#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| তৃতীয় পর্ব ||
[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]
মল্লিককুঞ্জের সকালবেলাটা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই কাটে। বাড়ির বেশিরভাগ সদস্যেরই সকাল সকাল বাইরে যাওয়ার তাড়া থাকে। তাই আকাশে সূয্যি মামা দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই এই বাড়িতে কাজ শুরু হয়ে যায়।
মল্লিককুঞ্জ হলো শ্রাবণের বাসস্থান। ওদের বংশের পদবি অনুসারেই বাড়ির নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে শ্রাবণের বাবা শেখর মল্লিক এই বাড়ির সর্বময় কর্তা। পেশায় তিনি একজন রাজনীতিবিদ এবং তার সাথে সাথেই ব্যবসায়ী। যদিও বর্তমানে তার ব্যবসা তার ছোটভাই শ্রীনাথ মল্লিকই দেখাশোনা করেন।
শ্রাবণের ভাই প্রিয়ম পড়ে ক্লাস ইলেভেনে। শ্রাবণের থেকে সে অনেকটাই ছোট। শ্রাবণের কাকা শ্রীনাথ মল্লিকের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে নিশিতা পড়ে কলেজে আর ছোট মেয়ে ঈশিতা পড়ে এইটে। ওরা দুজনেই শ্রাবণের ভীষণ ন্যাওটা। শ্রাবণকে ওরা ডাকে দাদাভাই বলে। শ্রাবণ ওদের দুজনকেই ভীষণ স্নেহ করে।
সকাল সকাল জলখাবার খাওয়ার জন্য শ্রাবণ খাওয়ার টেবিলে এসে বসলো। বাকিরা আগেই বসে আছে। ওর তৈরী হয়ে আসতে আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।
শেখর মল্লিক গম্ভীরভাবে তার প্রাতঃরাশ সারছিলেন। শ্রাবণ ঠিক ওনার পাশের চেয়ারটায় এসে বসলো। উনি শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি ব্যাপার শ্রাবণ, তুমি কি নতুন কোনো কেস নিয়ে খুবই ব্যস্ত? আজকাল বাড়িতে তোমায় দেখতেই পাইনা প্রায়।”
শ্রাবণ পাউরুটিতে মাখন মাখাতে মাখাতে বললো,
“যে রেপ কেসটা নিয়ে আলোচনা চলছে বর্তমানে, ওটার দায়িত্ব আমায় দেওয়া হয়েছে বাবা। বুঝতেই পারছো, হাই প্রোফাইল কেস ওটা। তাই স্বীকার করছি যে, আমি ভীষণই ব্যস্ত।”
“ওই কেসটা তুমি হ্যান্ডেল করছো? অত্যন্ত রহস্যজনক বিষয়টা। তোমার আগে যারা হ্যান্ডেল করছিলো তারা তো কিছুই করতে পারলো না। আশা করি তুমি মামলার নিস্পত্তি করতে পারবে আর অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারবে।”
“আমিও তাই আশা রাখছি বাবা। কিন্তু কেসটা দিনে দিনে এতোই কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে যে, আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ বিভাগের কেউ অপরাধীর সঙ্গে জড়িত আছে বলে আমার সন্দেহ হচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যেই অনেক প্রমাণ লোপাট হয়েছে। ফরেন্সিক টেস্টগুলোর রিপোর্ট ঠিকঠাক নেই। মেয়েগুলোর দেহের ময়নাতদন্ত করা হয়নি সঠিকভাবে। সব মিলিয়ে বিষয়টা অত্যন্ত জটিল।”
“বুঝতে পারছি। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করো, তুমি সফল হবেই। আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে তোমার প্রতি।”
এরপর আর কথা বিশেষ এগোলো না। শ্রাবণ দ্রুত খাওয়া শেষ করেই বেরিয়ে গেলো। ফরেন্সিক টিমের সঙ্গে তার বিশেষ আলোচনা রয়েছে আজ। বাকিরাও যে যার কাজে চলে গেলো এরপর।
____
তিনদিন টানা বৃষ্টির পর আজ আকাশে রোদের দেখা দিয়েছে। রুশিতা তাই ছাদে এসে বসেছে আজ। এই কদিন ওর ঘর থেকে বেরোনো একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। তাছাড়া প্রথম দুইদিন জ্বরের ঘোরে অবসন্ন ছিল ও। গতকাল থেকে একটু একটু করে শরীরটা ঠিক হয়েছে। আজ ও অনেকটাই সুস্থ। আর যেহেতু আজ বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই, তাই আজ ও বাইরে বেরোনোর অনুমতি পেয়েছে।
এই তিনদিনে মায়ের কাছ থেকে যে পরিমাণ বকা রুশিতা শুনেছে, তাতে ওর শুধরে যাওয়াই উচিত। অর্থাৎ, আর কোনোদিন বৃষ্টির ধারপাশ দিয়েও না যাওয়া উচিত। কিন্তু রুশিতা জানে, যদি এখন বৃষ্টি নামে, তাহলে ও আবার ভিজবে। এটা চিরকালের নিয়ম। বৃষ্টি হয়, ও ভেজে, মা বকা দেয়। এই চক্র চলে আসছে রুশিতার ছোটবেলা থেকেই। আর এটা থামার নয়।
রুশিতার পাশেই বসে আছে উর্জা। ওরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করছে। আজ রবিবার, তাই ছুটির দিন। সেইজন্যই এই সময়ে ওরা বাড়িতে, নতুবা ওরা কলেজে থাকতো এখন। সেক্ষেত্রে এই আড্ডাটা হতো না।
উর্জা হঠাৎই ঠাট্টার সুরে বললো,
“রুশু, ধর তোর বিয়ে যদি একজন পুলিশের সাথে হয়? কেমন হবে বল তো?”
রুশিতা চোখ মুখ বিকৃত করে উর্জার দিকে তাকালো। তারপর প্রচন্ড বিরক্ত স্বরে বললো,
“ভীষণ বাজে হবে। আর আমি জীবনেও কোনো পুলিশকে বিয়ে করবো না। অমেরুদণ্ডী প্রাণী বিয়ে করার শখ নেই আমার।”
উর্জা হেসে ফেললো ওর কথা শুনে। হাসতে হাসতেই বললো,
“সবাই তো একরকম না বল? কেউ কেউ ভালোও হতে পারে।”
“বাহ্, বেশ তো পুলিশদের হয়ে সাফাই গাইছিস! বলি, রাস্তাঘাটে কোনো পুলিশের প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
“আশ্চর্য! প্রেমে পড়বো কেন?”
“তোর তো স্বভাবই তাই! রাস্তাঘাটে, বাসে – ট্রেনে, পুজোর প্যান্ডেলে যেকোনো জায়গায় সুন্দর ছেলে দেখলেই হলো! সেই ছেলে আগামী কিছুদিনের জন্য তোর মন দখল করে বসে থাকবে।”
উর্জা মুখ বেঁকালো, তবে বিশেষ প্রতিবাদ করলো না। কারণ, কথাটা রুশিতা খুব একটা ভুল বলেনি। যদিও উর্জা এসব বলে মজা করার জন্যই। নয়ত আজ অবধি কোনো ছেলের সাথে সাহস করে কথাও বলেনি ও। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মজা করতে দোষ কোথায়?
হঠাৎই একটা কোলাহল শোনা গেলো। যেন অনেক মানুষ ওদের বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে, চিৎকার করতে করতে। উর্জা আর রুশিতা ছুটে গেলো ছাদের রেলিঙের দিকে। বাড়ির সামনের রাস্তায় চোখ রেখে ওরা যা বুঝলো, একটা প্রতিবাদ মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে।
এখন গ্রাম – শহর সর্বত্র এইরকম মিছিল হচ্ছে। এতগুলো মেয়ের সাথে হওয়া অবিচারের প্রতিবাদে পথে নামছে সবাই। সকাল থেকে সন্ধ্যা, প্রতিবাদ চলছে। যদিও প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রুশিতাদের বাড়ির কেউই এই ধরণের মিছিলে যোগদান করতে পারেনি। তার কারণ হলো রণজিৎ তালুকদারের তীব্র নিষেধাজ্ঞা। ওনার মতে, বাড়ির কেউ মিছিলে গেলে ওনার রাজনৈতিক জীবন প্রভাবিত হতে পারে।
রণজিৎ তালুকদারের অনেক সিদ্ধান্তই ওদের পছন্দ হয়না। কিন্তু ওনার বিরোধীতা করার সাহস ওদের নেই। শান্তিনিবাসে ওনার কথাই শেষ কথা। এমনকি ওনার বড় দাদাও ওনার উপরে কিছু বলেন না। সেখানে রুশিতারা তো কিছু বলতেই পারবে না।
মিছিলে যোগ দেওয়ার সুযোগ না থাকায় দূর থেকেই মিছিল দেখতে থাকলো ওরা। রুশিতার নজরে আসলেন একজন বৃদ্ধা মহিলা। রুশিতা অবাক হলো। এই বয়সেও এই বৃদ্ধা মিছিলে এসেছেন? শারীরিক জোর না থাকলেও এনার মনের জোর যে প্রচুর, তা মানতেই হবে। মনে মনে বৃদ্ধার প্রতি সম্মানটা অনেকটা বেড়ে গেলো রুশিতার।
____
প্রায়ান্ধকার একটা ঘরে চেয়ারে বসে আছে এক ব্যক্তি। তার হাতে একটা ধারালো ছুরি। তার সামনেই টিভি চালানো রয়েছে। টিভির আলোতেই সামান্য যা আলোকিত হচ্ছে ঘর। এছাড়া ঘরে কোনো আলো নেই।
টিভির পর্দায় একজন সুন্দরী সংবাদপাঠিকা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাঠ করছেন। তার চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে উদ্বিগ্নতা। বোঝা যাচ্ছে যে, সংবাদটি ভীষণই চিন্তার কোনো সংবাদ।
“কলকাতা শহর বর্তমানে নারীদের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। অন্তত শহরের সামগ্রীক পরিস্থিতি বিচার করে তাই বলা যায়। গত একমাস ধরে চলা কুৎসিত ধর্ষণ কাণ্ডে যুক্ত হলো আরও একটি মেয়ের জীবন। হ্যাঁ, ধর্ষিতার সংখ্যা ষোলো থেকে বেড়ে হলো সতেরো।
স্বাভাবিক ভাবেই আবারও প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকার উপরে। তারা কি ঘুমাচ্ছে এখন? সাধারণ জনগণের প্রশ্ন এই মুহূর্তে এই একটাই। সম্প্রতি তদন্তের দায়ভার তুলে দেওয়া হয়েছে ইন্সপেক্টর শ্রাবণ মল্লিকের হাতে। যাকে সকলে দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার বলেই চেনে। আশা করা যায়, তিনি খুঁজে বের করবেন অপরাধীকে, এই রহস্যর কিনারা তিনি করেই ছাড়বেন। কিন্তু তবুও, মানুষ এখন আতঙ্কিত। কবে স্বাভাবিক হবে পরিস্থিতি? প্রশ্ন জনতার।”
উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে টিভিটা অফ করে দিলো সেই ব্যক্তি। সে যেন ভীষণ হাসির কোনো কথা শুনেছে। হাসি তার থামতেই চাইলো না। বেশ কিছুক্ষণ হাসার পর সে থামলো। আর তার মুখভঙ্গি হয়ে উঠলো হিংস্র। নিজের মনেই সে বলে উঠলো,
“যত বড় পুলিশই আসুক না কেন, আমাকে ধরার ক্ষমতা কারোর নেই। আমি আমার কাজ করেই যাবো। এই তো সবে শুরু। এখনও কলকাতা অনেক ভালো আছে। আমি তো একে মৃতদের শহরে পরিণত করবো। আমার প্রতিশোধ নেওয়ার এখনো অনেক বাকি। এতো সহজে থামবো আমি?”
ছুরিতে হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলতে লাগলো সেই রহস্যময় ব্যক্তি। তার কথায় প্রকাশ পেতে থাকলো তীব্র আক্রোশ। বলা যায় যে, সেই এই মুহূর্তে কলকাতার সবচেয়ে বড় খলনায়ক। যাকে হাতে পেলে ছিঁড়ে খেত জনগণ। কিন্তু সে যে ধরাছোঁয়ার বাইরে!
চলবে…..