চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-০৭

0
10

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| সপ্তম পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে রুশিতা, উর্জা আর তাপ্তি। সন্ধ্যাবেলায় যেহেতু আসার উপায় নেই, তাই দুপুরের খাওয়াটাই আজ রেস্টুরেন্টে খাবে বলে ঠিক করেছে ওরা। সেই মতো রণজিৎ তালুকদারের থেকে অনুমতি নিয়ে ওরা চলে এসেছে ওদের এলাকার সব থেকে বড় রেস্টুরেন্ট, ‘ভোজ অ্যান্ড আড্ডা’-য়। ওরা যখনই বাইরে খাবে ঠিক করে, তখনই এই রেস্টুরেন্টে আসে। এখানের খাবারের গুণগত মান এবং স্বাদ অতুলনীয়।

মেনু কার্ড দেখে ভেবেচিন্তে ওরা স্টার্টার হিসেবে চিকেন টিক্কা, আর মেন কোর্সে মিক্স ফ্রায়েড রাইস আর হান্ডি চিকেন অর্ডার করলো। আজকের পুরো বিল রুশিতা পে করবে। বাড়ি থেকে এমনটাই কথা হয়ে এসেছে। তাই তাপ্তি আর উর্জা মনের আনন্দে খাবার অর্ডার করলো। বোনের পার্স ফাঁকা করতে ওরা বেশ আনন্দই পাচ্ছে।

ফ্রায়েড রাইস আর হান্ডি চিকেন খাওয়া শেষ করে ডেজার্টে রসগোল্লা নিলো ওরা। এক বাটি রসে ডোবানো গরম, এবং তুলতুলে রসগোল্লাগুলো সত্যিই ওদের মন জুড়িয়ে দিলো। এরপর বিল পে করে বেরিয়ে এলো ওরা।

রাস্তায় বেরিয়ে হঠাৎই রুশিতার চোখ পড়লো রাস্তার পাশে বসে থাকা কিছু পথশিশুর মুখের দিকে। মলিন মুখগুলো দেখে রুশিতার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ও বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো। উর্জা ওকে পিছন থেকে ডেকে বললো,

“কোথায় যাচ্ছিস রুশু? কি করবি?”

“ওই বাচ্চাগুলোকে দেখ উর্জা, কি মায়াবী না ওদের মুখগুলো? ওদেরকে কিছু খাওয়ালে কেমন হয়? দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ খিদে পেয়েছে ওদের।”

উর্জা এবার খেয়াল করলো বাচ্চাগুলোকে। তাপ্তিও দেখলো। সত্যি বলতে, ওদেরও কষ্ট হলো ওই ছোট শিশুগুলোর জন্য। শীত – গ্রীষ্ম – বর্ষা বারোমাস খোলা আকাশের তলায় রাস্তায় বাস ওদের। কত কষ্ট করেই না বেঁচে আছে ওরা। একদিন যদি ওদেরকে একটু সুখের খোঁজ দেওয়া যায়, ক্ষতি কোথায়? রুশিতার কথায় ওরা তাই আপত্তি করলো না।

রুশিতা কাছের একটা দোকান থেকে বাচ্চাগুলোর সংখ্যা হিসাব করে পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদি কিনলো। ইচ্ছা করেই এমন খাবার কিনলো যা রেখে খাওয়া যাবে। এর সাথে সবকটা বাচ্চার জন্য চকলেট কিনলো। তারপর ওরা তিনজন মিলে খাবারগুলো বাচ্চাদের হাতে তুলে দিলো।

খাবার পেয়ে বাচ্চাগুলোর সে কি আনন্দ! খিলখিল করে হেসে উঠলো ওরা। ওদের হাসিমুখগুলো দেখে মন জুড়িয়ে গেলো রুশিতাদের। মানুষকে সাহায্য করলে যে এতটা পরিতৃপ্তি পাওয়া যায়, তা আগে জানা ছিল না ওদের।

রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো শ্রাবণ। সে এসেছিলো একটা চায়ের দোকানে, সিগারেট কিনতে। পুলিশ হয়ে এই একটা নিয়মভঙ্গই করে শ্রাবণ। ভীষণ চাপে থাকলে ও সিগারেট খায়। খাওয়া একেবারেই উচিত না, তা জানার পরেও খায়।

রুশিতাকে দেখে শ্রাবণ চিনতে পারলো প্রথমেই। আগের দিন এই মেয়েটার সাথেই ঝামেলা হয়েছিল ওর। কিন্তু আজকের বিষয়টা দেখে শ্রাবণ অবাক হলো। আগের দিনের ওই কোমর বেঁধে ঝগড়া করা মেয়েটা যে এতটা ভালো মানসিকতার হতে পারে, সেটা শ্রাবণ ভাবেনি। ও বিড়বিড় করে বললো,

“যাক, মেয়েটা তারকাটা হলেও মানবিক!”
____

রক্তাক্ত হাত নিয়ে নিজের ঘরে বসে আছে আদিত্য। একটু আগেই ঘরের দেওয়ালে সজোরে ঘুষি মেরেছে ও। ফলে ওর ডান হাতের অবস্থা খারাপ। এই অতিরিক্ত রাগটাই একদিন ওকে শেষ করবে। এটা জানা সত্ত্বেও আদিত্য রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কিছুতেই।

আদিত্যর প্রেমিকা, সুনয়নার বাড়িতে বিয়ের কথা বার্তা চলছে। এর আগের সম্বন্ধগুলো সুনয়না কোনো রকমে কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এইবার যার সাথে বিয়ের কথা চলছে, সেই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। সুনয়নার বাবা মা এই সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে চাইছেন না। বরং তারা চাইছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুনয়নার বিয়েটা দিয়ে দিতে।

সুনয়না ফোন করে সেই কথাটাই বলেছিলো আদিত্যকে। সে বেচারিও বিয়েতে রাজি নয়। আধবুড়ো লোকের সাথে কোন মেয়েই বা বিয়ে করতে চায়। আর সুনয়না মেয়েটা এমনিতে ভীষণই ভালো। আদিত্যকে সুনয়না বলছিলো, কোনোভাবে যদি ওরা দুজন বিয়ে করতে পারে, সেই উপায় খুঁজতে।

আদিত্য কোনো উপায় তো খুঁজে পায়ইনি, উপরন্তু রাগের মাথায় নিজেকে আঘাত করে বসে আছে। ও ভেবে পাচ্ছেনা, কিভাবে সুনয়নার বিয়েটা আটকানো যায়। আদিত্য নিজে বেকার একজন যুবক। কোনো মেয়ের অভিভাবকই চাইবেনা তাদের মেয়েকে একজন বেকারের সাথে বিয়ে দিতে। খুব তাড়াতাড়ি কোনো চাকরি জোটার সম্ভাবনাও নেই। তাই, সুনয়নার বাড়িতে গিয়ে কথা বলার মতো পরিস্থিতি এখন নেই।

নিজেকে এই মুহূর্তে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে আদিত্যর। ওর প্রেমকাহিনিও তাহলে অসম্পূর্ন থেকে যাবে? ওকেও দেখতে হবে নিজের প্রেমিকাকে অন্য কারো স্ত্রী রূপে? ভাবতেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আদিত্যর। এরকম অস্থির পরিস্থিতিতে এর আগে কখনও পড়েনি ও।

একটা সিগারের ধরালো আদিত্য। ব্যর্থ প্রেমিকের সিগনেচার স্টাইল এটা, প্রেম ব্যর্থ হওয়ার পথে এগোলেই সিগারেটের নেশা ধরা লাগে। কথাটা ভাবতেই এতো দুঃখের মাঝেও হাসি পেলো আদিত্যর। কখনও কখনও কি আজগুবি কথা মাথায় আসে ওর!

ঘরের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো আদিত্য। আকাশটা ভরে আছে তারা দিয়ে। মাঝে একা চাঁদ, আলো দিয়ে যাচ্ছে। যদিও নিজের আলো না, অন্যের থেকে ধার করা আলো। এতদিন চাঁদের সাথে প্রেমিকার তুলনা করে এসেছে আদিত্য। কিন্তু আজ কেন যেন, চাঁদের সাথে নিজেকে বড় একাত্ম মনে হলো ওর। ও নিজেও তো চাঁদের মতোই একাকী, অন্যের আলোয় আলোকিত। ওর নিজস্ব তো কিছুই নেই। একটাই পরিচয়, ও রণজিৎ তালুকদারের ভাইপো।

কথাটা ভাবতেই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো আদিত্যর। নাহ্, আরও একবার রণজিৎ তালুকদারের থেকে আলো ধার করতে হবে ওকে। এই যাত্রাও ওকে চাঁদ হয়েই থাকতে হবে, আর তালুকদার সাহেব হবেন সূর্য। আদিত্যর মাথার মধ্যে একটা পরিকল্পনা সেজে উঠতে লাগলো।
____

একাকী ঘরে বসে রহস্যময় সেই ব্যক্তি। সমাজের কাছে যার একটাই পরিচয়, সে একজন রেপিস্ট। নিজের এই পরিচয় অবশ্য সে ভালোই উপভোগ করে। নিজের হাতে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে সে লিখলো, SB। তার নামের আদ্যক্ষর!

SB যেন মানুষ নয়, দানব গোত্রীয় কিছু। ধারালো ছুরি দিয়ে চামড়া কাটার পরেও তার মধ্যে কোনো বিকার দেখা গেলো না। যেন সামান্য যন্ত্রণাও অনুভূত হচ্ছে না তার। অন্যদের মারণ যন্ত্রণা দিতে দিতে নিজে কি পাথর হয়ে যাচ্ছে ও?

কয়েকদিন ধরে SB একটু চিন্তায় আছে। কলকাতায় হত্যাকান্ড শুরু করার পর থেকে এই প্রথম ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। আর ওর এই চিন্তার জন্য দায়ী মানুষটা হলো ইন্সপেক্টর শ্রাবণ মল্লিক। এই অসভ্য পুলিশটা ওকে একটু বেশিই ঘাটাতে শুরু করেছে। অদ্ভুত পদ্ধতিতে তদন্ত করতে শুরু করেছে সে। যাতে করে, SB- এর পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে।

আইন – কানুন, পুলিশ এসবে ওর কোনো ভয় নেই। ও জানে, এখন ধরা পড়লে ওর একটাই শাস্তি, সেটা হলো ফাঁসি। সেই নিয়েও ওর কোনো ভয় নেই। নিজের জীবনের প্রতি কোনো মায়া ওর নেই।

SB -র শুধু একটাই চিন্তা, ওর কাজ শেষ হওয়ার আগে ধরা পড়লে চলবে না। অন্তত একশোটা মেয়েকে শিকার করবে ও। তারপর ও থামবে। মহানগরীর বুকে আতঙ্কের বীজ বুনে দিতে চায় ও। যেভাবে একদিন আতঙ্কিত হয়েছিল ও নিজে!

ওর পথে এখন একটাই কাঁটা, শ্রাবণ মল্লিক। এই কাঁটা উপড়ে ফেলতে হবে শীঘ্রই। নাহলে ওর জীবনে নেমে আসবে বিপদ। SB মনে মনে ভাবতে শুরু করলো, কি করা যায়। হয়তো, শ্রাবণ মল্লিককে চিরতরে সরিয়ে দেওয়াই একমাত্র উপায়।

প্রতিশোধ! লোকে বলে, প্রতিশোধের আগুন মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে। হ্যাঁ, অন্ধই! SB এই প্রতিশোধের খেলায় অন্ধ হতেও রাজি। কিন্তু নিজের প্রতিশোধ পূর্ণ না হওয়া অবধি ও থামবে না। কেউ ওকে থামাতে পারবে না।

চলবে…….