গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক ২ পর্ব-৩+৪

0
389

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-৩)
সিজন ২
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৫.
মেহজাদের অ্যাপার্টম্যান্টের ছাদ বিরটা বড়। একপাশে একটা মাঝারি আকৃতির সুইমিংপুল আছে। তবে যারা সাঁতার জানেনা তাদের যেতে মানা করা হয়েছে। মেহজা সাঁতার কা’টতে জানে তবে তেমন একটা ভালো করে পারে না। টিউব লাগে, তাছাড়া এখানে একা এসে সাঁতার কা’টাও ঠিক নয়। সাথে কেউ থাকলে ভালো হতো। আফসোস, তার এখনও কোনো সমবয়সী মেয়ের সাথে পরিচয় হয়নি যারা এই বিল্ডিং এ থাকে।

এখন বিকেল সাড়ে চারটা। মেহজা একা একা বসে আছে সুইমিংপুল এর ধারের আরাম কেদারায়। আর দৃষ্টি স্বচ্ছ পানিতে। তখনই তার সামনের ছোট সোফাটায় কেউ একজন এসে বসে। মেহজা চোখ তুলে তাকায় দেখতে পায় সেদিনের মেয়েটি, যাকে ইমা ম্যামদের বাসায় দেখেছে সে। মেহজা এটাও জানে ইনি ইমা ম্যামের ছোট বোন এবং পেশায় একজন ডাক্তার(শিশু বিশেষজ্ঞ)। তবে তার নামটা সে মনে করতে পারছেনা। সৌজন্যতার খাতিরে একটা মৃদু হাসি উপহার দিল। মেয়েটিও হাসে, হাসার সাথে সাথে তার সবকটি দাঁত ঝিলিক মেরে ওঠে। দেখতে সুন্দর লাগে। মেহজা মুগ্ধ হয়। এরা ভাই-বোন সবকয়টা অত্যন্ত সুন্দর তো! মেয়েটি বলল,
-‘মেহজা?’
-‘জ্বি।’
-‘আমি ইকরা। তোমাদের উপর তলায় থাকি।’
-‘জানি আপু। আপনাকে দেখেছি আমি। ইমা ম্যামের বোন।’
-‘উহু। ইমা ম্যাম টানা লাগবেনা। সেই কলেজে গেলেই ছাত্রী-শিক্ষিকা সম্পর্ক এখানে তো আপুই বলতে পারো। আর ম্যামের বোন বলে আমাকে আবার ইগনোর করবেনা।’
-‘না না! ইগনোর করব কেন?’
-‘স্টুডেন্টরা নিজেদের স্যার ম্যামদের সাথে সাথে তাদের আত্মীয়দেরও এড়িয়ে চলে এবং সামনে পড়লে অত্যন্ত সম্মান করে আর ফ্রী হয়ে কথা বলতে পারেনা। আমি চাইছিনা তেমন সম্পর্ক আমাদের হোক। এখানে আমরা প্রতিবেশী এটাই বড় কথা।’

ইকরা নামের মেয়েটিকে মেহজার ভালো লাগল খুব। দেখতেও সুন্দর, কথাও সুন্দর। অতঃপর দুজনে গল্প চালায় বেশ কিছুক্ষণ। ভাব হয় তাদের। ফেসবুকে এড হয় এবং ঠিক করে তারা অতি শীঘ্রই সুইমিংপুলে সাঁতার কা’টবে।

——————-
সন্ধ্যার দিকে ইরফান বাসায় ফিরলে বোনদের আর মা’কে একসাথে বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। সচরাচর কারো সময় মিলে না। বিশেষত ইকরার। আজ হঠাৎ তাকে এই সময় আড্ডায় মশগুল দেখে সে একটু প্রসণ্ণ হলো। তবে সে তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই তাদের আলাপচারিতা বন্ধ হলো। একটু ভাববার বিষয়! সে সোফায় বসে ইমার পাশে। গলা থেকে টাই খুলতে খুলতে প্রশ্ন করে,
-‘কী ব্যাপার? চুপ করে গেলে যে সবাই?’
ইমা বলল,
-‘তেমন কিছু না। তুই ইদানিং দেরি করে ফিরছিস যে!’
-‘দেরি কখন করলাম? আমি বরং এই কয়দিন তাড়াতাড়ি ফিরছি। আগে এগারোটার আগে আসা হতো!’
-‘সেটা তো তুই জানিস কেন এখন এগারোটার আগে আসিস।’
-‘কেন মানে? আপাতত, এখন আর কোনো গোল মিটিংয়ে বসা হয় না। তাই ফিরে আসি। অফিসের বেশকিছু কাজগুলো বাসায় বসে করি। আবার নির্বাচন আসছে সামনে তখন দেখা গেল সপ্তাহে দুদিন আসা হবে কীনা সন্দেহ আছে!’
-‘আচ্ছা?’
-‘হুম।’

ইকরা বলল,
-‘তুই না নিউ ইয়ার্ক যাওয়ার কথা বলছিলি! যাবিনা?’
-‘বড় আপু তো আসছে। আমার আর তাহলে যাওয়ার কী দরকার!’ –কিছুটা গম্ভীর হয়েই বলল কথাটা।

সবাই হা করে গেল। ইরা আসছে অথচ তারা কিছুই জানেনা। ইরফান মা-বোনদের দিকে খেয়াল করে বুঝতে পারে সে বড় একটা স্পয়লার দিয়ে দিয়েছে। ইরা সারপ্রাইজ দিবে বলেছিল অথচ সে কীভাবে কথাটা বলে দিল! আজকাল মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করছেনা। ব্যাপারটা ভালো না। সে উঠে এলো সেখান থেকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবল কাজের চাপে আসলে মাথা কাজ করছেনা। কাল বিশ্রাম নেওয়া যাক!

ওদিকে মাহিমা বেগম কল করে তার বড় মেয়ের কাছে। সবাই আনন্দে, উচ্ছাসিত হয়ে পড়ছে। ইরার কাছে লিস্ট তৈরি করে দিচ্ছে নিজেদের দরকারি জিনিসের। ইরা প্রথমে ইরফানের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে কথা শোনায় পরে সে ও তার আসার ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে থাকে সবাইকে। জানা গেল পরশুদিন আসছে সে। আগামীকাল দশটায় ফ্লাইট। মাঝে প্রায় একটাদিন লাগবে আসতে আসতে। তাদের গ্রুপ কলে তারা তাদের সেজো বোন ইনায়া কেও যোগ করে। ইনায়াকে কড়াকড়ি ভাবে বলে দেওয়া হয় সে যেন কাল চলে আসে। ইনায়া চট্টগ্রাম থাকে স্বামী-সন্তান সহ। বড় বোনের আসার সংবাদ শুনে তার নিজস্ব ব্যস্ততার কথা ভুলে গেল। ঝটফট বলে দিল আগামীকাল আসবে সে। ব্যাস আর কী চাই? সবাই হৈ হুল্লোরে মেতে ওঠে।

৬.
সকাল ছয়টা বাজে। মেহজার মা তাকে ডেকে তোলে ঘুম থেকে। নামায পড়তে বলে তিনি বেরিয়ে যান। মেহজা হেলে দুলে উঠে ফ্রেশ হয়ে, অযু করে নামায পড়ে। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আবহাওয়াটা উপভোগ্য দেখে সে ফটাফট এক কাপ চা নিয়ে আসে। চা বানানো ছিল কেন না তার বাবা-মা ভোরে উঠে নামায পড়ে, চা পান করবে তারপর বাহিরে গিয়ে হেঁটে আসে। সবসময় চা বেশি করে বানিয়ে ফ্ল্যাক্সে রেখে দেয়। যার যখন ইচ্ছা হয় তখন সে নেয়।

মেহজার বারান্দায় পুরোটা গ্রিল নেই। এতে স্বচ্ছ আকাশ ভালোভাবে দেখা যায়। আগের ভাড়া বাসার বারান্দা বন্ধ খাঁচার মত ছিল। আর এটা মুক্ত! আহা!

মেহজার বারান্দায় দুটো বেতের সিঙ্গেল সোফা আছে। এবং সাথেই আছে একটি সেন্টার টেবিল। তার উপর আছে একটা ছোট্ট ক্যাক্টাস গাছ। মেহজার এই গাছটি ভীষণ প্রিয়। সখ করে এনেছে। তবে রাফসান দেখতে পারেনা। কারণ দুইবার তার হাতে কাঁটা ফুটে। মেহজা সেই কথা মনে করেই হেসে দিল। তখনিই বাম পাশে উপরের দিকে চোখ গেল। ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইরফান। বারান্দাটা বেডরুমের নয়। তাদের ফ্যামিলি লিভিং এর। মেহজা এই জায়গাটা ভালো করেই চেনে। ইরফান রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এক মনে আকাশ দেখছে। মেহজা তার দেখাদেখি একবার তাকায় তবে সে বিশেষ কিছু দেখছেনা। রোজকার মতো, তবে সুন্দর। কিন্তু ইরফানের এভাবে চেয়ে থাকাটা আকর্ষণীয় লাগছে। মেহজার মন বলল ইরফান হয়তো কিছু ভাবছে। তবে যাই হোক! লোকটা দেখতে বেশ!

—————–
মেহজার আজ আর পড়তে যেতে ইচ্ছে করছেনা। তাই সে সঠিক সময়ে যায়নি। তবে তার মা কিছুক্ষণ পর পরই এসে বলছে তৈরি হয়ে পড়তে যেতে। ফাঁকিবাজি করলে চলবে না। অগত্যা বহু কষ্টে মনকে প্রথম দিনকার মতো কোনো মতে মানিয়ে ছুট লাগায় উপরতলায়। মনটা ভীষণ খারাপ! তার একদিনও ছুটি নেই কেন? শনিবার হিসেবে কলেজ বন্ধ ছিল কিন্তু এই টিউশনের কোনো বন্ধ হওয়ার নাম গন্ধ নেই। আট-নয় দিনেই হাপিয়ে গেছে সে। বাকি মাস কীভাবে কাটবে?

আজ আর সিঁড়ি ডিঙিয়ে গেল না। লিফট্ এ গেল। তবে অন্যদিনের মতো আজ ইমাদের বাসায় নিরবতা ছিল না। বাচ্চাদের আওয়াজ এবং বেশকিছু গলা শোনা গেল। সে খুশি হয়ে গেল। নিশ্চয়ই মেহমান এসেছে। তবে তো আর পড়তে হবে না! সে উল্টোদিকে হাঁটা ধরে তখনিই পেছন থেকে ভরাট গলায় শোনা যায়,
-‘ইউটার্ন নিচ্ছো যে? আজ পড়বে না!’
মেহজার মনটা বিষিয়ে ওঠে। সে ঘুরে দাঁড়ায়। সদর দরজায় ইরফান দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ঘরোয়া পোশাক কালো টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার। একদম যেন ম্যান ইন ব্ল্যাক! মেহজা মিনমিন করে বলল,
-‘আজকে তো পড়া হবে না তাই চলে যাচ্ছি ভাইয়া।’
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘পড়ানো হবে না কেন? আর না পড়ানো যদি হয় তো বই খাতা নিয়ে এলে কেন? কী! মেজো আপু মানা করে দিল নাকি!’
-‘না সেটা না। আসলে আমিই চলে যাচ্ছি। আপনাদের বাসায় মেহমান তো। তাই ভাবলাম চলে যাই। এখন সমস্যা হতে পারে।’
-‘বেশি বোঝো নাকি? আর মেহমান দেখলে কোথায়? আমার সেজো আপা এসেছে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। তাই শোরগোল হচ্ছে। নাথিং এলস্। ভেতরে যাও তুমি। আপা যেহেতু বারণ করেনি সেহেতু পড়াবে।’

মেহজা চোখমুখ কুঁচকে ভেতরে গেল। এই লোক আস্ত ভেজাল তো! তবে ভেতরে যেতে যেতে সে শুনতে পেল ইরফান বলছে,
-‘ফাঁকিবাজ একটা।’

হাহ! কী অপমান!

#চলবে।

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-৪)
সিজন ২
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৭.
সোফার এক কোণে চুপচাপ বসে আছে মেহজা। দেখে মনে হচ্ছে তার মতো শান্ত মেয়ে বোধ হয় আর একটিও নেই! ইনায়া মেহজার সামনে বরাবর সোফায় বসে আছে। তার পাশে আছেন মাহিমা বেগম। ইমা আর ইকরা কিছুক্ষণ পর পরই রান্নাঘর থেকে এটা সেটা এনে টেবিল ভরিয়ে ফেলছে। মেহজার এই মুহূর্তে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। মাহিমা বেগম বললেন,
-‘মামণি? মন খারাপ নাকি!’
-‘না আন্টি। আসলে আমি তখন থেকে একটা কথা বলতে চাইছি।’
-‘হ্যাঁ বলো। এত সংকোচ কেন?’
-‘আজকে কী ম্যাম পড়াবে না?’
-‘না আজকে পড়ানোর দরকার নেই। আজকে আমরা সবাই গল্প করব।’
-‘গল্প করব?’
-‘হ্যাঁ। আমার তিন মেয়ে আজ সাথে আছে বড়টা ও এখন প্লেনে। আল্লাহ্ চাইলে আগামীকাল সে আসবে।’
-‘ভালো খবর আন্টি।’
-‘হুম। কত বছর পর আসছে!’
-‘কয় বছর হয়েছে আন্টি?’
-‘চার বছর হতে আর দুই মাস বাকি।’
-‘অনেক সময় তো।’
-‘হ্যাঁ মা!’

ইনায়া এতক্ষণে নিরবতা ভঙ্গ করল। মুঁচকি হেসে মায়ের দিকে তাকালো। মা মেয়ে ইশারায় চোখ নাড়াচ্ছে, ইশারাতেই যেন কথা সেড়ে নিচ্ছে। ইনায়া মেহজার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘মেহজা তুমি এইচ এস সি পরীক্ষার্থী?’
-‘জ্বি আপু।’
-‘প্রিপারেশন কেমন? আর বিজ্ঞান বিভাগেই তো?’
-‘জ্বি আপু।’
-‘ভালো। স্বপ্ন কী? কী হতে চাও!’
-‘আমার ইঞ্জিনিয়ার পেশাটা ভালো লাগে। বুয়েটে পড়ার ইচ্ছা।’
-‘তাহলে তো ম্যাথ ভালো পারতে হবে। ম্যাথে কেমন?’

এই প্রশ্নের উত্তরটা ইমা এসে দিল,
-‘ম্যাথে ভালোই। তবে তাড়াহুড়ো করে অতিরিক্ত। যার ফলে সব গুলিয়ে ফেলা তার অভ্যাস।’

মেহজা লজ্জা পেল। চোখ নিচে নামায়। তখনিই শুনতে পায় কেউ বলছে,
-‘তাড়াহুড়ো টা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, প্রায়শই সবার মধ্যে দেখা দেয়। তবে পড়ালেখার ক্ষেত্রে সিরিয়াসনেস প্রয়োজন। যা ওর মধ্যে আছে।’

মেহজা পুনরায় চোখ তুলে তাকায়। ইরফান দাঁড়িয়ে আছে। ইরফানের কথা শুনে ইমা মেহজার দিকে একবার আড়চোখে তাকায়। ইনায়া আর মাহিমা বেগম মুখ টিপেই হাসছেন। ইকরা এলো তার আজকের স্পেশাল ম্যেনু ‘চিকেন রেশমি কাবাব’ নিয়ে। এই খাবারটি সে দুর্দান্ত বানায়। ইরফানের বলা কথা তার কানেও গিয়েছিল। তাই সে বলে,
-‘ওর সিরিয়াসনেস নিয়ে তুই জানলি কীভাবে!’
-‘আমি দেখেছি। সেদিন যখন ওর এক্সাম নিচ্ছিলাম। বাই দ্য ওয়ে! কত পেয়েছিলে?’
কথাটা মেহজাকে বলল। মেহজা কাঁপা গলাতেই বলল,
-‘৪৯’
-‘৫০ এ তো?’
-‘জ্বি।’
-‘তোমার দেখছি জ্বি জ্বি করা স্বভাব। অতি ভক্তি আবার চোরের লক্ষণ। জানো তো?’

সবাই হেসে দিল এই কথা শুনে। তবে মেহজা স্তব্ধ হয়ে গেল। আবার অপমান! সে মাত্রই এই লোকটাকে ভালো মানুষ ভাবলো। আজকাল কোনো কিছুর বিশ্বাস নেই। কে কখন বদলে যায়! একটা গান আছে না? ‘সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে’। না না! সম্পর্কের কিছু তো নেই। এখানে মানুষের কথা আর আচরণ বদলে গেল একটি পলকে। তাদের আবার কীসের সম্পর্ক!

ইমা চেয়েছিল মেহজাকে পড়াতে তবে ইনায়া আর ইকরা জোর করেছে আজ যেন না পড়ায়। তারা মেহজার সাথে কথা বলবে। প্রতিবেশীরা যেমন বলে। তার পড়ানোর জন্য তাদের সাধারণ প্রতিবেশীর সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ছোট বোনদের এমন কথা শুনে ইমা চোখ পাকায়। তবে তাদের মা যখন সাই দিলেন তখন আর কিছু বলল না। চুপ করে সেও তাদের আড্ডায় বসে।
ইরফান সেই তখনিই নিজের রুমে চলে গেছে। তার নাকি ঘুম প্রয়োজন। মেহজার এই লোকটার প্রতি ভীষণ রাগ জমা হয়েছে। সুযোগ বুঝে ঝারতে হবে।

৮.
রাস্তার এক পাশে দুইটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। গাড়িতে বসা সিনান সেই মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। এর মধ্যে চুল খোলা রাখা মেয়েটিকে দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। জ্যাম কা’টতেই তাদের গাড়ি সামনে অগ্রসর হলো। তবে পেছনের সেই ফেলে আসা মেয়েটিকে সে পুনরায় পেছন ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করল।

পঁচিশ তলা এই বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে সিনান কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। এলাকাটা আভিজাত্যে মোড়া। চারিদিকেই কেমন বড়লোকি ভাব। নিজামের ফুপি এই বিল্ডিং এ থাকেন। সে এসেছে নিজামের সাথে। নিজাম তার ফুপিকে তাল দিতে এসেছে। তাল দিয়েই চলে আসবে নাকি। তাই সিনান ঠিক করল বাহিরেই অপেক্ষা করবে। নিজামের জোরাজুরিতেও যায়নি।

নিজাম চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই সেখানে একটি রিকশা এসে থামে। সিনান ভালো করে দেখে সেই মেয়েটি! তার মানে মেয়েটি হয়তো এই খানেই থাকে। মেয়েগুলো সোজা ভেতরে চলে গেল। নাম এন্ট্রি করে লিফট্ ধরে। সিনান নিজামের সাথেই ছিল একসাথে নাম এন্ট্রি করা পর্যন্ত সে তার পাশেই ছিল। পরবর্তীতে সে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। তাই এখন যখন সে ভেতরে আবার ঢোকে রিসিপশন থেকে তাকে আর কিছু বলা হলো না। সে সোজা লিফট্ এ গিয়ে ওঠে। খোলা চুলের সেই মেয়েটি বাবল গাম চিবোচ্ছে বোধ হয়! একটা ঘ্রাণ আসছে।

সে চুপ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। তখনিই পাশে থাকা মেয়েটি বলল,
-‘কী ভাই? কোনো সমস্যা?’
সিনান ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘সমস্যা হবে কেন?’
-‘না মানে আপনি আমার বান্ধবীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যা অশোভন লাগছে।’
-‘আমি বাজে দৃষ্টি দিচ্ছিনা।’
সেই মেয়েটিও এবার তার দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে। মেয়েটি বলল,
-‘আপনার আমার দিকে তাকানোটা আমার সহ্য হচ্ছে না। তাই দয়া করে অন্যদিকে তাকান।’
-‘আশ্চর্য! আপনাকে দেখছি যে সেটা কে বলল? আমি তো মিররে নিজেকে দেখছি। আপনারা কী একটু বেশিই ভাবছেন না?’
-‘ফাইজলামি পেয়েছেন? আপনি মিররে নিজেকে দেখছিলেন!’
-‘তাই তো!’
-‘মিথ্যে বলবেন না একদম। অসভ্য লোক।’
-‘কী! অসভ্য! আমি?’
-‘তা নয়তো কী? আর আপনি কোন ফ্লোরে যাবেন? বাটন ক্লিক করেন নি তো।’
সিনান একবার বাটন গুলো দেখে বলল,
-‘ওই ফ্লোরেই যাচ্ছি।’
-‘আচ্ছা তাই?’
-‘বলুন তো কার বাসা?’
-‘আমার বন্ধুর রিলেটিভস্।’
-‘বন্ধুর রিলেটিভস্ এর বাসায় আপনার কী দরকার?’
-‘আমার বন্ধু সেখানে আছে তাই।’
-‘মিথ্যাবাদী।’
-‘আচ্ছা দেখা যাক।’

আঠারো তলায় যখন তারা নামে তখন ফ্ল্যাট নম্বর A2 এর দরজার সামনেই সিনান নিজাম কে দেখতে পায়। ভাগ্যিস তখন ফ্লোর নম্বর দেখে নেয়। নাহলে এই মেয়েগুলো বেইজ্জতি করে দিত আজ।
নিজাম সিনানকে দেখে বলল,
-‘কী ভায়া! তখন যে এলে না। এখন কেন এসেছ?’
-‘তোর দেরি হচ্ছিল তাই দেখতে এলাম।’
-‘তাই নাকি? কিন্তু আমার দেরি হয়নি এই যে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।’
-‘তাড়াতাড়ি আয়।’

দুজন সামনের দিকে অগ্রসর হতেই একটা ডাক পেছন থেকে ভেসে আসে।
-‘নিজাম ভাইয়া!’
নিজাম পেছন ফিরে দেখল উপর তলার সিঁড়ি ডিঙিয়ে মেহজা নেমে আসছে। এসেই সে বলল,
-‘কখন এলে? আরে সিনান ভাইয়াও যে!’
সিনান মৃদু হাসে। মেহজাকে সে চেনে আরো আগে থেকে। নিজামদের বাড়িতে পরিচয় হয়েছিল। সিনান বলল,
-‘এসেছি মিনিট ছয় কী সাত হবে। বেশিও হতে পারে। সঠিক জানিনা।’

মেহজা এবার তাদের দুজনের পেছনে থাকা দুইটি মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে। একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে,
-‘তোরা! কখন এসেছিস?’

বেনুনী করা মেয়েটি বলল,
-‘মাত্রই।’
-‘তোরা যে আসবি বললি না তো!’
-‘বলার কী আছে? ইচ্ছে হয়েছে এসেছি।’
-‘আমি তো ম্যামের কাছে পড়তে গিয়েছিলাম। আজ পড়ায়নি তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম। অন্য সময় হলে বসে থাকতি। সময় শেষ হয়না এমন মনে হতো। তা ভাইয়ারা! বাসায় যাবেন না?’

নিজাম বলল,
-‘না না আজকে কাজ আছে ফুপিকে বলছি পরে আসব।’
-‘সিনান ভাইয়া প্রথমবার এসেছেন। একটু কিছু খেয়ে যান। ছয় সাত মিনিটে নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া হয়নি।’
-‘আসলে আমরা একটু দরকারি কাজে যাচ্ছি। নেক্সট টাইম এসে খেয়ে যাব। আজ নয়। ঠিক আছে!’
-‘আসবেন কিন্তু।’
-‘অবশ্যই। ভালো থেকো।’

দুজনেই চলে গেল। মেহজা তার দুই বান্ধবী প্রথি আর অনাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। যেই মেয়েটির দিকে সিনান তাকিয়েছিল সে হচ্ছে অনা আর যে অনার সাথে আছে সে হলো প্রথি। মেহজা, অনা, প্রথি সবাই বেস্টফ্রেন্ড। সিনানরা যেতেই অনা বলল,
-‘তুই ওই বিটলাকে আবার আসতে বললি কেন? আর কী হয় ও তোদের?’
-‘নিজাম ভাইকে দেখলি না! আমার মামাতো ভাই। তার বন্ধু হলো সিনান ভাই। একেবারে তাদের গলায় গলায় ভাব। আমাদের চেয়েও বেশি।’
-‘বাব্বাহ!’
অনার কথাটা অবজ্ঞার স্বরে ছিল। মেহজা তা স্পষ্ট খেয়াল করে। সে বলল,
-‘সিনান ভাই ভালো মানুষ। আমি চিনি তাকে। পেশায় একজন মেজর। আমার জানা মতে, তার আচরণ অসংলগ্ন নয়। তুই কেন তার উপর বিরক্ত? কারণ কী!’
প্রথি বলল,
-‘চল আমি বলছি সবটা।’

তিনজন বাসায় ঢোকে। তারপর তখনকার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে। তবে মেহজা তাদের আশ্বস্ত করে তেমন কিছু নয়। মানুষটা ভালো। তবে অনার মোটেও তাকে ভালো মানুষ লাগেনি। তার ছোট খালামণি একদিন বলেছিল,
-‘শোন অনা!আর্মির চরিত্রের ঠিক নেই। যত পারিস দূরে থাকিস।’
অনা তখন এইটে পড়ে। সে অবাক হয়ে বলেছিল,
-‘কেন খালামণি?’
-‘আমি একটার সাথে ঘর করি তো তাই বুঝি।’
অনা সেদিন হেসেছিল। তবে তার ছোট খালু খারাপ নয়। মানুষটা রসিক স্বভাবের। সবার সাথে মজা করে। তার খালামণি সেটাকে সহ্য করতে পারেনা। তাই ডিরেক্ট তার চরিত্রে নি’শা’না করে।
তবে এই লোক বদমাইশ। এই ব্যাটা বদ। সে স্পষ্ট দেখেছে মিররে এই লোক তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মনে মনে গা’লি দিয়ে বলল, ‘লুইচ্চা!’

৯.
আজ কলেজ শেষে আইসিটি স্যারের প্রাইভেট পড়ে মেহজা বড় রাস্তা ধরে হেঁটে আসছিল। অন্য সময় রিকশা থাকে আজ আশেপাশে রিকশা নেই। যাও দুই একটা পেয়েছে তারা যাবেনা। রাস্তায় নাকি কীসের গ্যা’ঞ্জা’ম লেগেছে। তাই সে আর শুধু শুধু দাঁড়িয়ে না থেকে পা চালায়। মোড়ের মাথায় আসতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কপাল থেকে এক ফোঁটা ঘাম গালে গড়িয়ে পড়ে। এক দল ছেলে দৌঁড়ে আসছে এই দিকে। সবার হাতে হকি স্টিক, ইট, পাথর, লাঠি, কারো হাতে জ্ব’লন্ত মশাল। মেহজার পা নড়ছে না। সে দিশেহারা হয়ে ওঠছে। কী করবে! সামনে অবশ্য ভাঙচুর শুরু হয়েছে। রাস্তায় টায়ার বিছিয়ে আ’গু’ন জ্বালিয়ে দিয়েছে। মেহজা যে উল্টোদিকে চলে যাবে সেই চিন্তাও মাথায় আসছেনা। তবে এই মুহূর্তে তার গা গুলিয়ে আসছে। বাম পাশের রাস্তা থেকে আরো কিছু ছেলে এগিয়ে এলো তাদের হাতেও নানান মা’রপি’ট করার সামগ্রী। দুই দল হঠাৎ করেই ঝগড়া ঝাটি শুরু করে। তারপর শুরু হয় মা’রা’মা’রি। মেহজার চোখ মুখ শুকিয়ে আসছে। শনিবার দিন তাই এদিকের দোকান গুলোও বন্ধ। হঠাৎ কয়েকটা ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসে। সে এবার উল্টো দিকে দৌঁড় লাগায়। ছেলেগুলো এবার সমান গতিতে দৌঁড়ায়। অর্ধেক যেতে না যেতেই তারা সামনে এসে পথ আটকায়। মেহজা কেঁদেই দিবে এমন অবস্থা। ছেলেগুলো মধ্যে লম্বা, সুঠামদেহী ছেলেটি বলল,
-‘আপু তুমি এইদিকে কেন এসেছ? বাসা কোথায়!’
ছেলেটার কথা শুনে মেহজার কেন যেন একটু স্বস্তি মিলল। সে বলল,
-‘রজনীগন্ধ্যা কলণীর আমি।’
-‘এই দিকের রাস্তা তো ব্লক হয়ে গেছে। যেতে পারবেনা। আর রজনীগন্ধ্যা বললে না! আমাদের ভাই ও ওই কলণীর। আমরা ভাইকে কল করছি। দেখি কি করা যায়! তবে তুমি ততক্ষণে বড় রাস্তায় ফিরে যাও। এদিকে এসো না। আর সাবধান থাকবে, বড় রাস্তায় ও যেকোনো মুহূর্তে ওরা চলে আসবে।’

মেহজা দ্রুত গতিতে পা চালায়। বড় রাস্তায় উঠতে হবে। তাড়াতাড়ি! মেহজার পা রীতিমত ভ’য়ে কাঁপছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে। চোখেও পানি টলমল করছে। কী হবে! গতবার তাদের ক্লাসের শ্রাবণী এমন হ’র’তা’লের কবলে পড়েছিল। সেই যে শ্রাবণী তার এক চোখ হারিয়েছে! আ’গু’নের গো’লা এসে তার মুখের উপর পড়েছিল। ইশ! কী য’ন্ত্র’নাদায়ক ছিল।

বড় রাস্তায় আসতেই দেখে এখানে ও মোড়ের মাথায় যেমন অবস্থা ছিল তেমনই। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। অনুভূতি শূন্য হয়ে সে ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। তখনই তার সামনে একটা মার্সডিজ কার এসে জোরে ব্রেক কষে। সে আকস্মিক ভয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ভেতর থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে ওঠে,
-‘উঠে এসো। জলদি!’
মেহজা চকিত নয়নে সেদিকে তাকায়। দেখে ইরফান ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। মেহজা তখনও দাঁড়িয়েই আছে। ইরফান এবার রেগে গেল। সে গাড়ি থেকে নেমে এপাশের দরজা খুলে একপ্রকার ঠেলে মেহজাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। তারপর নিজেও উঠে পড়ে। সামনের পুরোনো সেই কলেজ রোড দিয়ে ধুলো উড়িয়ে সাই সাই করে ড্রাইভ করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে যায়।

মেহজা ওই রক্তিম, শক্ত মুখভঙ্গির পুরুষের দিকে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। দুপুরের শেষ ভাগের এই রোদটা এসে দুজনের মুখেই ঝাপটা দেয়। এই সুন্দর লালচে কমলা রোদে গৌড় বর্ণের ইরফানকে দেখতে এত আকর্ষণীয় লাগছিল! মেহজার চোখই সরছিল না। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এখন তার ভ’য়ে বুক কাঁপছেনা
কাঁপছে এই গম্ভীর, সুদর্শন পুরুষের পাশে বসে থাকার কারণে।

#চলবে।