চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-১৩

0
10

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| ত্রয়োদশ পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

রাত এগারোটায় স্টেশনে এসে পৌঁছালো শ্রাবণ। এটা গ্রামাঞ্চল, অনেক আগেই এখানের মানুষরা নিদ্রায় ডুবে গিয়েছে। স্টেশনে টিমটিম করে একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। তার আলোতেই শ্রাবণ দেখতে পেলো, একজন রোগা, গ্রাম্য চেহারার লোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন হাতে একটা হারিকেন নিয়ে। লোকটির পরনে লুঙ্গি, এবং সোয়েটার ও শালের চাদর। শ্রাবণ এগিয়ে গেলো লোকটির দিকে। লোকটি ওকে দেখেই বললো,

“বাবু, আপনিই কি সেই পুলিশের লোক, যিনি কিনা কলকেতা থেকে আসতেছেন?”

কথাবার্তায় গ্রাম্য টান। কিন্তু কেন জানি গলার স্বরটা বড় মধুর ঠেকলো শ্রাবণের কানে। ও মৃদু হেসে বললো,

“হ্যাঁ, আমিই তিনি। আপনার নামটা?”

“আজ্ঞে, আমি হলুম গে হরিপদ সামন্ত। আপনি যেখানে থাকবেন, তার থেকে একটু দূরেই আমার বাসা।”

“জঙ্গলের মধ্যে?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। খুব ঘন জঙ্গল নয় অবশ্যি। আরো কয়েকঘর মানুষ আছে ওখানে।”

“বাহ্, ভালো। তাহলে চলুন, যাওয়া যাক। কত দূর এখান থেকে? ভ্যান – ট্যান কিছু পাওয়া যাবে?”

“যে আজ্ঞে, পাওয়া তো যায়না, কিন্তু আপনে আসবেন বলে একজনকে দাঁড় করিয়ে রেখিছি। তয়, ভাড়াটা এট্টু বেশি লাগবো।”

“সে নিয়ে সমস্যা নেই। চলুন তবে।”

শ্রাবণের হাতের সুটকেসটা হরিপদ নিজের হাতে নিয়ে নিলো। তারপর স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। স্টেশনের বাইরে একজন ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ গিয়ে ভ্যানের সামনের দিকে উঠে বসলো। হরিপদ শ্রাবণের সুটকেসটা মাঝখানে তুলে দিয়ে নিজে পিছনে বসলো।

প্রায় ৪৫ মিনিট সময় লাগলো শ্রাবণের বাংলোয় পৌঁছাতে। গ্রাম ছাড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে বাংলো। তবে সেখানেও কয়েকঘর মানুষের বসতি আছে দেখা গেলো। বাংলো বলতে আর কিছুই না, একতলা একটা সাধারণ বাড়ি মাত্র। সেটার অবস্থাও বেশ জরাজীর্ণ। আশপাশে প্রচুর গাছের পাশাপাশি ঝোপ – ঝাড়ও রয়েছে প্রচুর। মশার উপদ্রব এখানে ভীষণই হবে, মনে মনে ভাবলো শ্রাবণ।

ওকে নামিয়ে দিয়ে হরিপদ বললো,

“আজ্ঞে বাবু, আমি তাহলে চলে যাই? কাল সকালে আসবো নাহয়। আর কাল আপনার রান্না মিনুর মা করে দেবে। আজ খেয়ে এসেছেন তো?”

খাওয়া বলতে বহুক্ষণ আগে শ্রাবণ একটা স্টেশনে নেমে রুটি তরকারি খেয়েছিলো। তবে সেসব পেটের কোন তলায় পরে রয়েছে কে জানে! তবুও ও কথা বাড়ালো না। মাথা নেড়ে খেয়েছে জানিয়ে বিদায় জানালো হরিপদকে।

বাড়ির ভিতরে ঢুকলো শ্রাবণ। ও আসবে বলেই হয়তো একটু ঝাড় – পোছ করে পরিষ্কার করা হয়েছে বাড়িটা। তবুও ধুলো, ঝুল আছে ভালোই। শ্রাবণের অস্বস্তি হলো একটু। এরকম পরিবেশে থাকার অভ্যাস ওর নেই। তবুও কি আর করা যাবে, এখন তো থাকতেই হবে।

তিনটে ঘরের মধ্যে সব থেকে পরিষ্কার যে ঘরটা মনে হলো, সেটাতেই নিজের সুটকেস নিয়ে ঢুকলো শ্রাবণ। ঘরের একটা চৌকি, তার উপরে তোষক পাতা। বিছানার চাদর শ্রাবণ সাথে করে নিয়ে এসেছে। সেটা ও বিছিয়ে নিলো চৌকির উপর। এই মুহূর্তে ও ভীষণ ক্লান্ত। এখন একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন ওর। যদিও এরকম অচেনা পরিবেশে ঘুম হবে কিনা সন্দেহ আছে। শ্রাবণ একটা মশার ধুপ জ্বালিয়ে দিলো ঘরের এক কোণে। তারপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো চৌকির উপর। জামাকাপড় পর্যন্ত বদলালো না, সেইটুকু ধৈর্য্যও এখন নেই ওর।
__________

বিশেষ কাজে দুই একদিনের মধ্যেই দিল্লি যাওয়ার কথা ভাবছেন রণজিৎ তালুকদার। ওনার ব্যবসায় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটা মেটাতে ওনারই যাওয়া প্রয়োজন। অথচ, এইদিকে এখন রাজনৈতিক তালগোল চলছে। সেক্ষেত্রে রাজ্য ছেড়ে বেরোনোও উচিত হবে না। উনি এই বিষয়টা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে ভুগছেন বর্তমানে।

তালুকদার সাহেবের দিনকাল অবশ্য ভালোই কাটছে। সম্প্রতি ওনার কিছু বাড়তি উপার্জনও হয়েছে। উপার্জনের পরিমাণটা অবশ্যই অনেক বেশি, যে কারণে উনি প্রফুল্ল আছেন। দলেও বেশ ভালো অবস্থান এখন ওনার। এদিকে বোনের মেয়ে শুভ্রা আর নিজের মেয়ে রুশিতার বিয়েও ঠিক করে রেখেছেন, নিজের লাভজনক পরিবারে। সব মিলিয়ে, উনি এখন সুখের চরম শিখরে অবস্থান করছেন।

তবে সুখ এমনি এমনি স্থায়ী হয়না, তার জন্য পরিশ্রম করতে হয়। কেউ কেউ শারীরিক পরিশ্রম করে, তো কেউ বৌদ্ধিক পরিশ্রম করে। তালুকদার সাহেবের পরিশ্রমটা অবশ্যই বৌদ্ধিক। নিজের পারিপার্শ্বিক সকলের থেকে তিনি সুবিধা আদায় করে নেন। ছাড় দেননা পরিবারকেও। এবারও দিল্লি যাবেন শুধু ব্যবসার কাজে নয়, অন্য উদ্দেশ্যও আছে ওনার। তবে, বোধহয় যাওয়াটা একটু পিছোতে হবে। এদিকের সব কিছু মসৃণ না করে রেখে যাওয়া যাবে না।

তালুকদার সাহেবের ভাবনার মাঝেই ওনার ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো। উনি তাকালেন ফোনের স্ক্রিনের দিকে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সুপ্রতিমের নাম। তালুকদার সাহেব বুঝলেন, বিয়ের বিষয়ে তাড়া দেবে সুপ্রতিম। কিন্তু এদিকে রুশিতাও টালবাহানা করে বিয়ে পিছিয়ে দিচ্ছে খালি। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করলেন।
________________

আজ রুশিতারা ঘুরতে বেরিয়েছে। সকাল থেকেই ঘোরা শুরু করেছে ওরা, তবে সাথে কোনো গাইড নেয়নি। আদিত্য ঠিক করেছে, ওরা একাই ঘুরবে, নিজেদের ইচ্ছামতো। গাইডের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঘুরে লাভ নেই। তাই সকাল সকাল গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে রেডি হয়ে গেছে আদিত্য। বাকিরাও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়েছে।

দুটো গাড়ি নিয়েই বেরোনো হয়েছে। আগে থেকে ঠিক করে রাখা ছিল, কয়েকটা মন্দির আর দর্শনীয় স্থান ওরা সবার আগে দেখবে। সেই অনুযায়ী সেসব জায়গাগুলো দর্শন করা হলো। এক জায়গায় কালী মায়ের মন্দিরে ওরা পুজোও দিলো। তারপর সেখান থেকে প্রসাদ খেয়ে ওরা এগোলো পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। মাঝে অবশ্য একজায়গায় থেমে নিজেদের সাথে আনা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো ওরা।

কাছের একটা আদিবাসী গ্রামে গিয়ে গাড়ি থামালো ওরা। এখানে প্রায় সবই মাটির বাড়ি। তবে কিছু ইটের গাঁথনির বাড়িও আছে। মাটির বাড়িগুলোর দেওয়ালে খরিমাটি এবং প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী রঙ দিয়ে আলপনা দেওয়া। এই আলপনাগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, এর নকশাগুলো বেশিরভাগ সময় জ্যামিতিক বিভিন্ন আকৃতির হয়। বাঙালি বাড়িতে পুজো – পার্বনে যে ফুলপাতাসহ আলপনা দেওয়া হয় তার থেকে অনেকটাই আলাদা।

ওরা এসব দেওয়ালের কিছু ছবি তুললো। তারপর কথা বললো বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের সাথে। এখানের গ্রামবাসীরা ওদের নিয়ে গেলো গ্রামের মোড়লের বাড়িতে। সেই বাড়িটা তুলনায় বড় হলেও সেটাও মাটির বাড়ি। ওদেরকে বসিয়ে জল – মিষ্টি খাওয়ালো আদিবাসিরা। ওরা অল্পক্ষণ গল্পও করলো। সব মিলিয়ে এখানে বেশ ভালো একটা অভিজ্ঞতা হলো।

এই গ্রাম থেকে বেরিয়ে আদিত্য বললো,

“চল, এবার একটু জঙ্গলের দিকে যাওয়া যাক। কপাল ভালো থাকলে দুই – একটা হরিণের দেখা পেলেও পাওয়া যেতে পারে।”

ওর কথার উত্তরে উর্মি বললো,

“আদিদা, বিকেল হয়ে গেছে। জঙ্গলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে আসবে। আমাদের গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে তো ঢোকা যাবে না। হেঁটে যেতে হবে।বিপদ – আপদও তো হতে পারে। রিস্ক নেওয়া কি উচিত হবে? তার থেকে কাল সকালে গেলেই তো হয়।”

আদিত্য ওর কথা প্রায় ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বললো,

“আরে, অ্যাডভেঞ্চারে একটু আধটু রিস্ক থেকেই। জীবনে প্রথমবার আমরা বাড়ি থেকে একা একটা ট্রিপে আসতে পেরেছি। এটাকে স্মরণীয় করে রাখতে হবে না? আমরা সবাই তো আছি, কিচ্ছু হবে না। তুই চিন্তা করিস না।”

এরপর আর কথা বলা চলে না। সবাই আবার গাড়িতে উঠে রওনা দিলো জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। যতটা অবধি গাড়ি যায় ততটা অবধি গাড়ি নিয়েই গেলো ওরা। তারপর একটু ঠিকঠাক জায়গায় গাড়ি পার্ক করিয়ে নেমে পড়লো ওরা। সত্যিই এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। জঙ্গলের ভিতরে তো আরো অন্ধকার লাগছে। যদিও এখানে জঙ্গল অনেকটাই পাতলা।

ওরা সবাই পায়ে হাঁটা পথ ধরে এপাশ ওপাশ ঘুরতে থাকলো। এখানে মানুষের চলাচল আছে, হয়তো আশপাশে বসতিও আছে। এছাড়াও অন্যান্য গ্রাম থেকে মানুষ আসে শুকনো পাতা, গাছের ডাল কুড়োতে। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো।

আদিত্য ঘুরে ঘুরে ফটো তুলছে। দুই একটা কাঠবেড়ালির ছবি তুললো, কিছু বুনো ফুলের ছবিও তুললো। বাকিরাও ফোনের ক্যামেরায় যতটা সম্ভব ফটো তোলা যায় তুলছে।

হঠাৎ রুশিতার নজর কাড়লো একটা প্রজাপতি। আকারে বেশ বড় রঙবেরঙের ডানাওয়ালা প্রজাপতিটা দেখতে মারাত্মক সুন্দর। রুশিতা যেই ছবি তুলতে গেলো, প্রজাপতিটা উড়ে গেলো। আর কি করা, রুশিতাও দৌড়ালো প্রজাপতিটার পিছন পিছন।

চলবে……