#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
||দ্বিতীয় পর্ব ||
[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]
রাত বেশ গভীর। শান্তিনিবাসের বারান্দায় ব্যস্ত পদচারণা করছেন রণজিৎ তালুকদার। যিনি কিনা এই বাড়ির সর্বময় কর্তা। এই মুহূর্তে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও তালুকদার সাহেব ঘুমাতে পারছেন না। তার মাথায় ভিড় করে রয়েছে বিভিন্ন চিন্তা।
রণজিৎ তালুকদার শাসক দলের একজন বিধায়ক। খুব সৎ তাকে বলা যায়না। অবশ্য, বর্তমান সময়ে রাজনীতিতে সৎ মানুষ কয়জনই বা আসে? রাজনীতির পাশাপাশি তালুকদার সাহেব একজন পাকা ব্যবসাদার। চালকল, কাপড়ের ব্যবসা ইত্যাদি আরো অনেক রোজগারের পথ রয়েছে ওনার।
শান্তিনিবাস রণজিৎ তালুকদারের বাসস্থান। সুবিশাল এই প্রাসাদপম বাড়িটি প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো। তবে তালুকদার সাহেব এই বাড়ির অনেক সংস্কার করিয়েছেন। যার ফলে শান্তিনিবাস এই যুগের যেকোনো বিলাসবহুল বাড়ির সাথে টেক্কা দিতে পারে।
এই বাড়িতে রণজিৎ তালুকদার তার আরো তিন ভাই এবং এক বোনের সাথে যৌথভাবে বাস করেন। ভাইবোনদের মধ্যে মেজো হলেও তালুকদার সাহেবই বাড়ির সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ওনার বড় দাদা সব দায়িত্ব ওনার উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।
এখন তালুকদার সাহেবের চিন্তার কারণ হলো একটা বিশেষ দ্রব্য। যা তার হাতে এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। অথচ জিনিসটা কবে তার হাতে আসবে সেই বিষয়েও তিনি নিশ্চিত নন। সব মিলিয়ে, তালুকদার সাহেবের মানসিক অবস্থা একেবারেই ভালো নয়।
____
সন্ধ্যার সময়ে কলকাতার জনবহুল রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে শ্রাবণ। এখন যদিও ও পুলিশের পোশাকে নেই, একজন সাধারণ মানুষের পোশাকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে ও। এভাবে রাস্তায় বেরোনোর কারণ আছে। পুলিশের পোশাকে থাকলে মানুষ এমনিতেই সমীহ করে চলে, সচেতন থাকে ওর সামনে। কিন্তু সাধারণ ভাবে থাকলে সেই ভয় নেই। সবাই ওকে বাকিদের মতোই সাধারণ একজন ভেবে নেয়। ফলে মানুষের গতিবিধি লক্ষ্য করায় সুবিধা হয় শ্রাবণের।
রাস্তার একধারে পশরা সাজিয়ে বসেছে অনেক মানুষ। পথচলতি জনগন কেনাকাটা করছে সেখান থেকে। বিষয়টা এমনিতে স্বাভাবিক হলেও শ্রাবণ বিরক্ত হলো। কারণ ফুটপাথ দখল করে হকার্সদের ব্যবসা করাটা আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু এই বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়না। আর পুলিশ তো সরকারের হাতের পুতুল।
অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পরেও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লো না শ্রাবণের। রাস্তাঘাটে মেয়েদের যে প্রায়শই হেনস্থার শিকার হতে হয় এটা শ্রাবণের ভালোই জানা আছে। সেরকম কিছু চোখের সামনে দেখতে চাইছিলো ও, অন্তত কাউকে তো একটা ধরে শাস্তি দিতে পারতো। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটলো না। সেটা অবশ্য একপক্ষে ভালো।
বাড়ির পথ ধরলো শ্রাবণ। আজ আবার ওর নাইট ডিউটি আছে। বাড়ি ফিরে ইউনিফর্ম পরে নিয়ে আবার থানায় আসতে হবে। পুলিশের চাকরিটাই যে এমন, নির্দিষ্ট কোনো ডিউটি শিডিউল নেই। তাতে অবশ্য শ্রাবণের কোনো কষ্ট নেই। ছোট থেকেই ওর স্বপ্ন ছিল পুলিশ হওয়া। না, পুলিশ সম্পর্কে মানুষের মনে যেমন ধারণা প্রচলিত তেমন পুলিশ নয়, বরং সত্যিকারের মানুষের সেবা করা একজন পুলিশ অফিসার হিসাবেই নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে ও।
বাড়িতে ফিরে পুরো বাড়িটা বেশ শুনশান লাগলো শ্রাবণের কাছে। কেউ কি বাড়ি নেই? বাড়ির সকলের কি একসাথে কোথাও যাওয়ার কথা ছিল? মস্তিষ্কে বেশ চাপ দিয়েও কিছু মনে করতে পারলো না শ্রাবণ। অবশ্য ইদানিং কোথাও যাওয়ার কথা থাকলেও ওকে জানানো হয়না। কারণ বেশির ভাগ জায়গাতেই ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়না।
শ্রাবণের ঘরটা দোতলার এক প্রান্তে। ঘরে যাওয়ার পথেই ও মুখোমুখি হলো ওদের বাড়ির দীর্ঘদিনের কাজের লোক, রত্নাপিসির সঙ্গে। শ্রাবণ জিজ্ঞাসা করলো,
“কি ব্যাপার রত্নাপিসি, বাড়ি এতো শুনশান লাগছে কেন?”
রত্নাপিসি একগাল হাসলেন। এই মানুষটার এটা একটা বৈশিষ্ট্য, বড় সুন্দর হাসতে পারেন তিনি। শ্রাবণের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন,
“সবাই তোমার মামার বাড়ি গিয়েছে গো! ক্যান, তুমি জানো না?”
শ্রাবণও প্রত্যুত্তরে হাসলো সামান্য। তারপর বললো,
“না গো, জানতাম না। আসলে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকি তো, সব সময় সব খবর নেওয়া হয়না।”
রত্নাপিসি আর কিছু বললেন না। শ্রাবণও আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরে আসার পর ওর মনে হলো, একটু স্নান করা প্রয়োজন। একেবারে ঘেমেনেয়ে একশা অবস্থা হয়েছে ওর। এখন সেপ্টেম্বর মাস চলছে। তবে গরমের বহর দেখে মনে হচ্ছে মে মাসের দুপুরবেলা!
শ্রাবণ ওর ঘরের সাথে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকে গেলো স্নান করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নান সেড়ে বেরিয়ে আসলো সে। অতঃপর তৈরী হয়ে নিলো পুলিশের উর্দি গায়ে দিয়ে। কাঁধের কাছে থাকা স্টারগুলোয় একবার হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো শ্রাবণ।
____
ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করছিলো রুশিতা। খাতায় কলমে যদিও এটা বর্ষাকাল নয়, তবুও কয়েকদিন ধরে ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। আর বৃষ্টি হলেই রুশিতার মনটা যেন ময়ূরের মতো নেচে ওঠে। বৃষ্টির জলের প্রতিটা কণার সাথে নিজেকে একাত্ম করতে ব্যাগ্র হয়ে ওঠে ও।
এখনও তেমনই বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে চলে এসেছে ও। মা জানলে যদিও ওর কপালে দুঃখ আছে। তবু, অতো ভাবনা চিন্তা করে কাজ করলে সব সময় চলে না। সুন্দর করে ভিজে নিয়ে সাবধানে মায়ের চোখ এড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেই তো হলো। তাহলেই মা আর কিচ্ছু টের পাবে না।
প্রায় আধঘন্টা ধরে ভেজার পর ছাদ থেকে নেমে আসলো রুশিতা। ততক্ষনে ওর গায়ে হালকা কাঁপুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। ও বেশ ভালোই বুঝতে পারছে যে, আজ রাতে ওর জ্বর আসবে। হালকা পাতলা জ্বর নয়, বেশ ভালোরকম জ্বর। আর সেই জ্বরের কারণটা যখন বাড়ির লোক জানবে, তখন ওর সাথে কি হবে সেটা ভাবতেই কেঁপে উঠলো রুশিতা।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে দোতলায় পা রাখতেই রুশিতা মুখোমুখি হলো শুভ্রার। শুভ্রা ওকে দেখেই ভ্রু কুঁচকালো। প্রচন্ড বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“রুশু, তুই আবার বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিলি?”
রুশিতা আমতা আমতা করলো। এখন যাই উত্তর দিক না কেন, শুভ্রার ঝাড় থেকে ওকে বাঁচানোর ক্ষমতা কারোর নেই। এদিকে উত্তর না পেয়ে শুভ্রা ধমকে উঠলো,
“উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কি সমস্যা?”
রুশিতা মৃদুস্বরে বললো,
“বেশি ভিজিনি শুভ্রাদি।”
শুভ্রা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ঘরে চল এখন।”
বলেই রুশিতার হাতটা ধরলো শুভ্রা। আর তারপরই চমকে উঠে বললো,
“তোর গা গরম রুশু! জ্বর এসে গিয়েছে তো!”
রুশিতা আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,
“মাকে কিছু বোলো না শুভ্রাদি। কাল সকালের মধ্যে জ্বর সেড়ে যাবে, তুমি শুধু মাকে কিছু বোলো না। মা জানলে মেরেই ফেলবে!”
শুভ্রা হতাশ কণ্ঠে বললো,
“তোকে নিয়ে আর পারিনা রুশু! এই বয়সে এমন বাচ্চামো কি মানায়? চল, ঘরে চল। মেজো মামীকে বলতেই হবে, নাহলে আমার ঘাড়ে মাথা থাকবে না। সরি রে, তোকে বাঁচানো সম্ভব হলো না আমার পক্ষে।”
শুভ্রার অকপটে বলা কথা গুলো শুনে অতিশয় অবাক হলো রুশিতা। মাকে জানিয়ে দেবে? না না, এ হতে পারেনা। রুশিতা এতো তাড়াতাড়ি মরতে চায়না! কিন্তু ও একঘন্টা ধরে বৃষ্টিতে ভিজেছে শুনলে মা নির্ঘাত ওকে আরবসাগরে ফেলে দেবেন! অবশ্য, আরব সাগরে ফেলার জন্য মহারাষ্ট্র অবধিই বা যাবেন কেন? কলকাতা থেকে একটু জার্নি করে দীঘা গিয়ে বঙ্গোপসাগরেই ফেলে দেবেন নিশ্চয়ই।
আগডুম বাগডুম ভাবতে ভাবতেই রুশিতার ঘর চলে এলো। ওকে ঘরে এনে প্রথমেই বিছানায় শুইয়ে দিলো শুভ্রা। তারপর ওকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে বলে ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। রুশিতা অবাক হলো। ও নাহয় বৃষ্টিতে ভিজে একটু অন্যায়ই করে ফেলেছে, তাই বলে ওকে একটু ওষুধও দেবে না! একটা প্যারাসিটামল দিলে কি খুব সমস্যা হয়ে যেত? নাহ্, এই বাড়িতে ওর একেবারেই দাম নেই। এর থেকে হিমালয়ে চলে যাওয়াই ভালো। কিন্তু হিমালয়ে কি ফোন চার্জে দেওয়া যাবে? আর ওখানে তো ফুচকা, বিরিয়ানি কিছুই পাওয়া যাবে না। আইসক্রিমটা নাহয় ক্রিম ছাড়া আইস খেয়ে পুষিয়ে নেবে। কিন্তু বাকিগুলো?
ওর ভাবনার মাঝেই ওর মা, সোহিনী দেবী ঘরে এসে ঢুকলেন। তার পিছন পিছন আসলো শুভ্রা আর উর্মি। রুশিতার রাগ ধরলো শুভ্রার উপর। আচ্ছা, তাহলে মার কাছে নালিশ করতে যাওয়া হয়েছিল? ঘর শত্রু বিভীষণ সব!
সোহিনী দেবী এসে রুশিতার কপালে হাত রাখলেন। তারপর শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোয়ালে নিয়ে আয় শুভ্রা। মাথা না মুছিয়েই শুইয়ে দিয়েছিস মেয়েটাকে। মাথায় জল বসে আরও ঠান্ডা লাগবে।”
শুভ্রা তাড়াতাড়ি ছুটলো তোয়ালে আনতে। সোহিনী দেবী এবার রুশিতার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“কোন সাহসে তুমি বৃষ্টির মধ্যে ছাদে গিয়েছিলে?”
সোহিনী দেবী রেগে গেলে রুশিতাকে তুমি করে বলেন। রুশিতা কোনো জবাব দিলো না। এখন উত্তর দেওয়া মানেই আগুনে ঘি ঢালা। তার থেকে চুপ থাকাই ভালো। সোহিনী দেবী আবার বললেন,
“এতো বড় হয়েছো তুমি, বুদ্ধি কি একটুও হলো না এতদিনে? সেধে গিয়ে কেউ জ্বর বাঁধায়? এখন তিনদিন বিছানায় পড়ে থাকবে, কষ্টটা কার হবে শুনি? আমি আর পারিনা তোমায় নিয়ে! হাড় মাস জ্বালিয়ে খেলো!”
রুশিতা করুণ চোখে চেয়ে রইলো মায়ের দিকে। সোহিনী দেবীর কথার মাঝেই শুভ্রা তোয়ালে নিয়ে আসলো। সোহিনী দেবী শুভ্রার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে রুশিতার পাশে বসলেন। তারপর ওর মাথাটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে মাথা মুছিয়ে দিতে শুরু করলেন।
চলবে….