চন্দ্রকথা পর্ব-০৫

0
293

#চন্দ্রকথা
সিমরান মিমি
পঞ্চম পর্ব

ছায়াচ্ছন্ন অপরাহ্ণ।দিনমনি অস্তমিত হবার অপেক্ষায় মাত্র। বিস্তীর্ণ জনাকীর্ণ ভূমির উদ্ভিদেরা প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পঁচে গেছে এবং বাকি টুকু রোদের তাপে শুকিয়ে শুকনো খড়কুটোতে রুপ নিয়েছে।এই মৃতভূমির মধ্যখানটাতে জীবন্ত এক পদ্মবিল।তার’ই কিনারে বসে আছেন দুটি মানবছায়া।রাজকুমার অভিরূপ সিং এর বাহু দ্বারা আবদ্ধ হয়ে বুক-পিঠে ঠেকিয়ে ছোট্ট খাচার পক্ষীজাতের মতো বসে আছেন রাজকুমারী অতৃপ্তা।

_প্রিয় পদ্মরাগিনী,অর্ধচন্দ্রের চেয়েও অধিক উজ্জ্বল শ্রেষ্ঠ কৌমুদিনী,আমার অতৃপ্তা;এই অধম রাজকুমার কে কি বিবাহ করা যায়?

রাজকুমারী তার অধর এবং ওষ্ঠ ফাঁক করে লজ্জায় নুয়ে পড়ে হাঁসলেন।এই উজ্জ্বল হাসির সাথে সাথেই যেন অজস্র মুক্তা ঝরে পড়লো কিনারে।সন্ধ্যার আঁধার ধরনীতে ঘেরাও করলেও যেন তা আলোকিত হয়ে উঠলো তার রুপের উজ্জ্বলতায়।মাথা নাড়িয়ে ধীর কন্ঠে আওড়ালেন,

-যায়।

শব্দটুকু উচ্চারণ করতেই লজ্জারা যেন তার সারা দেহ ছেঁপে উঠলো।উত্তেজিত মন,কম্পনরত ঠোঁট, রক্তিম মুখশ্রী, ধানের পাতার মতো ঢেউ খেলানো দেহটাকে নিয়ে দ্রুত উঠে পড়লো রাজকুমারের কোল থেকে।আর পিঁছু ফিরলো না।ছুঁটতে লাগলো অন্ধকারের দিকে।হাতের আঙুলগুলো শিরশির করে উঠছে।প্র‍য়াস হচ্ছে কিছু চেপে ধরার।পিছপা হলেন না তিনি।অন্ধকারের মধ্যেই কাছে থাকা কিছু দুহাত দিয়ে চেপে ধরলেন।নরম শিমুল তুলার ন্যায় বস্তুটিতে ঢুকে পড়লো রাজকুমারীর নখ।ছিঁড়ে নাকের কাছে উড়তে লাগলো তুলা।আচমকাই খুক খুক করে কেশে উঠলেন তিনি।পাশ থেকে পিতলের জগ টা নিয়ে পান করলেন পানি।সম্বিত ফিরতেই লক্ষ্য করলেন কক্ষের এক কোনায় জ্বলন্ত মোমবাতির দিকে।ধীরে ধীরে পদ্মবিল এবং রাজকুমারের অনুপস্থিতি বুঝতে পেরে আবিষ্কার করলেন এটা তার খোয়াব ছিল এবং তিনি কক্ষেই ছিলেন।খোয়াব শব্দটা মস্তিষ্কে আসতেই রাজকুমারী লজ্জায় নুইয়ে পড়লেন।নিজেকে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন,“ছিঃ!হোক এটা খোয়াব।তাও রাজকুমারী কি করে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে বিবাহের প্রস্তাবে রাজি হলো?তাও কি-না ওই রাজকুমারের কোলে বসে।”

আচ্ছা,যদি এমন হতো, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে সে সবটা জেনে যাবে এবং স্বপ্নের বিবরণ ও।তাহলে?ভাবতেই রাজকুমারের সম্মুখ প্রান্তের আসনে বসে থাকা রাজকুমারী লজ্জায় নুইয়ে পড়লো সেই ভরা জনসভার মধ্যেই।তার মুখ-চোখ জুড়ে উজ্জ্বলতা এবং লজ্জার রক্তিম আভা উপস্থিত।চন্দ্রনগরের মহারানী পারমতি বানু সিং রাজকুমারের দিকে সেই থেকেই লক্ষ্য করছেন।তারা প্রাসাদে এসেছেন দু প্রহর কেঁটেছে।পুত্রের বিবাহের প্রস্তাবে বেশ আঁটসাঁট বেঁধে এসেছেন এবার।যার দরূন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সভাসদ নিয়ে বসেছে আজকের সভা। ইন্দ্রনগের রাজা শওকত উজ জামান সবার সঙ্গে আলোচনা শেষে কন্যাকে প্রশ্ন করলেন। বললেন,

_“রাজকন্যা,তোমার যাবতীয় শিক্ষা-দীক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে কিছুকাল পূর্বেই।তোমার ইচ্ছার মূল্য দিয়ে আজ অবধি কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেই নি।তবে এ-পর্যায়ে বিবাহ করা উচিত।চন্দ্রনগরের মহারাজ, মহারানী,রাজকুমার প্রত্যেকেই উপস্থিত এখানে।তারা তোমাকে উক্ত রাজ্যের ভবিষ্যৎ রানী করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।এবারে তোমার মত জানাও।তবে একটা কথা স্মরণে রাখবে,এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও অতি শীঘ্রই তোমার পছন্দনীয় কোনো পাত্রকে হাজির করবে।তবুও বিবাহ তোমাকে করতেই হবে।

চমকে উঠলেন রাজকুমারী। খোয়াব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার মধ্যিখানে এতোসব কথা যেন বেমালুম অগ্রাহ্য’ই করেছে সে।হুট করেই রাজ সভার মধ্যে তিনি বেশ অসস্তিতে পড়লেন।লজ্জা, উত্তেজনা,চমক সব মিলিয়ে আমতা আমতা করে বললেন,

_আমি বিবাহ করিতে প্রস্তুত নই পিতা।আর আমার কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ ও নেই।

হাসলেন মহারানী।বললেন,

-রাজকুমারী আর কি বা বলবে।তিনি তো লজ্জায় গুমরে মরছেন।নিজের বিবাহের কথা কি আর নিজে বলতে পারে?বিগত পুরো সময়টাতে নিরবেই আমি তাকে লক্ষ্য করেছি এবং সম্মতিসূচক হাসিও দেখেছি।নতুন করে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই।

রাজকুমারী চোখ তুলে একবার অভিরুপের দিকে তাকালেন।পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে মহারানীর দিকে তাকিয়ে সম্মানের সহিত বললেন,

-“তেমন কোনো ব্যাপার নয় রানী’মা।

থেমে,

পিতা, আমি সভা ছাড়ছি।কক্ষে যাওয়া প্রয়োজন।

বলেই দ্রুতপায়ে হেঁটে গেলেন।দাসীরাও একে একে তার পিছু ধরলেন।রানী পারমতি হেসে বললেন,

“রাজকন্যার নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই।অভিরুপ কে যে তার অপছন্দ সেটাও বলেননি।শুধু বলেছেন বিবাহে প্রস্তুত নন।আপনার কি মনে হয় মহারাজ,বিবাহ যোগ্যা এক পাত্রী যে চে নির্লজ্জের মতো বলবে আমি বিবাহে রাজী,আয়োজন শুরু করুন।”

রাজকীয় বিবাহের জন্য পুনর্দমে সজ্জিত হলো চন্দ্রনগরের প্রাসাদ।প্রাসাদের বহিরাঙ্গন থেকে পুরোপুরি সোনালি আলোয় ঝলমল করছে। প্রবেশদ্বারের উপরে সোনার পাতে তৈরি বিরাট তোরণ স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে দুই রাজ্যের প্রতীক চিহ্ন খোদাই করা । তোরণ থেকে ঝুলছিল মুক্তোর মালা, যা অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে। প্রাসাদের বাইরের পথজুড়ে বিছানো লাল মখমলের কার্পেট, যার পাশে সারি দিয়ে সাজানো রূপার মশাল।রাজকীয় পালকি থেকে রুপালি ঝালর সরিয়ে নববধু উঁকি দিয়ে দেখলো সবটা
প্রাসাদের অন্দরমহলে ঢুকতেই প্রথম দৃষ্টি পড়লো স্ফটিকের বিশাল ঝাড়বাতি, যা প্রাসাদকে এক স্বপ্নময় আলোয় ভরে তুলেছে। প্রাসাদের ছাদ এবং দেওয়ালে কারুকাজ করা চিত্র, যা রত্নখচিত সোনার সীমানা দিয়ে আবৃত । বিশাল হলঘরটি সজ্জিত ছিল চন্দনের কাঠের আসবাবপত্র, যা সোনার পালিশে ঝকঝক করছে।সারা প্রাসাদ জুড়ে ফুলের অপরূপ সজ্জা। হলঘরের প্রতিটি কোণে রাখা সুবিশাল ফুলদানি, যাতে সাজানো অজস্র পদ্ম। বিবাহের যাবতীয় অনুষ্ঠান ইন্দ্রনগরেই সম্পন্ন হয়েছে। বিবাহ পরপরই অতি দ্রুত নববধুর পালকি,ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত নিয়ে রাজ্যের দিকে রওনা দিয়েছে তারা।দীর্ঘ একটা মাস রাজ্য ছিলো অনাথের ন্যায়।রাজা-রানি, রাজপুত্র, কন্যা,এক তৃতীয়াংশ সৈন্য সবই ছিলো তাদের সাথে।দীর্ঘ এ সময়ে যেকোনো মুহুর্তে’ই রাজ্য দখল করে নিতে পারতো শত্রুরা।যার কারনেই তাড়া।


তাজা ফুল এবং রঙ-বেরঙের মোমবাতির আলোয় ছেয়ে আছে কক্ষ।বিশালাকার পালঙ্কের উপর বিছিয়ে রাখা হাজারো গোলাপের পাপড়ি।রাজকন্যা অতৃপ্তা কম্পনরত হাতে পাপড়ি গুলো সরিয়ে পালঙ্কে বসলেন।আশে-পাশে অজস্র নতুন দাসী।তারা ব্যস্ত রয়েছে রাজকন্যাকে সেবা দেওয়ার প্রয়াসে।রাত্রি ধীরে ধীরে গভীর হলো।নিরবতায় ছেঁয়ে গেল প্রাসাদ।হঠাৎ’ই কানে এলো জুতোর ঠক্ ঠক্ আওয়াজ।আতংকে ছেঁয়ে গেল দাসীরা।তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেললো।যেন ওই আওয়াজের অধিকারী তাদের আতংকের কারন।যিনি কক্ষে প্রবেশের পূর্বেই তাদেরকে সেই কক্ষ ত্যাগ করতে হবে।

অবশেষে চলে এলো সেই সন্ধিক্ষণ।রাজকুমার অভিরুপ সিং জয়ীর বেশে শির উঁচু করে ঢুকলেন কক্ষে।যেন ইন্দ্রনগরের এই রাজকুমারী কে জয় করা বিস্তর প্রদেশ দখল করার চেয়েও অধিক কঠোর এবং অসম্ভব ছিলো।তবে তিনি সেটা পেরেছেন।এবং সেটাও খুব দ্রুত প্রেমের বিনিময়ে।কথিত রয়েছে নারী হচ্ছে বহুরুপী।তনে এদের আয়ত্ত করাও খুব সহজ।এদের সাথে আপনি যত কঠোর হবেন তার পরিবর্তে তার দ্বিগুন কঠোরতা আপনি ফেরত পাবেন।নারীকে ভালোবাসতে হয়।তাকে আপনি যতটা স্নিগ্ধ এবং কোমল ভাবে ছোঁবেন, সে তার অধিক দ্রুততার সাথে নুইয়ে লজ্জাবতী লতার ন্যায় বাহুতে আবদ্ধ হবে।অভিরুপ বক্ষ ফুলিয়ে পালঙ্কে বসলেন।হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেন রাজকন্যার কপোল।বৃদ্ধাঙুল দিয়ে সযত্নে ছুঁয়ে দিলেন অধর।অতৃপ্তা ছিঁটকে দূরে সরে গেল।বক্ষের কম্পন বাড়ছে ক্রমশ।দুহাতে মখমলের চাঁদরটি খাঁমছে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো।রাজকুমার বাঁধা মানলেন না।বাহু দ্বারা আবদ্ধ করে ওষ্ঠাধরে চুম্বন করলেন।দীর্ঘ সময় এ অনুভূতিতে ডুবে থাকার পর ঘোর লাগানো কন্ঠে রাজকুমার বললেন,

-আমার পদ্মফুল,আজ আপনাকে দলিত করবে এই রাজকুমার।তবে ভয় নেই।একটা পত্রদল ও বিনষ্ট করবো না।শুধু ভালোবাসবো।

চলবে?