#চারুকাব্য ৯
লেখা : #azyah_সূচনা
“পালিয়েছে?”
“জ্বি স্যার”
কবির সাহেব ‘ জ্বি স্যার ‘ বিপরীতে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করলো প্রমোদকে।হাপিয়ে উঠেছেন চেঁচামেচি করে। বয়সতো কম হলো না।পেছন থেকে এক বিদেশি রমণী এগিয়ে এলো।মধ্য বয়স্ক।কবির সাহেবের স্ত্রী।
বললো,
“তুমি রাগারাগি করো না।তোমার প্রেসার হাই হয়ে যাবে।”
“চুপ থাকো!প্রেসার হাই হওয়ার মতোই ঘটনা ঘটেছে।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তোমরা মহিলা মানুষরা জানোই একটা কথা। সব ঠিক হয়ে যাবে।আর কোনো আশ্বাস নেই তোমাদের কাছে এই বাক্যটা ছাড়া।তুমি জানো কাব্যর কাছে থাকা প্রমাণগুলো যদি ভুলক্রমেও ফাঁস হয় কি হবে?এইযে আলিশান বাড়িতে থাকছো।দামী কাপড়,গহনা।আরামের জীবন!সব হারাম হয়ে যাবে। জান মাল সব নিয়ে টান দিবে আমাদের ডায়না।”
বাংলা বোঝে সে।তাই চুপ হয়ে গেলো।বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই পাড়ে এই পথ।পুরনো খারাপ কাজের অন্ত টেনে নতুনভাবে সব শুরু করলেই পারে।কিন্তু না।সে শুধু চেনে টাকা আর ক্ষমতা। আবার ভয়ও পায়।সে আসলে কি চায়?নিজে জানে?জানলে হয়তো এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হতো না তাদের।
___
রাতের আঁধার কেটেছে।সাথে ঝড়ের গতিবেগও।ঝলমলে রবি তীর্যক রোশনি ছড়াচ্ছে চারিদিকে।ভেজা মাটির ঘ্রাণ ভেসে এলো চারিপাশ থেকে। নির্ঘুম রাত পার করতে অভ্যস্ত কাব্য।তবে কাল রাতের ঘটনা মোটেও সস্তিদায়ক ছিলো না।সামান্য স্পর্শনুভূতি এতটা দাগ কাটতে পারে? অস্থিরতার বিচলণ থামেনি এরপর থেকে।অথচ চারু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দিব্যি ঘুমিয়েছে।ইজি চেয়ারে বসে সারারাত পাহারা দিতে হয়েছে তাকে।মাত্র বারান্দায় এসে বসলো।একবার ইচ্ছে জেগেছিল।তুলে প্রশ্ন করুক।কি করে এত নিশ্চিন্তে ঘুমায় তাকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে।বুকের যে অংশে ক্ষণিকের জন্য চারুর মাথাটা স্পর্শ করেছিলো?সেখানটায় বারবার হাত চেপে ধরছে।মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।কষ্টে,খুশিতে,ভয়ে।চারুর ক্ষেত্রে এই অনুভূতিটা ভিন্ন। ভালোবাসা অনুভব করে তিলেতিলে।তাহলে এই অল্পখানি ছোঁয়া কেনো বিষাক্ত পদার্থ এর মতন ছেয়ে যাচ্ছে হৃদয়ে?
চারু জেগে উঠে।চোখ সজাগ হতেই একটু ভীত হয়ে উঠলো। বেচেঁ আছেতো?নাকি ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে।আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো।না সব আস্ত আছে।জানালার বাহিরে ভাবুক কাব্যকেও দেখা যাচ্ছে।কি ভয়টাই না পেয়েছে কাল?ভয় পেয়ে কাব্যকে জাপ্টে ধরেছে সেটাও হঠাৎ মাথায় এসে বারি খেলো। লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে নেয়।নিজে আগ বাড়িয়ে তার কাছে এসেছে!তাও এমন একজনের কাছে যাকে সে ঘৃনা করে।সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বুজে কাব্য।
অকস্মাৎ বলে উঠে, “ফ্রেশ হয়ে এসো।নাস্তা রেডি”
আচমকা আওয়াজে টনক নড়ে।গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেছে।রুনা চালের রুটি করেছেন।সাথে ঝাল ঝাল হাসের মাংস কষা।কাব্যকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে নাস্তা সেখানেই নিয়ে গেলেন।
কাব্য প্রশ্ন করলো, “আপনারা নাস্তা করেছেন?”
“না সাহেব।আপনাগো খাওয়া শেষ হইলে খাবো।”
“উঠেন কয়টায় ঘুম থেকে?”
“এইতো ছয়টায়?”
দেয়ালে আটকে থাকা ঘড়ির দিকে চাইলো কাব্য।সকাল দশটা তেত্রিশ মিনিট। গুরুগম্ভীর গলায় বললো,
“আমিতো এমন কোনো নিয়মে বাঁধিনি আপনাদের যে আমাদের খাওয়া শেষ হলেই আপনাদের খেতে হবে।”
“না সাহেব সেটা করতে যাবেন কেন?মালিক সাহেবেরা না খাইলে আমরা খাইতে পারি? জুঠা হইয়া যাইবো না?আপনারা খাইয়া যা থাকবো তাই আমরা খাবো”
ভেদাভেদপূর্ন কথা পছন্দ হলো না কাব্যর।মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, “ঘরে আনাজের অভাব?”
“না সাহেব তা হইবো কেন?আপনার ঘরে সবকিছু পাঁচটা পুরা”
“তাহলে যখন খাবারের সময় হবে খেয়ে নিবেন।আপনার মেয়েটা আছে না?কি নাম ওর? টুনি?ওর পড়ালেখা কতদূর?তাছাড়া আপনাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমজাদকে জানাবেন। জাতিগত ভেদাভেদটা আমার সামনে আর কখনো যেনো না হয়।”
একটু রেগেই কথাগুলো বলেছে কাব্য।রুনা একটু ভয় পেলো কিন্তু মুগ্ধও হয়।নিচু জাতি বলে সর্বক্ষণইতো তারা পীড়িত।কাব্যর কঠিন শব্দেও সৌন্দর্য্য খুঁজে পেলো।মুখে আঁচল টেনে খাবার এগিয়ে দিয়ে চলে গেলো।জানালার আড়ালে দাড়িয়ে সবটাই শুনেছে চারু।ভালো কাজের বিনিময়ে রুষ্টটা আসেনি তার মনে।ভাবলো সে কি ভালো নাকি খারাপ?নাকি ভালো মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো অনুত্তম পুরুষ।
আওয়াজ দিলো কাব্য।বলে উঠলো, “চারুলতা তোমার হয়েছে?নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
বেরিয়ে এসেছে চারু।ইচ্ছে ছিলো না মুখোমুখি হওয়ার।নির্লজ্জ্ব ভেবে চলেছে নিজেকে।কি করে জড়িয়ে ধরলো তাকে? ঝড়ের ভয় কি কাব্যর চেয়ে বড়?
চারুর দিকে চোখ পড়তে নজর সরিয়ে নেয় কাব্য। কুসুম রঙের শালীন পোশাক আবারো তাকাতে বাধ্য করলো। রঙটা নয় এই রঙে আবৃত চারু আকর্ষণ করছে।মুখে মুক্তাদানার মতন চকচক করছে পানি। কাব্যের ডাকে হয়তো মুখটা মুছে আসার সময়টুকু পায়নি। তড়িৎ গতিতে পূনরায় নজর সরায়।নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে বলে উঠলো,
“দেখো চালের রুটি আর হাসের মাংস করেছে রুনা আপা। নিশ্চয়ই খুব ভালো হবে খেতে।”
কাব্যর মতন করেই চারুও মুখ ভার করে বসলো।যেনো গতরাতের কোনো কিছুই তার মনে নেই। চালের রুটি দেখে একদফা মায়ের কথা মনে পড়লো। ভারাক্রান্ত হলো হৃদয়।কখনো ভেবেছিল এখানে এসে দাড়াতে হবে?
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হয়। মিনিট পাঁচেক নীরবতায় কাটিয়ে দিয়ে চারু চিন্তার বাহিরে প্রশ্ন করে বসে কাব্যকে,
“আপনার পরিবার কোথায়?”
শখ করে খাবার খাচ্ছিলো কাব্য। হাতটা থামিয়ে দেয় চারুর প্রশ্নে। দৃষ্টি তুলতে পারছে না। কাল রাতের মতন হৃদয়ে ঝড় তুলবে আবারো।পিটপিট করে চোখের পলক ফেলে কাব্য বললো,
“এতদিন পর জানতে ইচ্ছে হলো?”
“হ্যাঁ।আমার মনে হয় আমাদের কথা বলা উচিত!”
“আমাদের?”
মুখে উত্তর তৈরি ছিলো।ভেবেছিল কাব্য যাই বলুক তার কথার বিপরীতে আরো অনেক প্রশ্ন করবে।সেটা আর সম্ভব হয়নি। থতমত খাইয়ে দিয়েছে তাকে।এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বললো,
“হ্যা! সত্য বলতে আমি মেনেই নিয়েছি আমার বাকিটা জীবন আপনার মতন মানুষের সাথেই কাটানো লাগবে।তাই স্ত্রেইট ফরওয়ার্ড প্রশ্ন করবো।আপনি উত্তর দিবেন”
“আমাকে অর্ডার করছো চারুলতা?”
“যেটাই মনে করেন।আমি জানতে চাই।আপনার রহস্য কি?আপনাকে আমার বাবা কিভাবে চেনে?আপনার আসল পরিচয় কি?”
মুচকি হেসে হাত তোয়ালে দিয়ে মুছে নিলো কাব্য। খাবার প্লেট দূরে সরিয়ে পিঠ এলিয়েছে সোফায়।পায়ের উপর পা তুলে বললো,
“আমি কাব্য আফনান একজন খারাপ নিকৃষ্ট লোক এটাই আমার পরিচয়”
তার হেয়ালি কথায় আজ দমবে না চারু।পন করেছে যে করেই হোক নিজের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ছাড়বে আজকে।তর্জনী আঙ্গুল তুলে বললো,
“একদম হেয়ালি করবেন না! আপনি কি ভাবেন এমন রাগী মুখ নিয়ে ঘুরেন বলে আপনাকে সবসময় ভয় পাবো?”
“আমার মুখে সর্বদা একটা হাসি থাকে চারুলতা তুমি রাগ কোথায় দেখলে?”
“কথা ঘুরাচ্ছেন?বলুন না।আপনি যদি স্পষ্ট জবাব না দেন?আমি পালিয়ে যাবো এখান থেকে”
“পালাও পারলে”
নাকের পাটা ফুলে ফেঁপে উঠে চারুর।ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে এবার।ঠোঁট চেপে আছে।কিছু বলবে বলবে ভাব। অতঃপর বলে উঠে,
“সমুদ্রে ঝাঁপ দিবো বলে দিলাম!”
ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো।মুখ জুড়ে যেনো কালো মেঘের ছায়া ঘনিয়েছে। সর্বদা যে হাসি থাকে?সেটাও উধাও। আজকাল চারুর রাগ দেখা যায়।মাত্র যা বললো সেটা আবার সত্যি সত্যি না করে বসে।নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে কাব্য। সঙ্গীন গলায় বললো,
“এই ধরনের কথা দ্বিতীয়বার মুখে যেনো না আসে চারু।”
কাব্যর হুমকিপূর্ণ কন্ঠ গায়ে মাখলো না চারু।বললো,
“আমাকে জীবিত সুস্থ স্বাভাবিক দেখতে চাইলে বলুন।উত্তর দিন।আজ প্রশ্ন উত্তরের দিন।শুরু করুন”
হেরে যাওয়া দেখছে নিজের।সচক্ষে। ভালোবাসায় বেধে ফেলা কি কম ছিল?আজ আবার ভয় দেখিয়ে নিজের প্রশ্নের জবাব হাসিল করে নিচ্ছে যে?
“আমার পরিবার বলতে আমার দাদী ছিলেন।”
“এখন উনি কোথায়?”
“নেই”
নেই বলতে এই পৃথিবীতে নেই।শুনে খারাপ লাগে চারুর।তবে দমে গেলো না।আবার প্রশ্ন করলো,
“আর বাবা মা?”
তুচ্ছ হেসে কাব্য বললো, “আমি আমার তথাকথিত বাবা মার একটা ভুল ছিলাম।ঐযে তুমি বলো না?আমি ভুল?সত্য!আমার জন্মটাই ভুল। সাত বছর একসাথে থাকার পর যখন তারা দুজন তাদের ভুল বুঝতে পারে? পথ আলাদা হয়ে যায় তাদের।দুজন দুই পথে দৌড়ায়।মধ্যে রয়ে যাই আমি।ছয় বছরের একটা দিশেহারা ছোট বাচ্চা ছেলে।”
“বাবা মা স্বার্থপর হতে পারে?”
আওয়াজের জোর বাড়িয়ে কাব্য বললো,
“ফালতু কথা এসব!কে বলেছে বাবা মা স্বার্থপর হয় না?কে বলেছে রক্তের সম্পর্ক অমূল্য হয়?সব মিথ্যে।এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা জীব স্বার্থপর!”
দৃষ্টিনত হয় চারুর।খানিকটা নিচু স্বরে বলল, “আর আপনার দাদী?তার সাথেতো আপনার রক্তেরই সম্পর্ক।”
“আপন দাদী ছিলেন না সে আমার।বাবা নামক লোকটার খালা ছিলেন তিনি।নিজ হাতে লালন করেছেন আমার। জানো চারু?যে বয়সে আমার বাচ্চাদের সাথে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিলো আমি আমার দাদীর আঁচলে ধরে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছি।”
দ্বিধায় আক্রান্ত হলো হৃদয়।এই ক্ষণে কিছুতেই অসন্তোষ ভাবটা আনতে পড়ছে না।দৃঢ় ভাবটা আসছে না।বরাবরই নরম হৃদয়ের অধিকারিণী সে।কাব্যর প্রতিও কোনো রকমের মায়া উৎপন্ন হতে পারে?
“হয়তো জীবনের এমন একটা পরিস্থিতি থেকে উঠে এসে এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন।যেখানে আপনার সব আছে।”
“আমার দাদীতো নেই।যাকে সবচেয়ে ভালো রাখার কথা ছিলো সে এসব দেখার আগেই চলে গেলো।”
কাতরতা কাব্যর কণ্ঠে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে চারুর। মিশ্র অনুভূতি!মন ডাকছে মায়ায় পড়তে।আবার কোথাও এক অজানা বাঁধা।এই মুহূর্তে আক্রোশ এর চেয়ে বেশি মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দিলো চারু।শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“সৃষ্টিকর্তা যাকে বেশি ভালোবাসেন তাকে নিজের কাছে ডেকে নেন। এতে আমাদের কোনো হাত নেই।”
“তাকে খুন করা হয়েছে!”
একই স্থানে বসে কত রকমের অনুভূতির স্বীকার হওয়া যায়? মাত্র কাব্য যা বললো সেটা চেতনা শূন্য করে তুললো চারুকে।খুন বড্ড ভয়ঙ্কর একটা শব্দ।ভেতরে ভেতরে কেপে উঠে চারু।প্রশ্ন করতে নেয়।কাব্য হাত উচিয়ে থামিয়ে দিল।বললো,
“প্লিজ আর কোনো প্রশ্ন করো না।আমার অস্থির লাগছে।অশান্তি অনুভব হচ্ছে বুকে!”
অল্পস্বল্প হাপাচ্ছে কাব্য।নিঃশ্বাসের গতিবেগ ঠিক নেই। অস্থিরতা সর্বাঙ্গ জুড়ে।তাদের মনের অবস্থা সামান্য কি আন্দাজ করতে পারলো চারু?এখানেই থেমে যাওয়া উচিত।জোর দেওয়ার কোনো মানেই হয় না।তাকে পছন্দ নয় বলে কষ্ট দিবে? এতাওতো অন্যায়।কাব্যকে ঘন ঘন শ্বাস নিতে দেখে চারু বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আপনার কি খারাপ লাগছে? অসুস্থবোধ করছেন?”
“নাহ।আমাকে একা থাকতে দাও।”
তার সামনে থেকে উঠে দাড়ায় চারু।চোখ যায় দুর সমুদ্রে। পাড়ে বসার ইচ্ছা জাগলো তৎক্ষনাৎ।এই মুহূর্তে সমুদ্রবিলাস ভারাক্রান্ত মনকে শীতল করতে সক্ষম হবে।
“আরেকটা কথা এসব শোনার পর আমার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কোনো দরকার নেই।আমাকে ঠিক আগের মতই ঘৃণার চোখে দেখবে!”
_
‘পৃথিবীর দৈর্ঘ্য বিশাল।বসবাস ভিন্ন বিভিন্ন প্রাণের।বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জলোচ্ছাসে হৃদয়ের দৈর্ঘ্য অতি ক্ষুদ্র।অত্যন্ত ক্ষুদ্র’।আরো অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করার ছিলো কাব্যকে।হয়ে উঠলো না।তার বারণ নয়।নিজেই ইচ্ছে করে আগায়নি।মানুষ যতই নিকৃষ্ট হোক না কেনো তাকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার নেই।মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা।বাবা মাও স্বার্থপর হতে পারে? নিষ্ঠুর হতে পারে?ধোঁয়াশার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াসে আরো যেনো ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেলো চারিপাশ।
ঘন্টাখানেক পেরিয়েছে এই কূলে বসে।শক্ত গাছে পিঠ ঠেকিয়ে চেয়ে আছে।পাখিরা সমুদ্র বুকে এদিক ওদিক উড়ে চলেছে। স্বাধীন জীবন তাদের।বাঁধা নেই কোনো ধরনের। অক্ষি শীতল হলো চারুর।এই উড়ে চলা পাখিগুলোর বাধাহীনতা দেখেও সস্তি। স্থির সমুদ্র ভ্রম মেশানো।ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে দিতেই ওড়না লেপ্টে নিলো গায়ে। জড়োসড়ো হয়ে আরো ঘণ্টাখানেক পেরোবার অপেক্ষায়।
“আপা?সাহেব বলছেন আপনাকে ঘরে যাইতে।এতখন এদিকে বইসা থাকলে আপনার পিঠ ব্যথা করবো”
“ওনাকে গিয়ে বলেন আমি আসবো না।আমার পিঠ আমার ব্যথা!”
টুনি হাসলো। ভেবে নিলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হয়তো মনোমালিন্য হয়েছে।এসব ছোটোখাটো ঝগড়া কত দেখেছে বাবা মার মধ্যে।আবার মিলেও গেছে তারা একটা সময় পর।উল্টো ঘুরে কাব্যর কাছে গিয়ে তথ্য দিলো।বললো,
“আপা আপনার উপরে রাইগা আছে হয়তো।আসবে না বইলা দিছে সরাসরি”
কপাল কুঁচকায় কাব্য।রেগে যাওয়ার মতন কিছুই হয়নি।তাহলে? টুনিকে রেখেই নিজে গেলো এবার চারুর দিকে।কোমরে হাত রেখে দাড়িয়ে বললো,
“আমি তোমাকে রাগ করার মতন কিছু বলেছি?”
“কই?নাতো?”
“তাহলে রেগে আছো কেনো?”
“আমার মেজাজ, আমার রাগ!”
বোধগম্য হয়নি চারুর কথা।অবুঝের মতন এদিক ওদিক চাইলো।পরক্ষণে মনে হলো এখানে তার পরাজিত হওয়া উচিত।বললো,
“আমার কোনো কথা খারাপ লাগলে আমি ক্ষমা চাইছি।ঘরে আসো।”
“আমার সময় হলে আসবো।আর হ্যা সমুদ্র উপভোগ করছি।বারবার বিরক্ত করবেন না। ভাগেন এখান থেকে!”
চলবে….
#চারুকাব্য ১০
লেখা : #azyah_সূচনা
ধমকের উপর ধমক।ক্লাসে কোমলমতি চুপচাপ মেয়ে রূপে দেখেছে তাকে।রাস্তা খাটে সাবধানে তার চলা ফেরা ছিলো।যেদিন বিয়ে করেছে সেদিনও বোকার মতন কেদে কেদে বন্যা ভাসিয়েছে এই মেয়ে।ভয়ে হাতপা কাপতেও দেখা গেছে।কাব্য ভেবেই নিয়েছিলো সে হবে ছিচকাদুনে।নরম সরম স্বভাবের মেয়ে মানুষ।এখানে আবহাওয়া ভিন্ন।হুটহাট কাব্যকে ধমকে উঠে।আজকাল চোখে ভয়টাও দেখা যায়না।তাকে ভয় পাক কাব্য কখনো চায়নি।তাই বলে কাটকাট কথায় কাব্যের বচনশক্তি কেড়ে নিবে?বুকে এক অজানা জ্বালা অনুভূত হয়।তার কথার জোরে কিছু বলার সাহস হয়ে উঠে না।
সঠিক সময়ে সঠিক মানুষ এসে হাজির।হাতের আঙ্গুলে এক দুই গুনে নিলো।পরপর দুইবার ধমক খেয়েছে আমজাদের সামনে।আরো একবার গতরাতে।সেটার সাক্ষী আমজাদ ছিলো না।শান্তি অনুভব করে সে।এই শান্ত সুরে হুমকি দেওয়া লোকটার ব্যবস্থা করার জন্য কেউতো এসেছে।
“স্যার ম্যাডাম আপনাকে দ্বিতীয়বার ধম…”
পিস্তলটা যেনো তার আরেক বউ।সারাক্ষণ কোমরে গুঁজে রাখে। তোড়জোড় দেখিয়ে বের করে নিলো। আমজাদের কাছে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,
“বেশি কথা বললে সবগুলো বুলেট তোমার মাথার খুলির এপার ওপার করে দিবো।যাও এখান থেকে!”
খানিকটা ভয় আর বড়সড় কষ্টের পাহাড় দিয়ে ধেইধেই করে হেঁটে চলে গেলো আমজাদ।ছেলে মানুষ না হলে বোধহয় কেঁদে ফেলতো।এতবছর পাশে থেকেও এই লোক এমন খারাপ ব্যবহার করে মাঝেমধ্যে!আমজাদের কথায় মেল ইগো হার্ট হলো বোধহয় কাব্যর।আবার এসে দাঁড়ায় বিস্মৃত চারুর পানে। কাটকাট গলায় বলে উঠে,
“উঠে দাড়াও”
ভার চক্ষুদ্বয় আবার তুলে চায় কাব্যর পানে।চেচিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে কি সমস্যা কি আপনার?শান্তি দেবেন না?কথা বাড়ানোর মুডে নেই সে। গুরুত্বহীনভাবে বললো,
“যাবো না”
হাতে স্পর্শ অনুভব করে চারু। কোমড় বেকিয়ে হাত ছুঁয়েছে কাব্য। ঘটনার সম্পূর্ণ বুঝে উঠার আগে টেনে তোলা হয়। তার চেয়ে দ্রুত গতিতে পাজাকোলে তুলেছে।চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে আসবে ভাব।কাব্য হাটা শুরু করলে চারু আঘাত করা শুরু করলো কাব্যর বাহুতে।
“ছাড়েন আমাকে।নামান বলছি।খারাপ লোক!”
“কাল আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে।আর আমি আজ তোমাকে কোলে তুলে নিয়েছি। শোধবোধ!….আর হ্যা!যখন তখন যারতার সামনে ধমকাবে না আমাকে।”
“মোটেও নাহ! সেটার সাথে এটার কোনো সম্পর্কই নেই। কাল রাতে আমি ভয় পেয়ে করেছি কাজটা।আর আপনি?আপনি সজ্ঞানে আমাকে তুলে নিয়েছেন।আপনার নিয়তে খোট!”
বড়বড় কদম ফেলে সোজা বারান্দায় এসে ঠেকেছে।নামিয়ে দিলো চারুকে। ছটফট করে হাপিয়ে উঠেছে চারু। তত্সত্ত্বেও কাব্যর মুখে কোনো প্রক্রিয়া নেই।এতবড় জলজ্যান্ত মানুষকে তুলে এনেও হয়রান হয়নি সে।
“নিয়তে খোট থাকলে বিয়ের রাত থেকেই অধিকার ফলানো শুরু করতাম।তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো চারু আমি তোমার স্বামী।”
“ইশ! খালি সাধু সাজা হয় তাই না?”
“ঝগড়া করছো কেনো?”
“তকি আদর করবো?”
বলে ঠোঁট কামড়ে নেয় চারু। কথায় কথায় অরুচিপূর্ণ কথা বলে ফেলেছে।সেখানে কাব্য নীরব।তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চারুর দিকে।তার দৃষ্টি এড়াতে চারু পালায়।দ্রুত প্রস্থান ঘটায় নিজের।চুপিচুপি আমজাদ শুনেছে।শেষ কথাটিই বেশি কানে বাজলো।মনে মনে বললো,
“হ্যা করেন আদর!আমাদের কপালে কি এসব আছে নাকি?”
__
“চারু তোর কিন্তু দিনদিন সাহস বাড়ছে।যে নিজের সহচরকে পিস্তল দেখায় সেকি তোকে ছেড়ে দিবে?মুখটা সাবধানে চালাস”
নিজেকে আনমনে শাসালো চারু।হুটহাট রেগে যাওয়ার নতুন স্বভাব পেয়েছে।তাও আবার কাব্যকে।ভুলতেই বসেছিলো কাব্যর সাথে তার সম্পর্ক।সে এখন একা নয়। বিবাহিত।কাব্য আফনানের বিবাহিত স্ত্রী।তবে আচার আচরণে এখনও রয়ে গেছে অবিবাহিত তরুণীই রয়ে গেছে।প্রায় একমাসের সংসারে নিজের মধ্যে কিছু না বদলালেও আশপাশে অনেক কিছুই বদলে গেছে।দরজার পাশে উকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে চারু।ওই খারাপ লোকটা নেইতো?নাহ নেই।
বেরিয়ে আসা মূলত খটখট আওয়াজে।একজন লোক কাঠ নিয়ে কিছু একটা করছেন। খোদাই করছেন দেখে মনে হলো।চারু তার কাছে দাড়িয়ে বললো,
“আপনি কি করছেন?”
“আফা বাড়ির নেমপ্লেট বানাই।”
“নেমপ্লেট? কাঠ দিয়ে?”
“হ আফা।স্যার কইছেন এই কাঠের উপরে খোদাই কইরা বাড়ির সামনে লাগাইতে।”
নিজের কাজের উপর মনোযোগী হয় লোকটি। নৈপুণ্য হাতে সেখানে বসেই দশ মিনিটে কাজ শেষ করে নিলো। হাসিমুখে বাঁশের সাহায্যে মাটিতে গেথে দেয় চার কোনাচে নেম্পলটটি। কোথা থেকে যেনো কিছু ফুল আর লতাপাতা এনেছেন। নেমপ্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো।চারুর সম্মুখ থেকে সরে গেলে তার চোখে ভেসে আসে এই কাঠের বাড়ির নাম।
“চারুকাব্য নিবাস”
অজান্তেই হাসি ফুটে চারুর মুখে। লোকটিকে পেরিয়ে এগিয়ে যায়।ছুঁয়ে দেখে নেমপ্লেটটি। মুগ্ধ মুখোভঙ্গিমা।তার নামটাও এখানে সুন্দর দেখাচ্ছে।কাব্যর নামের সাথে জুড়ে আছে।এই সামান্য কিছু কারো মনে উচ্ছাস জাগাতে পারে?মনের মাঝে তীব্র আকাংখা ছিলো।একদিন বাবা মায়ের জন্য একটি ছোট্ট নীরে হবে তাদের বসবাস। অভাবহীন,পরিপূর্ণ।এভাবেই নেমপ্লেট সাজাবে ঘরের সম্মুখভাগে। কাঠ দিয়ে তৈরি হতে হবে সেই নেমপ্লেটকে অবশ্যই।ইচ্ছেটা অনেকাংশে পূর্ণ হলো। তবে ভিন্ন উপায়ে।
“পছন্দ হয়েছে তোমার চারুলতা?”
অস্ফুট কন্ঠে বলে, “খুব খুব”
কোনো জড়তা নেই মুখটায়।দুটো শব্দ উচ্চারণ করেছে উচ্ছাসের সাথে।মনে ইচ্ছে জাগে।এভাবেই যদি সর্বক্ষণ কথা বলতো?ঘৃণার চোখে না দেখে ভালোবাসার চোখে দেখতো? হৃদয়তো অবাধ্য। দুর্বহ জিনিস চেয়ে বসে বারেবারে।ঠোঁট কামড়ে আটকে থাকা খুশির জোয়ারে চক্ষু নিবদ্ধ। সরছে না, সরাতে চাচ্ছে না কাব্য।বক্ষ পিঞ্চিরায় এই নিদারুণ জ্বালার উপশম হবে কোনোদিন।ভেতরে ভেতরে ভস্ম করছে সবকিছু।প্রকাশের অভাবে কয়লা জমেছে অন্তরে।
লোকটির টাকা পরিশোধ করে দেয় কাব্য।হাসিমুখে নিজের সম্মানী পেয়ে বিদায় নিলো সে।এরই মাঝে হাসি খুশি চারুকে দেখে মনের মাঝে সাহস যোগায়।মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় অনুভব করাতে চারুকে। অবহেলায় অবহেলাপূর্ণ স্বভাবে দিকে ঢলে পড়া মানুষ।ভালোবাসতে জানতেও প্রকাশ করতে জানে না।
কম্পিত হাতজোড়া নিজের হাতদ্বয়ের মধ্যে আবদ্ধ করে নিলো আলগোছে।ভাসমান চোখের উপরিভাগে কপালে মধ্যমা ভাজ ফেলেছে। ঘোরে আচ্ছন্ন সেই রাশভারী গলায় বললো,
“সুন্দর লতা, প্রাণ ভ্রমরা আমার।তোমার হাসিতে আমার কালো হৃদয় অদ্ভুত রকমের সস্তি পাচ্ছে।আমার সবকিছুই তোমার।শুধু আমিটাই তোমার হতে পারলাম না।আমার ভালোবাসাটা হয়তো অপূর্ণই রয়ে যাবে।”
জলে টলমল করতে থাকা চোখ জোড়ায় এক বিশাল মায়ার সাগর দেখা মিলছে।নেত্র পলকহীন।স্নেহ দেখেছে অনেকের চোখে তবে এই দৃষ্টি ভিন্ন। সপ্তপর্নে লোচন সরায় চারু।হাতের দিকে দৃষ্টপাত করে। স্বাস্থ্যবান শক্ত হাতে অজস্র দাগ।মিশে গেছে ত্বকের সাথে।অনেক পুরোনো বোধহয়।ডান হাতের কিছু অংশ ডেবে আছে।আর কিছু ভাবলো না চারু।
বললো, “আপনার হাতে কি হয়েছে?”
“এটা? তেমন কিছু না”
“দেখে মনে হচ্ছে বড় ধরনের আঘাত পেয়েছেন।”
“নাহ! বললাম তো তেমন কিছু না।…আচ্ছা চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখাই”
বিশাল হাতের তালুতে চারুর নরম হাতটি আবদ্ধ হয়েই পিছু চললো কাব্যর।এসে দাঁড়িয়েছে কাব্যর ঘরে।এখানে থাকে সে। চারুর থেকে দুরত্বে।চারুকে বসতে ইশারা করে পুরোনো স্টিলের আলমারি থেকে ধুলোয় মাখা একটা অ্যালবাম বের করে চারুর পাশে এসে বসে।পা গুটিয়ে খুলে ধরলো চারুর পানে।
তর্জনী আঙ্গুল পুরনো এক ছবিতে ঠেকিয়ে বলে উঠে,
“এটা দেখো জীবনে প্রথমবার কক্স বাজার গিয়েছিলাম। দাদী আর আমি। এখনকার মতন তখন সৈকতে অহরহ ফটোগ্রাফার ছিলো না।অনেক আকুতি মিনতি করে আমাদের পাড়ার একজন ক্যামেরাম্যানকে দিয়ে তুলিয়েছি”
“কেনো?”
“টাকার সল্পতা।কেউ নিজের ব্যবসায় লস করে আমাদের ছবি তুলে দেবে নাকি?মজার বিষয় হচ্ছে এই ছবিগুলোর মূল্য মাত্র পাঁচ টাকা।যতবার ছবি তুলে দিত আমি ওনার টুকটাক কাজ করে দিয়েছি।এভাবেই হিসেব নিকেষ হতো আমাদের।”
আশ্চর্য্য হয় চারু। ছবি তোলার জন্য এত কিছু? অদ্ভূত!প্রশ্ন করলো,
“ছবি তোলার এত শখ আপনার?”
“না ব্যাপারটা তেমন নয়।আমার দাদী হাসির ছলে বলেছিলেন আমি মারা গেলে আমার মুখটাও ভুলে যাবি তুই।এই কারণেই স্মৃতি ধরে রেখেছি।এইযে মুখটা।আমি কোনোদিনও যেনো না ভুলি”
কাব্যর মুখের দিকে চেয়ে চারু বললো, “অনেক ভালোবাসেন তাকে?”
চোখ নিচু রেখেই কাব্য বললো, “তাকে আর তোমাকে”
“কেনো?উনি আপনার জীবনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে।আপনার সাথে ছিলো সর্বক্ষণ।আমিতো ছিলাম না।”
নিঃশ্বাস ফেলে কাব্য। খট করে অ্যালবামটি বন্ধ করে পুনরায় চায় মোহিত দৃষ্টিতে।ফটাফট বলে উঠে,
“মনে আছে সেদিনের কথা?প্রেস ক্লাবের সামনে দাড়িয়ে ছিলে?তুমি লাল রঙের ড্রেস পড়েছিলে সেদিন।”
“নাহ মনে নেই।আমি প্রশ্ন করলাম কি আপনি উত্তর দিলেন কি?”
“সেদিন আমি তোমায় প্রথম দেখেছিলাম চারুলতা।তোমার বারবার মাথায় কাপড় টানাটা আমার মনে ধরেছিল।গাড়িতে বসে ছিলাম নির্বিকার।তোমার দিকে একবার তাকানোর পর দ্বিতীয়বার জানি না কেনো চোখ সরাতে ইচ্ছেই করছিলো না।এভাবেও ভালোবাসা যায়?এভাবে শূন্য মস্তিষ্কে কারো দিকে একধ্যানে চেয়ে থাকা যায়?আমি ছিলাম।এক ঘন্টা নয়।তিন ঘণ্টা!যতক্ষণ তুমি সেখানে ছিলে”
জানার আগ্রহ বাড়ে চারুর।তাই কাব্যর কথার প্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলল, “তারপর?”
“তারপর কি? তেষ্টায় শুকিয়ে যাওয়া মুখটা চাতক পাখির মতন এদিক ওদিক চাইছিলো।”
আনমনে চারু বলে উঠে, “তারপর একটা লোক আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে যায় তাইতো?”
কাব্য হাসে। স্মরণশক্তি ভালো প্রখর চারুর।অল্প বর্ণনায় সেদিনের কথা চট করে মনে পড়ে গেছে।কাব্য বললো,
“সেদিন তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলে বলোতো?একজন মহিলাকে আসতে দেখেছিলাম।তোমার হাতে কিছু একটা দিয়ে চলে গেলেন।কে ছিলো সে?”
“আমার স্টুডেন্টের মা।তার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।বেতন বাকি ছিলো সেটাই দিতে এসেছিলেন।”
খানিকটা বিরক্তির সুরে কাব্য প্রশ্ন করলো, “একটা মানুষকে এতক্ষন অপেক্ষা করিয়েছে?”
“বেতনতো দিতেই চাননি।তিনমাস ঘুরিয়ে মাঝ রাস্তায় এসে দিয়ে গেছেন।জানি না কেনো”
“তোমার উচিত ছিলো তাকে দুয়েকটা কথা শোনানো।প্রথমত তোমার কষ্টের টাকা। দ্বিতীয়ত তোমাকে তিন ঘণ্টা রাস্তায় দাড় করিয়ে রেখেছে।”
“কি দরকার মানুষের সাথে ঝামেলায় জড়ানোর। আপনি বলেন।এরপর কি হলো?”
ভালোবাসার মানুষের কাছেই তার প্রেমে পড়ার গল্প শুনতে চাচ্ছে।এমন পরিস্থিতিতেও পড়তে হবে কাব্যকে সেটাতো আগে ভাবেনি?বললো,
“আমি প্রেস ক্লাবেই তোমাকে চারবার দেখেছি।তুমি সেখানে কি করতে?”
“স্টুডেন্ট পড়াই বললামইতো ”
“তুমি আমাকে আমার ভাবনার অগোচরেই নিজের মধ্যে বেধেছো।প্রেস ক্লাবের সামনে আমাকে প্রতিদিন অপেক্ষা করিয়েছো।আবার কখনো বাসস্টপে,রাস্তার দ্বারে।আমি কেনো প্রথম দিনের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারিনি? কোলাহলে কেনো তোমার মুখটা আমার চোখে এসে আটকেছিলো?”
আসক্ত চোখজোড়া।ভিন্ন নেশায়।কি করে যেনো গভীরভাবে প্রত্যেকটা বাক্য বলে। স্বাভাবিক বাক্যের ধ্বনিতে মাদকতা মেশানো থাকে সর্বক্ষণই। নিঃসন্দেহে তার কন্ঠ অত্যন্ত সুন্দর।আজ আরো অত্যধিক মাত্রায় সুন্দর শোনাচ্ছে।সর্দির কারণে গলা হয়েছে আরো ভার।ধীর গতির আওয়াজ কান অব্দি খুব রয়ে সয়েই পৌঁছায়।
“তারপর জানতে চাইবে না চারুলতা?আমি বলতে চাচ্ছি।মন হালকা হচ্ছে আমার”
কাব্যর হাতের একপাশে ডেবে থাকা অংশে চোখ রেখেই চারু মাথা দোলায়। ধিমা স্বরে জানতে চায়,”বলেন”
“অপেক্ষার বাসনা দিনদিন বাড়িয়ে তুলেছিলে তুমি।অপেক্ষার সময়গুলো কতটা উপভোগ করেছি আমি জানো? কতবার লুকোচুরি খেলেছো আমার সাথে হিসেব আছে?সারাদিন অপেক্ষা করিয়েছো।তোমায় একঝলক দেখার জন্য ওই গাড়ির সিতে মাথা এলিয়ে পুরো একটা দিন শেষ করেছি। একবারতো পাঁচদিন তোমার কোনো খোঁজ ছিলো না।একই রাস্তায় শতবার চক্কর দিয়েও তোমাকে খুজে পাওয়া দায় হয়ে উঠে।আমার পাগল প্রায় অবস্থা দেখে আমজাদ খোজ লাগায় তোমার। কোথায় থাকো,কি করো।সব!”
“আপনি কোচিংয়ে কীভাবে আসলেন?”
“তোমার মাহমুদ স্যারের হাত ধরে।”
মাহমুদ স্যার।ভালো মানুষ সে।চারুর পূর্ব পরিচিত। সংসারের দায়িত্ব চারুর ঘাড়ে পড়লে সেই সাহায্য করে তাকে। টিউশনি খুঁজে পেতে বরাবরই তার অবদান বেশি।শেষমেশ সেও বিশ্বাসঘাতকতা করলো?
“তোমার মাহমুদ স্যার প্রচণ্ড ভীতু একটা লোক।দুয়েকটা হুমকি দিয়েই তাকে হাত করা গেছে।আর তার কাছ থেকেই জেনেছি বাকিটা তোমার সম্পর্কে।”
না জানি কি রকমের হুমকি দিয়েছে মাহমুদ স্যারকে।তার খপ্পর থেকে মাহমুদ স্যারও বাঁচেনি জেনে কপাল কুচকে নেয় চারু।এটাও বোঝা গেলো এখানেও দোষ কাব্যর।নাক ফোলাতে লাগে।
ঠোঁট উল্টে চারু বলে উঠে, “আপনি সত্যিই একটা খারাপ লোক!উনি কত ভালো মানুষ জানেন?আপনি ওনাকেও ভয় দেখিয়েছেন?”
“তোমার ওর জন্য দরদ দেখানো লাগবে না!”
“দেখাবো দরদ আপনার কি?”
“মাহমুদকে তুলে আনি?”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাব্যর দিকে চায়।এই মানুষটার প্রতি অনুভূতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে পরিবর্তন হয়।তাদের কথোপকথনের শুরু হয়েছিলো ভিন্নভাবে। এখন ইচ্ছে করছে তার মাথাটা দুইভাগ করে দিতে।
“এগুলোই পারবেন আপনি।সজীবের হাতটাও আপনি ভেঙেছেন তাই না?আর এইযে আমার এতগুলো ছবি।বিনা অনুমতিতে ছবি তুলেছেন আমার।আপনার নামেতো মামলা করা উচিত! মিথ্যে শিক্ষক হওয়ার,একটা মেয়েকে বাড়ি ছাড়া করার,জোর করে বিয়ে করার।লজ্জা নেই না?”
ঠোঁট কামড়ে হাসে কাব্য। বাচ্চাসুলভ কণ্ঠে অভিযোগ করছে। হুমকিও দিচ্ছে।এতে কাব্যর কিছু আসে যায়।তবে মন প্রশান্তকারী প্রত্যেকটা কথা।
“এভাবে আমার সাথে নীরবে বসে কথা বলবে।ধমক দিবে,হুমকি দিবে, রাগও দেখাবে।আমি মাথা পেতে নিতে রাজি”
হৃদয়ের গতিবেগ অত্যন্ত তীব্র।মেয়েটি কি জানে কাব্যর অনুভূতিগুলো কত প্রবল? অনুভব করতেইতো জানে না তাকে।বুকে হাত রেখে যদি অনুভব করতো?কতটা ভালোবাসা কাতর তার অন্তর।
“এত ঠান্ডা মেজাজের নয় আপনি।তারপরও কেনো চুপচাপ আছেন?”
“তুমি আমার চোখের সামনে আছো তাই”
মিনমিনে কন্ঠে চারু বলে উঠলো, “আমি কিন্তু পরীক্ষা দিবো”
“অবশ্যই দিবে।আমি তোমাকে সাফল্যের চূড়ান্ত সীমানায় দেখতে চাই বউ”
চলবে..