জঠর পর্ব-১১+১২

0
544

#জঠর
#পর্বঃ১১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

মুখের ভেতর এক দলা ভাত নিয়ে বসে আছে পিউলী। কিছুতেই খেতে চাইছে না বাচ্চাটি। নওশাদ সাহেব জোর করে মুখে লোকমা ঠুসে দেওয়ার দরুণ ওভাবেই চুপ করে বসে আছে। নওশাদ সাহেব আদুরে গলায় বললেন—

“খেয়ে নাও পিউলী, পাপা রাগ করবে।”

পিউলী অসহায় মুখ করে চেয়ে রইল। মুখের ভেতরের খাবারটুকু কষ্টের সাথে গিলে নিয়ে বলল–

“আমি খাবো না। মামুনির কাছে যাব।”

নওশাদ সাহেব আশ্বাসের সুরে বললেন—

“খেয়ে নাও সোনা। খাওয়া হলেই দাদু নিয়ে যাব। না খেলে পাপা রাগ করবে।”

পিউলী তার আধো আধো গলায় আপত্তি করে বলল—

“না। আমি মামুনির কাছে যাব। না হলে খাবো না। খাবো না। খাবো না।”

কান্না জুড়ে দেয় পিউলী। হতচকিত নওশাদ সাহেব। মেয়েটা আজকাল বড্ড জেদি হয়ে যাচ্ছে! কারো কথাই শুনে না।
,
,
,
ধুম ধরে বসে আছে নায়েল। প্রায় মিনিট পনেরো যেন পুরো পৃথিবী থমকে গেছে তার জন্য। আধশোয়া বসে পা সটান করে ছড়িয়ে রেখেছে অর্হিতা। মাথায় গোলাকার গজ বাঁধা। দুই পাশে ছড়ানো চুলের মাঝ গলিয়ে নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নায়েলের দিকে। নায়েল স্থির, নিষ্কম্প, শান্ত। তার সমান্তরাল চাহনি নিজের মুঠোয় পুরে রাখা অর্হিতার হাতে। অর্হিতা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল—

“চুপ করে আছেন কেন নায়েল? আপনি প্রশ্নের উত্তর দেননি।”

সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পায়ে পিচ্ছিল জাতীয় কিছু একটার সংস্পর্শে আসতেই পেছন দিকে হেলে পড়ে অর্হিতা। ভাগ্য সহায় বলে, সিঁড়ির রেলিং ধরার কারণে মাথার পেছনে সামান্য জায়গা কেটে যায় যাতে তিনটা স্টিচের প্রয়োজন পড়ে। প্রায় এক সপ্তাহ জোর করেই হাসপাতালে রাখা হয় অর্হিতাকে। তারপর বাসায় নিয়ে আসা হয়। তার দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব নায়েলের ওপর। সব মিলিয়ে আজ পনেরো দিন।

নায়েল অবনত মুখটা তুলে বলল—

“আমি দুঃখিত। যা হয়েছে সবটার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”

অর্হিতা অসহনীয় গলায় বলল—

” আপনাকে ক্ষমা চাইতে বলিনি। আমি আমার প্রশ্নের জবাব চেয়েছি।”

নায়েল নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে বলল—

“হ্যাঁ। পিউলীর জন্মদাতা আমি নই। ও আমার বোন নিহিতার মেয়ে। কিন্তু পিউলী তা জানে না। আর আমিও চাই না ও কখনো জানুক যে আমি ওর পাপা নই।”

হেয়ালি গলায় বলে উঠে অর্হিতা—

“লুকিয়েছেন কেন আমার কাছ থেকে? কেন বলেননি এসব?”

“সুযোগ হয়নি। আমি যতবার আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছি পিউ ছিল আমার সাথে।”

ফিচেল হাসে অর্হিতা। ক্যাটক্যাটে গলায় বলল—

“আপনি কী সত্যিই গিরগিটি না-কি? মোবাইল ছিল না আপনার কাছে? আসলে আপনি ইচ্ছে করেই বলেননি। ইচ্ছে তো করছে আপনাকে….।”

এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসে নায়েল। ঝট করে ওঠে অর্হিতাকে বুকপাঁজরে জড়িয়ে ধরে। অর্হিতার রক্তপ্রবাহ যেন থমকে যায়। শ্বাসরুদ্ধ করে ঘটনার আকস্মিকতা আন্দাজ করতে সময় লেগে যায় তার। কণ্ঠে প্রখর আবেগ নিয়ে বলতে থাকে নায়েল—

“প্লিজ অর্হিতা, আমি আমার সব কাজের জন্য ক্ষমা চাইছি। প্লিজ, কোথাও যাবেন না। প্লিজ।”

অর্হিতার কী যেন হলো। সে কিছুই বলতে পারল না। কাঁপন শুরু হলো তার দেহে। তরতর করে তার ভেতরের শীতলতা উষ্ণ হতে লাগল। বিগলিত হলো সমস্ত রাগ, অভিমান। নিজের অজান্তেই আঁকড়ে ধরল নায়েলকে। অদ্ভুত, অবোধ্য, অপ্রমত্ত অনুভূতির সাগরে তলিয়ে গেল সে। অনাস্বাদিত এক প্রগাঢ়, অতলান্তিক ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হলো অনুপলেই। যখন বুঝতে পারল নিজেকে সংকুচিত করে নিল অর্হিতা। অবিচ্ছিন্ন পুরুষালী সৌরভে অর্হিতার নারীমন অসহায় হয়ে পড়ে। সে মিষ্টি সুরে বলল—

” এইটা আবার সরি বলার কোন পদ্ধতি! সরুন মি. গিরগিটি।”

নায়েল কেঁপে ওঠে। অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুততার সাথে সরে আসে। ব্রীড়াময় চাহনি। মিচকি হাসি অর্হিতার অধরের কোণে। ছেলেমানুষ এত লজ্জা পায়! তার সুপ্ত মন যেন আকাশ কাঁপিয়ে হাসছে। কিন্তু তার আভাস পায় না নায়েল। নায়েলের দিকে মজার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সশব্দে হেসে ওঠে অর্হিতা। হেসে হেসে বলল—

“চিন্তা করবেন না। এত সহজে আপনার পিছু ছাড়ছি না। আর মরছিও না। পিউ বলল, আপনি না-কি বলেছেন আল্লাহ যাদের বেশি ভালোবাসেন তাদের নিজের কাছে ডেকে নেন! আমার ক্ষেত্রে তার ভালোবাসার পরিমাণ একটু কম। আমাকে তিনি এত তাড়াতাড়ি নিবেন না। এই যে দেখুন, দিব্যি আপনার সামনে বসে আছি। আব্বুর হার্টে ছিদ্র ছিল। টাকা ছিল না। বিনা চিকিৎসায় মারা যান আব্বু। আব্বুর শোকে মাস দুয়েকের মধ্যে আম্মুও মারা যায়। তারপর দুই ভাইবোন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী আর তার মানুষকে চিনতে শুরু করলাম। যার কেউ নেই পুরো পৃথিবীটাই তার। তাই না বলুন। এই পৃথিবীটাও আমার। ভাববেন না, রোগে-শোকে নিজের আত্মাহুতি দেবো। এত সাহস নেই আমার। নিজের জীবন নেওয়া কী এত সোজা! বেঁচে আছি, বেঁচে থাকব। যতক্ষণ না ওই ওপরওয়ালার পেয়ারি না হই। সো, ডোন্ট ওয়ারি মি. গিরগিটি। ”

কথা শেষ করেই মুক্ত হাসে অর্হিতা। তার ঝরা হাসিতে নায়েলের উদ্বিগ্ন মনে জলপ্রপাত নামে। অর্হিতা থমকে যায়। সন্ধানী গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—

“পিউর বাবা কোথায়?”

নায়েল কাতর চোখে তাকায়। একটু সময় নেয়। চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলল—

“মাহিম জানে না পিউর কথা। ডিবোর্সের পর আর কখনো ও এখানে আসেনি। আমিও খোঁজ নেইনি। পিউর কথাও জানাইনি।”

“ও আচ্ছা। আপনার বাবা হওয়ার সুপ্ত বাসনা পূর্ণ হলো তাই। সাবাশ!”

নায়েলের কাঁধে হাত দিয়ে সাবাশি দেওয়ার ভঙ্গিমায় চাপড় মারতেই ভ্রূকুঞ্চন করে নায়েল। মেয়েটা এত অদ্ভুত কেন?

চলবে,,,

#জঠর
#পর্বঃ১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ঊষরের বুকে এক প্রশান্তির ছায়া হয়ে পিউলীর জীবনে নেমে আসে অর্হিতা নামের এক জলপ্রপাত। যার প্রতিটি ধাবহান স্রোতে সে তার মাতৃস্নেহের সমস্ত তৃষ্ণা মেটাতে সর্বদা তটস্থ।

প্রভাতের মিষ্টি রোশনাইয়ের ঝলমলে আবরণে আচ্ছাদিত বসুন্ধরা আজ উচ্ছ্বাসিত। কিন্তু খানিক বাদেই তার দখল নিয়ে নিল কুঞ্চিত কৃষ্ণাভ কাদম্বিনীর ভাঁজ। লুকিয়ে গেল প্রভাকর কৃষ্ণাভ কাদম্বিনীর আড়ালে। থেমে থেমে ইলশেগুড়ি বৃষ্টির সাথে অগ্নিসখের টান। শীতলতা বইছে প্রকৃতিতে। নিমগ্ন প্রকৃতিতে খেলছে বৃষ্টি আর অগ্নিসখের দোল।

ছোটো এক টুকরো রুটি পিউলীর মুখে দিতেই উচ্চলিত হয়ে তা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে গিলে নিল সে। সাদা মুক্তোর মতো ঝকঝকে দাঁতের মিষ্টি হাসিতে বাতাসে দোল তোলে পিউলী। অর্হিতা সন্দিহান চোখে চেয়ে বলল—

“হাসো কেন?”

পিউলী খিলখিলিয়ে হাসে। অবারিত হাসি। বলল—

“তুমি সুন্দর।”

অর্হিতা কপট বিস্ময় নিয়ে বলল—

“ও মা! তাই না কি?”

“হুম।”

“কতটুকু সুন্দর?”

“অনেকটুকু।”

পিউলী তার দুই হাত ছড়িয়ে দেখায়। অর্হিতা মুচকি হাসে। তৎক্ষণাৎ কক্ষে ঢোকে নায়েল। একদম রেডি হয়েই এসেছে। পিউলীর দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র গলায় বলল—

“চলো পিউ, পাপার দেরি হচ্ছে।”

পিউলী উঠে দাঁড়াতেই তার হাত ধরে অর্হিতা। নরম গলায় বলল—

“ওকে নিতে হবে না। আজ থেকে পিউ আমার কাছেই থাকবে।”

পিউলী দন্তপাটি সমান করে হাসে। তার চোখ দুটো মিলিয়ে আসে। উপচে পড়ে খুশি চোখের পল্লবে। নায়েল বিছানার কাছে এগিয়ে আসে। পিউলীকে টেনে নিজের কাছে এনে চোখে, মুখে টপাটপ চুমু খেয়ে বলল—

“খুশি? মামুনি তোমাকে তার কাছে থাকতে বলেছে।”

“হুম।”

“গুড গার্ল। দুষ্টুমি করবে না। মামুনিকে জ্বালাবে না ওকে?”

“হুম।”

“মাই হার্ট। পাপা যাচ্ছি। বাই।”

“বাই।”

নায়েলের বুকের ওপর থেকে যেন পাথর সরে আসলো। দীর্ঘ স্বস্তির সাথে বলল—

“অর্হিতা, পিউর খেয়াল রাখবেন।”

অর্হিতা কপট কটাক্ষ করে বলল—

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। মেয়ের বডিগার্ড করেই তো এনেছেন।”

নায়েল ঠোঁট কামড়ে হাসে। ঝুঁকে অর্হিতার কানের কাছে গিয়ে বলল—

“তাহলে মেয়ের বাবার বডিস্প্রে হয় যান। আই ডোন্ট মাইন্ড।”

অর্হিতা দাঁত কিড়মিড় করে তাকায়। অসহ্য গলায় বলল—

“অশ্লীল !”

নায়েল ধুম করেই পিউলীর দিকে তাকায়। অর্হিতা জিব কামড়ে চোখ পিটপিট করে অস্ফুট গলায় বলল—

“সরিইইই। আর বলব না।”

নায়েল মাথা ঝাঁকায়। মিষ্টি হেসে বলল—

“পাপা যাচ্ছি পিউ। বাই।”

“ওকে।”

কলেজে যাওয়ার তাড়া হৃতির। কোনোমতে ছুটে চললেই যেন হলো। দরজার কাছ থেকে দেখতে পেল নায়েল নিচে নামছে। বুকে ধাক্কা লাগে হৃতির। কাতর চোখ দুটো ফিরিয়ে নিয়ে পা বাড়াতেই নায়েলের শক্ত কণ্ঠের আহ্বান।

“দাঁড়াও হৃতি।”

হৃতি থমকায়। ফিরে তাকায় ছলছল লোচনে। আগ্রহীসত্ত্বা অনঢ়। টলটলে গলায় বলল—

“কিছু বলবে?”

নায়েল সামনে এসে অনুদ্বেগ সুরে বলল—

“চলো, আজ আমি তোমাকে কলেজ পৌঁছে দিচ্ছি।”

হৃতির অবাকের মাত্রা অভ্রভেদী। লক্ষ্যভ্রষ্ট তীরের ন্যায় চিন্তিত চোখে চেয়ে বলল—

“কেন?”

“এমনি। ইচ্ছে হলো।”

হৃতি আপত্তি করে বলল—

“প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারব।”

“আমি তোমাকে আমার সাথে যেতে বলেছি। চলো।”

“বললাম তো না।”

নায়েল শুনল না। খপ করে হৃতির হাত ধরে। হৃতি বদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রয়। বিস্মিত, বিমূঢ় সে। নায়েল কখনো এমন আচরণ করে না।
,
,
,
গাড়ির জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস। তাতে আছে সিক্ত সকালের মিষ্টি ঘ্রাণ। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে তুলোর মতো মেঘের ছড়াছড়ি। কুসুমকোমল সূর্যের রশ্মি একটু একটু করে তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে হৃতির চোখে, মুখে। নায়েলের শক্ত দৃষ্টি ফ্রন্ট মিররে। কণ্ঠে কাঠিন্যতা রেখে বলল—

“এসব করলে কেন?”

চট করে নায়েলের দিকে নজর ফেলে হৃতি। চকচকে চাহনি রেখে বলল—

“কী করেছি আমি?”

নায়েল গাড়ি থামায়। স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে কাত হয়ে হৃতির দিকে চেয়ে বলল—

“সেদিন তুমিই ছিলে সেখানে তাই না?”

হৃতি ফুঁসলে উঠে বলল—

“আমি ছিলাম বলে আমিই এসব করেছি তুমি ভাবলে কী করে?”

নায়েল তপ্ত শ্বাস ফেলে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বলল—

“তাতো তুমি ভালো করে জানো। সিঁড়ির উপর তেল ছিল। আর ঘরে একমাত্র তোমারই আনাগোনা রান্না ঘরে।”

হৃতি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল—

“রান্নাঘরে আমার যাতায়ত বলে আমিই এসব করেছি তুমি ভাবলে কী করে? রান্নাঘরে তো মাঝে মাঝে পিউলীও যায়। তাহলে ওকে কেন সন্দেহ করছ না?”

“জাস্ট শাটআপ ইয়ার। তুমি কী বলছ তা বুঝে বলছ তো?”

হৃতির চোখ বেয়ে ঝমঝমিয়ে শ্রাবণের ধারা নামে। নায়েল এভাবে তাকে বলতে পারে না। অবশ্য বলবেই না কেন? আশ্রিতাদের এর চেয়ে ভালো আচরণ আদৌ কী প্রাপ্য?
,
,
,
কুচকুচে আঁধারে অবগাহনে মত্ত বিভাবরী। তার আঁধার ফুঁড়ে মশাল জ্বালিয়ে স্বগৌরবে উঁকি দিচ্ছে সুধানিধি। ঘন কালো আঁধারে অস্পষ্ট আবছায়ায় বাসায় ফিরেছে নায়েল। জরুরি মিটিং থাকায় আজ একটু দেরি হয়েছে ফিরতে।

বসার ঘরের কৃত্রিম বাতির প্রখর আলো। সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে পা চালাতে থাকে নায়েল। ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীরের উৎফুল্লতা প্রয়োজন। গায়ের ব্লেজার খুলে তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে নায়েল। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয়। সময় প্রহরী তখন জানান দিচ্ছে রাতের মধ্য প্রহরের। চুলের পানি শুকিয়ে একটা পাতলা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে নেয় নায়েল। অর্হিতার কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত বোধ হয় তার। পিউলীকে আনতে হবে। মেয়েটা মামুনিকে পাওয়ার খুশিতে যেন সব ভুলে গেছে। নক করতেই ভেতর থেকে সাড়া পায় নায়েল। জড়তা ঝেড়ে ফেলে ভেতরে ঢুকে একটু অবাক-ই হয় সে। পিউলী ঘুমোচ্ছে তার পাশে আধো জাগরিত অর্হিতা। তার চোখে, মুখ তন্দ্রালুভাব। নায়েল মৃদুমধুর গলায় বলল—

“সরি, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। আমি পিউকে নিয়ে যাচ্ছি।”

অর্হিতা ঘুমো ঘুমো গলায় বাঁধা প্রদান করে বলল—

“না। আজ থেকে পিউ আমার কাছেই থাকবে।”

“ও আপনাকে ঘুমোতে দেবে না। রাতে জ্বালাবে।”

“এত চিন্তা! সেইটা তো আমাকে ওর মা বানানোর আগে ভাবা উচিত ছিল তাহলে।”

ট্রাউজারে এক হাত গুঁজে অনুতপ্ত চোখে তাকায় নায়েল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল—

“পিউ খেয়েছে তো?”

“হ্যাঁ। খাইয়ে দিয়েছি।”

“আপনি খেয়েছেন?”

“আমি কার জন্য না খেয়ে থাকব? তেমন কেউ তো নেই।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়েল। ঘুরে দাঁড়াতেই অর্হিতার কঠোর গলার প্রশ্ন—-

“আপনি খেয়েছেন?”

“নায়েল ফিরে তাকায়। নম্র স্বরে বলল—

“হ্যাঁ।”

অনেকটা বিনীতভাবেই বলে উঠে অর্হিতা—-

“আপনার কী একটু সময় হবে? আপনার সাথে একটু কথা ছিল।”

নায়েল অধর চেপে ধরে মাথা ঝাঁকায়। টুল টেনে একটু দূরত্বে বসে।

“বলুন।”

অর্হিতা ছড়ানো পা গুটিয়ে নিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল —-

“হৃতিকে আপনি কী বলেছেন?”

চোখে হাসে নায়েল। তার ভাবভঙ্গি এমন যেন সে জানত হৃতি এমনটা করবে।
নায়েল সরস গলায় বলল—

“কী বলেছে ও আপনাকে?”

“মেয়েটা যথেষ্ট ভালো। আপনার ওকে এভাবে দোষারোপ করা উচিত হয়নি।”

নায়েল তার উপরেরে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরক্ষণে সরল গলায় বলল—

“আমি জানি। হৃতি এমন কাজ করতে পারে না।”

“তাহলে?”

“আমি চাই ও এই বাড়ি থেকে দূরে থাকুক।”

“কিন্তু কেন?”

নায়েল পূর্ণ নজর ক্ষেপণ করে অর্হিতার দিকে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। অর্হিতা গুমোট হাসল। ভাবাবেশ ছাড়া বলল—

“একটা মেয়ের পক্ষে একা একটা সমাজে বসবাস করা এত সহজ নয় নায়েল। ওকে আপনি হোস্টেলে যাওয়ার কথা বলেছেন। মেয়েটা বয়স হিসেবে এখনো অনেক নাজুক। কাজটা আপনার ঠিক হয়নি। পাথরকে আঘাত করলে হয় সে চূর্ণবিচূর্ণ হবে না হয় যে তাকে আঘাত করবে তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেবে। কিন্তু মোম! মোম গলে যাবে। তাকে তার স্থায়িত্ব অশিথিল রাখতে তাপ থেকে দূরে থাকতে হবে। হৃতি মেয়েটা মোমের মতো। আপনাকে ওর ছায়া হতে হবে। ওকে সমাজের অবাঞ্চিত তপ্ততা থেকে আপনাকেই রক্ষা করতে হবে। মেয়েটা আপনাকে অনেক ভরসা করে, হয়তো ভালোও বাসে। কিন্তু আপনার মনে হয়তো সেই ধরনের কোনো অনুভূতি নেই। অবশ্য থাকলেও এখন আর কাজ হবে না। আমার অধিকার আমি অন্য কাউকে দেবো না। এতটা উদার নই আমি।”

নায়েলের কপালের মাঝ বরাবর কুঞ্চিত হয়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে তাকাল অর্হিতার দিকে। অর্হিতা অক্ষিকোটর ঘুরিয়ে নিয়ে বলল—

“এখন আপনি আসতে পারেন। ঘুম পাচ্ছে আমার। আরো কিছু বলার ছিল। কাল বলব। রাত জাগলে আবার আমার খিদে লাগে। যান। গুড নাইট।”

নায়েল বিরক্ত হবে না-কি আফসোস করবে ভেবে পায় না। মেয়েটার ব্যবহারে দিনকে দিন সে অবাকই হচ্ছে। অধিকারের কথা বলে নায়েলের পুরুষ হৃদয়েও ঝড় তুলে দিলো। নায়েল হতাশ শ্বাস ফেলল। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে যেতেই পাতলা চাদরের ভেতর থেকে ঘুমকাতুরে গলায় বলে উঠে অর্হিতা—

“লাইটটা অফ করে দিবেন প্লিজ। আলোতে ঘুম আসে না আমার।”

নায়েল ধীরগতিতে তাই করল। দরজা চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। নিজের কক্ষে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আর তার চোখের দর্পণে ধরা দিচ্ছে না। তার অবাধ্য মন ছুটে চলছে কোনো অজানা উদ্দেশ্যে। নায়েল বিভ্রান্ত। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সে অনেকদূর চলে এসেছে। এখন তো নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত তার।

চলবে,,,