চারুকাব্য পর্ব-০৩

0
280

#চারুকাব্য ৩
লেখা : #azyah_সূচনা

সূর্যোদয় হয়েছে অনেক আগেই। রৌদ্রের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।জানালা ভেদ করেই চারুর মুখে শোভা পেলো। নিদ্রা পালালো চট করে তৎক্ষনাৎ। গতরাতে কোনোভাবেই ঘুম আসছিলো না। আসবেইবা কি করে?তার মস্তিষ্কে বসবাস করছিলো নানান চিন্তা চেতনা।হৃদয় ছিলো বিষাদগ্রস্ত।বিশাল বিছানায় পিঠ পেতে শুতেও চায়নি।কাব্যের মোটা কণ্ঠে বাধ্য হয়েছে।সে কি ভয় পেতে শুরু করেছে কাব্যকে?যেখানে সে নিজে ভুক্তভুগী।দোষী কাব্য নিজে।তারপরও নিজের বল প্রয়োগ করে যাচ্ছে চারুর উপর। ঘুরে তাকায় চারু।একই বিছানায় দূরত্ব নিয়ে ঘুমিয়ে আছে কাব্য।ঘুমোনোর ভঙ্গিও বিচিত্র।পা গুটিয়ে রেখেছে।মাথা নুয়ে।বাচ্চাদের ভঙ্গিতে উল্টপাশ ঘুরে ঘোর তন্দ্রায়।এত লম্বা চওড়া একটি মানুষ এভাবে ঘুমোলে কেমন দেখায়?ভাবতে নিয়েও ভাবলো না চারু।তাকে নিয়ে ভাবতেই চায়না।এমনেতেই বিনা নিমন্ত্রণে জীবনে কাল হয়ে এসে হাজির হয়েছে।হঠাৎই কেনো জেনো চারুর মনটা আশ্বস্ত হয়।নাহ!সে ভুল করেও কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি।মাঝরাতে ঘুম ভেঙেছে একবার।ঠিক একই পরিমাণ দূরত্ব নিয়েই ঘুমিয়ে ছিলো।তাদের মধ্যকার সীমা লঙ্ঘন করেনি হয়তো।

উঠে এক মুহুর্ত থাকলো না এখানে। কাল রাত থেকে এই ঘরে আটকে আছে।কাব্যর ঘুমের সুযোগে বেরিয়ে পড়লো দ্রুত পা চালিয়ে।দম বন্ধকর পরিবেশ থেকে মায়ের কাছে এসে শান্তি লাগছে।জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললো।বাবা হুইল চেয়ারে ভাসমান চোখে চেয়ে।জেনেছে ইতিমধ্যে। সিধেসাদা লোকটা প্রতিক্রীয়া দিতে পারছে না।বাকশুণ্য সম্পূর্ণ।ছোট ভাইটাও জেনেছে তাদের ঘরের আরেকজন সদস্য যোগ হয়েছে। ব্যাস! এতটুকুই।

“মা আমি বিয়ে করতে চাইনি।আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েটা হয়েছে মা।আমাকে ক্ষমা করে দাও”

“চারু! আমি জানিরে মা।আমি কাল রাতেই তোর মুখ দেখে বুঝেছি।”

“আমাকে ক্ষমা করে দাও”

মেয়ের গাল বেয়ে অশ্রু নিজ হাতে মুছে দিলেন।স্বামীর আড়ালে নিচু আওয়াজে প্রশ্ন করলেন, “ছেলেটা কাল রাতে…তোর..”

বুঝে ফেললো চারু মায়ের অব্যাক্ত কথার অর্থ।আমতা আমতা করছেন প্রশ্ন করতে।চারু মাকে থামিয়ে বললো, “না মা।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শায়লা।নত চোখে দাড়িয়ে।হটাৎ মনে হলো জানা উচিত কিভাবে হলো এসব।সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন,

“আমি জানতে চাই।বিয়েটা কি করে হলো?কেনো হলো?”

চারু দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক এক করে সবটা খুলে বলে।সেখানে দাড়িয়েই।ঘরে একটা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।তবে মায়ের শেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।বিয়েটা কেনো হয়েছে সেটার স্পষ্ট উত্তর যে তার কাছেও নেই।

উচ্ছস্বর ভেসে এলো কানে। ‘ চারুলতা, চারুলতা ‘ বলে চেচাচ্ছে।বড় বড় কদম ফেলে এসে হাজির কাব্য। আশ্চর্য্যজনকভাবে তার মুখে আতংকের ছাপ।আসতে আসতে একদম চারুর একদম সামনে এসে দাঁড়ায়।ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে নিয়েছে চারু।কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই চোখ পরে হুইল চেয়ারে।বুঝতে বাকি নেই সে চারুর বাবা।কাব্যর শ্বশুর আব্বা। আপাদত মনোযোগ চারুর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে ঝুঁকে সালাম করলো নাদিম সাহেবকে।মুখে মুখে সালামটাও জানিয়েছে।মেয়ের হাত চেপে উভয়ই তাজ্জব দৃষ্টিতে চেয়ে তাদের দিকে। ভদ্রতা দেখাচ্ছে?জোর করে বিয়ে করে ভালো সাজা হচ্ছে?

পূনরায় ফিরে এসে শায়লার উদ্দেশ্যে বললো, “আমাকে খাবার দেওয়া যাবে এখন?ক্ষিদে পেয়েছে আমার”

অদ্ভুতভাবে শায়লার মনে মায়া হলো। তাও কাব্যর প্রতি!কেমন মায়াময় কণ্ঠে খাবার চাচ্ছে?মুখটা দেখেই মনে হলো বেশ ক্ষুধার্থ।মন গলে যাওয়ার আগেই শক্ত করে নেয় শায়লা।বড্ড খারাপ মানুষ সে।তার মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে।বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ করেছে মেয়েকে বিমুখতায়।দাতে দাত চেপে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন।নাদিম সাহেব হুইল চেয়ার নিয়ে চলে গেলেন অন্যঘরে। কাল রাত থেকে এই বাড়িতে চলাফেরা করতেও মনে নানান চিন্তা আসে।এটাতো তাদের বাড়ি না।অন্যের বাড়িতে থাকছে তারা।নিজের বলে এখানে মানুষগুলো ছাড়া কিছুই নেই।

“চারুলতা?”

এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে চারু বললো, “আপনাকে খাবার দিচ্ছে।

” আপনি ফ্রেশ হন”

“আমি ভয় পেয়েছিলাম চারু।”

আপনাআপনি মুখ থেকে “কেনো?” শব্দটি বেরিয়ে আসলো চারুর।

“ভাবলাম আমার ঘুমের সুযোগে পালিয়ে গেলে কিনা।”

“সেই উপায় রেখেছেন?”

অবহেলাপূর্ণ আওয়াজে বলে উঠে চারু। এতে বিশেষ কোনো হেলদোল দেখা গেলো না কাব্যর মুখশ্রীতে।চারু দেখলো না।দেখার ইচ্ছে নেই।যত দূরে থাকা সম্ভব তত দূরেই থাকবে।

“আমাকে হারিয়ে যাওয়ার ভয় দেখিয়ো না কখনো। মরে যাবো!”

এবার না চেয়ে পারলো না কাব্যর মুখপানে। তৎক্ষনাৎ নেত্র তুলে দেয়।তাকে উপেক্ষা করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো কাব্য।দরজা খুলে শুধু মাথা বের করে উকি দিয়েছে।

“আমমমজাআআদদদ”

সুরেলা টানে ডাকে আমজাদকে।সবসময়।এরকম করে কেউ ডাকলে নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যাবে।এখানে সে সুযোগ নেই।কারণ দুটো!তারা উভয়ই ছেলে।দ্বিতীয় কারণ কাব্য আফনান মোটেও সুবিধের লোক না।সারাটা রাত দরজার বাহিরেই ছিলো।ভাগ্যিস একটা সোফা আছে বাহিরে।নাহয় দাড়িয়েই রাতটা পাড় করা লাগতো।নির্ঘুম রাত কাটিয়ে শরীর আর সায় দিচ্ছে না।ইচ্ছে হচ্ছে না কাব্যর এই মধুর ডাকের উত্তর দিতে।তবে দিতে হবে।

“জ্বি..জ্বি স্যার”

“আসো ভেতরে আসো।নাস্তা করবে।”

“আমি?”

“নাতো কে?বাকি গার্ডরা কোথায়?”

“আছে স্যার নিচে।”

“এলার্ট করো ওদের।আসতে বলো।”

“জ্বি আচ্ছা স্যার”

সেখানে দাড়িয়ে ফোন বের করে নিলো।সবাইকে একত্রে ফোন করেছে।একজনকে উপরে আসতে বলেছে।কারণ সে এখন ভেতরে ঢুকবে।দরজার বাহিরে গার্ড দেওয়ার জন্য কাউকে প্রয়োজন।চারু দেখছে সবটা। শুনছেও বটে।বেশি দুরত্বে নয়।আমজাদ সারারাত দরজার বাহিরে দাড়িয়ে ছিলো ভেবেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।কাব্যর জন্য জন্মেছে আরো একরাশ বিষাদ।একটা মানুষ পাষণ্ড হতে পারে?এভাবে একটা মানুষকে দাড় করিয়ে এখন খেতে ডাকছে?
আমজাদ হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বসে পড়ে।আসা যাওয়ার পথে কাব্য চারুকে বলে গিয়েছে এখানেই থাকতে।চোখের আড়াল যেনো না হয়।সাথে নিয়েই খেতে বসলো। বিতৃষ্ণা নিয়ে খাবার এগিয়ে দিলো শায়লা।

“সারারাত ডিউটি করেছো।খেয়ে দেয়ে ঘুমোবে।আজ তোমার আর ডিউটি নেই।”

“আমার ঘুমের প্রয়োজন নেই স্যার।আম ফিট!”

“আছে আমজাদ।”

কঠোরভাবেই বললো কাব্য কথাটি।মেনে নেয় আমজাদ বিনাবাক্যে।ভীষণ ভয় পায় কাব্যকে। ভীষণ এর চেয়েও আরো একটুখানি বেশি হয়তো।তবে কাব্য ভয়ানক নয়।আজ অব্দি তার যত্নে কোনো কমতি রাখেনি কাব্য।জোর খাটিয়ে নিজের সব কার্য উদ্ধার করেছে ঠিকই।সাথে বাহু চেপে সাবাশিও দিয়েছে।হেসেছে তার সাথে অনেক সময়।হাসিয়েছে তাকে।মন গলে যায় তার একটি কথায়।

“আমজাদ।তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো?”

মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন আমজাদ। পেটে ইদুর বিড়ালের রেস লেগে গেছে। যথাসময়ে এসে উদ্ধার করেছে কাব্য মহাশয়।নাহয় ক্ষিদের তাড়নায় অক্কা পেয়ে যেতো।পরদিন হেডলাইন ছাপা হতো। ক্ষুদায় ভুগে অক্কা পেলেন আমজাদ।

___

“পড়তে বসো”

দরজার পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলো চারু।যতটা অঘটন ঘটুক না কেনো? জিবনতো থেমে থাকবে না।বাধ্য হয়ে করতে হবে প্রতিদিনের কাজ।বাবাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে ফেরার পথেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো কাব্যের মোটা আওয়াজ।

কঠিনতা বজায় রেখে চারু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “পড়তে বসবো মানে?”

“বিয়ে করেছি জোর করে।তার মানে এটা নয় তোমার চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্নটা ভেস্তে ভাসিয়ে দেবো”

“আপনিতো ভালো নয়।তাহলে কেনো ভালো সাজার চেষ্টা করছেন? কি প্রমাণ করতে চাইছেন?”

অবলীলায় জবাব দেয় কাব্য, “নিজেকে”

“আপনাকে প্রমাণ করার আর কিছুই নেই। সব কাল কয়েক ঘন্টার মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে।”

কয়েক দফা চোখের পলক ফেলে কাব্য।একপ্রকার উপেক্ষা করে বসে চারুর তাচ্ছিল্যতম কথাবার্তা।

“বাবা মাকে ভালো একটা জীবন দিতেইতো এত কষ্ট করা তোমার? মৌলিক সকল চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে।তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করো।”

“আমার আর কোনো স্বপ্ন নেই!”

“রেগে আছো তুমি।রাগ কমলে পড়তে এসো।আমি বইপত্র নিয়ে বারান্দায় বসলাম। পড়াবো ”

সে পড়াবে?সেতো শিক্ষক নয়। কাল নিজেই স্বীকার করেছে।একজন শিক্ষক হওয়ার ভনিতা করে গেছে। মিথ্যে শিক্ষক হয়ে কি শিক্ষাদান করা যায়?হয়তো যায়।নাহয় এতদিন কিভাবে কাটকাট ভাবে পুরো একটা ক্লাসকে হ্যান্ডেল করেছে?

পানির গ্লাসটা ধপ করে টেবিলের উপর রাখলো চারু।মা তার দিকে করুন চোখে চেয়ে। চয়ন ফিরেছে সবে স্কুল থেকে।ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে দিতে মেয়েরদিকেও একবার, কয়েকবার চেয়েছে।

“চারুলতা!”

আবারো ডাক। বিরক্তিতে চোখ শক্তভাবে বুজে নেয় চারু।নিজের নামের প্রতি বেশ রাগ হতে শুরু করলো।মানায় না!একদম মানায় না কাব্যর মুখে ‘ চারুলতা ‘ ডাকটি।

বিরাগ ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ায় কাব্যর সামনে।কাব্য হেসে চোখের চশমাটা ঠিক করে নিলো।আগেই বই খাতা ছিটিয়ে রেখেছে গোলাকার টেবিলে। ভ্রূ উচিয়ে বললো,

“বসো।কোন টপিকে তোমার সমস্যা বলো।আমি লাইন বায় লাইন বুঝিয়ে দেবো।”

কথা বলতে ইচ্ছুক নয় চারু।নাই এখানে বসতে। যার ভাষ্য ভালো লাগতো বিশাল ক্লাস রুমে।তার বোঝানো এখন হজম হবেনা।

“কি বিশ্বাস করতে পারছো না?”

“কি করে করবো?আপনিতো সম্পূর্ণটাই মিথ্যে”

কাব্যর যেনো কিছুই আসে যায়না।কেমন অদ্ভুত মুখের ভঙ্গি নিয়ে থাকে।শুধু মুখে একটা অমায়িক হাসি ঝুলায়।ব্যাস! এতটুকই।অপেক্ষা করতে করতে কপালে ভাজ পড়লো।বোঝা হয়েছে চারুর শেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে সে ইচ্ছুক নয়।এখন পড়ালেখা করতে হবে।

অত্যন্ত ভারী স্বরে বলল এবার, “বসো।অপেক্ষা করতে পছন্দ করি না আমি”

স্পষ্ট শব্দে হুমকি দিচ্ছে।মাত্র যে হাসিটা ছিলো মুখে?সেটাও বিলীন।চারু ঢোক গিলে।এখন পড়া মাথায় ঢুকবে না। তারপরও বসতে বাধ্য তার সামনে।এই গরমে পরনে কালো রঙের ফুল হাতা টি শার্ট।আঙ্গুলের ভাজে কলম এতে মাথা ঝুকালো বইয়ের দিকে।এক একটা পেজ উল্টে পাল্টে দেখছে গুরুগম্ভীর ভাবমূর্তিতে।চারু তার কর্মকাণ্ডে দৃষ্টি স্থাপিত করে।একেক করে সব বই খাতা চেক করে মুখ খুললো কাব্য। তর্জনী আঙ্গুল রেখেছে বইয়ের পৃষ্ঠায়।

বললো, “এই পর্যন্ত পড়ানো হয়েছে।আমি নিজে কমপ্লিট করিয়েছি তোমাদের।নাও আরেকবার রিভাইস দিয়ে নাও”

“দেওয়া লাগবে না”

চারুর উত্তর মেনে নেয় নি কাব্য। চট করে নিঃশ্বাস ফেলে।মুখে এখনও রয়েছে গাম্ভীর্যের ছাপ।শব্দ করে বইটি চারুর সামনে রেখে বললো,

“পাঁচ মিনিটে রিভাইস দিবে।আমি আসছি”

ফোনটা ভাইব্রেট করছে।পকেট থেকে ফোন বের করে নিলো। সদর দরজার পাশে রয়েছে আরো একটি দরজা।সন্ধান হয়তো আজ অব্দি চারু ও তার পরিবার পায়নি।আশপাশ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখে নিলো।কেউ নেইতো? আওয়াজহীনভাবে ঢুকে গেলো রুমটায়। ফোনে মিসড কল এসেছে।সাথে বেশ কয়েকটা এস.এম.এস।কল ব্যাক করে কাব্য।
অন্ধকার কক্ষের সেন্টার টেবিলে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে।ফোন কাধে গুজে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“বলো মাহমুদ”

“তুমি চারুকে বিয়ে করে ফেলেছো?”

“হ্যাঁ। অভিনন্দন জানাও”

মাহমুদ এর সাহায্যে কোচিংয়ে এসেছিলো কাব্য।চারুর সাথে তার পরিচয়ের বিষয় জেনেই এখানে পা বাড়িয়েছে।মাহমুদ হাসবে নাকি অসস্তি প্রকাশ করবে বুঝে উঠতে পারলো না।সে জানে চারু মেয়েটা সরল সোজা।আর কাব্যর জীবন প্যাঁচে ভরা।বিগত আটমাসে কাব্য সম্পর্কে কিছু জানা না গেলেও মনের ভেতরে খটকা সর্বদাই কাজ করতো।ভাবতে ভাবতে চুপ বনে গেলো মাহমুদ।জেনে শুনে মেয়েটাকে ভুল জায়গায় ঠেলে দিলো নাতো।

“না মাহমুদ!তুমি কোনো ভুল করোনি।বরং ভালো করেছো।আমি ছাড়া চারুকে কেউ ভালো রাখতে পারবে না।”

বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠে।যেনো তার অন্তরের বোবা চিন্তাগুলোর উত্তর দিয়ে দিচ্ছে কাব্য।আমতা আমতা করে বলল,

“হ্যা তাতো অবশ্যই!”

“কেনো কল করেছো?”

“এইতো চারুর ব্যাপারটাই ভাবছিলাম”

কন্ঠ জোরালো হয়।ফোনের অপরপাশে রাগের আভাস পাওয়া গেলো।বললো, “কেনো মাহমুদ!কেনো ভাবছো চারুলতাকে নিয়ে?ওকে নিয়ে তোমার কিসের ভাবনা?চারুলতা আমার।আমি ভাববো ওকে নিয়ে।”

কণ্ঠের বজ্রপাতে ভরকে উঠে মাহমুদ।তার কথার অর্থ কখনো সেরকমটা ছিলো না।দ্রুত বলে উঠলো,

“না কাব্য।আমি…”

“রাখছি!”

রাগ দমিয়ে চারুর কাছে এসে বসেছে।বই নিয়ে আকাশপানে অন্যমনস্ক এক মেয়েকে দেখছে।হৃদয় বললো তার চোখে এত সুন্দর কোনো দৃশ্য আগে কোথাও দেখা হয়নি।দুঃখী এক মুখের ঘোরে পড়তে চাইছে।তার গালে লেপ্টে থাকা দুয়েকটা চুলও যেনো আকর্ষণের প্রতীক।দু চোখে ভ্রম ধরতে শুরু করেছে। ক্লাসে মাথায় কাপড় এটে থাকা মেয়েটিকে আড়ালে আবডালে কতবার দেখা হয়েছে হিসেব নেই। প্রটিরাতের স্বপ্নে তার দখলদারিত্ব দীর্ঘদিনের।হৃদয় শীতল হতে শুরু করলো পাষাণ মানবের। ঘন হয় নিঃশ্বাসও। নিষ্পলক চেয়ে থেকে চোখের নিচের অংশে একটু আধটু জল জমেছে।

ঠোঁট আপনাপানি প্রসারিত হয়ে আসে।বলে উঠে, “তোমাকে আমি কেনো ভালোবাসলাম?”

আশপাশে অমনোযোগী চারুর কানে এই প্রশ্ন হুশ ফেরায় তার।কাব্য তার দিকে চেয়ে।এমন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে যার উত্তর সে নিজেও চায়।

“আদৌ ভালোবাসেন?”

“অনেকটা।”

“কেনো?কি আছে আমার মধ্যে?গরীব একটা মেয়ে আমি।চেনা নেই জানা নেই।এটা কেমন ভালোবাসা?”

“চিনি তোমাকে।এইযে তুমি রাস্তা দিয়ে চলার পথে বারবার মাথায় কাপড় টেনে নিতে?পুরুষ লোক দেখলে মাথা নামিয়ে নিতে?রাস্তার পাশে টংয়ের দোকানে দাড়িয়ে এক ক্লাস পানি খুব তৃপ্তি সহকারে পান করতে? সবই আমার পছন্দের।শুধু অপছন্দের হচ্ছে তোমার দীর্ঘশ্বাস।তপ্ত গরমে তোমায় পুড়তে দেখে আমার কষ্ট হতো।তোমাকে সারাদিন পরিশ্রম করতে দেখে আমার কষ্ট হতো।”

“কি করে বিশ্বাস করবো আপনাকে?”

“করতে হবেনা চারুলতা।আমি বিশ্বাসের পাত্র নই।”

আর কথা আগ বাড়ায়নি চারু।সাথে কাব্যও। পূনরায় টিচারের রূপ ধারণ করেছে।একজন সাবলীল ভাষ্যকর এর মতন করে পড়া বুঝিয়েছে।যেমনটা কোচিংয়ে করতো। অবাক হয় চারু।প্রথমে মনে শঙ্কা ছিলো।ভুলভাল বোঝাচ্ছে নাতো?সেই শঙ্কাটাও সময়ের সাথে ভুল প্রমাণ করে দেয় কাব্য।

দিন পাড় হয়েছে অদ্ভুতভাবে।কেউই স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না ঘরে।তার একমাত্র কারণ কাব্য।ভয় প্রতি কদমে।কখন কি করে বসে।তেমন কিছুই হয়নি আপাদত।মেনে নিতে না পারলেও সহ্য করছে।নিজেদের জিম্মি হিসেবেই ধরে নেয়।গতরাতের মতই বিশাল এক দূরত্ব নিয়ে ঠিক একই ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে কাব্য।সন্দিহান দৃষ্টি তার দিকে রেখে চারুর চোখেও ঘুমেরা ঝুঁকে আসে।কখন ঘুমিয়েছে সে নিজেও জানে না।তন্দ্রায়ও যেনো সে সজাগ।পাশের মানুষটি তাকে পুরোপুরি সস্তির ঘুম কেনো নিঃশ্বাসটা অব্দি নিতে দিবে না।

রাত তিনটে,

বিকট আওয়াজে ঘুম পুরো দমে উড়ে গেলো।লাফিয়ে উঠেছে চারু।বুকে হাত চেপে ধরলো। ঘাবড়ে গিয়েছে অনেকটা।বাবা মায়ের কোনো বিপদ হলো নাতো?সর্বপ্রথম এই চিন্তাটাই এসেছে মাথায়।দ্রুত উঠে দাড়ায়।পা বাড়িয়েছে দরজার দিকে।এর পূর্বে থেমে গেলো।কাব্য নেই।বেডের ডানপাশটায় ঘুমিয়ে ছিলো।কোথায় গেলো এই রাতের বেলায়?কাব্যের অনুপস্থিতি ভয়কে আরো দ্বিগুণ করে।একবার ভাবলো বারান্দায় নয়তো? দৌড়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি।এখানেও নেই সে।ফিরে আসায় পথে চোখ গেলো নিচের বাগানে।কালো কোট পরিহিত দশ বারোজন পুরুষ দাড়িয়ে। ঘেরাও করে আছে জমিনে লুটিয়ে পড়ে থাকা একজন লোককে।

চলবে…