#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| অষ্টদশ পর্ব ||
[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]
“বাহ্, তোমায় তো বেশ সুন্দর দেখতে। তোমায় আমরা বউমণি বলে ডাকবো, কেমন?”
রুশিতার পাশে বসে শ্রাবণের কাজিন নিশিতা বললো। রুশিতা সামান্য হাসলো। শ্রাবণের আরেক কাজিন ঈশিতা বললো,
“তোমার নামের সাথে আমাদের নামের কত্ত মিল দেখো, রুশিতা, ঈশিতা, নিশিতা।”
রুশিতা আবারও হাসলো। সত্যি, এটা ও ভেবে দেখেনি একবারও। ও বললো,
“হ্যাঁ, বেশ মিল। খেয়াল করিনি তো!”
ওরা বেশ খানিকক্ষণ গল্প গুজব করলো। রুশিতা এখানে আসার পর প্রথম প্রথম বেশ মনমরা হয়ে ছিল। সকালে ঈশিতা – নিশিতারা স্কুলে ছিল, তাই রুশিতার সাথে দেখা হয়নি। বিকেলে বাড়ি ফেরার পরেই ওরা এসেছে রুশিতার সাথে দেখা করতে। ওদের সাথে গল্প করে এখন ভালোই লাগছে রুশিতার।
সকাল থেকে সবাই-ই রুশিতার সাথে ভালো ব্যবহারই করেছে। শ্রাবণের মা উমাদেবী এবং শ্রাবণের কাকিমা কবিতা দেবী দুজনেই বেশ ভালো মানুষ। রুশিতার সাথে সারাদিন অনেক কথাবার্তা বলেছেন ওনারা, ওকে সহজ করার চেষ্টা করেছেন। বিষয়টা রুশিতার ভালো লেগেছে। ও নিজেও চেষ্টা করছে মানিয়ে নিতে। যতই হোক, এখন এটাই ওর পরিবার। সবটা মেনে নিয়ে এই বাড়ির মানুষগুলোর সাথেই থাকতে হবে ওকে এখন থেকে। তাই মানিয়ে নেওয়াই ভালো।
রুশিতাদের গল্পের মাঝেই ঘরে ঢুকলেন উমা দেবী। উনি বললেন,
“বাহ্, বেশ গল্প হচ্ছে দেখছি। ঈশিতা, নিশিতা তোরা এখন পড়তে বস যা। আমার রুশিতার সাথে একটু কথা আছে।”
জেঠির কথায় ওরা দুজন তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। রুশিতার দিকে একবার তাকিয়ে ওরা দৌড় দিলো। উমা দেবী এসে রুশিতার পাশে বসলেন। তারপর বললেন,
“বৌমা, হিসেব অনুযায়ী তো কাল তোমাদের বউভাত হয়। অনুষ্ঠান করে যেহেতু বিয়ে হয়নি, তাই বউভাতও অনুষ্ঠান করে করছি না এখন। কিন্তু ভাত কাপড়ের নিয়মটা তো পালন করতে হবে। তোমার কি এতে কোনো আপত্তি আছে?”
“না আন্টি, আমার কোন আপত্তি নেই। আপনারা যা ভালো বুঝবেন করুন।”
“পাগলী মেয়ে, তুমি এখনও আমায় আন্টি ডাকছো?”
“না মানে… সরি আন্টি… ইয়ে, মানে, তাহলে কি ডাকবো?”
উমা দেবী হেসে ফেললেন। তারপর রুশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুমি আমাকে মামণি ডাকতে পারো। কি, পারো না?”
রুশিতাও হাসলো। বললো,
“অবশ্যই। আমি আপনাকে মামণি বলেই ডাকবো।”
“হুমম, আর এই আপনি আজ্ঞে করবে না একদম। তুমি করে বলবে, ঠিক আছে?”
“আচ্ছা মামণি।”
“এই তো, মিষ্টি মেয়ে আমার। আচ্ছা চলো, চা খাই একটু। শ্রাবণটা যে কখন বাড়ি আসবে? পুলিশের চাকরির জন্য ওর প্রায়ই ফিরতে রাত হয়। তোমার একা একা লাগবে খালি।”
রুশিতা ভাবলো, শ্রাবণের সাথে সাক্ষাৎ যত কম হয় ততোই ভালো। এমনিতেই শ্রাবণকে ওর সহ্য হয়না। তায় এই হঠাৎ বিয়েটার ফলে শ্রাবণের সামনে দাঁড়ালেই ওর লজ্জা লাগে। তাই ও চেষ্টা করে শ্রাবণকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে। কিন্তু শাশুড়ির সামনে তো আর সেটা বলা যায় না। রুশিতা তাই চুপচাপ উমা দেবীর পিছন পিছন চললো রান্না ঘরে, চা বানাতে।
________________________
শুভ্রার বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। রণজিৎ তালুকদার ঠিক করেছেন, তাড়াতাড়ি শুভ্রা আর অনিকের বিয়েটা সেড়ে ফেলবেন। রুশিতার ঘটনাটার পর থেকে উনি যেন আতঙ্কিত হয়ে আছেন। কখন কি অঘটন ঘটে বলা তো যায়না! সাবধানের মার নেই। শুভ্রার বিয়েটাও তাই তাড়াতাড়িই সাড়তে চাইছেন তিনি।
শুভ্রা এখন বসে আছে অনিকের ফোনের আশায়। এতদিনে ওদের সম্পর্কটা অনেকটাই গভীর হয়েছে। এটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেও বিয়ের আগের মেলামেশাটা ওদের নিজেদের মধ্যে সহজ হতে সাহায্য করেছে। সত্যি বলতে, শুভ্রা মাঝে মাঝে ধন্যবাদ দেয় নিজের ভাগ্যকে, যে ও অনিকের মতো একজন জীবন সঙ্গী পেতে চলেছে।
শুভ্রার ভাবনার মাঝেই অনিকের ফোন আসলো। শুভ্রা তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে অনিক বললো,
“কি ম্যাডাম, কি করছেন?”
অনিক মাঝে মাঝেই শুভ্রাকে ম্যাডাম বলে ডাকে। ও জানে শুভ্রা এতে লজ্জা পায়। আর তাই অনিক ইচ্ছা করেই এই নামে ডাকে ওকে। শুভ্রা বললো,
“স্যারের ফোনের অপেক্ষা করছিলাম।”
অনিক হাসলো। বললো,
“বাহ্, আমার সাথে মিশে ভালোই কথা শিখেছো আজকাল। ভাবছি, আমার সাথে থাকতে শুরু করলে কি হবে?”
শুভ্রা এবার সত্যিই লজ্জা পেলো। ও বললো,
“উফফ, আপনিও না….”
অনিক হেসে উঠলো বেশ জোরে। হাসতে হাসতেই বললো,
“নাহ্, তোমার উন্নতি হলো না আর। সেই লজ্জা পেয়েই গেলে।”
এরপর ওদের দুজনের খুনসুটিময় আলাপ চললো আরও অনেকক্ষণ। ফোনালাপ তো আর কয়েকদিন মাত্র চলবে। এরপর থেকে তো ওরা দুজন সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে, পাশাপাশি বসেই আলাপ করতে পারবে। সেই সময়টার অপেক্ষায় আছে ওরা দুই জনই।
________________________
কেটে গিয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। এই কদিনে রুশিতা মল্লিককুঞ্জে অনেকটাই সহজ হয়েছে। শ্রাবণের সাথেও আগের থেকে সহজ হয়েছে ও। টুকটাক কথাবার্তা বলে এখন ওরা দুজন। তবুও, সামান্য একটা দূরত্ব রয়েছে এখনও। তবে, শ্রাবণের ভাইবোনরা, অর্থাৎ প্রিয়ম, ঈশিতা, নিশিতা এদের সাথে বেশ ভালোই আড্ডা দেয় রুশিতা। ওদের সাথে সময়টা ভালোই কেটে যায়।
মাঝে দুইদিন কলেজেও গিয়েছে ও। কলেজে গিয়েই উর্জার সাথে দেখা হয়েছে, কারণ এর মধ্যে শান্তিনিবাসে যায়নি রুশিতা। উর্জা রুশিতাকে দেখেই রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছিলো। ফলে বিয়ের পর প্রথম দিন কলেজ গেলেও ক্লাস করা আর হয়নি রুশিতার। পরদিন অবশ্য ক্লাস করেছে ও।
এখন নিজের ঘরে বসে জামাকাপড় ভাঁজ করছিলো রুশিতা। অবশ্য, এটা ওর একার ঘর না, বরং ওর আর শ্রাবণ দুজনের ঘর এটা। শান্তিনিবাসে রুশিতার ঘরের তুলনায়ও এই ঘরটা অনেক বড়। বিছানা, সোফা, কাবার্ড, ড্রেসিং টেবিল, বেড সাইড টেবিল রাখার পরেও ঘরের অনেকটা জায়গা ফাঁকা। রুশিতা ভাবে, এতো বড় ঘর কি করতেই বা বানানো হয়েছিল?
হঠাৎ করেই, রুশিতার ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো। ফোনটা বেডসাইড টেবিলে রাখা ছিল। রুশিতা উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। ও একটু ভেবে রিসিভ করলো কলটা। অপর প্রান্ত থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনি কি রুশিতা মল্লিক বলছেন?”
বিয়ের পর এখন রুশিতার পদবি মল্লিক। ও বললো,
“হ্যাঁ, আপনি কে? আমার সাথে কি দরকার আপনার?”
“আপনার সাথেই তো দরকার ম্যাডাম! আমি কে? আমি সেই মানুষ যাকে পুরো কলকাতা শহর খুঁজছে। আপনি আমায় SB বলতে পারেন। খুব তাড়াতাড়িই আপনার ঠিকানা হবে আমার বাড়িতে। কটা মেয়েকে যেন শেষ করেছি আমি? যাইহোক, আপনিও তাদের মধ্যে একজন হবেন। আপনার মৃত্যু আসন্ন মিস রুশিতা। রেডি থাকুন।”
কলটা কেটে গেলো। লোকটার কথাগুলো রুশিতার মেরুদন্ড দিয়ে যেন ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিলো। ও থরথর করে কাঁপতে লাগলো ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতেই ও বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। আর তখনই ও শ্রাবণের কণ্ঠ শুনতে পেলো,
“কি হয়েছে রুশিতা?”
রুশিতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, দরজার কাছে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। ও উত্তর দিতে চেয়েও পারলো না, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। শ্রাবণ দ্রুত ঘরের ভিতরে এসে রুশিতার পাশে বসলো। রুশিতার হাতে ফোন ধরা দেখে আন্দাজ করলো, ফোনেই কিছু একটা হয়েছে। শ্রাবণ রুশিতার একটা হাত ধরে আশ্বাসের সুরে বললো,
“কি হয়েছে, আমায় বলো?”
রুশিতা ধীরে ধীরে পুরোটা বললো। তারপর কেঁদে ফেললো। শ্রাবণের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। কিন্তু ও অন্য কিছু না বলে রুশিতাকে সামলানোর চেষ্টা করল। ও বললো,
“শান্ত হও রুশিতা, কিচ্ছু হবে না। শান্ত হও, কেঁদো না।”
রুশিতা হাউমাউ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“ওই লোকটা আমায় মেরে ফেলবে শ্রাবণ। এতগুলো মেয়ের সাথে যা হয়েছে আমার সাথেও তাই হবে। আমি মরতে চাইনা শ্রাবণ, আমি মরতে চাইনা।”
শ্রাবণ জড়িয়ে ধরলো রুশিতাকে। রুশিতার মাথা নিজের বুকে চেপে ধরলো ও। তারপর রুশিতার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো,
“কিচ্ছু হবে না তোমার। কেউ তোমার ধারেপাশেও আসতে পারবে না। আমি আছি তো? তোমার বর বেঁচে থাকতে তোমার কিচ্ছু হবে না। শান্ত হও তুমি।”
রুশিতার কান্না থামলো না বরং বৃদ্ধি পেলো। শ্রাবণ ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বললো,
“বউ, কান্না থামাও প্লিজ, কষ্ট লাগে তো!”
চলবে………