চারুলতা তোমার জন্য পর্ব-১৪

0
11

#চারুলতা_তোমার_জন্য
#১৪তম_পর্ব

শ্রাবণের পুরু ঠোঁটের অচেনা উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠলো চারু। মস্তিষ্ককোষগুলো নির্জীব হয়ে পড়লো। নিজেকে আবিষ্কার করলো এক মারাত্মক ছোঁয়াচে উন্মাদতা। যে উন্মাদতায় প্রতিরোধগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। বিস্ময়ের আবেশে টের পেলো এক অবাধ্য চাহিদা, এক দূর্বোধ্য আকর্ষণ। এতোকাল সেই আকর্ষণের ধার ধারে নি চারু। অথচ আজ যেন সব কিছু বৃথা মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তটাকেই মনে হচ্ছে চিরন্তন সত্যি। বিস্ময়ের তুলো মেঘগুলো সরতেই এক নেশাতুর চোখের মাঝে আটকে গেলো চারু। রুদ্ধশ্বাসকর সেই দৃষ্টি। ডুবে গেলে তল, কিনারা নেই। শক্ত হাতের বেষ্টনীতে তখন কোমল কটিদেশ পিষছিলো। চুম্বনের নেশায় মত্ত শ্রাবণ। কখন যে ক্লান্ত সূর্যটা ডুবে গেছে খেয়াল নেই কারোরই। নেশায় ভঙ্গ পড়লো যখন ইন্টারকমটা বেজে উঠলো। শ্রাবণ হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলো। দৃষ্টি আবদ্ধ চারুর পেলব মুখখানায়। চারুর চোখজোড়া বন্ধ। শ্রাবণ গাঢ় স্বরে ধীরে বললো,
“আজ এখানেই ক্ষান্ত দিলাম, অন্যসময় না হয় অসংযমী হব”

চারু চোখ মেললো। বিমূঢ়, বিহ্বল দৃষ্টি তার। মোহর আচ্ছাদনে কি সেও পিচলেছিলো? শ্রাবণ হাসতে হাসতেই চলে গেলো ইন্টারকমের দিকে। চারু ঠোঁটজোড়ায় হাত দিয়ে অনভিজ্ঞ মানুষের মত প্রথম অভিজ্ঞতার চিন্তায় ধপ করে বসে পড়লো। লজ্জা, উত্তেজনায় তার বুকখানা টিপটিপ করছে। গলাখানা শুকিয়ে গেছে যেন।

শ্রাবণ এখনো ফিরে নি। চারু শূণ্য ঘরটার দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যিখানটায় কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করলো। বিশাল এক শূণ্যতা। অথচ একটু পূর্বেও তা ছিলো না। শ্রাবণ ঘরে নেই, অথচ তাকে দেখার জন্য প্রমত্ত হয়ে উঠেছে হৃদয়। মনে হচ্ছে কতটা কাল কেটে গেছে, কতটা সময় সে শ্রাবণকে দেখছে না। চারু অনুভব করলো সে শ্রাবণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। চোখ মেলার পর থেকে তাকে দেখার পিপাসা তাকে উন্মত্ত করে তুলেছে। অথচ এমন কিছুই পরিকল্পনায় ছিলো না। তার জল্লাদকে ভালো লাগার কথা নয়। এই রোবট মানুষকে কার দেখতে ইচ্ছে হয়? হয়, চারুর হয়। হুটহাট বেলেহাজের মত কথা বলা লোকটিকে দেখতে ইচ্ছে করে, হুটহাট করে তাকে কাছে টেনে নেওয়া লোকটিকে দেখতে ইচ্ছে করে। দেখতে ইচ্ছে করে সেই মানুষটিকে যে তার খারাপ সময়টাতেও মোটেই সমালোচনার ধার ধারে নি, বরং তার পাশে ছিলো ঢালের মত। এই মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে হবে না কেন? সেরাতেও শ্রাবণ তাকে বুকের মাঝে টেনেছিলো। বলিষ্ট হাতের বলয়ে ছিলো চারু। অথচ সে সীমা অতিক্রম করে নি। চারু কি চাইছিলো শ্রাবণ সীমা অতিক্রম করুক? হয়তো চাইছিলো। কিন্তু তেমন কিছু হল না।

****

অফিসে শ্রাবণের জল্লাদ রুপখানা অটুট রইলো। সে কঠিন প্রস্তরের মত। দুটো বাড়তি কথা বলে না। এর থেকে তো বাসাতেই ভালো ছিলো। চারুর এখন অফিসে আসতে ভালো লাগে না। একটা রোবটের সাথে কাজ করতে ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে হয়,
“আপনি বাসার মত ব্যবহার এখানে করেন না কেন?”

পরমুহূর্তেই থেমে যায়, কারণ অফিসে আগের মত আচরণ করার বুদ্ধিটা তার। সুতরাং শ্রাবণ ভুল কিছু করছে না। মিসেস তালুকদার শব্দটির অভ্যাস খুব মারাত্মক। তার চেয়েও মারাত্মক চারুলতা শব্দটি। চারুলতা শোনার জন্য কানজোড়া ছটফট করে, অস্থির হয়ে উঠে হৃদয়। কিন্তু শ্রাবণ সেদিনের পর আর কাছে আসে নি, চারুলতা বলে ডাকেও নি। চারু শানিত নয়নে দেখছে শ্রাবণকে। শ্রাবণ কিছু ফাইলে স্বাক্ষর করছে। ধারালো দৃষ্টির আঁচ পেতেই সে বলে উঠলো,
“মন মেজাজ কি খারাপ মিস মেহেনাজ?”
“না, মনের কি হবে?”
“তাহলে মেজাজ খারাপ?”
“না স্যার, সবকিছু বহাল তবিয়তেই আছে। দয়া করে ফাইলগুলো দিন। নয়তো আমাকে চ্যালাকাঠে ঝুলাবে”

শ্রাবণ হাসলো কি? বোঝা গেলো না। তবে চেয়ারে বিশাল দেহটা ছেড়ে দিয়ে বললো,
“আপনাকে চ্যালাকাঠে ঝুলানোর সাহসও বুঝি কারোর আছে?”
“সবার আছে। আমি কি? একটা সামান্য জীব। এই সামান্য জীবের প্রতি মায়া কারো নেই। আপনার গলা তো ধরতে পারে না, আমার গলা ধরে। সেক্রেটারির গলা ধরে যদি শ্রাবণ তালুকদারের টিকি পাওয়া যায়। ওরা তো জানে না যে শ্রাবণ তালুকদারও আমার গলাই ধরে”
“আমি বোধ হয় আপনাকে কাজ দিচ্ছি না। তাই তো এতো বকার সময় পাচ্ছেন। এক মিনিট”

বলেই এক বিশাল প্রজেক্টের দায়িত্ব দিয়ে বললো,
“ইঞ্জয় মিসেস তালুকদার”

চারুর ইচ্ছে করলো নিজের কপালে জুতা দিয়ে দুটো বাড়ি দিতে। এই লোকের জন্য তার মনজমিন খা খা করছে? সে কি আর লোক পেলো না? অসহ্য! জল্লাদ কোথাকার!

নিজের ডেস্কে যেতেই রিসিপশন থেকে ফোন এলো। রিসিপশনের মেয়েটা বিনয়ী স্বরে বললো,
“চারু ম্যাডাম, আপনার সাথে দেখা করতে একজন এসেছেন। উনি ওয়েটিং রুমে বসে আছেন”
“আমার সাথে দেখা করতে?”
“হ্যা, বলছে এপোয়েনমেন্ট ছিলো”
“মনে করতে পারছি না তো”
“তাহলে আমি কি তাকে চলে যেতে বলব?”

চারু কিছু একটা ভেবে বললো,
“না আমি আসছি। উনাকে বসতে বল। আচ্ছা উনি তার পরিচয় দিয়েছেন?”
“জি, জয়নুল আহমেদ”

জয়নুল আহমেদ চারুর বাবার নাম। বাবা তার সাথে দেখা করতে এসেছে? হুট করেই মনটা পুলকিত হয়ে উঠলো চারুর। উৎফুল্ল স্বরে বললো,
“উনাকে বসতে বল, আমি আসছি”

যতটা উচ্ছ্বাসের সাথে সে নিচে নেমেছে ওয়েটিং রুমে আসতেই তার উচ্ছ্বাস একেবারে গুড়োগুড়ো হয়ে গেলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুশান। ঠোঁটে সেই নির্লজ্জ হাসি। বেহায়া শব্দের আক্ষরিক অর্থই যেন বহন করছে সে। চারুর চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। দৃষ্টিতে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেলো। বীতশ্রদ্ধ স্বরে শুধালো,
“তুমি এখানে?”
“ভালো আছো চারু? আমি তোমাকে কত ফোন করেছি। তুমি ফোন ধরো নি। উলটো ব্লক করে দিয়েছো”

চারুর গা রাগে রি রি করছে। রুশানের মুখে এই ধরণের কথা কি আদোপি মানায় ওকে? ঘৃণার আগ্নেয়গিরির লাভায় কাউকে পুড়িয়ে ফেলা গেলে হয়তো রুশান সেই অগ্নির শিকার হলো। চারু জীবনে একটা ভুল করেছে, এই প্রতারকটাকে ভালোবেসেছে। নিজেকে ভুলে ভালোবেসেছে। চারু চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
“তোমাকে বলেছিলাম, আমার সামনে না আসতে”
“চারু তুমি আমাকে ভুল বুঝছো! মানছি আমি তোমার মোবাইল থেকে কোটেশনের ফাইলটা চুরি করেছি। কিন্তু আমি যা করেছি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। চারু বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে ঠকাই নি। হৃদির সাথে আমার তেমন সম্পর্ক নেই। তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও প্লিজ”

চারু নিজের সংযম হারাতে বসেছে। ইচ্ছে হলো রুশানের মুখে ঠাটিয়ে চড় বসাতে। কিন্তু এটা অফিস। সে কোনো রকম রঙ্গের কেন্দ্রবিন্দু হতে চায় না। কঠিন স্বরে তাই বললো,
“তোমার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ রুশান। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো। আর আমার বিয়ে হয়ে গেছে। সুতরাং আমাকে আর যন্ত্রণা করবে না”

চারুর কথাটা শুনতেই রুশানের মুখভাব বদলে গেলো। রুক্ষ্ণ একটা চেহারা বেরিয়ে এলো শান্ত মুখশ্রীর আড়াল থেকে। এতোটা সময়ের মেকি অপরাধবোধগুলো যেন উবে গেলো মুহূর্তেই। চারু যেতে ধরলেই হাত টেনে ধরলো শক্ত হাতে। রাগী স্বরে শুধালো,
“তুমি বিয়ে করে ফেলেছো? আমাকে এতোটা অসহায় অবস্থায় রেখে? তোমার জন্য আমাকে পনেরো দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। আমার চাকরি চলে গেছে। আমি একুলেও নেই ও কুলেও নেই। আর তুমি কিনা বিয়ে করে নিয়েছো? কাকে বিয়ে করেছো? নিজের বসকে? কি হল বলো?”

রুশানের স্পর্শে শরীর যেন ছ্যাত করে উঠলো চারুর। ঘৃণার তীব্রতা বাড়লো। রুশানের স্বর বাড়লো। চারু কঠিন স্বরে বললো,
“অভদ্রের মত আচরণ বন্ধ কর। আমি সিন ক্রিয়েট চাই না। ছাড়ো আমাকে”
“ছাড়ছি, আগে আমার টাকা ফেরত দে। আমার গয়নাগুলো ফেরত দে”
“তোমার টাকাটা প্রথমত তোমার নয়। সেটা কোম্পানিকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। আর গয়না তোমার বাড়িতে পাঠানো হয়েছে”
“সেটা বলতে তো হবে না। ওই টাকা আমার। শুধু তাই না, তুই আমাকে এখানে চাকরির ব্যবস্থা করবি। তোকে বিয়ের জন্য আমি চাকরি হারিয়েছি”
“আমাকে বিয়ে করার জন্য?”
“হ্যা, তোর জন্য”

চারুর সংযম এবার ভেঙ্গে গেলো। গায়ের সমস্ত বল দিয়ে ধাক্কা মারলো সে রুশানকে। রুশানের হাতের বাধন ছুটে গেলো। সে একটু দূরে ছিটকে গেলো। সেই সুযোগে চারু সজোরে তাকে থাপ্পড় মেরে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
“এই শেষবার রুশান। আর আমার সামনে এলে তোমাকে পুলিশে দিব আমি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তোমাকে বিশ্বাস করা। তোমার ভাগ্য ভালো আমার হাসবেন্ড তোমাকে জেলে দেয় নি। তবে আমি এতো মহৎ নই। ওয়ার্ন করছি সামলে যাও”

চারু আর এক মুহূর্ত দাঁড়াবে না। তার গা ঘিনঘিন করছে। এখন না সরলে বোধ হয় রুশানকে সে খু’ন করে ফেলবে। এতোটা ঘৃণা হয়তো সে কাউকে করে নি। রুশান এতোটা নিচু মনমানসিকতার মানুষ? ভাবলেই ঘৃণার টগবগে লাভা যেনন বাড়ছে। রুশানের সময় লাগলো চারুর এমন রুঢ়রুপ গ্রহণ করতে। যখন অনুভূত হলো তখন নিজের বোধশক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে গেলো। মস্তিষ্ককে দখল করলো আত্মদাম্ভিকতা। নিজের অহমিকার পাঁচিলে কেউ আঘাত করবে তাও এমন তুচ্ছ নারী, সহ্য করতে পারলো না রুশান। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওয়েটিং রুমের টেবিলের কাচের ফুলদানিটা চারুর মাথা বরাবর ছুড়ে মারলো। কিন্তু আক্রমণটা চারুর শরীর ছুঁলো না। তার পূর্বেই তাকে আগলে ধরলো শ্রাবণ। তার পিঠ বরাবর সজোরে ফুলদানিটা লেগে ভেঙ্গে গুড়িয়ে পড়লো মাটিতে। মোটা কাঁচের আঘাতে পিঠ কেটে রক্তে ভিজে গেলো শার্ট এবং কোট। আকস্মিক ঘটনায় স্থবির চোখে তাকিয়ে রইলো চারু। সাথে সাথেই রুশানকে পাকড়াও করলো গার্ডরা। পুলিশে খবর দিলো রিসিপশন। শ্রাবণের সহিংস দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হলো রুশানের উপর। রুশানের মুখখানা রক্তশূণ্য হয়ে গেলো। সেই দৃষ্টি এতটাই ভয়ংকর যে রুশানের ভেতরটাও কেঁপে উঠলো। চারুর সৎবিৎ ফিরতেই সে বিভ্রান্ত স্বরে শুধালো,
“আপনি ঠিক আছেন?”

চারুর কণ্ঠ শুনতেই শ্রাবণের দৃষ্টি নরম হলো। মোলায়েম স্বরে বললো,
“হ্যা, আমি ঠিক আছি”

কিছুই ঠিক নেই। শ্রাবণের পিঠে বিশাল গভীর ক্ষত। ফুলদানিটা খুব ভারী ছিলো। সেটা চারুর মাথায় লাগলে নির্ঘাত সাংঘাতিক কিছু হতে পারতো। পুলিশ রুশানকে ধরে নিয়ে গেলো। চার্জ বসালো, “এটেম্প টু মার্ডার আর হ্যারাসমেন্টের”। শ্রাবণকে নিয়ে চারু হাসপাতালে চলে এলো। মুহূর্তের জন্য তার দুনিয়াটা যেন নিঃস্ব লাগছিল। মনে হচ্ছিলো শ্রাবণের যন্ত্রণায় তার বুক কাঁপছে। হারানোর এই বিশ্রী ভয় তাকে গ্রাস করে ফেললো। কাকে হারানোর? শ্রাবণকে। শ্রাবণবিহীন জীবনকে সে কল্পনাও করতে চায় না। জল্লাদের মধ্যে অনেক ত্রুটি থাকলেও এই জল্লাদটি কেবল তার, এটাই তো তার একমাত্র শান্তি। এই শান্তির জায়গাটা কেউ নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিলে সে তো আমার সেই খড়কুটোর মতো হয়ে যাবে। তার জীবনে কোনো রঙ, আশা থাকবে না। চারু কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শ্রাবণ তার অশ্রু দেখছে। চারুর এই অশ্রুসিক্ত মুখখানা এতোটা লাবণ্যময়ী কেন? এই অশ্রু তার জন্য বলে। গাঢ় স্বরে বললো,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে চারুলতা”

***

শ্রাবণকে বেড রেস্ট দেওয়া হয়েছে। সে বাসাতেই আছে। চারুও অফিসে যাচ্ছে না। কাজগুলো সব ঘর থেকেই সে সামলে নিচ্ছে। ক্লাইন্টের সাথে মিটিং, রিপোর্ট সবকিছুই তার দখলে। প্রজেক্টের কাজেও কোনো ত্রুটি রাখছে না। শ্রাবণ মুগ্ধ চোখে তাকে দেখছে। কাজে মগ্ন চারুকে বেশি লাবণ্যময়ী লাগে নাকি কান্নারত চারুকে? নাকি রাগে রক্তিম চারুকে? নাকি তার স্পর্শে লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া চারুকে? শ্রাবণ নির্ধারণ করতে পারলো না। তবে সে জানে তার চারুলতার থেকে সুন্দরী নারী পৃথিবীতে নেই।

বিকেলে স্যুপ এনে দেখা গেলো শ্রাবণ গভীর ঘুমে। পেইন কমানো ঔষধ দিয়েছে শ্রাবণকে। শরীরটা তাই দূর্বল। যখন তখন সে ঘুমিয়ে পড়ে। স্টিচের জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলেছে ডাক্তার। ইনফেকশন হলেই ঝামেলা। সকালে একবার করেছে অবশ্য। এখন আরেকবার করে কাপড় বদলে দিতে হবে। কিন্তু ডাকতে ইচ্ছে করেছে না শ্রাবণকে। বিকেলের মায়া রোদ এসে পড়ছে শ্রাবণের শ্যাম মুখে। পুরুষ মানুষের মধ্যে এতো আকর্ষণ কেন লুকিয়ে রাখবে স্রষ্টা? চারু অনুভব করলো সে চোখ সরাতে পারছে না। আকর্ষণ নাকি প্রেম? আলাদা করতে পারলো না চারু। তবে এটুকু বুঝলো তার স্বামীর থেকে মুগ্ধকর পুরুষ পৃথিবীতে নেই। এই মানুষটাকে হারালে চারু বাঁচতো কি করে? শ্রাবণের মাথার কাছটায় ঝুকে কপালের চুল গুলো সরিয়ে চুমু খেলো হুট করে। সে সাথে তার চোখ ভিজে এলো। সেই অশ্রুর স্পর্শ গালে পেতেই চোখ মেললো শ্রাবণ। উদ্ভ্রান্ত স্বরে শুধালো,
“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”

চারু উত্তর দিতে পারলো না। শ্রাবণকে একপ্রকার জড়িয়ে ধরলো সে। শ্রাবণও তাকে আগলে ধরলো। কান্নায় ভেজা মুখখানায় অজস্র চুমু আঁকলো। তার স্পর্শ ঘন হতে লাগলো। চারুও বাঁধা দিলো না। আসলে সে পারলো না। সেও যেন শ্রাবণের ভালোবাসার স্রোতে ভাসতে চায়। শ্রাবণ খুব ধীরে বললো,
“তোমার এই কান্নারত ভঙ্গুর অবস্থা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে চারুলতা, আমার তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে নিজের মধ্যে মিশিয়ে ফেলতে। তুমি আমার কাছে অথচ আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছে নেই। তোমাকে আরোও গভীরভাবে পেতে ইচ্ছে করছে। আমার করে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে”

শ্রাবণের উন্মাদনায় সাড়া দিলো যেন চারু। ভেতরের অবাধ্য ইচ্ছেগুলোকে ছাড়া দিয়ে বললো,
“আমি আপনাকে বোধ হয় ভালোবেসেছি, জল্লাদ”

শ্রাবণ গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে। শিরদাঁড়া বেয়ে যেন উষ্ণ রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। ঠোঁটে অহংকারী হাসি উন্মোচিত হলো,
চারুলতা শুধুই তার।

***

আজ সকালটা হলো খুব আয়েশ করে। মিষ্টি কিছু স্মৃতিকে পুঞ্জিভূত করে ঘুম ভাঙ্গলো চারুর। সারাদেহ জুড়ে শ্রাবণের স্পর্শ। শ্রাবণ তখন ঘুমিয়ে। একপলক তাকে দেখে উঠে পড়লো চারু। বারান্দার ঝুলন্ত গাছে একটা অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। কাঁচা রোদে স্নান করে সেটাকে প্রচন্ড স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। হাত মুখ ধুয়ে, গোসল সেরে নিজের জন্য এক কাপ চা বানালো চারু। সাথী খালা কাজ করছেন। আজকে খিঁচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। যদিও শ্রাবণ মুখ বাঁকাবে। তার এই বাঙ্গালী খাবার ভালো লাগে না। তারজন্য একটু ফ্রাইড রাইস বানাবে চারু। চাল, ডাল ধুয়ে মশলা দিয়ে খিঁচুড়ি বসালো চারু। এই ফাঁকে একটু স্ক্রল করলো ফেসবুক। তারমধ্যেই একটা পোস্ট সামনে এলো,
“পুলিশের গাড়ি থেকে পালানোর সময় ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করেছেন রুশান ইসলাম”

কিছু সময় স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো চারু। রুশান মারা গেছে? পোস্টে খুব বিস্তারিত কিছু লেখা নেই। শুধু লেখা আছে, আজ রুশানকে কোর্টে চালান করার সময় সে পালানোর চেষ্টা করে। তখন অসাবধানতায় দূর্ঘটনার শিকার হয়। জায়গায় মৃত্যু। এতোটা বাজে মৃত্যু রুশানের ভাগ্যে থাকবে ভাবে নি চারু। ঘৃণা, রাগ জীবিত মানুষের উপর থাকে। মৃত মানুষের প্রতি থাকে কেবল আফসোস। রুশানের ভাগ্যটাই হয়তো খারাপ। রুশানের মা মাঝে এসেছিলেন। ছেলের হয়ে অনুরোধ করতে। শ্রাবণ বেশ বাজে ভাবে তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে। তার জন্যও আফসোস হচ্ছে চারুর। ছেলেকে তিনি ভালো অবস্থানে দেখতে চেয়েছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললো চারুর। চা টা খাওয়া হয় নি। ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা চায়ের থেকে অখাদ্য কিছু নেই। গরম করলে সেই অনুভূতিটা থাকবে না। তাই ফেলে দিলো চা টা। এমন সময় ডাক কানে এলো,
“চারুলতা?”

চারুর ঠোঁটে উঁকি দিলো হাসি। ছুটে গেলো সে। শ্রাবণ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি এভাবে না বলে চলে আসবে না তো”
“ঘুমাচ্ছিলেন তো জ্বালাতে ইচ্ছে হল না”

শ্রাবণ হাতের বাঁধন শক্ত করলো। সাথী খালা আছে অথচ তার কোনো ভাবাবেগ নেই। চারু তাগিদা দিয়ে বললো,
“আপনার কফি আর টোস্ট রেডি। খাবেন, চলুন। আর আজ কিন্তু আমরা ডাক্তারের কাছে যাব, মনে আছে?”

কথা শেষ হতে না হতেই শ্রাবণের ফোন ভাইব্রেট করলো। শ্রাবণ একবার দেখলো। অচেনা নম্বর। শ্রাবণ প্রথমে ধরলো না। সে এখন চারুর সাথে ব্যস্ত। কাজের ফোন এখন ধরবে না সে। ফোনটা আবার বাজলো। তিনবারের বেলায় চারুই বললো,
“ধরুন না, জরুরি কিছু হতে পারে। সামনের সপ্তাহে আমাদের প্রজেক্ট ইনোগ্রেশন”

ফলে বাধ্য হয়েই ধরলো শ্রাবণ। ওপাশ থেকে অচেনা একটি নারী স্বর শুনতে পেলো,
“শ্রাবণ স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন?”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি