চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব-২১+২২

0
1088

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২১

বিছানার উপর পা তুলে বসে আছে স্পর্শী। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। নির্বাণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু দিয়ে বারংবার গালে ঘর্ষণ চালাচ্ছে আর বিরবির করে কিছু একটা বলেই চলেছে। মাঝে মধ্যে ঘুরে স্পর্শীকে জিজ্ঞেস করে উঠছে, “পরিষ্কার হয়েছে?” স্পর্শী হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেওয়া সত্ত্বেও ক্ষান্ত হচ্ছে না সে, বার বার গাল ঘষেই চলেছে। ইতিমধ্যে গালের সেই অংশটুকু রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কিয়ৎক্ষণের বেশি এইভাবে চলতে থাকলে হয়তো জায়গায়টা ছুঁলে যাবে। নির্বাণের এমন কান্ড দেখে স্পর্শী বিকেলের কথা মনে পড়ে যায়। সে সময় নাহিদ নির্বাণকে জড়িয়ে না ধরলেও মাস্কের ভেতর দিয়ে গালে হালকা কাঁদা ছুঁয়ে দেয়। এই নিয়ে নির্বাণের যে কাণ্ড। বকে-টকে রাখেনি নাহিদকে। তবে, সারা শরীরে কাঁদা লেগে থাকায় নাহিদ মাইর থেকে বেঁচে যায়। অন্যথায় নির্বাণের হাতে হয়তো আজ সে শহিদ হয়েই যেত। মেলা থেকে নির্বাণ কোনমতে তড়িঘড়ি করে বাসায় এসে দু’বার ফ্রেশ হয় তবুও যেন তার মনের খুঁতখুঁতানি ভাবটা অতিক্রম করে উঠতে পারেনি। সে যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কার্য চলমান রেখেছে তো রেখেছেই।
স্পর্শীর ভাবনার মাঝেই নির্বাণ চতুর্থবারের মত জিজ্ঞেস করে উঠে,

“দেখ তো, পরিষ্কার হয়েছে কি-না?”

স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়৷ অবসন্ন সুরে বলে, “বলছি তো হয়েছে। এই নিয়ে চারবার একই কথা জিজ্ঞেস করলেন, এখন আর কিভাবে বুঝাই আপনাকে আমি?”

নির্বাণ অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে একবার স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় আয়নাতে তাকালো। হাতের টিস্যুটা ফেলে আবার নতুন টিস্যু নিয়ে পূর্ণ উদ্যোমে গালে ঘষা শুরু করলো। স্পর্শী এইবার হতাশাজনক নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো, শব্দহীনভাবে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই আবার ফিরে আসলো সে, বাটিতে বরফ নিয়ে৷ বাটিটা বিছানার উপর রেখে এগিয়ে গেল নির্বাণের দিকে। নির্বাণের চলন্ত হাতের কব্জি ধরে মন্থর কন্ঠে বলে, “হয়েছে, আর কত? জায়গায়টা কেমন লাল হয়ে আছে দেখেছেন? আরেকটু হলে তো চামড়া ছিলে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। থামেন এবার।”

কথাটা বলে স্পর্শী নির্বাণের হাত থেকে টিস্যুটা নিয়ে ফেলে দিল। অতঃপর নির্বাণকে টেনে বিছানায় বসালো। বাটি থেকে এক টুকরো বরফ নিয়ে চেপে ধরলো গালে। সপ্তপর্ণে গালের চারপাশে হিম পরশ বুলিয়ে দিতে থাকলো। কন্ঠে তীব্র রাগ মিশিয়ে বলল,

“আপনি না বলেন, অতিরিক্ত কিছুই ভালো না? তাহলে নিজের বেলায় কেন মানেন না? সামান্য কাঁদা লেগেছে। কোন ক্ষতিকারক এসিড না যে আপনি এমন করছেন। ইশশ কি অবস্থা করেছেন জায়গাটার, দেখেছেন একবার?”

নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না, নীরব রইলো। নিভৃতে তাকালো স্পর্শীর দিকে। দুইজনের মাঝে দূরত্ব কিঞ্চিৎ, দূরত্ব ঘুচে গেলেই তীব্রভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি গণনা করা যাবে। ক্ষণে নির্বাণের ইচ্ছে করলো দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিতে। ভাবনাটা কার্যকরী করতেই নির্বাণ কিঞ্চিৎ সময় বিলম্ব না করে স্পর্শীর কোমর চেপে ধরে তাকে নিজের দিকে টান দেয়। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠার আগে স্পর্শী ঝুঁকে পড়ে নির্বাণের দিকে, দুই আঙ্গুলের ফাঁক থেকে ছুটে পড়ে বরফের টুকরোটি। ভর সামলাতে হাত গিয়ে ঠেকে নির্বাণের বুকে। এক গাছি চুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুখে, বৃহৎ বিস্ময়ান্বিত দৃষ্টি তাকায় সে। নির্বাণ ধীর হাতে স্পর্শীর মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়,

“নিজের স্যারের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছ? মনে ডর-ভয় নেই? এখন আমি যদি তোমায় শাস্তি দেই, মানা করার সাধ্য আছে তোমার?”

স্পর্শী অস্ফুটস্বরে বলে, “এইটা ভার্সিটি না, আর না আপনি এখন আমার স্যার।”

“তাহলে আমি এখন কি তোমার? সেটা বুঝে না-হয় শাস্তি দিব তোমায়।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। লজ্জায়,সংশয়,সংকোচে মেদুর গালে ছড়ায় রক্তিমা। শব্দ,বাক্য হয় নিরুদ্দেশ। নির্বাণ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হয় নাহিদের কন্ঠ। ভড়কে উঠে দু’জনেই। নির্বাণ তৎক্ষনাৎ কোমর থেকে হাত সরাতেই স্পর্শী লাফিয়ে সরে দাঁড়ায় নির্বাণের নিকট হতে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায় দরজার দিকে। পরমুহূর্তে নাহিদ এসে বলে,

“ভাবী আপনাকে মা ডাকছে আর ভাই মা তোকে সব গুছিয়ে রাখতে বলেছে। রাতের খাবার খেয়েই রওনা হবো আমরা।”

স্পর্শী কোনমতে মাথা দুলিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে শয়নকক্ষ ত্যাগ করে। স্পর্শী যেতেই নির্বাণ রাগান্বিত নয়নে তাকায় নাহিদের দিকে, ক্ষণেই নাহিদের অভিব্যক্তি পাংশুটে হয়ে যায়। নির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তুই একবার ঢাকা চল। সব হিসাব-নিকাশ যদি সুদে আসলে না চুকিয়েছি আমি তাহলে দেখিস।”

নির্বাণের কথার শুনে নাহিদ ধরে নিল নির্বাণ তাকে বিকেলের ঘটনার জন্যই শাসাচ্ছে। সেই ঘটনার রেশ ধরে নাহিদ আমতা-আমতা সুরে বলে, “আরেহ ভাই সরি না, আমি ফাজলামো করতে চাচ্ছিলাম শুধু। তোকে কাঁদা লাগানোর কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না, সব ভুলবশত হয়েছে। এইবারের মত মাফ করে দে, জীবনেও আর তোর ধারের কাছে ঘেষবো না। প্রমিস!”

নির্বাণ পুনরায় চোখ রাঙানো মাত্র নাহিদ মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে, “মৃদুল আমায় বিছানায়, ধুর! রুমে ডাকছে। আমি যাই!”

কথাটা বলেই নাহিদ কেটে পড়ে। নির্বাণ সেদিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় গিয়ে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। তার মনে এখনো আশঙ্কা আছে তার গাল পরিষ্কার হয়নি।

_____________________

নিস্তব্ধ রাত্রি। অনিলের তীক্ষ্ণতা পেরিয়ে হাইওয়ের রাস্তা ধরে শা শা শব্দে চলছে গাড়ি। গাড়ির ইনার লাইট অফ থাকায় বুঝা যাচ্ছে না ভিতরকার অবস্থা। বাহিরে হতে মাঝে মধ্যে সোডিয়াম লাইটের টুকরো টুকরো আলো গাড়ির জানালা ভেদ করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে স্পর্শীর ঘুমন্ত মুখশ্রীতে। শ্যামময়ী নারীর ঘুমে ব্যাঘাত আনার প্রবল চেষ্টা যেন। পিছনে নিলুফা আর নাহিদও তন্দ্রাঘোরে বিভোর। নির্বাণ রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিমর্ষচিত্তে তাকালো স্পর্শীর পানে। ঘুমন্ত মানবীর মুখশ্রী জুড়ে তখন আদুরে ভাব বিরাজমান। আর কিঞ্চিৎ প্রহর আছেই তারা একসঙ্গে, অতঃপর পুনরায় দুইজনে দুই প্রান্তে। ফের কবে একত্রে আসবে দুইজনে কে জানে? যত গাড়ি এগুচ্ছে ততো নির্বাণের হৃদয়ে দহনক্রিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কয়েকদিনের ব্যবধানেই মানুষটা যে অজান্তেই তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে, সেই অভ্যাস এখন কি করে ছাড়াবে সে? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো নির্বাণ৷

কিঞ্চিৎ প্রহর পরেই পূবাকাশে অগ্নিপিণ্ডের স্নিগ্ধ আভার দেখা মিললো। কৃষ্ণ আকাশ আবৃত হলো নীলাভ-সাদা চাদরে। পাখিদের কলধ্বনি গুঞ্জিত হলো চারদিক। নির্বাণ নাহিদ ও নিলুফাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ছুটলো স্পর্শীর কোলানির দিকে৷ দেখতে দেখতেই গাড়ি এসে থামলো ‘ব্যাংক টাউন’ কোলানির সামনে। নির্বাণ সিটবেল খুলে ঘুরে বসলো স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী তখনও ঘুমে কাঁদা। আলতো স্বরে ডাকলো নির্বাণ। কিয়ৎকাল পর গোঙানির মত শব্দ করে স্পর্শী পিটপিটিয়ে চাইলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,

“কি হয়েছে? এত সকালে ডাকচ্ছেন কেন?”

নির্বাণ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “তোমার বাসা এসে গিয়েছে। উঠো!”

কথাটা কর্ণপাত হওয়ার মাত্র স্পর্শী টনক নাড়লো। চোখ টানটান করে তাকালো চারিপাশে। নিজের কোলানীর সামনে গাড়ি দেখে স্থির হলো সে। অতঃপর পিছন সিটের দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মা আর নাহিদ ভাই কোথায়?”

“বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছি।”

স্পর্শী চমকিত হবে বলে, “কখন? আর আমাকে ডাকেননি কেন? মা কি ভাবছে বলুন তো? বিদায়ও নিতে পারলাম না।”

“কিছু ভাবছে না সে। মা এইসব বিষয় এত একটা গুরুত্ব দেয় না। চিন্তার বিষয় নেই।”

স্পর্শী অপ্রসন্ন হয়, “তাও তো!”

কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকে সে। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “আচ্ছা, আমি যাই।”

নির্বাণ তখন স্পর্শীর দিকেই তাকিয়ে ছিল। মুহূর্তে চোখাচোখি হলো তাদের। স্পর্শী লজ্জায়,সংকোচে দৃষ্টি নামালো। নির্বাণ অকস্মাৎ বলে উঠে, “স্পর্শী!”

নির্বাণের মোলায়েম কন্ঠে সম্মোধনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “জি?”

“সাবধানে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো।”

“আপনিও রেখেন।”

নির্বাণ কিছু বলল না। নীরবে এগিয়ে এলো স্পর্শীর মুখের সম্মুখে৷ নির্বাণ এগিয়ে আসতে দেখে স্পর্শী পিছালো না, সে জানে নির্বাণ তার সিটবেল খুলে দেওয়ার জন্যই এগুচ্ছে। খামাখা মাথা পিছিয়ে ইজ্জতের ধূলিসাৎ করার মানে হয়-না। কিন্তু নির্বাণ স্পর্শীর ভাবনার উর্ধ্বে গিয়ে এক অপ্রকাশিত কাজ করে বসল। নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া আলতোভাবে চেপে ধরে স্পর্শীর ললাটে। অনন্তর, খুব আদুরে ভঙ্গিতে স্পর্শীর গালে হাত রেখে বলে, “আমার অভ্যাসগুলো এইভাবেই পরিবর্তন না করলেই পারতে।”

কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীর সিটবেল খুলে দিয়ে সরে আসে সে। দৃষ্টি স্থির করে সামনে। ঘটনাক্রমে স্পর্শী বিমূঢ়,বিহ্বল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকায় সামনে৷

#চলবে

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২২

বিছানার একপার্শ্বে দেয়ালে মেরুদণ্ড ঠেকিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে বসে আছে স্পর্শী। দৃষ্টি তার স্থির উড়ন্ত নীলাভ পর্দার দিকে। পর্দার আস্তরণ ভেদ করে এক মুঠো রোদ হামাগুড়ি খাচ্ছে শুভ্র মেঝেতে। নিদ্রাভর নয়নে ভাসছে শ্যামপুরুষের স্নিগ্ধ মুখশ্রী, মনের দুয়ারে বিচরণ করেছে তার সাথে কাটানো স্মৃতি। কিঞ্চিৎ সময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মৃতি চারণ হতেই স্পর্শী নিজ অজান্তে হাত ছোঁয়ায় কপালের মধ্যভাগে। মানুষটার অকৃত্রিম স্পর্শ লেগে আছে এইখানে। মুহূর্তে লালাভ রঙটি নিবিড়ে খেলা করে যায় ফুলো দু’টি গাল জুড়ে। হেসে উঠে সে। তবে, ঘটনার আকস্মিকতা তখনও তার মাঝে বিরাজমান। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলে উঠে,

— কি রে হাসছিস কেন এইভাবে?

চমকে উঠে স্পর্শী। দরজার ধারে সালেহাকে দেখে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে, “কিছু না এইভাবেই।”

সালেহা সন্দিহান দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে চুলে হাত খোপা করতে করতে বলেন, “নির্বাণের পরিবার কেমন ছিল? আর তাদের ব্যবহার?”

“সব ভালো ছিল মা, চিন্তা কর-না। দেখো, আসার সময় নানাজান আমাকে দু’জোড়া স্বর্ণের চুড়ি দিয়েছেন।”

কথাটা বলে স্পর্শী নিজের দুই হাত সামনের দিকে তুলে ধরে। সালেহা সেটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, ঠোঁটের কোণে ফুটে তার তৃপ্তির হাসি। প্রফুল্ল কন্ঠে বলে,

“ভালো হলেই তো ভালো। তা চুড়ি দুইটা বেশ সুন্দর। সাবধানে রাখিস নিজের কাছে, হারিয়ে ফেলিস না। এখন, খাবার দিয়েছি খেতে আয়।”

স্পর্শী মাথা দোলায়, “আচ্ছা।”

“আর শুন, ব্যাগ থেকে বাসি জামাগুলো নামিয়ে রাখিস। বুয়া আসলে ধুতে দিয়ে দিব।”

“আচ্ছা।”

সালেহা আর কিছু বলেন না, নীরবে রুমটা প্রস্থান করেন। স্পর্শী হাতের কাজটুকু সেড়ে বাহিরে চলে আসে। টেবিলের নিকট আসামাত্র পার্শিয়া উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে উঠে। স্পর্শী পার্শিয়ার দিকে তাকানো মাত্র সে দৌড়ে আসে। স্পর্শী মিষ্টি হেসে হাটু গেঁড়ে বসে হাত দু’টো মেলে ধরতে পার্শিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কোলে। স্পর্শী বেশ আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দেয় পার্শিয়ার ধূসর রঙ্গের কেশে। তবে, পার্শিয়ার চেঁচানো থামে না। নিজ ভাষায় যতটুকু সম্ভব অভিযোগ জারি করছে সে। অভিমানী কন্ঠে যেন প্রশ্ন করছে, “আমাকে ফেলে তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি জানো না আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না? তাহলে আমাকে একা রেখে গেলে কেন?”

স্পর্শী হাসে। নিবিড় বন্ধনে পার্শিয়াকে আবদ্ধ করে আহ্লাদী সুরে পার্শিয়াকে ভুলাতে থাকে। একটা সময় গিয়ে পার্শিয়া শান্ত হয়। মমতাময় পরশ পেতে মাথা হেলিয়ে স্পর্শী বা বাহুতে ঘেষে।

________________

সাঁঝ শেষে আঁধারে আবৃত হয় নীলাভ আকাশ। শুভ্র মেঘ রূপান্তরিত হয় কৃষ্ণবর্ণে। তীব্র অনিলের আনাগোনায় ঝমঝম শব্দ করে উঠে বৃক্ষের দল। সময় নিয়ে ডেকে উঠে মেঘদূত। ঝড় আসার আশঙ্কা। কিন্তু আবহাওয়া নিয়ে যে স্পর্শীর কোন ধ্যাণ নেই। সে নিমগ্ন অন্য কাজে। দীর্ঘ বিরতির পর আজ আবার তার হাতে উঠেছে রঙ-তুলি। গভীর মনে সে আঁকতে ব্যস্ত কারো মুখশ্রী। এই প্রথম প্রচেষ্টা তার। আগে কখনো কারো মুখশ্রী আঁকার ক্ষীণ চেষ্টাও করেনি সে। তবে এইবার কেন করছে কে জানে? টানা তিনঘণ্টা ক্যানভাসে কাঠ পেন্সিলের সুক্ষ্ণ,পুরু আঁচড়ে অর্ধেক স্কেচ সম্পন্ন হয়। ক্লান্তিমাখা নিঃশ্বাস ফেলে নাক অবধি আঁকা স্কেচটির দিকে একমনে তাকায় স্পর্শী। মানবটির মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো, চোখের মনিতে দৃঢ়তা,প্রখরতা স্পষ্ট। চোখের নিজে কিঞ্চিৎ খাদ, নাকের দিকে বসন্তের গাঢ় দাগ। প্রতিচ্ছবিটি অর্ধাংশ হলেও পরিস্ফুট নির্দেশ করছে এক ব্যক্তির দিকেই। মানুষটি স্পর্শী বড্ড কাছের। বড্ড!
স্পর্শী হাসে। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার মন তীব্রভাবে চাইছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কন্ঠ শোনার, তার মুখ দর্শন করার। সে যতই অস্বীকার করুক না কেন, নিভৃতে মানুষটা তারও অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাও বাজে এক অভ্যাসে। কিছু সময় স্পর্শী ভাবলো। ফোন দিবে কি-না, ফোন দিয়ে কি বলবে? ফোন দেওয়া কি ঠিক হবে তার? বুঝে উঠতে পারলো না সে। কিয়ৎক্ষণ অস্থিরচিত্তে কাটিয়ে স্পর্শী উঠে দাঁড়ায়। বিছানার উপর থেকে নোংরা হাতেই ফোনটি মুঠোয় পুরে নিল। ডান হাতের তর্জনীর সাহায্যে কন্ট্রাক্ট লিস্ট স্ক্রোল করলো সে, নির্বাণের নাম্বার স্ক্রিনে রেখে ভাবলো আবার। অতঃপর লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ডায়াল করলো নির্বাণের নাম্বারে।

__________________

দুপুরে খেয়ে ভাতঘুম দেয় নির্বাণ। সেই ঘুম গিয়ে ভাঙ্গে সন্ধ্যার নামার ঠিক পড়ে। তন্দ্রাঘোর কাঁটামাত্র নির্বাণের মাঝে অদৃশ্য এক ব্যাকুলতা ঘিরে ধরে। মন জুড়ে বিচরণ করে এক কৃষ্ণময়ী নারী আর কিছু অশোভন চিন্তাধারা। যা কি-না পীড়িত করছে নির্বাণের অন্তঃস্থলকে। তবে, ভিতরে ভিতরে সে দগ্ধ হলেও বাহির দিয়ে তার অভিব্যক্তি নিত্যদিনকার মতই শীতল। নিজের অনুভূতি থেকে ছাড় পেতে ব্যস্ততায় নিজেকে নিমজ্জিত করার চেষ্টা করে।
কখনো রুম জুড়ে পায়চারি করে, তো কখনো বুকশেলফ থেকে পছন্দের বইটি বের করে মনোযোগ স্থির করার চেষ্টা করে। কখনো বা ভার্সিটির লেকচার গুছিয়ে, কখনো স্লাইড তৈরি করে৷ কিন্তু সবই যেন আজ বিফলে যাচ্ছে, মন বসছে না কোথাও। উৎকন্ঠা, ব্যগ্র মন কি আর খোরাক মিটা না পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। মোবাইল হাতে নিতেই আগমন হলো নাহিদের, “কি করছো ভাই?”

নির্বাণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, “কিছু না। কেন কোন দরকার?”

“খালি যেহেতু আছিস সেহেতু আমার কিছু উপকার করে সোয়াব কামা।”

বিস্তৃত হেসে বললো কথাটা নাহিদ। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কি চাই তোর?”

“আমাকে এই ট্রামগুলো বুঝিয়ে দে। আগামাথা কিছু বুঝতাসি না।।”

“কোন বই এইটা?”

“নিউক্লিয়ার ফিক্সিস।”

নির্বাণ মোবাইল পার্শ্বে রেখে নাহিদের কাছ থেকে ফোনটা হাতে নেয়৷ ম্যাথ আর ক্যালকুলেশনে একবার চোখ বুলিয়ে নাহিদকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করে। বোঝানোর শেষে নাহিদ বলে উঠে, “তোর এতটুকু মাথায় এত এত থিওরি, ম্যাথ,ইকুয়েশন রাখোস কিভাবে? এত স্টোরেজ আমদানি কোথা থেকে করোস? তোকে দেখলেই আমার ডিপ্রেশন মোড অন হয়ে যায়।”

“কাজ শেষ হলে চোখের সামনে থেকে বিদায় হো।”

নাহিদ ভেংচি কেটে বলে, “দোয়া দিতে চাইসিলাম যে, এক হালি বাচ্চার বাপ হো। কিন্তু তুই ওইটার যোগ্যই না। ইশশ! আমার ভাবীর জীবনটাই গেল তোর সাথে বিয়ে হয়ে। এই জন্যই বলে, একটি ভুল সারাজীবনের কান্না।”

নির্বাণ রোষানল দৃষ্টিতে তাকালো। তা দেখে নাহিদ ভ্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে, “আরেহ আমার ভাইটা কত কিউট,সুইট। একদম শিম্পাঞ্জির মত, ভাবী তোকে পেয়ে খুব লাকি।”

কথাটা বলেই নাহিদ কেটে পড়ে। নাহিদ কেটে পড়তেই নির্বাণের অস্থিরতা দ্বিগুণ। নিজের সাথে প্রায় এক প্রকার যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে ফোন লাগায় স্পর্শীর নাম্বারে। তবে রিং ঢোকা মাত্র অতি মিষ্ট সুরে এক নারী বলে উঠে, “আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন তা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার কল করুণ।”

মুহূর্তেই নির্বাণের ভ্রু কুঁচকে গেল। পরপর পাঁচবার কল মিলালো সে। তবে, প্রতিবারই একটি কথা প্রতিধ্বনিত হলো, “কলটি এখন ব্যস্ত আছে।” নির্বাণ বুঝে উঠতে পারলো না স্পর্শী এত কথা বলছেটা কার সাথে? নির্বাণ আরও কয়েকবার ফোন মিলালো কিন্তু ফলাফল সেই আগের ন্যায় রইলো। বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুচে এলো নির্বাণের। তীব্র আক্ষেপ নিয়ে কিছু একটা বিরবির করলো। শেষে রাগ সংযত করতে ন পেরে ফোনটা উল্টো করে ফেললো বিছানার উপর। ক্ষণেই ফোনটা চাপ খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল। অপরপ্রান্ত হতে কেউ শুনতে পেল “সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না” -এর মত তীক্ত ধ্বনি। অথচ নির্বাণ জানলোই না অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটিও দীর্ঘসময় যাবৎ তার নাম্বারেই কল মিলাতে ব্যস্ত ছিল।

__________________

ঝাঁজালো বর্ষণের রাত। চারিপাশ আদ্রতায় ঘেরা।
রাস্তার ভাঙা, নিচু অংশে জমে আছে কাঁদা পানি। ঘড়ির কাটা তখন এগারোটা বেজে সাঁইত্রিশের ঘরে পদার্পণ করেছে সবে। স্পর্শী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ মনে বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ উপভোগ করছিল, ঠিক সে সময় কর্কশ কন্ঠে স্পর্শীর ফোনটা বেজে উঠে। রিংটোন শুনে স্পর্শী বারান্দা থেকে রুমে আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে নির্বাণের কল। নির্বাণের নামটি দেখামাত্র অভিমানের পুঞ্জীভূত মেঘ প্রগাঢ়তা পায়। সেসময়, কতবারই না কল করলো সে নির্বাণকে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যস্ত বলছিল তার ফোন, এরপর বন্ধ। উপরন্ত, একটিবারের জন্যও নির্বাণ তাকে কল-ব্যাক করেনি। এই দ্বায়িত্ব তার স্পর্শীর প্রতি?

স্পর্শী ঠিক করলো সে কোনক্রমেই ফোন ধরবে না। মানুষটাও বুঝুক অপেক্ষা জিনিসটা ঠিক কতটা দীর্ঘ এবং কষ্টদায়ক। তবে, কথাটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না সে। তৃতীয়বারের মত ফোন বেজে উঠতেই কলটা রিসিভ করলো স্পর্শী। কিছু বলার পূর্বেই কাঠিন্য কন্ঠে নির্বাণ বলে উঠে, “নিচে নামো এখনই। ফাস্ট!”

কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার সুযোগ পেল না স্পর্শী। তার আগেই ফোন কেটে গেল। স্পর্শী বিহ্বল, বিচলিত, উৎকন্ঠিত স্তব্ধ হয়ে থাকলো কিয়ৎকাল। অতঃপর বাহিরে না গিয়ে আগে ছুটলো বারান্দার দিকে। সেখান থেকে বাড়ির সামনের রাস্তাটা সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। বারান্দায় এসে স্পর্শী রাস্তার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি স্থির হয় কালো রঙের গাড়িটির দিকে। গাড়িটি সে চিনে, বেশ ভালো করেই চিনে। স্পর্শী নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তবে, পরমুহূর্তেই রাস্তার ধারে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে তীব্র বর্ষণের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুদ্ধিভ্রষ্ট,বিমূড় প্রায়। নির্বাণ তখন নিবিড়ভাবেই স্পর্শীর বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, যার দরুন স্পর্শী ওর দিকে তাকানো মাত্র দৃষ্টি বিনিময় তাদের। ক্ষণেই যেন দুই মরুর বুকে নামে এক পশলা বৃষ্টি। তৃষ্ণা মিটায় অশান্ত মনের। হাতের ইশারায় নির্বাণ পুনরায় স্পর্শীকে নামতে বলে। কিন্তু স্পর্শী তখনও স্থির, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সিক্ত পুরুষের প্রণয়ী অনুভূতি জাগ্রত করা কর্মকাণ্ডে।

#চলবে