁছনে ফিরতে নিলেই কারো সাথে ধাক্কা খায়। অপর পাশের ব্যক্তিটি পড়ে যাবে বুঝতে পেরে তার মেদহীন কোমন আকড়ে ধরে। তারপর সেই অনাকাঙ্খিত চেহারা দেখে বলে,
“মিস ঈশিতা!”
“ডক্টর তানজীব!”
দুজনেই চেয়ে আছে একে অপরের দিকে বিস্মিত নয়নে। আদৌ সম্ভব! আবার কীভাবে দেখা হতে পারে তাদের!
#চলবে।