চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব-২৭+২৮

0
1130

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৭

করিডরের সামনে এসে কানের নিচ থেকে ফোন রেখে সামনে এগুতেই খুব জোরে কারো সাথে ধাক্কা খেল স্পৃহা। ধাক্কা জোরে খাওয়ায় মুহুর্তেই নিজের ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে বসে পড়লো সে। হাতের মুঠোয় পুরে থাকা ফোনটি ছিঁটকে পড়লো কয়েক হাত দূরেই। নাকের ডগায় ঝুলতে থাকা চশমা হলো অনড়। স্পৃহা চোখ পিটপিট করে কিঞ্চিৎ মুহূর্ত ব্যয় করলো ঘটনাটা বুঝে উঠার জন্য। অতঃপর বুঝতে পেরে ঝটপট মাথা তুললো৷ সামনে সুঠাম, চওরা বুকের অধিকারী এক শ্যাম মানবকে দেখামাত্র তার ভ্রু কুঁচকে এলো। চশমাটা হাতের তর্জনী দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে গলা খাঁকাড়ি মেরে বলল,

“দেখে চলাফেরা করতে পারেন না নাহিদ ভাই? এত তাড়া কিসের আপনার? পড়ে গেলাম তো আমি।”

স্পৃহার ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে নাহিদের কপালের মধ্যভাগে সুক্ষ্ম তিনটি ভাঁজ পড়লো। রসিকতার সুরে বলল, “ইন্দুর সমান মানুষ হলে, তাকে কি আর চোখে দেখা যায়? আমার সামনের রাস্তা তো ফাঁকাই দেখেছিলাম।”

নাহিদের ঠাটারি শুনে স্পৃহার বিরক্তিতে চোখ-মুখ ঘুচে এলো৷ সেই সাথে রাগে চোখ অগ্নিশিখার ন্যায় ঝলঝল করে উঠলো। সে একটু খাটো সে জানে, হয়তো নাহিদের তুলনায় একটু বেশি। কিন্তু তাই বলে সে ইন্দুর নয় বা এমন ছোটও নয় যে তাকে চোখেই পড়বে না। সে সাথে, তাকেই পরোক্ষভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। স্পৃহা ফোঁস ফোঁস করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, ক্ষণেই কোমরের দিকে সুক্ষ্ম এক ব্যথা আঁচ করতে পেরে মৃদু কন্ঠে আর্তনাদ করে পুনরায় বসে পড়ে সে৷ চোখ দু’টি খিঁচে বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করলো। অতঃপর চোখ খুলে পুনরায় উঠার চেষ্টা করার পূর্বেই সামনে থেকে একটি হাত কেউ এগিয়ে দিল, “হাতটা ধরে উঠো।”

স্পৃহা একপলক নাহিদের মুখপানে তাকিয়ে, হাতের দিকে তাকায়। খানিকটা ইতস্তত করলো সে, “লাগবে না। উঠতে পারবো আমি।”

নাহিদ এইবার রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো, “হাত ধরতে বলেছি তোমায়। ধরো!”

স্পৃহা অসন্তোষ নয়নে তাকালো তবে কথা বাড়ালো না, নাহিদের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো৷ ইফতারের পরবর্তী সময় হওয়ায় মানুষজনের আনাগোনা তেমন একটা নেই৷ যার দরুন, মান-সম্মান একটু হলেও রক্ষিত আছে স্পৃহার। উঠে দাঁড়ানোর পর কোমরে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো সে। বেশি জোরে না পড়ায় ব্যথাটা সহ্যনীয়, তবে পরে পেইনকিলার না খেলে উপায় হবে না। স্পৃহার মুখের অদ্ভুত আর উদ্ভট অভিব্যক্তি দেখেই নাহিদ বলে উঠলো, “বেশি লেগেছে বেয়াইন সাহেব? মালিশ করে দিব?”

স্পৃহা কটমট দৃষ্টিতে তাকালো, “ফাজলামো পেয়েছেন? একে তো আপনার জন্য পড়লাম আমি, তার উপর সরি পর্যন্ত বললেন না আপনি।”

নাহিদের গা ছাড়া ভাব, “সারাদিন বান্দরের মত লাফালাফি করলে এমনটাই হবে। বিয়েতেও তো স্থির ছিলে না এক জায়গায়, সারাক্ষণ টো টো করছিলে এদিক সেদিক।”

প্রথমে ইন্দুর আর এখন বান্দর সম্মোধন শুনে স্পৃহা প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠলো৷ রোষানল দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যাই করি না কেন আপনার সমস্যা কি?”

নাহিদ রসিকতার সুরে বলে, “সমস্যা যে আছে। আপনি হচ্ছেন আমার একটা মাত্র বেয়াইন, আপনার কিছু হলে এই বেয়াই মানুষটার-ই তো সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে। নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে সে।”

স্পৃহা চোখ ছোট করে বলে, “ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে?”

নাহিদ ঠোঁটের কোণে চমৎকার এক হাসির রেখা টেনে বলে, “তোমার তাই মনে হলে, তাই-ই। হ্যাঁ, করছি আমি ফ্লার্ট।”

স্পৃহা ফুঁসে উঠলো, কড়া কন্ঠে দুইটি বাণী বলার প্রস্তুতি নিতে যাবে তার পূর্বেই নিজের ফোনের দিকে দৃষ্টি গেল তার। ফোনের স্ক্রিনে আড়াআড়িভাবে লম্বাটে একটি দাগ পড়ে আছে। ফোনটির করুণ অবস্থা দেখা মাত্র দ্রুত সে-টি তুলে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হলো। ফোনটা হাতে নেওয়া মাত্র উৎকন্ঠা সে বলে উঠে,

“ডেম ইট! এখনই নষ্ট হতে হলো ফোনটা।”

নাহিদ সচকিত দৃষ্টিতে একবার তাকালো স্পৃহার দিকে। ভাবলো, এখনই স্পৃহা হয়তো রাগে ফেটে পড়বে। কিন্তু না তার ধারণা ভুল করে দিয়ে স্পৃহা একবারে শান্ত হয়ে গেল, টু শব্দ পর্যন্ত করলো না আর। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ মুঠোফোনের ভাঙা ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর কোন দ্বিরুক্তি না করে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। নাহিদ অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো স্পৃহার চলে যাওয়ার পানে।
স্পৃহা সাহেলার সাথে এসেছিল স্পর্শী আর নির্বাণের জন্য খাবার নিয়ে। কথা ছিল একসাথেই ইফতার করবে তারা। নাহিদ আসরের পর থেকেই হসপিটালে হওয়ায় দেখা হয়ে যায় তাদের। অতঃপর স্পৃহার ফোন আসায় সে বাহিরে চলে যায়, ঠিক তখন নাহিদও তার ব্যক্তিগত কাজে বের হয়। আর করিডরে আসতেই সেই ঘটনাটা ঘটে যায়।

কিয়ৎক্ষণ পর, নিজের কার্য শেষে নাহিদ স্পর্শীর কেবিনে আসলে জানতে পারে স্পৃহা সন্ধ্যার ঘটনার পর পরই চলে গিয়েছে। স্পৃহা চলে গিয়েছে শুনে নাহিদের মন আপনা-আপনি ক্ষুণ্ণ হয়ে গেল। অনুশোচনাবোধ হলো নিজের মাঝে। খেয়াল হলো, দোষটা বোধহয় ওরই ছিল।

_____________

স্পর্শীকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে কিয়ৎ প্রহর পূর্বেই। ডাক্তার আপাতত বাসায় কয়েকদিন বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন। স্পর্শীর খেয়াল রাখতে নির্বাণ লাজশরম ভুলে নিলুফাকে বলে ওদের বাসায় চলে আসে। কিছুদিন স্পর্শীর সাথে থাকবে বলে। স্পর্শী প্রথমদিকে এই বিষয় নিয়ে প্রচন্ড লজ্জা পেলেও পরবর্তীতে ঠিক হয়ে যায়।
রাতে সাহেলা স্পর্শীকে খায়িয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর নির্বাণ রুমে আসে। ঔষধের বক্স হতে রাতের ঔষধগুলো বের করে স্পর্শীকে দেয় খাওয়ার জন্য। ঔষধের বক্স পুনরায় নিজ স্থানে রাখার উদ্দেশ্যে নির্বাণ সেদিকে যাওয়া মাত্রই পার্শিয়া মৃদু শব্দ করে রুমে প্রবেশ করলো। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে এলো স্পর্শীর দিকে। কাছে আসতেই খুব আদুরে ভঙ্গিতে স্পর্শীকে ডাকতে শুরু করল৷ স্পষ্ট কোলে উঠার আহ্বান তার। স্পর্শী স্মিত হাসলো, হালকা ঝুঁকে হাত নিম্নে নিয়ে পার্শিয়ার মাথায় হাত বুলালো। বেশি ঝুঁকলো না পেটের সিলিতে টান পড়বে বলে। স্পর্শী পার্শিয়ার উদ্দেশ্যে কিছু বলার পূর্বেই নির্বাণ বলে উঠে,

“ওকে রুম থেকে বের কর।”

স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “ওর থেকে আপনার এত কি সমস্যা শুনি? কি করেছে ও?”

“ডাস্ট এলার্জির সমস্যা আছে আমার, বিড়ালের সংস্পর্শ সয় না আমার। আর এমনেও বিড়াল আমার পছন্দ না। বের কর ওকে।”

স্পর্শী নাক ফুলিয়ে কিছু বলার পূর্বেই পার্শিয়া উচ্চস্বরে ‘মিয়াও!মিয়াও!” করে চিল্লিয়ে উঠল। ক্ষণেই চমকে উঠল দু’জনেই৷ পার্শিয়া গা ঝামটা মেরে পিছন দিক দেখিয়ে রুম থেকে চলে গেল৷ পার্শিয়ার এহেন কর্মে নির্বাণ হতবিহ্বল নয়নে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে, “এমন করলো কেন?”

স্পর্শী কিছু হেসে উঠে বলে, “বেচারা রাগ করেছে আপনার উপর। তাই এমন করল।”

“তাই এমন? অদ্ভুত!”

“একটা কথা বলে রাখি, আমাকে আপন করার আগে কিন্তু আপনাকে পার্শিয়াকে আপন করে নিতে হবে। না-হলে কিন্তু বউ পাবেন না।”

নির্বাণ ঠোঁট দু’টি গোল করে চিন্তামগ্ন হওয়ার অভিনয় করে বলে, “কিন্তু… বউকে যে আমি অনেক আগেই আপন করে নিয়েছে, এখন কি হবে? আমি কি বিবাহিত ব্যাচেলর বলে গণ্য হব তখন?”

নির্বাণের কথার অর্থ বুঝতে পেরে স্পর্শীর শ্যামবর্ণ গালে রক্তজবার গাঢ় রঙ আলতোভাবে মেখে গেল। অস্ফুটস্বরে বলে, “আপনি চরম অসভ্য।”

নির্বাণ দরজায় খিল দিতে স্পর্শীর দিকে এগিয়ে এসে বলে, “হ্যাঁ শুধু তোমারই জন্য।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। নির্বাণ স্পর্শীর কাছে এসে ওর হাত টেনে ধরলো, হাতের মধ্যখানে হ্যান্ড-স্যানিটাইজার ঢেলে দিয়ে বলল, “হাত ভালো মত রাব করে নাও। পার্শিয়াকে ধরেছ তুমি।”

কথাটা শোনামাত্র স্পর্শী অসন্তোষ নয়নে তাকায়, তবে কিছু বলে না। কারণ সে জানে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নির্বাণের মাথাব্যথা সীমাহীন। তাকে বলেও কাজ হবে না। তাই সে, নিভৃতেই নির্বাণের কথা মেনে নিল৷ নির্বাণ স্মিত হেসে রুমের বাতি বন্ধ করে নীলাভ আলোটি জ্বালিয়ে দিল। সন্তপর্ণে স্পর্শীর নিকটে এসে শুয়ে ওকে আলগাভাবে জড়িয়ে ধরলো। তৎক্ষনাৎ স্পর্শীর অধরের শেষপ্রান্তে উপস্থিত হলো একরাশ হাসি। কিয়ৎক্ষণ নিভৃতে কেটে যেতেই নির্বাণ মিহি কন্ঠে বলে উঠে, “রাতে কোনপ্রকার সমস্যা হলে আমাকে জাগিয়ে বলবে। নিজে নিজে মাতব্বরি করবে না, অন্যথায় আমার সাবজেক্টে তোমার নাম্বার কাটতে কোন কৃপণতা করবো না আমি।”

কথাটা শোনামাত্র স্পর্শীর অধরের কোণে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু উবে যায়। সে অভিযোগের সুরে বলে, “এটার সাথে নাম্বারের কি সম্পর্ক? বর বলে আপনি এমন দূর্নীতি করতে পারেন না, এইটা অন্যায়। তার উপর বউকে থ্রেট তো গুরুতর অন্যায়।”

“তোমার মত ত্যাড়া মানুষকে সোজা করতে মাঝে মধ্যে দূর্নীতিবাজ হওয়াই যায়। আর এমন থ্রেট না দিলে বউ জীবনেও কথা শুনবে না।”

স্পর্শী বিরবির করে বলল, “স্যারকে বিয়ে করার এমন সাইড ইফেক্টস থাকবে জানলে আমি জীবনে এই বিয়ে করতেই রাজী হতাম না।”

নির্বাণের কর্ণকুহরে কথাটা গিয়ে পৌঁছাতেই নির্বাণ বলে উঠে, “রাজী যেহেতু হয়েছ সেহেতু ভোগান্তি তো ভুগতেই হবে। ইউ হ্যাভ নো আদার চয়েস।”

“হুহ!” স্পর্শী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নির্বাণ তা দেখে ধীর গতিতে নিজের মুখটা স্পর্শীর গ্রীবাদেশে নিয়ে আলতোভাবে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে, “সাইড ইফেক্ট নিয়ে চিন্তা না করে সুস্থ হও আগে। এরপর বেনিফিটও দেখতে পাবে।”

“বেনিফিট কি কি একটু শুনি।”

নির্বাণ স্পর্শীর কান বরাবর মুখ স্থির করে মিহিস্বরে বলে, “তোমাকে মা ডাক শুনাবো।”

পরক্ষণেই স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসতেই স্পর্শী বলে, “লাগবে না আমার কোন বেনিফিট। ঘুমান তো আপনি।”

নির্বাণ আরও কিছু বলতে চাইলো তবে সময় কাঁটা টুকটুক করে একের পর এক ঘর পেরিয়ে যেতে নির্বাণ কথা এগুতে চাইলো না। তাই ছোট করে বলল, “আচ্ছা ঘুমোও। রাত হয়েছে অনেক।”

#চলবে

#চৈতালি_পূর্ণিমা
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৮

রৌদ্রজ্বল আকাশে শুভ্র মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা। প্রকৃতি কেমন ঝিম ধরে বসে আছে। অতি ব্যস্ততা শহরের মাঝেও যেন ছেঁয়ে আছে নিস্তব্ধতা। ঘড়ির কাঁটা মৃদু শব্দ করে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। ঠিক বারোর ঘরে এসে বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। এমন সময়ই ইউসিসি কোচিং সেন্টার থেকে স্পৃহা বেরিয়ে রাস্তার ধারে আসে। নাকের ডগা হতে চশমাটা পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে রিকশা খুঁজতে উদ্যোগী হয় সে। রোজায় ধরেছে আজ তাকে, সব কেমন ছন্নছাড়া লাগছে। তার উপর অসহ্যনীয় এই গরম। কোনমতে এখন বাসায় যেতে পারলেই বাঁচে সে। সে এদিক সেদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজতে নিলে হুট করেই তার চোখ গিয়ে আটকায় রাস্তার অপারে দাঁড়িয়ে থাকা নাহিদের দিকে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে সে স্পৃহার পানেই তাকিয়ে আছে। দুইজনের দৃষ্টি একে অপরের সাথে বিনিময় হতেই নাহিদ রাস্তা পার হয়ে এদিক আসে। স্পৃহা এই মধ্যদুপুরে নাহিদকে নিজের কোচিং-এর সামনে দেখে বেশ অবাকই হলো। নিজের আশ্চর্যান্বিত ভাব লুকাতে না পেরে সে সালাম দিয়ে বলে উঠে, “আপনি এখানে কি করছেন নাহিদ ভাই? কোন দরকারে এসেছেন কি?”

নাহিদ সালামের উত্তর দিয়ে বলে, “হ্যাঁ দরকারেই এসেছি।”

স্পৃহা ঠোঁট গোল করে বলল, “অহ আচ্ছা। তা বাসায় চলেন।”

“না অন্য কোনদিন।”

নিত্যদিনের তুলনায় নাহিদকে আজ বেশ গম্ভীর, শান্ত দেখাল। স্পৃহা ভাবলো নাহিদ হয়তো তাড়ায় আছে, তাকে দেখেছে বলে ভদ্রতার খাতিরে দেখা করতে এসেছে। তাই সে নাহিদকে বাসায় যাওয়ার জন্য আর জোর করলো না, ব্যস্ত ভঙ্গিতে রিকশা খোঁজায় মনোযোগী হলো। আকস্মিক নাহিদ বলে উঠে, “সেদিন জন্য সরি। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কাটা দেয়নি সেদিন, অনিচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কাটা লেগেছিল।”

স্পৃহা চোখ তুলে তাকালো। নিজের চশমা ঠিক করে বলল, “জানি নাহিদ ভাইয়া। তবে চিন্তা করবেন না, আমি কিছু মনে করিনি। ভুল আমাদের দুইজনেরই ছিল।”

নাহিদ কিঞ্চিৎ হাসলো। ডান হাতে থাকা প্যাকেটটা স্পৃহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। এখন এইটা নাও।”

স্পৃহা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “জি?”

নাহিদের নির্লিপ্ত কন্ঠ, “তোমার জন্য এটা, নাও।”

স্পৃহা বিস্ময়কর কন্ঠে বলল, “আমার জন্য? কি?”

নাহিদ প্রত্যুত্তর করলো না। খুব সন্তর্পণে স্পৃহার হাতটা টেনে ধরে ওর হাতের মুঠোয় ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “রাখো।”

স্পৃহা ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলো ভিতরে একটি মোবাইল সেটের বক্স। স্পৃহার বুঝতে দেরি নি এটা কিসের জন্য তাকে দেওয়া হয়েছে। সে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত ব্যাগটা নাহিদের হাতে ধরিয়ে দেয় এবং বিনয়ী কন্ঠে বলে, “আমি এইটা নিতে পারব না ভাইয়া, আপনি নিয়ে যান।”

“তোমাকে ফোনটা আমি বিনা কারণে দিচ্ছি না। আমার জন্য তোমার ফোন নষ্ট হয়েছে বলেই দিচ্ছি।”

“আমি তো বলছি সমস্যা নেই৷ ওই ঘটনা আমি ভুলে গিয়েছি তাই বলব আপনিও ভুলে যান। সেটা একটা এক্সিডে ছিল অনুশোচনা করার প্রয়োজন নেই, ফোনটা নিয়ে যান আপনি।”

নাহিদ অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার দিকে। কিছু বলার পূর্বেই পিছন থেকে স্পৃহার ডাক পড়ে। স্পৃহা ডাকা সাড়া দিতে পিছন ঘুরে তাকায়। তার ক্লাসমেট মৃন্ময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে। ছেলেটাকে দেখা মাত্র নাহিদের দৃষ্টি প্রখর হলো। স্পৃহা প্রত্যুত্তর করতেই মৃন্ময় সামনে এগিয়ে এলো মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “স্পৃহা তোমার কাছে গতকালকের নোট আর শিটগুলো হবে? আমি মিস দিয়েছিলাম কাল ক্লাস।”

স্পৃহা স্বল্প হেসে বলে, “হ্যাঁ আছে। তুমি নিতে পারো আমার থেকে।”

কথাটা বলে স্পৃহা একবার আড়চোখে নাহিদকে পর্যবেক্ষণ করে নিজের ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর কয়েকটা শিট বের করে মৃন্ময়ের হাতে তুলে দিল। মৃন্ময় বিস্তৃত হেসে বলে, “বাঁচালে আমায়। থ্যাংকস আ লট!”

স্পৃহা স্মিত হাসলো। মৃন্ময় নোটগুলোর দিকে নজর বুলাতে বুলাতে বলে, “আমার সাথে না-হয় ফটোকপির শপে চল, এখনই সব কপি করে তোমাকে নোটসগুলা ফিরিয়ে দিচ্ছি। অন্যথায় বাসায় নিয়ে গেলে আমি আবার ফেরত দিতে ভুলেও যেতে পারি।”

স্পৃহার কয়েকটা শিট আজ দরকার ছিল বলে মৃন্ময়ের প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে যায়। অতঃপর নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আসি ভাইয়া, ভালো থাকবেন। আর বাসায় এসেন কিন্তু।”

নাহিদ নিরুত্তর রইলো, তবে প্রখর দৃষ্টি অনড় থাকলো। স্পৃহা কোন উত্তর না পেয়ে পুনরায় একই কথা বলল। নাহিদ এইবার প্রত্যুত্তরে শুধু বলল, “যাও!”

স্পৃহা কোন সময় বিলম্ব করলো না মৃন্ময়ের সাথে সামনের দিকে হাঁটা দিল। নাহিদ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। পিছন থেকে শুনতে পেল ছেলেটা জিজ্ঞেস করছে, “ভাইয়াটা কে?”

স্পৃহা উত্তর দিল, “আপুর ছোট দেবর হয় তিনি। কোন কাজে এসেছি একটায়, হুট করে দেখা হলো তাই কথা বলছিলাম।”

পরবর্তীতে মৃন্ময়, স্পৃহা দূরে চলে যেতে আর কোন কথা নাহিদের কর্ণগোচর হলো না। তবে নাহিদের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। ভিতরকার অনুভূতি রূপ নিল বিশ্রী। নিজের সীমাহীন রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে খুব জোরে সামনে পড়ে থাকা ইটের টুকরোতে লাথি মারে। হঠাৎ করা এমন কর্মকান্ডের কোন ব্যাখা পেল না সে। এত রাগের উৎস পেল না। তার রাগটা আসলে কিসের জন্য? স্পৃহা তার দেওয়া গিফট নেয়নি বলে নাকি স্পৃহা অন্য একটা ছেলের সাথে আছে বলে নাকি স্পৃহা তাকে বোনের দেবর বলে সম্মোধন করেছে বলে? কে জানে!

__________________

বড় সড়কের দিকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নির্বাণ। পাশেই স্পর্শী বসে ঝিমুচ্ছে। প্রায় সকাল সকালই ঘুম পূর্ণ হওয়ার আগেই নির্বাণ তাকে ঘুম থেকে তুলে উঠিয়েছে, হসপিটালে যাবে বলে। আজ তিন হলো তাকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করা হয়েছে,তাই রেগুলার চেকাপ এখন আবশ্যক। স্পর্শী আজ যেতে না চেলেও নির্বাণ তাকে বলতে প্রায় ধরে বেঁধেই নিয়ে এসেছে। এতে স্পর্শী গাল ফুলালেও নির্বাণের মন গলেনি। যাই হোক না কেন, স্পর্শীর স্বাস্থ্যের সাথে নির্বাণ কোন ধরনের হেলা করতে প্রস্তুত নয়।

হসপিটালের সামনে পার্কিং এরিয়াতে গাড়ি পার্ক করে নির্বাণ আগে গাড়ি থেকে নামে। স্পর্শীর সিটের দিকে ঘুরে এসে দরজা খুলে স্পর্শীকে নামতে সাহায্য করে সে। অতঃপর গাড়ি লক করে স্পর্শীর হাতে ফাইল দিয়ে তাকে এক হাত দিয়ে ভালোমত জড়িয়ে ধরে এবং আরেক হাতের মুঠোয় স্পর্শীর হাতটি শক্ত করে ধরে। তার পুরো চেতনা এদিকেই নিবদ্ধ, স্পর্শীর যাতে বিন্দুমাত্র কষ্ট না হয়। আশেপাশে অনেকেই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, চাহনিতে কারো বিস্ময় তো কারো মুগ্ধতা তো কারো ঈর্ষা। কিন্তু তাদের বা তাদের চাহনির দিকে নির্বাণ বা স্পর্শী কেউই বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ডাক্তারের কেবিনের দিকে।

চেকাপ করিয়ে বের হওয়ার সময় একটা ওয়ার্ডবয়ের সাথে স্পর্শীর ধাক্কা লাগলো। সাথে সাথে ওয়ার্ডবয়ের হাত থেকে দু’টো কাঁচের শিশি পড়ে ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। নির্বাণ দ্রুত স্পর্শীকে পিছনের দিকে টেনে আগলে নিল। ব্যাকুল, উৎকন্ঠা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ঠিক আছো? কোথাও ব্যথা পাও নি তো?”

ঘটনাক্রমে স্পর্শী ভয়ে কিছুটা আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নির্বাণ কন্ঠ শুনে সে চোখ তুলে তাকায়। নিজেকে শান্ত করে আশ্বস্ত সুরে বলে, “ঠিক আছি আমি।”

স্পর্শী ঠিক আছে শুনে কিছুটা শান্ত হলে সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই গলা উঁচু করে ওয়ার্ডবয়ের উদ্দেশ্যে ল বলে উঠলো, “দেখে চলা ফেরা করতে পারেন না?”

নির্বাণের অতি গাম্ভীর্যপূর্ণ উচ্চকণ্ঠ শুনে ওয়ার্ডবয় ভয়ে কেঁপে উঠে। পরিবেশটাও হঠাৎ শান্ত হয়ে যেতে ওয়ার্ডবয় ঘাবড়ে যায়, অস্ফুটস্বরে বলে, “স..সরি স্যার! সরি ম্যাম! আমি খেয়াল করিনি।”

নির্বাণ রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “খেয়াল করিনি মানে কি? এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কিভাবে হয় মানুষ? এখন আমার ওয়াইফ যদি পড়ে যেত বা কাঁচ তার শরীরে বিঁধে যেত তখন কি হতো? এর দায়ভার কি আপনি নিতেন নাকি অথোরিটি নিত?”

ওয়ার্ডবয় অত্যন্ত ভয়ার্ত কন্ঠে বলে, “সরি স্যার! আমার ভুল হয়ে গিয়েছে এমন আর হবে না। প্লিজ স্যার এবারে মত মাফ করে দিন।”

নির্বাণ আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্পর্শী নির্বাণের বাহু টেনে ধরে অত্যন্ত ভীতু গলায় বলে, “নির্বাণ থাক না! বলছে তো ভুল হয়ে গিয়েছে৷ মাফ করে দেন। আপনি এখন যান ভাইয়া আর দ্রুত ফ্লোর পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নিন।”

শেষ কথাটি স্পর্শী ওয়ার্ডবয়ের উদ্দেশ্যে বলল। নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে পুনরায় ওয়ার্ড বয়ের দিকে তাকালো। ওয়ার্ড এর ফাঁকে, “ধন্যবাদ ম্যাম! আমি এখনই সুইপারকে পাঠাচ্ছি পরিষ্কার করে দিতে জায়গাটা।”

কথাটা বললেই ওয়ার্ডবয় কোনমতে দৌড়ে পালালো। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো অতঃপর স্পর্শী কে শক্ত করে ধরে সে জায়গা থেকে আস্তে আস্তে সরে আসলো। সাবধানতা এত যে ফুলের টোকাও যেন স্পর্শী ত্বক স্পর্শ না করতে পারে৷ হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসতেই নির্বাণ সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো একজন মধ্যবয়স্ক লোক কানে ফোন চেপে কথা বলতে বলতে আসছে। গায়ে এপ্রোন ঝুলছে তার। মানুষটিকে দেখামাত্র নির্বাণের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো লোকটার দিকে, ক্রোধে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। সামনের মানুষটিও নির্বাণকে দেখামাত্র থমকে দাঁড়ালো, কিছু একটা বলে ফোন কানের নিচ থেকে নামিয়ে নিল। নির্বাণ আর দাঁড়ালো না দ্রুত পা চালালো সামনের দিকে। লোকটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সে বলে উঠে, “কেমন আছো?”

নির্মাণ এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। এভাবেই নির্বাণের মেজাজ চওড়া ছিল তার উপর এই লোকের সাক্ষাৎকার যেন তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। তবুও সে নিজেকে প্রচন্ড শান্ত রাখার চেষ্টা করে কাঠকাঠ কন্ঠে বলল,”আমি কেমন আছি সে-টা জেনে আপনার কোন কাজ নেই। সো মাইন্ড ইউর ওউন বিজনেস।”

কথাটা বলে নির্বাণ আর কোন সময় ব্যয় করে দ্রুত সে স্পর্শীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। স্পর্শী তখন পুরোটা সময়-ই নীরব থেকে পর্যবেক্ষণ করে যায়। এমনকি গাড়িতে উঠার পরও সে কোন প্রকার টু শব্দ করে না। প্রশ্ন করে না, নির্বিকার থাকে৷ কেন না, নির্বাণের মুখশ্রী দেখেই তার বুঝতে দেরি নির্বাণ ঠিক কি পরিমাণ রেগে আছে। আর তার রাগ যে কত ভয়াবহ তা স্পর্শীর থেকে ভালো কে বাই জানে? এখন অল্প কিছু হলেই সে রাগে ফেটে পড়বে আর তার ভোগান্তির শিকার হতে হবে স্পর্শীকে। তাই সে চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলো। তবে মনে মাঝে বুনতে শুরু করলো অজানা অজস্র প্রশ্ন। মিললো কিছু সমীকরণ। সেই লোকটার আর নির্বাণের মুখ আকৃতিতে কিঞ্চিৎ মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। দুইজনের মধ্যে পরিচিতি তো নিশ্চয়ই আছে কিন্তু সে-টা কি তাই অজানা।

গাড়ি যখন হসপিটালের তীর-সীমানা থেকে কয়েক মাইল দূরে এসে অবস্থান করে তখন স্পর্শীর মনের মাঝে কিছুটা সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “লোকটা কে ছিল?”

নির্বাণ তাকালো না স্পর্শীর পানে৷ রাস্তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “তার পরিচয় দেওয়ার মত কোন সম্পর্ক বা পরিচয় আমার কাছে নেই।”

স্পর্শী নিম্ন স্বরে বলল, “জি আচ্ছা।”

“তবে…. তাকে আমি একদা বাবা বলে জানতাম।”

#চলবে।