চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
7

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| বিংশ পর্ব || (শেষ)

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

আজ শুভ্রার বিয়ে। শান্তিনিবাস জুড়ে আজ প্রচুর ব্যস্ততা। পুরো বাড়িটা ভরে আছে আত্মীয় স্বজনে। ধুমধাম করেই বিয়েটা হচ্ছে। পুরো বাড়ি সেজে উঠেছে ফুল – আলোর সাজে।

রুশিতা এবং শ্রাবণ সকাল থেকেই এইবাড়িতে আছে। মল্লিককুঞ্জের বাকি সদস্যরা সন্ধ্যায় আসবেন। ওরা দুজন সারাদিন থাকবে এখানে। রুশিতা তো সকাল থেকেই এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আর শ্রাবণ খালি ওর পাগলামিগুলো দেখে যাচ্ছে।

রুশিতা আর শ্রাবণের বিয়ের এক মাস হয়ে গিয়েছে। এই একমাসে ওরা দুজন একে অপরের অনেক কাছাকাছি এসেছে। ওদের সম্পর্কটা অনেক দৃঢ় হয়েছে এখন। শ্রাবণ যেন রোজ রোজ নতুন করে রুশিতার প্রেমে পরে এখন। অবশ্য, নিজের বউয়ের প্রেমে পড়া খারাপ কিছু নয়।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য শুভ্রাকে তৈরী করছে সবাই মিলে। তবে মূলত শুভ্রাকে সাজাচ্ছে উর্মি আর উর্জাই। বাকিরা বসে বসে গল্প করছে। রুশিতা গল্প করতে করতেই সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। ওর মনে পড়ে গেলো সেই দিনটার কথা, যেদিন শ্রাবণরা SB -কে গ্রেফতার করেছিল।

SB -ই যে সুপ্রতিম, সেটা জানার পর রুশিতার চোখমুখের অবস্থা দেখার মতো হয়েছিল। আর শ্রাবণ ওর সামনে বসে খালি হেসে যাচ্ছিলো। রুশিতা তখন বারবার কপালে হাত ছোঁয়াচ্ছে আর ভাবছে যে ভাগ্যিস ও জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিলো আর শ্রাবণের সাথে বিয়েটা হয়েছিল। নাহলে তো সুপ্রতিমের সাথেই বিয়েটা হতো ওর। ভাবতেই রুশিতা শিউরে উঠেছিল।

রণজিৎ তালুকদারও অবাক হয়েছিলেন সুপ্রতিমের আসল পরিচয় জানার পর। তিনি এমন কিছু আন্দাজও করতে পারেননি। হয়তো উনি একটা শিক্ষাও পেয়েছেন যে, সবকিছুতে স্বার্থ দেখতে গেলে নিজেরই ক্ষতি হয়। সুপ্রতিমের বাবার সাথে একটা বিজনেস ডিল ক্লিয়ার করার জন্য উনি বিয়ের সম্বন্ধটা করেছিলেন। অথচ কত বড় ভুল করেছিলেন সেটা তিনি বুঝেছেন।

সেইদিন প্রথমবারের মতো বাবাকে আবেগপ্রবণ হতে দেখেছিলো রুশিতা। তালুকদার সাহেব শ্রাবণের হাতদুটো ধরে বলেছিলেন,

“আমার মেয়েটাকে তুমি বাঁচিয়েছো শ্রাবণ। তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।”

তালুকদার সাহেবের চোখ ছলছল করছিলো সেই মুহূর্তে। সবাই-ই অবাক হয়েছিল ওনার ওরকম চেহারা দেখে। আসলে, সবাই তো ওনাকে কঠোর রূপেই দেখে অভ্যস্ত। তাই ব্যতিক্রমী চেহারাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো সবারই। বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে বাস্তবেই এমনটা ঘটেছে।

আর সুপ্রতিম? পুলিশের জেরায় সে যা বয়ান দিয়েছে তা শুনে গায়ের রোম খাড়া হয়ে গিয়েছে সকলের। সুপ্রতিমের ভাষ্যমতে, ছোটবেলায় ওরা হায়দ্রাবাদে থাকতো। সুপ্রতিমের যখন আঠারো বছর বয়স, তখন ওরা কলকাতায় আসে। ওর একটা বোন ছিল, যে ওর থেকে চার বছরের ছোট। কলকাতায় আসার দুই বছর পর, হঠাৎ একদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে ওর বোনকে তুলে নিয়ে গিয়ে কয়েকটি ছেলে ধ*র্ষ*ণ করে। আর তার পর থেকেই সুপ্রতিমের সমগ্র কলকাতার প্রতি ঘৃণা জন্মায়, এবং সে ধীরে ধীরে পরিণত হয় একজন সাইকোতে।

ফাঁসি হয়েছে সুপ্রতিমের। প্রায় তিরিশটা ধ’র্ষ’ণের উপযুক্ত শাস্তি এটাই মনে হয়েছে বিচারকদের। পুরো কলকাতা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সুপ্রতিম সাজা পাওয়ার পর। কিন্তু সুপ্রতিম মরে গিয়েও একটা কথা প্রমাণ করে দিয়ে গেলো, Villains are not born, they are made by the society.

রুশিতার ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটালো তাপ্তি। সে রুশিতার মাথায় টোকা মেরে বললো,

“কি রুশুদি, বসে বসে বরের কথা ভাবছিস বুঝি?”

সবাই হেসে উঠলো তাপ্তির কথা শুনে। রুশিতা চোখ পাকিয়ে তাকালো তাপ্তির দিকে। বললো,

“ভীষণ পেকেছিস তুই তাপ্তি!”

তাপ্তি পাত্তাও দিলো না ওর কথায়। বাকিরাও দিলো না। উর্মি রুশিতাকে বললো,

“রুশু, এমনি এমনি বসে না থেকে তৈরী হয়ে নে যা। পরে দেখা যাবে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে আর তুই তৈরী হোসনি।”

এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। আর সেইজন্যই উর্মি রুশিতাকে একপ্রকার ঠেলা মেরেই পাঠালো তৈরী হতে। রুশিতা রুমে এসে দেখলো বিছানার উপর শ্রাবণ শুয়ে আছে। রুশিতা বললো,

“এই, বাইরে যাও তুমি।”

শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুশিতার দিকে। প্রশ্ন করলো,

“কেন?”

“আমি জামা বদলাবো।”

“তো?”

শ্রাবণের ডোন্ট কেয়ার মুডে “তো” বলা শুনে রুশিতা অবাক হয়ে গেলো। ও বললো,

“তো মানে? বাইরে যান এক্ষুনি।”

শ্রাবণ হাসতে হাসতে বাইরে চলে গেলো। রুশিতা ভিতর থেকে দরজা আটকে দিলো। তারপর তৈরী হতে শুরু করলো।

_______________________________

সন্ধ্যায় বিয়ের অনুষ্ঠান। সবাই সুন্দর করে সেজে ঘুরছে। রুশিতা একটা গাঢ় গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে, চুলে সুন্দর করে খোঁপা বেঁধেছে। সাথে আছে স্বর্ণের গহনা। এমনিতেই রুশিতা দেখতে খুবই সুন্দর। তায় আজকে সাজার ফলে ওকে অপরূপ সুন্দর লাগছে দেখতে।

শ্রাবণ একটা কালো রঙের শেরোয়ানি পরেছে। শ্রাবণের দিক থেকেও চোখ ফেরানো মুশকিল আজ। বিয়েতে নিমন্ত্রনে আসা কয়েকটি মেয়ে তো চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে শ্রাবণকে। বিষয়টা রুশিতার চোখ এড়ালো না। ও তাই সোজা শ্রাবণের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

“কেমন লাগছে আমায়?”

শ্রাবণ রুশিতার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বললো,

“রাণী রাণী লাগছে তোমায়। এবার থেকে দেখছি রাণীসাহেবা বলে ডাকতে হবে।”

রুশিতা লজ্জা পেলো। ওকে লজ্জা পেতে দেখে হাসি পেলো শ্রাবণের। রুশিতাকে লজ্জায় ফেলতে ওর মজাই লাগে। এখনও মজা লাগলো ওর।

একপাশে স্টেজ করা হয়েছে প্রোগ্রামের জন্য। শুভ্রার সব কাজিনরা নাচ – গান করবে স্টেজে। প্রথমে কিছু সোলো, গ্ৰুপ পারফরমেন্স হওয়ার পর উর্জা ঘোষণা করলো,

“এবার কাপল ডান্স করবে আমাদের সবার ফেভারিট কাপল রুশিতা অ্যান্ড শ্রাবণ জিজু!”

রুশিতা আর শ্রাবণ দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। ওরা তো কোনো নাচ প্র্যাক্টিস করেনি। কিন্তু বাকিরা ওদের ঠেলে স্টেজে উঠিয়ে দিলো। উর্জা গান চালালো। শ্রাবণ এবং রুশিতা কোনো প্রিপারেশন ছাড়াই নাচ শুরু করলো —

Tere saamne aa jaane se
Yeh dil mera dhadka hai,
Ye galti nahi hai teri
Kusoor nazar ka hai.

Tere samne aa jaane se
Yeh dil meraa dhadka hai
Yeh galti nahi hai terii
Kusoor nazar ka hai.

Jis baat ka tujhko darr hai
Wo karke dikha dunga,

Aise na mujhe tum dekho
Seene se laga lunga
Tumko main chura lunga tumse
Dil mein chupa lunga…

নাচ শেষ হতে সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। এরকম রোমান্টিক একটা গানেও ওরা দুজন যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখে নাচ করেছে। আর সেটাই নজর কেড়েছে সবার। বাকিদের নজর এড়িয়ে শ্রাবণ রুশিতার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। তারপর কানে কানে ফিসফিস করে বললো,

“দেখলে তো, তোমার বর কত সুন্দর নাচ জানে?”

রুশিতা মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। শ্রাবণ ওর যাওয়ার পথের দিকে হাসতে থাকলো।

এরপর আদিত্য এবং সুনয়নাকে দিয়েও কাপল ডান্স করালো উর্জা। আদিত্য আর সুনয়নার বিয়ে দুই পরিবারের সম্মতিতেই ঠিক হয়ে আছে, তবে আরও মাসছয়েক পর হবে বিয়ে। আজ শুভ্রার বিয়েতে সুনয়নার পরিবারকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছে।

_______________________________

ফুচকার স্টলের দিকে যাচ্ছিলো উর্মি। অন্যমনস্ক হয়ে চলার ফলে হুট্ করেই কারো সাথে ধাক্কা লাগলো ওর। সামনে তাকিয়ে যাকে দেখলো, তাকে ও মোটেই আশা করেনি এখানে। উর্মির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অরূপ, সেই ব্যক্তি যে উর্মি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সময় ওকে ধরেছিলো। উর্মি বললো,

“আরে, আপনি এখানে?”

অরূপও অবাক হয়েছে উর্মিকে দেখে। সে বললো,

“আমি তো রণজিৎ তালুকদারের ভাগ্নির বিয়েতে এসেছি। আমার বাবা আর তালুকদার সাহেব ফ্রেন্ড। কিন্তু তুমি তালুকদার সাহেবের কে হও?”

“উনি আমার জেঠু হন, মেজো জেঠু।”

এরপর টুকটাক কথায় কথায় উর্জার সাথে গল্প জুড়ে দিলো অরূপ। উর্জারও মন্দ লাগলো না গল্প করতে। চারদিকে এতো জুটি দেখে বোধহয় ওরও জুটি বাঁধতে ইচ্ছা হলো।

_______________________________

রুশিতাদের পাল্লায় পরে অনিকের পকেট সত্যিই ফাঁকা হয়ে গেলো। জুতো লুকিয়ে, গেট ধরে অনেক টাকাই আদায় করেছে ওরা। বেচারা অনিক কিছু বলতেও পারলো না। অনিকের দুর্দশা দেখে শুভ্রা মিটিমিটি হাসলো শুধু।

লাল বেনারসিতে শুভ্রাকে ভীষণই সুন্দর লাগছে। আসলে, বিয়ের দিন প্রতিটা মেয়েকেই সুন্দর দেখায়। অনিক নজর ফেরাতে পারছিলো না শুভ্রার দিক থেকে। শুভ্রার মায়াবী চেহারা যেন ওকে সম্মোহন করে রেখেছে।

সুন্দর ভাবে ওদের বিয়েটা হয়ে গেলো। অগ্নিসাক্ষী করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো দুজন। সারা জীবনের জন্য এক হয়ে গেলো ওদের পথচলা।

_______________________________

সব অনুষ্ঠান শেষে ঘরে আসলো রুশিতা। শ্রাবণ আগেই ঘরে চলে এসেছে। ওর নাকি মাথা ব্যাথা করছে। রুশিতা ঘরে এসে দেখলো, শ্রাবণ বিছানায় শুয়ে আছে। রুশিতা দরজাটা আটকে তারপর জিজ্ঞাসা করলো,

“মাথা ব্যাথা কমেছে?”

শ্রাবণ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। রুশিতা এবার গয়নাগুলো খোলার উপক্রম করলো। শ্রাবণ ওকে বাঁধা দিয়ে বললো,

“একটু দাঁড়ান রাণীসাহেবা।”

শ্রাবণের ডাকটা শুনে লজ্জায় নুইয়ে গেলো রুশিতা। শ্রাবণ উঠে দাঁড়িয়ে রুশিতার গলায় একটা স্বর্ণের চেন পরিয়ে দিলো। চেনের মধ্যে একটা লকেট, যাতে একটা লাভের মধ্যে S+R চিহ্ন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাস্টমাইজ করা লকেটটা। রুশিতা অবাক চোখে শ্রাবণের দিকে তাকাল। শ্রাবণ বললো,

“বিয়ের পর থেকে তোমায় কোনো উপহার দেওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম আজ কিছু দিই তোমায়। পছন্দ হয়েছে তো?”

“অনেক, অনেক পছন্দ হয়েছে। এত্ত সুন্দর একটা লকেট, পছন্দ হবে না কিভাবে?”

শ্রাবণ হাসলো। তারপর রুশিতার কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে বললো,

“ভালোবাসি রুশিতা, অনেক ভালোবাসি তোমায়। চলো না, বিয়ের পরেই নাহয় আমাদের একটা প্রেমকাহিনীর সূচনা হোক? ছবির মতো সুন্দর একটা প্রেম? ভালোবাসবে আমায় রুশিতা?”

রুশিতা কাঁপছে। শ্রাবণের হাত খামচে ধরে সে বললো,

“ভালোবাসি শ্রাবণ, আমিও অনেক ভালোবাসি তোমায়।”

শ্রাবণ রুশিতার কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো। তারপর বললো,

“কি নাম দেওয়া যায় বলোতো আমাদের এই প্রেমের? হুমম…. চিত্রার্পিত প্রেম! ছবির মতো শান্ত, অথচ সুন্দর এক প্রেম। সুন্দর না? চলো রুশিতা, প্রেমসায়রে ভাসা যাক।”

অতঃপর আর কি? প্রেমসায়রে ভাসার মধ্য দিয়ে সূচনা হলো শ্রাবণ রুশিতার চিত্রার্পিত প্রেমের। দুজনে মিশে গেলো প্রেমের চরম উষ্ণতায়।

~ সমাপ্ত ~