#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২১)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
তীব্র রোদের ছটায় ঘুম উবে যায় মেহজার চোখ থেকে। মেহজা পাশে ফিরে দেখে ইরফান নেই। উঠে বসে সামনে তাঁকাতেই চোখে পড়ে সাদা টি-শার্ট পড়িহিত ইরফানকে। আজ অন্যরকম লাগছে ইরফানকে। এর কারণ একটাই! সে আজ টি-শার্ট পড়েছে তাও আবার সাদা! মেহজা আগে কখনও দেখেনি এই ভাবে তাকে। গতকালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলোও নেই, ক্লিন শেইভ করেছে। সবসময় সেট করে রাখা চুল গুলো আজ এলোমেলো। চোখে চশমা পড়ে আছে ইরফান। মেহজা ভ্রুঁ কুঁচকায়, ইরফানকে তো কখনও তো চশমা পড়তে দেখেনি সে। ইরফানের কী চোখে সমস্যা আছে? কথাটা ভাবতেই মেহজার হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ইরফানের এই অল্প বয়সে চশমা পড়তে হবে! পরক্ষণেই সে আবার ভাবে ইরফান তো বুড়ো! এইতো! ত্রিশ হয়েছে কিছুদিন আগে। মেহজা প্রথির নম্বর থেকে ইরফানকে “শুভ জন্মদিন” লিখেই ব্লক করে দেয়। যদি অপরিচিত নম্বর দেখে কল দেয়? তো সর্বনাশ! প্রথিও সব জেনে যাবে। জেনে যাওয়ার কথা ভাবতে গিয়ে মেহজা ঠিক করে নেয় সে আজ অনা আর প্রথিকে তার বিয়ের কথা জানাবে। যেখানে সব গোপন কথা, সত্য কথা তারা তাকে জানায় বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে তারও তো তাদের সবটা জানাতে হবে। পরে কখনও অন্যকারো থেকে জানলে বা পরিস্থিতিটা এমন হয় যে তারা জেনেছে তখন তো তারা কষ্ট পাবে। তার ফ্রেন্ডরা তার থেকে সব জানার অধিকার রাখে!
মেহজা আপনমনে যখন ভেবেই চলেছিল ইরফান তখন তার দিকে তাঁকায়। মেহজাকে অন্যমনষ্ক দেখে ইরফান মেহজাকে ডেকে ওঠে,
“মেহজা! উঠে গেছ?”
ভাবনায় ছেদ ঘটায় মেহজা সামনে তাঁকায় পুনরায়। ইরফানের মুখে উপচে পড়া আলোদের প্রতি মেহজার রাগ হয়। কি সুন্দর তারা ইরফানের সাথে লেপ্টে আছে! ইরফান এই মুহূর্তে মেহজাকে খুবই আকর্ষিত করছে তার প্রতি। মেহজা বিছানা থেকে নেমে প্রথমে আলগোছে খোপা বেধে নেয়। সে অসাধারণ দৃশ্যটি ইরফান খুব করে উপভোগ করে। মেহজা খোপা বাধা শেষ করে কাবার্ডের কাছে যায়। সেখানে কেন যায় তা সে জানেনা। তবে এমন মনে হচ্ছে তার ব্যবহার করার মত কিছু সে পাবেই।
সত্যিই মেহজা কাবার্ড খুলে একপাশে কিছু শাড়ি পায়। যা আগে কখনও দেখেনি। ওহ্! আগে কখনও সে কাবার্ড খুলেও তো নাই। যখনিই এসেছে ব্যাগে করে জামা কাপড় এনে ব্যাগ থেকেই নিয়ে পড়ত। কাবার্ডের দিকে তাঁকায়নি পর্যন্ত। কালো রঙের একটা জামদানি নিয়ে সে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। ইরফান সেদিকে চেয়ে মুঁচকি হাসে। শাড়ি গুলো সেদিনই কিনেছিল যেদিন সে ইমা আর রাদিফের সাথে বিয়ের কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। পাখি যেহেতু নীড়ে ফিরবেই তাই আগে থেকেই সব কিছু যোগাড় করে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। মনে মনে ইরফান চেয়েছিল কালো জামদানিটা মেহজা পড়ুক। মেহজা যদি অন্য শাড়ি নিত তাহলে সে কিছু বলত না। কারণ সে কখনোই মুখ ফুটে মনের কথা বলার মত পুরুষ নয়!
আধা ঘন্টা পর ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে মেহজা বের হয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। দরজা লাগানোর শব্দে ইরফান চুখ তুলে সামনে তাঁকায়। মেহজার দিকে তাঁকিয়েই সে স্তব্ধ হয়ে যায়। হাতের কাজ তার বন্ধ হয়ে যায়। চোখ থেকে চশমাটা খুলে তার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে। সে শাড়িটা কেনার সময় মেহজাকে কল্পনাতে যতটা সুন্দর লাগবে ভেবেছিল এখন বাস্তবে মেহজাকে তার থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে দেখে বিমূঢ় হয়ে রয়। মেহজা ইরফানের দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক খুঁজে গতবারের ক্রিম কিছু পায়। কাল রাতের শাড়ির সাথে ম্যাচিং চুড়ি গুলো এখনও তার হাতে। সেগুলোর ঝনঝন শব্দে ঘরটা ভরে উঠছে যেন। ইরফানের কেন যেন এই মুহূর্তে চমৎকার লাগছে। বউ আছে তার সামনে একেবারে গিন্নির মত লাগছে।
মেহজা কানের দুল গুলো তখন খুলেই ঘুমিয়েছিল। এই শাড়ির সাথে ভালোই মানাবে দেখে তা পড়ে নেয়। তখনিই ইরফান এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। মেহজা আয়নায় ইরফানকে দেখে ভ্রুঁ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি? কিছু লাগবে?”
“লাগবেনা কিছু।”
“তাহলে সরুন। মস্ত বড় শরীরটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নড়তেও তো পারব না মনে হচ্ছে।”
“তো নড়তে বলেছে কে তোমায়?”
মেহজা কিছুটা রাগ নিয়েই ইরফানের দিকে তাঁকায়। ইরফান মৃদু হেসে ড্রেসিংটেবিলের দ্বিতীয় জ্রয়ার থেকে একটি বক্স বের করে। বক্সটা এত সুন্দর ভেতরের জিনিসটা না জানি কেমন হয়- এসবই ভাবছিল মেহজা। তখনিই ইরফান বক্স খুলে কিছু একটা নিয়ে মেহজাকে সোজা করে তার গলায় একটি লকেট পড়িয়ে দেয়। যেখানে একেবারে ছোট ছোট করে সুন্দর ডিজাইন করা ইংরেজীতে লেখা আছে মিসেস ইয়াজিদ। নামের মধ্যে ছোট ছোট ডায়মন্ড খোদাই করা। আর পুরোটাই প্ল্যাটিনামের। মেহজা অবিশ্বাস্য নয়নে লকেটটার দিকে চেয়ে আছে। আদৌ এসব সত্যি কীনা সে সেটাই ভাবছে। তখনিই ইরফান তার ঘাড়ে একটা গভীর স্পর্শ দিয়ে বলে,
“পছন্দ হয়নি?”
“এটা খুব দামি। আমার জন্য এত দামি জিনিস আপনার কেনা উচিত হয়নি।”
“আপনি মানুষটা আরো দামি। আর তাছাড়া কি কিনব বা না কিনব, কার জন্য কিনব, উচিত-অনুচিত এসব তোমার থেকে জানতে চাইনি আমি।”
মেহজা বিস্মিত হয়ে যায় ইরফানের প্রতিটা কথায়। ইরফান আবারও বলে ওঠে,
“মেহজা!”
“হু,,
“আমার বয়স ত্রিশ হয়ে গেছে। এখন তোমার মনে হয়না আমার একটা বাচ্চার প্রয়োজন?”
“না! আমার এমন মনে হয়না।”
“কেন? আমার কিছুদিন পর চুল পাকবে আর আমি বুড়োও হয়ে যাব। তখন আর বাচ্চা হবে? বা হলেও তার জন্য আমি আর কি-ই বা করতে পারব! তাছাড়া বাবা আর মাও নাকি ছেলের ঘরের নাতি নাতনির মুখ দেখতে চায়। বুঝতেই তো পারছ?”
“আচ্ছা! একটা বাচ্চার কাছে বাচ্চা চাইছেন কীভাবে আপনি? আমাকে তো কিছুদিন আগেও বাচ্চা বাচ্চা করে তাড়িয়ে দিতেন। এখন সেই বাচ্চার কাছেই বাচ্চা চাইছেন কেন লজ্জা করেনা!”
“আমি তো…..
“আপনি কী? বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন তাই তো! আপনি তো একটা বুড়ো-ই। আমি তো আর বুড়ি হয়ে যাচ্ছি
না। তাই আমার দরকার নেই।”
“আমি বুড়ো?’
“তা নয়তো কী?”
“এখন যদি আমি বলি যে, আমি বিয়ে করব মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে বুঝলে! আর কত মেয়ে তো আমাকে স্বামী হিসেবে পাবে সেই আশায় বসে আছে। কারণ কেউই জানেনা আমি বিবাহিত।”
“জানবে কীভাবে? যে লোক নিজের বউকে সমাজের সামনে না আনতে পারে সে কোন আক্কেলে আবার বাচ্চা চায়! আপনি তো একটা কাপুরুষ। তার সাথে নির্লজ্জও বটে। মেয়ে দেখলেই তো আপনার গা কিলবিল করে।”
কথাগুলো বলে মেহজা আর একমুহূর্তও দাঁড়ায়না। রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর ইরফান সেদিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকে। বাচ্চার কথাটা সম্পূর্ণ মজা করেই বলেছে সে। সে নিজেও চায়না অনার্স এর আগে মেহজার মা হওয়াটা। তার বাবা মাও কখনো এমন আশা করেনি বা এমন ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। তারা নিজেরাই তাদের মেয়েদের মাস্টার্সের আগে বিয়ে দেয়নি সেখানে মেহজার থেকে এই বয়সে নাতি নাতনির আশা করা বহু দূরের কথা। মেহজার আসলে রাগ করার কারণ তাদের বিয়ে নিয়ে গোপনীয়তাতে। আসলেই তো! তার স্ত্রী মেহজা আর সেটা সকলের জানা উচিত। গোপন থাকবার মত সম্পর্ক তো তাদের নেই। তাহলে কীসের এত গোপনীয়তা। কথা হয়েছিল মেহজার আঠারো হলেই অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলবে। আর মেহজার আঠারো হয়েও গেছে। তাহলে আর দেরি কীসের!
মায়ের ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাঁড়ায় সে। কিছু দিন আগেই এসে মাকে সরি বলে চলে গেছিল সে। তাদের সম্পর্ক এখন আগের মতোই। ইরফান যখন মাহিমা বেগমকে সরি বলে, ক্ষমা চায় তখন মাহিমা বেগম কত কান্না করেছিল। যা ইরফানের অপরাধবোধ আরো বাড়িয়ে তোলে।
☆☆☆☆
বাথটাবে শুয়ে অনা কাঁদছে। শরীরে তার জ্বালা ধরেছে। অসহনীয় যন্ত্রনায় সে মরে যাচ্ছে যেন। ব্লিডিং হচ্ছে তার, ব্যাথায় কাতর হয়ে যাচ্ছে সে। পেটে চাপ দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে কিন্তু তা সে পারবেনা। পিরিয়ড হয়েছে তা সে বুঝতে পারছে। তার সাথে আরেকটি ব্যাপার নিয়ে শঙ্কা হচ্ছে তার। ভয় করছে। সত্যিই যদি তার আর সিনানের মধ্যে কিছু হয়ে যায় তাহলে সে কাউকে মুখ দেখাতে পারবেনা।
তখন,
সিনানকে থাপ্পড় মেরেই সে ছুট লাগায় মেহজার রুমে। ভাগ্য সহায় ছিল বিধায় সেই ঘর থেকে তাকে বের হতে কেউ দেখেনি কারণ সাতটা বাজছিল সবাই তখন ঘুমেই বিভোর ছিল। সবাই ক্লান্ত তাই এখনও হয়তো শুয়ে আছে। অনার লেহেঙ্গাটায় রক্ত লেগে আছে তবে সেই রুমের বিছানার চাদর ঠিক ছিল। ভারি লেহেঙ্গার ভাজ ভেদ করে চাদর পর্যন্ত যেতে পারেনি এই তরল!
গোসল সেড়ে রুমে এসে দেখে প্রথি বিছানায় বসে আছে। প্রথির চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। নেশার ফলেই হয়তো এমন হয়েছে।
কেউ যদি জানে তারা কাল ড্রিংকস্ করেছে তাহলে অঘটন ঘটে যাবে। নতুন কোনো বিপদে পড়বে। তবে সবার আগে সে সিনানের বিচার করবে। তার কৃতকর্মের ফলও তো তাকে ভুগতে হবে। এমন জঘন্য অপরাধের ভয়ঙ্কর শাস্তি প্রাপ্য তার।
#চলবে।
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২২)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ নিয়ে ইরফানদের দোতালার বড় লিভিংটায় বসে আছে মেহজা, অনা, প্রথি। মেহজা অনা আর প্রথিকে কল করে বলেছে ঊনিশ তলায় আসতে তাই তারাও এসেছে। দুজনে আসতেই কাজের মহিলা দরজা খুলে দেয়। আর তারা আশেপাশে কাউকে না দেখতে পেয়ে মেহজার খোঁজ করতেই তাদের বলা হয় সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসতে। তারাও কোনো কথা না বাঁড়িয়ে উপরে চলে আসে। এখানে এসে প্রথমে আশপাশটা দেখে যা বুঝতে পারে এটাই ইরফানদের বাসা। বিয়েতে ইরফানকে দেখে যখন অনা মেহজাকে জিজ্ঞেস করে ইরফান এখানে কীভাবে, তখন মেহজা শুধু বলেছে তারা একই বিল্ডিং এ থাকে সেই সুবাদে তারাও স্বপরিবারে আমন্ত্রিত। তবে মেহজা এটা বলেনি যে তাদের উপর তলায় ইরফানরা থাকে।
অনা আর প্রথি দ্বিতীয় চমকটা পায় তখন যখন তারা মেহজাকে শাড়ি পড়িহিতা দেখে। অসময়ে, অন্যের বাসায় তাও আবার বধূ বেশেই বলতে গেলে সে কী করছে তারা তা ভেবে পায়না। অনা চমকিত কন্ঠে মেহজাকে বলে,
‘এসব কী মেহু? তুই এখানে কি করছিস! আমাদেরই বা কেন এখানে ডাকলি!’
‘বলব সব। আগে দুজনে এখানে এসে বস।’
মেহজার হাতের ইশারা অনুযায়ী দুজনেই মেহজার মুখোমুখি সোফায় বসে। অবাক চোখে মেহজাকেই পর্যবেক্ষণ করে চলছে দুজন। কেমন একটা ধাঁধাঁর মত লাগছে সব কিছু। কাজের মহিলাটি তিন কাপ চা এনে দিয়ে নিরবে চলে যায়। মেহজা অনা আর প্রথিকে অনুরোধ করে চা টা খাওয়ার জন্য। শত বিস্ময় নিয়ে তারাও চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল। একটা সাসপেন্সন এর মধ্যে ধোঁয়া ওঠা গরম চা-ই তো মোস্ট ইম্পর্টেন্ট!
‘আমি আজ আমার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা তোদের সাথে শেয়ার করব। যা আগে কখনও করিনি কিন্তু করা উচিত ছিল। সেটা সম্পূর্ণই আমার দোষ আমি মানছি। তবে এটাও জানি তোরা আমায় ক্ষমা করে দিবি পরিশেষে।’
অনা মেহজাকে চোখের ইশারায় বলছে ‘বল’ তাই মেহজা প্রথম থেকে বলা শুরু করে,
‘আমার তখন এস এস সির আর তিন মাস বাকি। হুট করেই অনেকদিন আগের কিনে রাখা ফ্ল্যাটটা তে আমাদের শিফ্ট হতে হয়। এখান থেকে আমার স্কুল আর রাফসানের স্কুল কাছে, ভাইয়ার অফিস কাছে, বাবার অফিস গোডাউন, শোরূম সব এদিকেই। দাদার বাড়ি, ফুফুদের বাড়ি, ছোট খালামণির বাড়ি সবই এদিকেই। তাই আমাদের জন্য ব্যাপারটা খুবই ভালো ছিল। আগে যেখানে থাকতাম সেটা তিন তলায় ছিল যার ফলে বড় বড় দালান গুলোর জন্য দিনের শহরই দেখতে পারতাম না রাতের কালো শহর তো দূরের কথা। আঠারো তলায় থাকব শুনে সে কি খুশি আমার! আনন্দে আত্নহারা আমি এখানে এসে আরো বেশিই উচ্ছাসিত হয়ে পড়ি। এর একটাই কারণ! আমাদের উপর তলার ইরফান ইয়াজিদ! লোকটাকে আমি যেদিন প্রথম দেখি সেই দিনটা আমি আজও ভুলিনি। শুধু দিন নয় সময়টাও জানি। নভেম্বরের ছয় তারিখ সকাল নয়টা দুই মিনিটে। স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিফ্টে উঠি যখন তখন শুধু অনুভব করি আরও একজন আছে লিফ্টে। আমি অতোটা গুরুত্ব দেইনি। তারপর যখন সামনে থাকা মিররে পেছনের ব্যক্তিটিকে দেখে আমি বাকহারা হয়ে পড়ি, দিশাহীন হয়ে যাই, হুট করেই অসহায়ত্ব বোধ করি। আমার হাত পা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিল। লোকটি ধারালো চাহনীতে আমি মনে হয় কেটে কুটে কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিলাম। এত গম্ভীর আর সুপুরুষ আমি আগে দেখিনি। আমি সবসময় লম্বু নামে আখ্যায়িত ছিলাম। সেই আমিই সেদিন এক পুরুষের বুকের সমান হয়ে বড্ড আফসোস করেছিলাম কেন আর একটু লম্বা হলাম না। আমার বাবা আর ভাইও লম্বা কিন্তু সে অনেক বেশিই লম্বা ছিল তাই আমি প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম। আমি যে আরেকটি মানুষ লিফ্টে উঠেছি তাতে তার কোনো হেলদোল নেই। সে সোজা হয়ে আছে একটু চোখটাও ঘুরাচ্ছে না। জাস্ট লাইক আ রোবট! বুঝলি!’
মেহজা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করে,
‘আমার এই প্রেমটা লিফ্টেই গাঢ় হয়। লিফ্টটা আমার প্রেমের সবচেয়ে বড় সাক্ষী জানিস! তো সেদিনের পর থেকে আমি রোজ এই সময়ে বের হতাম আর সৌভাগ্যক্রমে প্রতিদিন তাকে লিফ্টে পেতাম। হুট করে আমার ক্লাস এর সময় একঘন্টা পিছিয়ে নেয়। তখন আমার দশটায় বের হতে হত আর আমি তার দেখাও আর পেতাম না। তবে এর মধ্যে প্রতিবেশি হিসেবে তার সাথে আমাদের পরিচয়পর্ব সমাপ্ত হয়। আমিও তাকে খুব বিরক্ত করতে লাগলাম। তাকে কোথাও দেখলেই মুঁচকি হাসি দেওয়া আর তার অগোচরে শত শত উড়ন্ত চুমো ছুড়া আমার রোজকাল কাজের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে কিন্তু একসময় আমার কার্যকলাপে আমার মনের ভেতরের ব্যাপারটা ধরেই ফেলে। আমিও একদিন তাকে দেখে ছোট ভাই রাফসানের সামনেই তার চোখে চোখ রেখে একটা চোখ মেরে দিলাম। ব্যাস! এটাই বয়ে আনে বিপদ। রাফসান বাবাকে জানিয়ে দেয় আমিও রিমি আপু মানে বর্তমানে যে আমার ভাবী পূর্বে সে আমার খুব পরিচিত এবং কাছের এক আপু ছিল। তো আমি তার কাছে যাই আর সবটা জানাই। বাবা বকবে বা মারবে এই ভয়েই শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।’
মেহজা মৃদু হেসে অনা আর প্রথির দিকে তাঁকিয়ে পুনরায় বলা শুরু করে,
“সেদিন তাকে আবারও লিফ্টে পেলাম। সে আমাকে আর আমার ভালোবাসাকে সেদিন তুচ্ছ করেছিল আবেগের কাছে। অল্প বয়সের দোষ বলে আখ্যায়িত করেছে। যা আমার আবেগ বা দোষ কোনো কালেই ছিল না। তোরাই বল! থাকলে বুঝি আজও তাকে ভালোবাসতাম! ভালোবাসি এটাই তাকে বোঝানো দায়! রাগে দুঃখে একটা মাস আর তার দিকে তাঁকায়নি। নিজেও দেখা দিতাম না আর। তারপর একদিন হুট করেই তার মায়ের সাথে দেখা প্রথম পরিচয়েই তিনি তার বাসায় ডিনারে নিমন্ত্রণ করে। তার অনুরোধ ফেলতে পারিনি বিধায় আমি সেদিন যাই। সেই দিনটা আরো স্মরণীয় আমার কাছে। কারণ সেদিন একটা নোংরা ভুল বোঝাবোঝির জন্য আমি আর সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাই!”
এবার চরম অবাক হয় অনা ও প্রথি দুজনেই। বিবাহ বন্ধন! মানে মেহজা বিবাহিতা? মেহজা ওদের দুজনের চেহারার রঙ বদলাতে দেখে বলে,
“আমি বিবাহিতা আর এটাই সত্যি। ঐ যে ইরফান ইয়াজিদকে তোরা স্বামী হিসেবে চাস! সেই ইরফান ইয়াজিদ আমার স্বামী। তিনি একান্তই আমার ব্যক্তিগত সম্পদ! যার ভাগ আমি আর কাউকে দেব না কখনও।”
দুজনকেই শকের মধ্যে দেখে মেহজা মিটিমিটি হাসে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলে,
“প্রথম দেখার এক্সাক্ট টাইমটা মনে আছে কেন জানিস? কারণ আমি মিররে তাঁকানোর আগেই হাতে থাকা ঘড়িতে তাঁকিয়ে সময় দেখেছিলাম। কয়েক সেকেন্ডে নিশ্চয়ই মিনিট পার হয়নি। সেকেন্ডের সংখ্যাও দুই তিনের বেশি তো নয়। আর তারিখ তো জানতামই।”
————————————
সেই কখন থেকে ইরফান আর ইমা মাহিমা বেগম আর আহনাফ মজিদের ঘরে বসে আছে। এর মধ্যে একবারও আসল কথাটি বলে উঠতে পারছেনা সে। কেমন একটা আড়ষ্টতা কাজ করছে তার মধ্যে। বলবে বলবে ভাবছে কিন্তু বলতে ভয় করছে। পরিস্থিতিটা অনুকূলে নেই মনে হচ্ছে।
ইমা ভাইয়ের ছটফটানির কারণ কি তা জানে। ইরফান তাকে সবটা জানিয়েই এখানে নিয়ে এসেছে। এখন সে যেহেতু বলছেনা তাই তাকেও চুপ করে থাকা চলবেনা তাই ইমা বলল,
“আব্বা! কিছু জরুরী কথা ছিল। যদি আপনি চান তো বলতে পারি।”
“হ্যাঁ বল।”
“বাবুর বিয়ের একবছর হতে চলল। মেহজার ও আঠারো হয়ে গেছে কয়েকমাস আগে। তো আমি বলছিলাম কী এবার আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের বিয়ের স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া দরকার। ইরফান তো এখন যেহেতু একা থাকে ওর পাশে ওর স্ত্রীর থাকাটা খুব জরুরী। তাই বলছিলাম আপনি অতি শীগ্রই কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।”
“আমিও তো দুদিন ধরে সেটাই ভাবছি। তোমার মাও কাল রাতে বলেছে এই ব্যাপারে। যেহেতু তার আর মেহজার সম্পর্ক এখন ঠিক হয়েছে তাই আর সমস্যা দেখছিনা। ইয়াজ! তুমি কি বল? অনুষ্ঠান করব এখন!”
“জ্বি যা ভালো মনে কর তাই কর।”
“আমাদের মনে করাটা এখন বড় বিষয় নয়। একসাথে থাকবে তোমরা তাই তোমাদের সমোঝতা করা দরকার বলে আমি মনে করি।”
“বাবা তুমি অনুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম চালু করতে পারো পরশু থেকে।”
“বেশ তা-ই হবে। তবে মেহজা!”
“সেও চায় বাবা। সামাজিক স্বীকৃতি তার প্রাপ্য।”
“ঠিক আছে আমি ওর বাবার সাথে বিকেলে বৈঠকে বসব না হয়।”
“আচ্ছা।”
ইরফান বেরিয়ে আসে তার বাবা মায়ের রুম থেকে। এখন চাপ একটু কম লাগছে। যাক! কিছু কাজ তো করা শেষ এবার মেহজার রাগ ভাঙাতেই হবে।
#চলবে।