জলফড়িং পর্ব-১৩

0
344

#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ১৩

লাইন অন করে তৎপর পায়ে দ্রুত এগিয়ে কম্পিত হস্তে দরজা খুলে কাঙ্ক্ষিত মানুষ’কে চক্ষে বিঁধে ইরার। আদি শান্ত অথচ গম্ভীর চক্ষে ওর দিকে ভ্রুঁদ্বয় ঈষৎ কুঞ্চিত করে নেত্র মেলে চেয়ে। যেন আজ নতুন কোন মানবীর সাক্ষাৎ নিতে এসেছে সে! অতঃপর গম্ভীর, সরস গলায় বলল,

—” সামনে থেকে সরে দাঁড়াও!”

অনিচ্ছায় শর্তেও সরে দাঁড়ায় ইরা। আদি ভেতরে ঢুকে নৈশব্দ্যে দরজা লক করে দেয়। বক্ষস্থল ধ্বক করে কেঁপে উঠে ইরার। ভীতসন্ত্রস্ত চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায়। আদি সময় ব্যায় করেনি সোজা ইরা’র সিঙ্গেল খাটে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে! ওর হাতে ইরার এন্ড্রয়েড ফোন! আদি সে-ই ফোনে দৃষ্টি স্থবির রেখে। ক্ষীণ আওয়াজে বলে,

—” বসো, কিছু কথা আছে তোমার সাথে!”

নিরুপায় ইরা চুপচাপ ওর স্ট্যাডি টেবিলের চেয়ার টেনে বসে। আদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরর্বার গম্ভীর্যে ভরপুর গলায় প্রশ্ন করে,

—” রাহুলের সাথে যোগাযোগ হয় তোমার তাই না?”

অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো ইরার! হকচকিয়ে, বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো আদির গম্ভীর্য, রোষাগ্নি আদলে। সাহসা হাত-পায়ে কাম্পন ধরে! বুক ধড়ফড় করে! ঘন ঘন পলক ঝাপটায় আনমনে। হ্যাঁ ইরা নিজের ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছে, শত বাঁধা অতিক্রম করে! বাড়িতে কারোই যোগাযোগ নিষিদ্ধ রাহুলে সঙ্গে। এটা বাড়ির কর্তাদের কড়াকড়ি আদেশ! অথচ সেই আদেশ ও অমান্য করেছে বহু আগে। ইরা পুনরায় কয়েকপল আঁখিপল্লব ঝাপটে আদি’র হাস্তে বন্দী ওর ফোনে করুণ চক্ষে তাকায়। পুনশ্চ, ঠাওর হয় মিথ্যে বলার অবকাশ নেই কিঞ্চিত পরিমাণ। অর্থাৎ নতমস্ত’কে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নম্র গলায় শুধায়,

—” হ্যাঁ আমি ভাইয়া’র সঙ্গে রোজ কথা বলি! ওর সঙ্গে আমার শুরু থেকে যোগাযোগ ছিলো! ”

আদি কস্মিনকালেও ভাবেনি ইরা অকপটে এতটা সহজেই স্বীকার করে নিবে বিষয়টা! আজ ইরা’কে যতই দেখছে যেন নতুনত্ব কারো সঙ্গে ওর পরিচয় হচ্ছে। বাড়ীতে কেউ-ই হয়তো এপর্যন্ত ইরার মতো সাহস দেখায়নি! যতটুকু মেয়েটা একদিনে দেখালো। ইরা সাহসী আদিও জানে, মানে। কিন্তু ওর এখনো এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে কিভাবে ও মুখের উপর সব একের পর এক সত্য বাক্যগুলো আওড়ে যাচ্ছে! মেয়েটার ভয় হচ্ছে না কেন? যদি ও কথাটা ছোট বাবা’কে বলে দেয় তো কী হবে ভেবে কেন বুক কাঁপছে না? আদি বিস্ময়াবিষ্ট, হতভম্ব, গমগমে গলায় বলে,

—” রাহুল, কোথায় থাকে এখন? ”

ইরা’র সহজ প্রতুক্তি,

—” ঢাকায়! ”

ইরা কিঞ্চিৎ দম নিয়ে পুনরায় উৎফুল্ল গলায় শুধায়,

—” জানো? আমি দ্রুতই ফুপি হতে যাচ্ছি! ”

ইরা’র উৎফুল্লতা, সম্মুখে বসা বলিষ্ঠ পুরুষের নিকট আচমকা বিষ ঠকলো। আদি শক্ত, রাশভারী গলায় বলল,

—” তোমার ভাই, সত্যি-ই ঐ মেয়েটার সঙ্গে ভালো আছে? ”

ইরা সাহসা ঝট করে উঠে! রাগান্বিত গলায় শুধায়,

—” কী বুঝাতে চাইছো? ঐ মেয়ে বলে? ”

সাহসা আদি হুট করে উঠে দাঁড়ায়। জোড়ালো পায়ে একদম ইরা’র সম্মুখে এসে দাঁড়ায়! সঙ্গে সঙ্গে ইরা থতমত খেয়ে হকচকিয়ে যায়। আদি সেটা দেখে ঠোঁটে’র কোণায় বিস্তৃত হাসি ফুটিয়ে অঅন্যরকম, ক্ষীণ আওয়াজে শুধালো,

—” রেগে যাচ্ছো? আচ্ছা, তুমি কী সত্যি আমাকে বিয়ে করতে চাও না? নাকি রাহুলের ব্যাপার’টা আমি-ই বাসায় জানিয়েছিলাম বলে আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছো! প্রতিশোধ নিচ্ছ?”

আদি’র কণ্ঠে পূর্বের মতো গাম্ভীর্যের, দাম্ভিকতার রেশ মাত্র নেই। আকস্মিক অত্যন্ত ভিন্ন ঠেকল চিরচেনা ভরাট কন্ঠের আওয়াজ! এহেন নরম, কোমল, তেজহীন নিষ্প্রাণ, ঘোর লাগা কণ্ঠে আদি ইতিপূর্বে কখনও ইরা’র সঙ্গে-ই কথা বলেছে ব’লে মনে পড়না। অথচ আজ বলছে, এবং আদি’র এভাবে সান্নিধ্যে চলে আসায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ইরা! বৃহৎ ঢোক গিলে, শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে আদি’র মুখশ্রীতে নেত্র নিবদ্ধ করে। আদি কাঙ্ক্ষিত প্রত্যুত্তরে’র আশায় ওর দিকে চেয়ে! ইরা একসঙ্গে কম্পিত, ভীত, অস্বস্তিকর গলায় বলল,

—” ভাইয়া..! তুমি ভুল বুঝছো। আমার রাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাইয়া’র বিয়ের কিছুদিন আগে হয়! তাহলে আমি প্রতিশোধের জন্য কিভাবে রাদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছি? আমি কী জানতাম ভাইয়া এভাবে বিয়ে করে নিবে? আমি আসলে তোমাকে শুধু-ই আমার ভাই ভাবি একদম রাহুল ভাইয়ার মতো! তাছাড়া আমি রাদ’কে…! ”

শ্লেষাত্মক বাক্যটি সম্পূর্ণ করার পূর্বেই আকস্মিক ইরা’র গ’লা চেপে ধরলো আদি! সাহসা ভরখে গেলো ইরার ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা! হতবিহ্বল চক্ষে চাইলো আদি’র অত্যন্ত শান্ত, শীতল গম্ভীর মুখে। আদি হাতে তখনও বল সৃষ্টি করেনি কিন্তু আলতো ভাবে শুধু গলা’টা চেপে ধরে ইরা’কে উঠিয়ে নিজের মুখোমুখি টেনে আনে। নিষ্প্রভ, বিগলিত গলায় বলে,

—” আমিও তোমাকে ভালোবাসি ইরা! সে-ই ছোট্ট বেলা থেকে। শুধু বুঝতে পারিনি! আমাকে একটা সুযোগ দাও প্লিজ লক্ষ্মীটি!”

কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ইরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও। আদি’র মুখনিঃসৃত এহেন কোমলবাক্য গুলো বজ্রপাতের ন্যায় শ্রবণেন্দ্রিয়ে ঝটকা খেয়ে অন্তর বিষিয়ে, বিষাক্ত করে তুললো মুহূর্তে। এপর্যায়ে এক ধাক্কায় আদি’কে নিজের থেকে দূরে ঠেলে দেয় ইরা। আদি’র সান্নিধ্যে বিব্রত করে তুলছে ওর অভ্যন্তরীণ!

আদিও নিরর্থ, নির্জিব বস্তুর মতো দূরে গিয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো। ইরা’র নাক, কান দিয়ে যেন গরম দোয়া নির্গত হচ্ছে। কী বলল এসব আদি? ও প্রচণ্ড অপ্রস্তুত আদি’র এহেন স্বগতোক্তি’তে। আদি ইরা’কে কী ভাবে না ভাবে ওর জানা নেই। ইরা আদি’কে ভাই বৈ অন্যকিছু কস্মিনকালেও ভাবেনি! ফলস্বরূপ এহেন কথায় ভীষণ রকম অস্বস্তি বোধ হচ্ছে আদি’র সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতেও! ছিঃ, আদির মনে তাহলে এই ছিলো? ও এমনটা কখনোই ভাবেনি। ও ভেবেছিলো ইরা প্রেম করে এবং আদি’র সঙ্গে, বড় বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। এখন বিয়ে ভেঙ্গে গেলে বাসার সবাই কষ্ট পাবে, বা পাচ্ছে, বলেই আদি রাগ দেখাচ্ছে। কিন্তু না বিষয়টি আরও জটিল!

ইরা কিয়ৎক্ষন চেষ্টা করেও রা করতে পারলো না। নিরুত্তর, নিসাড়া যেন ওর শ্বাসনালী কেউ চেপে ধরে রেখেছে। ফলশ্রুতিতে শ্বাসরুদ্ধকর, দমবন্ধ এক পরিস্থিতি! আদি ইরার স্তিমিতনেত্র, অপ্রস্তুত, বিব্রতকর মুখশ্রীতে চক্ষুদ্বয় বুলিয়ে পুনর্বার অনুরক্তির সুরে ঠাণ্ডা আওয়াজে বলল,

—” লিসেন টু মি ইরা, আমি জানি তোমার আমার আচমকা অনুভূতি প্রকাশে খারাপ লাগছে। আমি জানি তুমি আমাকে ভাইয়ের চোখে-ই দেখো। কিন্তু আমিও মানুষ আমার নিশ্চয়ই অনুভূতি থাকতে নেই এমন তো নয়, তা-ই না? আমি ভালোবাসি তোমাকে! এতদিন তোমাকে বাজে পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইনি বিদায় আমি নিজের অনুভূতি হাইড করে গিয়েছি। আমি তোমার খারাপ চাইনি কখনো! তাছাড়া আমাদের বিয়ে হবে এটা আমি অনেক আগে থেকে জানি। ভেবেছিলাম বিয়ের পর তোমাকে সব জানাবো। কিন্তু আজ তুমি অন্যকারো সঙ্গে সম্পর্ক আছো শুনে আমি এভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি! আমি এটা মেনে নিতে পারছিনা তুমি অন্য…!

দেখো ইরা বাসায় সবার আমাদের নিয়ে অনেক আশা, ভরসা! সমাজের আর পাঁচটা বাচ্চার মতো আমরা বড় হইনি। আমাদের চাওয়ার আগেই আমরা সব পেয়েছি। আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে আমাদের গার্জিয়ান! কখনো কিছুর কমতি, খামতি রাখেনি কিছুতেই। সর্বোচ্চ ভালোবেসে আগলে রেখেছেন সকলে মিলে। বাবা, ছোট বাবার শুধু একটা মাত্র চাওয়া আমারা যেন ভালো থাকি! তাদের সম্মান রাখি!

সে-ই আমরাই আজ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি নিজেদের মতো করে! জীবন ভর ভালোবাসার প্রতিদান দিচ্ছি তাদের সম্মান, শিক্ষায় আঙুল তুলে। তাদের সিদ্ধান্ত’কে অমান্য করে। ওদের মনে এর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করছে সেটা একটি বার ভাবছিনা। রাহুল ভালো খারাপ যেভাবেই হোক, না বলে এভাবে বিয়ে করে নিয়ে কী কোনও অন্যায় করেনি? তাও একটা বিবাহিত মেয়ে’কে…!

সমাজ আমাদের দিকে ওর জন্য আঙুল তুলেনি বাজে ভাবে? অস্বীকার করতে পারবে আমি এগুলো মিথ্যে বলছি? আমিও রেগে গিয়েছিলাম ব’লে-ই ঐদিন কিছু কথা বলে ফেলি খুব অন্যায় করে ফেলেছি কী ইরা? রাহুলের সাথে বড় ভাই হিসেবে, সেটা বাদ দিলাম বন্ধু হিসেবে এটুকু রাগ দেখানো আমার ভুল ছিলো?

তুমি একবার ভাবো যে-দিন ঐ মেয়ের হাসবেন্ড আমাদের বাসায় এসে আমাদের বাবা-মা’র উপর কাঁদা ছুড়ে মেরে গেলো। বাজে ভাষায় গালাগাল করে শিক্ষায় প্রশ্ন তুলে গেলো। ওদের কেমন লেগেছিলো তখন? ”

ইরা জলে টইটম্বুর চক্ষে, শুষ্ক ঢোক গিলে। কম্পিত অতর্কিত গলায় বলে,

—” ক..কী বলতে চাইছো তুমি? ”

আদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পুনর্বার এসে ইরা’র মুখোমুখি দাঁড়ায়! ওর বলিষ্ঠ উষ্ণ হাত ওর গালে হাত রাখতে গেলে ইরা তৎক্ষনাৎ কয়েক পা পিছিয়ে যায়।আদি বিগলিত হাসে! স্পষ্ট গলায় বলে,

—” ভয় পেও না ইরাবতী। আমি তোমার সাথে অন্যায় কিছু করবো না!

আমি শুধু বলতে চাইছি। আজ রাহুলের মতো একি ভুল তুমি করে আবারও সবাই’কে কষ্ট দিলে। কিভাবে বললে বাবার সামনে বসে ঐ কথা গুলো? আমাকে কষ্ট দিলে, এতটা দিন ধরে জমানো আমার অনুভূতি গুলো রুষ্ট করলে। কেন ইরা? আমাদের কী কোনও অধিকার নেই তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার? আমি চাইলেও তোমাকে ভুলতে পারবো না ইরা! ছোট্ট বেলার অনুভূতি কী করে পারবো? আমি অনেক যুদ্ধ করেছি নিজেকে মানানোর কিন্তু পারছিনা। তা-ই আবারও তোমার কাছে ছুটে এসেছি! আমি চাই তুমি..!”

ইরা ঝাপসা চক্ষে চেয়ে! আতঙ্কিত গলায় বলল,

—” কী চাও তুমি?”

—” তোমরা দুইভা-ই বোন শুধু নিজেদের কষ্ট’টা-ই বুঝো। আমি চাই আমাকে নিয়ে তুমি একটু ভাবো। আচ্ছা ওয়েট ওয়েট যাও, প্র‍য়োজন নেই আমাকে নিয়ে ভাবার! শুধু একটু বাবা এবং মায়েদের কথা ভাবো। ওরা কতটা কষ্ট পাচ্ছে। তোমার ঔদ্ধত্য ভাব দেখে? আজ তুমি তাদের কতটা কষ্ট দিয়েছো। বড়বাবা একটি বার তোমার কাছে আসেনি। জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি তোমার কথা। সে কিন্তু জানে আমি তোমাকে আঁটকে রেখেছি তবুও, না!

আমি চাই, সবার কথা ভেবে অন্তত একটু স্যাকরিফাইজ করে নাও ইরা! এতগুলো মানুষ’কে শুধু মাত্র একজনের জন্য কষ্ট দিও না। যে-কিনা মাত্র কিছু দিন হলো তোমার জীবনে এসেছে। একটি বার আমাদের কথাও ভাবো, যারা তোমাকে ছোট্ট বেলা থেকে আগলে রেখেছে, ভালোবেসেছে, কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে..। অকৃতজ্ঞদের মতো সবার ভালোবাসা ভুলে যেও না। অনুরোধ রইলো প্লিজ!”

বাক্য সম্পূর্ণ করে। ইরা’কে দ্বিধান্বিতায় জর্জরিত করে ওর ছোট্ট মস্তিষ্ক, হৃদয় ঘোলাটে করে দিয়ে ওকে সেখানেই ফেলে আদি হনহনিয়ে দরজা খুলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়! ইরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির ন্যায়! এ-ই মুহূর্তে ওর কী করা উচিৎ, ঠিক বুঝতে পারছে না! আদি মিথ্যে কিছু-ই বলেনি। এ-র মধ্যে এটা-ই বড় সত্য যে ইরা আদি’র কথা ভেবে সেক্রিফাইজ করলে বেঁচে থাকবে হয়তো! শুধু ভালো থাকবে না! ইরা ভালো থাকতে চায়। শুধু বাঁচতে চায় না। বেঁচে থাকতে চায় বাঁচার মাতো। প্রাণপুরুষের কাধে নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে ভালোবেসে মাথা ফেলে সুন্দর ভুবনে, জীবন উপভোগ করতে চায় প্রানখুলে! এ-ই ছোট্ট চাওয়াটি কী তবে ঘোর অন্যায়? তবে বাবা মায়ের কষ্ট’টাও নিশ্চয়ই অগ্রাহ্য করতে পারবে না ও। তাহলে এখন কী করবে ইরা! বেছে দিতে হলে, কার ভালোবাসা বেছে নিবে? সবাইকে-ই তো ও অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসে!

ইরা’র ভাবভঙ্গি লুকিয়ে সূক্ষ্ম, নিগূঢ় চক্ষে পর্যাবেক্ষন করে আদি। ওর শুকনো মুখশ্রী, অশ্রুসিক্ত লোচন স্পষ্ট প্রমাণ করে! তীর জায়গায় মতো-ই লেগেছে। আদি অনেক ভেবেচিন্তে-ই ভোররাতে ইরা’র মস্তিষ্ক চিবিয়ে খেয়েছে। আদি স্পষ্ট জানে, এবার ইরা অনুতপ্ত হবে। সিদ্ধান্ত হীনতাবোধ করবে। কনফিউজড করে যে দিয়েছে আদি ওকে! কথার ছলে অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করেছে! দুই বছরের সম্পর্ক আর যাইহোক না কেন, বাবা মার উর্ধ্বে না। ও জানে এ-ই কথাটা লেগেছে জায়গায় মতো। ইরা’র মনকুটিরে দূর্বল স্থানে-ই আঘাত হেনেছে। এবার ইরা কতটুকু সেক্রিফাইজ করে সেটা-ই দেখার অপেক্ষায়!

আদি জানে এটা করা ওর একদম উচিৎ হয়নি! যেই কথাগুলো ওর বাবাও ইরা’কে বলবেনা যেটা ও আজ বলেছে। কিন্তু না বলেও আদি পারেনি। বাবার উপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই আদি’র, ইরা একটু কেঁদে-কেটে কিছু বললে-ই ওর বাবা’র নরম মন গলে যাবে! আদি কারো উপর নির্ভরশীল না থেকে ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে এটুকু চেষ্টা করতে চায়! নাহলে পুরো জীবন আফসোস থেকে যাবে। আদি একটুও চেষ্টা করেনি! ইরাবতী’কে নিজের করে পেতে!

এই মুহূর্তে আদি শুধু নতুন ভোরের অপেক্ষায়! রাহুলের সাথে কথা বলে ওকে নিয়ে আসবে ও বাড়িতে। তাহলে হয়তো ইরার মনে কিঞ্চিৎ ঠায় মেলবে ওর! সেটাই যে ওর জন্য অনেক!
____________

রাদ একাধারে ফোন দিয়ে যাচ্ছে নিজের ফোনে, যেটা এক মুহূর্ত না ভেবে ওর ইরানী’কে দিয়ে এসেছে। কিয়ৎক্ষন আগে বাসায় ফিরে এসেছে রাদ, ওর নিরিহ মা ওর জন্যে তখন পর্যন্ত সজাগ বসে ছিলো অথচ মায়ের সঙ্গে দু’টো বাক্য আওড়াতে পারেনি। কী করে পারবে? ইরা’র বাসা থেকে বেরিয়ে সে-ই যে ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে অথচ মেয়েটা তুলছে না! কানে বাজে শুধু দরজায় আঘাতের ঠক ঠক শব্দ গুলো! কিছু হলো না তো মেয়েটার! একটা-ই চিন্তা। যা চিত্তে সৃষ্টি করছে অস্থিরতা!

আকস্মিক একে একে সর্বদিক থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ আজানের মধুর ধ্বনি যেন কোণায় কোণায় গুঞ্জন সৃষ্টি করছে। প্রতিটা আত্মার জন্য সময়টা প্রশান্তির! কিন্তু শান্তি পাচ্ছে আজ শুধু রাদ! এ-ই তো মাত্র দেওয়া কলটা ইরা কেঁটে দিয়েছে। এবং পরপর একটা ম্যাসেজ দিয়েছে,” ভালো লাগছে না আমার! কল দিও না, প্লিজ ঘুমাও!”

রাদ ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জবাবে লিখলো,” প্লিজ ইরা একটু কল দাও, কথা বলতে হবে না শুধু কল দাও। ”

ইরা’র পড়ের রিপ্লাই’টা রাদ’কে ভেঙ্গে দিয়েছে,” রাদ প্লিজ। আমার ভালো লাগছে না তুমি বুঝতে কেন পারছো না!”

এহেন পরিস্থিতিতে ইরা এভাবে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না! পুনর্বার বড্ড নেগেটিভ ভাবছে রাদের মন। ওর নেগেটিভ ভাবনা গুলো কখনো মিথ্যে হয় না। তাহলে এবার কী হবে? কাশিশ সম্মুখে বসে কিন্তু রাদ বলতে পারছে না। ইরা ফোন কেঁটে দিয়েছে। এখন ফোনটাই বন্ধ করে দিয়েছে। রাদ তবুও, অস্থির হাতে একনাগাড়ে কল দিয়ে যাচ্ছে। জুহা ছেলের অস্থিরতা, ব্যাকুলতা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। কাশিশ এটা সেটা বলেও রাদ’কে শান্ত করতে পারছেনা। রাদের কপাল বেয়ে চিকন ঘামের ঝরছে। সম্পূর্ণ শার্ট ভিজে গেছে ঘামে তার! চোখ দু’টো টকটকে রক্তিম! নির্ঘুম একটি রাতের শ্লথ আদলে স্পষ্ট! পূর্বের থেকেও বড্ড মলিন, ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে সুশ্রী মুখটা। জুহার সহ্য হলো না আর, আচমকা দ্রুত পদে হেঁটে ভেতরে এলেন৷ কাশিশ’কে স্পষ্ট গলায় বললেন,

—” তোর রুমে যা, গিয়ে ঘুমিয়ে পড় কেমন দেখাচ্ছে সেই খবর আছে! আমি দেখছি ওকে!”

জুহা’র কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো যা কাশিশ’কে মায়ের কথা অগ্রাহ্য করতে দেয়নি। কাশিশ একনজর রাদের চিন্তিত মুখে তাকিয়ে উঠে চলে গেলো। জুহা রাদের কব্জি টেনে বেডে বসিয়ে নিজেও বসলো। সঙ্গে সঙ্গে জুহার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে রাদ গুটিসুটি মেরে! জুহা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আদুরে স্পর্শে! নরম গলায় বলে,

—” খিদে পেয়েছে?”

রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ লাঞ্চ টাইমেও কাজের চাপে খেতে পারেনি। তারপর খাওয়া-দাওয়া ঘুম এসবের কথা যেন মনে-ই পড়েনি। মায়ের নরম কণ্ঠে এখন অনুভূত হচ্ছে। পেটটা ঝলসে যাচ্ছে রীতিমতো! মাথা’টায় সূক্ষ্ম ভাবে ব্যাথা করছে খুদায়! রাদ আড়ালে মায়ের মায়াময় মুখশ্রীতে কিয়ৎক্ষন চেয়ে থাকে। মায়ের মুখটাও যেন আস্ত একটা ভালোবাসা! একনজর তাকালেও শান্তি! চক্ষু মুদে নেয় রাদ। আচমকা মলিন, সরল গলায় বলে,

—” খুব খিদে পেয়েছে মা! কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না!”

জুহার কলিজায় টান পড়ে। চক্ষু ভিঁজে উঠে। তবুও, নিজেকে শক্ত রাখে ছেলের সম্মুখে। মায়েরা সব পারে। কখনো পাথর, কখনো গলে যাওয়া মোম! জুহা ঝুকে ছেলের মাথায় চুমু খায়। চক্ষু বন্ধ রেখেই রাদ পুবরায় তপ্ত গলায় আবদার করে বলল,

—” ইরানী’কে ভালোবাসি মা, ওকে এনে দাও!”

রাদের মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে-ই জুহা দৃঢ়ভাবে বললেন,

—” ইরা তোমার ভাগ্যে থাকলে, অবশ্যই তুমি ওকে পাবে বাবা! ধৈর্য ধরো! ”

রাদের বন্ধ চক্ষু হতে গড়িয়ে পড়ে তরল অশ্রুকণা! মায়ের অলক্ষ্যে সেটা মুছতে ব্যাস্ত হয়ে উঠে টলমটল পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। রাদের বক্ষপিঞ্জর দাউ দাউ আগুনে পুড়ছে, ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে বক্ষঃস্থলে। সাথে এক সমুদ্র কষ্ট! এতটা ঝুঁকি নিয়ে ও ইরা’কে ফোন দিয়ে এলো! অথচ মেয়েটা ওকে এভাবে বলতে পারলো! তবে বসে বসে কেন কাঁদছিলো? ওর জন্য কাঁদছিলো তো? তাহলে একটু কল ইরা চাইলেই দিতে পারতো রাদ জানে! কিন্তু দিলো না কেন? আজ রাদ প্রেয়সীর মতো কাঁদতে পারেনা বলে! অবহেলা করতে পারেনা ব’লে! বেহায়া মন এখনো চাইছে, ওর ইরানীর নিশ্বাসের শব্দ কুটু হলে-ও একটু শুনতে!

রাদ অবুঝ নয় ও জানে, একটু কথা কালকেও চাইলে বলতে পারে। কিন্তু ওর অভ্যন্তরীণ সেটা বুঝতে অক্ষম। অস্থির, বেসামাল মন ওকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। কেন যেন মনে হয় সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে! ইরাণী’কে পাবে তো সঙ্গেসাথী অর্ধাঙ্গী রূপে? ক’টা সুন্দর দিন, মুহূর্ত উপভোগ করতে পারবে তো ধরণীর বুকে! ঐ শ্যামা কন্যা কোন আসক্তি’তে আসক্ত করলো ওকে! শ্যামা কন্যা এতটা নিষ্ঠুর কেন?

চলবে!