চিত্তে অঙ্কিত কৃষ্ণরেখা পর্ব-১১+১২+১৩

0
1349

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১১|
#ফাহমিদা_নূর

–“ দাভাই তুমি?
তার চোখের আশ্চর্যের রেশ।

চোখের গগলস হাতে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় শ্রেয়াণ শুধায় –“ কেনো?আমি কি এখানে আসতে পারি না?

–“ গত একবছরের কর্মজীবনে কখনো তো বোনের খুঁজে এখানে আসোনি!আজ হঠাৎ কী মনে করে?

–“ নাক বুঁচা মেয়ে একটা,তোর খুঁজে আসতে যাবো কেনো?প্লেতে নেহমাত নামের একজন আছে তার কাছে নিয়ে চল!

নাক বুঁচা নামটা শুনেই কটমট দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রেয়া।মানে কী এটার?নাকটা একটু বুঁচা টাইপ বলে যত্রতত্র বলে বেড়াবে?তবে এটা ভেবে আমার খুশি লাগলো কতোদিন পর ভাই তাকে এই নামে ডাকলো!প্রথা চলে যাওয়ার পর শ্রেয়াণ কেমন একরোখা, গম্ভীর হয়ে গেছিলো। প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি কথাই মুখ থেকে বেরই করতো না।

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়ে ছোট ছোট চোখে পারিপার্শ্বিক অবস্থা অবলোকন করে নেয় কৌশলে।নাহ, এখানে তেমন কেউ নেই।যে দুয়েক জন আছে তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত।তা দেখেই ধরাম করে শ্রেয়াণের বাহুতে হাত মুঠো করে ঘুষি লাগিয়ে দেয় শ্রেয়া।মুখে বলে–“ নাক বুঁচা কাকে বলো?কোন আইডিয়া আছে তোমার বোন কে এই নাক দেখেই ক’জন ভালোবাসার প্রস্তাব দেয় দিনে?

শ্রেয়াণের দৃষ্টি সরু অথচ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।বরং শ্রেয়ার হাত ধরে সম্মুখে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে-“ নেহমাতের ক্লাসে নিয়ে চল!

শ্রেয়া পায়ে পা মেলাতে মেলাতে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে-“ নেহমাত?নামটা যেনো কোথাও শুনেছি!ওহ হে, সেদিন ওই বাচ্চা বুড়িটাই তো বলেছিল আমাকে তার ফিফিনের মতো দেখতে! কিন্তু ভালো ভাবে ব্যাপার টা জানার আগেই প্রিন্সিপাল সুনয়না সবাইকে অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিল।আমিও আর এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিনি। কিন্তু তোমার তার সাথে কী দরকার?ও কে?

–“ এ্যাঁই তোমার বসের জন্য আর কতোক্ষণ অপেক্ষা করবো, হ্যাঁ?কি ভেবেছেন ওনি?তার সাথে মিটিং এ্যাটেন্ড করা ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ নেই?ম্যানার্সলেস লোক একটা!

আফিফ অসহায় মুখে প্রথার সব কথা হজম করে নিল। মিনমিনে গলায় উত্তর দিল–“ আর একটু অপেক্ষা করুন ম্যাম।বস এখনি এসে পড়বে।

–“ এখনি এসে পড়বে,এখনি এসে পড়বে বলতে বলতে পুরো আধাঘণ্টা ওয়েস্ট করেছো তুমি!আর একবার যদি শব্দ টা মুখ দিয়ে বের করেছো,গলা চেপে দেবো তোমার!

চেহারায় অত্যন্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে বলে প্রথা।পাশেই আদওয়া দাঁড়িয়ে আছে থমথমে, বিষন্ন প্রতিমায়।তারা বর্তমানে শ্রেয়াণের কেবিনে অবস্থান করছে।

ঠোঁটে আঙুল সেঁটে চুপসে যায় আফিফ।জানের‌ ভয় সবারই আছে।প্রথা যদি‌ সত্যিই গলা চেপে দেয় তখন তো শ্বাস রোধ হয়ে মারাও যেতে পারে সে।ঔ মুহূর্তে কে বাঁচাবে তাকে?তার চেয়ে চুপ থাকায় মঙ্গল।

–“ তুমি একটা ইঁচড়্যে পাকা মেয়ে,আমি তোমায় সাথ্যে কথা বলবো না!
বেঞ্চের মাঝখান থেকে কিছুটা বা দিকে ঘঁষে গিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল ফিহা।তা দেখে নেহমাত তার দিকে আরো চেপে বসে বলে-“ তুমি একটা শান্ত আর কুট্টুসি মেয়ে তাই আমি তোমার সাথেই কথা বলবো!

–“ আবার তুমি আমাকে নকল করেছো?সরো এই বেঞ্চ থেকে,তুমি আমার সাথে বসবে না!
–“ আমি তোমার সাথেই বসবো আর ফ্রেন্ডশিপ ও করবো!
–“ একদম নাহ!আমি এই বেঞ্চেই বসবো না।বলে ফিহা ব্যাগ নিয়ে পেছনের বেঞ্চে চলে যায়।তার পিছু নেহমাতও গিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে–“ তুমি সেখানে যাবে আমিও সেখানেই যাবো!

ফুঁসে উঠে ফিহা। কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় নেহমাতের পানে।সে কিছুতেই এই ইঁচড়ে পাকা মেয়ের সাথে বসতে চায়না।অবশ্য নেহমাত ও আগ্রহ দেখাতো না যদি ফিহা তাকে দেখা মাত্র বলে না উঠতে –“ তুমি এই বেঞ্চে একদম বসবে না!

নেহমাত মাত্রই রাউনাফ আঙ্কেলকে বিদায় দিয়ে ক্লাসে ঢুকেছিল।ফিহা তখন বসেছিল দ্বিতীয় বেঞ্চে।সেই বেঞ্চ ক্রস করে যাওয়ার পথেই শুনতে পেলো ফিহার কথা।নেহমাতের আবার নিষেধে আসক্তি বেশী, তাছাড়া মানুষ কে রাগীয়ে দিতে তার ভালোই লাগে।ফিহাকে তার পাশে বসতে নিষেধ করতে দেখে বাঁকা হেসে–“ আমি তো আজ এখানেই বসবো!বলে বসে গেল তার পাশে।সেই থেকে দুজন দুষ্টু মিষ্টি তর্ক করছে আর বেঞ্চ পাল্টাচ্ছে।

ভাইকে নিয়ে শ্রেয়া তাদের ক্লাসে ঢুকে। একাধিক বাচ্চাদের মাঝে শ্রেয়াণের চোখ জোড়া কাঙ্ক্ষিতজন কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অস্থির, আকুল দৃষ্টি পুরো কক্ষ অবলোকনের মাঝে শেষ বেঞ্চের দিকে নজর যায়। প্রসস্থ হয়ে আসে তার নেত্র। বিস্তির্ণ হয়ে আসে ঠোঁট।প্রশান্তি, আনন্দরা হৃদয়ের কুল যেনো গ্রাস করছে তার।এতো সুখানুভূতি হচ্ছে কেনো তাকে দেখে?তার রক্ত বলে?

–“ কাকাই তুমি!
শ্রেয়াণ কে দেখে প্রফুল্ল চিত্তে বলে উঠে ফিহা। অমায়িক হাসল শ্রেয়াণ।ফিহার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর দিয়ে নেহমাতের দিকে তাকায় তৃষ্ণার্ত চোখে।শ্রেয়াও চেয়ে রয় তার দিকে।কে য়ে?যার জন্য তার ভাই অফিসের মিটিং ওয়েটিঙে রেখে দেখা করতে এসেছে? তখনও জানতে চাইলেও জবাব দেয়নি শ্রেয়াণ।

বড়ো বড়ো দুজন মানুষের আঁখি যোগল তার দিকে নিবদ্ধ দেখে গালে হাত রেখে চোখ ছোট ছোট করে গভীর নয়নে তাকায় নেহমাত।

–“ ফিফিন জানো এই ইঁচড়ে পাকা মেয়েটা আমাকে খুউব জ্বালাচ্ছে!
আশপাশ একবার চোখ ঘুরিয়ে নেহমাতের দিকে স’ন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলে উঠল –“ এখানে কোন স্বজনপ্রীতি চলবে না!

হা করে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রয় শ্রেয়া।অবাকের রেশ ধরে রেখে পাশে তাকায়। যদিও নেহমাতের কথায় শ্রেয়াণের নিজেরও তার মতোই অবস্থা তবে তা মুখে ফুটিয়ে না তুলে স্বাভাবিক ভাবে তাকালো নেহমাতের দিকে। আপাতত তার চাওয়া নেহমাতের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা, কিন্তু কিভাবে কী শুরু করবে বুঝতে পারছে না।সে কখনো বাচ্চাদের সাথে তেমন একটা মিশেনি।ফাইজা,ফিহার সাথে যা হয় তা ই।

–“ স্বজনপ্রীতি মতলব?
থমথমে গলায় জানতে চাইলো শ্রেয়া।নেহমাত বিজ্ঞদের মতো উত্তর দেয়–“ আপনাকে যেহেতু কুট্টুসি মেয়ে ফিফিন ডেকেই বিচার দিয়েছে তার মানে ও আপনার পরিচিত। এখন যদি আপনি ওর হয়ে বিচার করেন,তাকে বলা হবে স্বজনপ্রীতি।ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?

দুদিকে মাথা দুলিয়ে ছোট স্বরে –“ ক্লিয়ার।শব্দটা উচ্চারণ করে অদৃশ্যে তাকিয়ে রয় শ্রেয়া।কেনো যানি ফিহার মতো তারও একবার ডাকতে ইচ্ছে করছে ইঁচড়ে পাকা মেয়ে বলে।

শ্রেয়াণ চোখের ইশারায় কী যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে।ক্ষণকাল পর তা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়ে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়।নেহমাত কে উদ্দেশ্যে করে বলে–“ নেহমাত!উনি হচ্ছে ফিহা আই মিন কি যেনো বললে, কুট্টুসি মেয়ে?তার কাকাই!

শ্রেয়াণ অস্থির গলায় বলে–“ এখন তো ক্লাস নেই চলো আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে পরিচিত হই?

জহুরি দৃষ্টিতে শ্রেয়াণের উপর নিচ পর্যবেক্ষণ করে নেহমাত হাত ঝাঁকিয়ে শুধায় –“ ও হ্যালো মিস্টার! অপরিচিত কারো সাথে যাওয়া ব্যাড ম্যানার্স!এতো বড় হয়েও তুমি সেটা জানো না?নাকি শুধু গায়ে পিঠেই বড়ো হয়েছো?

শ্রেয়াণের চোখে অদ্ভুত এক দ্যুতি ছড়াচ্ছে।অধর কোণে কোমল হাসি।বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উষ্ণতা আর তীব্র আবেগ খেলা করছে তার।মনে হচ্ছে যেন বুকটা ভালোবাসায়, সুখানুভূতি আর বিস্ময়ে ফেটে যাবে এখুনি।সে চিত্তাকর্ষক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।তার প্রতিটি বাক্য যেনো মন্ত্রের ন্যায় কর্ণে বিঁধছে। আফসোস হচ্ছে,আরো আগে যদি তার দেখা পেতো?তাকে ছুঁতে পারতো?তাকে যদি বক্ষে জড়িয়ে রাখতে পারতো?
অন্যদিকে শ্রেয়া এখনো ঘোরে আছে নেহমাতের কথায়। কোন বাচ্চা যে এতোটাও পন্ডিত হতে পারে তার জানা ছিল না পূর্বে। হতবুদ্ধি হয়ে কিঞ্চিৎ শ্রেয়াণের দিকে হেলে বলে–“ দাভাই?কার সাথে দেখা করতে এসেছো তুমি?এ-তো সাক্ষাৎ ধানী ল’ঙ্কা!

–“ তোর মনে হচ্ছে না,ও কোথাও না কোথাও আমার কতো দেখতে?
–“ হঠাৎ এ কথা বলছো যে?
পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে জানতে চাইলো শ্রেয়া।শ্রেয়াণ বিনিময়ে চোখের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলল। মাথা কাত করে সম্মতি দিয়ে শ্রেয়া দু পা সরে আসে।

গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নেয় শ্রেয়াণ।নেহমাতের পাশে বেঞ্চে বসতে বসতে বলে–“ অপরিচিত কোথায়?মিস. তো বলেছে আমি তোমার ফ্রেন্ড ফিহার কাকাই!
–“ কিন্তু ওতো আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চায়না!
–“ কে বলেছে করতে চায়না? অবশ্যই করবে!

পরপরই ফিহার উদ্দেশ্য বলে –“ কী,করবে না ফিহা নেহমাতের সাথে ফ্রেন্ডশিপ?

গাল‌ ফুলিয়ে বসেছিল ফিহা।কাকাই য়ের কথায় ছোট ফিহাও বুঝতে পারছে তাকে ফ্রেন্ডশিপে হ্যাঁ বোধক শব্দ ব্যবহার করতে ইঙ্গিত দিচ্ছে। ইঙ্গিত পেয়ে স্বস্তি পেলো বোধহয় ফিহা।হাসল মন খুলে।যার অর্থ সে করবে ফ্রেন্ডশিপ!

বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত ধুকপুকানি হচ্ছে আনন্দে, বিস্ময়ে আর উত্তেজনায়।শ্রেয়াণের মনে হচ্ছে যেন নিজের হৃদয়ের এক টুকরো সামনে বসে আছে তার। যে দু’পায়ে হাঁটছে,হাত নাড়িয়ে মুখের অবয়ব বিভিন্ন ভঙ্গিতে করে কথা বলছে।আর শ্রেয়াণ একদৃষ্টিতে তার মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে।বুকের ভেতর এক গভীর ভালোবাসার ঢেউ খেলে যাচ্ছে,যা এতটাই শক্তিশালী যে চোখে জল আসতে চাইছে বারংবার।বাবা হওয়ার অনুভূতি সত্যিই ভয়ঙ্কর।এই অনুভূতি একদিকে যেমন কোমল, তেমনি শক্তিশালী। এই মুহূর্তে একজন বাবা হয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে শ্রেয়াণ –“এই ছোট্ট প্রাণটা আমার, আমি তাকে আর হারাতে দেবো না! খুব শিঘ্রই নিজের কাছে নিয়ে আসবো সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে। তবে তার আগে ঔ জে.কে কে খুঁজে বের করতে হবে! মৃ!ত্যু দিতে হবে নির্ম!ম!

–“ আচ্ছা,আমি তোমায় কি বলে ডাকবো?

প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে জানতে চাইলো নেহমাত।ঘোর কাটে শ্রেয়াণের। পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সম্মুখে।তারা এখন ক্যানটিনের একটি গোল টেবিলে বসে আছে।সাথে ফিহা কেও এনেছে।শ্রেয়া ক্লাস টিচার কে বলে কয়ে দুজন কে শ্রেয়াণের সাথে আসতে দেয়ার অনুমতি নিয়েছে।

–“ তোমার যা ইচ্ছে!

গালে হাত দিয়ে উমম_ শব্দ করে কী যেন ভাবে নেহমাত।বলে–“আমরা তো এখন ফ্রেন্ড তাই আঙ্কেল ডাকা যাবে না!তাহলে কি ডাকবোও..উমম নাম ধরেই ডাকবো! এবার বলো তোমার নাম কি?

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হতাশার দৃষ্টিতে তাকায় শ্রেয়াণ।বাহ,বাবাকে মেয়ে নাম ধরে ডাকবে! ব্যপারটা খুব ভালো। কিন্তু আগে জানতে নেহমাত তার বাবার নাম জানে কী না?প্রথা কে তো বলেই দিয়েছে যতদিন না সে জানাবে ততদিন শ্রেয়াণ কিছু ই বলবে না মেয়েকে। কৌশলে শ্রেয়াণ বলল–“ তুমি কি শ্রেয়াণ নামটা কখনো শুনেছো?

চোখ বন্ধ করে মস্তিষ্কে বিচরণ করলো নেহমাত।মনে করার চেষ্টা করে শ্রেয়াণ নামটা পূর্বে কখনো শুনেছে কি না!বিচরণ শেষে চোখ মেলে বলে–“ না তো?এই নামটা কখনো শুনিনি!এটা কার নাম? তোমার?

মুখটা কিঞ্চিৎ মলিন হয়ে আসে শ্রেয়াণের।খানিকটা অভিমান ভার করলো প্রথার জন্য।বাবাকে নাহয় পরিচয় করিয়ে দিতে বিবেকে বেঁধেছিল কিন্তু নামটাও তো অন্তত জানাতে পারতো?পরপরই আবার মনকে শুধরে দেয়,হয়তো প্রথা যা করেছে ভালোই করেছে!তার জায়গায় যে কেউ থাকলে নিশ্চয়ই এটাই করতো।ফুঁস করে শ্বাস ফেলে বলে–“ হুঁ! আমার নাম শ্রেয়াণ।শ্রেয়াণ জাওয়ান!

–“ ওয়াও কিউট নেম,আজ থেকে তোমায় এই নামেই ডাকবো!
–“ ওকে,কিউট আম্মাজান!

খিলখিল করে হেসে উঠলো ফিহা। আম্মাজান নামটা তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে।
–“ তোমাকে কাকাই আম্মাজান ডেকেছে।
–“ তুমিও তো আমার আম্মাজান!
ফিহার গাল টিপে দিয়ে বলে শ্রেয়াণ। তখনই বারো বারের মতো শ্রেয়াণের ফোন ভাইব্রেশন দিয়ে উঠে।অনিহা সত্তেও দাঁতে দাঁত চেপে ফোন কানে ধরে , টেবিল ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে আসে।রুক্ষ কন্ঠে হিসহিসিয়ে বলে–“ আফিফের বাচ্চা,বার বার কল কে টে দেয়ার পরো কল করার অনুমতি কে দিয়েছে?আমি?

–“ স্যরি বস! কিন্তু ম্যাম তো চরম লেভেলের ক্ষেপেছেন!

–“ এইটুকুর জন্য আমাকে বিরক্ত করছিলে?আর কতক্ষণের জন্য কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে নাও!

ওপাশ থেকে আফিফের গলার স্বর আসলো না বরং একটা তীব্র আক্রোশ মিশ্রিত কন্ঠ ভেসে এলো–“ এই যে মিস্টার শ্রেয়াণ জাওয়ান!কী ভাবেন নিজেকে?প্রাইম মিনিস্টার নাকি প্রেসিডেন্ট?

কপাল কুঁচকে কান থেকে ফোন সরিয়ে সামনে এনে ফের কানে তুলে শ্রেয়াণ–“ আজব!আমি কেন নিজেকে প্রাইম মিনিস্টার বা প্রেসিডেন্ট ভাবতে যাবো!

–“তাহলে আমাদের কী মনে করেন? মিটিং সময় পেরিয়েছে এক ঘন্টা আগে! অথচ আপনি এখানো অনুপস্থিত!

–“ আ আমি?
–“ হ্যাঁ আপনি?
–“ আ মি?

দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে রক্ত চক্ষু নিয়ে আফিফের দিকে চাইলো প্রথা। এখন শ্রেয়াণ বদলে এর মাথায় ফোন টা আছাড় মেরে ভাঙতে ইচ্ছে করছে। দাঁতে দাঁত চেপে যতটা টেনে টেনে ব্যঙ্গ করা যায় ঠিক তেমন করেই বলল-“ জী আপনি কোথায় অবস্থান করছেন, অনুগ্রহ করে বলা যাবে কী! যদিও সেটা আপনার ব্যাক্তিগত..

সত্যিটা বলতে চেয়েও থেমে যায় শ্রেয়াণ।নাহ,মেয়ের মনে জায়গা না নেয়া অব্ধি মাকে কিছুই বলা যাবে না।দেখা গেলো মেয়েকে হারানোর ভয়ে আবারো কোথাও গায়ের হয়ে গেলো।শ্রেয়াণ একবার হারিয়েছে তাদের। দ্বিতীয় বার পেয়েও হারালে নিঃস্ব হয়ে যাবে সে। বেঁচে থাকার কোন কারণ ই অবশিষ্ট থাকবে না!

–“ আ আমি এক জন কে র্ রক্তদান করতে এসেছি! ইমার্জেন্সি।ইউ নোউ রক্তদান বড়ো হৃদয়বানের কাজ।তুমি যদি চাও আমি এখনি সব ছে ড়ে ছু ড়ে মিটিং এ্যাটেন্ড করতে পারি!কি বলো আসবো?

মুহূর্তেই বুঝি নেতিয়ে এলো প্রথার রাগত মুখখানি। জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে একবার আদওয়া পরপর আফিফের দিকে তাকায়।গলা খাঁকারি দিয়ে বলে –“ ঠিক আছে,দায়িত্ব শেষ করেই আসুন। অপেক্ষা করছি আমরা!
কথা শেষে অদৃশ্যে তাকিয়ে আফিফের মুখের উপর ফোন তুলে ধরে।অবাক না হয়ে পারেনা বেচারা।একটু আগের জলন্ত অগ্নিশিখা মুহূর্তেই কিভাবে নিভে গেল? ওপাশ থেকে কী এমন বাণী শুনালো তার বস?

–“ স্যরি প্রাণ!একটু মিথ্যা বলতে হলো।
ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে কথাটি বলে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় শ্রেয়াণ।ফিহা নেহমাত দুজন নিজেদের মধ্যে কী যেন আলাপ করছে। আনমনেই ঠোঁটর কোণে হাসির রেখা খেলে যায় তার।

সময় এখন দুপুর দুইটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট।রোদ্দুরের তেজ এই সময় একটু বেশীই থাকে।স্কুল থেকে ফিরছে নেহমাত।এসির মধ্যেও ঘামছে যেনো।তাকে নিতে গিয়েছিল রাউনাফ।

নিউইয়র্কে থাকা কালিন এখানের স্কুলে ভর্তির সব ব্যবস্থায় করে ফেলেছিল অনলাইনের মাধ্যমে।আর এসবে নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে থেকেছে রাউনাফ।নেহমাত কে সেই প্রথম দিন থেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা সবটা সেই করেছে।শুধু আজ নয় বিগত পাঁচ বছর যাবত সাহস যুগিয়েছে প্রথাকে।সবার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যুগিয়েছে প্রেরণা। প্রথা কৃতজ্ঞ তার প্রতি ‌।চরম কৃতজ্ঞ।

–“ মাম্মি!মাম্মি!মাম্মি
বাড়িতে পা রাখতেই অস্থির চিত্তে চেঁচাতে লাগে নেহমাত। মাত্রই ফিরেছে প্রথা।গোসল সেরে সবে বেরিয়েছে বাথরুম ছেড়ে। হলুদ বেগুনি মিশেলে থ্রি পিস পরিধানে।দেখছিল আয়নায়,পরখ করছিল নিজেকে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় লাগছে কি না।এরি মধ্যে নেহমাতের ডাক শুনে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল তার।রাউনাফ ফোনে জানিয়েছিল তারা আসছে।
দুতলা থেকে নিচে ড্রয়িং রুমে এসে দেখে নেহমাত কোমরে দুহাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে প্রথার অপেক্ষায়।প্রথা হাসি মুখে এগিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেয় । চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় সারা মুখে।মেয়েও মাকে আদর ফিরিয়ে দেয় নিঃশব্দে। ড্রয়িং রুম থেকে প্রতাপ চৌধুরী আর রাউনাফ চোখ জুড়িয়ে দৃশ্য টা দেখে স্বস্তির প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে।

–“ কেমন কেটেছে আজকে?
–“ অন্নেক সুন্দর এ্যান্ড স্পেশাল!
–“ স্পেশাল?
–“ হুম!কারণ আজ আমি ফ্রেন্ডশিপ করেছি একজনের সাথে!যে আমায় এত্তো গুলা ভালোবাসা দিয়েছে!
–“ ওলে বাব্বা!কে সে?
রাউধাফ বলল।

নেহমাত তড়িৎ মাথা নেড়ে জবাব দেয়–“ উহুম, এখন বলা যাবে না,সিক্রেট!

–“ ওওওও!আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের নিহাত বেবীর অনেক সিক্রেট থাকে।

বিনিময়ে নেহমাত দুচোখ বুজে নিজস্ব ভঙ্গিতে হাসি দিল।
–“চলো তোমায় চেঞ্জ করিয়ে দিই।
প্রথা মেয়ের ফের চুমু দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগুতেই পেছন থেকে রাউনাফ বলে উঠে –“ প্রথা তোমাকে একটা কথা বলার ছিল!ওকে ফ্রেশ করিয়ে একবার এদিকে এসো!

ক্ষণকাল চেয়ে থেকে স্মিত হাসলো প্রথা ,বলল–“ আসছি।তুমি বাবার পাশে বসো।

প্রথা নেহমাতের সাথে টুকটাক কথা আদান প্রদান করতে করতে কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়,তার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে রাউনাফের শেষ কথাগুলো।কী বলবে সে?

#চলবে ইনশা-আল্লাহ

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১২|
#ফাহমিদা_নূর

প্রথাদের সাথে করেই বিডি এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করেছিল রাউনাফ।যদি কোন প্রয়োজন পড়ে অথবা কোন বিপদ হয়। যেহেতু এখন সবকিছু ঠিকঠাক গতিতে চলছে তাই নিউইয়র্ক ফিরে যাবে কাল সকাল দশটার ফ্লাইটে।এটাই বলতে ডেকেছিল প্রথাকে। সেদেশে তার নিজস্ব বিজনেস আছে।প্রথা অবশ্য এর চেয়ে বেশী কিছু জানে না তার ব্যাপারে।

–“মাম্মি রাউনাফ আঙ্কাল কাল সত্যি সত্যিই চলে যাবে?
বেডে ঠোঁট উল্টে শুয়ে আছে নেহমাত।এক হাতের আঙুলের সাথে অন্যহাতের আঙুল সংঘর্ষ করে খেলছে।আধশোয়া বসে তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলো প্রথা।নেহমাতের বাণীতে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে শুধায় –“ মিথ্যে মিথ্যে কখনো যাওয়া যায়?
–“ আমার খুউব খারাপ লাগছে।মিস করবো অন্নেক!
–“ আঙ্কাল তো বলেছে তোমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করবে প্রতিদিন।
–“ ওও,মাম্মি।ফোনে দেখার চেয়ে বাস্তবে দেখার কত্তো ডিফারেন্স তুমি জানো! বাচ্চা মেয়ে একটা আবার বোকা বোকা ও,জানবে কিভাবে?
মুখ ভেঙ্গায় নেহমাত। চোখ পাকিয়ে স্থির চেয়ে রয় প্রথা। স্বভাব, চরিত্র একদম বাবাকে পাশ কাটিয়ে এসেছে।সব সময় তাকে খুঁচিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা।

–“ কি দেখছো ওমন করে! নজর লেগে গেলে পেট ব্যথা করবে আমার!

মাথা ঝাঁকিয়ে নেহমাতের গায়ে চাদর মুড়িয়ে দেয় প্রথা। চোখের পাতা বুজে দিয়ে বলে–“ হয়েছে আর পন্ডিতি করতে হবে না।রাত অনেক হয়েছে।ঘুমো এখন। স্কুলে যেতে হবে তো!

স্কুলের কথা মনে পড়তেই চোখ থেকে প্রথার হাত সরিয়ে দেয় তড়িৎ–“আমি তো ভুলেই গেছিলাম ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে।

বেড ছাড়তে নিলে প্রথা চেপে ধরে বিছানায়–“ এতো রাতে কোন ফ্রেন্ড জেগে নেই তোমার। শুধু শুধু ডিস্টার্ব করো না।

–“ মাম্মি তুমি হয়তো জানো না, আমার ফ্রেন্ডটা অনে_ক বড়ো।এতো তাতাড়ি ঘুমাবে না।

–“ যেমনি হোক!ঘুমো এখন।

–“ প্লিইজ!ব্যাস একবারই কল দেবো!আমি তাকে বলেছিলাম বাসায় ফিরেই কল দেবো কিন্তু সারাদিন মনেই ছিল না।হয়তো ফ্রেন্ড আমার কলের অপেক্ষায় আছে!
–“ কাজ বাজ নাই,না? তোমার ফ্রেন্ডের?যে ,ফোন স্ক্রিনে চেয়ে থাকবে নিহাতের কলের অপেক্ষায়?

–“ ওহ মাম্মি , ডোন্ট আন্ডার-ইস্টিমেট এ্যানি ম্যান।আমাকে এতোটাও ছোট ভেবোনা,ওকে?

–“ মানলাম , আমার আম্মাজান তুমি। চোখ বুজ এবার!
–“ প্লিজ একবার করি না কল ?

মেয়ের সুশ্রী তে তাকায় প্রথা। চোখ ছোট ছোট করে ঠোঁট চুকা করে অনুমতির আশায় তাকিয়ে আছে। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে নজর ব্যালকনির দিকে দেয়।ক্ষণকাল পর বলে–“ ওকে,

নোট থেকে নাম্বার তুলে কল লাগায়। রিং হতেই কারো ফোন রিংটোন ভেসে আসে কানে।নেহমাত তাকায় মায়ের পানে– ফোন বাজছে কারো? তীর্যক পলকে পুরো কক্ষে নজর বুলায় মা-মেয়ে দুজন।প্রথা উঠে দাঁড়ায় বিছানা ছেড়ে। আওয়াজ টা কেনো যেনো ব্যালকনি থেকে আসছে মনে হলো!

তড়িঘড়ি করে পকেট হাতড়ে ফোন বার করে সাইলেন্ট করে নেয় অনতিবিলম্বে। দাঁতে দাঁত পিষে শ্রেয়াণ। আননোন নাম্বার দেখে মনে মনে অশ্রাব্য গালি দেয় দুয়েক। স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ব্যালকনি সংলগ্ন জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরের পরিবেশ দেখার চেষ্টা করে।–শালার পর্দার জন্য ঠিকমতো দেখাও যাচ্ছে না।বহু চেষ্টায় দেখতে পায় প্রথা ব্যালকনির দিকেই এগিয়ে আসছে। সিধে হয়ে যায় শ্রেয়াণ।কি করবে এবার? এখনই তো প্রথার কাছে ধরা খেয়ে যাবে! খট করে দরজা খুলার আওয়াজ পায়।হুট করে পিঠ পিছে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকানোর ভং করে শ্রেয়াণ। ঘাড় কাত করে একবার আড়চোখে তাকানোর চেষ্টা চালায় পেছনের পরিস্থিতি। ব্যালকনিতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে কেউ পিঠ করে আছে। চেহারা না দেখেই বুঝে যায় প্রথা।খানিক সময় দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে চেয়ে রয়। তারপর দ্রুত পায়ে গিয়ে হুট করেই শ্রেয়াণের বাহু টেনে তার দিকে ফেরায় প্রথা।চোখ বেয়ে ক্রুদ ঝড়ে পড়ছে যেনো।

স্যারেন্ডার করার ন্যায় দুহাত কাধের উপরিভাগে তুলে ধরে শ্রেয়াণ। মুখাবয়ব এমন করেছে যেনো খুব ভয় পেয়ে আছে।ঢং দেখে প্রথার ক্রুদ্ধ হয় দ্বিগুণ। বহিঃপ্রকাশে ছট করে থাবা বসায় শ্রেয়াণের তুলে রাখা হাতে। হিসহিসিয়ে বলে–“ এখানে কী করছেন চোরের মতো?

জ্যাকেটের কলার ঠিক করার অজুহাতে টেনেটুনে দিয়ে হাত মুঠো মুখের সাথে সেঁটে সামান্য গলা খাঁকারি দেয়।প্রথা তখনো তার দিকে চেয়ে ভারি ভারি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।একপল তার দিকে চেয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশ পানে নজর রাখে শ্রেয়াণ। বাঁকা চোখে তাকাতে ভুলে না।

–“ কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে?

এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় শ্রেয়াণ।সাদা টপ্সের সাথে কালো প্লাজু পড়ে আছে রমণী। দৃষ্টি অনড় রেখে পূর্বের কথার জবাব দেয় –“ মেয়েকে দেখতে এসেছিলাম। চোরের লক্ষন কী পেলে?

আঙুল তাক করে প্রথা এগিয়ে এসে কিছু বলবে,ভেতর থেকে নেহমাতের ডাক শুনতে পায়–“ মাম্মি ওখানে এতোক্ষণ কি করছো?কাউকে দেখেছো নাকি?

তেজি নজরে শ্রেয়াণের মুখশ্রীতে চেয়ে জবাব দেয় প্রথা–“ না নাহ,কে আসবে এখানে?তবে চোর টোর আসলেও আসতে পারে,বলা তো যায়না?

–“ কি বলছো তুমি?চৌর এসেছে?
–“ আররে তেমন কিছু না, তোমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলো তুমি!
পরপর শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে কণ্ঠ নামিয়ে বলে–“ সময় থাকতে ফিরে যান,রাগ উঠলে কিন্তু ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবো বলে দিলাম!
–“ আইলা!বলো কী? স্বামীকে খুন করার চিন্তা ভাবনা আছে দেখছি?বউ, এটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। ধর্মে সইবে না!

কক্ষে ঢুকতে যাচ্ছিল প্রথা। শ্রেয়াণের কথা কর্ণে পৌঁছাতেই স্থির দাঁড়িয়ে যায়। স্বামী? তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে ঠিকই কিন্তু ডিভোর্স হয়নি এখনও!স্বামীই তো! ধীরস্থির ঘাড় ঘুরিয়ে একবার শ্রেয়াণের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় প্রথা।।

–“ কার সাথে কথা বলছিলে তুমি?
–“ আরে কেউ না।বাদ দাও, তোমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা হয়েছে?কল তুলেছে?
–“ উহু, লাস্ট বারের মতো দিয়ে দেখি!

ফের একি নাম্বার থেকে কল এলে কিছু কথা শুনিয়ে দেবার মনস্থির করে ফোন কানে তুলে শ্রেয়াণ ‌।তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে অপর প্রান্ত থেকে মৃদু রাগ দেখিয়ে শুরু করে–“ হ্যালো মিস্টার, এতোক্ষণ ফোন তুলছিলে না কেন? ডিস্টার্ব করে ফেললাম নাকি?

কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বার পরখ করে শ্রেয়াণ।সেভ করা নেই,তাহলে এটা কার গলা?শুনেছে শুনেছে মনে হচ্ছে।কানে তুলে ফোন।
–“ কি হলো মিস্টার ফ্রেন্ড?কথা বলছো না কেন?

ক্ষণকাল মৌন রয়ে শ্রেয়াণ বলে–“ নেহমাত?

–“ হুমম, চিনত পেরেছো তাহলে?

ফোন কানে সেঁটে রেখেই দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শ্রেয়াণ।অধর কোণে মৃদু হাসির ঝিলিক। শান্তি শান্তি লাগছে হৃদয়ের কোথাও।তার মেয়ে নিজ থেকেই তাকে কল দিয়েছে।

–“ তুমি কি ব্যস্ত?
–“ কেনো?
–“ কথা বলছো না যে, আমার কন্ঠ ভালো লাগছে না?
–“ তুমি যেমন মিষ্টি তার চেয়েও মিষ্টি তোমার কন্ঠ।ভালো লাগবে না কেনো? আমার তো ইচ্ছে করছে শুধু তোমার কথা শুনেই যাই।তাইতো চুপ করে আছি!
–“ সত্যি?
–“ তিন সত্যি!
–“ ওওওওহো,থ্যাঙ্কিউ মিস্টার! কিন্তু একটা কথা , তুমি মেয়েদের মতো ফিসফিসিয়ে কথা বলছো কেন বলোতো?

বুক ভর্তি শ্বাস টেনে শ্রেয়াণ হতাশার সুরে বলে–“ ফেঁসে আছি একজায়গায়!গলা উঁচু হলে ধোলাই খাওয়ার চান্স বেশী!
–“ বলো কীই?কার এমন সাহস যে তোমায় ধোলাই দেবে?
–“ আছে আছে! তুমি তাকে চিনেও চিনবে না!

গালে হাত ঠেসে মেয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রথা। চোখ দুটো কুঁচকে আছে।
–“ এভাবে চেয়ে তাকার উদ্দেশ্য কী?জানো না কেউ তাকিয়ে থাকলে আমার লজ্জা লজ্জা ফিল হয়।কথা বলতে পারি না!

কপাল কুঞ্চিত হয় প্রথার। ঠোঁট বিস্তির্ণ হয় কিঞ্চিৎ।–“ ওলে আমার লজ্জাবতী ফুল,ভুল হয়েছে আমার।কথা শেষ হলে ফোন দিয়ে দাও, ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে!
–“ এখনি লাগবে?

ভালোবাসা নাকি বলে কয়ে আসে না।হুট করে এসে হৃদ মাজারে গেড়ে বসে অজান্তেই।শ্রেয়া,আনার্সেরও ঠিক এমন কিছুই হয়েছিল! কলেজ করে ফেরার পথে শ্রেয়া প্রায়শই শাহাদের সাথে দেখা করতে হাসপাতালে যেতো।শাহাদের সহকর্মী সাথে গাঢ় বন্ধুত্ব আনার্সের।বন্ধুত্বের খাতিরে সেও টুকটাক হাল চাল জিজ্ঞেস করতো শ্রেয়ার। সেখান থেকে একটু একটু মিশতে মিশতে কখন যে দুজনের মনে একে অপরের জন্য কিছু একটা উপদ্রব হয়েছিল ধরতেই পারেনি।

অনুভূতি চেপে রাখতে নেই।সময় থাকতে তা প্রকাশ না করলে পস্তাতে হবে–তাই, কালবিলম্ব না করে আনার্স একদিন শ্রেয়া কে প্রপোজ করে বসে। ঘটনার আকষ্মিকতায় অকেজো হয়ে গেছিলো শ্রেয়ার মস্তিষ্ক, অনুভূতি।কুল কিনারা না ভেবেই সেদিন পিঠ বাঁচিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে শ্রেয়া।তার এমন প্রতিক্রিয়ার আনার্স ভেবে নিয়েছিল –হয়তো শ্রেয়ার মনে তার জন্য কোনো অনুভূতি তৈরি হয়নি অথবা তাকে পছন্দ নয় পার্টনার হিসেবে।মনে মনে অনুসূচনা হচ্ছিল তার।হয়তো ভুল করে ফেলেছে ভেবে!
দুদিন পর হঠাৎ ই তার কেবিনে আগমন ঘটে শ্রেয়ার। তখন আনার্সের কেবিনে বৃদ্ধা বয়সী রুগীর উপস্থিতি ছিল।অথচ শ্রেয়া তাকে অগ্রাহ্য করে দিকবিদিক না তাকিয়ে সোজা আনার্সের কলার আঁকড়ে ধরে। ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলে–“ ভালোবাসি বলে প্রপোজ করেছেন অথচ দুদিন ধরে লাপাত্তা?এটাই আপনার ভালোবাসার নিদর্শন?

ঘটনা এতো তাড়াতাড়িই ঘটে গেছে যে আনার্স পরিস্থিতি সামাল দিতে ভুলে বসেছিল। কেবল নির্বোধ, বিস্মিত চোখে দেখে যাচ্ছিল শ্রেয়া কে‌।অথচ শ্রেয়া নিরুদ্বেগ।বোধ ফিরতেই কক্ষে নজর হাঁটিয়ে দেখে বৃদ্ধা তাদের দিকে তাকিয়ে মিধিরমিধির হাসছে। সন্তর্পণে কলার ছাড়িয়ে বলে–“ তুমি তো প্রপোজ এক্সেপ্ট ই করোনি, সেখানে ভালো..

–“ যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে–নিরবতা সম্মতির লক্ষণ! আমিও তো সেদিন টু শব্দ করিনি, তাহলে কিসের ভিত্তিতে বলছেন আমি প্রপোজ এক্সেপ্ট করিনি‌।

সেদিন অত্যাধিক পরিমাণে বিস্ময় ভার করেছিল আনার্সের চোখে। পরপরই পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে সামাল দেয়।

সে থেকে চলছে আসছে দুজনের ছুটিয়ে প্রেম।তারা ফোনালাপন করে রোজ,মাঝে মধ্যে দেখাও করে,পার্কে হাঁটে পাশাপাশি অথচ কোন দিন শ্রেয়ার হাত ধরেনি আনার্স।তবে অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতাবশত দুয়েক বার ধরতে হয়েছিল ‌।এই যেমন — শ্রেয়া হাঁটার মাঝে হোঁচট পড়ে যাচ্ছে, তখন আনার্স পাশে থাকলে মুখ থুবড়ে পড়া থেকে তাকে বাঁচায়। অথবা রাগ ভাঙানোর তাগিদে ভুলবশত হাতের উপর হাত চলে যায়।

–“ আমাদের সম্পর্কের সূচনা কিভাবে হয়েছিল তোমার মনে আছে?
ওপাশ থেকে ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ আর ঘুম জড়ানো কন্ঠ ভেসে আসে–“ হুঁ!

–“ তুমি কী ঘুমাচ্ছো?
–“ উুঁ!

আনার্সের বুঝতে বাকি নেই শ্রেয়া ঘুমের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।বুক ভর্তি শ্বাস টেনে ফোন কানে ধরে রেখে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে থাকে।মিষ্টি রঙের আবদ্ধ দেয়ালের কবিনে বসে আছে সে। ডিউটি রাত দুটো পর্যন্ত। এখন বাজে মাত্র বারোটা তিন।

নেহমাত কে ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে কখন যে প্রথার চোখ লেগে গেছে টেরই পায়নি।আচমকা ঘুম হালকা হয়ে আসে তার।ঘাড় চুলকানো সাথে নিয়ে অলস ভঙ্গিমায় চোখ মেলে খানিকটা সময় স্থির চেয়ে রয় অদৃশ্যে। অতঃপর শুয়া থেকে উঠে বসে যেই না নেহমাতের গায়ে চাদর দিতে যাবে তখন ই খেয়াল করে বেডে দুহাত ভাঁজ করে তাতে মুখ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে শ্রেয়াণ। চোখের পাতা বুজে আছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে যতক্ষন হুশে ছিল তার চোখ জোড়া নেহমাতের চেহারাতেই নিবদ্ধ ছিল। ফুঁস করে শ্বাস টেনে ফোন হাতে নেয় প্রথা।রাত দেড়টা প্রায়।

শ্রেয়াণের পাশে বসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডাকে মৃদু স্বরে,যাতে নেহমাতের কানে না পৌঁছায়। প্রতিক্রিয়া মেলে না শ্রেয়াণের।সে নির্দ্বিধায় চোখ বুজে আছে।ফের ডাকে প্রথা–“ শ্রেয়াণ!শ্রেয়াণ!এ্যাই শ্রেয়াণ?

কপালে হাত বুলিয়ে আঁখি বন্ধ রাখে সেকেন্ড কয়েক। আরেকটু নিকটে বসে শ্রেয়াণের বাহু ঝাড়া দিতেই দ্বিতীয় কান্ড বাঁধিয়ে বসে শ্রেয়াণ।বেড ছেড়ে প্রথার গলা আঁকড়ে ঘাড়ে মুখ গুজে দেয়। স্থির হয়ে গেল প্রথা।খেই হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে এক হাতে ঠেস দেয় ফ্রোরে।

এই বুঝি নিঃশ্বাস আটকে এলো প্রথার! শ্রেয়াণের প্রতিটি ভারি নিঃশ্বাসের আঘাতে তার হৃদস্পন্দন ছুটছে এলোমেলো। আন্দোলিত হচ্ছে সর্বাঙ্গে। লোমকূপে কাঁটা দিয়ে উঠছে।জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে সংযত রাখার প্রয়াস চালায় প্রথা।শ্রেয়াণ কে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকে।

জীবন থেকে আরো একটি দিনের ইতি ঘটে নতুন ভোরের সূচনা হয়েছে ধরণীতে।দূর দূরান্ত হতে ভেসে আসা আজানের শব্দে তন্দ্রা ছুটে শ্রেয়াণের। জায়গাটা কেমন শক্ত শক্ত ঠেকছে?আড়মোড়া ভেঙ্গে জোরপূর্বক চোখ মেলে পাশে তাকাতেই চক্ষু অস্বাভাবিক হয়ে যায় তার। চোখ ডলে ফের তাকিয়ে দেখে সত্যিই পাশে প্রথা ঘুমিয়ে আছে তার ডান হাতের উপর। দুজনই ফ্লোরে।ঘাড় বাঁকিয়ে বেডে রাখে দৃষ্টি।মেয়েটাও ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে।বা হাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে রাতের কথা স্মরণ করে– নেহমাতের সাথে ফোনালাপের খানিক পর প্রথা তাকে ঘুমানোর তাড়া দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।যা ব্যালকনি থেকে উঁকি দিয়ে শ্রেয়াণের নজরে ভাসমাউ। একপর্যায়ে মা মেয়ে দুজন চোখ বুজলে শ্রেয়াণ আলগোছে পা ফেলে কক্ষে প্রবেশ করে আশপাশ চেক করে নেয়।–নাহ, দু’জনের চোখ বন্ধ তাছাড়া দ্বোরও লক করা।শ্রেয়াণ বসে যায় মেয়ের সম্মুখে। দুজনের কপালে দু চুমু এঁকে তাকিয়ে থাকে অপলক। কখন যে পাপড়ি লেগে গেলো?

কিন্তু এখন সেসব ভাবার বিষয় নয়।প্রথা যদি চোখ খুলে তাকে দেখতে পায়?কাল নিশ্চই ঘুম থেকে তুলতে চেষ্টার কমতি রাখেনি! এখন তাকে হাতে পেলে চিবিয়ে খেতে দুবার ভাববে না।কী করা যায়?কী করা যায়?

#চলবে ইনশা-আল্লাহ

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১৩|
#ফাহমিদা_নূর

–“মাম্মি তুমি ফ্লোরে ঘুমাচ্ছো ক্যানো? উঠো,উঠোওও!

পিটপিট চোখ মেলে প্রথা। ক্ষণকালের জন্য অদৃশ্যে চেয়ে থেকে হাতের পিঠে চোখ মুছে আধোঁ আধোঁ নজরে সামনে তাকায়।নেহমাত তখনো মায়ের বাহুতে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে যাচ্ছে।

–“ তুমি ফ্লোরে ক্যানো?
–“ উুঁ?
অলস ভঙ্গিতে শব্দচারণ করে মেয়ের দিকে চায় প্রথা।এপাশ ওপাশ নজর ছিটিয়ে নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করে চোখ পাকিয়ে তাকায়।তড়াক করে মস্তিষ্কে হানা দেয় রাতের দৃশ্যপট।শ্রেয়াণ কে জাগাতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষণিকের জন্য চুপ ছিল প্রথা, তারপর কখন চোখের পাতা বুজে এলো? অনুসন্ধানি দৃষ্টিতে ঘরময় চোখ বুলিয়ে মাথা চুলকায় কিঞ্চিৎ।শ্রেয়াণ কোথায়?নেহমাত ওকে দেখে নেয়নি তো?চট করে মেয়ের উদ্দেশ্যে নজর নিক্ষেপ করে? ছোট ছোট আঁখি যোগল মায়ের পানে ন্যস্ত করে রেখেছে বাচ্চাটা।গলা খাঁকারি দেয় প্রথা। ফ্লোর ছেড়ে উঠে নেহমাতের শিয়রে বসতে বসতে বলে–“ কাউকে দেখেছো তুমি?

ফোলা ফোলা চোখে ঠোঁট চুকা করে চেয়ে নেহমাত জিজ্ঞেস করে –“ মাতলাব?

–“ আ্ মানে আমি ছাড়া কেউ ছিল কি রুমে?তুমি দেখেছো কাউকে?
–“ নাতো ,কেউ এসেছিল?
–“ না নাহ কে আসবে? এমনি বলছিলাম আরকি!আজ এই সময়ে ঘুম ভাঙলো যে তোমার?
–“ ওয়াশ রুম!

মাথা নাড়িয়ে প্রথা নেহমাত কে কোলে তুলে ওয়াশ রুমে ছেড়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়ায়।মাথায় বিচরণে আছে শ্রেয়াণের কথা।লোকটা গেলো কোথায়?জাগনা পেয়ে ফিরে গেছে?নাকি অন্যকোথাও..
মনে মনে জপতে জপতে ঘরময় দৃষ্টি ঘুরাচ্ছিল প্রথা। হঠাৎ চোখ সেঁটে যায় কক্ষে অবস্থিত সোফার পেছনের দিকে।মনে হলে সেখানে কেউ হামাগুড়ি দিয়ে আছে।চোখ ডলে ফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে প্রথা।নাহ, এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু মনে খটকা থেকেই যায়,তাই ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেদিক। জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে আস্তে আস্তে সোফায় হাঁটু ভেঙে বসে সোফার তুলিতে হাত রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে বিষ্ময়ে চোয়াল ঝুলিয়ে হা করে থাকে। চোখ দুখানি ঈষৎ বড়ো বড়ো।

তার মুখের আকৃতি দেখে হাসার চেষ্টা করে শ্রেয়াণ। ফ্লোরে হামাগুড়ি দিয়ে বসে শির উঁচু করে হাত নাড়িয়ে বলে–“ গুড মর্নিং!

নিজেকে সংযত করে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো প্রথা। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করে হিসহিসিয়ে বলল–“ আপনি এখানে কি করছেন?
–“ আর বলো না! একটু আগেই ঘুম ভাঙলো।পিছ ফিরে দেখি হিটলার মায়ের কিউটি মেয়েটা নড়েচড়ে উঠছে। যেহেতু হিটলার বলেই দিয়েছে –সে না পরিচয় করে দেয়া অব্ধি মেয়ের সামনে যেনো ভুল করে না বসি।তাই কী আর করার, মেয়ের থেকে পিঠ বাঁচাতে সোফার পিছনে ঠাঁই নিয়েছি।

তার কন্ঠে হতাশ।চোখে অসহায়ত্ব।চোখ রাঙিয়ে তাকায় প্রথা।হাত কিরিমিরি করে শ্রেয়াণের চুল টেনে দিতে হাত বাড়িয়ে ফের গুটিয়ে নেয়।

–” এখন
শব্দটা বড়ো করে বলে চোখ বুজে মাথা ঝাঁকিয়ে কন্ঠ নিচু করে বলে–“ এখন কি করবেন।বসতি করবেন এখানেই?
–“ তো আর কি করবো?
–“ বেরিয়ে যান এক্ষুনি!
কথার মাঝেই নেহমাতের গলা ভেসে আসে।একপল কড়া চোখে শ্রেয়াণের দিকে তাকিয়ে মেয়ের ডাকে সাড়া দেয় প্রথা।

নেহমাত কে বেডে শুইয়ে গায়ে চাদর মেলে দিয়ে ফোন হাতে তুলে।৪:৩৫ বাজে।দূর হতে আজানের সুমধুর সুর ভেসে ভেসে আসছে। তপ্ত শ্বাস নেয় প্রথা।ঘাড় উঁচু করে সোফার দিকে তাকিয়ে শ্রেয়াণ কে উঁকি দিতে থেকে চোখ মুখ কঠিন করে তাকায়।মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলে–“ ঘুমো?

মাকে একহাতে জড়িয়ে বলে–“ হুঁ!তুমি আজ এখানে ছিলে?

–“ কেনো? আমার কি এখানে থাকা নিষেধ?
–“ ফ্লোরে?
–“বে ডে গ্ গরম লাগছিল তাই ফ্লোরে গিয়েছিলাম!ভালোই লেগেছে!
মাথা চুলকিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে জবাব দেয় প্রথা।নেহমাত কিছু পল বোকা বোকা চাহনি দিয়ে চোখ বুজে নিয়ে বলে–“ আজ তাহলে এখানেই থাকো!

জাওয়ান বাড়িতে যাচ্ছে না বেশ কদিন হয়েছে। আগের তুলনায় মন অনেকটা হালকা তাই শ্রেয়াণ ঠিক করেছে আজ রাতের দিকে যাবে।

অফিসে প্রবেশ করতেই একজন এ্যাম্প্লয়ি এসে জানায় ওয়েটিং রুমে তার ছোট বোন শ্রেয়া অপেক্ষা করছে।কথাটি শুনেই কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসে ।নিম্নাষ্ঠ কামড়ে ধরে অল্পক্ষণ ফ্লোরের দিকে চেয়ে থেকে চোখের সামনে হাত উল্টে করে তুলে ধরে শ্রেয়াণ। কব্জিতে কামড়ে থাকা ঘড়ি দেখে নেয় মিটমিট নেত্রে। মাত্র বাজে ছয়টা তেরো মিনিট।এতো সকালে শ্রেয়া কেনো দেখা করতে আসবে? কোন ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়? ঘাড় স্লাইড করতে করতে ওয়েটিং রুমের দিকে হেঁটে যায় শ্রেয়াণ।

–“ মাত্র বাজে ছয়টা,এতো সকালে বাড়ি থেকে বেরুনোর পারমিশন কে দিয়েছে তোকে?

কক্ষে প্রবেশ কালে গম্ভীর গলায় জানতে চাইলো শ্রেয়াণ।তার স্বর শুনতেই অস্থির ভঙ্গিতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শ্রেয়া। দ্রুত কদমে এগিয়ে যেতে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে–“ সেদিন তুমি বলেছিলে,নেহমাত মেয়েটা কোথাও না কোথাও তোমার মতো দেখতে?আর ও-ও বলেছিল আমার চেহারা নাকি তার ফিফিনের মতো! সত্যি করে বলো দামাই,নেহমাতই কি তোমার আর প্রথা বৌ মণির মেয়ে?

কথা শেষ করতে করতে শ্রেয়াণের সম্মুখে পৌঁছে যায় শ্রেয়া। জবাবের আশায় উত পেতে তাকিয়ে রয় ভাইয়ের পানে।

পকেটে দুহাত গুঁজে টানটান ভঙ্গিতে স্থির চেয়ে থাকে শ্রেয়াণ। মুখাবয়ব দেখে বুঝার জো নেই তার মনে কি চলছে। চোখ তার শিতল কিন্তু মুখটায় কাঠিন্য ভাব। শ্রেয়া কাঙ্ক্ষিত জবাব না পেয়ে ফের বলে –“ প্লিজ আমাকে বলো দাভাই? সারারাত তোমাদের কথাগুলো ভেবেছি আমি, তাই বেশী অপেক্ষা করতে না পেরে সকালেই তোমার কাছে জানতে ছুটে এসেছি!

আচানক শ্রেয়াণের ঠোঁটে মৃদু হাঁসির রেখা খেলে গেল। মানুষ যখন নিজের চাহিদার চেয়ে বেশী কিছু পেয়ে প্রাপ্তির হাসি হাসে? তার হাসিতে ও এমন কিছু ছিল। শ্রেয়ার তাই মনে হলো।

–“ হ্যাঁ!ওই মায়া মায়া চোখ, গোলগোল চেয়ারা সমৃদ্ধ মেয়েটাই আমার আর প্রথা থেকে সৃষ্টি। আমার একমাত্র সন্তান! আমার একটা পাঁজর!

শ্রেয়া যেনো এটা শুনারি অপেক্ষায় ছিল।তার চোখে একধরণের দ্যুতি ঝলমল করছে।অধর কোণে হাসি। দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে বিষ্ময়ে। দ্রুত এগিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে–“ সত্যি বলছো?

শ্রেয়াণ হাসলো কেবল।
— “ মা রোজ একবার হলেও তার না দেখা দাদুভাইয়ের জন্য অশ্রু ফেলে।আমি এখন ই মাকে বলবো..
–“ উহু! আপাতত কাউকে জানাবিনা কিছু!
–“ কেনো?

শ্রেয়াণ তাকালো চোখ তুলে ,বলল-“ নিষেধ করেছি তাই!

বিরস মুখে শ্রেয়া সায় দেয়।
–“ বৌ মণির সাথে একবারো দেখা হয়েছে তোমার?
–“ তোর সাথে দেখা হয়নি স্কুলে?
–“ হয়নি তো!

শ্রেয়াণ পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়। সন্দিহান চোখে বলে-“ নেহমাত কে,কে নিতে আসে?
–“ তাকে তো চিনি না। একবার কথা হয়েছিলো।কী জেনো নামম?ও-হে রাউ নাফ ছিল!

শ্রেয়াণ বিড়বিড় করে“রাউনাফ“!কে এই রাউনাফ? তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে দাঁড়াবে নাতো পরবর্তীতে?ফুঁস করে শ্বাস ফেলে বলে–“ না জানার জেনে গেছিস এবার ফিরে যা!আমি আফিফ কে বলে দিচ্ছি তোকে বাসায় পৌঁছে দিতে!

পাঁচ বছর আগেই সেই নাম্বার গুলো ট্রেস করতে গিয়ে বারে বারে অপারগ হয়ে ল্যাপটপে ঘুসি মারতে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে শ্রেয়াণ। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে তার। নাসারন্ধ্র বেয়ে ঘন ঘন ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে।জে.কে নামক ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে এই নাম্বার ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।চেয়ারে গাঁ ভাসিয়ে দেয় দীর্ঘ শ্বাসের সাথে চোখ বুজে ।তাকে চিহ্নিত করার আরো একটা উপায় হলো–তার ভয়েস!শ্রেয়াণ পাঁচ বছর ধরে ফোনের ওই ভয়েস মিলিয়ে এসেছে অনেক নাম্বারের কিন্তু একটাও মিল পায়নি। নাম্বার ট্রেক করা না গেলে একমাত্র ভয়েসের মাধ্যমেই তাকে শনাক্ত করতে হবে!

ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে থাই গ্লাসের দ্বোর খুলার আওয়াজ অনুসরণ করে সম্মুখে তাকায়।প্রথা এসেছে,তার পেছন থেকে –ম্যাম দাঁড়ান, স্যার ব্যাস্ত বলতে বলতে ছুটে আসছে।

শ্রেয়াণ চোখের ইশারায় চলে যেতে বললে আফিফ যে পথে এসেছে সে পথে ফিরে যায়।

প্রথা লম্বা কদমে এগিয়ে আসে।নিজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়াণ।রাগে রিরি করছে প্রথার মুখ,নাকের পাটাতন ফুলে ফুলে উঠছে, ফুঁস ফুঁস শব্দ হচ্ছে নিঃশ্বাসের। ঠোঁট ঠোঁট চেপে সুচালো দৃষ্টিতে উপর নিচ পরখ করে শ্রেয়াণ।নেভি ব্লু আর সাদা মিশেলে থ্রি পিসে সজ্জিত প্রথা।এই রঙটা একটু বেশীই যায় প্রথার জন্য। একদৃষ্টিতে চেয়ে ক্ষণকাল ফুঁস ফুঁস করতে করতে আচমকা হাতে থাকা ফাইল নিয়ে আক্রমণ করে বসে প্রথা।বুকের উপরে এলোপাথাড়ি মা/রতে থাকে একনাগাড়ে–“ চুরের মতো অন্যের বাড়িতে আর ঘুচবেন?একটুর জন্য মেয়ের সামনে পড়েন নি! লজ্জা লাগে না রাত বিরেতে যার তার ঘরে চুরের মতো উঁকি দিতে? লজ্জাহীন নির্লজ্জ পুরুষ!

বাঁধা দেয়না শ্রেয়াণ। কেবল চেয়ে থাকে অপলক।ঔ সুশ্রী তে কী এমন আছে?এতো মায়া কেনো লাগে? ইচ্ছে করে যুগ যুগ ধরে সামনে বসিয়ে শুধু দেখে যেতে, তবুও যেনো চোখর তৃষ্ণা মিটবে না।

আঘাত করতে করতে হাঁপিয়ে গিয়ে থেমে যায় প্রথা।সে থামতেই মৃদু হাসে শ্রেয়াণ।চোখের মণি একবার ডানে পরপর বাঁয়ে ঘুরিয়ে হুট করে প্রথার কোমর আঁকড়ে ধরে নিকটে নিয়ে এসে নজরে নজর রাখে।থ হয়ে যায় প্রথা। আকষ্মিকতায় বিষ্ময়ে হাতের ফাইল ফ্লোরে পড়ে গিয়ে ধাস করে আওয়াজ সৃষ্টি হলো কক্ষজুড়ে।রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে কিছু বলবে,তার আগেই শ্রেয়াণ স্নিগ্ধ গলায় বলে উঠে,

–“ আই লাভ ইউ!
ভাষাহীন হয়ে পড়ে প্রথা। চোখ পাকিয়ে তাকায়, অথচ শ্রেয়াণের চোখ শিতল। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত জবাব দেয় প্রথা–“ গোষ্ঠী কিলাই আপনার লাভের! চরিত্রহীন পুরুষ একটা।মেয়ে দেখলেই ছুঁয়াছুঁয়ি করতে মন চায় তাই না? ছাড়ুন আমাকে।

#চলবে ইনশা-আল্লাহ

|ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। মন্তব্য করতে ভুলবেন না যেন|