চারুকাব্য পর্ব-২৫+২৬

0
245

#চারুকাব্য ২৫
লেখা : #azyah_সূচনা

লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে চারুর।শীতের শুরুর আগেই গলায় মাফলার পড়তে হয়েছে।তাও আমার শাড়ির সাথে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষিকাদের ড্রেস কোড শাড়ি।সেখানে মাফলার বেমানান। তবে সে বাধ্য!গলায় মস্ত বড় দাগ। ভাগ্যিস বাড়ি থাকতেই দেখেছে!নাহয় আজ তার নামে শিরোনাম হয়ে যেতো।সবাই মশকরা করতো।অনেকে ভালো চোখেও দেখতো না। কাব্যকে শাসানোর সুযোগ পায়নি।সে ঘুমের রাজ্যে মগ্ন ছিলো।আজ ডেকেও দেয়নি।রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বেরিয়েছে।এক মেয়ে ছাত্রীকে দেখে মাথায় বুদ্ধি এলো।হেজাব পড়ে আসতো? তাহলেইতো এত অসস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।সকাল সকাল কি রেখে কি করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারেনি।বুদ্ধিটাও আসতে বেশ দেরি করেছে।

মিস রাইসা এবং তানভীরকে এগিয়ে আসতে দেখে ভরকে উঠে চারু।এদের মুখোমুখি হলেই প্রশ্ন করবে।এড়িয়ে যেতে চাইলো।তার আগেই তারা এসে হাজির।

যেই ভয় ছিলো সেটাই হলো।মিস রাইসা প্রশ্ন করলো, “চারু ম্যাডাম আপনার গলায় মাফলার কেনো?অসুস্থ নাকি?”

চট করে মাথায় মিথ্যে বাহানা এসেছে। অসুস্থতা।চারু নিচু গলায় উত্তর দিলো, “হ্যা মিস একটু গলা ব্যথা।”

তানভীর এরই মধ্যে বলে উঠলো, “সিজনটা ভালো না।আপনি বরং আদা চা খান।”

চারু মাথা দোলায়।বলে, “জ্বি সময় হলে খেয়ে নিবো”

খানিকটা এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে কথা বললো চারু। তানভীরের চোখে লেগেছে এই আচরণ।অন্যদিকে চারুর মস্তিষ্কে কাব্যর ধ্যান ধারণা।নিজ থেকেই বলেছে তানভীরের সাথে প্রয়োজন ব্যতীত কোনো কথা বলবে না।রাগটা পুরপুরি প্রকাশ না করলেও চারু অনুভব করেছে।ছেলে মানুষের ভালোবাসা কি এতোটাই প্রখর হয়? প্রিয় মানুষের পাশে অন্য কাউকে এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করা যায় না?কাব্যর অনুপস্থিতিতেও তাকে দেওয়া কথা স্মরণে রেখেছে চারু।অন্যদিকে এটাও চাচ্ছে না কোনোভাবে তানভীর কষ্ট পাক।তার এখানে কিই বা দোষ?ক্লাসের বেল বাজতেই সস্তি পেলো চারু।ক্লাসের বাহানায় যাওয়া যাবে।এই সময়টায় তানভীরেরও ক্লাস থাকে। তানভীরই তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো নিজের ক্লাসের উদ্দেশ্যে।

_

“আমাকে না বলে চলে গেলে কেন আজ?আর গলায় মাফলার পেঁচিয়েছো কেনো? কি হয়েছে?”

বাড়ি ফিরে ঘরে অব্দি ঢুকতে দিল না।বেল বাজানোর সাথেসাথে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।যেনো উত্তর না দিলে ঘরে প্রবেশ করা যাবে না।

“আপনি জিজ্ঞেস করছেন গলায় কি হয়েছে?”

“হ্যাঁ।আমি ছাড়া আর কে তোমার জন্য চিন্তিত হবে?”

“নিজে দোষ করে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করছেন?”

“কি করেছি?” অবুঝ স্বরে প্রশ্ন করে কাব্য।

গলার কাছ থেকে সামান্য মাফলার সরিয়ে দাগটা দেখায় কাব্যকে।পরপর আবার পেঁচিয়ে নেয়।কাব্য কিছু বলার আগেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেলো ভিতরে।শায়লা বেগম চারুকে দেখেই বললেন,

“হাত মুখ ধুয়ে আয়।চা দিচ্ছি”

মায়ের কথা শুনে এগিয়ে গেলো চারু। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনেও চেয়েছে।কাব্য নেই! দরজাটাও খোলা।এত দ্রুত কোথায় গেলো?চোখের পলকে গায়েব। জ্বীন ভুত নয়তো?

দাড়িয়ে স্টুডেন্টদের সামলাতে হয়।বসে বসে আয়েশ করে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না।গলার উপরতো আরো চাপ পরে।শুকনা পাতলা দেহে আর কত সয়? অনেকপর লাগাতার কাজ করায় কোমড় ব্যথার আভাস পেলো চারু। মেরুদন্ড বেয়ে উঠে চলেছে এই পীড়া।ক্লান্ত মুখ পানিতে ভিজিয়ে সতেজ হলেও অভ্যন্তরীণ ক্লান্তি মিটছে না।চা খাওয়ার ইচ্ছে হলো না। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো।মিনিট পাঁচেকে কাব্য ফিরেছে। হাতে পলি ব্যাগ।

চারু ঘাড় ফিরিয়ে দেখে দেখলো।প্রশ্ন করলো, “এগুলো কি?”

“মলম এনেছি।”

পরপর অভিযোগের সুরে বলল, “ফার্মেসির লোকগুলো অধম। এদেরকে দাগ সরানোর মলম চেয়েছি।ওরা আমার সাথে দাগের বিস্তারিত বর্ণনা চাইতে শুরু করলো।কি দাগ,কেমন দাগ,কি করে দাগ পড়লো!”

চারু তাড়াহুড়ো করেই প্রশ্ন করে ফেলে, “আপনি কি বলে দিয়েছেন কিসের দাগ?”

“মাথা খারাপ!ওদের আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার বলতে যাবো?এত বোকা নাকি আমি?”

চারু ঠোঁট চেপে হাসে।জিজ্ঞেস করে দুষ্টুমির স্বরে, “তাহলে কি আপনি চালাক?”

“অবশ্যই”

“হ্যাঁ চালাক সমাজের লিডার আপনি”

চারুর ঠাট্টা বুঝতে একে সেকেন্ড সময় নেয়নি। প্রেয়সীর জন্য যত্ন করে মলম এনেছে।যেহেতু অপরাধী সে তাহলে সেই অর্থে ভুল শুধরানোর দায়িত্বও তারই।এখানে চারুলতা কিনা তাকে উপহাস করলো? বিদ্রুপপূর্ণ মন্তব্যে ভাজ পড়ে কপালে।

“এই নাও মলম।গলায় লাগিয়ে নাও।”

“আপনি লাগিয়ে দেন চালাক লোক”

“মজা নিচ্ছো আমার সাথে?”

“হ্যাঁ”

“আমাকে বোকা মনে হয়?”

“সেটা হবে কেনো?আপনি মাত্র বললেন আপনি চালাক।আমি আপনাকে বোকা ভাবতে যাবো কোন সাহসে?”

কৌতুক করেই যাচ্ছে চারু।অন্যদিকে কাব্যর ধৈর্য্য কম।হনহন করে ঘুমের চারিদিকে চক্কর দিলো।কি করবে দিশা খুঁজে পাচ্ছে না।ঘরে থাকবে নাকি চলে যাবে এই হিসাবটাও মেলাতে পারছে না।আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসতে লাগলো চারু।ঘুরে ফিরে এখানেই আসবে।ক্ষণিকের ছটফট তার।অবশেষে চারুর চিন্তাই ঠিক হলো।কোনো উপায় না পেয়ে তার বরাবর এসে বসেছে।

কাব্যকে বেশি রাগতে না দিয়ে কাছে এসে জরিয়ে ধরে বললো,
“পাগল একটা!”

“আমার ধৈর্য্য কম।”

চারু উত্তরে বলে, “সমস্যা নেইতো”

“সত্যিই সমস্যা নেই?এইযে গতরাতে তোমার উপর রাগ দেখালাম।এখনও তোমার মজা সহ্য না করতে পেরে হাঁসফাঁস করছিলাম।….চারুলতা?আমি আমার মাথায় সমস্যা নেইতো আবার?”

মসৃণ ঠান্ডা হাতে কাব্যর গাল জড়িয়ে চারু উত্তর দিলো, “আমি বাজেভাবে তোমার মধ্যে বাঁধা পরে আছি।তুমি অধৈর্য হও আর তোমার মাথায় সমস্যা থাকুক আমার কিছুই আসে যায়না।দিনশেষে আমার সস্তির নীড় তুমি।তোমার সব পাগলামো আমার।নারীকে সামলায় যত্নবান পুরুষ।ভালোবাসে,আগলে রাখে।কেনো এই দায়িত্ব শুধু পুরুষের?আমিও পালন করবো এই দায়িত্ব। তোমায় আগলে রাখার দায়িত্ব।পূর্বে তুমি যা কিছু হারিয়েছ সবটার পূর্ণতা হবো।কথা দিলাম।”

রাগ নিবারণের যাদু জানে হয়তো। নিমিষেই অধৈর্যতার বাঁধ ভেঙে গুড়িয়ে দিলো।কোমল কন্ঠস্বরে কিছু সুন্দর কাব্য হৃদয় ছুঁয়েছে।এলোমেলো অনুভূতির মধ্যে একরাশ সস্তির লীলাখেলা।আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল আবদ্ধ করে কাব্য। চারুর হাতের পিঠে চুমু খায়।

বলে, “আমার একটা জীবন ছিলো।প্রাণহীন।সেখানে প্রাণের সন্ধান পেয়েছি সেদিন যেদিন উপলদ্ধি করলাম আমার হৃদয় হরণ হয়েছে। ভালোবাসারা বীজ বপন করতে শুরু করেছে।আমার কোনো আক্ষেপ নেই সুন্দরী লতা।আমার কোনো অপূর্ণতা নেই।আমি কষ্ট পেয়েছি পূর্বে এটা ভেবে ভুল করবে না।আমার কোনো অনুভূতি ছিলো না তখন।এখন আছে।আর এই অনুভূতিগুলো স্বপ্নের চাইতে সুন্দর।আমার একটা ঘর আছে যেখানে আমার প্রণয়িনীর বসবাস।সাথে বাবা মা আর একটা ছোট্ট বাচ্চা ভাইও আছে।আমার সাথে ছায়ার মতন লেগে থাকা একজন বড় ভাইয়ের মতন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।দেরিতে পেয়েছি।তবে যথাযথ পেয়েছি।আমি পূর্ণ।চারুলতার ফিরে কাব্য পরিপূর্ণ।”

____

ঘরে অল্প মানুষের হইচই পড়ে গেলো।একদিকে কাব্য চেচাচ্ছে।অন্যদিকে চয়ন।কাকে রেখে কার কাছে যাবে বুঝে উঠতে পারলো না।তাদের মধ্যে যোগ দেয় শায়লা।অবশেষে তার গলার স্বরটা জড়িয়ে পুরো একটা মাছের বাজার।অন্যদিকে আমজাদ বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে।চঞ্চল সাহেব আর সেই একমাত্র চুপ এই সারা বাড়িতে।মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম।

এক মুহুর্ত দাড়ায় চারু বসার ঘরের মধ্যিখানে।জোরে নিঃশ্বাস ফেলে চেচিয়ে উঠে সবার উদ্দেশ্যে,

“চুপ!একদম চুপ সবাই।এক এক করে সবার কাছে আসছি আমি।মাছের বাজার লাগিয়ে দিয়েছে!”

কাব্য,চয়ন থেমে গেলেও দমলেন না শায়লা।রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, “নতুন বউ ঘরে এসে খাবে কি শুনি? একটাবার পা রাখিসনি রান্নাঘরে।আমি এই বয়সে আর কতো করবো!”

মায়ের কথা মাথা দোলায় চারু।চোখ গেলো শেরওয়ানি গায়ে বসে থাকা আমজাদের দিকে।বেচারার অবস্থা কাহিল।বিয়ে করছে অথচ একেক জনের চেঁচামেচি দেখে চুপিসারে বসে আছে।

চারু আমজাদের উদ্দেশ্যে বললো, “ভেবেছিলাম আপনার স্যারকে আবার বিয়ে করবো।কিন্তু এসব দেখে আমার বিয়ের স্বাদ মিটে গেছে।”

“সরি ম্যাডাম।”

“বাদ দেন।আপনার কি দোষ?”

বলে হনহন করে স্থান ত্যাগ করে।অন্যদিকে আমজাদ।ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি মনের মধ্যে।বিয়ে করছে।অথচ জানে না বউ কে?যে তিনজনকে পছন্দ তালিকায় রেখেছিলো তাদের মধ্যেই একজন।আর এই কেরামতির পেছনে আর কেউ না স্বয়ং কাব্য আফনান।রহস্যময় বিয়ে।কবুল বলার আগ পর্যন্ত নাকি বউকে দেখা যাবে না।একটু দয়া দেখিয়ে ফোনে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিল দুইহাত। ব্যাস!মেয়ের কণ্ঠের সাহায্যে এতবড় স্টেপ নিতে হবে?কোন জন্মের শত্রুতা করছে কাব্য কে জানে।প্রথমে বিয়ে করতে বাধা,এরপর উকিল বাবা।এখন বউ কে সেটাই জানে না। মাথাটা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে।বিয়ের পূর্ব মুহূর্তে মস্তিষ্ক জানান দিবে ‘ কানেকশন এরোর ‘।

কাব্যর পেছনে দাড়িয়ে ঝাঁঝালো সুরে প্রশ্ন করে চারু, “কি সমস্যা চেচাচ্ছেন কেনো?”

উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে থাকা পুরুষটি মুখ ফেরায়।পরনে সাদা ইন করা শার্টের সাথে কালো প্যান্ট।পেছন থেকে ঠিকঠাক লক্ষ্য না করলেও ফিরে চাইতে চোখে বাজলো।পা থেকে মাথা পর্যন্ত বারবার চোখ বুলাচ্ছে চারু। পরিপাটি কাব্যকে ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে।এক কথায় যাকে বলে চোখ ধাঁধানো সুন্দর।মুখের দাগগুলো ম্লান হয়ে আসল গায়ের রংটা ফুটে উঠেছে।তার চেয়ে বেশি সুন্দর তার মুখে সমসময় থাকা ছোট্ট এক টুকরো হাসি।নিজের অজান্তেই চারুর মুখে হাসি ফুটলো। কালো ব্লেজারটা হাতে নিয়ে চারুর দিকে এগিয়ে দেয় কাব্য।

আবদার করে, “পড়িয়ে দাও”

অক্ষির ঘোর কাটলো সবে। গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বরে।এই ধ্বনিটাও অত্যন্ত প্রিয়। বিনাবাক্যে কাব্যর হাত থেকে ব্লেজারটি নিয়ে পড়িয়ে দিতে লাগলো।বাহু টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নির্দ্বিধায় বলে উঠে,

“আজ আপনাকে এত সুন্দর লাগতে বলেছে কে?বিয়ে বাড়ীতে যদি কেউ নজর দেয়?”

“দিলে মন্দ হয়না।”

কাব্যকে আলতো ধাক্কা দিয়ে চারু বলে উঠলো, “খুব শখ না?”

“হ্যাঁ খুব।তবে শুধু চারুলতার নজরে পড়ার তীব্র শখ।কিন্তু আমার চেয়ে বেশি যে তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে?তার দায়ভার কে নেবে?”

চারু চোখ নামিয়ে হাসে।আকষ্মিক মনে পড়ে আমজাদের কথা। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বসে আছে বেচারা।কাব্যকে বললো,

“কাজটা মোটেও ঠিক করছেন না।জানেন আমজাদ সাহেব কতটা চিন্তিত?”

“আমি কি ওকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছি নাকি?”

“না তারপরও?এটা কেমন বিয়ে যেখানে বর জানেই না তার বউ কে?”

চারুর কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে কাব্য বলতে লাগলো, “যেমন তুমি জানতে বর কে?এটা আমার একটা রিচুয়াল”

কোনোদিন চারু কাব্যর বেড রুমের দিকে নজর তুলেও তাকায় না।আজ এই মুহূর্তে এসে হাজির।দুজনকে একে উপরের সাথে এমতাবস্থায় দেখে বিব্রত বোধ করলো আমজাদ।চোখ নামিয়ে কেশে বুঝাতে চাইলো তার উপস্থিতি।চারু ছিটকে সরে যেতে চাইলো।তবে পারেনি। নির্লজ্জতা দেখিয়ে একহাতে কোমর জড়িয়ে নিজের পাশে দাঁড় করিয়েছে। আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা চারু লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেললো।ঠিক একই পরিস্থিতি আমজাদেরও।যে কথাটি বলতে এসেছিল সেটা আর বলা হচ্ছে না।

“বলো আমজাদ”

“স্যার….এবার নাহয় বলে দেন আমার হবু বউ কে? মানে ওই তিনজন মেয়ের মধ্যে কোনটা?”

কাব্য কুটিল হাসে।প্রশ্ন করে বসে আমজাদের ঠিক বিপরীত প্রসঙ্গে।বলে,

“বলোতো আমজাদ?আমাদের পাশাপাশি কেমন দেখাচ্ছে?”

ভ্রূ কুঁচকায় আমজাদ।এটা কি তার প্রশ্নের জবাব?কাটিয়ে দিলো অন্য প্রশ্নের মাধ্যমে। বোবা বনে রইলো সেও।উত্তর দিবে কেনো?সেকি জানে না তাদের কেমন দেখায় পাশাপাশি?

“বলছো না কেনো তুমি কি জেলাস আমজাদ?”

“নাহ স্যার”

“তোমারওতো এই দিন আসছে।তুমি কেনো হিংসে করছো?”

“আমি হিংসে করছি না স্যার।আমিতো..”

“চুপ থাকো! রাকিবকে বলো গাড়ি বের করতে।রওনা হব। তোমারতো ধৈর্য্য সহ্য নেই দেখছি।উতলা হয়েছ বিয়ে করার জন্য।”

আমজাদের সৌভাগ্য।আজ বলেনি গাড়িটা তুমি চালাও।জামাই বেশে বড় গাড়ীর একদম পেছনের সিটে জায়গা হয়েছে। কেনো? এর উত্তর কাব্যর ভাষ্যমতে নতুন বরের খারাপ নজর লাগবে। কোথা থেকে আমদানি করে এসব কথা কে জানে?বলেও এভাবে যেনো কোনো সিরিয়াস ইস্যু।

শুভ মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলো অনেকটা বছর।বিয়ের বয়স পেরিয়ে দু বাচ্চার বাবা হওয়ার কথা ছিলো। তা না এই বয়সে বিয়ে করতে হচ্ছে।তবে বিয়েটা হচ্ছে।এটাই অনেককিছু।কবুল বলে বিয়েটা সম্পন্ন করে নেয়। বধূকে বসানো হয়েছে অন্য ঘরে।এই যাত্রায়ও বউকে দেখা হলো না।তার মতই ভুক্তভুগী তার কপাল!কাব্যর কথামত উকিল সেই দিয়েছে।ব্যাস!হয়ে গেলো সে আমজাদের উকিল বাবা।খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে বউকে দেখার সুযোগ হয়েছে।নাম তার মৃদুলা। মৃদুলাকে আনা হচ্ছে শুনেই চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়েছিল আমজাদ।বুকের মাঝে ঢিপঢিপ আওয়াজ তুলছিলো হৃদয়।চোখ বরাবর বসা তাঁর সদ্য বিবাহিত লাজুক বউকে দেখে পরান জুড়ালো।কাব্যর পছন্দ আসলে খারাপ হতে পারেনা।চারু তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমজাদ। সঙ্গিনীকে ভীষণ মনে ধরেছে।

বিদায় বেলায় মৃদুলার বাবার হাত ধরে কাব্য বললো,

“আমজাদ আমার জন্য কাজ করে না। ও আমার ভাই।সুখে দুঃখে চিরকাল আমার পাশে থেকেছে।আমার অবর্তমানে আমার পরিবারকে সকল অমঙ্গল থেকে রক্ষা করেছে।যে লোক নিজের জীবন যৌবন ত্যাগ করে অন্যের হেফাজতে লিপ্ত ছিল এতকাল সে আপনার মেয়ের সাথে কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।আমজাদ যেমন আমার ভাই মৃদুলাকেও আমি বোনের চোখে রাখবো।আমার স্ত্রীও আছে আমার পাশে। অভিযোগ করার সুযোগ পাবেন না।যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কখনো আমাকে একটা কল করবেন শুধু।বাকিটা আমি দেখে নিবো”

চলবে..

#চারুকাব্য ২৬
লেখা : #azyah_সূচনা

“আমার আর এই গুলি বারুদ জীবন পাড় করার ইচ্ছে নেই।স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাইছি।সাথে আপনাদেরও একটা স্বাভাবিক জীবন দিতে চাইছি।আমি চাই নতুন কিছু শুরু করতে।যেনো আপনাদের কেউ কখনো কি কাজ করেন জানতে চাইলে বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন নিজের কর্মের কথা।আমি জানি আমরা কোনো বেআইনি কাজ করিনি।করছি না।তারপরও!আর হ্যা!ঘাবড়াবেন না। আপনাদের আমি কাজ ছাড়া করছি না।আপনাদের নতুন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।আর যতদিন প্রশিক্ষণ চলে আপনাদের কেউ খালি হাতে থাকবে না।মাসের এক তারিখে ন্যায্য বেতন আপনারা পাবেন।শুধু একটাই অনুরোধ এতদিন সাথে থেকেছেন এবারও থাকেন।আমরা সবাই মিলে নতুন কিছু শুরু করি আসুন”

মালিকের দেখা মেলে কালেভদ্রে একবার। অমাবস্যার চাঁদের ন্যায় সে।দেখা দেয় না সচরাচর।আজ দিয়েছে দেখা।এতদিনের চলে আসা কাজ বাদ দিয়ে নতুন কিছু শুরু করতে চায়। কর্মরত ত্রিশজন শ্রমিক অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে।যে লোক গলা উচু করে কথা বলতো সবসময়। গাম্ভীর্যতায় টইটুম্বুর থাকতো।তার ব্যবহারে শালীনতা। কন্ঠস্বরে আকুল আবেদন। বেতন নিয়ে কোনোদিন ঝামেলা করেনি আজ পর্যন্ত।তাই তার গাম্ভীর্যের সূত্র ধরে তাকে খারাপ লোক বলা যায় না।হয়তো এটাও একটা ব্যক্তিত্ব।তবে মতের দ্বিধায় সকলেই।একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।এতদিনের কাজ বাদ দিয়ে নতুন কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে দ্বিধা তাদের।

এরমধ্যে একজন শ্রমিক বললেন, “স্যার যদি নতুন ব্যবসায় মুনাফা না হয়?”

“লাভ মন্দা থাকবেই।তাই বলে কাজ আটকানো যাবে না।আর আমি সব ব্যবস্থা করেছি আগেই।আপনাদের সাহায্য আর সাপোর্ট দরকার”

আরেকজন বলে উঠে, “স্যার আমরা সবাই একে অপরের সাথে কথা বলে আপনাকে জানালে আপনি রাগ করবেন?”

কাব্য হাসে।বলে, “কেনো রাগ করবো?আপনাদের মতামত প্রকাশ করার অধিকার আছে।এটা আরো ভালো হয় সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন।”

“নতুন কাজটা কি স্যার?”

“এই ওয়েরহাউজটা হবে একটা গার্মেন্টস।বাইরের দেশে ডিলার ম্যানেজ করেছি।আপনাদের তৈরিকৃত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হবে।”

অনেকে আগ্রহ দেখালো।আবার অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত।অনেকটা সাহস নিয়ে কাব্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমজাদকে আনেনি। বউয়ের সাথে হানিমুনে পাঠিয়েছে তাকে।বিয়ের পাঁচমাস চলে।এবার লোকটাকে একটু শান্তি দেওয়া উচিত।আর কত কাজ করবে?বউকে সময় দেক এবার।

তাদের সিদ্ধান্তের জন্য সময় দিয়ে কাব্য বেরিয়ে পড়লো থানার উদ্দেশ্যে।ডাক পড়েছে।হয়তো কবির আফনান রিলেটেড কোনো কাজ।তাছারাও কাব্য নিজ থেকেই যেতো মুহিত সাহেবের কাছে।গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হলো।

“কবির সাহেবের স্ত্রী দেশে এসেছিলেন।তার সাথে দেখা করতে।”

অফিসার মুহিতের চেম্বারে বসে আছে কাব্য এবং মুহিত সাহেব উভয়েই।চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে কাব্য বললো,

“দিস ইজ নট এন ইম্পর্ট্যান্ট থিং।এটা বলার জন্য ডেকেছেন?”

“না। ভদ্রমহিলা কেস রি ওপেন করতে চান। লয়ার এনেছেন সাথে।”

“সাজাপ্রাপ্ত আসামীর কেস আবার রি ওপেন হয় কি করে?”

“হবে না।কিন্তু সে চেষ্টা করছে নানাভাবে।”

“যাই করেন অফিসার মুহিত কবির আফনান কোনোভাবে যেনো ছাড়া না পায়!নতুন করে জীবন শুরু করতে চাচ্ছি।যদি এবার পুরোনো কিছু বাঁধা হয় নিজ হাতে মারবো কবির আফনানকে।”

রেগে গিয়ে বললো কাব্য।মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে এসব ঝামেলা আর সে চায় না।জীবনটাকে গোছানোর চেষ্টায় আছে।স্বাভাবিক করে সবকিছু।মুহিত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

বলতে লাগলো, “আমি আছি।আর আমি থাকতে কবির আফনানের জায়গা জেলেই।”

একজন গার্ডকে ডাকে কাব্য। হাতে তার বড় খয়েরী বাক্স।কাব্যের আদেশে মুহিত সাহেবের ডেস্কের উপর রেখে চলে গেলো।কাব্য বাক্সটি ঠেলে নেয় মুহিত সাহেবের দিকে।কিছুই বুঝতে না পেরে মুহিত সাহেব প্রশ্ন করলেন,

“কি এটায়?”

“সমস্ত বন্দুক যা আমার কাছে ছিলো।আর সাথে সবগুলোর কাগজপত্র”

মুহিত সাহেব অবাক গলায় প্রশ্ন করেন, “ফিরিয়ে দিচ্ছ কেনো?”

“আর কোনো দরকার নেই এসবের।”

“কেনো কাব্য? সেফটির জন্য রাখো অন্তত।বিপদ কয়ে বলে আসেনা। তোমারতো সব ডকুমেন্ট আছে।”

“আর কোনো বিপদ দেখছি না।এখন শুধু সুখ আর সুখ।আমার সন্তান আসছে।আমি চাই না জন্মের সাথেসাথে আমার হাতে বিপদজনক কোনো অস্ত্র দেখুক।আমি আমার সন্তানকে স্বাভাবিক জীবন দিতে চাই।”

মুহিত সাহেবের মুখে উচ্ছাসের হাসি।সম্পর্কে সৎ বাবা হয় সে কাব্যর।তবে এই সৎ এর সাথে বাবা শব্দটাও জড়িত। সন্তান আসছে শুনে হৃদয়টা খুশিতে আপ্লুত হয়ে উঠে।ঝলক দেখা যায় মুখে। কষ্টেবলকে জোর গলায় ডাকলো।সেও এসেছে ঝড়ের গতিতে।

মুহিত সাহেব বললো, “মজিদ!পাশের দোকান থেকে মিষ্টি আনো।দ্রুত যাও”

অদ্ভুত দৃষ্টি স্থাপন করে কাব্য। মুহিত সাহেবের এত খুশি হওয়ার কি আছে এটাই বুঝতে পারলো না।বাবা হচ্ছে সে আর খুশিতে ফেটে পড়ছে মুহিত সাহেব। হাতড়ে ফোনটাও বের করলেন।কল মেলালেন সাবিনার কাছে।

উচ্ছাসের সুরে বলতে লাগলেন, “সাবিনা!কাব্যর ঘরে নতুন মেহমান আসছে।ছোট্ট মেহমান।আমি পুরো থানার স্টাফদের মিষ্টি খাওয়াচ্ছি।আসার সময় তোমার জন্যও নিয়ে আসবো”

ফোনের অন্যপাশে কি প্রতিক্রীয়া কাব্য জানলো না।একবার জানতে ইচ্ছে করলো।পরপর নিজের মনের লাগাম টানে।এখানে দুর্বল হলে চলবে না।এক ফোঁটাও নয়।সব দূর্বলতা তার চারুলতার জন্য।গর্ভে পালিত তার আর চারুর ভালোবাসার চিহ্নর জন্যে।

কাব্য মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মুহিত সাহেবকে প্রশ্ন করল, “আপনি এত খুশি হচ্ছেন যে?”

“খুশির সংবাদে খুশি হব না।আমিওতো দাদ…”

কাব্য ভ্রূ জোড়া উঁচিয়ে চায় মুহিতের দিকে। তীর্যক দৃষ্টি।বাকি কথাটা পূর্ন করলেন না মুহিত সাহেব।কাব্যর প্রতি যে সে বাবার ভালোবাসা অনুভব করে?সেটাতো কাব্য জানে না।জানলেও কিছু আসে যায়না।মেনে নিবে না সে কোনোদিন।

“আমি আসি।”

“মিষ্টি খেয়ে যাও।”

টেবিল থেকে একটা আস্ত মিষ্টি মুখে পুড়ে নিলো কাব্য।এটা তার বাচ্চার খুশিতে আনানো হয়েছে।ফেলে দিলো না।খেয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,

“আসি।আমার বাচ্চাটার জন্য দুআ করবেন পারলে।”

____

“সমুদ্র খুব সুন্দর তাইনা?”

মৃদুলা ছোট্ট শব্দে উত্তর দেয়, “জ্বি খুব সুন্দর।”

“তুমিও খুব সুন্দর।”

লাজুক হাসে মৃদুলা।চক্ষু নত করে। আমজাদের মুখে এই পাঁচমাসে প্রথমবার শুনছে এমন কথা।যত্ন করে তবে ভালোবাসার কয়েক বাক্য ছুঁড়ে দিতে শেখেনি এখনও।

আমজাদ প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?কষ্ট পাবেনা তো?”

“আপনি আমার স্বামী আপনার আমার সাথে কথা বলতে ভাবতে হবে না। নির্দ্বিধায় বলুন”

“মেয়েদেরকে বাবা মায়েরা আঠারো থেকে বিশ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়।তোমার বাবা মা কেনো দেয়নি?প্লিজ মৃদুলা কষ্ট পাবে না।”

মৃদুলা স্মিথ হাসে।আমজাদের কথায় সে কিছু মনে করেনি।তবে তার বিয়ে হয়নি কেনো এটা ভেবে মনের কোণে খারাপ লাগা এসে বসলো।বললো,

“আমি ছোটোবেলা থেকেই খাটো আর স্বাস্থ্যবান।এজন্য আমাকে কেউ পছন্দ করতো না।তাছারাও আমার বাবার টাকা নেই।তাই বিয়েটাও হয়নি।”

“তুমি এসবে কষ্ট পেতে?” নরম সুরে জিজ্ঞেস করে আমজাদ।

“হ্যা একটু ”

“জানো তোমার বিয়ে হয়নি কেনো তখন?কারণ আমারও বিয়েতে ছিলো বাঁধা।আমি আমার দায়িত্বে মগ্ন ছিলাম।আমার বিয়ের ফুল না ফুটলে তোমার কি করে হবে বলো? তোমাকেতো আমার জন্যই তৈরি করা হয়েছিলো।”

মন খারাপেরা ছুটে পালায়।সমুদ্র বেয়ে দূরে চলে গেছে। পড়ন্ত সন্ধ্যায় সমুদ্র তীরে উপভোগ করছে তাদের মধু চন্দ্রিমা।বিয়ে হয় সৃষ্টিকর্তার আদেশে।তাদের ক্ষেত্রে আদেশটা দেরি করে এসেছে।তবে এসেছে বড্ড আয়োজন করে।পাঁচ মাসে মনে হলো আমজাদ সত্যিই একজন ভালো মানুষ। উফটুকু করার সুযোগ পায়নি এ’কদিনে। তাছাড়াও কাব্য আর চারু।পরিবারের এক অংশ করে নিয়েছে তাকে।একই ছাদের নিচে তাদের সকলের বসবাস।

“আপনি খুব ভালো মানুষ আমজাদ সাহেব।সাথে কাব্য ভাই আর চারু আপাও।”

আমজাদ হেসে উত্তর দেয়, “কাব্য স্যার খাটি মানুষ শুধু মাথার তারটা একটি ছিড়া।চারু ম্যাডামও।দুই পাগলের শায়েস্তা করতে আসছে আরেকজন।ভুল হলেই লাঠি চার্জ করবে”

সাহস করে আমজাদ মৃদুলার হাতটা নিজের হাতে আগলে নেয়। মৃদু গলায় কাঁধে মাথা রাখার জন্য বললো। কম্পিত হৃদয় নিয়ে মৃদুলা সাহস দেখিয়েছে।কাধে মাথা রেখে বললো,

“আমরা অনেকদিন হয়েছে কক্স বাজার এসেছি।ফিরে যাওয়া দরকার।চারু আপার এই সময় সবাইকে দরকার।”

“হ্যা কালকেই ফিরবো।কিন্তু এর আগে বাবুর জন্য আগে থেকেই অনেক কিছু কেনাকাটা করবো।আমাদের উপহার হবে সর্বপ্রথম উপহার।”

বয়সে কিই বা আসে যায়?সঠিক সময়েই আসে সঠিক মানুষ। তাড়াহুড়োয় বাড়ে অস্থিরতা।ক্লান্তি।জীবনের উঠানামা করার গতিতে একে অপরকে পেয়ে পরিপূর্ণ।ধৈর্যের ফল মিষ্ট হয়। জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে নিজেদের দুজনকেই ভেবে নিলো আমজাদ আর মৃদুলা।

___

“বাবা!আমার জানবাচ্চা।বাবা কি বেশি দেরি করেছি আসতে?”

শুয়ে বই পড়তে থাকা চারুর পেটে মাথা রেখে আদুরে কথাবর্তা বলছে।চট্টগ্রাম গিয়েছিল।মাত্রই ফিরে এসেছে কাব্য।তাকে দেখেই চারু ভেবে নেয় এসে জড়িয়ে ধরবে।এত ঘণ্টার দূরত্ব পুষিয়ে নিবে বুকে টেনে।চারুর এমন চিন্তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলো কাব্য।তাকে কোনো ধরনের পাত্তা না দিয়েই মাথা পেতে খোশগল্পে মেতেছে।

হিংসুটে মুখ বানিয়ে চারু বললো, “বাবার সাথে কথা বলবে না বাবার জানবাচ্চা।বাবা খারাপ মায়ের দিকে খেয়াল দেয়না।”

“হু আর ইউ?”

চারুর চোখ কপালে উঠেছে।কি বললো কাব্য? সে কে এটা জানতে চাচ্ছে?এখনই ভুলে গেলো তাকে?আগুন ছুড়তে লাগলো চোখ থেকে।জোরেশোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়েছে কাব্যর দানবীয় মাথা।

রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকা চারুর দিকে চেয়ে কাব্য বললো, “এত নড়াচড়া করো কেনো?আমার জানবাচ্চাটা ব্যথা পাবে”

“তুই যা এদিক থেকে।”

“এভাবে কথা বলে না বোকা মেয়ে”

“যেতে বলেছি!একদম কাছে আসলে খবর আছে ”

কাব্য যেনো আরো রাগিয়ে দিলো।তাকে কোনো প্রকার গুরুত্ব না দিয়ে আলমারি থেকে ঘরের কাপড় বের করছে।চারুর দিকে এক পলক চেয়ে হেসে চলে গেল ফ্রেশ হতে। দ্রুতই ফিরে এসেছে।বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

“ক্ষিদে পেয়েছে।গিয়ে খেয়ে আসি।…..ওহ তুমি খেয়েছো?”

“মজা করেন?”

“নাতো।তুমি না খেলে আমার বাচ্চাটা বড় হবে না”

“কাব্যর বাচ্চা। চক্ষের সামনে থেকে দুর হন।”

“কাব্যর বাচ্চা তোমার পেটে। দ্রুত আনো পৃথিবীতে তারপর নাহয় তাকে নিয়ে অন্য ঘরে থাকবো।”

চারুর খাওয়ার রুটিন আছে।রাত নয়টার মধ্যে রাতের খাবার কমপ্লিট করতে হয়।তারপর ঔষধ।এখন রাত বারোটা বাজে। রাস্তায় থাকতেই খোঁজ নিয়েছে শায়লাকে কল করে।তার খাওয়া আগেই কমপ্লিট।

“বাবুর নানুমনি আমাকে খেতে দিন ক্ষিদে পেয়েছে ”

ঘরের দরজা একটা পুরুষ মানুষ উকি দিয়ে আছে।কি অদ্ভুত!এক দেখায় ভয় পেয়েছে শায়লা।বুকে থুথু ছিটিয়ে নেয় তৎক্ষনাৎ। কাব্যর মুখ দেখে হেঁসে ফেললেন।যেদিন থেকে শুনেছে বাবা হবে সেদিন থেকে সেই বাচ্চার রূপ ধারণ করেছে।

শায়লা একটু থেমে বললো,

“আসছি।টেবিলে গিয়ে বসো”

খাবার গরম করে খেতে দিলো কাব্যকে।এখানেও মুখটা থেমে নেই। একেকটা প্রশ্ন করছে শায়লাকে।পুরো ত্রিশ ঘণ্টা দূরে ছিলো চারুর কাছ থেকে।প্রতি ঘণ্টার হিসেব নিতে লাগলো।খাওয়া দাওয়া সেরে অলস ভঙ্গিতে ঘরে এসে বসে।রাগে দগ্ধ চারুকে দেখে ভীষণ রকমের মজা পাচ্ছে।তবে আর প্রকাশ করলো না।রাগানোর একটা লিমিট রাখলো।বেশি রাগালে চারুর ক্ষতি সাথে তার সন্তানেরও।

একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে বললো, “সরি”

নিরুত্তর চারু।এমন ভাব ধরলো কোনো শব্দ শুনতেই পারেনি।কাব্যর কোনো অস্তিত্বই নেই। হাতে রাখা বইয়ে নজর দিয়েই রুষ্ট মুখ ভঙ্গি বজায় রেখেছে।

“সরি চারুলতা”

“হূ আর ইউ?”

“আমি?আমি তোমার কাব্য,তোমার স্বামী,ভালোবাসা,তোমার অনাগত সন্তানের বাবা।”

“আমি কাব্য নামের কাউকে চিনি না।”

“আমি সরি।সত্যি দুষ্টুমি করছিলাম।তোমাকে একটু জ্বালিয়েছি।কিন্তু এটা সত্যি আমি কাকে বেশি ভালোবাসবো বুঝতে পারছি না।আমার হৃদয়ে আরেকজন জায়গা করছে ধীরেধীরে।দুজনে মিলে ঠাসাঠাসি করছো তোমরা।”

রাগটা বেশিক্ষণ রইলো না।ফিক করে হেসে ফেলে।তার হৃদয়ে তারা নাকি ঠাসাঠাসি করছে? এ কেমন কথা?চারুর হাসি দেখে সস্তি পায় কাব্য।চারুর গালে আদরে ভরিয়ে দিতে শুরু করে। আকৃষ্টতা প্রণয়িনীর মুখ জুড়ে। কপোল থেকে ওষ্ঠ টানছে।লোভী হৃদয়।ডুবে তৃষ্ণা মিটিয়ে দিলো চারুলতার ওষ্ঠে। মায়ের আদরের পালা শেষ করে এবার তার জানবাচ্চার পালা।

পেটে মাথা রেখে চারুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে,

“আমার বাচ্চাটা কি নড়াচড়া করে চারুলতা?”

“হ্যাঁ দুইমাসের একটা বাচ্চা ফুটবল খেলে পেটে।আমি হলাম রেফারি।”

চারুর ব্যঙ্গ বুঝেছে চারু। চারুকাব্যের অংশের বয়স খুব অল্প। নড়াচড়া করার মতন এখনও সঠিক সময় আসেনি। উৎসুক মন কাব্যর।নয়মাস তার কাছে নয় বছরের মতন লাগছে।সে পারলে সব নিয়ম নীতি বাদ দিয়ে এখনই তার বাচ্চাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতো।

“আমি ভালো বাবা হতে পারবোতো?নাকি ঐ কবির আফনানের মতন….”

“ওনার নাম নিবেন না।ওই লোক আপনার জন্মদাতা হলেও সে আপনার বাবা না।সে কারো বাবা হওয়ার যোগ্যই না।বাবা শব্দটা অনেক দায়িত্বের,অনেক ভালোবাসার।আমরা অনেকেই দেখেও দেখি না এই ভালোবাসা।আপনি হবেন আমার সন্তানের জীবনের শ্রেষ্ট মানুষ।আর আমার জীবনের শ্রেষ্ট প্রেমিক পুরুষ।”

“আমি চেষ্টা করবো তোমাদের আগলে রাখার।”

“আমরাও আপনাকে আগলে রাখবো।”

“ছেলে হবে নাকি মেয়ে?”

“সেটাতো জানি না।কিন্তু হ্যাঁ যার দল ভারী হবে সেই হবে লিডার। বিপরীত পক্ষকে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখতে হবে বলে দিলাম।”

চলবে…