#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪০
সৌমিক যখন ঘরে ফিরে এলো ততোক্ষনে অপর্ণা তৈরি হয়ে গিয়েছে প্রায়, ওকে দেখেই সৌমিক হাসলো,
মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, আজ আর তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যেতে পারবো না, খুব দেরি হয়ে যাবে। আজকের দিনটা চলে যাও প্লিজ!
আমি তো যেতেই চাই, কিন্তু মাই তো রাগ করেন! তার ওপরে তো আজ আরো মাথা গরম!
সৌমিক হাতে টাওয়েল নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে হাসলো,
আর বলবে না কিছু, বলে দিয়েছি আজ! মা আসলে বড্ড ভুলভাল ভাবে! মায়ের মনে হয় আমার বাইকে তুমি না থাকলে বোধহয় মিতা উঠে পড়বে!
সৌমিক এর হাসি দেখেও অপর্ণার মুখে হাসি এলো না, ইদানিং এরকম একটা ভাবনা মাঝে মাঝে তার মধ্যেও দেখা দিচ্ছে! হটাৎ করে মিতার তাকে এড়িয়ে চলার পেছনে সে কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। মিতা তাকে এড়িয়ে চলে সৌমিকের সঙ্গে কেনো যোগাযোগ রাখছে শুধু! অপর্ণা সৌমিকের দিকে তাকালো,
আচ্ছা! যদি ধরো মিতা কখনো তোমার বাইকে সত্যিই উঠতে চায় কোনো কারণে তাহলে তুমি কি করবে? ওঠাবে না?
সৌমিক অবাক হয়ে তাকালো,
সত্যি! আমি না এই মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে তোমার কোনো ফারাক পাচ্ছি না! যদি সত্যি কিছু দরকারী মনে হয় তাহলে ওঠাতে হবে, এতে এতো ভাবনা চিন্তার কি আছে! আজ তোমরা সবাই মিলে আমার দেরি করিয়ে ছাড়বে!
অপর্ণা নিজেকে সামলে নিলো, বিরক্ত গলায় বললো,
আমিও তোমার মায়ের সঙ্গে তোমার পার্থক্য করতে পারিনা! তোমাদের দুজনেরই যা জেদ! তোমাকে যেমন কিছু জিজ্ঞেস করলেই বিরক্ত হও, কৈফিয়ত চাইছি বলে মনে হয় তোমার, উনিও তেমনই! সামান্য একটা খাম নিয়ে যে এত কিছু হতে পারে বুঝতে পারলে আর কোনো প্রশ্নই করতাম না! এতো কিছু হলো তাও কিন্তু ওটা কিসের খাম সেটা জানা গেলো না শেষ পর্যন্ত!
তোমাদের আসলে তিল কে তাল করা স্বভাব, দিদি, তুমি দুজনেই যা করলে, তাই মা বিরক্ত হলো, আমিও ঠিক এই কারণেই বিরক্ত হই! নাহলে ওটা একটা সাধারণ টাকার খাম যেটা রীতা পিসিকে দেওয়া হচ্ছিলো! আর তুমি মিতার কথা বলছো? এই তুমিই তো মিতাকে আমার থেকেও ক্লোজ ভাবো বোধহয়, তাকে বলে এসেছো আমরা কোথাও বেড়াতে যাইনি আজ পর্যন্ত!
কথাগুলো বলেই বাথরুমে ঢুকে গেলো সৌমিক, অপর্ণা মনে মনে চমকে গেলো! মিতা কে বলেছিলো যেটা সেটা সৌমিকের কানে পৌঁছালো কি করে! মিতা বলে দিলো ওকে! শুধু এটুকুই নাকি আরো কিছু বানিয়ে বলেছে! কি প্রসঙ্গে উঠলো কথাগুলো! কিন্তু এখন কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না, কখনো ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে! এখন তো আরো অন্য সমস্যা এসে উপস্থিত! তারমানে শেষ পর্যন্ত টাকাটা রীতা পিসিকে দিতেই হচ্ছে! মিনতি মাসী কি সত্যি টা জানে নাকি ওকে অন্য কিছু বলে পাঠানো হচ্ছে! আর নিজেকে ধরে রাখা যাচ্ছে না! ও ভাবছিলো চুপ করেই থাকবে, কিন্তু এবার আর সেটা সম্ভবপর হবে না, ওর মধ্যে যেনো সেই পুরোনো অপর্ণা ফিরে আসছে, মনে হচ্ছে এবার এই নোংরামি গুলো কে আর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়!
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অপর্ণা ধীরে ধীরে নিচে নামলো, অনিন্দিতার রান্না হয়ে গিয়েছিলো, তার কাছ থেকে সাজানো থালা নিয়ে এসে ভাসুর আর সৌমিকের খাবার টেবিলে রাখলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই দু ভাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো দেখে সে ওপরে উঠে নিজে তৈরী হয়ে নিচে নামলো। মোটামুটি একই সময়ে সে আর মিনতি বেরোয় আজ মিনতির একটু দেরি ছিলো, সকালের বকাবকি তে সময় নষ্ট হয়েছিলো। তার দেরি দেখে অপর্ণা বেরিয়ে পড়লো, সামনের রাস্তার বাঁক টা ঘুরে গেলেই আর বাড়িটা দেখা যায়না, সেই বাঁকের পাশে একটা গাছের ছায়ায় অপর্ণা মিনতির জন্যে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট পনেরো পরে মিনতি কে হন্তদন্ত হয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে অপর্ণা সামনে এগিয়ে এলো, তাকে দেখেই মিনতি চমকে তাকালো,
তুমি যাওনি এখনো বৌমা?
অপর্ণা মাথা নাড়লো, সোজা চোখে তাকিয়ে বললো,
না, তোমার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি! মা যে সকালে খামটা দিয়েছিলো ওটা রীতা পিসিকে দিতে যাচ্ছো তো? ওটা আমাকে দাও, আমি যাবার পথে দিয়ে যাবো, তোমাকে আর যেতে হবে না!
মিনতি অবাক হয়ে তাকালো,
তুমি কি করে জানলে ওটা রীতা কে দিতে হবে?
অপর্ণা হাসলো,
ওমা! জানবো না কেনো? রীতা পিসি তো আমাকেই বলেছিলো মাকে বলতে টাকার কথা! আমি একদিন ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম না, সেদিন!
মিনতি একটু ইতস্তত করলো,
দিদি কে একবার জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হতো না?
অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,
হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করো, আমি দাঁড়িয়েই আছি! তবে মা আবার আজ যা রেগে আছে তুমি নিজে যাওয়ার বদলে আমার হাতে দিচ্ছ, জানলে কুরুক্ষেত্র বাধবে! আমি আসলে এমনই যাবো তাই বলছিলাম, চলো তাহলে দুজনেই যাই নাহয়!
মিনতি কয়েক মুহূর্ত ভাবলো, ছোটো বৌমা যে টাকার কথা জানে সেটা বোঝাই যাচ্ছে! মাঝখান থেকে কাজ বন্ধ রেখে দুজনে মিলে যাবার কোনো মানে হয়না! সে খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
যাও তাহলে তুমিই! দিদিকে বলো না বরং যে তোমার হাতে দিয়ে দিয়েছি, তাতে আবার রাগ করবে! আমার তো সকালে অনেকগুলো বাড়ি থাকে, কিন্তু দিদি বললো রীতা নাকি খুব বিপদে পড়ে সাহায্য চেয়েছে, তাই হাতের কাজ ফেলে রেখেই যাচ্ছিলাম বাধ্য হয়ে। রীতা কেও বলে দিও দিদিকে যেনো না বলে তুমি নিয়ে এসেছো!
বলে দেবে জানিয়ে অপর্ণা খাম হাতে নিয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢোকাতে ঢোকাতে হাঁটতে লাগলো, আজ আর ইউনিভার্সিটি যাওয়া হলো না, এটারই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। একটা অটো ধরে মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলো অপর্ণা, দরজার বেলে হাত রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে দাঁড়ালো রীতা, ওকে দেখে হাসলো,
আরে, তুমি! এসো, এসো! আজ ক্লাসে যাওনি নাকি?
অপর্ণা ঢুকতে ঢুকতে হাসলো,
নাহ! আজ আপনার কাছেই এলাম, কিছু কথা ছিলো।
রীতা জিজ্ঞেস দৃষ্টিতে তাকালো, সোফার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,
বসো! বসে কথা বলো। কি বিষয়ে কথা?
অপর্ণা বসে পড়লো, ব্যাগ থেকে খামটা বার করে রীতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
মা দিয়ে পাঠালেন এটা, বললেন আপনার এ মাসের খরচ নাকি দিয়ে যেতে পারেন নি পায়ের সমস্যার জন্যে।
রীতা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে খামটা নিলো, একটু অবাক হয়ে বললো,
তোমার হাতে দিলো বৌদি!
অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,
হ্যাঁ, দিলেন তো! বাড়িতে তো আর কেউ ছিলো না আসার মতো, তাই আমিই এলাম! শুনলাম আপনার নাকি খুব অসুবিধা হচ্ছে, মাঝে মাঝেই মাকে ফোন করছেন! তবে একটা কথা আমার খুব অবাক লাগলো রীতা পিসি, আপনি সেদিন আমার শাশুড়ি সম্পর্কে অতো অভিযোগ করলেন, কিন্তু এটা একবারের জন্যেও বললেন না, যে তিনিই আপনার সংসার চালান! আমি তো মায়ের কাছে শুনে একদম হতভম্ব হয়ে গেছি, এর আগে তো কখনো আপনাকে নিয়ে কথা হয়নি, এবার হলো তাই জানতে পারলাম! যিনি আপনাকে বার করে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে তিনিই আবার আপনাকে এতো সুন্দর ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন, প্রতি মাসে খরচও দেন!
রীতা একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালো,
বৌদি তোমাকে ঠিক আর কি কি বলেছে আমার সম্বন্ধে?
অপর্ণা চোখে চোখ রেখে হাসলো,
বলেছেন তো অনেক কিছু, কিন্তু সেসব বলে আর আপনাকে লজ্জায় ফেলতে চাইনা! শুধু এটুকুই বলবো, আমি সবই জানি। আর আমি জানি মানে ঋজুও জানে এটুকু তো আপনি বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই! আমরা দুজনেই কেউ চাইনা যে মা এই টাকাটা প্রতিমাসে আপনাকে সারাজীবন পাঠিয়ে যান। মা অবশ্য বলছিলেন যে উনি যতদিন থাকবেন ততদিন দেবেন কিন্তু আমরা ভেবে দেখলাম যে আমরা তো আর উনি না থাকলে আপনাকে সারাজীবন খরচ দিতে পারবো না তাই হটাৎ করে কোনো একদিন টাকা বন্ধ হয়ে গেলে আপনিই বিপদে পড়বেন! তার থেকে এখন অনেকটা আগে থেকে কিছু ব্যবস্থা করে নিলে ভবিষ্যতে বেশি বয়সে আপনাকে হটাৎ করে বিপদে পড়তে হবে না। সেই জন্যেই এই মাসের টাকাটা দিয়ে গেলাম, ভবিষ্যতে আর কিছু দিতে পারবো না এটাও জানিয়ে গেলাম।
রীতার মুখ অপমানে লাল হয়ে গেলো,
তোমার শ্বশুর মশাই এটা জানেন? আর তোমার ভাসুর, ননদরা?
অপর্ণা হাসলো,
নাহ! ভাসুর, ননদ জানুক এটা কি আপনি চান? তাহলে জানিয়ে দেবো নাহয়! তবে আমার ননদ বড্ড রাগী, একথা জানলে মনে হয়ে আপনার বাড়িতে এসে এমাসের টাকাটাও ফেরত নিয়ে যাবে। আর ভাসুর তো নির্বিরোধী মানুষ, ঋজু না বলে দিয়েছে জানলে মনে হয় না উনি হ্যাঁ বলবেন আর। সেরকম হলে আপনিও কথা বলে দেখতে পারেন একবার দুজনের সঙ্গে, ফোন নম্বর দিয়ে যাবো আপনাকে। তবে শ্বশুর মশাইয়ের অনেক বয়স হয়ে গেছে, তার ওপরে উনি অসুস্থ তাই জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি ইচ্ছে করেই। আর জানলেও তো দিয়ে যাবার ক্ষমতা ওনার নেই সেই আমাদের ভরসাতেই থাকতে হবে।
রীতা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মোবাইল হাতে তুলে নিলো, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,
আমাকে আশুদার সঙ্গে কথা বলতে হবে, উনি কি বলেন সেটা আমি জানতে চাই!
অপর্ণা হাসলো, সোজা চোখে তাকিয়ে বললো,
আমার শাশুড়ি কে দেখে আমাকে বিচার করবেন না, আমি ওনার মতো ভীতু নই! এতদিন যা হয়েছে সেসব পুরনো কথা থাক, নতুন করে আর আমরা আপনাকে কিছু দিতে পারবো না সেটা বলেই দিয়েছি। এতে যদি আপনি কাউকে বলে দিতে চান, দিতে পারেন! আপনি আমার শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চান তো? ফোন করে দেখুন একবার, তবে মনে হয়না কিছু হবে। আমার শ্বশুর মশাই কে যদ্দুর চিনেছি তিনি বেসিক্যালি একজন মেরুদন্ডহীন স্বার্থপর মানুষ, যিনি না কখনো তাঁর স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন না কখনো আপনার পাশে দাঁড়াবেন। সেটা আশাকরি মুখে স্বীকার করতে না পারলেও মনে মনে আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করেন। যখন যেদিকে থাকা সেফ তখন উনি সেদিকেই থেকেছেন। মায়ের যতদিন দাপট ছিলো ততদিন মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বউকে অপমান করেছেন, বউ আপনাকে কিছু বলতে গেলে আপনার পাশে এসেও দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এই লোকই দেখুন, যখন আমার শ্বাশুড়ি আপনাকে ঘর থেকে বার করে দিচ্ছিলেন তখন একবারের জন্যেও মুখ খোলেন নি। অথচ সারাজীবন রোজগার করেছেন এবং এখনও আপনার খরচ চালানোর মতো ক্ষমতা যখন রাখেন তখন যদি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসতেন তাহলে আপনাকে ওই বাড়িতে রাখতে না পারুন সঙ্গে বেরিয়ে আসতে তো পারতেন? কিন্তু সেটা তিনি করেন নি কিন্তু, কারণ স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুস্থ জীবন যাপনের সুখ ছেড়ে আপনার সঙ্গে অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকায় ওনার আপত্তি ছিলো। অথচ আপনি ভাবেন উনি আপনাকে ভালোবাসেন! কিন্তু এই ধরনের লোকেরা আসলে কাউকেই ভালোবাসেনা, শুধু নিজের ভালো থাকাটাকেই প্রাধান্য দেয়। সেটা নিশ্চয়ই আপনি এখন অনেকটাই বুঝতে পারছেন? এই যে গত প্রায় মাস দুয়েক ধরে আপনার টাকা আপনি পাচ্ছেন না, তাতে আপনার কথায় উনি বউকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছেন শুধুই কিন্তু সত্যি যদি ওনার দায়িত্ব বোধ থাকতো তাহলে উনি নিজেই কাউকে দিয়ে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন বা আপনাদের সম্পর্কটাকে প্রকাশ্যে এনে আপনার পাশে দাঁড়াতেন। কিন্তু তিনি এসব কিছুই করবেন না, কারণ উনি ওনার স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চান, ওনার সাজানো কমফোর্ট জোন ছেড়ে যাতে ওনাকে কখনো বার হতে না হয় সেটা সব সময় ওনার মাথায় থাকে। আপনি নিশ্চয়ই সেটা বোঝেন তাই এতো বছর ধরে ওঁকে এখানে আনার চেষ্টা না করে ওনার স্ত্রী কে ব্ল্যাকমেল করে, যতদূর সম্ভব নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করেন।
অপর্ণার কথা শেষ হবার আগেই রীতা মোবাইল টেবিলে নামিয়ে রাখলো। তাকে ফোন নামিয়ে রাখতে দেখে অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো,
যাবার আগে দুটো কথা একটু বলে যাই, আমি চলে যাওয়ার পরে অবশ্যই একবার আপনার আশু দার সঙ্গে কথা বলে নেবেন, তাতে আপনারই মোহভঙ্গ হতে সুবিধা হবে। আমি যা বলে গেলাম, উনি যে ঠিক সেরকমই এটা আপনি বুঝে যাবেন। আর দু নম্বর কথা হলো, ভবিষ্যতে কাউকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে আমার শাশুড়ি কে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন আমাদের সম্মান অতো ঠুনকো নয়, যে আপনাদের এই খবর প্রকাশ্যে এলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। আসছি! আজ আপনার জন্যে আমার মোটামুটি গোটা তিনেক ক্লাস চলে গেলো, দেখি বাকিগুলো করতে পারি কিনা!
অপর্ণা বেরিয়ে যাবার পরেও থমথমে মুখে সোফায় বসে থাকলো রীতা, নিজেকে এই মুহূর্তে সংযত রাখা মুশকিল। অপর্ণা কে রীনা বলে দিতে পারে এটা একবারের জন্যেও ভাবনাতেই আসেনি ওর, নিজেকে খুব বোকা লাগছে এখন। ভেবে দেখতে গেলে এই এক রুমের ফ্ল্যাট টুকু ছাড়া তো কিছুই নেই ওর, কখনো সেই ভাবে সঞ্চয় করার কথা ভাবেনি ও। তাও বুদ্ধি করে যে ওবাড়ি ছেড়ে আসার পরে আশুতোষের কাছ থেকে এই ফ্ল্যাট টুকু নিয়ে রেখেছিলো তাই আজ মাথাগোঁজার ঠাঁই নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। কিন্তু সেটাই একমাত্র সমস্যা নয়, প্রতি মাসের খরচের কথাটাও ভাবতে হবে। এই বয়সে যে ভাবে জীবন কাটিয়ে এসেছে ও তাতে নতুন করে কিছু শুরু করতে পারা মুশকিল। খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে আশুতোষ কে শেষ পর্যন্ত ফোন করার সিদ্ধান্তই নিলো রীতা, ওর কথাটা ওর মুখ থেকেই শোনা দরকার।
রীতা সাধারণত এই সকালের দিকে ফোন করেনা কখনো কারণ এই সময়ে বাড়িতে লোকজন থাকে, তার ফোন করার সময় রাতে। তাই এই সময়ে ফোন পেয়ে আশুতোষ একটু অবাক হলেন, তার গলা পেয়েই রীতা কড়া গলায় বললো,
তোমার বউ আমাকে অপর্ণার হাতে টাকা পাঠিয়েছে সব বলে দিয়ে, সে এখানে এসে আমাকে রীতিমত হুমকি দিয়ে গেলো। জানিয়ে গেলো পরের মাস থেকে সে আর ঋজু চায়না যে আমাকে টাকা দেওয়া হোক! এবার তুমি কি করবে বলো? টাকা দিতে পারবে নাকি ছেলের ভয়ে বন্ধ করে দেবে?
আশুতোষ মনে মনে চমকে উঠলেন, রীনা অপর্ণা আর ঋজু কে জানিয়ে দিয়েছে! তিনি রীতার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে রীতা রাগের গলায় বললো,
বুঝলাম! তোমার কিছু করার নেই, তাই তো! কিন্তু আমার আছে! আমি তোমাকে ছাড়বো না! আমি এবার লোকের কাছে ভিক্ষা করে বাকি জীবন কাটাব, আর তুমি বহাল তবিয়তে বাড়িতে বসে বউয়ের সেবা নিয়ে যাবে সেটা হতে দেবো না! আমি নিজে রাস্তায় নামতে বাধ্য হলে তোমাকেও টেনে নামাবো বলে দিলাম!
এক মিনিট! ধরো ফোনটা!
রীতাকে ফোন ধরতে বলে আশুতোষ ফোনটা হাতে নিয়ে বসার ঘরের সোফা থেকে উঠে এসে, আড়চোখে খাটে পা ছড়িয়ে বসে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে, ধীরে ধীরে নিজের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, ফোনের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বললেন,
কি লাভ এসব করে? তাতে কি তোমার হাতে টাকা পয়সা আসবে কিছু? মাঝখান থেকে দুজনেরই সম্মান যাবে। বরং ভাবো কি করে এটা মিটিয়ে ফেলা যায়। আমি একটা কথা বলবো, মাথা ঠাণ্ডা করে শোনো। ঋজু তার মায়ের সব কথা শোনে, টাকা দিতে যদি নাও চায়, রীনা বললে সে দেবেই! তাই তুমি রীনাকে একটা ফোন করো, দরকার হলে ক্ষমা চাও, নিচু গলায় বলে দেখো ও ঋজু কে বলবে দিতে।
রীতা চিৎকার করে উঠলো,
কি বললে তুমি! আমি তোমার বউয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে সাহায্য চাইবো? আর তুমি কি করবে? বসে বসে মজা দেখবে?
আশুতোষ মাথা নাড়লেন,
না, আমিও বলবো তো! কিন্তু আমার বলায় কিছু হবে না সেতো তুমি জানোই! আজ পর্যন্ত ও কখনো আমার কোনো কথা শুনেছে বলো তুমি? তবে ওকে ওসব ব্ল্যাকমেলের ভয় দেখিও না, আমি আগেই বলেছিলাম তোমাকে! দেখলে তো ওতে কিছু লাভ তো হলোই না উল্টে হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। রীনার ভীষণ জেদ, যদি ওই ব্ল্যাকমেলের হুমকি না দিতে তাহলে আজকে এই পরিস্থিতি তৈরিই হতো না। আর এখন ঋজু ঢুকে পড়েছে মানে খুব স্মুথলি কিছু হবে না, হুমকির জন্যে ক্ষমা চাইতে হবে তোমাকে।
আমি ক্ষমা চাইতে পারবো না, দরকার হলে তুমি এখানে চলে এসো। টাকা তোমার, ওর কাছে ক্ষমা চাইতে যাবো কেনো?
কেটে কেটে বললো রীতা, আশুতোষ গলার স্বর নিচে নামালেন,
পাগলের মতো কথা বলো না! এই বয়সে, বাড়িতে ছেলে, বৌমা, মেয়ে, জামাই, এখন এসব লোক হাসানো ব্যাপার করা যায় নাকি!
রীতার গলা অপমানে বুজে এলো,
এই কথাগুলো তুমি তখনো বলেছিলে, যখন তোমার বউ আমাকে তাড়িয়ে দিলো! সেদিন তোমার বাড়িতে তো বৌমা, জামাই ছিলো না, তাও তো বেরওনি আমার সঙ্গে! অথচ আমি তো তোমার জন্যে আমার সংসার ছেড়ে এসেছিলাম।
আমি তোমাকে আসতে বলিনি, তুমি নিজেই থাকতে পারছিলে না তোমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে! বরং বলতে পারো তোমাকে এখানে থাকতে দিয়ে মা তোমার উপকার করেছিলেন। আমিও তো তুমি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরে তোমাকে নিজের ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছি, তুমি সেটা ইচ্ছে মতো সাজিয়েছ, এতদিন ধরে নিয়মিত খরচ দিয়ে এসেছি, আর কি চাও? এবারে তো আমারও বয়স হচ্ছে, ঋজুর বিয়ের রাতে যা হলো সেটাতো তোমার খুব ভালো করেই জানা, তারপরে আর আমার হাতে খুব বেশি কিছু নেই। এখন ছেলে, মেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে, ওদের মতকেই প্রাধান্য দিতে হবে, আর যদি সেটা না মানতে চাও তাহলে রীনার সঙ্গে কথা বলো। তুমি জোর করলেও এই বয়সে তোমার সঙ্গে গিয়ে থাকা আমার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয়। এখন রাখছি আমি, জানো বাড়িতে রজত, রত্না আছে, এরকম যখন তখন ফোন কোরো না।
আশুতোষ এর ফোন কেটে দেওয়ার আওয়াজে রীতার সম্বিত ফিরল, এই মুহূর্তে আর কি করতে পারে ও। আশুতোষ সম্পর্কে সব কথা যদি ও সবাইকে জানিয়েও দেয় তাহলেও যে খুব কিছু লাভ নেই সেটা ও বুঝতে পারছে এখন, কারণ যদি সত্যি আশুতোষের বিরুদ্ধে কিছু করার হতো তাহলে ঋজু সেটা আগেই করতো, কিন্তু ওরা যে সেটা করবে না, সেটা অপর্ণার বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। তাহলে এবার ও কি করবে, মিতা কে একবার ফোন করবে নাকি!
ক্রমশ
#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৪১
রীনার পায়ে প্লাস্টারের পর থেকেই এখন এঘরে সারাক্ষন বিভিন্ন জনের যাতায়াত, কখনো অনিন্দিতা, কখনো দীপা খাবার নিয়ে যাওয়া আসা করছে তো কখনো রত্না মায়ের সঙ্গে গল্প করতে আসছে। এতো লোক যাতায়াতের মধ্যে আশুতোষ কিছুতেই সময় বার করে উঠতে পারেন নি রীতার ব্যাপারে কথা বলার। রীনা পারতপক্ষে প্রয়োজন ছাড়া তাঁর সঙ্গে কথা বলেন না তাই তাঁদের স্বামী, স্ত্রীর কথোপকথন শুনে এঘরে বাইরের লোকের আনাগোনা কিছুক্ষনের জন্যেও যে বন্ধ হবে তার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যের দিকে অপর্ণা ফিরে এসেছিলো, কিছুক্ষন পরে রান্না ঘরে ঢুকে রাতের রান্না শেষে তাঁকে খাবার দিয়েছিলো, মুখ নিচু করে সেই খাবার খেয়েছেন আশুতোষ, বৌমার চোখে একবারের জন্যেও চোখ রাখেন নি। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ হবার পরে যখন সুযোগ এলো রাতে তখন আশুতোষ একটা চেয়ার টেনে স্ত্রীর মুখোমুখি বসলেন, গলা খাঁকরে বললেন,
ছেলে বউকে জানানো কি খুব দরকার ছিলো! এই বয়সে এতটা নিচে না নামালেই পারতে!
রীনা কথার মাথামুন্ডু কিছুই না বুঝে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালেন, আশুতোষ চোখ নামিয়ে নিলেন,
রীতা খুব সমস্যায় আছে, এই বয়সে কি করে চালাবে? ঋজু কে একটু বুঝিয়ে বল টাকা দেওয়া বন্ধ না করতে, অপর্ণা বোধহয় রীতা কে টাকা বন্ধের কথা বলে এসেছে!
রীনা মনে মনে চমকালেও চোখের পলক ফেললেন না, স্বামীর কোনো কথাতেই তাঁর কোনো আস্থা নেই। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,
অপর্ণা কি বলে এসেছে রীতা কে?
আশুতোষ মলিন হাসলেন,
খুব মজা পাচ্ছো মনে মনে তাইনা? মানছি রীতা তোমাকে ব্ল্যাকমেল করে ভুল করেছিল, তাই বলে ঋজু আর অপর্ণা কে জানিয়ে দিলে? আমাকে ছোটো করতে পারলে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না? যা যা করতে চেয়েছো সব মেনে নিয়েছি, একটা কথাও বলিনি, তাও শেষ পর্যন্ত ছেলে বউয়ের কাছে সম্মানটুকু রাখতে দিলে না? অপর্ণা যে আর টাকা দেবে না বলে এসেছে রীতা কে সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়, ইচ্ছে করেই তো ওকে দিয়ে খামটা রীতার কাছে পাঠিয়েছ?
রীনার ভেতরটা লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো, আর কি তিনি কখনো অপর্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবেন! সকালে মিনতির হাতে খাম দেখেই অপর্ণা সব বুঝে গেছে! কিন্তু ও কি করে জানলো এসব! এতো বছরে তো তিনি কখনো কারো সামনে এসব আনতে দেন নি, এমনকি মিনতি অনেকটাই বোঝে জানা সত্বেও একবারের জন্যেও ওর সঙ্গেও এসব নিয়ে আলোচনা করেন নি! কিন্তু ঋজু ঠিক কতটা জানে এসব, অপর্ণা কি ওকে আদৌ কিছু বলেছে? কিই বা জানে ও যে বলতে পারে? আর ঋজু কে উনি খুব ভালো করে চেনেন, সে যা ছেলে তাতে এরকম খবর জানলে চুপ করে থাকার বান্দা সে নয়, এক্ষুনি এসে মায়ের কাছে জবাবদিহি চাইতো সে। স্ত্রী কে চুপ করে থাকতে দেখে আশুতোষ অধৈর্য্য হলেন,
আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে রীনা, কেনো করলে এসব? তুমি কি চাওনা আমি এখানে থাকি? রীতার কি হবে, সেটাও বলো!
রীনা নিজেকে সংযত করে নিলেন, আশুতোষ ভয় পেয়েছেন বোঝা যাচ্ছে এখন তাঁর নরম হওয়া চলবে না। অপর্ণার সঙ্গে কথা বলা তাঁর পক্ষে কখনই সম্ভব নয় কিন্তু আশুতোষের কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে অপর্ণা রীতাকে টাকা দেবে না বলে জানিয়ে এসেছে। এই সুযোগে যদি সত্যি টাকা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই। রীনা গম্ভীর মুখে তাকালেন,
ঋজু বড়ো হয়েছে, সে ঠিক কি বলে পাঠিয়েছে অপর্ণাকে দিয়ে সেটা আমি জানিনা! কয়েকদিন সময় দাও কথা বলে জানাবো, এক্ষুনি কিছু বলা সম্ভব নয়। আর তোমার থাকার কথা যদি বলো, তাহলে বলবো বাড়ি তোমার, তাই তোমাকে চলে যেতে বলার কোনো অধিকার আমার নেই। একটা সময় ছিলো যখন আমি বলেছিলাম হয় রীতা এখানে থাকবে অথবা আমি আর আমার ছেলে মেয়ে, তখন তুমি আমাদের কেই থাকতে বলেছিলে। কিন্তু বলেছিলে রীতার থাকার ব্যবস্থা তুমি করে দেবে, তাই করেছো, আমি তোমাকে কোনো বাধা দিইনি! তাই এতদিন পরে তুমি চলে যাও এটা আমি বলতে যাবো কেনো, তোমার থাকাতে তো আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আর এখন তোমার যা অবস্থা, তাতে চলে যেতে বললেও যেতে পারবে কি? তার থেকে বরং চুপ করে বসে থাকো, নাহলে ওই রীতার সাপোর্টে দাঁড়াতে গেলে আবার ঋজু তোমাকেই না বাড়ি ছাড়া করে দেয়!
কিছুক্ষন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গেলেন আশুতোষ, রীনা মনে মনে চিন্তিত হলেন। অপর্ণা ঠিক কতটুকু জানতে পেরেছে না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে অপর্ণা কে ডেকে ঠিক কি জিজ্ঞেস করবেন বুঝে পাচ্ছেন না তিনি, অপর্ণা তো একবারের জন্যেও কিছু বুঝতে দেয়নি তাঁকে। ও কি তাহলে মিনতির কাছ থেকে টাকার খামটা নিয়ে নিয়েছিলো! এই সত্যিটা একমাত্র মিনতি জানে, কিন্তু সে রীনার কাছে এরকম কিছু ঘটলে বকুনির ভয়ে কিছুতেই মুখ খুলবে না। সেই থেকেই কয়েকদিন ধরে ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে দিনরাত কাটাচ্ছেন রীনা কাউকেই কিছু বলে উঠতে পারছেন না।
সেদিনের ঘটনার পরে দুদিন কেটে যাওয়ার পরও যখন আশুতোষের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পেলনা রীতা তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই মিতাকে ফোন করেছিল তৃতীয় দিন। তাকে রীতার একটু দরকার আছে, একবার দেখা করতে চায়, এটা শোনার পরে সেদিনই অফিস ফেরত বাড়িতে এসেছিলো মিতা, খুব উদগ্রীব হয়ে জানতে চেয়েছিলো,
তোমার ঠিক কি হয়েছে বলো তো রীতা পিসি, আমায় হটাৎ করে ডেকে পাঠালে?
আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারিস, পেট টা চালাতে হবে তো? কতোবার তোর কাছে চাইবো বল তো?
একটু অস্বস্তি নিয়েই বলেছিলো রীতা, মিতা হেসেছিলো, আদুরে গলায় বলেছিলো,
তোমাকে বলেছি না, তুমি শুধু ঋজুর পিসি নও, আমারও পিসি! এতো হেজিটেট করো কেনো? ঠিক আছে আমি দেখছি কিছু করা যায় কিনা!
মিতাকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল, নিজের চিন্তা চেপে রেখে তাকে চা খাইয়েছিল রীতা, খুশির কারণ জানতে চাওয়ায় মিতা হেসেছিলো, উৎফুল্ল গলায় বলেছিলো,
আমি ঋজু কে ভুল ভেবেছিলাম পিসি, ও বাধ্য হয়েই এই বিয়েটা করেছে। ওরা কোথাও বেড়াতে যায়নি বলে যে কথাগুলো সেদিন অপর্ণা বলছিলো এখানে বসে, সেগুলো একেবারে সত্যি! অপর্ণার নাকি পুরনো প্রেম ছিলো, ঋজু রবিকে দিয়ে সেটার ডিটেইলস খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে, যাতে অপর্ণার সত্যিটা ওর মায়ের সামনে আনা যায়।
রীতার মুখের কোনো পরিবর্তন হয়নি, কারণ সে আগের দিন অপর্ণার মুখ থেকে সব কথা শুনে ইতিমধ্যেই বুঝেছিলো ঋজুর সঙ্গে অপর্ণার সম্পর্ক ঠিক কেমন। সে কিছুক্ষন মিতার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলেছিল,
এগুলো তুই কি করে জানলি? ঋজু বলেছে তোকে?
মিতা হাসলো,
না, রবি বলেছে! ওই তো সবটা খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। তবে এটা ঋজু কিজন্যে খুঁজছে সেটা সম্ভবত ও বুঝতে পারেনি! আমি ঋজু কে দেখা করতে বলেছি একদিন, সবটা জেনে তোমাকে বলবো।
রীতা চায়ের কাপের দিকে ইশারা করে বলেছিলো,
নে চা খা, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! তোকে একটা কথা বলি মিতা, রবির কথা তুই কি বুঝেছিস আমি জানিনা, কিন্তু এটুকু বলতে পারি এটা একদম সত্যি নয়। ঋজুর সঙ্গে অপর্ণার সম্পর্ক ভালোই, ও কখনই অপর্ণাকে ছেড়ে তোর কাছে আসবে না! এই মিথ্যে আশায় থাকিস না!
মিতার মুখ কালো হয়ে গিয়েছিলো, ও একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো,
তুমি কি করে জানলে পিসি? তোমার সঙ্গে তো অপর্ণার দুদিনই দেখা হয়েছে মাত্র! শেষ বার তো আমার সঙ্গেই এসেছিলো।
রীতা কোনো উত্তর দেয়নি, কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিলো,
এখন এসব ভুলে যা, জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কর! যখন সুযোগ ছিলো তখন জেদ দেখালি আর এখন এসব ভেবে লাভ কি? কতো করে বুঝিয়ে ছিলাম আমি আর তোর মা, তুই শুনলি না তখন! কি হতো যদি বিয়ের কদিন পরে যেতিস?
মিতা ঘাড় নেড়েছিলো,
তুমি জানোনা ঋজু কে, একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর ও কিছুতেই ওই বাড়ি ছেড়ে যেতো না! সারাজীবন আমাকে ওই বাড়িতে থাকতে হতো! আর ওর মায়ের সঙ্গে ওই বাড়িতে থাকলে এমনিতেই কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্স নিতে হতো আমাকে।
রীতা উঠে দাঁড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলেছিলো,
তোর মনে হয় সেই জেদ ওর কমে গেছে এখন? নতুন করে অপর্ণাকে ছেড়ে তোর কাছে আসবে? ওসব ছাড়, নিজের কথা ভাব! আর আমার একটা ব্যবস্থা কর কিছু!
সেদিনের ঘটনার পর থেকে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, অপর্ণা মনে মনে একটু চিন্তায় ছিলো ওর এই আগ বাড়িয়ে রীতাকে বলে আসাকে শাশুড়ি ঠিক কিভাবে নেবেন ভেবে। রীতা পিসি নিশ্চয়ই ওর শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁর কাছ থেকেই শাশুড়ি সব কিছুই জানতে পারবেন ঠিক। মনে মনেই নিজেকে কোনো বড়সড় রাগারাগির জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছে অপর্ণা, শাশুড়ি ওকে ডাকলে ঠিক কি কি বলবে ও, সবটাই সাজিয়ে রেখেছে পরপর। কিন্তু আজ দিন পাঁচেক হয়ে গেছে তাও রীনা ওকে ডাকেন নি। নিজের কৌতূহল আর ধরে রাখতে না পেরে দিন দুয়েক আগে যখন মিনতি ঘর মুছতে এসেছিলো তখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো অপর্ণা,
মা তোমাকে সেদিন রীতা পিসির বাড়ি যাওয়া নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছে মাসী? তুমি যে যাওনি সেটা রীতা পিসি মাকে বলে দেয়নি তো?
মিনতি ঘর মুছতে মুছতে বরং অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো, ভীত গলায় বলেছিলো,
সেকি গো! তুমি রীতাকে বৌদিকে বলে না দেওয়ার কথা বলে দাওনি ছোটো বৌমা, বললুম যে তোমাকে সেদিন? তাহলে তো আমি খুব বকুনি খাবো গো!
অপর্ণা তাড়াতাড়ি ঘাড় কাত করেছিলো,
হ্যাঁ গো, বলেই দিয়েছি। তাও একবার জিজ্ঞেস করে নিলাম তোমায়।
যদিও রীতার বাড়ি থেকে ফেরার পরে মিতার মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তবু ও নিজেকে বুঝিয়েছে বারবার। মনকে স্বান্তনা দিয়েছে এই ভেবে যে রীতা পিসি হয়ত ভুল বুঝেছে সবটা। রীতা পিসির সাবধান বাণী মনে না রেখে ও কিভাবে ঋজুর কাছে সব কথা জিজ্ঞেস করবে তার প্ল্যান করেছে। এর মধ্যেই শনিবার অফিস থেকে বেরোনোর আগে রবির ফোন এলো, এখন সারা সন্ধ্যে ও কি করবে জানতে চাওয়ায় মিতা হাসলো,
ব্যাপার কি তোর? আজকাল বড্ড খোঁজ খবর নিচ্ছিস! কিছু করার নেই এখন, জাস্ট বেরোচ্ছিলাম বাড়ি যাবার জন্যে। আসবি নাকি? ঋজু কেউ ডেকে নিয়ে আয় তাহলে!
রবি হা হা করে হাসলো,
আমার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, তাই তোকে ফোন করলাম! একটু এসে তুলে নিয়ে যা আমাকে।
মিতা গাড়ি নিয়ে গিয়ে রবি কে তুলে গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
মহা ধান্দাবাজ তো তুই! গাড়ি খারাপ বলে আমাকে ডেকে নিয়ে এলি। ঋজু কে ফোন করেছিস?
রবি একটু অস্বস্তি নিয়ে তাকালো,
একটা কথা বলবো তোকে, রাগ করবি না তো? ওকে ওর মতো ছেড়ে দে না এবার। ও জীবনে অনেক এগিয়ে গেছে মিতা, ওর জন্যে তুই পিছিয়ে থাকিস না আর। কাকিমা তোর জন্যে ছেলে দেখছে, তুই একটু কথা বলে দ্যাখ দু একটা। তবে কাকিমা কেও বলেছি, তোকেও বলছি, দিল্লির ছেলে নয় আমি চাই তুই এখানেই থাক!
মিতা কড়া চোখে তাকালো, বিদ্রুপের গলায় বললো,
তোকে ঘটকালি করতে কে দায়িত্ব দিয়েছে? মা তো? তো সেটাই কর, মায়ের কাছে গিয়ে পাত্রের ভালো মন্দের বর্ণনা দে, এখানে কেনো? ঋজু যে জীবনে এগিয়ে গেছে অনেকটা এটাও মাই তোকে বলতে বলেছে তাই না? এই সব করে কি পাস তুই?
রবি মলিন মুখে তাকালো,
কাকিমা কিচ্ছু বলেনি। যা বলছি এটা সবটাই ঋজুর মুখের কথা! তুই ওকে দেখা করার জন্যে বলেছিস নাকি শুনলাম! তোকে যে আমি সমরের কথাটা বলেছিলাম সেটা ওকে বলে দিয়েছিস? ও আমার ওপরে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে, বলছিলো ওদের পার্সোনাল ব্যাপার আমি কেনো তোর সঙ্গে শেয়ার করেছি!
ওদের পার্সোনাল ব্যাপার! ঋজু বললো এটা?
বিস্মিত গলায় জানতে চাইলো মিতা, রবি ঘাড় কাত করলো,
হ্যাঁ, ও বলছিলো ওর আর অপর্ণার সম্পর্ক যে খুব নর্মাল, ওদের মধ্যে যে কোনো ডিসপিউট নেই এটা তোকে জানিয়ে দিতে। আমি বললাম ওকে, এর মধ্যে আমাকে না জড়িয়ে তোকে ডাইরেক্ট বলতে সবটা। তার উত্তরে ও আমাকে পাগল বললো, তোর সঙ্গে নাকি এসব পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে ও কোনরকম আলোচনা করতে চায়না।
মিতা থমথমে মুখে জানলার বাইরে তাকালো, কিছুক্ষন পরে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
ভালো কথা! এর পরে তো আর কোনো কথাই থাকতে পারে না! তবে এগুলো তুই বলছিস মায়ের পরামর্শে নাকি সত্যি ও বলেছে এটুকু তো আমাকে জানতেই হবে!
রবি ঘাড় নাড়লো,
ঠিক আছে! কথা বলে নিস তুই! আমার কোনো আপত্তি নেই!
এরপরে দুজনেই চুপ করে থাকলো কিছুক্ষন, তার পরে রবিই প্রথম কথা বললো,
কালও সন্ধ্যে বেলা গিয়েছিলাম তোর বাড়িতে, বলিনি তোকে। তোর ফিরতে দেরি হয়েছিলো নাকি? কোথাও গিয়েছিলি?
মিতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো,
হ্যাঁ, রীতা পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম, ডেকেছিলো পিসি আমাকে। তুই কি করতে এসেছিলি?
কাকিমা ডেকেছিলেন, ওই কয়েকটা ছেলের প্রোফাইল দেখার ব্যাপারে। আগের দিনও সেই জন্যেই গিয়েছিলাম, বলিনি তোকে। পরে ভাবলাম লুকিয়ে রেখে লাভ কি, বিয়েতো করবি তুই। কাকিমা যতোই বলুন তোর মত না হলে খবর নিয়েই বা লাভ কি।
মিতা হাসলো,
তোর আমার জন্যে এতো চিন্তা কেনো? একেবারে সব দায়িত্ব নিয়ে বসে আছিস!
রবি একটু ইতস্তত করলো,
কি করবো বল? কাকিমা কে কি বলবো? তবে তুই কলকাতায় থাক এটা সত্যি আমি চাই!
পরে বলছি তোকে! এখন কিছুদিন থাক এসব! তবে তোকে একটা অন্য কথা বলার ছিলো। রীতা পিসির জন্যে কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারিস? ওঁর অবস্থা খুব খারাপ।
রবি অবাক হলো,
এতদিন কি ভাবে চলতো? আচ্ছা ঠিক আছে দেখছি! তবে একবার ঋজুর সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। এটাও ওদের বাড়ির ব্যাপার বুঝলি তো, রীতা পিসির সঙ্গে তো ওদের সম্পর্ক ভালো নয় তাই ওকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করা উচিত হবে না।
রবির বাড়ি এসে গিয়েছিলো, নামার সময় মিতা জিজ্ঞেস করলো,
কাল তো রবিবার, দুপুরে আসবি নাকি?
রবি মাথা নাড়লো,
নাহ! হবেনা! কাল ওই সমরের ব্যাপারে খোঁজ নিতে যাবো একজায়গায়। রবিবার আছে তো কাল তাই, অন্য দিন তো সময় হয়না। তার মধ্যে আবার গাড়ি খারাপ মানে উবের নিতে হবে!
মিতা হাসলো,
ঋজু কে জিজ্ঞেস করিস, ওর আপত্তি না থাকলে আমিও যাবো। আমার গাড়িতেই যেতে পারি আমরা, উবের লাগবে না।
রবি অবাক হলো, বিরক্ত গলায় বললো,
এতো কথা বললাম তোকে, তাও তুই যেতে চাইছিস! কেনো বুঝতে পারছিস না ওর তোর প্রতি কোনো ফিলিংস নেই!
মিতা গাড়ি স্টার্ট করতে করতে হাসলো,
বলে দেখিস একবার!
ক্রমশ