#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১০
রোদের তীব্রতা আজ খুবই প্রখর। নায়ীব দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় সড় এপার্টমেন্টের সামনে। জিহাদও পাশে দাঁড়ানো। এখানের আট তলার ছাদ থেকে ছেলেটা লাফ দিয়েছে। রাত তখন দশটার কাছাকাছি। ওত গভীর রাত হয়নি বলে তাকে মানুষ দেখেছে সঙ্গে সঙ্গেই, তবে মৃ ত্যু হাসপাতালে যাওয়ার আগেই হয়েছে। সিঁড়িতে সিসিটিভি আছে। দেখাই যাচ্ছে স্পষ্টরুপে, সেসময় আর কেউ ছাদে যায়নি। এটা যে খু*ন তা কোনোভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব না। খু*ন যদি প্রমাণই না হয়, তবে খু*নি খোঁজার মানে আছে? সব প্রমাণ, যুক্তি দেখিয়ে কেসটা ডিসমিস করেছে ওরা। তবে এম.পি মহোদয় নায়ীবের কাজে ওত সন্তুষ্ট কি না বোঝা গেলনা। এপার্টমেন্ট থেকে নামছেন তিনি। সঙ্গে ম্যানেজার, বডিগার্ড! আরও একজনকেও দেখা গেল। তবে তার সঙ্গে এম.পি মহোদয়ের কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। সে তার মেয়ে, রায়া। এম.পি রাজিব হোসেনের একমাত্র মেয়ে।
রাজিব হোসেন হাঁটতে হাঁটতে এগোলেন। রাজনীতি জীবনে কত শত দুঃখ চাপা দিয়ে এসেছেন! পায়ে পিষেছেন কত মানুষের আহাজারি! রাজনীতি মানে তো এসবই। নিজের স্বার্থটাই আগে। যে মা রা গেছে সে তার ভাগ্নে হয়। র ক্তের না হলেও, তার মা কোনো না কোনো ভাবে রাজিব সাহেবের বোন। বিয়ের অনেক বছর মা হয়েছিলেন। ছেলেটাকে তাই ভালোবাসতেন অনেক বেশি। তাই রাজিব সাহেবের কাছে এত আর্জি করেছেন যাতে কেসটা ঠিকঠাক ভাবে পরিচালিত হয়!
নায়ীবের চোখে কালো সানগ্লাস। মুখে ক্ষীন হাসি। রাজিব সাহেবকে বড্ড চিন্তিত দেখাচ্ছে। কি কারণে কে জানে! তাতে ওর কিই বা যায় আসে। লোকটা বড্ড অহংকারি। জিহাদ আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে, নায়ীবের এসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পছন্দ না। কেসের কারণ ছাড়া সে খুব একটা এদের স্মরণাপন্ন হয়না!
রায়া চোখ ঘুরালো এদিক সেদিক। রোদ সরাসরি চোখে এসে পড়ছে। চোখ কুঁচকে সে মিটমিটিয়ে তাকাল সামনে। পুলিশরা এখানো দাঁড়ানো এখানে! তবে মুখ্য একজনই! ইয়াকীন! নেমপ্লেটের অক্ষর গুলো চোখে লাগলো খুব। নামের চেয়েও আরো বেশি চোখে লাগল তার ঠোঁটের কোণের সুমিষ্ট হাসি। এমন সূক্ষ্ণ হাসি কেউ হাসে? হাসলে হাসবে বড় করে! তবে মন্দ লাগছেনা। রায়া চোখ সামান্য কুঁচকেই তাকিয়ে রয়।
“ হাও আর ইয়্যু ইয়াং ম্যান?”
“ আ’ম এবসোলিউটলি ফাইন, স্যার!”
নায়ীবের কণ্ঠ স্বাভাবিক। তবে মস্তিষ্কে চলছে অন্য ভাবনা। এত ভালো ব্যবহার এসব লোকের থেকে তো আশা করা যায়না!
রাজিব হাসলেন। কাঁধের নিকট হাত রাখতেই সামান্য ঘাড় ঘুরালো নায়ীব। চশমার আড়াল হতে তীক্ষ্ণ চোখে হাতটায় তাকিয়ে আবার মাথা সোজা করল ও।
“ তোমার পদে আগে যারা ছিল, ওরা মাসে দুবার হলেও আমার সঙ্গে দেখা করে যেত! আর তোমাকে তো ধরাই যায়না। এত কেস সামলাও নাকি?”
খোঁ চাটা ধরতে পারল নায়ীব। তবে দাঁতে দাঁত পি ষে নিজেকে সংবরণ করল। বলল,
“ জ্বি, ইদানীং খুব কাজ থাকে।”
“ হুম, ভালো। দেশের সেবা করো, মাঝেমধ্যে দোয়া নিয়ে যেও।”
রাজিব সাহেব হাঁটা ধরলেন। পিছু পিছু তার চ্যালারাও ছুটলো। রায়া অবাক চোখে বাবাকে দেখে গেল। বাবার ব্যবহারটা এত অদ্ভুত কেন?
ওরা চোখের আড়াল হতেই জিহাদকে নিয়ে গাড়িতে উঠল নায়ীব। গজগজ করতে করতে সামনের খালি অংশে সানগ্লাস ছুঁড়ে ফেলল। জিহাদ গাড়ি স্টার্ট দেয়। আড়চোখে নায়ীবকে খেয়াল করে। গজগজ করতে করতে সে বলছে,
“ শা!লার দোয়া নাকি আমার লাগবে! অসহ্য! এই স্পীড বাড়াও জিহাদ!”
জিহাদ তৎক্ষনাৎ স্পীড বাড়ালো। তবে মুখ বাঁকিয়ে হাসতে ভুললনা।
…
গ্রামে সাঈম সাহেবের একটা আলাদা সম্মান আছে। চেয়ারম্যানের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম তিনি। জয়পুর বিশাল বড় গ্রাম। দুটো দিক বিভক্ত করেছে একটা ছোট্ট নদী। সাঈম সাহেবের দোতলা বাড়িটা নদীর ব্রিজের কাছেই। এপার-ওপার, দুপারই কাছে বলা চলে। সাঈম সাহেবের বিশালাকার বাড়িটায় তার একমাত্র ভাই; সাহিদ সাহেবও থাকেন। দুই ভাই-ই রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত। গ্রামের সবার ধারণা, সাঈম সাহেব চেয়ারম্যানের আসন ছাড়লে সাহিদ সাহেব দীর্ঘ সময়ের জন্য তা আঁকড়ে ধরবেন।
খাবার টেবিলে আলাপচারিতা চলছে। বাড়ির পুরুষেরা বসা চেয়ারগুলোয়। কয়েকটা চেয়ার খালিও। সাঈম সাহেব আর সাহিদ সাহেব দুই মাথার চেয়ারে বসা। সুহাদ, সাহিদ সাহেবের ছেলে ইফাদ, ইনানও বসা। সঙ্গে বসা বাইরের ক’জন মানুষ। আশা কাজের লোকদের দিয়ে খাবার একে একে টেবিলে পাঠালেন। বাটি রাখার ক্ষণে শব্দ করেই রাখছেন তিনি। বাইরের খাবার রুম থেকে শোনা যাচ্ছে সে শব্দ। বাকিরা খেয়াল না করলেও সাঈম সাহেব খেয়াল করলেন তা। এসবের মানেও তিনি বুঝেন। রোজ রোজ বাইরের লোক ঘরে আনা আশার পছন্দ না। আশা স্বামীর মুখের উপর কিছু না বললেও মাঝেমধ্যে রাগ করে এটা-সেটা করে ফেলেন। সাঈম সাহেব তা দক্ষতার সঙ্গে সামলে আসেন। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবনে তিনি গম্ভীর প্রকৃতির সেটা সবাই জানে। ভদ্রলোক খুবই কম কথা বলেন। বউয়ের সাথেও তাই। বিয়ের প্রথম প্রথম আশা ভয় পেলেও এখন ভয় কেটে গেছে। সম্মান করেন বলে মুখের ওপর কিছু বলতে পারেননা, এসব যে আশার স্বভাব বিরোধী!
সাঈম সাহেব খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। বাইরের লোক বলতে দলের কিছুসংখ্যক পুরোনো ব্যক্তিবর্গ, এই যা! এইযে, আজ দুজন বসেছে। বয়সে তারা সাঈম রহমানের সঙ্গেরই। সাঈম সাহেব জোর করেই এদের খেতে বসিয়েছেন। অতিথি আপ্যায়নে কমতি রাখেন না তিনি।
হঠাৎ একজন খাওয়ার মাঝে বলে উঠলেন,
“ তা, সুহাদ বাবা! ব্যবসার কাজ কেমন চলে?”
সুহাদ খেতে খেতে জবাব দিল,
“ ভালোই চলে,চাচা।”
“ ভালো হলেই ভালো। তোমরা দুজনও কি ব্যবসা করবা? নাকি বাপ-চাচাদের দিক অনুসরণ করবা?”
শেষের প্রশ্নটা ইফাদ আর ইনানের দিকে ছুঁড়া। ইফাদ বড়, এবার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ বর্ষে,ছুটি কাটাতে এসেছে। ইনান, ক্লাস টেনে। খেতে খেতে হা করে তাকাল ইনান। বড়ই জটিল প্রশ্ন করেছে এই লোক! চাচার পর বাবা চেয়ার দখল করলে আরো ক’বছর অপেক্ষা করতে হবে! তারপর সুহাদ ভাই যদি সুযোগ লুফে নেয়! এরপর আবার সিরিয়ালে ইফাদও আছে। তার সুযোগ আসতে বহু দেরী! কয় যুগ লাগবে কে জানে!
তার ভাবনার মধ্যেই ইফাদ জবাব দিল,
“ চাচা, আমি এসবে নেই। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেই চাকরি ধরব!”
“ নিজেদের ব্যবসা রেখে চাকরি?”
ভদ্রলোক নাক কুঁচকালেন।
সাঈম রহমান গম্ভীর গলায় বললেন,
“ ওদের যা ইচ্ছা হবে, তা-ই করুক। পড়াশোনাকেও কাজে লাগাক, নিজের যোগ্যতা যাচাই করুক।”
ইফাদ বড্ড খুশি হলো চাচার জবাবে। ভদ্রলোক এবার ফিরলেন ইনানের দিকে। ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি বাবা? তুমি কি হবা?”
ইনান চারদিকে তাকায়। মায়ের ইচ্ছা সে ডাক্তার হবে। বাবার তেমন কিছুই ইচ্ছা নেই তাকে নিয়ে। টেনেটুনে পাশ করা ইনানকে নিয়ে নাকি ইচ্ছা পোষণ করতে সাহিদ সাহেব লজ্জা পান! এত বড় কথা তিনি প্রি টেস্টের রেজাল্টের দিন বলেছিলেন। ইনান মাথা নুইয়ে জবাব দিল,
“ দেখি, চাচা! অনেক দেরি এগুলোর।”
ভদ্রলোক থেমে থাকলেন না। আরও জিজ্ঞেস করলেন,
“ আপনার মেয়ে কেমন আছে, ভাইজান? শহরে সহিসালামতে আছে তো?
“ আল্লাহর রহমতে, ভালোই আছে। আর এক দুই বছর, এরপর ওর পড়াশোনা শেষ।”
“ বিয়ে শাদি দিবেন না? হাতে তো কত ভালো ভালো পাত্র আছে আপনার!”
“ সময় হোক, দিব।”
রান্নাঘর থেকে কান পেতে আছেন ইমা। এসব কথোপকথন শুনে তিনি আশার দিকে চাইলেন। আশা গোমড়া মুখে সবজি কাটছেন। রাতের রান্নার আয়োজন এখনই শুরু করেছেন! ইমা কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ আপা! ভাইজান কি স্রোতের জন্য পাত্র ঠিক করে রেখেছেন?”
“ না তো! আমাকে তো বলেননি কিছুই!”
“ খাবার ঘরে যে শুনলাম..”
আশার ললাটে গুটি খানেক ভাঁজ পড়ে। সবজি কাটায় সামান্য বিরতি নিয়ে বলেন,
“ আচ্ছা, জিজ্ঞেস করবো দেখব পরে।”
…
স্রোতের ফাইনাল এক্সামের ডেট ঠিক হয়েছে। হাতে সময় ওতো নেই। সারাদিন ভার্সিটি শেষ করার পর, বিকালে আবার জোহাকে পড়িয়ে রাতের সময়টুকুই হাতে পায় স্রোত। শুভ্রা টিউশন করায়না। তাই ধুমিয়ে পড়ছে। স্রোত তাই বলে এসেছে জোহাকে পরীক্ষা শেষে পড়াবে। আর গ্যাপ থাকলে এক দুইদিন পড়া দেখিয়ে আসবে। জোহার মা আপত্তি করেননি।
…
নায়ীবের আস্ত সিগা রেটের প্যাকেটটা শেষের পথে। আগে এক প্যাকেট সে অনায়াসে এক সপ্তাহে খেত। খুব কমই খেত। ইদানীং এসবে একটু বেশিই ঝুঁকে পড়ছে। এই যে, রাতে ছাদে আসার একদমই ইচ্ছা করতনা আগে। অথচ এখন! ক্লান্ত শরীর টেনে সে চুপিচুপি এসেছে ছাদে.. তাও এই ছাইপাঁশটা খাবে বলে! সেদিন টং দোকান থেকে প্যাকেট নিয়ে বেরোনোর সময় স্রোত কেমন বাঁকা নজরে দেখছিল তাকে। দৃষ্টি দু’টো ছিল বড়ই কঠোর। যেন নায়ীব কোনো ঘোর অন্যায় করছে। মেয়েটা দেখতে অপরুপ। রুপ যদিও নায়ীবকে ওতো টানেনা। মেয়েটার বাচনভঙ্গি চমৎকার। গুছিয়ে, নরম গলায় কেমন কঠিন কথা বলে!
জিহাদের সঙ্গে প্রথম দিন কেমন তেজ দেখাল! এরপর নতুন স্রোতকে দেখল নায়ীব। নাবিদ সাহেব, নিশাত, জোহার সঙ্গে সে যেন অন্য আরেক কোনো স্রোত। কি মিষ্টি মিষ্টি মুখ করে কথা বলে! সামান্য কথায়ই ঠোঁট এলিয়ে হাসে! নায়ীব খেয়াল করে খুব। মস্তিষ্ক ‘অন্যায়’ বললেও হৃদয় ক্রমশ ঝুঁকে যাচ্ছে।
নায়ীব যে আগে প্রেম করেনি, তা নয়! স্কুল লাইফে তার একজন তথাকথিত ক্রাশ ছিল। এরপর চিঠি আদান প্রদানও হলো। কিন্তু মেয়েটা শেষে এসে জানাল, নায়ীবকে নিয়ে সে বিশেষ কিছুই ফিল করেনা। অথচ তার স্বাভাবিক কথাবার্তা, চালচলন, হাসি-ঠাট্টায় নায়ীবের মনে বাটারফ্লাই ফিলিংস আসতো। নায়ীব ওতটাও ইমম্যাচিউর ছিলনা! সে জানে, মেয়েটা দীর্ঘ ছয়মাস তার সঙ্গে ছলনা করেছে। মানুষ চিনতে সে বড্ড কাচা- এটা বুঝেছে সে এই ইন্সিডেন্টের পরই।
নায়ীব মাথা ঝাড়া দিল। এসব সে ভাবছে কেন কে জানে! কিছুটা সময় সে ‘নারী’ শব্দটাই সহ্য করতে পারতোনা! সঙ্গ তো আরো আগেই ঘৃণা করত। এরপর ধীরে ধীরে ভুল ধারণা ভাঙ্গল। নায়ীব এরপর থেকে জানে, বুঝে; সবাই এক নয়।
সিগা রেট প্রায় শেষের দিকে। প্যাকেটটাও ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিল ও। সামান্য ঝুঁকে দেখল একবার। এভাবেই তো সেদিনে ঘাড় ঘুরিয়ে অপরূপা মেয়েটাকে সে দেখল। দূর থেকেই কেমন গোল-গোল চোখে তার চোখের মণিতে সরাসরি তাকাচ্ছিল! পাতলা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় সামান্য ফাঁক হয়ে ছিল! চেহারায় চমকানো,হতভম্বী ভাবটাও ছিল— সবমিলিয়ে তাকে বরাবরের মতই সুন্দর দেখাচ্ছিলো। নায়ীব খুব করে মনে করতে চাইলো প্রথম দিনটার কথা। মেয়েটা এসে বসেছিলো চেয়ারে। গায়ে ছিল ঝকঝকে সাদা একটা টপ। হাতে ছিল ক’টা চুড়ি! ঝিনঝিন শব্দ তুলেছে বার কয়েক। মেয়েটা হাত নাড়িয়ে কথা বলে কিনা!
প্রথমে নায়ীব ভেবেছিল, পাশে বসা ভদ্রলোক তার বাবা নাহয় অন্যকিছু! সে গেছিল ওয়াশরুমে। ফিরে আসতে আসতে শুনলো, মেয়েটা বলছে সে ম্যারিড! নায়ীব বিষম খেয়েছিল যেন। এইটুকুন মেয়ের বিয়ে হয়েছে, ব্যাপারটা অদ্ভুত।
সে ওতকিছু তখন ভাবেনি। এখন ভাবছেনা। মাথা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বিরক্ত চোখে সিগা রেটের শেষাংশে তাকিয়ে সেটাও ছুঁড়ে ফেলে নিচের দিকে। এরপর গটগট পায়ে ছাদ থেকে নামে। আশ্চর্য! এই ছাদে এসেও মেয়েটার কথা মনে পড়ছে তার! সিগা রেটও তাকে মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? মনটা বোধহয় হাতছাড়া হচ্ছে ক্রমশ!
…
নিশাত স্টিক হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। নায়মা গোসল করছেন। বেলা গড়ালে তিনি গোসল করতে ঢুকেন৷ অদ্ভুত বিষয়। নাবিদ সাহেব ফোন হাতে বসে আছেন। নিশাত চুপিচুপি, নিঃশব্দে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে, জোহা মেয়েটা রোজ কাপড় তুলতে আসে। বিকালবেলা নায়মাও যান কাপড় তুলতে। তিনিই একথা বলেছেন। জোহাকে নিশাতের অত্যন্ত প্রয়োজন। তার ধারণা মাফিক জোহা গুনে গুনে দশ মিনিট পর গুনগুনিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠল। তিন তলায় নিশাতকে ওমন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সহসা চমকে গেল। দুই সিঁড়ি নেমে গেল ফের।
এরপর আবার হাঁফ ছেড়ে বলল,
“ আরে আপু আপনি? ভয় পেয়ে গেছিলাম! এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”
“ তোমার অপেক্ষা করছিলাম, জোহা। আসো গল্প করি?”
জোহা না করলনা। মা আজ ঘুমে বিভোর। সে দশমিনিটের জায়গায় বিশ মিনিট থাকলেও সমস্যা নেই। তাই নে মাথা নেড়ে বলল,
“ ঠিক আছে!”
..
জোহার সামনে তিন পদের নাশতা রাখা। নায়মা গোসল থেকে বেরিয়ে ফ্রোজেন নাশতাগুলো ভেঁজে দিয়েছেন। নিশাত বিছানার কিনারায় বসা। আর জোহা টুলে। নিশাত ছোট্ট প্লেটগুলো ঠেলে দিয়ে বলল,
“ খাও! চেয়ে আছো কেন? তোমার জন্যই আনিয়েছি। খেয়ে বলো, মজা কিনা!”
জোহা এক ভ্রু কপালে তুলে। একে একে সব নাশতাই খায়। শেষ মুহুর্তে নিশাত বলে,
“ দরজাটা একটু ভিড়িয়ে আসবে, জোহা?”
“ সিওর, আপু!”
এরপর জোহা সেকেন্ড খানেকের ব্যবধানে উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে আবার এসে বসল। নিশাত ঝুঁকে। চোখ-মুখ চকচক করছে তার!
“ আজকে তোমার আপু এসেছে?”
“ না, স্রোত আপু আর আসবেনা।”
নিশাত হকচকালো। তার হকচকানো দেখে জোহা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। নিশাত প্রশ্ন করার আগেই বলল,
“ আপুর এক্সাম। এক্সাম শেষে আসবে। আবার এক্সামে গ্যাপ থাকলে আসলেও আসতে পারে।”
“ ওহ! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!”
বুকে একহাত চেপে চোখ উল্টায় নিশাত। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তেই জোহা বড়-বড় চোখে তাকায়।
“ কেন, কেন?”
“ এমনিই। এভাবে তাকাচ্ছো কেন?”
জোহার সন্দেহ দূর হলোনা। ভ্রু আর কপাল থেকে নামলইনা। নিশাত আবার ঝুঁকল। ফিসফিস করে বলল,
“ আচ্ছা আপু কি…”
“ পিওর সিঙ্গেল।”
সেকেন্ড খানেক মাঝারি রুমটায় পিনপতন নিরবতা বিরাজ করল। এরপর নিশাতই সর্বপ্রথম ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। জোহাও তাল মেলালো। তাদের এই পাগলের মত হাসির শব্দ শুনে নায়মা ঠাস করে দরজা খুললেন। এরপর হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
চলবে.
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১১
অসহ্য রকমের বিরক্তি ঝেঁকে ধরেছে ওয়াহিদকে। পরীক্ষার আর মাত্র চারদিন বাকি। সচরাচর পরীক্ষার পনেরো দিন আগে থেকে ওয়াহিদ কোমর-মাথা বেঁধে পড়তে বসে। কিন্তু সে এবার তা পারছেনা। পড়তে বসলেই কিছু একটা তাকে অন্যমনস্ক করে ফেলে। সেই জিনিসটা কি, সেটা সে বাদে কেউ জানেনা। আর ওয়াহিদ এই বিষয় মানতে নারাজ। স্রোতকে টক্কর দেয়া বোধহয় এবার আর সম্ভব না। তবে তাদের নিরব প্রতিযোগিতা উপভোগ করে সবাই-ই। ওয়াহিদ নিজেও করে! মেয়েটা সর্বদাই নিজেকে কঠিন ধাচের দেখাতে চায়। দুনিয়াকে বোঝাতে চায় সে স্ট্রং ওম্যান। কিন্তু ওয়াহিদ জানে, মেয়েটা মোটেও ওরকম না। হয়তো মানসিক ভাবে স্ট্রং,তবে ওতটাও না। এইযে, কখনো ওয়াহিদ তাকে পেছনে ফেললে কেমন আগু-ন চোখে তাকায়! পরক্ষণে আবার কেমন বিষন্ন হয়ে যায় ছোট বাচ্চাদের মত! যেন যেকোনো সময় মায়ের কোলে গিয়ে মুখ গুঁজে কেঁদে দিবে। তবে এবার আর তা সম্ভব না। ওয়াহিদ তা ঢের বুঝতে পারছে।
পিয়াশ হাই তুলে। ওরা বসে আছে ঘাসের ওপর। বিলের ধার, নির্জন পরিবেশ। রাস্তার সাইডে বাইক রাখা। পিয়াশ ওদিকে তাকাচ্ছে একবার, ওয়াহিদকে দেখছে একবার। কপাল কুঁচকে সে বিলের অস্বচ্ছ জলের পানে তাকিয়ে আছে।
“ কি হয়েছে তোর?”
“ জানিনা, পড়ালেখা হচ্ছেনা। ভাবছি, খামার দিব।”
“ নট আ ব্যাড আইডিয়া। কিন্তু তোর সরকারি কর্মকর্তা বাপ মানবেন?”
“ একদমই না! তিনি তো আমাকে একশো টাকা দিতেই ভরসা পাননা। আর খামারের টাকা?”
ওয়াহিদের কুঁচকানো মুখ আরো কুঁচকে গেল। পিয়াশ শব্দ করে হাসল। সহসা বলতে লাগল,
“ মেয়েটা ভার্সিটিতে এসেছিল!”
“ কে?” নিচু স্বর। দমানো, চাপা কৌতুহলটা নজর এড়াতে পারলনা পিয়াশের। পিয়াশ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে। বন্ধু যে তার প্রেমে ভালোভাবেই পড়েছে, সে তা তার আচরণেই বুঝতে পারছে। কিন্তু গাধা তো স্বীকার করছেনা!
“ নিশাত!”
“ ওহ।” ছোট্ট জবাব ওয়াহিদের। বিশেষ ভাবাবেগ দেখা গেলনা এবার। যেন এসব সে জানেই।
“ এক্সি ডেন্ট করেছিল..”
“ জানি।”
থামল পিয়াশ। মিনিটের মাথায় ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“ মেয়েটাকে মনে ধরেছে তাইনা?”
“ কি যা তা বলছিস!”
“ ওয়াহিদ! আ’ম নট জোকিং! সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি।”
“ পিয়াশ! মেজাজ খারাপ হচ্ছে!”
“ আমি বুঝি সব। প্রেম আমিও করি, প্রেমে পড়ার সাধ, লক্ষণ সবই মুখস্থ আমার!”
“ থামবি তুই?”
“ একদম না! বলনা, একবার মুখে বল, তুই ওকে পছন্দ করিস, ভালোবা..”
“ এই শা/লা! চুপ।”
“ ধ্যাত ব্যাটা! তুই চুপ! তুই ওর কারণেই অন্যমনস্ক থাকিস ইদানীং। সারাটা দিনই ওকে নিয়েই ভাবিস! এক কথা তোকে দু’বার বলতে হয়! পড়াশোনায়ও এবার তুই অমনোযোগী। এমন তো আগে হয়নি, ওয়াহিদ! তুই যে ওর উপর নজর রাখিস, এটাও আমি জানি!”
ওয়াহিদ এবার দমে গেল। ভয়ংকর রকমের রাগটা মাথায় চড়তে গিয়েও কোথায় মাঝপথে হারিয়ে গেল। পিয়াশ তো ভুল বলেনি। কিন্তু এই গাধাটা এসব জানল কীভাবে? মনের ভাবমূর্তি ওয়াহিদ খুব সহজে কাউকে দেখাতে চায়না। পিয়াশ তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হলেও সে কখনো পিয়াশের সামনে এমন আচরণ করেনি যাতে এসব প্রকাশ পায়। সেদিন কেবল নাম্বার জোগাড় করতে বলেছিল! এই যা!
মুখটা ছোট হয়ে আসলো ওর। ঘোর অমানিশায় ছেয়ে গেল সুদর্শন মুখের আদল। আসলেই কি সে প্রেমে পড়েছে?তার ছোট হওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে পিয়াশ হাসল। কাঁধে হাতে রেখে বলল,
“ স্বীকার করে নে! পাখি উড়াল দিলে কিন্তু সমস্যা!” বলতে দেরী, পিঠে শক্তপোক্ত হাতের থা-বা বসতে দেরী নেই। অকস্মাৎ এমন কান্ডে বাকহারা হয়ে পড়ল পিয়াশ। সেকেন্ড গড়াতেই ব্যথার ককিয়ে উঠল! ওমন পুরুষালী শক্ত হাতের থা-বায় কে না ব্যথা পাবে! চোখ-মুখ মারাত্মক কুঁচকে গেল।
ওয়াহিদ থা-বা বসিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তৎক্ষনাৎ। প্যান্ট হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে তাকাল পিয়াশের দিকে। আহহা! এই নাটকবাজ এমন করছে কেন? সে তো আস্তে করে প্রত্যুত্তর দিল কেবল! এতেই কুপোকাত! ভাবনারা পালানোর আগেই পিয়াশ উঠে দাঁড়ালো। এরপর হাম-লা চালাল ওয়াহিদের ওপর।
…
নিশাত ভাইয়ের ভাব-সাবে লক্ষ্য রাখছে ইদানীং। এইযে, দোতলায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটা দুই সপ্তাহ ধরে আসেনা!
গেট পেরোতেই কখনো মুখোমুখি হয়না, চোখে চোখ পড়েনা- এতকিছুই যে ঘটছেনা, এসবে কি নায়ীবের যায় আসেনা? নিশাতের তো যায় আসছে। ভাইয়ের সঙ্গে স্রোতের দেখা হচ্ছেনা বলে তার খুব কষ্ট লাগছে। সে ভেবেছিল, তার ভাইয়েরও একই দশা। কিন্তু সে বোধহয় ভুল। ভাই আহামরি কিছুই ভাবেনা স্রোতকে নিয়ে।
সকালে রেডি হচ্ছিলো নায়ীব। গায়ে নীল রঙের শার্টটা জড়িয়ে সে বেরিয়ে এল রুম থেকে। তার রুমটা নিশাতের রুমের থেকে আরেকটু বড়। তিনটা রুমেই বারান্দা আছে। শুধু গেস্ট রুমে নেই। নিশাত নিজের বারান্দায় চারটা ফুলের চারা লাগিয়েছে। বেতের চেয়ার দিয়ে একপাশ সাজিয়েছে। লাল-নীল লাইটও লাগানো আছে। রাতে মাঝেমধ্যে সে সেখানে গিয়ে বসে থাকে। নাবিদ সাহেবও তার দেখা দেখি বারান্দায় ক’টা গাছ লাগিয়েছেন। তবে তিনি পানি দিতে ভুলে যান মাঝেমধ্যে।
নিশাত একারণে বকাবকি করে উনাকে। বাবা-মেয়ের এসব কান্ডে নায়ীব বরাবরের মতই নির্বিকার। সে গাছ-টাছ ওত পছন্দ করেনা। তার বড়-সড় বারান্দাটা উদাম রাখা। একটা মানুষ অনায়াসে থাকতে পারবে। রুমেও খুব সামান্য ফার্ণিচার রাখা। বাড়তি সব গেস্ট রুমে ঠেস দিয়ে রাখা।
নিশাত ব্রেডে জেলি লাগাতে লাগাতে চোখে তুলে একবার চাইল নায়মার পানে। কালকে তিনি চলে যাবেন। নায়মা কেমন ইতস্তত বোধ করছেন, চোখ-মুখে তা প্রকাশ পাচ্ছে। নায়ীব এসে বসল নিশাতের পাশের চেয়ারটায়। শান্ত চোখ জোড়া টেবিলেই বিরাজ করল কতক্ষণ। এরপর দু’টো ব্রেড নিশাতের প্লেটে তুলে দিয়ে চোখের ইশারায় জেলি লাগাতে বলল। নিশাত নিশ্চুপে সম্মতি দিয়ে আবার তাকালো ফুপুর দিকে। মহিলার মতিগতি বোঝা বড়ই দায়। সহসা নিশাত তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
“ কি বলবে ফুপ্পি! বলে ফেলোনা! সবাই আছে তো এখন..”
নায়মা ভরসা পেলেন না তাতেও। নিশাত বাদে দুই জোড়া চোখের দৃষ্টি তড়াক করে তার দিকে মোড়ল। নাবিদ সাহেবের স্বাভাবিক দৃষ্টি আর নায়ীবের সন্দিহান।
নায়মা শেষমেশ মুখ খুললেন। তার পূর্বে শাড়ির আঁচলের নিচ থেকে কাগজের মত কি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। নায়ীব চায়ে সবেই চুমুক বসিয়েছিল। টেবিলের ওপর এসব আজগুবি জিনিস দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো।
কিন্তু সেকেন্ডের মাথায়ই সেগুলো উলটে দিলেন নায়মা। টেবিলের একাংশ জুড়ে সেগুলো আবার মেলে রাখলেন। ছবি! কম হলেও দশটা তো হবেই! এগুলো সকালে নিশাতকে দেখিয়ে ফেলেছেন তিনি। তবে নায়ীবকে দেখানোর সাহস পাচ্ছিলেন না। নাবিদ সাহেব এসব পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে সামান্য হাসলেও আকস্মিক বিষম খেল নায়ীব। চোখ দু’টো কুঁচকে এল। হাত থেকে চায়ের কাপটা শব্দ করে টেবিলে রেখেই পানির গ্লাস হাতে তুলে নিল। ঢকঢক করে পানি গিলার ক্ষণে নিশাত তড়িঘড়ি করে ভাইয়ের পিঠে, মাথায় হাত বুলালো।
হতভম্ব বনে গেলেন নায়মা। এরপর জ্বিভে কাম ড় দিয়ে বললেন,
“ কি যে করিস রে বাবা! সাবধানে খা! গরম চা!”
“ চা তো ওতো গরম না।” ভ্রু বাঁকিয়ে বলল নিশাত।
“ তাহলে বিষম খেলি কেন?”
নায়ীব থমথমে স্বরে মুখ খুলল,
“ এগুলো কি ফুপ্পি!”
“ কেনো? মেয়েদের ছবি। দেখতো কোনটা কোনটা সুন্দর।”
“ মনে হচ্ছে আমি কোনো কাপড়ের দোকানে এসেছি।” নায়ীবের কথায় বিরক্ত হলেন নায়মা। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“ এই, মুখ কমিয়ে চালা। তোর বয়স আমরাও পার করেছি। আমাদের সময় সোজা ধরে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। তোদের তো তাও পাত্র-পাত্রী দেখার সুযোগ হচ্ছে!”
“ কি বলছিস কি নায়মা? মিথ্যে বলে আমার ছেলে-মেয়েদের বুঝ দিচ্ছিস কেন?”
নায়মা গরম চোখে তাকালেন নাবিদ সাহেবের দিকে। নাবিদ সাহেব চোখ তুলে তাকালেনও না। খেতে খেতে মিটমিটিয়ে হাসলেন।
ছবিগুলো আরেকটু ঠেলে নায়ীবের দিকে এগিয়ে দিলেন উনি।
বললেন,
“ দেখ না রে বাপ! অনেক কষ্টে দুইজন ঘটক লাগিয়ে জোগাড় করেছি!”
বলতে বলতে তিনি একটা ছবি হাতে তুলে নিলেন। ছবির মেয়েটা সুন্দর ভীষণ। মুখের আদলটা লম্বাটে, খাড়া নাক, ফর্সা ত্বক। চুলগুলোও লম্বা। এইচএসসি দিয়েছে সবে। একে একে সব ডিটেইলস বলতেই নায়ীবের চোখ কপালে উঠল। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ এত ছোট মেয়েকে বিয়ে? অসম্ভব! দেখো গিয়ে এদের একটারও আঠারো হয়নি!”
“ সব কয়টার বয়স আঠারোর ওপর। তবে ঊনিশের নিচে। এই বয়সটাই বিয়ের জন্য একদম উপযুক্ত।”
“ হুম, ইমম্যাচিউরিটিতে ভর্তি থাকে এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মস্তিষ্ক!” নায়ীব নিরস মুখে বলে। ব্রেড চিবানো শুরু করে। ভেবে নেয় আর ফুপুর সঙ্গে তর্কে যাবেনা।
নায়মা বড্ড অসন্তোষ হলেন। ভাইয়ের পানে কটমট চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে! আমি কত খোঁজ খবর লাগিয়ে পাত্রী জোগাড় করেছি আর তোমার ছেলে দেখছেই না? কত দূর দূরান্তে খবর লাগিয়ে মেয়েদের ডিটেইলস আনছি, জানো?”
“ কি দরকার ফুপ্পি? আশেপাশেই তো সুন্দর, ভালো মেয়ে আছে।”
নায়মা ওত পাত্তা দিলেন না তার কথায়। তবে নায়ীব ঘাড় ফিরিয়ে কেমন করে তাকাল। আড়চোখে খেয়াল করে আবার মুখে ব্রেড পুরে চিবানো শুরু করল নিশাত।
“ আশেপাশে মানে? তুইও ফুপ্পির মত ঘটকালি শুরু করেছিস?”
“ ভালো পাত্রীর সন্ধান দিচ্ছি, ভাইয়া। ব্যাগড়া দিওনা। চোখের সামনেই কত মেয়ে ঘুরঘুর করে।”
নায়ীব চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই নিশাতের চলতে থাকা মুখ বন্ধ হয়ে গেল। সেকেন্ড খানেক গড়াতেই মাথায় আস্তে করে গাট্টা পড়ল।
নায়ীবের খাওয়া শেষ ততক্ষণে। উঠে দাঁড়িয়ে ও দরজার পাশটায় গেল। বলল,
“ যাচ্ছি, আব্বু! কিছু দরকার হলে আসার আগে কল দিও।”
এরপর সে জুতো পরে বেরিয়ে গেল। হা করে তাকিয়ে রইলেন নায়মা। এই ছেলে এতে ত্যাড়া কেন?
নাবিদ সাহেব তার চাহনি দেখে এবার মুখ খুললেন,
“ ওর রুমে রেখে দিস ছবিগুলো, রাতে দেখবে।”
চলবে..
#গোপনে_রাঙানো_প্রেম
#হুযাইফা_মাইশা
—১২
পড়ন্ত বিকেলে নায়ীবকে একপ্রকার জোর করেই ঠেলেঠুলে বাইরে নিয়ে এল নিশাত। সে গোপন সূত্রে খবর পেয়েছে, স্রোত আজ এসেছে। গোপন সূত্রের গোপন গোয়েন্দা কে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
নায়ীব এসেছে তিনটার দিকে। শীতের আগমন। অন্ধকার এখন ধরণীকে একটু আগেই গ্রাস করে। ইতিমধ্যেই অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। বাসার সামনের খোলা জায়গাটায় নিশাত আর নায়ীব দাঁড়িয়ে। নিশাত মাথা উঁচিয়ে একবার তাকাল উপরের দিকে। জোহাদের বাসার একটা বারান্দা এদিকে। জোহা বলেছে সে এদিকে একবার হাজিরা দিবে।
নিশাত খালি বারান্দা থেকে হতাশ হয়ে চোখ নামালো। নায়ীবের কল এসেছে, সে ফোনে ব্যস্ত। নিশাত তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি করল। বলল,
“ ভাইয়া, এখানে ক’টা ফুলের চারা লাগানো আছে। গোলাপ ফুল আর এই নয়ন তারার চারাটা আমার লাগবে। বারান্দায় লাগাব।”
ফোন কান থেকে নামিয়ে পকেটে পুড়লো নায়ীব,
“ এগুলো তো আংকেলের। নার্সারি থেকে এনে নিস।”
“ আমি যেতে পারবনা! তুমি এনে দিও?”
নিশাত চোখ ঘুরায় এর মধ্যে। ওইযে, বারান্দায় জোহা দাঁড়িয়ে হাত নাড়াচ্ছে।
সে তৎক্ষনাৎ চোখ সরাল। বলল,
“ দাঁড়াও, আমি ফোন আনছি। ছবি তুলে তোমাকে সেন্ড করে দেই, নাহলে ভুলে যাবে।”
নায়ীব প্রতিক্রিয়া দেয়ার পূর্বেই মেয়েটা রকেটের গতিতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নায়ীব বেক্কল বনে গেল। সে কি গোলাপ আর নয়ন তারা চেনেনা? এতই আহাম্মক নাকি! তার কাছেও তো ফোন আছে!
দুতলায় উঠার আগেই স্রোতের সঙ্গে দেখা হলো নিশাতের। নিশাতকে দেখে ও থেমে গেল। নিশাত হেসে প্রথমেই বলল,
“ আপু, আপনাকে তো দেখতেই পাইনা এখন।”
“ পরীক্ষা চলছে তো। তাই আসিনা। আর মাত্র কয়টা দিন। এরপরই শেষ! কেমন আছো তুমি? পা ঠিক হয়েছে?”
নিশাত মাথা নাড়ে। কিছু দাগ ছাড়া পায়ে আর কিছুই নেই। ব্যথাও হয়না।
“ এব্রিথিং ইজ অলরাইট। আপু, একটা কথা বলি?”
“ বলোনা!”
“ আপনাকে খোলা চুলেই বেশি প্রিটি লাগে।”
স্রোত চমকালো। একগাল হাসল। চুলটা আপাতত তার খোঁপা করা। সামনে, এদিকে-সেদিকে চুল বেরিয়ে গেছে বোধহয়। পাগ ল দেখাচ্ছে নিশ্চিত। নাহলে মেয়েটা হঠাৎ এ কথা বলবে কেন?
স্রোত হাস্যজ্বল মুখে বলল,
“ থ্যাংকিউ। তুমি আমাকে তুমি করেই বলো, মিষ্টি মেয়ে। আজ আসি।”
“ বাই, আপু।”
নিশাত দোতলা অব্দি গিয়ে আর উঠলনা। ফের নিচে নামল।
স্রোত সিঁড়ি নামতে নামতে চুলের খোঁপা খুলে ফেলল। হাত দিয়ে চুল সামান্য ঠিক করতে করতে এগুলো। ওমনি ধাক্কা লাগলো একটা প্রশস্ত,চওড়া বুকে। স্রোতের মনে হলো, তার অল্প বোঁচা নাকটা সম্পূর্ণ চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। ভাবনার মধ্যেই, কাঁধে একটা শক্তপোক্ত হাতের ছোঁয়া পেতেই জানটা ছলকে উঠল যেন। লাফিয়ে পেছনে সরতে গেলেই টাইলসে পা স্লিপ কাটল। অসহায় বনে টাল সামলানোর জন্য আবার ধরতে হলো সামনের ব্যক্তিকে। সব কিছু এত দ্রুতই ঘটল যে, স্রোতের মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ল। তার হাত দু’টো তখন সামনের ব্যক্তির কলারে। শক্ত মুট করে ধরা রাখা। চোখ দু’টো খিঁচে বন্ধ করে রাখা।
নায়ীব হতবাক, মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে। মুগ্ধতা অবশ্য সে স্বীকার করবেনা।
সেকেন্ড খানেক সে হা হয়ে দেখল তার কলার ধরে রাখা মেয়েটাকে। এরপরই বোধ-জ্ঞান ফিরতেই সামান্য স্বরে ডাকল,
“ স্রোত! তাকান! ভয় পেয়েছেন?”
স্রোত তাকাল। ওমনি তার মনে হল, না তাকালেই বোধহয় ভালো ছিলো। এখন সে এই লজ্জা থেকে মুক্তি কি করে পাবে?
নায়ীবের চোখ তখনও তার চোখ-মুখের প্রতিটা কোণায় ঘুরছে। তার এলেমেলো, উত্তাল দৃষ্টিটা তখনও স্রোত খেয়াল করেনি। নায়ীব ফের ডাকল,
“ সোজা হয়ে দাঁড়ান। দেখুন, ব্যথা পেয়েছেন কিনা?”
স্রোত কলার ছাড়ল। ইস্ত্রি করা শার্ট সামান্য কুঁচকালেই যে নায়ীব নাক সিটকায়, সেই নায়ীব আজ আর কুঁচকানো কলারের দিকে চাইলোনা। তার সমস্ত ধ্যান এখন একজনের পানে স্থির। স্রোত পিছু হটলো। নিচের দিকে তাকাল। আনমনা হয়ে চুলগুলো কানে গুঁজল।
গোধূলি লগ্নের লালচে মৃদু আলোয় নায়ীবের মনে হল, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হয়না! এই নত মুস্তক, মুগ্ধ করা লাজুক চেহারা সম্পূর্ণটাই অপরুপ! যেন আস্ত কাব্য রচনা করা যাবে তা দিয়ে। স্রোত মৃদু গলায় বলল,
“ সরি! আমি..আসলে খেয়াল করিনি!”
ওর এমন ইতস্তত ভাব দেখে নায়ীব তড়িঘড়ি করে বলল,
“ সমস্যা নেই।”
নায়ীব সরলো। স্রোত এগোলো। আবার চোখাচোখি হতেই নায়ীব অকস্মাৎ গভীর কণ্ঠে বলে উঠল,
“ আপনাকে দেখিনি অনেকদিন..”
কণ্ঠ, বাক্য, বাক্যের প্রতিটা শব্দই যেন স্রোতকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। ফোলা ফোলা গাল দু’টো গরম হয়ে উঠল। নায়ীবের কণ্ঠ যেমন গভীর,শান্ত চোখের দৃষ্টি তার চেয়েও এক ধাপ উপরে। এইযে, সে এক মুহুর্তের যেন স্রোতের থেকে চোখ সরায়নি। মূলত চোখ সরছেইনা। মনে হচ্ছে, কতদিন দেখেনি। চোখ, মন কিছুই মস্তিষ্কের বাঁধা মানেনা। আজ অবশ্য মস্তিষ্কও সায় জানাচ্ছে।
“ আমার এক্সাম চলছে, তাই আসা হয়না এদিকে।”
কথা শেষ হতে না হতেই আজান পড়ল।
স্রোত হকচকালো। ইশ! দেরী হয়ে গেল বোধহয়! তার হকচকানো দেখে ভ্রু কুঁচকালো নায়ীব। প্রশ্ন করল,
“ টেনশড্?”
“ জ্বি, দেরি হয়ে গেল!”
বলতে বলতে সে একবার হাতের ঘড়িতে চোখ বুলাল। আহহা! এখন সে রিকশা পাবে কোথায়?
নায়ীব গম্ভীর হলো। কপালে গুটি খানেক ভাঁজও পাড়ল। তার মুখের ভাবভঙ্গি রাতারাতি পালটে যাওয়ায় স্রোত আরেকটু চমকালো, থমকালো।
উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারাটা কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে! অল্প ভেজা চুলগুলো নুইয়ে আছে। গায়ে জড়ানো অলিভ কালারের শার্টটা আঁটসাঁট হয়ে আছে পেটানোর শরীরের সঙ্গে। অদ্ভুত! এই সুদর্শন পুরুষ সবসময় হাসেনা কেন? হাসলে নিশ্চয়ই আরো বেশি সুন্দর দেখাবে?
তার ভাবনার মধ্যেই গম্ভীর গলা শোনা গেল,
“ সন্ধ্যার আগে হোস্টেলে ফেরার চেষ্টা করবেন। দিন-কাল ভালো না। চলুন, এগিয়ে দেই।”
স্রোতের কি হলো কে জানে! এই ভর সন্ধ্যায় যে সে মন খুঁইয়েছে, তাও একটা কাঠখোট্টা মানুষের কাছে, সেটা সে বুঝতে পারলইনা। স্রোতের নিঃশ্বাস ভারী হলো। নায়ীব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে বোধহয়। ব্যর্থ হয়ে বলল,
“ যাবেন না?”
“ জ্বি, জ্বি! চলুন..”
স্রোত, নায়ীব পাশাপাশি হাঁটল। গেট পেরোলো আগে স্রোত। এরপর ফের পাশাপাশি। কদমে কদম মিলিয়ে হাঁটছিল দুজনে। গলির মুখটায় এসে থামল। এই নির্জন রাস্তায় একটা কুকর বাদে কিছুই নেই।
“ হোস্টেল কত দূরে?”
“ এখান থেকে বিশ মিনিটের মত দূর।”
“ একাই যান?”
স্রোত মাথা নাড়াল,
“ জ্বি।”
“ সেদিন আপনার মতই কাকে যেন দেখলাম, কারের মধ্যে।”
নায়ীবের সন্দিহান গলা। বাঁকা চাহনি। ল্যাম্পপোস্টের আলোর ছলকানি আছড়ে পড়ছে পুরো রাস্তায়। স্রোত ভাবুক হল। খানিক্ষণ ভেবে চট করে প্রশ্ন রাখল,
“ মলের সামনে?”
নায়ীব মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেয়।
“ আমার ভাইয়া এসেছিল, তার সঙ্গেই ছিলাম।”
“ওহ!”
ছোট্ট একটা জবাব। নায়ীবের চোখ-মুখ অত্যন্ত স্বাভাবিক। অথচ এখন বেহায়ার মত স্রোতই তার দিকে তাকাচ্ছে! একবার নয়, দুইবার নয়, বারবার! বিষয়টা হয়তো নায়ীবও খেয়াল করেছে। ও আড়চোখে তাকাতেই চোখা-চোখি হলো। ওমনি লজ্জাবতী গাছের পাতার ন্যায় নুইয়ে আসে স্রোত। থুতনি চট করে ঠেকে গলায়। কবে না ঘাড়টাই নেমে আসে!
রিকশার দেখা মিললো মিনিট দুই এক পর। স্রোত দামাদামী না করেই উঠে পড়ল। হুড তুললো। নায়ীব ভরাট গলায় শুধু বলল,
“ সাবধানে যাবেন।”
এরপর আবার সামনে চাইল,
“ সাবধানে পৌঁছে দিয়েন মামা।”
রিকশা চালক কি বুঝলেন কে জানে। ফোঁকলা দাঁত বের করে একটা বড় হাসি উপহার দিয়ে প্যাডেল মা রা শুরু করলেন।
হোস্টেলের সামনে রিকশা থামতেই চট করে নেমে পড়ল স্রোত। চুল অনেক আগেই ফের হাতখোঁপা করে নিয়েছে। মৃদু বাতাসে গা শিরশির করছে। ব্যাগ থেকে টাকা বের করার পূর্বেই রিকশা চালক হইহই করে উঠলেন। কপাল-টপাল কুঁচকে, জ্বিহবা কামড়ে বললেন,
“ ভাড়া নিলে মামায় আমারে খাই ফেলবো! আপনি যান। আপনার ভাড়া দেওন লাগবোনা!”
বিষ্ময়ে মেয়েটার মুখ চললনা। বড় বড় চোখে কেবলই হতভম্বী ভাব। রিকশা চালক ফের প্যাডেল মা রা শুরু করতেই তার হুশ ফিরে। দুই কদম এগিয়ে বলে,
“ কি বলেন আংকেল? কে খেয়ে ফেলবে আপনাকে? ভাড়া নিবেন না কেন?”
মেয়েটার চোখ-মুখের চাহনিতে অসন্তোষ। রিকশা চালক আর বিস্তারিত বললেন না। শুধু বললেন,
“ ভাড়া আমি নিমুনা। আপনি যান।”
এরপরই দ্রুত প্যাডেল মে রে চলে যান সামনে। স্রোত হাঁফ ছাড়ে। কি হলো এটা?
…
নিশাত কোমরে দু’হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। মুখে পুরোদমে কঠোর ভাব আনার প্রচেষ্টায় সে। তবে তার মিষ্টি মিষ্টি মুখটা কঠোর ভাব ধারণ করতে ব্যর্থ। নায়ীব বাইরে দাঁড়িয়েই জুতা খুলল। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“ কি?”
“ কোথায় ছিলে?”
“ তুই বল তুই উপরে ছুটে এলি কেন?”
“ ছুটে এলে কি তুমি ওভাবে স্রোত আপুর সাথে..”
নায়ীবের শক্ত-পোক্ত হাত দু’টো তড়াক করে এগিয়ে গেল। নিশাতের মুখ চেপে ধরল এরপর। মেয়েটা হতবাক হলো। বাক্যটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আকস্মিক ভাইয়ের এই হা মলায় কিছুই বুঝে উঠতে পারলনা। নায়ীব পা দিয়ে দরজা ঠেলে লক করল। এরপর নিশাতের মুখ চেপেই নিয়ে গেল নিজের রুমে। এরপর মুখ ছেড়ে দিল এক ধমক। তবে নিচু স্বরে। পাছে নাবিদ সাহেব যদি শুনে ফেলেন! হাত বাড়িয়ে দরজাটাও ভিড়িয়ে দিল।
তার এসব ধমক টমক আজ পাত্তা দিলনা নিশাত। মুখে হাত ঢলে অসন্তোষ চোখে তাকালো সে। নিঃশ্বাসটাই না আটকে যাচ্ছিলো!
“ বেয়াদব! মুখ বেশি বেড়েছে!”
নায়ীব গজগজ করে উঠল। নিশাত বড় বড় চোখ বানিয়ে তাকাল। বলল,
“ আশ্চর্য! যা দেখেছি, তা বলবনা? ভাইয়া তুমি..”
নায়ীব নিজের কপালে নিজেই চাপ ড় দিল একবার। এরপর চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ মার ব কিন্তু!”
“ দাঁড়াও, আব্বুকে বলব আমি!”
নিশাত মিছে মিছে দরজার পাশটায় গেল। নায়ীব ওমনি তাকে টেনে আনল। মাথায় দু’টো গাট্টা দিতেই নিশাত গলা ফাটিয়ে চেঁচাল,
“ ভাইয়া! ব্যথা পাচ্ছি কিন্তু..”
আবার তার মুখ চেপে ধরল নায়ীব। সেকেন্ড খানেকের মাথায় হাত সরিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে সে গিয়ে বসল বিছানায়। নিশাত সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইল।
“ ভুল বুঝছিস তুই নিশাত..”
“ আচ্ছা বলো, কোথায় ছিলে এতক্ষন?”
“ গলির মাথায়।”
“ একা?”
নায়ীব দাঁতে দাঁত চেপে তাকাতেই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসলো নিশাত। বলল,
“ বলোনা!”
“ না!”
“ জানতাম! ভাইয়া তুমি তো এসব আগে বলোনি!”
“ কি বলব?” অবাক স্বর নায়ীবের। সেকেন্ডের মাথায় ব্যাপারটা ধরতে পেরেই মাথায় আরেকটা গাট্টা বসালো সে। কিড়মিড় করে বলল,
“ তুই আসলেই দিন দিন বেয়াদব হচ্ছিস, নিশাত!”
…
জিহাদ বগলদাবা করে একজনকে নিয়ে এসেছে। ব্যক্তিটির একটা হাত তার হাতের কনুইয়ের প্যাঁচে। আসা মী হলে তো হ্যান্ডকাফ পরাবে! এ কেমন ধরনের পাকড়াও করা? থানার বাকিদের কাছে এ ব্যাপার সাধারণ হলেও রিপোর্ট লিখাতে আসা মানুষরা এ নিয়ে হেসে কুটিকুটি হলো। জিহাদ পাত্তা দিলনা। বুক ফুলিয়ে হেঁটে সে নায়ীবের কেবিনের মত রুমটায় এল। মাঝখানে একটা কাঠের হাফ দরজা দেয়া। জিহাদ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ স্যার, আসবো?”
তার চেঁচানোয় কান ধরে গেল পাশে থাকা ব্যক্তির। সে বিশাল বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ আস্তে চেঁচান। হাত ছাড়ুন! ”
“ ইম্পসিবল! আপনার পা যেই পালাই পালাই মিয়া! কবে না পালিয়ে যান,পরে স্যার আমার গর্দান নেবে।”
ভেতর থেকে রাশভারী কণ্ঠ ভেসে এল,
“ আসো!”
জিহাদ ওমনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তাকে এমন অবস্থায় দেখে আহাম্মক বনে গেল। হাতের প্যাঁচে আরেকজনের হাত! সঙ্গের ব্যক্তিটির মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। নায়ীব কপালে আঙুল ঘষে। চিন্তিত গলায় শুধায়,
“ এ কে? এভাবে ধরে আছো কেন?”
“ স্যার এই সেই পলাতক আসা-মী! এ-ই গাড়ি দিয়ে আপনাদের ধা-ক্কা দিয়েছে!”
গুনে গুনে এক মিনিট প্রচন্ড নীরবতায় কাটল। ব্যক্তিটির রাগ মিইয়ে গেল। সে জানত, কনস্টেবল কারোর বাইকে না দেখে ধাক্কা দিয়েছে সে। কিন্তু এ তো সিনিয়র ইন্সপেক্টর! চোখ-মুখ যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালাতে চাইল সে। হলোনা! ভীত ভাব তাকে ঘিরে ধরল।
নায়ীব তীর্যক দৃষ্টিতে পরখ করল। ছেলেটার বয়স কত হবে? ঊনিশ?বিশ? এরকমই হয়তো! দেখে উচ্চবিত্তই মনে হচ্ছে।
“ স্যার,আ’ম এক্সট্রিমলি সরি! ধাক্কাটা ইচ্ছা করে লাগেনি, আই সোয়্যার।”
কাঁপা কাঁপা গলার স্বর। জিহাদ ধমকে বলল,
“ তাহলে পালাচ্ছিলেন কেন?”
“ ভয়ে!”
“ মিথ্যা বলছে,স্যার।” জিহাদ নির্বিকার বনে সামনে তাকাল।
নায়ীব নির্বাক। চোখ দিয়ে ঘায়েল করা মানুষ সে। জবান খুব কম চালায় কাজের ক্ষেত্রে। তার চাহনি দেখেই ব্যক্তিটির ঘাম ঝরল। ঘাবড়ানো চোখ-মুখে কিছু বলার পূর্বেই প্রশ্ন এলো,
“ নাম কী?”
“বিভান। স্যার, সত্যি বলছি আমি ইচ্ছা করে ধাক্কা দেইনি।”
সিসিটিভি ফুটেজ আগেই চ্যাক করেছে নায়ীব। তাদের ধাক্কা দিয়ে এরপর আবারও এলোমেলো ভাবে গাড়িটা চালানো হয়েছে। মেইন রোডে আবার এক্সি ডেন্ট হতে পারত। তাদের এক্সি ডেন্ট ইচ্ছাকৃত হলে নিশ্চয়ই দক্ষ ড্রাইভার থাকত।
নায়ীব মাথা ঝাড়া দিয়ে কিছু বলার পূর্বেই আরো একজন দরজা ঠেলে ভেতরে এল। ধরাম শব্দ হলো। তিনজনের চোখ তড়াক করে ঘুরলো। নায়ীব প্রতিক্রিয়া দেয়ার পূর্বেই রায়া ছুটে এসে বিভানের কাছ ঘেষে দাঁড়ালো। হাত ছুঁয়ে, মুখের আদল পরখ করে বলল,
“ তুই ঠিক আছিস?”
বিভান মাথা নুয়ালো,
“ আপু, তুমি আসতে গেলে কেন?”
“ খবর পেলাম, তুই এখানে। বাবা-ই আসতে চাইছিলো, কাজের জন্য পারবেনা।” এরপরই রায়া সামনে তাকাল। ওমনি থমকালো। চিন্তারা দূর হলো। ঠোঁটদ্বয় সামান্য ফাঁক হলো বিষ্ময়ে। আপনা-আপনি একটা শব্দ বেরোলো,
“ আপনি?”
..
বিভান! রায়ার খালাতো ভাই। রায়া খুব আদর করে তাকে। অফিস থেকে সবেই বেরিয়েছিল মেয়েটা, যখন শুনলো বিভানকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তক্ষুনি ছুটে এসেছে। রাজীব সাহেবকেও কল করে জানিয়েছে। তিনি বলেছেন লোক পাঠাবেন।
নায়ীব ভ্রুকুটি করে দুজনকে পরখ করে নিল। বিভানকে নিয়ে গেছে জিহাদ। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ সে ফের করবে। গাড়ির লাইসেন্সও চ্যাক করবে। রায়ার বসার কথা বাইরে, সে বসে আছে নায়ীবের সামনে। নায়ীবও উঠে যেতে বলেনি। বিভানের আসতে কিছুক্ষণ লাগবে।
“ এক্সি ডেন্টটা কি আপনার হয়েছিল?”
“ হু!”
নায়ীবের চোখ ফাইলে। মিছে মিছে চোখ বুলাচ্ছে। রায়া চকচকে কৌতুহল নিয়ে আবার প্রশ্ন করল,
“ সো সেড! এরপর ওর খবর পেলেন কি করে?”
“ সিসিটিভি বলতেও কিছু আছে!” রুঢ় স্বর।
রায়া পাত্তা দিলনা সেসব। হাসলো সামান্য। এমন স্ট্রং পার্সোনালিটিই তো মানায় সুদর্শন পুরুষদের সাথে!
সন্ধ্যা নেমে গেছে এতক্ষণে, রাত আটটার ওপর বাজে। বিভানকে এরপর ছাড়ল জিহাদ। রায়া উঠে দাঁড়াল। নায়ীবও ফাইল-টাইল গুছিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। যাওয়ার তোড়জোড় তার। বিভান ভীষণ অনুতপ্ত! সে চোখ তুলে তাকাচ্ছেও না। রায়া একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইল,
“ অফিসার, আপনার ডিউটি আওয়ার শেষ?”
জিহাদ মুখ বাঁকাল। গর্ব করে বলল,
“ পুলিশদের ডিউটি আওয়ার-টাওয়ার নেই। টুয়েন্টি ফোর সেভেন আমরা অন ডিউটিতে থাকি।”
রায়া তার বলার ধরণে হেসে ফেলল। নায়ীব ভ্রু কুঁচকালো। রায়া আর বিভান বেরিয়ে যেতেই সে বেরোলো।
থানা থেকে বেরোতেই আবার দেখা হলো রায়ার সঙ্গে। বিভান তখন ফ্রন্টে বসা। ড্রাইভিং সিটটা খালি। রায়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভেতরে ঢুকেনি। কলে কথা বলছে হয়তো। মুখে মাস্ক। বাবা থেকেও যেন মেয়ে কড়া সিকিউরিটিতে থাকে। এই যে, পেছনে দু’টো বাইকে বডি গার্ড। দেখে বোঝাই যাচ্ছেনা। অথচ নায়ীব ধরে ফেলেছে।
চলবে..