চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-১৪

0
9

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| চতুর্দশ পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

হঠাৎ রুশিতার নজর কাড়লো একটা প্রজাপতি। আকারে বেশ বড় রঙবেরঙের ডানাওয়ালা প্রজাপতিটা দেখতে মারাত্মক সুন্দর। রুশিতা যেই ছবি তুলতে গেলো, প্রজাপতিটা উড়ে গেলো। আর কি করা, রুশিতাও দৌড়ালো প্রজাপতিটার পিছন পিছন।

প্রজাপতিটার পিছন পিছন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অবশেষে একজায়গায় গিয়ে থামলো ওটা। রুশিতাও থামলো, তারপর তাড়াতাড়ি ফটো তুলে নিলো। এরপর পিছন ঘুরেই ও অবাক হলো। আশপাশে কেউ নেই! এর মানে, ও দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। আর, সম্ভবত পথও হারিয়ে ফেলেছে।

রুশিতা কিছুক্ষণ তাও এদিক ওদিক এগিয়ে দেখলো বাকিদের দেখতে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ব্যর্থ হলো। ও সত্যিই অনেক দূরে চলে এসেছে। এখন ও ফিরবে কিভাবে? ধুর, সামান্য একটা প্রজাপতির পিছনে ছুটে কি বিপদটাই না হলো।

রুশিতা নিজের মোবাইল থেকে উর্মিকে কল করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এবারও হতাশ হলো। ফোনে টাওয়ার নেই। সেটাই স্বাভাবিক, জঙ্গলের মধ্যে আর কিভাবে নেটওয়ার্ক কাজ করবে! কিন্তু এবার ও কি করবে? পুরুলিয়ায় বাঘ আছে কিনা জানা নেই, তবে হাতি নিশ্চিত আছে। এছাড়া সাপখোপ, বিষাক্ত পোকামাকড় তো আছেই। এসবের খপ্পরে পড়লে আর বেঁচে ফিরতে হবে না!

উপায় না দেখে রুশিতা এবার বিষন্নমুখে হাঁটতে থাকলো। দেখা যাক, যদি বা জঙ্গল থেকে বেরোনো যায়, বা কোনো জায়গায় একটু টাওয়ার পাওয়া যায়। বসে থাকলে তো হবে না। এখানে বসে থাকলে হাতির পায়ের তলায় চ্যাপ্টা হতে হবে।

কিন্তু আজ বোধহয় রুশিতার ভাগ্যটাই খারাপ। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এখন শুরু হলো টিপটিপ করে বৃষ্টি। মাথা ঢাকার মতো কিছুই নেই ওর কাছে। বাধ্য হয়ে চুড়িদারের ওড়নাটা দিয়েই মাথা ঢাকলো ও। অন্তত কিছুটা হলেও তো ঠান্ডা লাগার হাত থেকে বাঁচা যাবে!
_______________

বিগত একঘন্টা ধরে রুশিতাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে আদিত্য, উর্মি, উর্জা, উদিত, আয়ুশ, প্রজ্ঞা, তাপ্তি, শুভ্রা। কিন্তু কোথাও রুশিতার কোনো চিহ্ন নেই। বাধ্য হয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। রুশিতাকে কল করা হলো বেশ কয়েকবার, তবে প্রতিবারই আউট অফ সার্ভিস বলছে। তার মানে, রুশিতা জঙ্গলের ভিতরেই আছে।

উর্মি বিরক্ত হয়ে আদিত্যর দিকে তাকালো। তারপর বললো,

“আমি আগেই বলেছিলাম আদিদা, এই সন্ধ্যাবেলায় আসার দরকার নেই। কাল সকালে আসা যাবে নাহয়। এখন কি করবো আমরা? রুশুর কি অবস্থা কে জানে? এখন ওকে না নিয়ে কিভাবে ফিরবো আমরা? তুমি এখানে বড়, তোমার তো দায়িত্ববানের মতো আচরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু না, তোমার মাথায় তো অ্যাডভেঞ্চারের ভুত চেপেছিল!”

যথেষ্ট কড়াভাষায় কথাগুলো বললো উর্মি। এভাবে কখনও ও কারো সাথে কথা বলে না। কিন্তু আজ বিষয়টা অন্য। আদিত্যও ওর কথায় কিছু মনে করতে পারলো না। সত্যিই তো, তখন উর্মির কথা যদি ও মেনে নিতো, তাহলে আজ এতো বড় বিপদ হতো না। বাস্তবিকই আজ রুশিতার বিপদের জন্য আদিত্য নিজেই দায়ী।

উর্জা এবার বললো,

“জেঠুমণিকে কি বলবো আমরা? রুশিতা হারিয়ে গেছে শুনলে জেঠুমণি আমাদের আস্ত চিবিয়ে খাবে। আর তাছাড়া, এখন আমরা করবোই বা কি? রুশিতাকে তো খুঁজতে হবে?”

ওর কথার উত্তরে শুভ্রা বললো,

“রণজিৎ মামাকে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই। এখন আমরা নিয়ারেস্ট থানায় যাবো, রিপোর্ট ফাইল করবো। আমরা যে বিধায়ক রণজিৎ তালুকদারের বাড়ির লোক, সেই রেফারেন্স শেয়ার করবো এখানে। বিধায়কের মেয়ে নিখোঁজ শুনলে ওরা এখনই সার্চপার্টি নামাবে জঙ্গলে। কাল সকালের মধ্যে যদি রুশুকে খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে আমরা কখনোই মামাকে বলবো না যে এমন কিছু ঘটেছিলো। আর নাহলে তো জানাতেই হবে।”

শুভ্রার কথাটা সবারই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। এমনিতেও এখন তালুকদার সাহেবকে সব জানালে বাড়িতে কান্নাকাটির রোল পরে যাবে। আর আদিত্যর জন্য হয়তো বাড়িতে পা রাখা চিরকালের মতো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সেটা ওরা কেউই চায়না। তাই এখন শুভ্রার কথা মেনে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো উপায়।

ওরা সবাই মিলে গিয়ে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভারকে বলা হলো, যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালাতে। এখন একেকটা মুহূর্তও অনেক দামী। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় তত তাড়াতাড়ি গিয়ে থানায় রিপোর্ট লেখাতে হবে। রাতের মধ্যেই রুশিতাকে খুঁজে বের করতে হবে। কে জানে মেয়েটা কোন বিপদের মধ্যে আছে? এই অন্ধকারে সম্বল বলতে তো আছে শুধু ফোনের ফ্ল্যাশলাইট। ওই জঙ্গলের মধ্যে একা একা কিভাবে রয়েছে কে জানে? ভগবানের কৃপায় ওর কোনো বিপদ না হলেই হয়।

___________________

আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। অন্ধকার হয়ে গেছে, তাই রুশিতা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটছে। ওর মনের মধ্যে ভয়টা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বুঝি কোনো জংলী জানোয়ার আক্রমণ করলো ওকে। এখান থেকে ও বেঁচে ফিরতে পারবে তো? এই প্রশ্নটা বারবার ওর মনে উদয় হচ্ছে।

পুরো পরিবারের কথা এখন মনে পড়ছে রুশিতার। হে ভগবান, এইবার বেঁচে ফিরলে তো সুপ্রতিমকে বিয়ে করতেও আপত্তি নেই। মনে মনে ভাবলো রুশিতা। ইশশশ, কী প্রয়োজন ছিলো প্রজাপতিটার পিছনে দৌঁড়ানোর? এখনও কী ও বাচ্চা আছে? এসব বোকামির জন্যই ওকে বারবার বিপদে পড়তে হয়।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যেনো কারো গায়ে ধাক্কা লাগলো রুশিতার। ও অবাক হলো। এই জঙ্গলে আবার কে থাকবে? তাকিয়ে সামনে যাকে দেখতে পেলো, তাকে দেখে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলো রুশিতা। আরে, এটা তো সেই পুলিশ, যে কিনা কলকাতার রে’প কেসের তদন্ত করছিলো।

সামনের মেয়েটাকে দেখে অবাক হলো শ্রাবণ। একটা কাজে বেরিয়েছিল ও, ফেরার পথে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই মেয়েটা এই জঙ্গলে কী করছে? এদিকে তো বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণ বললো,

“এই, তুমি সেই ফাজিল মেয়েটা না?”

“এই, আপনি সেই গাধামার্কা পুলিশটা না?”

শ্রাবণের কথার বদলে তেড়েমেড়ে জবাব দিলো রুশিতা। কতো সাহস, ওকে কিনা ফাজিল বলে। এদিকে শ্রাবণও রেগে গেলো রুশিতার কথা শুনে। ও বললো,

“আমাকে দেখে তোমার গাধা মনে হয়?”

“আমাকে দেখে আপনার ফাজিল মনে হয়?”

“ধুর, তোমার সাথে কথা বলাই বেকার। এখানে জঙ্গলে কি করছো তুমি? একেবারে ভিজে গিয়েছো তো।”

বলবে না বলবে না করেও রুশিতা বলেই ফেললো ওর এখানে আসার ইতিবৃত্ত। সেটা শুনে তো শ্রাবণের এবার মাথায় হাত পরার অবস্থা। আরও মাথায় হাত পড়লো রুশিতার পরিচয় শুনে। এই মেয়ে রণজিৎ তালুকদারের মেয়ে! রণজিৎ তালুকদারকে চেনে শ্রাবণ। কয়েকবার সামনাসামনি দেখেওছে। ওর বাবা আর রণজিৎ তালুকদার একই দলের বিধায়ক।

পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো শ্রাবণ। তারপর বললো,

“এই বৃষ্টিতে ভিজে কাজ নেই। ফালতু জ্বর বাঁধতে পারে। তুমি আমার বাড়িতে চলো। কাল সকালে তোমায় কাছাকাছি যে থানা আছে সেখানে পৌঁছে দেবো। ওরা তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেবে।”

“আপনার বাড়ি এখানে? এই জঙ্গলে থাকেন আপনি?”

“উফফ, ভীষণ ফালতু কথা বলো তুমি। চলো, আগে বাড়ি চলো। তারপর সব বলা যাবে।”

রুশিতা একবার ভাবলো, শ্রাবণের সাথে যাবে কিনা। যদি লোকটা খারাপ হয়? ওর সাথে খারাপ কিছু করে? তারপর ভাবলো, এমনিতেও ওর সাথে এখন ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর, এই লোকটা সম্পর্কে যা শুনেছে, তাতে লোকটাকে ভালোই মনে হয়। তাই এখন এর সাথে যাওয়াই ভালো। রুশিতা তাই রাজি হয়ে গেলো শ্রাবণের সাথে যেতে।

শ্রাবণের বাড়ি, অর্থাৎ এখন ও যেখানে রয়েছে সেখানে এসে রুশিতা দেখতে পেলো আশপাশে আরো কয়েকটা বাড়ি রয়েছে। অর্থাৎ এখানে জনবসতি রয়েছে। কিছুটা দূরে একটা মন্দিরের চূড়াও নজরে আসলো ওর। রাতের অন্ধকারে এর বেশি কিছু দেখতে পেলো না।

বাড়ির ভিতরে গিয়ে শ্রাবণ ভাবলো, রুশিতাকে থাকতে দেবে কোথায়? তারপর ওর মনে হলো, ভালো ঘরটাই রুশিতাকে দেওয়া ভালো। ও নাহয় পাশের ছোট ঘরটায় থাকবে একটা রাত। রুশিতাকে ঘরটা দেখিয়ে দিলো শ্রাবণ। তারপর কি মনে করে, নিজের সুটকেস থেকে নিজের একটা টিশার্ট আর প্যান্ট বের করে রুশিতাকে দিয়ে বললো,

“চেঞ্জ করে নাও। ভিজে কাপড়ে থাকলে জ্বর আসবে। আর আমি খাবার গরম করছি, চেঞ্জ করে নিয়ে বারান্দায় চলে এসো।”

রুশিতা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবেই কাপড়গুলো নিলো রুশিতা। শ্রাবণ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ওকে কাপড়গুলো দিয়েই। রুশিতা চেঞ্জ করে নিলো। তবে কাপড়গুলো ওর তুলনায় অনেক বড়। আর সেটাই স্বাভাবিক।

ওর জামা পরিহিত অবস্থায় রুশিতাকে দেখে হাসিই পেলো শ্রাবণের। কিন্তু ও কিছু বললো না। খেতে খেতে শ্রাবণ ওর এখানে থাকার কারণ সংক্ষেপে বললো। খাওয়া শেষে রুশিতাকে ঘরে চলে যেতে বললো ও, এবং বললো দরজা ভিতর থেকে লক করে রাখতে। তারপর নিজে পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

চলবে……..