#চন্দ্রকথা
সিমরান মিমি
চতুর্থ পর্ব
৭.
চঞ্চল বিকালের সুপ্ত রাশি সোনালী বর্নের ন্যায় প্রতিফলিত হচ্ছে ধরনীতে।দূর থেকে দুরান্তের আকাশে দেখা মিলছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির।এতটাই দুরত্বে তাদের বাস যে এই সুউচ্চ মিনার থেকেও বোধগম্য হচ্ছে না তাদের রঙ।হয়তো সারাদিন আহার খোঁজা এবং স্বাভাবিক নিয়মে উড়াল দেওয়ার পর নীড়ে ফিরছে তারা।তাদের ও ঘর আছে। ঘরে ফেরার টান ও আছে।শুধু নিজস্ব কোনো ঘর নেই রাজকুমারীর।নেই কোনো নীড়, যেখানে ফেরার আকুল টান থাকবে তার।বয়স তার বেড়েছে অনেক।রীতি অনুযায়ী যেখানে তেরো বৎসরের অধিক বয়সী কন্যা আজ সংসার করছে, সেইখানে সে সপ্তদশী কুমারী হয়েও অবিবাহিত। হয়তো রাজকন্যা বলেই কেউ কটু কথা বলার দুঃসাহস দেখায় না।প্রজার ঘরের কন্যা হলে আজ এতোদিনে হয়তো কলঙ্কের ছোঁয়ায় ভরা কলস গলায় বেঁধে ডুবতে হতো ওই দিঘির মাঝে।রাজকুমারীর যে বিবাহ হয় না এটাও নয়।বস্তুত তিনি নিজেই বিবাহ করছেন না।প্রথম কারন হিসেবে বলেছেন,শিক্ষা-দীক্ষা, যুদ্ধকৌশল সবকিছুতে পারদর্শী না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো সম্পর্কে জড়াবেন না।আর দ্বিতীয় কারন হিসেবে দেখিয়েছেন একজন পরিপূর্ণ যুবকের অনুপস্থিতি।হয়তো রাজা শওকত উজ্ জামান নিজেও একমাত্র কন্যাকে কাছ ছাড়া করতে চান নি বলে বিবাহের প্রতি ততটা জোর দেন নি।এই প্রশান্তিময় বিকেলে হৃদয়কে আরেকটু প্রশান্তি দেওয়ার জন্য প্রাসাদের সু-উচ্চ মিনারে অবস্থান নিয়েছেন রাজকুমারী। নিজ হাতে গম ছিঁটিয়ে দিচ্ছেন শক্ত ইটের বাঁধনে আবিষ্কৃত হওয়া ছাদে।পায়রা গুলো ছেঁটানোর শব্দ পেতেই ডানা ঝাপটিয়ে হামলে পড়লো সেদিকে।মুখে হাসি ফুটলো রাজকুমারীর। কিন্তু এই হাসি দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো না।এরমধ্যেই অন্যপ্রান্তে গম ছিঁটিয়ে দিলো কেউ।সাথে সাথেই দিক পরিবর্তন করে অন্যপ্রান্তে গেল পায়রাগুলো।আসন ছেড়ে ক্ষোভ এবং কৌতূহল নিয়ে তাকালো অন্যপ্রান্তে।মুখে চওড়া হাসি নিয়ে মিনারের পেছন থেকে বেরিয়ে আসলো রাজকুমার।দু-কদম এগিয়ে আসতেই গর্জে উঠলো অতৃপ্তা।বললো,
-আপনাকে এখানে কে প্রবেশ করতে দিয়েছে?প্রহরী!প্রহরী!
-তাদেরকে ডেকে লাভ নেই রাজকুমারী। সামান্য কিছু প্রহরী রাজকুমার অভিরুপ সিং কে আঁটকে রাখবে এটা হাস্যকর?আর তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি আমার বাগদত্তা।
সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে রাজকুমারী অন্যদিকে তাকালো।মুখে গাম্ভীর্য এবং কঠোরতা এনে বললো,
-আমি আপনাকে বিবাহ করবো না রাজকুমার।
-দ্বিমত করার কারন?
এ পর্যায়ে পিঞ্জর হারানোর যন্ত্রণায় হিংস্র হয়ে উঠলো অতৃপ্তা।চোখে-মুখে ক্ষোভ নিয়ে বললো,
-কারন আপনি আমার পিঞ্জর কে হত্যা করেছেন।যে পুরুষের মধ্যে পশুপাখির জন্য সামান্য মায়ার অস্তিত্ব নেই সে কি করে আমায় ভালোবাসবে?এরকম পাষাণ পুরুষকে কিরুপে বিবাহ করিবো বলতে পারেন?
কোনোপ্রকার বাক্যব্যয় করলেন না রাজকুমার।নিরব হয়েই প্রস্থান করলেন।অতিথিশায়ায় তার জন্য বরাদ্দকৃত বিলাসবহুল কক্ষটায় বসে বাহক কে ডাকলেন।পরপর দুটো পত্র লিখিয়ে ক্ষান্ত হলেন।দুটো পত্র নয় বরং একটা চিরকুট এবং অন্যটা পত্র।বেছে বেছে পত্রটিকে হাতে নিয়ে পড়লেন।
শ্রদ্ধেয় পিতা,
অতি দ্রুত’ই আপনি ইন্দ্রনগরের উদ্দেশ্যে মাতা এবং ভগ্নি সৌদামিনীকে নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করিবেন।রাজকুমারী অতৃপ্তার প্রতি আমি বড়’ই মুগ্ধ হইয়াছি এবং আমার ইচ্ছা এইরুপ যে চলমান যাত্রায়’ই তাহাকে বিবাহ করিয়া রাজপ্রাসাদে ফিরিবো।যদি কোনোভাবে ইহার বিপরীত হয় তা-হইলে রাজকুমারের শূণ্যতায় চন্দ্রনগরের প্রাসাদ খাঁ খাঁ করিলেও তিনি আর ফিরিবেন না।
পত্র রচনায়
রাজকুমার অভিরুপ সিং,চন্দ্রনগর।
পত্রখানা পড়িয়া বাহকের হাতে দিলেন।বললেন,
-অতিদ্রুত প্রেরণের ব্যবস্থা করুন।
বাহক একটু ইতস্তত বোধ করিয়া বলিলেন,
-রাজকুমার, অন্য পত্রটা কি প্রেরণ করিবেন না?
পত্রখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়িয়ে চাড়িয়ে চুপ হয়ে রইলেন।খানিকটা নিরবতা উপভোগ করে বললেন,
-এটা প্রেরণের উপযুক্ত সময় এখনো হয়নি।যেটা জোগাড় করতে বলেছি সেটা করো।যত স্বর্ণমূদ্রা প্রয়োজন হয় দেব।কিন্তু তাও আমার চাই।
৮.
সান্ধ্যকালীন আহার উপভোগ করার পর রাজকন্যা নিজ কক্ষে আসলেন।মুখের পাতলা কাপড় টা খুলে বিশালাকার দর্পনে স্বীয় মুখশ্রীর লাবণ্য দেখিতে ব্যস্ত হইলেন।হঠাৎই চোখ পড়িলো দর্পণের ভেতর।সেদিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘোর লাগা চোখে-মুখে পিছু ফিরলেন।পরিশ্রান্ত কদমে এগিয়ে গেলেন পালঙ্কের কাছে।নরম তুলোর বিছানার উপরে শুয়ে আছে এক শুভ্র স্বাস্থ্যবান বনবেড়াল।আত্মচিৎকার করে বেড়াল টাকে বুকের সাথে বাঁধিলো।ছলছল চোখে কেঁদে আপ্লুত হয়ে বললো,
-আমার পিঞ্জর!
বেড়াল টাকে বুকের সাথে বাঁধতেই পালঙ্কের উপর রাখা ছোট্ট চিরকুট খানার দিকে নজর গেল।ত্রস্ত হাতে সেটাকে তুলে নিয়ে ভাঁজ খুললো।সাথে সাথেই দৃশ্যমান হলো ভেতরকার লেখাগুলো।
“রাজকুমারী,
আপনাকে সাময়িক ব্যথিত করিবার জন্য হতভাগা ক্ষমাপ্রার্থী।শিকারের ব্যস্ততায় অজ্ঞাত হইয়া আপনার প্রিয় পিঞ্জরকে হত্যা করিয়াছি।কিন্তু উক্ত ভুলের যে কোনো সমাধান খুঁজিয়া পাই না।প্রতিনিয়ত ওমন কাজল চোখ একটা প্রাণীর বেদনায় অশ্রুতে লেপ্টে থাকিবে এ যে রাজকুমারের জন্য বিষাক্ত নীলাভ তীরের ফলার মতো বিঁধিয়াছে।সে জন্যই সারা রাজ্য খুঁজিয়া আরেকটা পিঞ্জর আনিয়া দিয়াছি।আশা করছি ইহার পরিবর্তে পরবর্তী সাক্ষাৎ এ একটু হইলেও ভালো ব্যবহার আশা করিতে পারি।তবে একটা সত্য স্বীকার না করিলেই নয়।রাজকুমার বড়ই হিংসুটে।তার চেয়েও অধিক ভালো রাজকুমারী অন্য আরেকজনকে বাসিবে এ যে অসহ্যকর।হোক সে প্রাণী,তাও অনুভূতি টা যন্ত্রণাদায়ক।আশা করছি পরবর্তীতে আপনার দ্বিতীয় পিঞ্জরকে আমার চেয়েও অধিক ভালো বাসিবেন না।ইহাতে সেই একই ভুল আবার করিবার সম্ভাবনা থাকিবে।তখনকার ভুল অজ্ঞাত থাকিলেও পরবর্তীতে সেটা জ্ঞাত’ই থাকিবে।
পত্র রচনায়
রাজকুমার অভিরুপ সিং
পত্রখানা পড়তেই রাজকুমারীর চোখে-মুখে বিস্তর উজ্জ্বলতা দেখা গেল।চক্ষু দুটো বন্ধ করে ধ্যানহারা হয়ে শুয়ে পড়লেন পালঙ্কে।আকস্মিক এমন অধিকারবোধে যে কোনো রমনীই তো মন হারিয়ে ফেলবেন এ যে অস্বাভাবিক কিছুই নয়।পরক্ষণেই দপ করে চোখ খুললেন।মনে মনে প্রগাঢ় প্রতিজ্ঞা করে বললেন,“সে তো যেমন তেমন রমনী নয়,সে রাজকন্যা।সামান্য একটা পত্রেই মন খুইয়ে বসে থাকা তার সাজে না।আর পড়বে না ওই ধুরন্দর রাজকুমারের সামনে। কক্ষনো না।পরক্ষণেই মন তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো তার পালানোর কথা।যদি সে রাজকুমারের সম্মুখে আর নাই’ই পড়ে তাহলে সে ভাববে রাজকন্যা তাকে ভয় পাচ্ছে, অথবা তার প্রেমে পড়ার কারনে লজ্জা পাচ্ছে।উহুহু!এমনটা হতে দেওয়া যাবে না।রাজকন্যা প্রতিনিয়ত তার সম্মুখে হাঁটবে।চিত্ত উঁচু করে শির খাঁড়া করে চক্ষুপানে চক্ষু রেখে হাঁটবে।তাকে বোঝাবে যে রাজকন্যা এতো সহজে হারবার পাত্রী নয়।কেন দিলো সে এই হুমকি মাখা চিরকুট।আর কি ভেবেছে একটা বনবেড়াল এনে দিলেই কি সে পিঞ্জরের কথা ভুলে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে?মোটেও না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই শিরায় শিরায় রক্ত টগবগ করে ধাবমান হলো।বেড়ালটাকে দাসীর নিকট রেখে দ্রুত কদমে বেরিয়ে পড়লো কক্ষ থেকে।এতোটাই তাড়াহুড়ো করেছিলো সে যে মুখ ঢাকতেই ভুলে গেছে।অতিথিশালায় ঢুকতেই প্রহরী আটকালো তাকে।পরক্ষণেই নিচু মুখে কাচুমাচু করতে করতে ফটক খুলে দিলো।রাজকন্যা দাম্ভিকতার বেশে অনুমতি ছাড়াই রাজকুমারের কক্ষে প্রবেশ করলেন।কন্ঠে তেজ নিয়ে বললেন,
~কি ভেবেছেন আপনি?আরেকটা বেড়াল দিলেই আমি খুশি হয়ে পিঞ্জরের কথা ভুলে যাবো?আর আপনাকে বিবাহ করতে রাজি হবো?
রাজকুমার নিরব।তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা,মুখশ্রীতে মোহনীয়তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছেন রাজকন্যার মুখপানে।ধীর কদমে সামনে এগিয়ে মোহনীয় কন্ঠে বললেন,
-এই চন্দ্র একমাত্র চন্দ্রনগরেই শোভা পায়।
মুহুর্তে’ই হতভম্ব হয়ে গেলেন রাজকন্যা।তার মুখশ্রী প্রকাশ্যে বুঝতে পেরেই কাঁচুমাচু করতে লাগলেন।রাজকুমার স্বীয় রুমাল ছুঁড়ে মারলেন তার দিকে।বললেন,
-ঢেকে রাখো রাজকন্যা।এটাই উত্তম হবে।কয়েক মুহুর্তেই আমার অন্তর জ্বালিয়ে দিয়েছো তুমি।নিদ্রা নিতে পারবো কি বাকিটা প্রহর?
থতমত খেয়ে গেলেন রাজকন্যা।ধমক দিয়ে বললেন,
-চুপ থাকুন।বাজে বকবক করা বন্ধ করুন।কেন দিয়েছেন আমাকে উপহার?
-এই প্রশ্নটা প্রভাতেও করা যেত।এই গভীর রাতে অন্দরমহল পেরিয়ে অতিথিশালায় আসার কি কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিলো?মানছি ভবিষ্যৎ স্বামীকে না দেখে নিদ্রা হচ্ছিলো না তোমার,তাই বলে লজ্জাও ছুঁলো না তোমায়?
আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো অতৃপ্তা।বললো,
-রাজকন্যা অতৃপ্তা কোনো কিছু ভয় পায় না।তার কাছে রাত-দিন সব সমান।
ঠোঁটে চওড়া হাসি ফুঁটিয়ে দু-কদম সামনে এগিয়ে আসলেন রাজকুমার।সম্মুখ প্রান্তের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ঝুঁকলেন রাজকন্যার দিকে।তার মুখের গরম নিঃশ্বাস গুলো বক্ষপিঞ্জরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। রাজকন্যা ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে নিলো।নিজেকে শামুকের মতো গুঁটিয়ে নিতে লাগলো ক্রমশ।দীর্ঘক্ষণ কোনো নিঃশ্বাসের আওয়াজ না পেয়ে দপ করে চোখ খুললো।রাজকুমার আসনে বসে হাসছেন।অতৃপ্তাকে চোখ খুলতে দেখে বললেন,
-তুমি ভীতু নও সেটা আমিও জানি।তবে তুমি রমনী,লজ্জাবতী লতার ন্যায়।একটু ছুঁলেই ডাল-পাতা নিয়ে নেতিয়ে পড়বে এক্ষুণি। কলঙ্ক তোমাকেও নিমিষে ছুঁতে পারবে।তবে রাজকুমার অভিরুপ সিং কোনো কলঙ্কিত নারীকে বিবাহ করিবে না।কক্ষে যাও,দ্রুত!
রাজকুমারী দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন কক্ষ থেকে।নিজেকে কড়া ভাবে শাসালেন বোকামির কারনে।গুরুজনরা ঠিকই বলে।পুরুষ মানুষ কাছেই আসে নারীর বুদ্ধি শুষে নেওয়ার জন্য।এরা প্রতিটা দৃষ্টিতে এবং কথায় মগজ খায়।
চলবে?