চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-০৪

0
12

#চলার_শেষ_প্রান্তে(৪)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

চারদিক জুড়ে নেমে এসেছে শুনশান নীরবতা। রাত গড়াচ্ছে দ্রুত, যেন সময়ও হাঁপিয়ে উঠেছে শোকের ভারে। দুপুর থেকে কেউ মুখে কিছু তোলেনি। খিদের যন্ত্রণায় শরীর কাঁপছে সিরাজের মায়ের, তবু মুখে কিছু বলেননি এতক্ষণ। অবশেষে, শক্ত হয়ে উঠে বড় ছেলের বউ রিনার ঘরে গেলেন তিনি। ক্লান্ত গলায় বললেন শাহীনা বেগম।
–” বড় ব‌উ রান্নাটা বসিয়ে দেও। সবাই দুপুর থেকে না খেয়ে আছি, আমারও শরীরটা ভালো লাগছে না।

রিনা তখন ঠোঁট বাঁকিয়ে গলা উঁচু করে বলল,
–” এতদিন তো ফারিয়াই সবকিছু কে/টে-ধুয়ে ঠিক করে দিত, আমি শুধু রান্না করতাম। এখন ও যখন নাই, আপনি সব ঠিকঠাক করে দেন, তারপর আমি রান্না করবো!

এই কথা শুনে শাহীনা বেগম যেন বি/ষ খেয়ে বসেন। চোখ রাঙিয়ে গর্জে উঠলেন,
–” তুমি আমাকে কাজের হুকুম দিচ্ছ? এত বছর সংসারে আছো, কখনো কি আমাকে এইসব করতে দেখেছো?

রিনা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল,
–” আপনি এতদিন করেন নাই, তাই বলে কি এখন পারবেন না নাকি? আপনি সবকিছু গুছিয়ে দিলে তবেই রান্না করবো, নাহলে আমি পারবো না!”

ঘরে যেন থমকে গেল বাতাস। রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন শাহীনা বেগমের গলা। পেটে খিদা অবহেলার তীব্র কাঁটা সব মিলিয়ে যেন এক অপার ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
শাহীনা বেগম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। রিনার চোখে-মুখে কোন অনুশোচনার ছাপ নেই। যেন স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো শাহীনা বেগমের।
তিনি ধীরে ধীরে ফিরে এলেন নিজের ঘরে। দরজাটা বন্ধ করে থম মেরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর ধরা গলায় বললেন,
–” আমার সংসারটা কি ফারিয়ার ভরসায় ছিল?”

এরপর দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলেন রান্নাঘরের দিকে। কোনো শব্দ না করে ধুয়ে ফেললেন ডাল, চাল, সবজি। হাঁড়িতে পানি তুলে চুলায় চাপালেন।
রিনা তখন পাশের ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে বলল,
–” সবকিছু ঠিক করেছেন? এবার দিন আমি রান্না করে ফেলি।

শাহীনা বেগম কিছু বললেন না। শুধু মুখ ফিরিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
–” আজ আমি নিজেই করবো। এখনো আমি
মরি/নি।”

রিনার মুখে কোনো কথা থাকলো না। শাহীনা বেগম রান্নায় মন দিলেন। প্রতিটি নড়াচড়ায় যেন এক ধরনের রা/গের ছাপ।
.
.
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে মূল ফটকের দরজায় শব্দ হলো। একটু পরেই ঘরে পা রাখলেন মতিন সাহেব, সঙ্গে ফারিয়া। দরজা খুলে চমকে উঠলেন শাহীনা বেগম। এইতো সন্ধ্যায় তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মতিন সাহেব, কিছু বলেও যাননি। আর এখন, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন!

–” ফারিয়া! বিস্ময়ে বলে উঠলেন তিনি।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। ক্লান্ত, ফ্যাকাসে মুখ, তবে চোখে ভরপুর শান্তি আর মায়ের মুখ দেখার আনন্দ।

ওদিকে ফারিয়ার ছোট ভাই-বোনরা দৌড়ে এল তার দিকে।
–” আপু!
ছোট বোনটা ফারিয়ার হাত ধরে বলল,
–” আপু কেমন আছো? তুমি আসবে আগে বলো নি কেন? তাহলে আম্মু তোমার জন্য অনেক কিছু রান্না করে রাখতো!

ফারিয়া হেসে তাদের জড়িয়ে ধরল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল আনন্দে। মায়ের কোলে ফিরে আসার যে শান্তি, তা কোনো শব্দে বোঝানো যায় না।
সাহানা বেগম অস্ফুট কণ্ঠে বললেন,
–” তুই হঠাৎ এই রাতে?
মতিন সাহেব শুধু বললেন,
–” সব কথা পরে বলবো। আগে ও একটু বিশ্রাম নিক।

স্বামীর কথায় সাহানা বেগম তখন আর কিছু বলেননি ঠিকই, তবে মনের ভেতর কেমন যেন অস্থিরতা জেগে উঠেছে। হঠাৎই মেয়ের চোখের ভেজা কণ্ঠস্বর, ক্লান্ত চেহারা আর সেই নীরবতা তার মনে প্রশ্নের পাহাড় জমিয়ে তুলেছে।

কিন্তু বাহিরে তিনি সবকিছু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন। মুখে এক চিলতে হাসি টেনে মেয়েকে বললেন,
–” তুই হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি তোর জন্য খাবার গরম করে দেই।

রান্নাঘরে ঢুকে চুপচাপ কাজ করতে করতে সাহানা বেগমের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল হাজারটা চিন্তা।
–” ফারিয়ার মুখ এত শুকনো কেন? চোখে এত বিষণ্নতা কেন? কিছু লুকোচ্ছে না তো? সিরাজ কোথায়? ও তো এলো না।

তার ভেতরের এই অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল, কিন্তু মুখে একটাও প্রশ্ন করলেন না। শুধু মেয়ের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললেন,
–” ভাতটা একটু গরম করে দিলাম, খেয়ে নে মা। মনে হচ্ছে তুই কিছুই খাসনি সারাদিন।

ফারিয়া মায়ের মুখের দিকে তাকাল সেই চিরচেনা স্নেহ, কিন্তু তার চোখের গভীরে যেন ছিল এক রকমের শঙ্কা। ফারিয়া আর কিছু বলতে পারল না, শুধু মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে পড়ল খাওয়ার জন্য।

সাহানা বেগম বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে। বড় কিছু। কিন্তু সময়ের অপেক্ষায় রইলেন, কারণ তিনি জানেন, মা হয়ে কখনো কখনো সব প্রশ্ন চেপে রেখে শুধু পাশে থাকা জরুরি হয়।

রাতটা কেমন যেন বোবা এক নিরবতায় কেটে গেল। ফারিয়া চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। সাহানা বেগম একটু পরেই ওর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত বাড়ালেন দরজায় টোকা দেওয়ার জন্য, কিন্তু হাতটা স্থির হয়ে গেল মাঝপথে। মন বলল,
–” এখন নয় সময় হলেই ও নিজেই বলবে।

পরদিন ফজরের নামাজ শেষে সাহানা বেগম কোরআন পড়ছিলেন। পাশে রাখা তসবিহটা হাতে নিতেই মেয়ে এসে তার সামনে চুপ করে দাঁড়াল। চোখ লাল, মুখ শুকনো, কিন্তু ভেতরে যেন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে।
–” আম্মু একটা কথা বলব?

সাহানা বেগম তসবি গুটিয়ে পাশে রাখলেন, ফারিয়াকে পাশে ইশারা করে বসতে বললেন।
ফারিয়ার গলা কেঁপে উঠল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
–” আমার আর সংসার রইল না আম্মু সিরাজ আমাকে তালাক দিয়েছে।

এটা বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
সাহানা বেগম যেন শূন্য হয়ে গেলেন। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, ঠোঁট কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি শুধু বললেন,
–” তোর বাবা রাতে আমাকে সবকিছু বলেছে।

তারপর সাহানা বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কান্না চেপে রাখা চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
–” তোর কষ্টের ভাগীদার আমরাও মা। তুই একা না, তুই একা না।

মা-মেয়ের সেই নিঃশব্দ আলিঙ্গনে যেন হৃদয়ের সব ভাঙাচোরা টুকরো একে একে জোড়া লাগতে শুরু করল। ঘরের বাতাসটা ভারি ছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে ছিল একরাশ স্নেহ, দোয়া আর নির্ভরতার সুবাস।
.
.

দু’দিন পর পাশের বাসার একজন মহিলা । ফারিয়াদের সাথে সম্পর্ক ভালো । ফারিয়াদের বাসায় এসে হাজির হলেন। দরজা খুলতেই ফারিয়াকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন তিনি।

–” আরে ফারিয়া মা, কেমন আছো? শুনলাম তোমার জামাই বিদেশ থেকে এসেছে!

তার কণ্ঠে উৎসুক সুর। এরপর খানিক থেমে আবার বললেন,
–” তা বলো তো, তোমার জন্য কি এনেছে? নিশ্চয়ই অনেক গয়না-গাটি এনেছে, তাই না?

মহিলার কথায় হালকা কাশি দিয়ে ফারিয়া কিছু বলতে গিয়েই থেমে গেল। হঠাৎই স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল সেই দিনের কথা।
সিরাজ বিদেশ থেকে ফিরে তার জন্য একটা চমৎকার সোনার চেইন এনেছিল।
কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। একদিন শাশুড়ি মা কেঁদে কেঁদে বললেন,
–” জীবনে একটা গয়নার অভাব মিটল না রে বাপ!

মায়ের মুখের সেই অভিমান দেখে সিরাজ আর সহ্য করতে পারেনি। চুপচাপ ফারিয়ার গলার চেইনটা নিয়ে বলেছিল,
–” এই চেইনটা মাকে দিয়ে দাও। তোমার জন্য আবার নিয়ে আসব নে।

সেই মুহূর্তে কিছু না বললেও, ফারিয়ার মনে একটা ক্ষীণ কষ্টের রেখা টেনে গিয়েছিল। আজ রিজিয়া খালার কথায় আবার যেন সেই স্মৃতি হৃদয়ের দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেল।
কিন্তু নিজেকে শক্ত করে সত্যিটা বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ফারিয়া। যেন রোজ রোজ এক কথা তাকে শুনতে না হয়…..

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।