#চলার_শেষ_প্রান্তে(১২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
কয়েকদিন ধরে বাড়ির গলিপথটা একটু বেশিই নীরব লাগছিল ফারিয়ার কাছে। আগে মাঝে মাঝেই তাহসানকে দেখা যেত অফিস যাওয়ার সময়, কিংবা বাবার সাথে বাজার করতে বেরোতে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সেই উপস্থিতি উধাও হয়ে গেছে।
একদিন বিকেলে সাহানা বেগম মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” ওরা নাকি বাসা বদলাবে নতুন ফ্ল্যাটে উঠবে মাসের শেষেই।
ফারিয়া যেন কিছু শুনেও শুনল না। বুকের মধ্যে হঠাৎ একটা শব্দহীন বিস্ফোরণ ঘটল। সে ধীর পায়ে বারান্দায় এল, নিচে তাকাল..
সেদিন রাতে মা যখন ঘরে এলেন, ফারিয়া পড়ার বই খুলে রাখলেও পড়ায় মন ছিল না। আলতো গলায় বলল,
–” নিচ তলার আন্টিরা এবার ভালো বাসা নিয়ে শান্তিতে থাকবেন ইনশা আল্লাহ। আমাদের বাড়িতে থাকতে কতো কষ্ট হয়েছে তাই না আম্মু?
সাহানা বেগম উত্তর দিলেন,
–” ওর বাবার ইচ্ছে ছিল নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার। এখন ওর চাকরিও হয়েছে, তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওদের নতুন বাসাটা শহরের দিকে, অফিসের কাছাকাছি নিবে। আসলে জীবন তো সবার সবসময় একরকম থাকে না আল্লাহ কখন কাকে গরিব থেকে ধনী বানান আবার ধনী থেকে গরিব বানান তা বলা যায় না। আল্লাহ ভালো জানেন।
সেই রাতে ফারিয়া ঘুমাতে পারল না। ভোরে ফজরের নামাজ শেষে চুপ করে জানালার পাশে বসে থাকল অনেকক্ষণ। চোখের সামনে শুধু একটা দৃশ্য ভেসে উঠছিল তাহসানদের চলে যাওয়া, নিঃশব্দ বিদায়, কোনো কথা না বলে, কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে।
আর ফারিয়া? সে থেকে গেল একই উঠানে, একই বারান্দায় এক বুক নিরবতা আর অপূর্ণ অনুভবে ভরে।
বিদায় সময়,
বাসার নিচে ভ্যান এসে দাঁড়াল সকাল সকাল। কয়েকজন শ্রমিক আসবাবপত্র উঠিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। সাগরিকা চৌধুরী বারবার দেখছিলেন যেন কিছু বাদ না পড়ে। তাহসান চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, হাতে ফোন, মুখে কোনও আবেগের রেখা নেই, কিন্তু চোখের গভীরতা বোঝাচ্ছিল, কিছু অনুভব হয়তো সে লুকিয়ে রাখছে।
ফারিয়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কপাল ঠেকানো ছিল গ্রিলের সাথে। নীচে শুধু তাকিয়ে রইল…
সাহানা বেগম পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
–” চলে গেল রে মা, ওদের নাকি আজ থেকেই নতুন বাসায় উঠতে হবে। আমার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে জানিস। ছেলেটার মা ভীষণ ভদ্র আর মিশুক ছিলেন।
ফারিয়া কিছু বলল না। মাথা নিচু করে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তাহসান গাড়িতে ওঠার আগে একবার শুধু ওপরে তাকাল। জানালায় ফারিয়াকে দেখা যায়নি, কিন্তু তার মনে হলো কেউ একজন দেখছে তাকে। চোখে কোনো কথা ছিল না, শুধু একটা মৃদু তাকানো বিদায়ের। তারপর মতিন সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল।
সেই গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতে যেতে, যেন একটা অধ্যায়ও মিলিয়ে গেল।
সন্ধ্যায় আকাশ ছিল খুব শান্ত, বাতাসে হালকা একটা শীতলতা।
তাহসানদের নতুন ফ্ল্যাটটি শহরের অভিজাত এক আবাসিক এলাকায়। বিশাল ছাদ, উন্মুক্ত বারান্দা আর বড় বড় জানালাওয়ালা থ্রি-বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট। বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় অবস্থিত বলে জানালার বাইরে তাকালেই আধা শহর যেন চোখে ধরা দেয়।
সাগরিকা চৌধুরী নতুন ফ্ল্যাট পেয়ে যেন খুশিতে ভেসে যাচ্ছেন। প্রতিটি রুম নিজের মতো করে সাজানো শুরু করেছেন তিনি।
তাহসান তার কিছু জমানো টাকা সব খরচ করে চলেছে বাসা সাজিয়ে তুলতে। যেমন ড্রয়িংরুমের দেয়ালে হালকা বাদামি ও সাদা রঙের ওয়ালপেইন্ট আর তার সাথে মিলিয়ে আনা হয়েছে কাঠের সেমি-মডার্ন সোফাসেট। মাঝখানে সেন্টার টেবিলের উপর একটি কাঁচের ফুলদানি, তাতে তাজা গোলাপ।
তাহসানের রুমে সাদা-নীল থিম রাখা হয়েছে। একপাশে পড়ার টেবিল, বইয়ের র্যাক আর দেয়ালে একটি ঘড়ি ও একটি আয়াতুল কুরসির ফ্রেম। বিছানার পাশে ছোট্ট এক টেবিল, তাতে কুরআন মাজিদ রাখা আছে যেন প্রতিদিনই সে ফজরের পর একটু তেলাওয়াত করতে পারে।
সাগরিকা চৌধুরীর ঘরটি কিছুটা ঘরোয়া রুচিতে সাজানো নরম পর্দা, দেয়ালে কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য, আর কোণের দিকে নামাজের জন্য নির্দিষ্ট একটি জায়গা।
বারান্দায় ছোট গাছের টবগুলো, একটা ঝুলন্ত ঝাড়বাতি আর সন্ধ্যায় জ্বলার মতো ফেয়ারি লাইট সব মিলিয়ে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। সন্ধ্যায় সেখানে বসে চা খাওয়া যেন এক স্বস্তির মুহূর্ত।
তাহসান অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। শহরের আলো ঝলমলে দৃশ্যের মাঝে, হঠাৎ তার মনে পড়ে পুরোনো বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই আবছা মেয়েটা…
শহর বদলায়, ঠিকানা বদলায়, কিন্তু কিছু অনুভব কি সত্যিই ফেলে আসা যায়?
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। সকালবেলা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ফারিয়া বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে দোয়া করল।
–” ইয়া আল্লাহ, তুমি সাহায্য করো। আমার মন শান্ত রেখ, ভুল-ভ্রান্তি যেন না হয়।
সাহানা বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
–” সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছিস তো?
ফারিয়া মাথা নাড়ল, মুচকি হেসে বলল,
–” হ্যাঁ আম্মু। দোয়া কইরো।
রাস্তায় রিকশায় বসে যাওয়ার সময় মায়ের দুচোখের চাহনি বারবার মনে পড়ছিল। তার মায়ের দুআ যেন সব সময় সঙ্গে আছে ফারিয়ার।
পরীক্ষার হলে ঢুকে নিজের রোল নম্বর খুঁজে নিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল। প্রশ্ন হাতে পেয়ে প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে সব সহজ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, প্রশ্ন যেন নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, কলম যেন আপনিই লিখে যাচ্ছে।
প্রথম দিন শেষ করে বাসায় ফিরে দরজা খুলেই বলল,
–” আলহামদুলিল্লাহ আম্মু অনেক ভালো হয়েছে!
সাহানা বেগম খুশি হয়ে মুখে হাত দিয়ে বললেন,
–” আলহামদুলিল্লাহ! আমার মেয়েটা কষ্ট করছে বলেই আল্লাহ এত সহজ করে দিচ্ছেন। বাকিগুলোও ইনশা আল্লাহ ভালো যাবে।
পরের দিনগুলোতেও ফারিয়া সময়মতো পড়াশোনা করে, নামাজের পর দোয়া করে পরীক্ষার হলে যায়। প্রতিদিন ফিরেই বলে,
–” আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়েছে, আম্মু।
মনে মনে সে বুঝতে পারছে জীবনে স্থিরতা, আত্মবিশ্বাস আর ইবাদতের শক্তি কতটা বড়।
.
.
পরীক্ষা শেষে হওয়ার পর,
তৃতীয় বর্ষে উঠতেই যেন পড়াশোনার চাপটা দ্বিগুণ হয়ে গেল। কোর্সগুলো আগের চেয়ে বেশি কঠিন, ক্লাস আর প্রেজেন্টেশন একের পর এক লেগেই আছে। ফারিয়া নিজের রুটিনে পরিবর্তন আনল সকালে পড়া, দুপুরে ক্লাস, বিকেলে টিউশনি, আর রাতে আবার পড়া।
সাহানা বেগম মাঝে মাঝে বলেন,
–” মা, একটু বিশ্রাম নিস। এত দৌড়াদৌড়ি করলে শরীরে চাপ পড়লে।
ফারিয়া হেসে বলে,
–” সময় তো কম আম্মু। এখন কষ্ট না করলে পরে আফসোস হবে।
দুপুরের দিকে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে সে তাড়াতাড়ি নাশতা করে বেরিয়ে পড়ে টিউশনির জন্য। দুইটা বাসায় পড়ায় একটায় ক্লাস সিক্স, আরেকটায় ক্লাস এইটের মেয়েকে। ওদের পড়াতে পড়াতেই নিজের অনেক কিছু ঝালিয়ে নেয় ফারিয়া। আর বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে।
রাতে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে চুপচাপ টেবিলে বসে যায়। তখন সাহানা বেগম এক কাপ চা দিয়ে পাশে এসে বসে বলেন,
–” দেখিস মা, তোর এই কষ্ট একদিন না একদিন কাজে দেবে। আল্লাহ্র উপর ভরসা রাখিস।
ফারিয়া তখন মায়ের চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসে। ক্লান্তি থাকলেও সে জানে তার স্বপ্নগুলোকে বাস্তব করতে হলে এই পরিশ্রমের বিকল্প নেই।
জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা ফারিয়ার চোখে অনেক দূরের এক দৃশ্য ভেসে ওঠে সে নিজেকে সফল একজন শিক্ষিকা হিসেবে দেখে। হয়তো কোনোদিন তার এই পথেই সে আলোর দেখা পাবে ইনশা আল্লাহ।
.
.
সকাল থেকেই ফারিয়ার মনে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা। আজ ফলাফল প্রকাশিত হবে। সাহানা বেগম বারবার এসে বলছেন,
–” কী রে মা, এখনও ফল আসেনি? একটু খোঁজ নে তো?
মোবাইল হাতে নিয়ে ফারিয়া ওয়েবসাইটে বারবার ঢুকছে, আবার বেরোচ্ছে। সার্ভার বারবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। অবশেষে একসময় ফলাফল এসে গেল।
ফারিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ফলাফল দেখে সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর খুশিতে চিৎকার করে উঠল,
–” আম্মু! আমি ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হয়েছি! মানে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি।
সাহানা বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বললেন,
–” আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আমার মেয়ের জন্য আল্লাহ কত বড় রহমত দিলেন আলহামদুলিল্লাহ।
দু’জনেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। সাহানা বেগমের চোখে জল, কিন্তু সেটা দুঃখের নয় পরম আনন্দের।
সেইদিন সন্ধ্যায় মতিন সাহেব অফিস থেকে ফিরে আসার পর খবর শুনে খুশি হয়ে বললেন,
–” আলহামদুলিল্লাহ। এই না হলে আমার মেয়ে?
ফারিয়া হাসল। অনেক কষ্ট, অনেক ঘুমহীন রাত, অনেক দোয়া আজ যেন সব সার্থক হয়ে গেল।
নিজের রুমে এসে ফারিয়া যখন জানালার পাশে দাঁড়াল, হালকা বাতাসে ওড়না উড়ছিল। তখন হঠাৎ তাহসান এর কথা মনে পড়ে গেল…..
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।