#চলার_শেষ_প্রান্তে(৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
মতিন সাহেব আসতে আসতে রাত আটটা বেজে গেল। এসেই মেয়ের শুকনো চোখমুখে দেখে আন্দাজ করে ফেললেন মেয়ে তার ভালো নেই। কিন্তু ঠিক কি হয়েছে? আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখলেন সোফার এক কোনায় দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে সিরাজ। এখানে আর কেউ নেই।
ফারিয়া বাবাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। চোখের পানি গুলো বাঁধা মানছে না কিছুতেই। মতিন সাহেব বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে?
সিরাজ এবার মুখ তুলে তাকায়, দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে তাকায় বাবা মেয়ের দিকে।
ফারিয়া ভাঙ্গা গলায় বলল,
–” আমার আর সংসার করা হলো না আব্বু। সিরাজ আমাকে তালাক দিয়েছে।
মতিন সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কিছুক্ষণ শব্দহীনভাবে ফারিয়ার কথা গিললেন তিনি। বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। মাথার ভেতর শব্দ করছে, বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবুও ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
–” কি বলছিস ফারিয়া? তালাক! সিরাজ এটা সত্যি?
সিরাজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার নিরবতাই যেন সব সত্যি করে দিল।
মতিন সাহেব চোখ মেলে তাকালেন সিরাজের দিকে। কণ্ঠে অসীম ক্লান্তি আর কষ্ট মিশিয়ে বললেন,
–” তুমি কি ভেবেছো, একটা মেয়ের জীবন এভাবে তছনছ করে দিলে সব শেষ হয়ে যাবে? এতো অমানুষ তুমি জানা ছিল না তো।
সিরাজ অসহায় দৃষ্টিতে ফারিয়ার দিকে চাইল। তারপর মাথা নিচু করে অস্পষ্ট গলায় বলল,
–” আমি আমি আর পারছিলাম না চাপে থাকতে। অনেকদিন ধরেই আমাদের মধ্যে সমস্যা হচ্ছিল। তাই আজ রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন…..
সিরাজ দ্রুত পায়ে এসে মতিন সাহেবের হাত দুটো ধরে আবারো বলল,
–” বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে বলিনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। আমি এই তালাক মানি না।আমি ফারিয়াকে কিছুতেই ছাড়তে চাই না খালু।
মতিন সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বুকের গভীরে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ধরলেন। আবার চোখ মেলে ফারিয়ার মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
–” চল মা, এখানে আর থাকার কিছু নেই।
সিরাজের মা এতোক্ষণে বেড়িয়ে আসেন। এসেই বললেন,
–” রাগের মাথায় বলে ফেলেছে এটাকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করেছেন কেন বুঝতে পারছি না। কাজী এনে আবার বিয়ে পড়িয়ে দিলেই হবে।
সিরাজের মায়ের কথায় মতিন সাহেবের রা/গ আরও বেড়ে গেল। কণ্ঠ কঠিন অথচ সংযত সুরে বললেন,
–” ইসলামে তালাকের বিষয়টাকে এত তুচ্ছ করে দেখার অনুমতি কোথাও দেয়া হয়নি। তিনবার তালাক উচ্চারণ করলেই বন্ধন চিরতরে ছিন্ন হয়। সেটা কি আপনি জানেন?
সিরাজের মা একটু বিচলিত হলেন, কিন্তু তবুও বললেন,
–” রাগের মাথায় একটা কথা বেরিয়ে গেছে, তার জন্য মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিতে চাইছেন?”
মতিন সাহেব এবার গলা শক্ত করে বললেন,
–” আমার মেয়েকে নিয়ে আপনাকে আর ভাবতে হবে না। আমার মেয়ের জীবন আপনি বা আপনার ছেলে খেলনা মনে করেছেন নাকি? যখন খুশি বিয়ে, যখন খুশি তালাক! এটা কি মজা? না বোন, আমার মেয়ে আর এই সংসারে ফিরবে না। ওর আত্মসম্মান আছে।
ফারিয়া তখন বাবার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, বাবার শক্ত ভাষায় আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলোও যেন কিছুটা শান্ত হলো।
সিরাজের মা অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। সিরাজ একদৃষ্টিতে মেঝে তাকিয়ে আছে। তার মধ্যে কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো অনুশোচনাও যেন মুখ ফুটে বের হতে পারছে না।
মতিন সাহেব আর একটি মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে রাজি নন। ফারিয়ার হাত শক্ত করে ধরে বেরি়ে যেতে চাইলে সিরাজ আবারো অনুরোধ করে বলল,
–” আমাকে একটা সুযোগ দিন খালু? আমি মসজিদের ইমাম সাহেব কে নিয়ে আসতেছি। উনি যেই ফয়সালা দিবেন আমি মেনে নিব।
মতিন সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। এক মুহূর্তের জন্য ফারিয়ার দিকে তাকালেন। ফারিয়ার চোখে স্পষ্ট অনীহা। কষ্টে জর্জরিত সেই চোখ দুটো যেন বলছে, আর নয়। তবুও অভিভাবক হিসেবে মতিন সাহেব আবেগকে সংবরণ করে দৃঢ় গলায় বললেন,
–” ঠিক আছে, ইমাম সাহেব আসুন, তার কথাই চূড়ান্ত হবে। কিন্তু মনে রেখো যাই হোক আমার মেয়েকে এখানে আর থাকতে দিচ্ছি না।
সিরাজ হাঁফাতে হাঁফাতে বেরিয়ে গেল ইমাম সাহেবকে আনতে। বাড়িতে চাপা উত্তেজনা। ফারিয়া বাবার কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইল। তার ভেতরেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর, সাদা পাঞ্জাবি পরা, মাথায় টুপি, গম্ভীর চেহারার এক ইমাম সাহেব সিরাজের সাথে ঘরে ঢুকলেন। ঘরের ভেতর এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। ফারিয়া সহ মহিলারা বড় করে ঘোমটা টেনে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।
ইমাম সাহেব আসন গ্রহণ করে শান্ত গলায় বললেন,
–” কি বিষয়? বলুন।
সিরাজ কাঁপা গলায় সব খুলে বলল, কীভাবে রাগের মাথায় তিন তালাক উচ্চারণ করেছে এবং এখন তা ফিরিয়ে নিতে চায়।
ইমাম সাহেব পুরো বিষয় শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
–” ইসলামে তালাক খুব সহজ কোনো বিষয় নয়, আবার এটাকে খেলাচ্ছলে নেয়াও ভয়াবহ গুনাহ। যদি তিনবার তালাকের শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে, তবে বিবাহ বন্ধন ইতিমধ্যেই শেষ।
ঘরে নেমে এলো ভারী নীরবতা। আরো স্পস্ট ভাবে বোঝাতে ইমাম সাহেব রেফারেন্স সহ বললেন,
–” ইসলামী শরীয়াহ মতে তালাক হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্নকারী চূড়ান্ত পদক্ষেপ। দাম্পত্য জীবনের সমস্যা জটিল হয়ে পড়লে এবং সমস্যা নিরসনের আর কোনো উপায় না থাকলে তা থেকে নিষ্কৃতির পথমাত্র। তাই তালাকের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে,পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তালাক দেওয়া, কথায় কথায় তালাক দেওয়া অন্যায়। তাই এ থেকে বেঁচে থাকা কর্তব্য।
আর তালাক যেহুতু অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তাই কেউ এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে। তাই কেউ যদি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেয়, জেনে হোক অথবা না জেনে, রাগের মাথায় হোক অথবা ঠাণ্ডা মাথায়, তাহলে তিন তালাক কার্যকর হয়ে সংসার বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। এরপর থেকে তিন তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর সাথে, পরস্পর দেখা-সাক্ষাত ও মেলামেশা এবং ফোনে যোগাযোগ রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম।
তিন তালাকের পরেও একত্রে বসবাস করা, বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট রাখা সুস্পষ্ট ব্যাভিচার বলে গণ্য হবে। ফলশ্রুতিতে এই অবস্থায় সন্তান জন্মগ্রহণ করলে বাচ্চার বংশ পরিচয় বাবার থেকে প্রমাণিত হবে না। বরং ওই সন্তানকে জারজ সন্তান বলা হয়। আর শরীয়ত নির্ধারিত উত্তারাধিকারী উক্ত জারজ হবে না। জারজ সন্তানের নিসবত হয় তার মায়ের দিকে। সেই হিসেবে পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাবার বদলে শুধু মায়ের নাম ব্যবহার করতে পারবে।
জেনে বা না জেনে কেউ এরূপ করে থাকলে এখন করনীয় হচ্ছে দ্রুত আলাদা হয়ে যাওয়া এবং এতোদিন অবৈধ সংসার করার কারণে আল্লাহ তা’আলার দরবারে উভয়কে খাঁটি মনে তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে।
তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত—
তিন তালাকের পর থেকেই উক্ত নারীর ইদ্দত শুরু হয়ে যায়।
এরপর ইমাম সাহেব চলে গেলে মতিন সাহেব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখে বললেন,
–” আল্লাহর বিধানই আমার সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আমার মেয়ে অপমানিত হয়ে আবার এ সংসারে ফিরবে না। চল ফারিয়া।
ফারিয়া চোখের পানি মুছে বাবার হাত ধরল।শেষবারের মতো এই বাড়ির দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল। কত স্বপ্ন বোনা ছিল এখানে অথচ সব ভেঙে গেল এক নিমিষেই। বুকভরা কষ্ট নিয়েও শক্ত পায়ে এগিয়ে গেল নিজের সম্মান আর নতুন জীবনের পথে। পেছনে পড়ে রইল কিছু অবহেলিত সম্পর্কের ভাঙা টুকরো।
ফাঁকা ঘরে একা দাঁড়িয়ে রইল সিরাজ, অনুতাপে ভেঙে পড়া এক মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে….
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।
_________________
রেফারেন্সঃ
রেফারেন্সঃ
ফাতাওয়ায়ে শামী ৩/৫১৮, হিদায়া ২/৪৩৮, দুররে মুখতার ৩/৫৪৯,বাদায়েউস সানায়ে ৩/১৮৭, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ২/৯১, বিন্নুরি টাউন 144001200048।
হানাফী ফিকহ (Hanafi Fiqh)
____________________
(আসসালামু আলাইকুম।
ভুল গুলো মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করছি।আর গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি সবার থেকে।)