ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
261

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩৭
অফিসে ঢুকে সবে সৌমিক একটু গুছিয়ে বসেছিলো রবির ফোন এলো। এতো সকালে রবি কে ফোন করতে দেখে সৌমিক একটু অবাক হয়ে গেলো,

কি ব্যাপার? তুই এখন? জরুরি কিছু নাকি?

রবি তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো,

হ্যাঁ, কাল রাতে রবীন বাবু মেসেজ করে অ্যাকাউন্ট নম্বর আর ওই উকিলের নম্বর পাঠিয়েছেন। তখন মিতার বাড়িতে ছিলাম তাই তোকে ফোন করিনি, পরে ফিরতেও রাত হয়েছে, কাকিমা ডিনার করিয়ে ছাড়লো। যাইহোক, যেটা বলার জন্যে ফোন করলাম এটা কিন্তু তোদের ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট, একটু দেখতো।

সৌমিক বিস্মিত হলো,

আমাদেরই ব্যাংক নাকি! দাঁড়া ডিটেইলস দিচ্ছি তোকে!

সৌমিক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, সামনের টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

রাজীব দা! দেখুন তো এই অ্যাকাউন্ট টা!

রাজীব সেন কম্পিউটারে মিলিয়ে দেখে সৌমিকের দিকে তাকালেন,

এটা তো সমর চৌধুরী নামে একজনের অ্যাকাউন্ট, আমাদেরই ব্রাঞ্চের, যাঁর স্ত্রী মাঝে মাঝেই টাকার জন্যে আসেন। মনে আছে তোমার, একবার তোমার কাছেও এসেছিলেন?

সৌমিক চমকে উঠলো, দ্রুত ফোন ঘুরিয়ে রবিকে বললো,

সমর চৌধুরী দীপাদির হাসব্যান্ড! রাজীব দা অ্যাকাউন্ট টা দেখেই চিনতে পেরেছেন!

ঠিক আছে! আমি ওনার সঙ্গে কথা বলবো, তুই অপর্ণা কে কিছু জানতে দিস না! রাজীব দা কে জিজ্ঞেস কর টাকাগুলো কোন অ্যাকাউন্ট এ গিয়েছে?

রাজীব চেক করলেন,

প্রসাদ মিত্র নামে একজনের অ্যাকাউন্টে! তবে মাঝে মাঝেই যেতো ওখানে, প্রায় বছর তিনেক ধরেই যেতো। কিন্তু সেতো অল্প টাকা, তিন বছরে খুব বেশি হলে লাখ দুয়েক মতো, বাকি টাকা তো শেষের কয়েকদিন এমনি চেক দিয়েছেন কয়েকজনকে, তারা পঁচিশ, ত্রিশ হাজার করে করে এক একেকজন মিলিয়ে প্রায় লাখ পাঁচেক টাকা তুলেছে!

রবি কে সবটা বলে দিয়ে সৌমিক নিজের জায়গায় ফিরে এলো, মনের মধ্যে খুব অশান্তি হচ্ছে। রবি যতোই নিজে কথা বলুক, দীপা দি ওর কাছেও জানতে চাইবে সবটা, তাতে এই খবর নেওয়ার কথা অপর্ণার কানে পৌঁছবে। একমাত্র যদি দীপা দি কে আড়ালে ডেকে বলা যায় সবটা, তাহলে উনি চুপ করে থাকতে পারেন। কিন্তু সেটা করতে গেলে যদি উনি কিছু মনে করেন, জানতে চান কেনো একথা অপর্ণার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে সে, তাহলে ঠিক কি জবাব দেবে ও! আর অপর্ণা যদি জানতে পারে দীপা দির হাসব্যান্ডই ওর চেনা সমর, তাহলে ঠিক কতোটা আঘাত পাবে ও!

খানিকক্ষন চিন্তা করে রবি কে আবার ফোন করলো সৌমিক, জানালো দীপার সঙ্গে ফোনে কথা না বলে সন্ধ্যের পরে ওরা দুজনে একসঙ্গে ওর বাড়িতে যাবে। কারণ দীপা রবি কে চেনে তাই ওর সঙ্গে ফোনে কথা বললে ও যেহেতু এখন সৌমিকদের বাড়িতেই আছে তাই মা কে সেটা বলবেই তাতে মা সবটা জেনে যেতে পারে। যেহেতু দীপার ফিরতে প্রায় সাতটা হবে তাই রবি কে একটু দেরি করে আসতে বললো সৌমিক। রবি রাজি হলো, জানালো সে দেরি করেই আসবে একটু কারণ তার পক্ষেও ছটার আগে বেরোনো সম্ভব নয়। রবি কে ফোন করেই তার যেতে দেরি হবে জানিয়ে অপর্ণা কে মেসেজ করে দিলো সৌমিক, আজ কদিন ধরে মায়ের বকুনির ভয়ে সে নিয়মিত অপর্ণা কে পৌঁছে দিয়ে এবং নিয়ে যাচ্ছে। তাই অপর্ণা খবর না পেলে ওর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে রাস্তায়।

আজ সারাদিন ঠিক করে কাজে মন বসছিল না সৌমিকের এর মধ্যেই মিতার ফোন এলো। সৌমিক ফোন তুলে দু এক কথা বলে রেখে দেওয়ার সময় মিতা জিজ্ঞেস করলো, আজ সন্ধ্যে বেলায় সে ফ্রি আছে কিনা, তার সৌমিকের সঙ্গে কিছু কথা ছিলো। সৌমিক ব্যস্ত থাকবে জানানোয় মিতা হাসলো,

হ্যাঁ, সেটা তো জানি! রবি বলছিলো একটু আগে তোরা কোথাও যাবি বোধহয় ওই সমর চৌধুরীর খবর নিতে! কিন্তু সেতো অল্প সময়ের কাজ, আমি ওইটুকু সময় নাহয় রবির গাড়িতে বসে থাকবো! তারপরে তো আমরা কথা বলতে পারি!

সৌমিক চমকে উঠলো, রবি এই কথাগুলো মিতাকে বলে দিয়েছে! যদিও মিতার জানা বা না জানাতে কোনো ক্ষতি নেই তবু এই মুহূর্তে কোনো কিছু সঠিক তথ্য না জেনে যেমন ও অপর্ণা কে জানাতে চায়না ঠিক সেরকমই অন্য কেউ জানুক এটাও চায়না! সৌমিক কে চুপ করে থাকতে দেখে মিতা জিজ্ঞেস করলো,

কি রে যাবি তো? আসবো আমি?

সৌমিক একটু বিরক্ত গলায় বললো,

না, আজ না, তোর সঙ্গে আমি দিন কয়েকের মধ্যেই একদিন দেখা করে নিচ্ছি!

রবি এলো একটু বেশি সন্ধ্যের দিকে, সৌমিক কে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ির দরজা খুলে হাসলো,

সরি! একটু দেরি হয়ে গেল, বিরক্ত হয়েছিস তাই না?

সৌমিক গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে রবির দিকে তাকালো,

বিরক্ত অন্য কারণে হয়েছি, তোর দেরির জন্যে নয়! মিতা কে সমরের কথা বলাটা কি খুব জরুরী ছিলো? আমি চাইনি এখন এটা কেউ জানুক!

রবি আড়চোখে তাকালো,

ক্ষেপে গিয়েছিস বুঝতে পারছি, আসলে কাল রবীন বাবুর ফোনটাই যতো গন্ডগোলের মুলে! ওটা এমন সময়ে এলো যখন আমি মিতার বাড়িতে! এবার ওতো যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, রসুলপুরের নাম শুনেই কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে। তারপরে ওর একটু অভিমান হয়েছিলো আসলে, আমি নাকি ইদানিং ওকে বন্ধু বলে ভাবছি না, ওর সঙ্গে কিছু শেয়ার করি না এইসব! তাই বলতে হলো! ওসব ছাড়, ও জানলেও কাউকে বলার মতো কিছু নেই!

সৌমিক চুপ করে রইলো, কিন্তু তার মুখ থেকে বিরক্তির ভাব মিলিয়ে গেলো না। বন্ধুর বিরক্ত মুখ দেখে রবি একটু চুপ করে থেকে নিজে থেকেই বললো,

বুঝতেই পারছি তুই খুব বিরক্ত হয়েছিস! কিন্তু আমি এতো কিছু বলতাম না হয়তো, কিন্তু ব্যাপারটা এমন হলো যে বলতে বাধ্য হলাম বলতে পারিস! আসলে ওকে অপর্ণা তোদের সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছিলো কখনো, তাই ও সেগুলোর সত্যতা যাচাই করতে চাইছিলো আমার কাছে।

সৌমিক অবাক হলো,

অপর্ণা আমাদের সম্পর্কে মিতাকে বলেছে! কখন? কি বলেছে?

অপর্ণার বোধহয় মিতার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো কখনো, মানে যদ্দুর মনে পড়ছে ওরা একসঙ্গে কোথাও গিয়েছিলো। সেখানে অপর্ণা বোধহয় ওকে বলেছে যে তোরা কোথাও বেড়াতে যাসনি আজ পর্যন্ত, তো সেই কথাগুলোই যাচাই করছিলো। এখন আমি কি বলতাম বলতো? আমি কতটুকু জানি তোদের সম্পর্কের ব্যাপারে, এই বিষয়ে তো তোর সঙ্গে আমার কখনো কোনো কথা হয়নি!

সৌমিক এর বিরক্ত লাগছিলো আরো, অপর্ণা মাঝে মাঝে বড্ড মূর্খামি করে ফেলে। এসব কথা ওর মিতাকে বলতে যাবার কি ছিল! ও খানিকক্ষন চুপ করে থেকে রবির দিকে তাকালো,

আর কি জিজ্ঞেস করছিলো তোকে? কোথাও বেড়াতে যাইনি তো কি হয়েছে? এটা থেকে ও কি খুঁজে বার করতে চায়?

রবি মাথা নাড়লো,

জানিনা! আমার নিজেরই এখন খারাপ লাগছে! মিতা বলছিলো কাল রাতে যে আমি ওকে বন্ধু ভাবিনা, এখন মনে হচ্ছে তুইও এটাই মুখে না বললেও মনে মনে ভাবছিস! আমার সমস্যাটা কোথায় বলতো, আমি মাঝখানে ফেঁসে আছি! তার চেয়ে এক কাজ কর না, দুজনে একদিন মুখোমুখি বসে কথা বলে নে! নিজেদের মধ্যে সব কিছু ক্লিয়ার করে নে, তোর সঙ্গে অপর্ণার সম্পর্ক যে স্বাভাবিক ওটা বুঝিয়ে দে ওকে! আমিও তাহলে এই দু নৌকায় পা দিয়ে রাখার টানা পোড়েন থেকে মুক্তি পাই! ও যদি বুঝে যায় যে তুই নতুন করে জীবন শুরু করে ফেলেছিস অপর্ণার সঙ্গে তাহলে ওরও এগিয়ে যেতে সুবিধা হবে জীবনে! মিছিমিছি ওর কৌতূহল জিইয়ে রাখতে চাইছিস কেনো?

মানে তুই চাইছিস আমি ওর সঙ্গে আমার আর অপর্ণার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবো? তুই কি পাগল নাকি!

অবাক হয়ে বললো সৌমিক, রবি আর কোনো কথা না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো।

রবি কে চুপ করে যেতে দেখে সৌমিক একটু অস্বস্তিতে পড়লো, হয়ত একটু বেশি খারাপ ভাবে বলে ফেলেছে ও। রবি ওর অনেক ছোটো বেলার বন্ধু, সারা জীবন ওর সব রকম বিপদে এগিয়ে এসেছে। এই যে সমরকে খোঁজার চেষ্টা, সেটাও রবি ছাড়া এক পাও এগোনো সম্ভব হতো না ওর পক্ষে, তাই ও যদি কিছু বলেও থাকে তার জন্যে অতোটাও বিরক্ত হওয়া উচিত ছিলো না ওর। আর আজ নাহোক কাল তো এই সত্যি গুলো সামনে আসবেই, শুধু অপর্ণা যাতে এক্ষুনি জানতে না পারে তার জন্যেই তো ও এটাকে চেপে রাখার চেষ্টা করছে। অপর্ণাকে নাকি ইদানিং মিতা এড়িয়ে চলছে, এটা অপর্ণাই বলছিলো একদিন, তাই এই কথাগুলো মিতার মাধ্যমে অপর্ণার কাছে পৌঁছে যাবে না এটা নিশ্চিত! সুতরাং মিতা জানলেও কিছু এসে যাবে না! সামনে একটা চার মাথায় মোড়, সেখানে এসে রবি বন্ধুর দিকে তাকালো,

এবার কোনদিকে?

সৌমিক অন্য মনস্ক ভাব থেকে বেরিয়ে এসে তাড়াতাড়ি সামনের দিকে আঙুল তুললো,

ডান দিকের রাস্তায় চল! এবার একটু জিজ্ঞেস করতে হবে কাউকে!

ওরা দুজনে যখন একে ওকে জিজ্ঞেস করে দীপার বাড়ির সামনে পৌঁছলো তখনও দীপা এসে পৌঁছয় নি! চিনতে যদিও বেশ অসুবিধা হয়েছিলো রাস্তাটা তবু সৌমিক ওকে ফোন করতে চায়নি, রবি কে বলেছিলো,

ফোন না করেই খুঁজি চল, যদি এখনও বাড়ি থেকে বেরিয়ে না থাকে তাহলে মা ফোনের কারণ জানতে চাইবে এক্ষুনি!

বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে গাড়িতেই বসেছিলো দুজনে, প্রায় আধ ঘণ্টা পরে দীপা এলো, তার হাতে ধরা মেয়ের হাত। ওদের দেখে চমকে গিয়ে অবাক হয়ে বললো,

আপনারা এখানে? কিছু হয়েছে নাকি? আমি তো এক্ষুনি বাড়ি থেকেই এলাম!

সৌমিক হাসলো, হাতে ধরা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

না, না বাড়িতে কিছু হয়নি! আমি অন্য দরকারে এসেছিলাম! আপনার মেয়ে নাকি?

দীপা ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, ওই পাড়ায় পরিচিত একজনের বাড়িতে স্কুল থেকে ফিরে থাকে, আমি ফেরার সময় নিয়ে ঢুকি! একা বাড়িতে রাখতে সাহস পাইনা!

সৌমিক গাড়ি থেকে নেমে এলো, গাড়িতে বসা রবির দিকে হাত দেখিয়ে বললো,

আপনাকেই সাহায্য করতে এনেছি ওকে, রবি কে চেনেন তো? ওকে আসলে আপনার হাজব্যান্ডের কথাটা বলেছিলাম, যদি আপনার টাকাগুলো কিছুটা উদ্ধার করা যায় তাই!

দীপা রবিকে খুব ভালো করেই চেনে, মাঝে মাঝেই রবি সৌমিকের কাছে আসে বাড়িতে। তাই চেনা মুখ দেখে দীপা যদিও হাসলো, তবু তার গলায় চিন্তায় স্বর ফুটলো,

উনি তো পুলিশে চাকরি করেন তাই না? স্যার! আমি চাইছিলাম না পুলিশ কেস হোক, তাহলে একটা টাকাও আমি পাবো না স্যার!

রবি গাড়ি থেকে নেমে এলো, দীপার দিকে তাকিয়ে বললো,

না, না কোনো কেস টেস নয় জাস্ট এমনি চেষ্টা করে দেখবো একটু! জানি আপনি অভিযোগ জানাতে ভয় পাচ্ছেন পাছে আপনার টাকা আটকে যায়! তাই দেখি একটু বাইরে থেকে চেষ্টা করে, যদি অভিযোগ না করে কিছু করা যায়!

দীপা খানিকটা স্বস্তি নিয়ে ওদের ডেকে ঘরে নিয়ে গেলো, ঘরে বসে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো সৌমিক। দারিদ্রের ছাপ থাকলেও সব কিছুর মধ্যেই রুচির ছাপ আছে, বোঝাই যাচ্ছে একসময় অবস্থা যথেষ্ট ভালোই ছিলো। দীপার চা খাবার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে রবি ওনাকে থামালো,

এখন আর চা খাবো না, এমনিতেও অনেকটা দেরি হয়ে গেছে! কতো গুলো প্রশ্ন করেই চলে যাবো, টাকাগুলো যদি উদ্ধার করে দিতে পারি তখন একদিন খেয়ে যাবো নিশ্চয়ই। আপাতত আপনি বসুন একটু এখানে!

দীপা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসলো, রবির দিকে তাকিয়ে বললো,

আচ্ছা, বলুন!

রবি গুছিয়ে বসলো,

আপনার স্বামী যে ব্যবসা করতেন পার্টনারশিপে সেটা আপনি জানতেন?

দীপা ঘাড় নাড়লো,

না, স্যার আমার ডিভোর্সের সময় ও ট্রাভেল এজেন্সি তে চাকরি করত। তবে আমি ওর খবর নিতে যখন বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন শুনেছিলাম যে ও ব্যবসা করবে বলে নাকি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে!

আপনি কি কোনোদিনও মেদনীপুরের বাড়িতে থেকেছেন? ওখানে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে আপনার?

রবির প্রশ্নে দীপা একটু চিন্তা করলো,

ওই দু একবার গিয়েছি মাত্র, চেনা জানা কেউ নেই! আসলে ওর তো অনেক ছোটো বেলায় বাবা, মা মারা গিয়েছিলো তাই ওখানের বাড়ি বন্ধই থাকতো! ও বিয়ের অনেক আগে থেকেই কলকাতায় থাকতো।

আপনার সঙ্গে তারমানে এখানেই পরিচয় হয়েছিলো তাই তো? প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন তো আপনি? মানে যদ্দুর শুনেছি আপনি সৌমিক কে এরকমই বলেছিলেন কিছু!

দীপা একটু অস্বস্তি নিয়ে আড়চোখে সৌমিকের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ স্যার! ওই স্কুলে যাতায়াতের পথেই পরিচয় হয়েছিলো, টুয়েলভে পড়তে পড়তে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম!

ডিভোর্সের কারণটা জানতে পারলেও বোধহয় একটু সুবিধা হতো! মানে যদি আপনার বলতে আপত্তি না থাকে,

দীপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রবি, দীপা ঘাড় নাড়লো,

আপত্তির কিছু নেই! আসলে ওতো ট্রাভেল এজেন্সি তে চাকরি করতো, খুব কম বাড়িতে থাকতো, কোনো দরকারে পাশে পেতাম না! বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম বলে বাড়ির লোকজনও যোগাযোগ রাখতো না। এই যে এতদিনের জন্যে চলে যেতো সেই ভাবে কোনো টাকা পয়সা দিয়ে যেতো না, একবার আমার মেয়ে অসুস্থ হয়েছিলো তখন টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল প্রায়! অথচ ছিলো না তা নয়, কিন্তু ভীষণ উল্টোপাল্টা খরচ করতো! যে যা বলতো সেটাই করতে শুরু করতো, এই করেই অনেক টাকা নষ্ট করতো মাঝে মাঝেই! এখন তো শুনছি কার পাল্লায় পড়ে ব্যবসা করবে বলে নাকি বাড়িই বিক্রি করে দিয়েছিলো। এইসব নিয়ে মাঝে মাঝেই ঝামেলা হতো, রাগারাগি হলে গায়েও হাত তুলতো মাঝে মাঝেই, তারপরে আর না পেরে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম! ও ও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেনি, অনেকদিন পরে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দিলো!

সৌমিক এর খারাপ লাগছিল, ও উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে দাঁড়ালো, এই সমস্ত পুলিশি জেরার ব্যাপারে ওর কোনো ইন্টারেস্ট নেই! ও শুধু সমরের সত্যি টা জানতে চায়! রবি দীপার দিকে তাকালো,

ট্রাভেল এজেন্সি তে ছিলেন বললেন তো উনি? অফিসটা কোথায় জানেন?

হ্যাঁ স্যার! দু এক বার গিয়েছি ডিভোর্সের আগে!

রবি উঠে দাঁড়ালো,

আজ আপাতত এই পর্যন্তই, পরে দরকার হলে আবার আসবো। ওই ট্রাভেল এজেন্সির অফিসের ঠিকানা টা দিন! আর আপনার হাজব্যান্ডের কোনো পরিষ্কার ফটো থাকলে দেবেন!

দীপার এনে দেওয়া ফটো আর ঠিকানা নিয়ে রবি বাইরে বেরিয়ে এলো, সৌমিক তখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। যাবার আগে সৌমিক দীপার দিকে তাকিয়ে বললো,

একটা কথা বলবো কিছু মনে করবেন না! বাড়িতে বলার দরকার নেই যে আমরা এখানে এসেছিলাম। মা একটু চিন্তা করেন তো সব ব্যাপারে তাই এসব থানা, পুলিশের ব্যাপার শুনলে ভয় পেয়ে যাবেন। এমনিতেই মা কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না সহজে, আপনি তাঁর সেই আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, তাই আমি চাইনা এখন উনি আবার আপনার ওপরে এসব থানা পুলিশের ঘটনায় বিশ্বাস হারান।

দীপা ঘাড় নাড়লো,

আপনি যা বলবেন তাই হবে স্যার! শুধু দেখবেন মাসীমা যেনো আমাকে চলে যেতে না বলেন!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩৮
কদিন ধরেই বিকেলে ফেরার পথে সুবোধ দাদু দের বাড়ি হয়ে ফিরবে মোটামুটি ঠিক করে নিলেও সুযোগ হচ্ছিলো না ঠিকমতো। মা কদিন আগে রাগারাগি করায় সৌমিক অপর্ণা কে বাইকে করে নিয়ে ফিরছে। অপর্ণা তাতে আপত্তি জানাতে পারেনি পাছে সৌমিকের কিছু সন্দেহ হয়। আজ হটাৎ করেই সুযোগ এলো, একটু বেলার দিকে সৌমিক মেসেজ করে জানিয়েছিল যে আজ তার ফিরতে দেরি হবে অপর্ণা যেনো চলে যায়।

তাই পাঁচটার ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই আজ অনেকটা আগেই বেরিয়ে পড়লো অপর্ণা, যাতে বাড়ি ফিরতে সময়ের হের ফের না হয়। তাহলেই আবার শাশুড়ির কৌতূহলের সৃষ্টি হবে, বিভিন্ন রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ওকে, অপর্ণা মনে মনেই খুশি ছিলো, একটা অটো কে হাত দেখিয়ে থামিয়ে উঠে পড়লো তাড়াতাড়ি।

অটোটা ওকে যেখানে নামালো, সেখান থেকেই ক্যাফেটা দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়িগুলোর মধ্যে থেকেই আলাদা করা যাচ্ছে সাদা রঙের বাড়িটাও। সামনের মিষ্টির দোকান থেকে এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে বাড়িটার দরজার বেল টিপলো অপর্ণা। দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তাকে অপর্ণা চেনে, ইনি সেই ভদ্রমহিলা যিনি বৌভাতের সকালে রত্নার ওপরে বিরক্ত হচ্ছিলেন। ওনাকে সামনে দেখে অপর্ণা একটু থতমত খেলো, এতক্ষনে মনে হচ্ছিলো সঙ্গে করে মিনতি মাসী কে নিয়ে এলেই বোধহয় ভালো হতো! মহিলা কে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপর্ণা একটু ইতস্তত করলো,

আমি ঋজুর স্ত্রী! মিনতি মাসী বলছিলো আপনারা কাছেই থাকেন, তাই…

এতক্ষনে ভদ্রমহিলা চিনতে পারলেন, তাড়াতাড়ি দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন,

এমা! আমি তো তোমাকে চিনতেই পারিনি! আসলে বৌভাতের দিন একবারই দেখেছি তো এসো, এসো, ঘরে এসো! মিনতি বলছিলো তুমি আমাদের বাড়িতে আসতে চেয়েছো, খুব ভালো লেগেছে আমার! আজকাল তো সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেখানে নতুন করে জোড়া লাগতে দেখলে খুব ভালো লাগে।

ভদ্রমহিলা দরজা খুলে এগিয়ে এলেন, অপর্ণার হাত ধরে স্বামীর কাছে নিয়ে গেলেন,

দেখো ঋজুর বউ এসেছে!

অপর্ণা এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলো ভদ্রলোক কে, উনি মাথায় হাত রাখলেন,

থাক, থাক! ছেলে বউ বাইরে, বুড়োবুড়িরা থাকি বুঝলে তো! মাঝে মাঝে এরকম কেউ খবর নিতে এলে ভালো লাগে। একসময় তো কলকাতায় আত্মীয় বলতে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনই ছিলো। ইদানিং বয়স হচ্ছে তো তাই আর আগের প্রজন্মের ঝগড়া এই প্রজন্মে এসে টেনে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করেনা। তোমার শ্বশুর কে অনেকবার বলেছি, যাঁর সঙ্গে অশান্তি তিনিই যখন নেই তখন আর এসব টেনে নিয়ে যাওয়ার দরকার কি! তবে সে শুনলে তো?

অপর্ণার সঙ্গে কথাবার্তার মাঝেই একজন বেশ বয়স্কা মহিলা বেরিয়ে এলেন, বয়স আশির অনেকটা বেশিই হবে প্রায়, তাঁকে দেখেই ভদ্রলোক হাত তুললেন,

মা! এদিকে এসো! দেখো কে এসেছে!

ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে চোখের ওপরে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে অপর্ণার মুখের দিকে তাকালেন, তাঁকে অচেনা ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক হাসলেন,

চিনতে পারলে না তো? তোমার নাত বউ গো, ঋজুর বউ বুঝলে! তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, তুমি মিনতি কে বলেছিলে না?

অপর্ণা তাড়াতাড়ি প্রণাম করলো, এই তাহলে সৌমিকের দিদা! মানে ঠাকুমার ভাই সুবোধ দাদুর স্ত্রী! এতক্ষনে উনিও বুঝতে পারলেন, হাত ধরে অপর্ণা কে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড় করালেন। অপর্ণার একটু খারাপ লাগছিলো, সুবোধ দাদুর বয়স আরো বেশি, প্রায় নব্বই এর কাছাকাছি, একদমই বিছানায় শয্যাশায়ী, উঠে বসার মতো ক্ষমতা নেই,অপর্ণা কে দেখে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুললেন। অপর্ণা কে ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর পেছন পেছন এগিয়ে আসা ভদ্রমহিলা হাসলেন,

অনেক দিন থেকে বাবা, মার তোমাকে দেখার ইচ্ছে বুঝলে! আসলে এখন তো দুজনেই বাড়িতে বন্দী, কোথাও বেরোতে পারেন না তাই কেউ এলে খুব খুশি হন। তোমার ঠাকুমা আর আমার শাশুড়ির একসময় ভীষণ বন্ধুত্ব ছিলো, দুই ভাই বোনে একসঙ্গে থাকবেন বলে জমি কিনে ছিলেন এখানে! কিন্তু সে আর হলো কই! তা তোমার জা এলো না কেনো? তাকেও তো বলেছিলাম একবার আসার জন্যে! এঁরা একটু দেখতে চান, কবে আছেন কবে নেই! একটু ঘুরে যেতে বোলো তাকে!

সেদিনের দেখা দৃশ্য মনে পড়লেই অপর্ণার মহিলাকে ভয় ভয় লাগে, সে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো,

বলবো দিদিভাই কে! ও ও আসবে তাড়াতাড়ি!

দিদা অপর্ণা কে কাছে ডাকলেন, খুব মৃদু গলায় বললেন,

বসো এখানে, একটু গল্প করি! একসময় কতো গিয়েছি তোমাদের বাড়িতে, এখন ভাবলেই মন খারাপ লাগে! আমার ননদ কে তো দেখোনি সে খুব জেদী মানুষ ছিলো, তার জেদেই সব কিছু নষ্ট হয়ে গেলো। তোমার দাদু খুব ভালো মানুষ ছিলেন, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আজ সব কিছু অন্য রকম হতো!

বয়স্ক মানুষেরা গল্প করতে ভালো বাসেন, কিছুক্ষনের মধ্যেই দিদা অপর্ণার বাড়ি, বাবা, মা শ্বশুরবাড়ির সব গল্প শুনে ফেললেন। শাশুড়ি কে গল্প করতে দিয়ে ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কিছুক্ষন পরে হাতে মিষ্টির প্লেট হাতে ঢুকে এলেন। অপর্ণা এগিয়ে দেওয়া প্লেট দেখে একটু ইতস্তত করছিলো, তাকে ইতস্তত করতে দেখে মহিলা হাসলেন,

খেয়ে নাও! বাড়িতে আমরা সবাই বয়স্ক, মিষ্টি এনে দেবারও কেউ নেই! নেহাত রান্নার মেয়েটা ছিলো বাড়িতে তাই আজ তোমাকে এনে খাওয়াতে পারলাম, পরের বার পারবো কিনা জানিনা! ও না থাকলে খালি মুখেই ফিরতে হতো!

ওনার ছেলে বাইরে থাকে শুনেছিলো ঋজুর মুখে, চারজন বয়স্ক মানুষ একা একা থাকেন ভেবে অপর্ণার খারাপ লাগছিলো। বয়স্ক মানুষ একা থাকেন দেখলেই ওর নিজের বাবা মায়ের কথা মনে হয়, সেই ভাবনা থেকেই ও মিতার বাবার অসুস্থতার সময়ে নিজের ফোন নম্বর দিয়েছিলো। আজও তার একই রকমের অনুভূতি হলো, ভদ্র মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

কাকিমা! কোনো দরকার হলে মিনতি মাসী কে দিয়ে বলবেন! আমরা তো কাছেই থাকি!

ভদ্র মহিলা হাসলেন,

ওই মিনতি আছে সেটাই ভরসা! ওকেই ডাকি সব দরকারে! আজ তুমি নিজে থেকে বললে, খুব খুশি হলাম! তোমরা ছাড়া আর কেই বা আছে আমাদের এখানে, এক সঙ্গে থাকবো এই ভরসাতেই তো বাবা, মা এখানে এসেছিলেন তখন। আজ যদি সব ঠিক থাকতো, তাহলে ঋজু, ঋষিই তো আমার সবচেয়ে বল ভরসার জায়গা হতো! কিন্তু সেসব আর হলো কই, একটা বাইরের লোকের জন্যে তো তোমাদের ঠাকুমা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে ফেললেন! কে পর, কে আপন সেটা একবারের জন্যেও ভাবলেন না! মানুষ নিজের স্বার্থের জন্যে কতো নিচে যে নামতে পারে তা তোমার ঠাকুমাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না!

ছেলের বউয়ের মুখ একটু বরাবরই বেশি তাই তাকে থামাতে তার শাশুড়ি মৃদু গলায় বললেন,

আহ্ বৌমা! এসব কথা এই ছোটো মেয়েটা কে বলে লাভ কি! ওরা তো নতুন এসেছে এখানে, ওদের ঠাকুমার দোষের ভাগীদার কি ওরা হবে?

ভদ্র মহিলা নিজেকে সামলে নিয়ে উল্টোদিকের সোফায় বসলেন,

সে আপনি ঠিকই বলেছেন মা, ওকে এসব বলা আমার উচিত হচ্ছে না! ইচ্ছে করলে তো ওর শ্বশুর সবটা ঠিক করে নিতেই পারতো আস্তে আস্তে, কিন্তু সে শুধরালে তো!

অপর্ণা মনে মনে আশ্চর্য্য হচ্ছিলো, একজন অসহায় মানুষ কে আশ্রয় দেবার পেছনে কি স্বার্থই বা থাকতে পারে! এটা তো মানবিকতার নিদর্শন!রীতা পিসিকে এখানে থাকতে দিয়ে ঋজুর ঠাকুমার ঠিক কি স্বার্থ চরিতার্থ হয়েছে সেটা জানার জন্যে অপর্ণার মন ছটফট করতে লাগলো। আরো কিছু নতুন তথ্য পাওয়ার আশায় অপর্ণা মৃদু গলায় বললো,

বাবা কিন্তু খুব নির্বিরোধী মানুষ কাকিমা, কোনো সাতে পাঁচে থাকেন না! এসব হয়ত ঠাকুমা করেছিলেন কোনো সময়ে কিন্তু এতে বাবার কোনো হাত নেই! বাবা কখনো কাউকেই কিছু বলেন না, নিজের মাকেও হয়ত মুখ ফুটে বলতে পারেন নি তখন! তবে ঠাকুমা কে আমি দেখিনি কখনো তাই উনি কেমন মানুষ ছিলেন আমি জানিনা!

এতক্ষন ছেলের বউয়ের বলা কথাকে থামাতে চেষ্টা করলেও, অপর্ণার কথায় এবার উনিই উত্তেজিত হলেন,

তোমার শ্বশুর ভালো মানুষ? তোমরা তো সেদিনের মেয়ে, তার আসল রূপ দেখবে কি করে! ওই বউকে সে মায়ের কথায় কতো কষ্টই না দিয়েছে! তাকে পিষে মারার চেষ্টা করেছে মা ছেলে মিলে, নেহাত সে দাঁত, মুখ খিঁচিয়ে পড়ে ছিলো তাই! আর যেতোই বা কোথায়? যাবার জায়গা নেই, পাশে দাঁড়ানোর কেই নেই বলেই তো ওরা মা ছেলেতে এরকম করার সাহস দেখাতে পারতো! কতো বুঝিয়েছি আমার ননদ কে, সে কোনো কথায় কান দেয়নি! তবে নন্দাই আমার ভালো মানুষ ছিলেন, তাঁর দিক থেকে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা ছিলো। কিন্তু সে চলে যেতেই তো আমার ননদ সাপের পাঁচ পা দেখলো।

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

আমি ঠাকুমা সম্বন্ধে তো কিছুই জানিনা, ঋজুরা মনে হয় ওনাকে ঠিক পছন্দ করেনা, তাই আমিও কখনো জানতে চাইনি কিছু!

এবারে ভদ্র মহিলা বিরক্ত গলায় বললেন,

মা তো তাও রেখে ঢেকে বলছেন, আমি অতো ভেবেচিন্তে কথা বলতে পারিনা কখনো! আমাদের পরিবারে আমার দূর্মুখ বলে বেশ বদনাম আছে বুঝলে! আমি স্পষ্ট কথার মানুষ, তাতে আমাকে লোকে খারাপ ভাবলেও কিছু যায় আসেনা। ওই ঠাকুমা কে পছন্দ করার মতো ঠিক আছেটা কি? সারাজীবন যদি ছেলে মেয়েরা দেখে ঠাকুমা মাকে বাজে বাজে কথা বলছে, একটা বাইরের মেয়েকে ঘরে তুলে বউ থাকতে তার হাতে সংসার তুলে দিচ্ছে তবে তো তারা ঠাকুমা কে অপছন্দই করবে তাই না!

অপর্ণা অবাক হলো,

বাইরের লোকের হাতে সংসার তুলে দিয়েছিলেন মানে?

মানে ওই অলক্ষী মেয়েটা! ওই তো সংসারে গিন্নি ছিলো, তোমার শাশুড়ি তো একঘরে হয়ে থাকতো! আশে পাশের লোকেরাও জানতো ও বাড়িতে গিন্নীর পরেই ওই মেয়েটার কথাই সব! ওই তো সম্পর্কগুলো কে নষ্ট করে দিলো! ওই মিনতির মা তো তোমাদের বাড়িতে কাজ করতো একসময়, ওর সঙ্গেও কি খারাপ ব্যবহার! শেষে কাজই ছেড়ে দিলো। ওই তো এসে বলতো এখানে যে বাড়িতে আমারই মতো বাইরের লোক গিন্নি পনা করে, সেখানে কাজ করতে পারবো না!

অপর্ণা মিষ্টির প্লেট তুলে নিয়ে মৃদু গলায় বললো,

কিন্তু মিনতি মাসী তো আমাদের বাড়ি কাজ করে এখনও? ওকে তো কখনো কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া হয়নি!

দিদা হাসলেন,

সেতো অনেক পরের কথা মা, যখন তোমার শাশুড়ির হাতে সংসার এলো তখন তো মিনতির মা কে বলে ওকে কাজে ঢোকালো বৌমা! তার আগেই ওই মেয়েটা কে বিদায় করেছিলো সে!

আপনি বোধহয় রীতা পিসির কথা বলছেন, তাই না?

অপর্ণার প্রশ্নে মহিলা অপর্ণার দিকে তাকালেন, গলায় ঘেন্না এনে বললেন,

রীতা পিসি! সে আবার পিসি হলো কবে থেকে! যতো সব শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা!

অপর্ণা মনে মনে চমকালো, ভদ্রমহিলার কথার নিহিত অর্থ অনুধাবনের চেষ্টায় ওনার দিকে তাকিয়ে বললো,

হ্যাঁ, মানে ঋজু, দাদা, দিদি এরকম বলেই ডাকে তো, তাই বললাম! যদিও উনি ওদের নিজের পিসি নন, তাও ওরাতো এরকমই বলে ডাকে সবাই!

মহিলা বিরক্ত গলায় বললেন,

হুঁ, ঐসব ডেকে তো আসল সত্যি ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা! ওই মহিলা যা কুট ছিলেন!
ওই মেয়েটা কে নাকি আশ্রয় দিয়েছেন! আশ্রয় না ছাই, ওসব শয়তানি বুদ্ধি! শুধু বউকে জব্দ করার চেষ্টা! দিব্যি ভদ্র, সভ্য ছেলের সঙ্গে সংসার করছিলো, হটাৎ নাকি সে এতো খারাপ হয়ে গেলো যে তার সঙ্গে আর ওই মেয়ে থাকতেই পারলো না! গোটা গ্রামের লোক বলেছিলো, কেউ চায়নি ওই রীতা শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে আসুক! এমনকি ওর দাদারাও কতো বুঝিয়েছিল ওকে তো সে মেয়ে শুনলে তো! তার তো তখন মাথায় হটাৎ বড়লোক হওয়ার ভুত চেপেছে! ওসব গরীব ঘর তখন আর ভালো লাগবে কেনো?

অপর্ণা অবাক হলো, মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,

কিন্তু কাকিমা, আশ্রয় পেলেই তো আর কেউ বড়লোক হয়ে যায়না! তাই রীতা পিসি এটা কি করে ভাবলেন যে উনি এই বাড়িতে থাকলেই বড়লোক হয়ে যাবেন? আর এটা কিন্তু আমিও শুনেছি যে উনি বেশ ভালোই থাকেন এখন! মানে বেশ স্বচ্ছল জীবন যাপন করেন! কি করে সম্ভব হলো এটা কে জানে? এখন তো আর ঠাকুমাও বেঁচে নেই! ঠাকুমা কি ওনার জন্যে কিছু টাকা পয়সা রেখে গিয়েছিলেন?

ভদ্র মহিলা বিরক্তিতে মুখ বেঁকিয়ে তাকালেন,

ঠাকুমা টাকা পয়সা দিয়ে গেছো কিনা জানতে চাও? তিনি তো তাঁর ছেলেকেই দিয়ে গেছেন ওই মেয়েকে! সারাজীবন তো তার পেছনেই সব গেলো তোমার শ্বশুরের! কতো আর বলবো! বউ কে জব্দ করতে যে কেউ ইচ্ছে করে অসভ্যতা কে প্রশ্রয় দেয়, তা প্রথম দেখলাম! সারা জীবন তো ওই মেয়ে ঘরে বসে ছেলের সঙ্গে নোংরামি করে গেছে আর উনি সেটাকে উস্কে গেছেন!

অপর্ণা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েছিলো, এই অভিযোগের কতোটা সত্যতা আছে, মনে মনেই তা বিচার করার চেষ্টা করছিল। দিদা হাত তুলে ছেলের বউকে থামিয়ে দিলেন, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললেন,

তোমরা অনেক বড়ো হয়েছো, জানি এসব শুনতে তোমাদের ভালো লাগবে না! আসলে এসব দেখতে অভ্যস্ত নই তো তাই অনেক দুঃখে বেরিয়ে আসে! তবে একটা কথা কি জানো মা, আমিও আশি পেরিয়ে গেছি, তাই এই বয়সে এসে মানুষের পাপ পুণ্যের বিচার করতে আর ইচ্ছে করেনা! তবু বিশ্বাস করি মানুষ কে তাঁর পাপ পুণ্যের হিসাব এই জন্মেই মিটিয়ে যেতে হয়, পরজন্ম বলে কিছু হয়না। আমার ননদ শেষ জীবনটা বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছে, চলেও গেছে খুব কষ্ট পেয়ে। অথচ আমার স্বামীর থেকে মাত্র ছয় বছরের বড়ো ছিলো তাই অতো তাড়াতাড়ি যাবার বয়স তার ছিলো না! যে বউকে অতো অপমান করেছে, তারই হাতের এক গ্লাস জলের জন্যে হা পিত্যেশ করে বসে থাকতো, নাতি নাতনিরা তো ফিরেই তাকাতো না। শাস্তি সে কম পায়নি, আর তার ছেলেকেও দেখো! দিব্যি সুস্থ সবল মানুষ, বিয়ের রাতে পড়ে গিয়ে একেবারে পঙ্গু হয়ে গেলো প্রায়, ঘর থেকে বেরোনোর ক্ষমতাই তার নেই। এবার শুধু ওই মেয়ের শাস্তি দেখা টা বাদ রয়ে গেছে! ওটা হয়ত আমি দেখে যেতে পারবো না, তবে বিশ্বাস করি সেও তার উপযুক্ত শাস্তি পাবে একদিন!

এই কথার পরে বাড়ির পরিবেশ একদম থমথমে হয়ে গেলো কিছুক্ষনের জন্যে, তারপরে কাকিমা নিজেই কথা ঘুরিয়ে দিলেন। যদিও অপর্ণার ভালো লাগছিলো না আর, এ কি শুনলো সে! ওতো শুধুমাত্র ব্ল্যাকমেলের কারণ জানতে চেয়েছিলো, সেই জিজ্ঞাসার উত্তরে ওকে কোন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই উঠে দাঁড়ালো অপর্ণা, ভবিষ্যতে যেকোনো প্রয়োজনে ওকে যেনো ওঁরা ডাকেন এটা জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো, মনটা বড্ড অস্থির লাগছে!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৩৯
গত দিন কয়েক ধরে একদম অস্থির লাগছে অপর্ণার, বাড়ির কোনো কাজে মন বসছে না। যতো বার বিকেলের চা নিয়ে ও শ্বশুরের সামনে গিয়েছে ততবারই ভেতরটা যেনো ঘেন্নায় ভরে উঠছে। এই ভদ্র চেহারার পেছনের মানুষটার এই রূপ!

বরাবরের স্পষ্টবাদী অপর্ণার পক্ষে এরকম ঘটনা জানার পরে চুপ করে থাকা যদিও অসম্ভব ছিলো তবু সে কিভাবে যে নিজেকে সংযত রেখেছে, সে নিজেই অবাক হয়েছে। মনে মনে ভেবেছে অপর্ণা, আজ যদি ও সেই বিয়ের আগের অপর্ণা হতো তাহলে এতক্ষন ও নিজেকে সামলে রাখতে পারতো না, মুখ দিয়ে কিছু কড়া কথা বেরিয়েই যেতো। নিজেই অবাক হয়েছে নিজের কথা চেপে রাখার ক্ষমতা দেখে! মায়ের ভাষায় তার মানে ও সত্যি পরিণত হয়ে উঠেছে এতদিনে! এতো নোংরামি জেনেও ও চুপ করে আছে! মেনে নিতে এবং মানিয়ে নিতে কি শিখে যাচ্ছে ও!

সব সময় এতো অন্যমনস্ক ভাব নিয়ে ঘোরার জন্যে বেশ কয়েকবার শাশুড়ির কাছে বকুনিও খেয়েছে অপর্ণা, যদিও সেসব বকুনিও তাকে স্পর্শ করছে না খুব একটা। যেদিন ও সুবোধ দাদুদের বাড়িতে গিয়েছিলো সেদিন সৌমিকেরও বাড়ি ফিরতে অনেকটা রাত হয়েছিলো, বাড়ি ফিরেও মায়ের জিজ্ঞাসার উত্তরে সে কোথায় গিয়েছিলো এ ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট উত্তর দিতে না পারায় শাশুড়ি ছেলের ওপরে রেগে রয়েছেন। সেই রাগের প্রকাশের পরেও সৌমিকের কোনো হেলদোল না থাকায় শাশুড়ির রাগ গিয়ে পড়েছে অপর্ণার ওপরে। সৌমিক কোথায় গিয়েছিলো সে ব্যাপারে অপর্ণা কে প্রশ্ন করায় ও মাথা নেড়ে ছিলো,

আমি জানিনা!

শাশুড়ি আরো রেগে গিয়েছিলেন,

কেনো জানো না? তোমার স্বামী কোথায় যায়, কি করে তার খোঁজ কি তোমার রাখা উচিত নয়? অতো রাত পর্যন্ত ও কোথায় ছিলো সেটা জিজ্ঞেস করো নি কেনো?

অপর্ণা একটু অবাক হয়েছিলো,

বলেছিলো তো আসতে দেরি হবে! নিশ্চয়ই কোনো কাজ ছিলো! এটা আবার কি জিজ্ঞেস করবো? ওর অফিসের ব্যাপারে আমি কি জানি!

রীনা বিরক্ত হয়েছিলেন,

অফিসের কাজ ছিলো, এটা তোমাকে বলেছে ও? নাকি নিজে নিজেই ভেবে নিয়েছো!

অপর্ণা অস্বস্তিতে পড়েছিলো, জানিয়েছিল সে আন্দাজ করেছে মাত্র! অপর্ণার নির্লিপ্ত ভাব দেখে শাশুড়ি বিরক্ত হয়েছিলেন,

যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই, আমার হয়েছে যতো জ্বালা! কোথায় গিয়েছিলো জিজ্ঞেস করো ওকে, আমাকে জানাবে জিজ্ঞেস করে!

বাধ্য হয়েই পরের দিন রাতে অফিস থেকে ফিরলে সৌমিক কে জিজ্ঞেস করেছিলো অপর্ণা, জানতে চেয়েছিল সেদিন সে কেনো দেরিতে ফিরেছে, কোথায় কাজ ছিলো তার। সৌমিক অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো,

এ আবার কি কথা! তুমি কি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো নাকি! কাজ ছিলো তাই দেরি হয়েছে, সেটা অফিসের কাজ না বাইরের এতো কথায় তোমার কাজ কি? আমি তোমাকে আগেও বলেছি, অহেতুক কৈফিয়ত দিতে আমার ভালো লাগে না!

অপর্ণা চোখে জল এসে গিয়েছিলো,

আমি চাইনি! তোমার মা চাইছে! আমি কেনো তোমাকে জিজ্ঞেস করছি না সেটা আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছে! আমি এসবের মধ্যে থাকতে চাইনা, সব ব্যাপারে আমাকে মাঝখানে নিয়ে আসো কেনো? এমনিতেই উনি আমার ওপরে বিরক্ত হয়ে আছেন, তার মধ্যে এতো কথা আমার ভালো লাগছে না! তুমি ওনার সঙ্গে গিয়ে কথা বলো, জানাও তুমি কোথায় গিয়েছিলে।

সৌমিক অপর্ণার চোখে জল দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো,

কি এমন বললাম যে তোমার এতো খারাপ লাগলো! মা কেনো রেগে আছে তোমার ওপরে? আবার কি হয়েছে?

অপর্ণা খাটে বসে পড়েছিলো,

তুমি তো সারাদিন ব্যস্ত থাক, আমার কথা শোনার সময় কোথায়? মাকে যখন পায়ে প্লাস্টার করাতে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম তখন রবীন কাকুর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো বলেছিলাম তোমাকে, মনে আছে? আমি ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম, সেই ফাঁকে উনি মাকে বলেছেন আমি নাকি সমরের সঙ্গে রেজিষ্ট্রি করেছিলাম! মা প্রচণ্ড রেগে গিয়েছেন, বলছেন আমার বাবা, মা সবটা লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে ওনাকে ঠকিয়েছেন!

সৌমিক মনে মনে চমকে উঠেছিলো, একই কথা তো রবীন বাবু সেদিন রবিকেও ফোনে বলছিলেন! এই ভদ্রলোক মাকেও এটা বলেছেন! মাথাটা প্রচণ্ড গরম হয়ে গিয়েছিলো সৌমিকের, রবীন বাবু কে সামনে পেলে ও কিছু বলবেই, লোকটাকে কিছুতেই ছেড়ে দেবে না! ও এগিয়ে এসে অপর্ণার মাথায় হাত রেখেছিলো,

বলোনি কেনো আমাকে? এতো তারমানে অনেকদিন আগের ঘটনা! এগুলো যে সত্যি নয় সেটা মাকে বলেছো? তোমার বাবা, মা না বললেও তুমি যে আমাকে বলেছো, এটা অন্তত মাকে বলতে পারতে তো?

অপর্ণা চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিলো,

বলেছিলাম, কিন্তু মা বিশ্বাস করেন নি বোধহয়! আমি তো রবীন কাকুর সঙ্গেও কথা বলাতে চেয়েছিলাম! মা বললেন, ওপর দিকে থুথু দিলে নিজের গায়েই পড়ে! এসব কথা জানাজানি হয়ে আমার সম্মান নষ্ট হলে নাকি ওনার সম্মান নষ্ট হবে! তাই আমি বলেছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলিয়ে সবটা ক্লিয়ার করবো ওনার কাছে! কিন্তু তোমার আমার জন্যে সময় কই! কখন বলবো তোমাকে এসব! কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই যদি তোমার মনে হয় আমি কৈফিয়ত চাইছি, তাহলে তো আর কোনো আলোচনা করার সুযোগই থাকে না!

সৌমিক পাশে এসে বসেছিলো, অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,

ঠিক আছে, আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলে নেবো!

সৌমিক নিজেই মায়ের সঙ্গে কথা বলে নেবে এটা শাশুড়ি কে জানানোর পর থেকেই রীনা আরো বিরক্ত হয়ে আছেন তার ওপরে, বুঝতে পারছে অপর্ণা, কিন্তু এতো কিছুর পরেও এই প্রথম বার খুব বেশি রাগ হচ্ছে না তার। বরং মনের মধ্যে শাশুড়ির জন্যে কোথাও খারাপ লাগা তৈরি হচ্ছে, মনে হচ্ছে ওনার রাগ, ক্ষোভ প্রকাশের জায়গা নেই বলেই হয়তো উনি সারাক্ষন কঠিন হয়ে থাকেন।

এই সব ভাবনা চিন্তার মধ্যেই আজ সকালে ঘটনাটা ঘটলো। সকালের চায়ের পর্ব মিটতে মিটতেই মিনতি মাসী আসে, আজও যথারীতি তাই এসেছিলো সে। সৌমিকের সঙ্গে না বেরোলে যদি আবার শাশুড়ি বিরক্ত হন, সেই ভাবনা থেকেই মাসী কে দরজা খুলে দিয়ে অপর্ণা তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে চলে এসেছিলো তৈরি হতে, মোবাইলটা নিচের বসার ঘরে থেকে গেছে খেয়াল করেনি।

খেয়াল হতে অপর্ণা দৌড়ে নীচে নামলো, বসার ঘরের টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে সে যখন ফেরত আসছিলো তখন মিনতি মাসী শাশুড়ির ঘর মুছে বেরিয়ে এলো, তার হাতের মুঠোয় ধরা একটা খাম। অপর্ণা কে সামনে দেখেই মিনতি যদিও খামটা আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো, তবু অপর্ণা লক্ষ্য করলো ব্যাপারটা। খামটা লুকিয়ে ফেলতে দেখে ওর আরো সন্দেহ হলো, খামটা যেহেতু সে ঘর থেকে হাতে নিয়েই বেরিয়েছে সেহেতু এটা শাশুড়ি ওর হাতে দিয়েছেন সেটা বুঝতে পারছিলো অপর্ণা। অপর্ণা কোনো রাখঢাক না করেই আঙুল তুলে খামটার দিকে ইঙ্গিত করলো,

ওটা তোমার হাতে কি? কিসের খাম মাসী?

মিনতির লুকিয়ে রাখার খুব বেশি আর উপায় ছিলো না, সে একটু থতমত ভঙ্গিতে খামটা আঁচল সরিয়ে সামনে নিয়ে এলো,

এটা? এটা দিদি দিলো, একজনকে দিতে হবে।

ইতিমধ্যে অপর্ণার গলার আওয়াজে রত্না বেরিয়ে এসেছিলো, মিনতিকে আঁচলের আড়াল থেকে খাম বার করতে দেখে কৌতুহলী হয়ে বললো,

ওমা! মা দিয়েছে তো ওরকম লুকিয়ে রেখেছ কেনো? দেখি, কি আছে এতে!

মিনতি অস্বস্তিতে পড়লো, রত্নার দিকে খামটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

টাকা আছে!

রত্না সবে মাত্র হাত বাড়াতে যাচ্ছিলো, তার আগেই রীনা ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠলেন,

সব কিছুতেই কি তোমার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে? তুমি দুদিনের জন্যে এসেছো, সব ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে ফেলো কেনো?

এই মায়ের কথায় কথায় দুদিনের জন্য এসেছো বলা রত্নার খুব খারাপ লাগে সেও রাগে চিৎকার করে উঠলো,

সব কথাতে এতো অপমান করো কেনো? কি এমন বলেছি মাসী কে? তোমার টাকা তুমি কাকে দাও আমি জিজ্ঞেস করেছি কখনো! অপর্ণা জিজ্ঞেস করলো তাই আমি দেখতে গিয়েছিলাম! তোমার বাড়ির ব্যাপারে মাথা ঘামাতে আসিনি!

রত্নার গলার আওয়াজ দোতলা পর্যন্ত পৌঁছলো, একটু পরেই ঋষি এবং সৌমিক দুজনেই সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালো। ঋষি রত্নার দিকে তাকিয়ে কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় রত্না বিরক্ত হলো,

কি আর হবে! সামান্য মিনতি মাসী কে জিজ্ঞেস করেছি খামে কি আছে, তাই মায়ের এতো রাগ! আমি কি মাসীকে এটুকু কথাও বলতে পারবো না ঋষি?

ঋষি দু ধাপ নিচে নেমে এলো, তারও অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু যেহেতু দিদি তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে তাই এই মুহূর্তে তার কিছু করার ছিলো না। সে দিদির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,

আরে নারে দিদি! মা অতো ভেবে কিছু বলেনি, তুই মিছিমিছি রাগ করছিস!

রত্না সন্তুষ্ট হলো না, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

থাক, জানি তুই মায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলবি না! আমিও মাকে ভালোবাসি ভাই, তবে অন্ধ সমর্থন করিনা!

ঋষি থতমত খেয়ে ওপরে দাঁড়ানো ভাইয়ের দিকে তাকালো, তার কোনো ব্যাপারে ডিসিশন নেবার ক্ষমতা কখনোই ছিলো না, সে বরাবরের নির্বিরোধী মানুষ। দাদা কে তার দিকে তাকাতে দেখে সৌমিক নিচে নেমে এলো, মিনতির দিকে ইশারা করলো চলে যাবার জন্যে, মিনতি তাড়াতাড়ি বালতি হাতে যেতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। সৌমিক খাটে বসা মায়ের দিকে তাকিয়ে দিদিকে ইশারা করলো,

মা পা ভেঙে বাড়িতে বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে বুঝলি, তাই সবার ওপরেই রেগে আছে। দেখিস নি আমি দেরি করে সেদিন ফিরেছিলাম বলে আমার সঙ্গেও কথা বলছে না। সামনের সপ্তাহে প্লাস্টার খুললেই মাকে মেজো মাসীর বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে কদিন, তাহলেই মায়ের রাগ কমে যাবে।

রত্না হেসে ফেললেও রীনা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন,

হ্যাঁ তোমরা তো বেঁচে যাও আমাকে তাড়াতে পারলে, যা খুশি করবে কেউ কিছু বলার থাকবে না তোমাদের!

সৌমিক দিদির দিকে ইশারা করলো,

যা ঘরে যা, মায়ের কথা ধরিস না!

দাদা, দিদি চলে যাবার পরে সৌমিক মায়ের ঘরে ঢুকে এলো, দরজা বন্ধ করে খাটে বসে বললো,

আমার আর অপর্ণার ওপরে রাগ, দিদির ওপরে দেখাচ্ছো! রজত দা আছে সেটা ভুলে যাচ্ছো বারবার!

রীনা মাথা নাড়লেন,

নাহ! আমার কারোর ওপরে রাগ নেই! আমি মিনতিকে কি দিয়েছি, সেটা ও জানতে চাইছে! ওর সব ব্যাপারে বড্ড কৌতূহল!

সৌমিক হাসলো,

সেটাই তো স্বাভাবিক মা! অপর্ণাও তো জানতে চেয়েছিলো! মিনতি মাসী যদি ওটা লুকিয়ে না রাখতো তাহলে কেউ জানতে চাইতো না, লুকিয়ে রাখতে দেখেই সবারই কৌতূহল হয়েছে! এই যে আমি কোথায় গিয়েছিলাম তোমাকে বলেছিলাম না বলে তো তোমার বারবার জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না?

রীনা মাথা নাড়লেন,

না, আমি আর জানতে চাইনা! বুঝেছি তুমি বিরক্ত হয়েছো। তোমরা সবাই এখন বড়ো হয়েছো, অনেক কথাই তো বলো না আমাকে!

সৌমিক মায়ের দিকে তাকালো,

অনেক কথা মানে কি কথা বলছো সেটা আমি জানি! অপর্ণা যে আমাকে ওর পুরনো সম্পর্কের ব্যাপারে জানিয়েছিল, সেটা আমি তোমাকে জানাই নি, এই তো?

রীনা ছেলের মুখের দিকে তাকালেন,

এটা বলা কি তোমার উচিত ছিলো না আমাকে? যদি জানতাম তাহলে আজ বাইরের কারোর মুখ থেকে শুনে এতটা খারাপ লাগতো না!

সৌমিক হাসলো,

প্রথম কথা যদি তুমি জানতে তাহলে কি বিয়েটা হতে দিতে? নিশ্চয়ই দিতে না! এটা তে তো অপর্ণার কোনো দোষ নেই, কেউ যদি খুন হয়ে যায় তাতে ওর কি করার থাকতে পারে বলো?

রীনা হাত তুললেন,

দোষ বলিনি তো, কিন্তু ওর বাবা, মার কি জানানো উচিত ছিলো না আমাদের! তাহলে অন্তত এটুকু তো ভালো লাগতো ভেবে যে আমাদের কেউ ঠকায় নি!

ঠকানোর কথা কি করে এলো এখানে? যদি তাই বলো তাহলে তো এই ছেলেটি মারা গিয়েছে মানে আর ফিরবে না, কিন্তু মিতার কথা গোপন করে রেখে আমরাই ওদের ঠকিয়েছি! কারণ মিতা সব সময় আমাদের পাশের বাড়িতে থাকবে! অপর্ণা তবু বলেছিলো আমাকে কিছু, কিন্তু আমি তো সেটুকুও বলিনি!

সৌমিক এর কথায় রীনা একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন,

আমি জানতাম তুমি একবার আমাকে কথা দিয়েছো মানে বিয়ের পরে তুমি অপর্ণার সঙ্গে এমন কিছু করবে না যাতে ওর খারাপ লাগে, সেই কনফিডেন্স থেকেই কিছু বলার প্রয়োজন মনে করিনি! কিন্তু ওর ব্যাপারটা অন্য! এই যে বিয়ের সময় তোমার বাবা পড়ে যাওয়ায় সবাই ওকে নিয়ে কথা বলছিলো এটা তো আমারও ভালো লাগেনি। ওনারা যদি একটু বলে দিতেন তাহলে হয়তো আমরা একটা পুজো করে নিতে পারতাম!

সৌমিক হাসলো,

আমি জানি তুমি এসব বিশ্বাস করো না, সেই জন্যেই অপর্ণার কুষ্টি মিলিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করো নি! সেই তুমি হটাৎ লোকের কথা ধরতে গেলে কেনো? আর কেনোই বা পুজো করতে গেলে পরে! ওকে তো বাড়িতেও পাঠিয়ে দিয়েছিলে, ও নেহাত থাকলো না তাই! বাবার এই ঘটনার জন্যে যদি ও দায়ী থাকে তাহলে তো আমারও দায়ী হওয়া উচিত, কারণ বিয়ে তো দুজনেরই হয়েছিলো। এই কথাগুলো তুমি পাড়ার লোক কে বলতে পারতে!

রীনা চুপ করে থেকে বললেন,

পাড়ার লোকের মুখ বন্ধ করার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু ওর মাকে বৌভাতের রাতে আমি বলেছিলাম, যে বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন এসব নিয়ে না ভেবে একটা পুজো করিয়ে নিলেই হবে। সেটাই করেছিলাম, আর তুমি তো ওকে ফিরিয়ে নিয়েই এসেছিলে আমার কথা তো শোনো নি! তাই ওটা নিয়ে আর বোলো না! তবে তোমার ওপরে আমার যে কনফিডেন্স ছিলো সেটা সত্যি কমে আসছে কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার অজান্তে অনেক কিছু করছো!

সৌমিক মায়ের হাতের ওপরে হাত রাখলো,

আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে তবু একটা কথা না বলে যেতে পারছি না! আমি জানি তুমি ভাবছো আমি লুকিয়ে মিতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি কিন্তু সেটা একদম ভুল ভাবনা! তোমাকে জানাইনি কিছু কারণ আমার ধারণা ছিলো তুমি অপর্ণার ওই পুরনো বন্ধুর ব্যাপারে কিছু জানো না। এখন যখন সবটাই জানো তখন বলছি আমি ওই ছেলেটার খুনি কে খুঁজছিলাম, কিন্তু যা বুঝতে পারছি ছেলেটা ভালো ছিলো না, ও অপর্ণাকে ঠকিয়েছিল কারণ ও ডিভোর্সি ছিলো, অথচ কখনো অপর্ণা কে জানায়নি। অপর্ণা এগুলো জানে না, জানলে খুব কষ্ট পাবে, তাই এখনো ওকে কিছু বলিনি, তাই আমি কোথায় গিয়েছিলাম সেটা অপর্ণা সত্যিই জানতো না!

রীনা অবাক হয়ে তাকালেন,

কি বাজে ছেলে তারমানে! অপর্ণা তো খুব বাঁচা বেঁচে গেছে!

সৌমিক হাসলো, উঠে পড়তে পড়তে বললো,

এবার নিশ্চয়ই তোমার সবার ওপরেই রাগ কমবে অল্প অল্প! বাকিটা জলির বিয়েতে মেজো মাসীর বাড়ি গেলেই কমে যাবে!

রীনার মুখে হাসি ফুটলো,

অপর্ণা কে সঙ্গে করে নিয়ে যাও!

সৌমিক ঘুরে তাকালো,

ওকে ওর সুবিধা মতো যেতে দাও মা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তুমি যেটা ভয় পাচ্ছ সেটা হবে না, আমি মিতাকে বাইকে তুলে নিয়ে যাবো না!

ছেলে তার মনোভাব বুঝতে পেরেছে ভেবে রীনা লজ্জিত হলেন, ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

আচ্ছা ঠিক আছে।

উঠে যেতে যেতে আবার ঘুরে দাঁড়ালো সৌমিক,

দিদির ওপরে রাগ করে বসে থেকো না আবার, ওকে ডেকে কথা বলো! সামান্য একটা খাম নিয়ে তুমি বড্ড বেশি রিয়াকশন দেখালে কিন্তু! এমন কাকে দিচ্ছ যেটা বাড়ির কাউকে বলা যায়না!

রীনা একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন,

সবাই কে বলা যায়না কারণ ওরা ব্যাপারটা বুঝবে না! তোমাকে বলতে আপত্তি নেই! টাকাটা রীতা কে পাঠাচ্ছি, ও নাকি খুব বিপদে পড়েছে তাই ফোন করেছিলো! লুকিয়ে রাখতে চাইনি, কিন্তু বললে এক্ষুনি রত্না চিৎকার চেঁচামেচি করবে, কিছুতেই দিতে দেবে না। ও তো জানো রীতা কে সহ্য করতে পারেনা!

সৌমিক আবার ফিরে এলো, অবাক গলায় বললো,

সত্যি পারো বটে তুমি! টাকা তোমার, তাই কিছু বলার নেই, কিন্তু দিদিকে এক্ষেত্রে আমি সাপোর্ট করছি! আমিও চাইনা তুমি ওকে একটা টাকাও দাও! সব ভুলে গেলে মা! এতো সহজে ক্ষমা করে দিলে? কি করতো তোমার সঙ্গে ও! যাইহোক, তুমি ভুলে গেলেও আমরা ভুলবো না, এটাই প্রথম, এটাই যেনো শেষ বার হয়! ভবিষ্যতে এরকম হলে কিন্তু আমারও আপত্তি থাকবে! তাতে তুমি রাগ করলেও আমার কিছু যায় আসে না!
ক্রমশ