চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-১৬

0
56

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| ষোড়শ পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

শান্তিনিবাসের ড্রইংরুমে রণজিৎ তালুকদারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রুশিতা, আদিত্য, উর্মি, উর্জা, শুভ্রা, তাপ্তি, প্রজ্ঞা, আয়ুশ, উদিত। তালুকদার সাহেব শরীর সামান্য হেলিয়ে বসে রয়েছেন সোফায়। আজ তার বিচারে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকে সমান দোষী। যে কোনো মুহূর্তে হয়তো তাদের ফাঁ’সির আদেশ হবে। এই মুহূর্তে তালুকদার সাহেব তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ভীষণভাবে চেষ্টা করছেন।

শ্রাবণ ওদের সাথেই কলকাতায় ফিরেছিল, কিন্তু শান্তিনিবাসে পা রাখেনি। রুশিতাকে এখানেই রেখে গিয়েছে, বলেছে পরে নিতে আসবে। বাড়িতে ঢোকার পর রুশিতাকে দেখে সবাই ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলো এবং স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে ওকে। এরপর আদিত্য সবটা গুছিয়ে বলেছে তালুকদার সাহেবকে।

তালুকদার সাহেব সবার আগে আদিত্যর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“তোমার উপরে সব দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম আমি। সেই দায়িত্ব পালনে তো ব্যর্থ হয়েছো। নিজের স্বপক্ষে কোনো যুক্তি আছে তোমার কাছে?”

আদিত্য কিছু বললো না। চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো। এখন কোনো উত্তর দেওয়ার অর্থ হলো আগুনে ঘি ঢালা। আর তাছাড়া সত্যিই ওর কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করার মতো কোনো যুক্তি নেই। তালুকদার সাহেব ওকে ছেড়ে দিয়ে রুশিতার সামনে গিয়ে বললেন,

“তোমার বয়স কত রুশিতা?”

রুশিতা জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। তালুকদার সাহেব গর্জে উঠলেন,

“প্রশ্ন করেছি আমি তোমায়! উত্তর না দিয়ে থাকার স্পর্ধা কিভাবে দেখাচ্ছ তুমি?”

রুশিতা নিচু কণ্ঠে উত্তর দিলো,

“২১ বছর।”

তালুকদার সাহেব এবার বললেন,

“বেশ। আমার জানামতে শিশুকাল থাকে ১০ বছর অবধি। কৈশোর সম্ভবত ১৮-র আগে অবধি। মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয় ১৮ বছর বয়সে। কি, তাই তো?”

রুশিতা ভীষণ মৃদু স্বরে বললো,

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমার হিসেব অনুযায়ী তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছো আজ থেকে ৩ বছর আগেই। অথচ তুমি কিনা প্রজাপতির পিছনে ছুটতে গিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেলে! যে কাজটা কিনা ৪-৫ বছরের বাচ্চারা করলে মানা যায়। এতটা অন্যমনস্ক তুমি কিভাবে হতে পারো? সব জায়গায় কি আমি তোমাদের কোলে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো?”

রুশিতা এখনও কিছু বললো না। অন্য সময় হলে হয়তো ও তালুকদার সাহেবের চোখে চোখ রেখে কথা বলতো। যে সাহসটা এবাড়িতে শুধু ওর মধ্যেই আছে। কিন্তু আজকের বিষয়টা আলাদা। আজ রুশিতার মধ্যে কোনো কথা বলার মতো ইচ্ছা বা শক্তি নেই। ও যেন ভীষণ ক্লান্ত হয়ে আছে। সত্যিই তো সকাল থেকে ঝড় বইছে ওর উপর। ওর দিকটা কেন কেউ ভেবে দেখছে না?

তালুকদার সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারও বললেন,

“আর তোমরা বাকিরা কি ভাবছিলে জানতে পারি? কাল রাতেই আমায় কেন জানানো হয়নি যে রুশিতা নিখোঁজ? আমাকে জানালে এই পুরো বিষয়টা এড়ানো যেত তা আশা করি তোমরা ভালোভাবেই জানো। তবুও কেন আমার কাছে সবটা গোপন করেছো তোমরা? আমার নিজের ভাইপো ভাইঝিরা আমার থেকে এতকিছু লুকিয়ে যাচ্ছে। আমি কাকে বিশ্বাস করবো এখন? এতো কিছু হয়ে গেলো অথচ আমি জানলাম না। জানিনা এখন সুপ্রতিমকে কি জবাব দেবো আমি!”

রুশিতা এবার মুখ খুললো,

“যা সত্যি সেটাই বলবেন। এমন তো নয় যে আপনি সুপ্রতিমের দাস, তাই তার ভয়ে আপনাকে তটস্থ থাকতে হবে।”

তালুকদার সাহেবের চোখজোড়া রাগে রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো। তিনি বললেন,

“তোমার জন্ম থেকে এই ২১ বছরে এই প্রথম আমার তোমাকে মারতে ইচ্ছা করছে। বড়োদের সম্মান দেওয়াটাও ভুলতে বসেছো দেখছি!”

“যার যতটা সম্মান প্রাপ্য আমি তাকে ঠিক ততটাই সম্মান দিই বাবা। অতিরিক্ত যে কোনো কিছুই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। হ্যাঁ, যেটা হয়েছে তাতে আমাদের সবার দোষ আছে। হ্যাঁ, পুরোটা মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু এমনিতেও কদিন পরে তো আমার বিয়েই দিতেন আপনি। শ্রাবণ নিজে পুলিশে চাকরি করে, তার বাবা আপনারই দলের বিধায়ক, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? নাকি সুপ্রতিমের সাথে বিয়ে দেওয়ার পিছনে আপনার কোনো স্বার্থ ছিল?”

রণজিৎ তালুকদার এবার বাস্তবিকই চড় মারার জন্য হাত তুললেন রুশিতার দিকে। কিন্তু রুশিতা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বললো,

“খবরদার, ওই ভুলটি করবেন না। সত্যিটা আপনার কাছে তেতো লাগতেই পারে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমাকে মারলে কিন্তু আপনার উপর অনেক অ্যালিগেশন লাগতে পারে, ভুলে যাবেন না যে আমি একজন পুলিশের স্ত্রী।”

কথাটা বলেই রুশিতা ড্রইংরুমের একপাশের পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। তালুকদার সাহেব এবং বাকিরা সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে। রুশিতা বরাবরই প্রতিবাদী, কিন্তু আজ যেন আগুন ঝরলো ওর প্রতিটা বাক্যের সাথে সাথে। তালুকদার সাহেব চূড়ান্ত বিস্মিত হলেন আজ। তার নিজের মেয়েই আজ তাকে চুপ করিয়ে দিলো?

রুশিতা নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানায়। এরপর কান্নায় ভেঙে পড়লো ও। এতক্ষণ সকলের সামনে নিজেকে শক্ত দেখিয়েছে ও। বুঝতে দেয়নি যে ওর মনের ভিতরে কি চলছে। কিন্তু এখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না।

নিজের প্রতি, সকলের প্রতি এখন বিরক্ত রুশিতা। ও আদৌ জানেনা কাল থেকে ওর জীবনটা কেমন হবে। জানেনা আদৌ শ্রাবণ ওকে নিতে আসবে কিনা, নাকি ডিভোর্স দিয়ে দেবে ওকে। বিভিন্ন অনিশ্চয়তার মাঝে আটকে আছে ওর জীবন। আর ও শান্তিতে একটু কাঁদতেও পারছে না। ওর জীবনটাই কেন এরকম হলো? একটু ভালো থাকা কি ওর ভাগ্যে নেই?

__________________________

নিজের সারা ঘর ভাঙচুর করছে শ্রাবণ। কাঁচের জিনিসগুলো ভাঙার ফলে হাত থেকে রক্ত ঝরছে। কিন্তু ওর তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। ও যেন আজ ধ্বংসলীলায় মেতেছে। নিজের সমস্ত রাগ এই জড় পদার্থগুলোর উপরেই ঝাড়ছে ও।

আজকের দিনটাই শ্রাবণের হাতে সময় আছে, নিজের যত রাগ, যত কষ্ট সব প্রকাশ করে নেওয়ার। কাল রুশিতাকে নিয়ে আসবে ও। কালকের পর থেকে আর এভাবে রাগের প্রকাশ করা যাবেনা। যতই হোক, সেই মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই। তাই তাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।

বাড়ির লোককে সমস্তটা বোঝাতে অনেক সময় লেগেছে শ্রাবণের। অনেক অযাচিত প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে ওকে। ওর মা, উমাদেবী বারবার রুশিতার ছবি দেখতে চাইছিলেন। কিন্তু শ্রাবণ কোথায় পাবে রুশিতার ছবি?

শেখর মল্লিক তো সম্পূর্ণ বিষয়টায় ভীষণই অসন্তুষ্ট। কারণ, রুশিতা হলো রণজিৎ তালুকদারের মেয়ে। আর রণজিৎ তালুকদার হলেন শেখর মল্লিকের দুই চোখের বিষ। তাই শ্রাবণের ধারণা হয়েছে, এবাড়িতে আসার পরে রুশিতাকে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। আর যেহেতু ও দিনের বেশিরভাগ সময়টাই বাড়ির বাইরে থাকে, তাই সেগুলো সামলাতেও পারবে না শ্রাবণ।

একটা সামান্য সাহায্যের হাত বাড়ানোর ফলে কত কিছু বদলে গেলো। শ্রাবণের জীবনটা অনিশ্চয়তার। কিছুদিন আগেই তো প্রায় ম’র’তে বসেছিল ও। আর এটা ও জানে বলেই নিজের জীবনে কাউকে জড়াতে চায়নি কখনও। এই জন্যই বাবা মার শত অনুরোধেও বিয়েতে রাজি হয়নি কখনও। কিন্তু সেই ওকে বিয়ে করতেই হলো, তাও কিনা এমন একটা পরিস্থিতিতে।

ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসলো শ্রাবণ। সকাল থেকে কিছুই খায়নি ও। রাস্তায় রুশিতার দাদা আদিত্য বারবার অনুরোধ করেছিল খাওয়ার জন্য, শ্রাবণ গা গোলানোর অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে। বাড়ি আসার পরেও কিছু খায়নি। এখনও খেতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু শরীরটা ক্লান্ত লাগছে এখন। ওর এখন একটু ঘুমের প্রয়োজন। যদিও ঘুম আসবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এমনিতেও তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, কাল সকালে রুশিতাকে এনে বাড়িতে রেখে যেতে হবে থানায়। পুরুলিয়া যে কাজে গিয়েছিলো সেটা সম্পূর্ণ করেই এসেছে, সেই বিষয়ে রিপোর্ট জমা করতে হবে।

চলবে………..