#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৮
সদ্য ভোর ফুটেছে। চারদিকে পাখির কিছিরমিচির ডাক। অনু জেগে উঠল। কপালের কোনায় ব্যথা হতেই তার হুঁশ ফিরলো। রাতে সে জানালার গ্রিলের সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। গভীর রাত পর্যন্ত সে জেগেছিলো। জানালার ধারে বসেছিল। তার রুম থেকে বিস্তীর্ণ উঠান ভেদ করে বাড়ির গেট দেখা যায় । অনুর কোথাও একটা আশা ছিল যে আদিত্য আসবেই। তাই তো মনকে হাজার বোঝানোর পরেও এইখানে বসেছিল। কিন্তু অন্যদিনের মতো সত্যিই আদিত্য ফেরেনি।
কপালে টনটন ব্যথা অনুভব হতেই অনু চোখমুখ কুঁচকে নড়েচড়ে বসলো। সে চোখ মুছে ফেলল। আর ভাববে না কোনো প্রতারক এর কথা। রাত যাওয়ার সাথে সাথে তার জীবন থেকে সত্যিকারের অর্থে সব মুছে গেছে।
চোখের সামনে কেউ একজন খালি কাপ ধরতেই অনু তাকালো।
আনিস মিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
অনু জিজ্ঞেস করল,
“বাবা তুমি?”
আনিস মিয়া হাতে থাকা চায়ের কাপটার দিকে ইশারা করে অনুকে জানালো,
“হয়ে যাক?”
অনু হাসলো।
বিয়ের আগে তারা বাপ্ মেয়ে খুব সকাল সকাল উঠে ছাদে সূর্যোদয় উপভোগ করতো। আনিস মিয়া আগেই উঠে চলে যেতেন ছাদে আর অনু পরে দু’কাপ গরম গরম চা নিয়ে যেত। এরপর বাবা মেয়ে একসাথে ছাদের বেঞ্চিতে বসে সূর্যোদয় উপভোগ করতো। কিন্তু বিয়ের পরে আর কোনোদিন সেই সুযোগ হয়নি কারণ আদিত্য থাকতে দিতো না। আর মাঝে মাঝে থাকতে দিলেও খুব কম সময় একদিন রাখতো। সেই একদিন অনুকে আনিস মিয়া আর ডেকে তুলতেন না। কারণ তিনি বুঝতেন।
অনু হাসলো। তার বাবা আবার সেই আগের দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চাইছে।
অনু উঠে দাঁড়িয়ে জানালো, “দাড়াও আমি চা করি।”
“তার প্রয়োজন নেই। আজ আমি করে নিয়েছি। তুমি মুখ ধুয়ে আসো।” বলেই আনিস মিয়া প্রস্থান করলো।
আর অনু মুখ ধোয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। মুখ ধুতে গিয়ে আয়নায় চোখ পড়তেই সে আটকে গেল। চোখমুখ ফুলে গেছে। কান্না করলেই চোখমুখ ফুলে যাওয়ার অভ্যাসটা অনুর নিজেরই ভালো লাগে না। অনু নিজেকে সামলালো। বাবা কী খেয়াল করেনি! অনুর ছোটোখাটো সব জিনিস তো উনি খেয়াল করে ফেলেন। তাহলে এটা করলো না!
অনু চোখে মুখে ভালো করে পানি ছিটালো। এরপর ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে ভালোমতো মুখে লাগালো। যাতে ফোলা ভাব কিছুটা হলেও কমে যায়। এরপর অনু ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
অনু ছাদে যেতেই দেখতে পেল বাবা সেই একইভাবে বেঞ্চিতে বসে আছে। মাঝখানে ধোয়া উঠা দুটো কাপ।
অনু বাবার পেছনের দিকটাতে তাকিয়ে রইল।
এই জিনিসটা সে বিয়ের পরে আদিত্যর সাথেও করতে চাইতো। সে ভেবেছিল, আদিত্য হয়ত বাবার প্রতিরূপ কিন্তু আদতে তা না। সবসময় আদিত্যর অফিস থাকতো ভেবে অনু তাকে ডেকে তুলতো না শুধু শছুটির দিনই ডাকতে যেত কিন্তু আদিত্য উঠতো না। অনুকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিতো। এজন্য অবশ্য অনু কিছুই মনে করতো না কারণ সবার স্বভাব তো একই নয়। কেউ কেউ এগুলো পছন্দ করে না। সকালের হাওয়া তো অনেকের ভালো লাগে না। সবার ভালো লাগা তো এক নয়। আদিত্য অনুর ভালোবাসা তাই বলে যে অনুর ভালো লাগাগুলো আদিত্যর ভালো লাগা হবে তাতো কথা নেই। এই ভেবে অনু নিজেকে সান্ত্বনা দিতো।
আনিস মিয়া পেছনে ফিরে মেয়েকে দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে কাছে ডাকলেন।
অনু এগিয়ে এলো।
আনিস মিয়া এক কাপ চা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকালেন। সামনের সারি সারি গাছের ফাঁক দিয়ে কী সুন্দর করে সূর্যের লাল আভা ভেসে উঠছে!
অনু তাকিয়ে রইল। আজ কতদিন পরে এভাবে মুক্তভাবে এটা দেখছে সে।
আনিস মিয়া সূর্যের দিকে দৃষ্টি রেখেই শুধালেন,
“যেভাবে নতুন করে সূর্য উঠছে সেভাবে নিজের জীবনটাও নতুন করে শুরু করো। রাতের সাথে সাথে তোমার অন্ধকারকে মিলিয়ে দাও। ভোরের সাথে সাথে সব মুছে ফেলো। এই নতুন ভোরকেই তোমার জীবনের নতুন সূচনা হিসেবে ভেবে নাও।”
অনু তাকিয়ে রইল তার আদর্শ বাবার দিকে।
আনিস মিয়ার মুখে কোনো হতাশা, চিন্তা নেই। তিনি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। যেন এই মুহূর্তে তার চেয়ে সুখী ব্যক্তি আর কেউ নেই। অনু তার বাবাকে বুঝে উঠে পায় না। এই মানুষটা এতো নিশ্চিন্ত ভাবে জীবন উপভোগ করে। তারও তো উচিত বাবার মতো হওয়া। কোনো কিছুতে দুঃখ না পেয়ে কপালের উপর ছেড়ে দেওয়া।
“আমাকে তোমার মতো করে গড়ে তুলো বাবা।”
আনিস মিয়ার সেই কথার জবাব না দিয়ে বললেন,
“পড়াশোনাটা শুরু করো।”
“আমি পারবো না বাবা। আমি মন দিতে পারবো না।”
“অবশ্যই পারবি।”
অনু আকাশের দিকে দৃষ্টি দিল। মৃদু বাতাসে সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মানুষ অভ্যাসের দাস। সময়ের সাথে সাথে অভ্যাস বদলে যায়।
আনিস মিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কী সুন্দর করে মেয়েটা বসে আছে! বাতাসে কেঁপে উঠার পরেও সহ্য করে নিচ্ছে! আনিস মিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।
এই বাড়িটা একদম গ্রামের শুরুতে হওয়ায় প্রকৃতি খুব সুন্দর করেই উপভোগ করা যায়। অনু প্রকৃতি ভালোবাসেই বলে আনিস মিয়া এভাবে বাড়িটি বানিয়েছিলেন। নাহয় তারও ক্ষমতা ছিল বড়ো বড়ো দালান করার কিন্তু অনু চাইতো না। সে ছোটোখাটো একটা খোলামেলা সুন্দর বাড়ি চাইতো। যেটা প্রকৃতির সাথে সুন্দরভাবে মিশে থাকবে। শুরু থেকেই অনু এমনটা ভালোবাসতো বলে আনিস মিয়াও সেইভাবেই বাড়িটি তৈরী করেছিলেন।
আস্তে আস্তে সূর্যের তেজ বেড়ে যাচ্ছে। গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্য তার কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাপদাহ বেড়ে উঠছে।
আনিস মিয়া সেদিকে দৃষ্টি রেখে শুধালেন,
“যেমনটা এই সূর্য মুহূর্তের মধ্যে তার তেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেই একইভাবে তুমিও তোমার কিরণ ছড়িয়ে দিবে। যাতে যারা হারিয়েছে তারা মূল্য বুঝে এবং আফসোস করে।”
“আফসোস করুক আমি তা চায় না বাবা।”
“কেন চাইবে না? তুমি তোমার মূল্য বুঝিয়ে দিবে। কোনো রাগ থেকে নয়। তারা পেয়ে হারিয়েছে এটার অপরাধবোধ তাদের হবেই।”
অনু চুপ রইল।
“উচ্চমাধ্যমিকের পরে তোমার দুইবছর কেটে গেছে। তোমার ভাগ্য ভালো। এই সময়েই আবার ভর্তি কার্যক্রম চলছে। গ্যাপটা পূরণ করে নাও। তোমার না মেডিকেলের পড়ার শখ ছিল? সরকারিতে আর সময় নেই। একটা প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করে দিবো তোমায়।”
“বাবা আমি এতদিনের গ্যাপ পূরণ করতে পারবো না। আমার সময় লাগবে।”
“মনে রেখো তুমি উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছো দুইবছর পেরিয়ে গেছে। এইবার যদি ভর্তি না হও তবে তুমি আর সুযোগ পাবে না। ভর্তি হয়ে গ্যাপ নাও। ”
অনু সামলালো। বাবার অমান্য সে হবে না। কিন্তু কলেজ যেতে হলে তার বের হওয়া লাগবে। এতে আশেপাশের মানুষের একেক কানাঘুষা সব মিলিয়ে সে কী সহ্য করতে পারবে!
“তুমি কী কোনোভাবে মানুষকে মোকাবিলা করার ভয়ে গ্যাপ নিতে চাইছো?”
অনু চুপ হয়ে যায়। তার চুপ থাকাকে আনিস মিয়া সম্মতি হিসেবে ধরে নিয়ে শুধালো,
“শোনো, মানুষকে নিয়ে ভাবলে চলবে না। নিজেকে নিয়ে ভাবো। মানুষ শুধরাবে না। ওরা ওদেরটা বলবেই। তুমি আমার মেয়ে। একদিন বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিবে। সেদিন যারা তোমার সমালোচনা আর খারাপ করেছে তারা অপরাধবোধে শেষ হবে। শুধু মাঝের এই সময়টাতে তোমার শক্ত থাকা লাগবে। আর আমি জানি আমার মেয়ে এগুলো খুব সহজে মোকাবিলা করতে পারবে। দিন শেষে নিজের একটা পরিচয় বানাও। কী? পারবে না? মানুষকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের পরিচয় গড়তে?”
অনু বাবা নামক প্ৰিয় মানুষটার দিকে একরাশ ভরসা নিয়ে তাকালো। এতদিন পরে সে আবার তার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়েছে তা সে কিছুতেই হারাবে না। তার বাবার জন্য হলেও সে উঠে দাঁড়াবে। বাবার এই আস্থা সে কিছুতেই আর হারাতে দিবে না। দিনশেষে নিজের একটা পরিচয় সে বানাবেই।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।