চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-১০

0
10

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| দশম পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

সময় এগিয়ে যায় অনেক দ্রুত। দ্রুততার সঙ্গেই পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় দুইমাস। এই দুইমাসে, বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই।

শ্রাবণ এখন একা একা হাঁটতে পারছে। এতদিন হুইল চেয়ারের সাহায্য নিতে হতো ওকে। তিনদিন আইসিইউতে থাকার পর ওকে বিশেষ তৎপরতায় বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লন্ডনের এক নামী নার্সিংহোমে চিকিৎসা করানো হয়েছে ওর। যেখানে প্রাণে বাঁচার আশাই প্রায় ছিল না, সেখানে এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম ও।

এতো কিছুর মধ্যেও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে শ্রাবণ। চাকরি থেকে দীর্ঘ ছুটিতে রয়েছে ও। কিন্তু তবুও কেসের খোঁজ খবর শ্রাবণ রাখেই। আর তাই ও জানে যে, বর্তমানে তদন্ত চলছে শুধু নামেই। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এই দুইমাসে আরও চারটে ধর্ষণ হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ধর্ষণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১।

শ্রাবণ অপেক্ষায় আছে, কবে ও সম্পূর্ণ সুস্থ হবে আর চাকরিতে যোগ দেবে। চাকরিতে যোগ দিয়েই শ্রাবণ যোগাযোগ করবে ইন্সপেক্টর রূদ্র চৌধুরীর সাথে, আর চেষ্টা করবে তদন্তের দায়ভার আবার ওর জিম্মায় নেওয়ার। নাহলে এই তদন্ত শুধুমাত্রই প্রহসন হয়েই থেকে যাবে। যদিও শ্রাবণ জানে, পুনরায় তদন্তের দায়ভার এতো সহজে ওকে দেওয়া হবে না। কিন্তু তবুও, ও লড়াই করবে।

শ্রাবণের ভাবনার মাঝেই দরজায় টোকা পড়লো। শ্রাবণ সামান্য গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলো,

“কে?”

দরজার বাইরে থেকে উত্তর আসলো,

“দাদাভাই, আমি নিশিতা। ভিতরে আসবো?”

“হ্যাঁ, চলে আয়।”

দরজায় ছিটকিনি দেওয়া ছিল না, শুধু ভেজিয়ে রাখা হয়েছিল। নিশিতা দরজা ঠেলে ভিতরে এসে ঢুকলো। তারপর শ্রাবণের পাশে এসে বসলো। শ্রাবণ বললো,

“কিরে, পড়তে যাসনি? পড়া ছিল তো তোর সকালে?”

“না, আজ স্যার ছুটি দিয়েছেন। তুমি বলো, শরীর কেমন লাগছে?”

“অনেকটা ঠিক আছি। আশা করছি আর এক – দুই সপ্তাহের মধ্যেই চাকরিতে জয়েন করতে পারবো।”

“তোমার মাথায় চাকরি ছাড়া কিছু ঘোরে না বলো?”

“কি করবো বল নিশু? তুই আর ঈশিতা যেমন আমার বোন, তেমন আরও কত বোন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে। কত বোনের সম্মানহানি হয়েছে। তাদের জন্য তোর এই দাদাকে চাকরিতে ফিরতেই হবে।”

“দায়িত্ব কি তোমার একার দাদাভাই? আরও তো অনেকে আছে, কই তারা তো এতো ভাবছে না?”

“বাকিরা খারাপ হলেই আমিও খারাপ হবো? ভাব সম্প্রসারণ পড়েছিস না, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে। বাস্তব জীবনেও এই নীতিটা মেনে চলতে হয় রে। আমি কখনোই এই নীতির বাইরে যেতে পারবো না।”

নিশিতা আর কিছু বললো না। জানে, তার দাদাভাইকে কিছু বলেই আটকানো যাবে না। যে নীতির কথা দাদাভাই বললো, সেটা তো ও নিজেও মেনে চলে। কিন্তু গত দুর্ঘটনাটার পর থেকে দাদাভাইকে নিয়ে বড্ড ভয় হয়। ওই দুর্ঘটনাটা সবকিছু এমন এলোমেলো করে দিয়ে গেছে যে, এখন সব সময়ই আতঙ্ক ঘিরে থাকে ওদের।
____

সুনয়নার বাড়ির ড্রইংরুমে বসে আছেন রণজিৎ তালুকদার। তার সামনে দাঁড়িয়ে সুনয়নার বাবা মা। তাদের মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে যে, রণজিৎ তালুকদারের আগমনে তারা অত্যন্তই অবাক হয়েছেন। এবং এই আগমনের কারণ ও তারা বুঝতে পারছেন না।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ। তারপর সুনয়নার বাবা তালুকদার সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“বিধায়ক সাহেব, কি মনে করে আমাদের বাড়িতে পা রাখলেন আজ হঠাৎ?”

রণজিৎ তালুকদার সামান্য হাসলেন। তারপর বললেন,

“একটা গুরুত্বপূর্ণ দরকারেই এসেছি। বলতে পারেন, আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।”

রণজিৎ তালুকদারের মতো দোর্দন্ডপ্রতাপ বিধায়কের মুখে অনুরোধের কথা শুনে সুনয়নার বাবা আরও অবাক হলেন। তিনি বিস্মিত কণ্ঠে শুধালেন,

“কি অনুরোধ?”

“আপনাদের মেয়ে সুনয়নাকে আমার পছন্দ হয়েছে। ভারী মিষ্টি মেয়ে। আমি ওকে আমার দাদার ছেলে আদিত্যর বউ করে নিয়ে যেতে চাই। আদিত্য এখনও কোনো চাকরি না করলেও আমার ব্যবসায় সে সক্রিয় ভাবে দেখাশোনা করে। খুব শীঘ্রই কোনো চাকরি জুটিয়ে ফেলবে ও। সুনয়না আমাদের বাড়িতে আদর যত্নে থাকবে। আশা করি আপনাদের কোনো আপত্তি নেই?”

সুনয়না নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিলো সব। তালুকদার সাহেবের কথা শুনে আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না, আদিত্যই তার কাকাকে পাঠিয়েছে এখানে। নিশ্চয়ই সেই কাজটা খুব একটা সহজ নয়। তবু আদিত্য সুনয়নাকে নিজের করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ওর কাকার সাথে কথা বলেছে এবং এখানে আসতে রাজি করিয়েছে, ভাবতেই সুনয়নার মধ্যে ভালো লাগা কাজ করলো। যাক, ওদের তাহলে বিচ্ছেদ হবে না।

সুনয়নার বাবা মা যেন রণজিৎ তালুকদারের কথা শুনে হাতে চাঁদ পেলেন। এরকম অনাকাঙ্খিত প্রস্তাব কি আর সবার কাছে আসে? খোদ শাসক দলের বিধায়ক বাড়ি বয়ে এসে তাদের মেয়েকে নিজের ভাইপোর বউ করে নিয়ে যেতে চাইছেন। এই প্রস্তাবে আপত্তি করার কোনো কারণই থাকতে পারে না। সুনয়নার বাবাও আপত্তি করতে পারলেন না। তিনি বললেন,

“এতো অসাধারণ প্রস্তাব। আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা রাজি আছি। তবে আমাদের একটু সময় দরকার। বোঝেনই তো, মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি বলে কথা।”

রণজিৎ তালুকদার হাসলেন। তিনি জানতেন, তার মুখের উপর না করার ক্ষমতা এদের নেই। আদিত্যটা মিছিমিছিই ভয় পাচ্ছিলো। উনি বললেন,

“অবশ্যই। আপনাদের যত ইচ্ছা সময় নিন, আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি শুধু প্রাথমিক কথাটা বলে গেলাম। এরপর একদিন আদিত্য, আর ওর বাবা মা এসে সুনয়নাকে দেখে যাবে। আসল কথা তো ওরাই বলবে।”

সুনয়নার এই পর্যায়ে এসে হাসি পেয়ে গেলো। তালুকদার সাহেব এমন অভিনয় করছেন যেন আদিত্য কিছুই জানেনা। অথচ আদিত্যই এখানে পাঠিয়েছে তালুকদার সাহেবকে। কপাল করে একটা কাকা পেয়েছে বটে আদিত্য!

এরপর সামান্য কিছু বাক্য বিনিময় করে উঠে পড়লেন তালুকদার সাহেব। সুনয়নার বাবা মার থেকে বিদায় নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে বেরোলেন। সুনয়নার বাবা ওনাকে বাড়ির দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন, এবং বারবার ক্ষমা চাইলেন যথাযথ আপ্যায়ন করতে পারলেন না বলে। তালুকদার সাহেব অবশ্য নিশ্চিত করলেন যে তিনি কিছু মনে করেননি। তালুকদার সাহেব চলে যাওয়ার পর সুনয়না মোবাইলে আদিত্যর নাম্বারটা ডায়াল করলো। সুখবরটা দিতে হবে যে!
____

ছাদে বসে লুডো খেলছে রুশিতা, উর্জা, তাপ্তি আর প্রজ্ঞা। ইতিমধ্যেই রুশিতা বাকিদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে। কোনো এক জাদুবলে রুশিতার সব সময়ই অনেক ছক্কা পড়ে। আর তাই ও বাকিদের থেকে এগিয়ে যায়।

লাল ঘুঁটি রুশিতার, নীল উর্জার, হলুদ প্রজ্ঞার আর সবুজ তাপ্তির। রুশিতার দুটো ঘুঁটি উঠে গেছে এর মধ্যেই। প্রজ্ঞারও একটা ঘুঁটি উঠে গিয়েছে। তাপ্তির একটাও না উঠলেও সব গুলোই ঘরের বাইরে। আর উর্জা বেচারির মাত্র একটাই ঘুঁটি ঘর থেকে বেরিয়েছে। যতবারই ওর ঘুঁটি বেরোচ্ছে, কেউ না কেউ খেয়ে ফেলছে।

এবারও রুশিতার চার পড়লো, আর রুশিতা উর্জার ঘুঁটিটা খেয়ে ফেললো। উর্জা রেগেমেগে চিৎকার করে বললো,

“এসব ঠিক না। রুশু চিটিং করছিস। এভাবে তোর সবসময় ভালো চাল পড়তে পারে না।”

বাকিরা হেসে গড়িয়ে পড়লো উর্জার কথা শুনে। কিন্তু কেউই ওর অভিযোগে পাত্তা দিলো না। রুশিতা বললো,

“হ্যাঁ, সেই তো, তোর ভালো চাল না পড়লেই আমাদের দোষ তাইনা? নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা!”

উর্জা কিছু না বলে মুখ বেঁকালো। বাকিরা হাসতেই থাকলো। তাড়াতাড়িই রুশিতার আরও একটা ঘুঁটি উঠে গেলো। তাপ্তিরও একটা ঘুঁটি উঠলো। উর্জার অনেক কষ্টে ঘুঁটি বেরোলো একটা। বেচারি খালি বাকিদের দোষ দিয়েই যাচ্ছে। প্রজ্ঞার আরও একটা ঘুঁটি উঠলো। প্রজ্ঞা আর রুশিতার মধ্যে এখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে।

খেলার শেষে রুশিতাই জিতলো, আর উর্জা তিন ঘুঁটিতে হারলো। যদিও সে হার স্বীকার করতে রাজি নয়। বরং বাকিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলো ও। কিন্তু কেউই ওকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে শুরু করে দিলো।

চলবে…..