#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৩)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
চারিদিকে পিনপতন নিরবতা। দিনের সূচনা হয়েছে বলে ব্যস্ততায় ভরে উঠেছে শহর। যার যার দৈনন্দিন রুটিন অনুযায়ী নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ইরফানও বেরিয়ে পড়েছে নিজের গন্তব্যে। ইমাও চলে গেছে তার নিজ স্থানে। পান চিবোতে চিবোতে মাহিমা বেগম দোতলায় উঠে এলেন। আশেপাশে তাঁকিয়ে ইরফানের রুমে চলে যায়। মেহজা রুম গুছিয়েছে ভালোই! বেলকনিতে ফুসুর ফাসুর আওয়াজ হওয়াতে তিনি সেদিকে গেলেন। তাকে দেখে মেহজা, অনা, প্রথি সব সটান করে দাঁড়িয়ে যায় বসা থেকে। মাহিমা বেগম প্রশস্ত হেসে সবাইকে নিচে খেতে ডাকে। তার নম্র ব্যবহারে তিনজনই খুশি হয় খুব।
তখন মেহজার জীবনের চরম সত্যর সাথে পরিচিত হওয়ার পর প্রথি কিছুটা রাগ দেখালেও অনা মেহজাকে সঙ্গ দেয়। সত্যিই তো! মানব জীবনের এমন কিছু ঘটনা থাকে যা চাইলেও নিজের অতি নিকটবর্তী মানুষের কাছেও বলা যায়না। পরিস্থিতি কিংবা সমাজ কীভাবে নিবে, কোনো ক্ষতি হয় যদি! এমন নানা প্রশ্নের জালে আটকা পড়ে পারেনা কোনো কিছু ব্যক্ত করতে। এই এখন অনা নিজেই তো এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ডুবে আছে। না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে চুপচাপ মেনে নিতে। এই মুহূর্তে তার অন্তরে সবচেয়ে বড় ঝরটি বয়ে চলেছে। তবুও দেখ! বাহিরে তাকে দেখে কেউ বলতে পারবেনা যে তার জীবনের এখন খুব কঠিন মুহূর্ত চলছে। সবাইকে সব বলার আগে সিনানের সাথে তার কথা বলতেই হবে। মনের কোণে একটু হলেও আশার আলো আছে যে ঐরকম কিছুই হয়নি কিন্তু চোখে যা দেখেছে তাও তো ফেলে দেওয়া যায়না। নিজের চোখটাকে তো কোনো মানুষই অবিশ্বাস করবেনা।
পরে ইরফানের চমৎকার ব্যবহারে প্রথিও গলে গেল। লোকটার সম্বন্ধে প্রথমে যে ধারণা জন্মেছিল তা ক্ষণেই বদলে গেল। সবচেয়ে বড় কথা মেহজা খুশি। ইরফানকে সে ভলোবাসে যেই অবস্থাতেই বিয়েটা হোক না কেন তারা স্বামী-স্ত্রী এর চেয়ে চরম সত্য আর নেই। অফিস যাওয়ার সময় মেহজার কপালে চুমু দিয়ে যাওয়া, মেহজার অবর্তমানের তার জন্য কেনাকাটা করে রাখা, আর মেহজার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া মিসেস পদবিটা ইরফান নিজেই তো দিয়েছে। তারা দুজন একে অপরের সাথে ভালো আছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু কি আছে?
টেবিলে এসে বসে ওরা তিনজন। মাহিমা বেগম নিজ হাতে সবার প্লেটে খাবার উঠিয়ে দেয়। গ্লাসের জুসটুকুও নিজ হাতে ঢেলে দেয়। মেহজা অনেকবার করতে চাইলেও তাকে এসব কিছুই তিনি করতে দেয়নি। মাহিমা বেগম পান ফেলে কুলি করে এসে তাদের সাথে না বসে সদর দরজার উদ্দেশ্য যেতে নিলে মেহজা বলে,
“মা! কোথায় যাচ্ছেন? খাবেন না আপনি?”
“হ্যাঁ খাব তো। আসলে তোমার মা কাল বলে দিয়েছেন সকাল সকাল তোমাদের বাসায় যেতে। বিয়েতে যেতে পারিনি বলে খুব রাগ করেছেন। তাই আজ সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত ওখানেই খেতে হবে। তবে তোমরা এখানেই খাবে আমি তোমার মাকে জানিয়ে দিব।”
“কিন্তু মা! বাসায় তো আমাদের অতিথিরা আছে তাদের তো!”
“সমস্যা নেই আমি আর তোমার আম্মু সামলে নিব। তুমি ওদের নিয়ে থাকো সময় দাও ওদের। আর ভুলেও কোথাও যেও না। ইয়াজ দুপুরে খেতে আসবে তুমি থেকো কিন্তু। আমি এখন গোসল করে রেডী হয়ে যেহেতু বের হচ্ছি বিকেলের আগে আর এদিকে ঢু মারব না।”
“আচ্ছা মা।”
মাহিমা বেগম চলে গেলেন। মেহজার কাছে কিছুটা বিব্রতকর লাগলেও সে খুশি হয়। এখন তিনজন মিলে জম্পেশ আড্ডা দিতে তো পারবে!
———–🍁🍁🍁————
কলিং বেলের আওয়াজে মেহজা তড়িৎ গতিতে ছোটে দরজা খোলার জন্য। সবে মাত্র সে যোহরের নামায পড়ে কিছুক্ষণের জন্য শুয়েছিল। অনা আর প্রথি একটু মার্কেট গেছে কিছু দরকারি জিনিস কিনতে। প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল এখনো আসেনি মেহজাও একাকী বিরক্ত হচ্ছে। ভেবেছে ওরা দুজন এসেছে কিন্তু না! সামনে ঈশিতা দাঁড়িয়ে। আকস্মিক ঈশিতাকে দেখে সে ঘাবড়ে যায়। ঈশিতাও মেহজাকে এখানে আশা করেনি যা তার চেহারায় স্পষ্ট! অবাক হয়ে মেহজাকে বলে,
“মেহজা তুই! তুই এখানে কী করছিস?”
“আসলে আপু….
“আসলে কী? এমন শাড়ি টারি পড়ে অন্যের বাসায় কী করছিস? ইরফানের মাকে তো তোদের বাসায় দেখে আসলাম।”
ঈশিতার প্রশ্ন করার পর হঠাৎ একটি পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠে মেহজা ও ঈশিতা দুজনেই চমকে ওঠে, সবচেয়ে বেশি চমকিত হয় তার বলা কথায় যা হলো,
“মেহজা তো এখানেই থাকবে। কারণ এই বাসা ওর স্বামীর বাসা তাই।”
ঈশিতা পেছনে থাকা ইরফানের দিকে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। কম্পিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“স্বামীর বাসা মানে? এটা তো আপনার বাসা।”
“আমিই ওর স্বামী।”
ঈশিতার অধর জোড়া কাঁপছে তার চেয়েও বেশি কাঁপছে তার এই মাত্র আঘাত পাওয়া হৃদয়টি। ইরফানের দিকে ব্যাথিত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে বলার মতো কিছু পায়না। কি বলবে সে? কি-ই বা বলার আছে! ইরফানের চেহারা দেখে তার কথা শুনে তো মনে হচ্ছেনা সে মিথ্যা বলছে। আর জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে গৃহবধূ সেজে মেহজা নিজেই তো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইরফান আরেকটু এগিয়ে এসে মেহজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এটা কেমন ভদ্রতা মেহজা? বড় বোন প্রথমবার তোমার শ্বশুরবাড়ি এসেছে আর তাকে তুমি চৌকাঠ পেরোতেই দিলেনা এখনো।”
মেহজা যেন এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল। ইরফানের কথাতে তা কেটে যায়। নিজের ভুলটা চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ায় সে লজ্জিত হয়। দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। ইরফান হাস্যজ্জ্বল মুখ করে ঈশিতাকে বলে,
“প্লিজ কাম ইনসাইড ডক্টর ঈশিতা!”
ঈশিতা অনিচ্ছা স্বত্তেও ভেতরে প্রবেশ করে। ইরফানের প্রতি নিজের এতদিনের বাসনা, প্রণয় যা ছিল মুহূর্তেই তা উঁড়ে কোথায় যেন চলে গেল! একরাশ অস্বস্তি এবং অনুশোচনা বোধ জাগ্রত হলো তার অন্তরে। ছোট বোনের স্বামীকে নিয়ে কীনা সে এতদিন এতরকম জল্পনা কল্পনা করে এসেছে। ভাগ্যিস তার অনুভূতিরা এখনো প্রকাশ পায়নি। ইশ! আজকেই সে এসেছিল ইরফানকে মনের কথা বলতে আর আজই কিনা এমন অপ্রিয় সত্যের সাথে পরিচিত হতে হলো? কেন এমন হয়! আমরা কেন তাকে পাইনা যাকে আমরা চাই! আর কেন-ই বা তাকে পাই যাকে আমরা কোনোদিনও চাইনা, চাইতে রাজিই থাকিনা।
ঈশিতাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলে ইরফান ফ্রেশ হতে যায়। ইতিমধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। সকালে খেয়ে বের হয়নি যার দরুন এখন ক্ষিদা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অফিসেও ফিরতে হবে এক ঘন্টার মধ্যে। আজকে বিকেলেই সিলেটের ফ্লাইট ধরবে সে। আবার সেখান থেকেও রাতে ঢাকার ফ্লাইট ধরে ফিরবে। সামনের বড় অনুষ্ঠানটার জন্য এখন অনেক ধকল যাবে তার উপর দিয়ে। নাহলে অনুষ্ঠানটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হবেনা। অপরদিকে সবকিছুর মধ্যেও একটি ব্যাপারে সে খুশি। ঈশিতাকে তার বৈবাহিক জীবনের ব্যপারে জানিয়ে দিতে পেরে। সে জানতো ঈশিতা তাকে নিয়ে কিছু অনুভব করে। তার এখনো মনে আছে তার রাজনৈতিক দলের একজনের বিয়েতে গিয়ে খাবার টেবিলে ঘটা সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি। সে অতি দ্রুত তা ভুলে যেতে চায়। অতি দ্রুত!
——————- 🍁 ——————-
“এই অনা? এত দ্রুত হাঁটছিস কেন? দাঁড়া আমার জন্যে!”
অনা প্রথির ডাক অগ্রাহ্য করে হেঁটেই চলেছে। সিনানকে এইমাত্র সে সামনের রাস্তায় একটি শপ থেকে বের হয়ে গাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। হাতের নাগালের বাহিরে চলে যাবে দেখে সে প্রথিকে ফেলেই দ্রুত গতিতে সেদিকে হাঁটা ধরে। সিনান ফোনে কথা বলতে বলতেই গাড়িতে বসে। তখনিই অনাও তার পাশের সিটে এসে বসে পড়ে। হুট করে নিজের পাশে নিজেরই গাড়িতে অযাচিত কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সিনান ভড়কে যায়। তবে অনাকে দেখে মুহূর্তেই চেহারার রঙ বদলে যায়। ক্রোধে ফেটে পড়ে যেন! সকালের চড়টা সে এখনো ভুলেনি। এর শোধও তো নেয়নি সে। যেহেতু আসামী নিজেই এসেছে তাহলে দেরি কীসের! সিনান কিছু করবে তার আগেই অনা বলে,
“গাড়ি স্টার্ট দিন! এক্ষুণি!”
“মানে? তোমার কথায় হবে নাকি!”
“যা বলছি করুন নয়তো খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি!”
ওদের কথার মাঝেই প্রথিও গাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ে অনা কাচ উঠিয়ে নেয়। তারপর সিনানকে বলে,
“প্লিজ!”
সিনান অনার দিকে তাঁকিয়ে একটি ফোস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে গাড়ি চালু দেয়। প্রথি দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সেই গাড়িটি যতক্ষণ না তা চোখের আড়াল হয়। অনার উপর একগুচ্ছ রাগ নিয়ে একটি রিকশা ডেকে মেহজাদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যেহেতু অনা নিজে থেকে গেছে নিজেই ফিরবে। আজ অনাকে হাতের কাছে পেলে সে অনার তাজা খবর ছাপিয়ে তবেই ছাড়বে। এই পণ করেই সে আকাশের পানে তাঁকায়। আজ এমন কাঠফাটা রোদ কেন? ইশ! ঘামে ভিজেও একাকার অবস্থা! বদমাইশ অনাটা নিশ্চয় এসির ঠান্ডা বাতাস খেতে খেতে যাচ্ছে!
সিনান একমনে ড্রাইভ করেই চলেছে। গন্তব্য জানা নেই তার। শুধু ড্রাইভ করতে হবে এটাই বুঝে গেছে। অনা এক ধ্যানে সিনানের দিকে তাঁকিয়ে আছে। লম্বা, বলিষ্ঠ শরীর তার সাথে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণটা যেন চোখ ধাধানো সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। অথচ দেখ? এই পুরুষটাই কতটা নিকৃষ্ট! এই সেই পুরুষ যে কিনা কাল রাতে তার অচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল। আচ্ছা! আসলেই কী সে এমন কিছু করেছে? কই! তাকে দেখলে তো এমন মনে হয়না!
“চোখ দিয়ে এভাবে গিলে খাচ্ছো কেন? বেয়াদব মেয়ে।”
সিনানের এমন অপরিচ্ছন্ন কথাতে অনার রাগ বেড়ে যায়। সিনানের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“ছিঃ লজ্জা করেনা আপনার এসব বলতে! আমি চোখ দিয়ে আপনাকে গিলে খাই নাকি আপনি……
গলায় কথা আটকে যায় অনার। চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত বের হতে থাকে। সিনান একটা নির্জন যায়গায় গাড়ির ব্রেক কষে। সিটবেল্টটা খুলে অনার দিকে ঝুকে যায়। অনার চোখের পানি নিজ হাতে মুছে দিয়ে বলে,
“কেঁদে আর কোনো লাভ নেই অনা। সত্যি বলতে আমার ডিএনএ এখন তোমার সর্বত্র বিচরণ করছে। আমি তার জন্য দুঃখীত। আমার কিছু করার ছিল না। আমি তো তোমাকে ওয়ার্ণ করেই ছিলাম। সবই ঠিক ছিল কিন্তু তুমি যখন আমার সামনে নিজ থেকে নিজের নিষিদ্ধ অঙ্গ তুলে ধরেছিলে আমি সত্যিই আর পারিনি নিজেকে আটকে রাখতে। শত হোক! পুরুষ তো! তাও আবার আমার ক্যারেক্টার ঢিলা।”
শেষের কথাটা চোখ টিপ দিয়েই বলে সিনান। এদিকে অনার গা থেকে থেকে কম্পন সৃষ্টি করছে। সিনানের বলা কথাগুলো শুনে তার অন্তরআত্মা যেন নড়ে গিয়েছে। বাবা-মা আর ভাইয়া এসব জানলে সব শেষ হয়ে যাবে। কোন মুখে দাঁড়াবে সে তাদের সামনে! সিনান অনার অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,
“দেখ অনা! আমার কাছে তোমার জন্য একটা বেস্ট অপশন আছে।”
অনা সিনানের দিকে তাঁকায় যার অর্থ “কী?” সিনান অনার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে বলে,
“হয় আমাকে বিয়ে কর নয়তো আমার বউ হয়ে যাও। এ ছাড়া আর কোনো থার্ড অপশন নেই। আর হ্যাঁ! সুইসাইড টাইপ কথা মাথায়ও আনবেনা। যদি আনো তো আমি নিজে তোমাকে শ্যুট করব। সি! আমার কাছে রিভলবার আছে!”
অনা সেদিকে তাঁকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকে অনবরত। কথা বের হয়না মুখ দিয়ে। সিনান সেই অধরে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দেয়। মুহূর্তেই অনা হু হু করে কেঁদে ওঠে। সিনান নিজের সিটে সোজা হয়ে বসে গা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে কাল রাতের স্মৃতি চারণ করে বিড়বিড় করে বলে,
“তুমি খুব বোকা অনা! খুব!”
ক্রন্দনরত অনার কর্ণকুহরে তা পৌঁছায়না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎের কথা মাথায় আসতেই গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার। কিন্তু তা যে অসম্ভব!
#চলবে।
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৪)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
ভর দুপুরে অতিথি এলে চা নাশতার আয়োজন করাটা এক প্রকার বোকামি। ভারী খাবারই খাওয়ার নিয়ম তখন। মেহজা চা কফি না দিয়ে ঈশিতাকে সোজা ভাত খেতে ডাইনিং এ এনে বসিয়ে দেয়। ইরফানও ফ্রেশ হয়ে টেবিলে এসে বসে। ঈশিতার বিপরীতে দুই চেয়ার বাদ দিয়ে বসে। সবার পাতে ভাত বেড়ে দিলে ইরফান মেহজার হাত টেনে ধরে তার পাশেই বসিয়ে দেয়। মেহজাকে সে নিজে ভাত বেড়ে দেয়। ঈশিতার দিকে তাঁকিয়ে অমায়িক হেসে বলে,
“মিস! প্লিজ খাওয়া শুরু করুন। আমি আর কিছুক্ষণই আছি আমাকে অফিসে ফিরতে হবে। আপনি আমি থাকা পর্যন্ত দয়া করে আমাকে আপনার আথিতিয়েতার সুযোগটা দিন।”
ঈশিতা মলিন হেসে মেহজার দিকে তাঁকায়। ছোট বোনটার কপাল আছে বলতে হয়! আচ্ছা আজ যদি সে মেহজাদের ফ্ল্যাটে থাকত সে মেহজার জায়গায় থাকত তাহলে কী তার সাথেই ইরফানের বিয়ে হতো? উহু! হতো না। কারণ ঈশিতা হচ্ছে ঈশিতা আর মেহজা তো মেহজাই। সে যেখানেই থাকত না কেন ইরফানের নজর হয়তো তার দিকেই পড়ত। কারণ সৃষ্টিকর্তা নিজেই জোড়া আগে থেকেই ঠিক করে পাঠিয়ে দেয়। বয়সের ব্যবধান অধিক হলেও তার জোড়া হিসেবে মেহজাই তো ছিল! ঈশিতা ভাবনার সাগরে ডুবে আছে খাবার খাচ্ছেনা তা দেখে ইরফান মাংসের বাটিটা সামনে ঠেলে বলে,
“খাওয়া শুরু করুন মিস ঈশিতা। কোনো প্রকার লজ্জা শরম মাথায় আনবেন না। আমার বউ কিন্তু এত লজ্জা পায়না জানেন। অচেনা পাব্লিককেও সে ভালোই চোখ মারতে জানে।”
ইরফানের বলা শেষের টিপ্পনি কেটে কথাটা মেহজার একটুও হজম হলো না। সে আর কোন পাব্লিককে চোখ মেরেছে? ইরফানের এমন সব কথায় মেহজা প্রতিবারই খুব কষ্ট পায়। লোকটা এমন কেন? একটু ভালো হলে কী হতো? দূষিত পুরষ!
ঈশিতার কাছে না পাওয়া বস্তুটি অত্যন্ত ভালো আর মেহজার কাছে সে অত্যন্ত খারাপ! দূষিত পুরুষ। পৃথিবীটা এমনই হয়তো! আমরা না পাওয়া বস্তুটিকে সবসময় গুরুত্ব দেই আর যেটি পাই তাকে অবহেলা করি। এক্ষেত্রে মেহজা অবহেলা নয় রাগ করেছে বটে। তবে প্রকৃত সত্য তো সেটাই!
“অনা? আমি তোমাকে লাস্টবার বলছি ভেবে দেখ। আমি কিন্তু আর তোমার পিছু ছাড়ছিনা।”
“ছাড়তে বলেছে কে? ঝুলে থাকুন। আমি মুখ বুজে সহ্য করব না কিছু। আমি এক্ষুণি মেহজাকে জানিয়ে দিব। আর ইয়াজিদ ভাইয়ার সাহায্য নিয়ে আপনার মতো শয়তান রেপিস্টকে চরম শাস্তি দিব।”
কথাটা বলেই গাড়ি থেকে নেমে সোজা লিফটের দিকে হাটা ধরে অনা। অনাকে এখানে নিয়ে আসার সময় রাস্তায় আর কোনো কথা বলেনি সিনান। অনা শুধু কেঁদেছিল। তারপর কী বিড়বিড় করছিল সিনান তা পাত্তা দেয়নি। এখন গাড়ি থেকে নেমে সিনান অনাকে আরেকবার মজা করে বলে উপরোক্ত কথাটি। তবে অনার মুখ থেকে এমন জবাবে তার কোনো পতিক্রিয়া দেখা যায়না। সিনানের এই হাসিখুশি মুখ দেখে অনা নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। সিনান শিষ বাজাতে বাজাতে লিফটে উঠে পড়ে অনাকে পাশ কাটিয়ে। অনাও লিফট এর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে তড়িৎ গতিতে তাতে উঠে পড়ে। সিনান আয়নায় এক ধ্যানে তাঁকিয়ে অনাকে দেখছেই। তার আশেপাশে যখন অনা থাকে কেন যেন তখন খুবই ভালো লাগে। অন্যরকম অনুভূতি হয়। অনা সিনানের অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকাকে উপেক্ষা করতে পারেনা। ধমকে বলে,
“শকুন নাকি? নোংরা লোক! এভাবে তাঁকিয়ে কী দেখছেন?”
“তোমাকেই দেখছি।”
“আমি তো জানিই। কিন্তু আমাকে দেখবেন কেন? ঐ যে কর্ণারের সিসিটিভি ক্যামেরাটা আগে দেখুন। উল্টোপাল্টা কিছু করবেন তো ঐখানে রেকর্ড হবে।”
“ওহ তাই?”
“হ্যাঁ।” দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে অনা জবাব দেয়। তৎক্ষণাত সিনান অনার হাত ধরে টেনে এনে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কপালে আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া দেয়। অনা রাগে ফুসে উঠে যেন। সিনানকে এক ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে নেয় সে। মেহজাদের ফ্ল্যাটের সামনে লিফট থামলে সে সিঁড়ি বেয়ে আবার উপরে উঠে যায়। সিনান অবাক হয় খুব। অনা উপরে কেন যাচ্ছে? বাসা কোনটা ভুলে গেল নাকি! হুট করেই মনে হয় অনা ছাদে যেতে পারে। কিছু করে ফেলে যদি! সিনানও পেছন পেছন যায়। অনাকে একটি ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে পড়ে। এটা যতদূর জানে ইয়াজিদদের বাসা। এখানে কেন এসেছে? বিচার দিতে! সিনানের হাসি পায়। মৃদু হেসে সে মেহজাদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিজাম সেই কখন থেকে ফোন করেই চলেছে। ব্যাটার থামাথামি নেই।
——————————————–
মেহজা এখন তার বাসায় যাবে। অনাকে অপেক্ষা করতে বলে সে ইরফানের রুমে এসে তার কলার চেপে ধরে বলে,
“আপনি এসব কী বললেন ঈশু আপুকে? আমি পাব্লিককে চোখ মারি? কাকে মেরেছি বলুন! আপনাকে ছাড়া আর কাকে চোখ মেরেছি?”
ইরফান রেডি হচ্ছিল। হঠাৎ মেহজার আক্রমণে সে ভড়কে যায়। পরে মেহজার মুখে কারণ জেনে সে মুঁচকি হাসে। তারপর বলে,
“আমাকে মারতে পেরেছ যখন তখন অন্য কাউকে মারাটা স্বাভাবিক নয় কি?”
“আপনি জঘন্য।”
“জানি তো।”
ইরফানের এমন ছন্নছাড়া কথা মেহজার রাগ ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। দ্রুত গতিতে পা ফেলে রুম ত্যাগ করে। ইরফান ভেবেছিল বলবে সে আজ আর আসবেনা। মেহজার সেদিকে কোনো আগ্রহই নেই। সে আছে নিজের রাগ অভিমান নিয়ে। ইরফানেরও মেহজার উপর সূক্ষ রাগ জন্ম নিল। এই জন্য সে এমন ইমম্যাচিউড মেয়ে বিয়ে করতে চায়নি। এখন তাকেই সারাজীবন ভুগে যেতে হবে। হয়তো আর কয়েক বছরে সে কিছুটা ম্যাচিউড হবে কিন্তু তাতে কী আর এখনকার সময়টা ফিরে আসবে? কখনোই না!
প্রথি অনা আসার পরে মেহজাদের বাসায় এসে উপস্থিত হয়। কলিংবেল বাজাতে যাবে তখন চোখ যায় অনা আর মেহজার দিকে। মেহজা শাড়ি বদলেছে। থ্রী পিছ পড়া হয়তো অনা সাথে করে নিয়ে গেছে। অনার দিকে তাঁকাতেই সে রেগেমেগে আগুন হয়ে যায়। সামনে গিয়ে অনার চুল টেনে বলে,
“বেয়াদব মেয়ে? কোথায় আর কার সাথে গিয়েছিলি তুই? আমি রাস্তায় নাজেহাল অবস্থায় কঠিন জ্যামে আর ভ্যাবসা গরমে কাহিল হয়ে গেছি। আর তুই বিন্দাস এসি গাড়িতে করে এসেছিস? আই থিঙ্ক তোর বয়ফ্রেন্ড ছিল তাইনা? ছিঃ অনা! আমাদের একবারও জানালিনা!”
মেহজা অবাক হয়ে দুজনকে দেখছে। অনার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁকাতেই সে কেঁদে দেয়। অনার আকস্মিক কান্নায় দুজনেই ভড়কে যায়। এখানে কাঁদার কী আছে? তারা কী তাকে মারবে!
#চলবে।