#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৭)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
প্রথি আর অনা একটি টেবিলে বসে জুস পান করছিল আর অল্প স্বল্প গল্প করছিল। তখনিই তাদের টেবিলে থাকা বাকি দুটো চেয়ার দখল করে নেয় নাজিম আর সিনান। সিনানের মুখই বলে দিচ্ছে এখানে এসে বসায় সে বিরক্ত। তাতে অনা প্রথি ভ্রুক্ষেপ করেনি। দেখেও না দেখার ভান করে নিজেদের মতো গল্প চালিয়ে যায়। সিনানের ভাব এমন মনে হয় যেন তারা তাকে ডেকে এনেছে। যেহেতু নিজ ইচ্ছায় এসেছে তাই মুখটা যেমনিই করে রাখুক তাদের কোনো আগ্রহ নেই সেদিকে। নাজিম কিছুটা হতাশ হয়ে প্রথিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কি ম্যাম! এতো ইগো কেন?”
প্রথি আকস্মিক নিজামের এমন কথায় চোখ বাঁকিয়ে তাকে দেখে নেয়। তারপর জুসে এক সিপ দিয়ে বলে,
“প্রথমত আমি আপনার ম্যাম নই। দ্বিতীয়ত! ইগো দেখাচ্ছি না আমার অরাটাই এমন।”
“চমৎকার কিন্তু।”
“হতে পারে।”
সিনান ওদের আলাপে আর মনোনিবেশ করেনি। প্রথির প্রতি চাপা রাগ জন্মেছে তার। সেই রাগ থেকেই এখন তার মন মেজাজ খারাপ। সিনান পাশের টেবিলে চোখ বুলাতেই দেখে একটা সুন্দর, ঝাকরা চুলের এক যুবক অনাকেই দেখছে। তার চোখে মুখে মুগ্ধতা, যা বলে দিচ্ছে অনাকে তার বেশ মনে ধরেছে। সিনানের ব্যাপারটা খুবই বিরক্তকর লাগে। অনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। তখনিই তার কানে ভেসে আসে নিজাম আর প্রথির আরো কিছু কথা না চাইতেও শুনতে হয় তাকে।
“আপনার নামটা তো বলুন!
“প্রথি, প্রথি মজুমদার।”
নিজাম আহত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বলে,
“সনাতন ধর্মাবলম্বী?”
“না। খাঁটি মুসলিম। কেন? মুসলিমদের মজুমদার নাম শুনেন নি?”
“শুনেছি তবে প্রথি নামটাতেও একটা….
“একটা কী? আর আমি হিন্দু না মুসলিম তা নিয়ে আপনার এতো ইন্টারেস্ট কেন? আপনি নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন না।”
“জ্বি হ্যাঁ হ্যাঁ! বিয়েই তো করতে চাই।”
“পুরান পাগলে ভাত পায়না নতুন পাগলের আমদানি। শুনে রাখুন! আপনাদের মতো লাজ লজ্জাহীন গায়ে পড়া পুরুষদের প্রতি আমার খুব বেশিই এলার্জী। ছ্যাঁচড়া বললেও ছ্যাঁচড়া শব্দটির অপমান হবে। আপনি তার থেকেও দশ মাইল পেছনে।”
নিজাম অবাক দৃষ্টিতে প্রথিকে দেখছে। এমন মেয়ে সে আর কখনোই দেখেনি। দেখতে যতটা নম্র ভদ্র এবং বোকাসোকা ভেতরটায় সে এসবের ধারও ধারেনা যেন! সিনানও কিছুটা চমকিত হয়। তবে প্রথির কথার ধরনে না তার ধর্ম সম্পর্কে জেনে। এতদিন সেও তো তাকে বিধর্মী মনে করেছিল। আজকাল নাম গুলোই এমন যে ছেলে-মেয়ে, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এসবের পার্থক্য ধরা যায়না। এখানেও যেন সে খুব বিরক্ত হলো।
অনা একের পর এক প্রথির শান্ত মস্তিষ্কে করা অপমান গুলো উপভোগ করছে। মেয়েটাকে ধরে একটা চুমো খেতে ইচ্ছা করছে। এবং সে চট করেই প্রথির ডান গালে একটি চুমো খায়। প্রথি বুঝেছে কারণ কী তাই সে মৃদু হাসে। তবে ব্যাপারটা সিনান আর নিজামের কাছে কেমন একটা লাগে। সিনানের প্রথিকে ধরে চড়াতে ইচ্ছা করে। মেয়েটা তার ব্যক্তিগত চুমোতেও ভাগ বসাচ্ছে। ওদের দিকে থেকে মুখ সরিয়ে পাশের টেবিলে আবারও তাঁকায় সে। দেখে সেই সুদর্শন যুবকটি মুখ কুঁচকে আছে। সিনান মনে হয় মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেল। চট করে উঠে গিয়ে সেই ব্যক্তিটির পাশের একটি চেয়ারে বসে পড়ে। নিজামও থমথমে মুখ নিয়ে সে জায়গা ত্যাগ করে। প্রথি আর অনা আবারও গল্পে মশগুল হয়। সিনান সেই সুযোগটিই কাজে লাগায়। হালকা কেশে যুবকটির মনযোগ কাড়ে। ভদ্র যুবক কিছুটা মৃদু হেসে সিনানকে বলে,
“কিছু বলবেন মি.!”
“জ্বি হ্যাঁ! আপনাকে সেই কখন থেকে দেখছি ঐ হোয়াইট ড্রেস পড়া মেয়েটির দিকে তাঁকিয়ে আছেন।”
যুবকটি যেন কিছুটা ঘাবড়ে যায়, মিনমিনে গলায় সিনানকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কি মেয়েটির ভাই?”
সিনান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, দ্রুত গতিতে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে,
“কি যা তা বলছেন! ভাই হতে যাব কেন? রাদিফের ছোট বোনের ফ্রেন্ড হয় এই মেয়েটি। আমি সেই সুবাদেই চিনি তাকে।”
যুবকটি যেন স্বস্তি ফিরে পায়! মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে বলে,
“আসলে মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি রিমির ফুফাতো ভাই অর্ণব!”
“আমি রাদিফ ভাইয়ের ভাই ব্রাদার সিনান।”
“ওহ।”
“যেহেতু মেয়েটিকে আপনার মনে ধরেছে তাই ভদ্রতার খাতিরে আপনাকে একটা সত্য জানিয়ে বড় ভুলের হাত থেকে বাঁচাতে চাই।”
“মানে? কেমন ভুল!”
“ঐ যে মেয়েটি নাম হচ্ছে সুমনা। ও একটা এলবি।”
“হোয়াট! আর ইউ কিডিং!”
“নো! আপনি কী দেখেন নি সে তার পাশে থাকা তার বান্ধবী প্রিয়াকে চুমো খেয়েছে। তারা একে অন্যকে ডেট করছে।”
“আর ইউ শিউর!”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট! দেখেননি আমার ফ্রেন্ড একটু প্রিয়াকে ইমপ্রেস করতে গেছে সে সরাসরি বলে দেয় আই আম লেসবিয়ান এন্ড সুমনা ইজ মাই গার্ল!”
“তাই নাকি!”
“জ্বি হ্যাঁ। আমি মিথ্যে কেন বলব? আমি একজন ভদ্রলোক। মিথ্যা আমায় শোভা পায় আপনিই বলুন!”
“না তো, একদমই না। আজকালকার মর্ডান ছেলে মেয়ে গুলো দুনিয়া ধ্বংস করে ফেলবে দেখছি। এদের তো জাহান্নামের আগুন জ্বালিয়ে ছাই করবে।”
“না না জাহান্নাম পর্যন্ত যাওয়া লাগবেনা। অভিশাপ দিয়ে আপনিও পাপের ভাগীদার হবেন না প্লিজ।”
“থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ্ ব্রাদার। অনেক বড় লজ্জা এবং ভুলের হাত থেকে আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে সবসময়। এই নিন আমার কার্ড একদিন আমার অফিসে আসবেন। গল্প করব অনেক।”
“অবশ্যই।”
মুঁচকি হেসে সিনান কার্ডটি পকেটে পুরে নেয়। অর্ণবও টেবিল ত্যাগ করে যেতে যেতে ছিঃ ছিঃ করছে শুধু। সিনানের খুব হাসি পায় কিন্তু পাশে থাকা রমনীরা দেখে ফেলবে তাই মুখ টিপে রেখে মুখটাই লাল করে ফেলে। অনাকে সে সুমনা বানিয়ে দিয়েছে আর প্রথিকে প্রিয়া যাতে অর্ণব কাউকে ওদের সঠিক নাম বলে ওদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতে না ফেলতে পারে। শিষ বাজাতে বাজাতে সিনান নিজামের কাছে যায়। প্রথমবার কোনো মেয়েকে পটাতে গিয়েছিল সে আর প্রথমবারই কিনা রিজেক্টেড! তাও আবার ভরপুর অপমানে! আহ, কষ্ট।
————————————
চোখ খুলে নিজেকে গাড়িতে আবিষ্কার করে মেহজা। ইরফানকে খোঁজে তার অবচেতন মন, আর পেয়েও যায়। গাড়িতে নেই কিন্তু সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ইরফানের হাতে আইসক্রিম ছিল। যা দেখে লোভ সামলাতে পারেনা মেহজা। গাড়ি থেকে নেমে সোজা ইরফানের সামনে গিয়ে দৌঁড়ায়। ইরফান একটুও চমকিত হয়না বরং মেহজাকে একটি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে,
“উঠে গেছো? নাও ধর!মাত্রই কিনে আনলাম। তাড়াতাড়ি খাও নয়তো গলে যাবে।”
মেহজা ইরফানের হাতে থাকা কোণটি নিজ হাতে নেয় তারপর ইরফানকে বলে,
“আপনি খাবেন না?”
“আমি এতক্ষণ খেয়েছি।”
“এতক্ষণ খেয়েছি মানে?”
“আইসক্রিম নিয়েছি চারটা সব তোমার জন্যই। কিন্তু গরম লাগছিল তাই আমি একটা খাই, খেতে ভালো লাগছিল তাই তিনটাই খেয়ে ফেলেছি। এটাও খেয়ে নিতাম যদি না তুমি চলে আসতে।”
“কি সাংঘাতিক! আপনি আমার তিনটে আইসক্রিম খেয়ে আমায় একটা স্বান্তনা পুরুষ্কার দিচ্ছেন! মিথ্যে বললেন কেন? মাত্র কিনে আনেন নি তারমানে। আরো আগেই কিনেছেন।”
“ঠিক ধরেছ। আমি আরো আগেই কিনেছি।”
“না! আমি একটা খাব না। আরো খাব আপনি আমার গুলো কেন খেয়েছেন?”
“আচ্ছা ফেরার সময় কিনে দিব।”
“আমরা এখন কোথায়?”
“মাঝ রাস্তায়, দেখছ না?”
“এখানে কেন?”
“এমনিই।”
“কমিউনিটি সেন্টারে চলুন। সবাই খোঁজ করছে হয়তো।”
“আইসক্রিম!”
“পরে এক বক্স না না চার বক্স কিনে দিবেন তাহলেই হবে।”
“পেটুক।”
“আপনার মতো।”
ইরফান মুঁচকি হাসে। মেহজ মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয় ইরফানকে সে উচ্চস্বরে হাসতে খুব কমই দেখেছে, উহু! দেখেই নি। এমনিতে তো হাসে না তেমন একটা আর হাসলেও শব্দহীন মুঁচকি হাসি হাসবে। যা সহজেই যেকোনো নারীকে ঘায়েল করতে সক্ষম।
মেহজা আগামীকাল হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছে। রাদিফের বৌভাতের পরদিনই ইরফান তার ফ্ল্যাটে চলে যায়। আজ সাতদিন হতে চলল মেহজা ইরফানকে দেখেনা। মনটা কেমন বিষিয়ে উঠছে বারবার। ব্যাগে জামাকাপড় গুছিয়ে রাখছিল তখনিই অনার কল আসে। রিসিভ করে মোবাইল কানের কাছে আনতেই শুনতে পায় অনা আর্তনাদ করে বলছে,
“মেহজা? আমার আজকে এংগেজমেন্ট! হুট করেই আয়োজন করে ফেলেছে। বাবার মুখের দিকে তাঁকিয়ে না করতে পারছিনা। বিয়েও আমি করতে চাইনা। তুই বল এখন আমি কি করব?”
“বিয়ে করে ফেল।”
“কী! এটা বলতে পারলি?”
“এখনিই তো নিশ্চয় বিয়ে হয়ে যাচ্ছেনা। ইটস্ জাস্ট এন এংগেজমেন্ট।”
“অন্য কেউ হলে করতাম কিন্তু একে তো জীবনেও না।”
“কাকে?”
“ঐ বেয়াদব সিনান।”
“ভালোই তো। মেজর সাহেব! করেই ফেল। ভালোই হবে।”
“ভালো নয় মন্দ হবে। তুই আমার পক্ষে নাকি তার!”
“ভালোবাসার পক্ষে।”
অনাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মেহজা কল কেটে দেয়। বিড়বিড় করে বলল,
“সিনান ভাই পারেও বটে।”
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মেহজার ফোনে একটি মেসেজ আসে। ইরফানের হাস্যজ্জ্বল ছবিটি স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই সে উচ্ছাসিত হয়ে পড়ে। মেসেজটি খুলতেই তার হার্টবিট মিস হয়ে যায় যেন! তার মনে ছিল না কিন্তু ইরফানের মনে আছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে,
“প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর শুভেচ্ছা প্রিয়তমা!”
খুশিতে কান্না করে দেয় মেহজা। তখনিই আরেকটি মেসেজ আসে,
“নিচে আসো,আমি অপেক্ষা করছি।”
এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুট লাগায় সদর দরজার দিকে। রিমিকে দেখতে পেয়ে বলে,
“ভাবি উনি এসেছে আমি গেলাম।”
মেহজার ছটফটানি দেখে রিমি হা হা করে হেসে ওঠে তারপর দরজা লাগিয়ে দেয়।
#চলবে।
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৮)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
একটি বট গাছের নিচে ইরফান মেহজাকে নিয়ে এসেছে। সে ভেবেছিল হয়তো কত শত আয়োজন করে রেখেছে ইরফান। কিন্তু ইরফান তো ইরফানই! সে আগেও তার অনুভূতির দাম দিত না এখনো দেয়না। মেহজা মন খারাপ করে বট গাছের নিচে বসে পড়ে। ইরফানও গাড়ি থেকে তখন একটি কেক নিয়ে আসে যার মধ্যে তার আর মেহজার রাদিফের বিয়ের দিন তোলা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অসাধারণ ছবি। হুট করেই মেহজা যেন সব অভিমান ভুলে গেল একটি কেকই যেন তাকে আনন্দিত করল। তবে ইরফান কিন্তু আদৌও এত ছোট পরিকল্পনা করেনি প্রেয়সীর জন্য। জোরে একটি শিষ বাজাতেই গাছটা আলোকিত হয়ে পড়ে। হরেক রকম রঙিন আলোয় গাছটি উজ্জ্বল করে উঠে। চারিদিকে আতশবাজি ফুটতে থাকে আকাশের বুকে হওয়া স্কাইশট গুলোতে স্পষ্ট লিখা থেকে হ্যাপি এনিভার্সেরী। মেহজার চোখে জল চিকচিক করে, প্রিয় মানুষটি যে তার কল্পনার ঊর্ধ্বে যেতে পারে তা সে ভাবতেই পারেনি। ইরফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। ইরফানও পরম ভালোবাসা মিশিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মেহজার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে এই সেই ইরফান যাকে পাওয়ার জন্য এক সময় সে অনেক পাগলামী করেছিল। আজ সেই ইরফানকে সে পেয়েও গেছে এত আনন্দ সে কোথায় রাখবে এখন? কারো নজর লেগে যাবেনা তো! মেহজা হু হু করে কেঁদে ওঠে। ইরফান তাকে কাঁদতে বাধা দিল না, কাঁদুক না একটু! সুখের সাথে একটু দুঃখ মেশানো অনুভূতি না থাকলে কী হয়?
ইরফানের বাহুডোরে আবদ্ধ মেহজা ইরফানকে আজ মুখে বলেই দিয়েছে ” ভালোবাসি মি. ইয়াজিদ!” পাষণ্ড ইরফান বদৌলতে একটুও ভালোবাসি বলল না তাকে। তাতে অবশ্য মেহজার দুঃখ নেই। আজকাল সে ইরফানের ভালোবাসার গভীরতা উপলদ্ধি করতে পারে। ইরফানের বিরুদ্ধের তার অভিযোগটাও সীমাবদ্ধ বলা চলে। ইরফানকে হুট করেই মেহজা অনুনয়ের সুরে বলে,
“আমার এইচ এস সি পরীক্ষার পর অনুষ্ঠানটা করলে কী খুব সমস্যা হবে?”
“একদমই না।”
“আপনি সত্যি বলছেন।”
“তুমি চাইলে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেই না হয় অফিসিয়ালি আমার ঘরে যেও।”
“না না! এইচ এস সি হলেই হবে। আমার ধৈর্যসীমা খুব কম।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমার তো আছে।”
“আপনি একটা বাজে লোক।”
“তোমারই তো!”
“হ্যাঁ! আপনি শুধুই আমার।”
মুখ উঁচিয়ে কথাটি বলল মেহজা। দেখতে পেল ইরফনের চোখে মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে আছে। আলতো হেসে চোখ বুজে সে।
————————-
সিনান আর অনার আকদ করিয়ে ফেলেছে সবাই। অনার শত বারণ করার পরও তারা কিছু শুনেনি। বর্তমানে অনার রুমে অনার বিছানায় সিনান বসে আছে। অনা তার থেকে এক হাত দূরুত্বে বসে আছে। সিনান নীরবতা ভেঙে বলে,
“কিছু বলবেনা অনা?”
“কি বলব? আর কিছু বলার বাকি আছে আমার! আর এখন কিছু বলেও কি কোনো লাভের লাভ হবে?”
“হবে আবার হবে না।”
“পেচিয়ে কথা বলা মানুষ আমর একদম পছন্দ না।”
“তোমার তো আমিটাকেই পছন্দ না অনা।”
“জানেন যখন বিয়ে করলেন কেন?”
“ভালো লাগে তাই।”
“যা দরকার ছিল তা তো পেয়েই গিয়েছিলেন। কোন ভয়ে এখন আমাকে বিয়ে করছেন? ওহ পুলিশে দিব তাই?”
“উহু! কোনো পুলিশেই আমাকে কিছু করতে পারবেনা। কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি।”
অনা এবার রেগে গিয়ে সিনানের কলার চেপে ধরে বলে,
“সেই রাতে আপনি যা করেছেন তা অন্যায় ছিল না? ঘৃণিত অন্যায় ছিল সেটা, চরম পাপ ছিল সেটা।”
“সেই রাতে কিছুই হয়নি অনা।”
সিনানের আলতো হেসে বলা কথাটি অনার হৃদয়ে শীতলতা এনে দিল যেন। সিনানের কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে কেন তা সে নিজেও জানেনা। তবুও নিজের দাম্ভীকতা বজায় রেখে বলে,
“আপনি মিথ্যে বলছেন।”
“একদম নয়। চাইলে এক্ষুণি প্রমাণ দিতে পারি! দিব?”
“কীসের প্রমাণ?”
“দুটো অপশন আছে। একটা হচ্ছে ছোট খাটো একটি রেকর্ডার আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি শারীরিক…….
“আপনি নোংরা লোক!”
“নোংরা হই বা যাই হয়ে থাকিনা কেন সত্য একটাই তুমি কুমারী আছো।”
এই কথাটি বলেই সিনান তার রুম থেকে প্রস্থান করে। অনা শুধু চেয়ে থাকে অবাক চোখে। তার মন মস্তিষ্ক দুটোই বলছে সিনানকে ভরসা করতে। যদি কিছু হয়েও থাকে তাহলে তো সে নিজেও বুঝতে পারত একটু হলেও। সিনানের গমনের পরই অনার মা এসে তাকে বলল,
“সিনান এমন রেগে বের হলো কেন অনা? কিছু হয়েছে?”
“না।”
“সত্যি বলছিস তো?”
“হ্যাঁ।”
“সিনান কি তোকে বলেছে আজ রাতে মিশনের উদ্দেশ্যে তাকে মিশর যেতে হবে।”
“মিশন? তাও আবার মিশরে!”
“হ্যাঁ তো, তোকে বলেনি কিছু?”
“না বলেনি আমাকে।”
“দুই বছরের জন্য যাচ্ছে শুনলাম।”
“তাই নাকি! ভালোই তো।”
“আরে ভালো না ছাই! শুনেছি এসবে বিপদ থাকে অনেক। কত মানুষ মরেছে। আমার তো ভয় করছেরে।”
“তুমি এখন যাও আমি একটু ঘুমাতে চাই।”
“এই অবেলায় ঘুমাবি কেন? শরীর খারাপ!”
“না, মন!”
অনার মা আসিয়া বেগম বের হয়ে এলেন রুম থেকে। অনার হুট করেই সিনানের জন্য মায়া জন্মালো। কে জানতো এই মায়া গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাবে একদিন!”
————————————————–
“আমাদের বিয়ের তিন বছর পর হুট করেই আমার পেটে ইজহাম চলে আসে। ওর বাবা তো সেই খুশি হয়েছিল কিন্তু মুহূর্তেই আমার ক্যারিয়ারের কথা ভেবে সে চুপসে যায়। তার এত খুশির বলিদান সেদিন আমি দিতে পারিনি। মা হওয়ার মত আনন্দের বিষয়টি আমি সাদরে গ্রহণ করেছি। প্রথম বর্ষের শেষের দিকে ইজহাম হয়। আমার সত্যি বলতে একটুও কষ্ট করতে হয়নি। তার বাবা,ফুফুরা, দাদা-দাদু,নানা-নানু, মামা-মামি সবাই তাকে মহা আনন্দে লালন পালন করেছে। দেখতে দেখতে আমার অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেল। পাড়ি জমালাম সূদুর আমেরিকায়। ইয়াজিদের বিজনেসের কাজটা এখানেও থাকাতে তাকে বছরের ছয়মাস আমেরিকা আর ছয়মাস বাংলাদেশ দৌঁড়াতে হতো। যা খুব কষ্টের ছিল। ততদিনে আমারও মাস্টার্সের জন্য আমেরিকার নাম করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া হয়ে যায়।
এক বছর হলো আমেরিকায় এসেছি। সবাইকে খুব মিস করি। ইরা আপুর সাথে সপ্তাহে একবার দেখা হয়। একদিন হলিডেতে সেও ক্যালিফোর্নিয়ার এই বাড়িটিতে আসে আমাদের সাথে দেখা করতে।
ইয়াজিদ লোকটি আমাকে খুব ভালোবাসে। যদিও যে আজ অব্দি মুখ ফুটে ভালোবাসি বলেনি। অবাক হওয়ার হলেও এটা সত্যি। তবে তার প্রতিটি কাজে প্রমাণ পায় আমাকে আর বাবুকে খুব ভালোবাসে তিনি। আজ আমি খুব খুশি। কারণ আজ আমার আর তার দ্বিতীয় সন্তানের এই পৃথিবীতে আসার সুসংবাদটি আমি জানতে পেরেছি। আর দেখ! লোকটি তা সম্পর্কে মোটেও অবগত না। বাহিরে ছেলের সাথে স্নো ফল নিয়ে খেলায় মত্ত সে। আচ্ছা! দ্বিতীয় জনের আসার খবরে সে কি খুব খুশি হবে? যেমনটি হয়েছিল ইজহামের বেলাতে!”
——- ডায়েরীতে এতটুকু লিখেই হাত থামালো মেহজা। আনন্দে তার শরীর কাঁপছে। পেটে হাত বুলিয়ে ডায়েরীটা লক করে দেয়। আজ সুপার শপে পাসওয়ার্ড সিস্টেম এই সুন্দর ডায়েরীটি দেখে লোভ সামলাতে পারেনা। ফটাফট কিনে নেয়। আজ থেকে সে সব কিছুই এই ডায়েরীতে বন্ধি করে রাখবে বলে মনঃস্থির করেছে।
চেয়ার ছেড়ে বড় জানালাটির পাশে দাঁড়ায়। ছোট্ট টি টেবিলটা থেকে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা কেটলি থেকে ঢেলে নেয়। এক চুমুক দেওয়ার পরই হঠাৎ তার নজরে যায় কেটলির পাশে একটি কাগজ। চায়ের কাপটা শব্দ করে রেখে কাগজটি খুলে বিস্মিত হয় সে, যাতে লেখা আছে,
“ধন্যবাদ প্রিয়তমা! সবকিছুর জন্যই ধন্যবাদ। আমার পরবর্তী সন্তানকে নিজ গর্ভে ধারণ করার জন্য আরো ধন্যবাদ। একদম বিচলিত বা অবাক হবেন না যে আমি জানলাম কীভাবে! আপনি কি এটা জানেন না যে আমি সবদিকেই খেয়াল রাখি! এই মাসের পিরিয়ডটা যে মিস গিয়েছে তা আমি জানি। ডক্টর স্টেইফির কাছ থেকে আজ প্রেগন্যান্সী রিপোর্ট এনেছেন তাও জানি। ধারণা সঠিক! ডক্টর স্টেইফি আপনাকে রিপোর্ট দেওয়ার আগেই আমাকে ইনফর্ম করেছে বেগমজান। সরি টু সে! আপনার সারপ্রাইজটা ভেস্তে গেল। আর শুনুন
“ভালোবাসি খুব”
আমি ভালোবাসি কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারিনা। কারণ আমার গোধূলী আকাশটা লাজুক লাজুক!
আমার আর ইজহামের পক্ষ থেকে লিটল ওয়ানকে অনেক ভালোবাসা।”
মেহজার ঠোঁট প্রশস্ত হয়। এই প্রথম লোকটি ভালোবাসি বলেছে মুখে নয় ঠিকই লিখে তো বলেছে! মেহজা চট করেই সামনে তাঁকায়। তাঁকিয়ে দেখে ইরফান তার দিকেই তাঁকিয়ে আছে মুখে লেগে আছে সেই মুঁচকি হাসি। হঠাৎ তার নজরে গেল পাশে থাকা স্নোম্যানটার দিকে। যার গায়ে মেহজার ওড়না পেচিয়ে রাখা হয়েছে। কপট রাগ দেখিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ইজহাম চেঁচিয়ে বলে,
“মাম্মা!”
এই একটি ডাক আর প্রিয়তমর মুঁচকি হাসি দুটোই তার রাগ বিলীন করে নিমিষেই! মেহজা আকাশের দিকে তাঁকায় সবকিছুর জন্যই মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করে সে।
#চলবে