চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-০৮

0
9

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| অষ্টম পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

“সখী তোরা প্রেম করিও না,
পিরিত ভালা না,
সখী তোরা প্রেম করিও না।
প্রেম করছে যে জন জানে সে জন
পিরিতির কি বেদনা,
করছে যে জন জানে সে জন
পিরিতির কি বেদনা,
সখী তোরা প্রেম করিও না…”

গান গেয়ে শুভ্রাকে জ্বালাচ্ছে রুশিতা। শুভ্রা আপাতত গাল ফুলিয়ে বসে আছে, অনিক ওকে কল করছে না বলে। গত তিনদিন ধরে অনিকের কোনো কল নেই। শুভ্রা একবার কল দিয়েছিলো লজ্জা অতিক্রম করে, রিসিভ হয়নি। ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, অনিক কল করলেই ও অনেক ঝগড়া করবে। যদিও শুভ্রা জানে, বাস্তবে ও কিছুই বলতে পারবে না।

আর এদিকে শুভ্রাকে দেখে মজা নিচ্ছে ওর বাকি বোনেরা। বিশেষত রুশিতা তো রীতিমতো শুভ্রাকে খোঁচাতে শুরু করে দিয়েছে। শুভ্রাকে রাগানোর উদ্দেশ্যেই গান গাইতে শুরু করেছে ও। বাকিরাও তাল মেলাচ্ছে রুশিতার সঙ্গে।

শুভ্রা পাশ থেকে একটা বালিশ তুলে ছুঁড়ে মারলো রুশিতার দিকে। রুশিতা সামান্য সরে যেতেই বালিশটা লক্ষ্যচ্যুত হলো। রুশিতা এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর বললো,

“নাহ্ শুভ্রাদি, তুমি বোকাই রয়ে গেলে। তুমি ভাবলে কি করে যে তুমি দি গ্রেট রুশিতা মল্লিকের গায়ে বালিশ ছুঁড়তে পারবে?”

শুভ্রা মুখ বেঁকিয়ে বললো,

“দি গ্রেট না ছাই! ঢং করিস না তো রুশু। ভালো লাগছে না এখন।”

তাপ্তি পাশ থেকে বললো,

“হ্যাঁ, সে তো ভালো লাগবেই না। তোমার ভিটামিন – ভালো লাগা যে কাছে নেই এখন।”

সবাই হেসে উঠলো। প্রজ্ঞা মাথা চুলকে বললো,

“ভালোলাগা ভিটামিনও হয়? বইতে তো পড়িনি!”

উর্জা একটা চাঁটি মারলো প্রজ্ঞার মাথায়। তারপর আক্ষেপের সুরে বললো,

“এই বাচ্চা পার্টিগুলোকে নিয়ে আর পারা গেলো না! ওই শোন, তোদের নাইনের বইতে এসব লেখা থাকবে না। ওগুলো উঁচু ক্লাসে পড়ায়।”

প্রজ্ঞা আর কিছু বললো না। জানে, বললেই ওর মাথায় আরেকটা চাঁটি পরবে। আর ও এই মুহূর্তে নিজের মাথা ব্যাথা করতে চায়না।

ওদের হাসাহাসির মধ্যেই শুভ্রার ফোন বেজে উঠলো। উর্মি বললো,

“ওই নাও, তোমার কিডনির ফোন এসে গিয়েছে। যাও সোনা, প্রেম করো তুমি। আমরা চললাম।”

ওরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রা কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে অনিকের কণ্ঠ ভেসে আসলো,

“কি করছো শুভ্রা?”

শুভ্রা মলিন কণ্ঠে বললো,

“বসে আছি, আপনি?”

“মাত্র অফিস থেকে ফিরলাম।”

“ওহ।”

মুখে কিছু না বললেও শুভ্রার কণ্ঠস্বরে যেন অভিমান ঝরে পড়ছে। খুব শীঘ্রই বিষাদের সুরটা ধরে ফেললো অনিক। ও নরম কণ্ঠে ডাকলো,

“বউ?”

আচমকা অনিকের এরূপ সম্বোধনে চমকে উঠলো শুভ্রা। পরোক্ষণেই, ভীষণ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো ওর মুখ। কোনো রকমে লজ্জা চেপে ও উত্তর দিলো,

“হু – হুমম?”

“মন খারাপ?”

“ন্-নাহ্।”

“বোঝা যাচ্ছে, আমার প্রিয়তমা এই মুহূর্তে তীব্র অভিমান করেছেন। অভিমানের কারণটা জানতে পারি বউ?”

“আপনি গত তিনদিন ধরে কল করছেন না কেন? আমিও একবার কল করেছিলাম, ধরেননি। কি ব্যাপার বলুন তো?”

“সরি শুভ্রা। আমাদের কোম্পানি একটা নতুন প্রজেক্টের উপর কাজ করছে, আর কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হওয়ায় আমি একটু চাপে ছিলাম। তাই তোমায় সময় দেওয়া হয়নি। সরি, এরকম হবেনা আর কখনও।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

“এই অধমকে কি ক্ষমা করা যায়?”

“আরেহ, কি বলছেন? ক্ষমা করার কি আছে?”

“অনেক কিছুই আছে। বিশ্বাস করো শুভ্রা, আর হবেনা এমন কখনও। এই প্রথম, এই শেষবার। আর কখনও অভিমান করার সুযোগ দেবোনা তোমায়।”

মান অভিমানের পালা শেষ হলো। তারপর গল্পে ডুবে গেলো ওরা দুজন। বরাবরের মতোই, মূল বক্তা অনিক, আর শুভ্রা শ্রোতা। যদিও মাঝে মাঝে শুভ্রাও কথা বলছে। আবার, অনিকের মজার কথা শুনে হেসে উঠছে কখনও কখনও। ওদের দুজনের প্রেমালাপ এগিয়ে চললো সুন্দরভাবে।
____

আজ রণজিৎ তালুকদারের মনটা বেশ প্রফুল্ল। হাসি হাসি মুখ করে নিজের গোপন কার্যালয়ে বসে আছেন উনি। পাশেই দাঁড়িয়ে ওনার ডান হাত, সমীর। পরিবারের বাইরে এই একটি মানুষকেই বিশ্বাস করেন রণজিৎ তালুকদার। সমীরও সেই বিশ্বাসের যথাযথ মর্যাদা দেয়।

রণজিৎ তালুকদারের হাতে ধরা একটা বেশ বড় আকারের হিরে। সামনের টেবিলে দামী মখমলী কাপড়ের উপর আরও কয়েকটা হিরে রাখা। সেগুলোর জ্যোতির থেকেও যেন রণজিৎ তালুকদারের চেহারার জ্যোতি বেশি এই মুহূর্তে। হিরেগুলোই যে ওনার প্রশান্তির কারণ, তা বুঝতে অসুবিধা হয়না।

সমীর তাকিয়ে রয়েছে তার মালিকের দিকে। তালুকদার সাহেব কিছু সময় পর বললেন,

“সমীর, কথা ফাইনাল হয়ে গিয়েছে তো?”

“হ্যাঁ স্যার, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি সব কথা বলে নিয়েছি। মাল যাবে, কড়ি আসবে।”

“বুঝলি সমীর, তোর উপরেই শুধু এতটা ভরসা করা যায়। তুই না থাকলে আমার অনেক কাজই ঠিকভাবে হতো না। যাক, মাল যাবে কবে?”

“আগামী কাল এখান থেকে পাঠানো হবে। ওদের লোক আসবে কাল আপনার কাছে। অ্যাডভান্স অর্ধেক টাকা দেবে। কিন্তু তার হাতে মাল দেওয়া যাবে না। মাল আমাদের ঘুরপথেই পাঠাতে হবে।”

“হ্যাঁ, সে আমি জানি। তারপর জিনিস গন্তব্যে পৌঁছালে বাকি টাকা আসবে। তাই তো?”

“একদমই তাই স্যার।”

“বালির বস্তাগুলো রেডি তো সমীর?”

“হ্যাঁ স্যার, রেডি না করলে কি হয়? ওর বদলেই তো এতো টাকা আসবে।”

ইঙ্গিতপূর্ন হাসি হাসলো সমীর। হাসলেন তালুকদার সাহেবও। তারপর হঠাৎই গম্ভীর হয়ে উঠলো ওনার মুখমন্ডল। উনি বললেন,

“সমীর, আবার মনে হয় র’ক্ত মাখতে হবে হাতে।”

“কেন স্যার?”

“পথে কাঁটা এসেছে কিছু। উপড়ে না ফেললে চলছে না। এগুলোকে রেখে দিলে ওই কাঁটায় আমাদের পা র’ক্তা’ক্ত হতে পারে। আর পায়ের থেকে হাতে র’ক্ত মাখা আমার পক্ষে বেশি পছন্দের।”

সমীর নিমেষেই বুঝে নিলো বিষয়টা। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবলো। এরপর বললো,

“নতুন একজন সিরিয়াল কিলারের খোঁজ পেয়েছি স্যার। মাখনের মতো কাজ করে একবারে। মনে দয়ামায়া কিচ্ছু নেই।”

“সিরিয়াল কিলারদের দয়ামায়া থাকে না সমীর। ওটা স্বাভাবিক বিষয়। একে তোর মনে ধরলো কেন সেটা বল।”

“এর আগের যে হিস্ট্রি আছে, তার জন্য স্যার। মারাত্মক রকমের টর্চার করে খুনটা করে। তারপর এমনভাবে সব সাজায়, মনে হয় যেন এক্সিডেন্ট। এরকম লোককেই তো আমাদের দরকার। আপনি বললে কথা বলবো এর সাথে।”

“হ্যাঁ, বলতে পারিস। নাম কি লোকটার?”

“সায়ন বসু স্যার।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। কথা বল। আর কালকের কেসটা দেখিস।”

“হ্যাঁ স্যার, কালকের কাজ ভালোভাবে মিটে যাবে। চিন্তা করবেন না একদম।”

তালুকদার সাহেব গভীর নিঃশ্বাস নিলেন। তার ভালো সময় কি আসছে? ইদানিং তো সব ভালোই হচ্ছে ওনার সাথে। আশা করা যায়, ওনার সমৃদ্ধি আরও বাড়বে। কঠিন সময় নিজের জীবনে বিশেষ দেখেননি তালুকদার সাহেব। দেখতে চানও না। ওনার ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে সব জায়গাতেই উন্নতি করতে অভ্যস্ত উনি। সে ভালো কাজেই হোক, আর খারাপ কাজেই হোক। উনি সব সময় শীর্ষে থাকতেই চান। আশা করছেন, এখনও শীর্ষেই থাকবেন।
____

রাত প্রায় বারোটা। তড়িঘড়ি সব ফাইল গুছিয়ে আলমারিতে তুলছে শ্রাবণ। আজ কাজ করতে করতে এতো রাত অবধি ও থানাতেই রয়ে গিয়েছে। যদিও ওর নাইট ডিউটি নেই আজ। যাদের নাইট ডিউটি আছে, তারা চলে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। কিন্তু শ্রাবণ এখনও বাড়ি যায়নি।

সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে থানা থেকে বেরোলো শ্রাবণ। আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। এবার বাড়ি গিয়ে একটু ঘুমানো দরকার। যদিও বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারবে না সেটা ও নিজেও জানে। কারণ কাল আবার সকাল সকাল ডিউটিতে আসতে হবে।

বাইকে স্টার্ট দিলো শ্রাবণ। বৃষ্টি পড়ছে আবার এখন। আজকেই হেলমেট পরে আসতেও ভুলে গিয়েছে ও। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো ওর মাথাতেই পড়তে লাগলো।

রাস্তা পুরো শুনশান। শ্রাবণ অন্যমনস্ক হয়ে ড্রাইভ করছিলো। ওর মাথায় ঘুরছিলো কেসের বিভিন্ন বিষয়। তাই ও খেয়ালই করলো না, উল্টোদিক থেকে তীব্রগতিতে মৃত্যুদুতের মতো এগিয়ে আসছে একটা লরি, ঠিক ওরই দিকে লক্ষ্য করে।

চলবে…..