জলফড়িং পর্ব-১৫

0
305

#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ১৫

রাদ এবং তার ইরানীর জীবন’টা যেন গোল গোল চক্রান্তের ন্যায় ঘুরছে। ক্ষনিকের জন্যেই মনে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় অভ্যন্তরীণ! প্রেম, প্রণয় এসেছিলো বুঝি মরিচিকা হয়ে। তা-ই তো দু’জনের গন্তব্য, যোগসূত্রে এসেও দু’জন দু’জন’কে পাবে তো? প্রশ্নটা থেকে-ই যায় বারংবার!

কাল যখন ইরা’র সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত, বি’ষা’ক্ত একটি ঘটনা অপ্রত্যাশিত ভাবেই ঘটে গেলো। স্তব্ধীভূত ইরা ভাবেওনি সে-ই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটানাটি রাদ’কে অর্ধাঙ্গ হিসেবে পাইয়ে দিতে একধাপ এগিয়ে দিবে। ফলশ্রুতিতে যতটা ভ’য়, বি’তৃ’ষ্ণা আদি’র জন্য বরাদ্দ ছিলো। ততটাও হতে পারেনি ইরা। যখন বড়বাবা। আদি’র থেকে নিয়ে ওর ফোন দিয়ে গেলো এবং এ-ও বলে গেলো। রাদের গার্জিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে যতদ্রুত সম্ভব।

ঘোলাটে মস্তিষ্কেই ইরা তৎক্ষনাৎ ভাবলো কিন্তু হায় ইরা’র স্মৃতিপটে কোথাও রাদের মায়ের নাম্বার নেই, কেননা কখনো প্রয়োজন-ই পরেনি নাম্বারটি সংগ্রহে রাখার। কিন্তু যদি সংরক্ষণে থাকতো ও তখনই বাবার নিকট হস্তান্তর করে দিতো নাম্বার’টি! অর্থাৎ মন চাইলেও ভাগ্য হলো না। এখানেই বেঁধে আছে এখন বিপত্তি!

দুই বাবা ইরা’র রুম ত্যাগ করতেই রুমে এলো নীলা, উনার দুশ্চিন্তার ভাড় চক্ষে ছিলো অনুশোচনা। অতঃপর মা যখন ওকে সান্ত্বনা দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে রুম ছাড়লেন। ইরা মায়ের সঙ্গে মুখ খোলেনি। মীতির কাধে মাথা রেখে সে-ই থেকে ভয়, ডর, নাওয়া, খাওয়া সর্বত্র ভুলে রাদ এবং কাশিশের নাম্বারে লাগাতার কল দিয়েই গেলো। কিন্তু ফোন বরাবরের মতোই বন্ধ, দুজনের!

দুঃখে, কষ্টে, হতাশায় ইরা’র ব্যাথিত মনে গহিন ভাবনায় এলো। প্রেমে মত্ত্ব হওয়াটা ওর জীবনের চরম ভুল ছিলো। প্রণয় হয়ে এসেছিলো যখন এতটাও কাবু না করলেও পারতো রাদ ওকে! এখন যে ও প্রাণপুরুষ ছাড়া এক মুহূর্ত নিজেকে কল্পনাও করতে পারে না। প্রেম বড্ড বেদ’নার আজকেই বিষয়টি গভীর, অত্যন্ত গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম ইরা। আজকে ভীষণ অস্থির লাগছে মনে হচ্ছে আজ যদি রাদের সঙ্গে কথা না হয়। রাদের ইরানী বুঝি ম’রে’ই যাবে। এ-রকম অস্থিরতা সে-ই প্রেমের শুরুতেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলো ইরা। এর-পর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় রাহুল বাড়ি ছাড়া হলো। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরলো ইরা। এ-র পর ও কখনো রাদের গাঢ় ভালোবাসায় অস্থির কিংবা বেসামাল হতে পারেনি। রাদের সঙ্গে গা ভাসিয়ে সমানতাকে রাদের গভীর প্রেম উপলব্ধি করতে ত্রুটি থেকে যায় ওর। ফলস্বরূপ বর্তমানে বুঝতে কষ্ট হয় রাদ’কে ওর। ওর ও বা কী দোষ? ইরা চুটিয়ে প্রেম করার সময়েও গভীর এক চিন্তায় আপন খেয়ালি ভাবেই দুশ্চিন্তায় মগ্ন থেকেছে। রাদ’কে বুঝতে দেয়নি কখনো এসব! তখন রাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দায় ছিলো ভালোবেসে ফেলেছিলো যে রাদ’কে ভীষণ তেমনি মন গহীনে ছিলো প্রখর ভীত ও। ধরেই নিয়েছিলো ইরা কখনোই রাদ’কে পাবে না ও।

প্রেমের শুরুতে মানুষ কখনোই ভবিতব্য উপলব্ধি কিংবা আঁচ করতে পারেনা। স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে ইরা নিশ্চয়ই স্পেশাল কেউ নয়। ইরা’র সঙ্গেও তা-ই হয়েছিলো ভবিষ্যতে কী হবে তার ধারণা টুকুও ছিলো না ওর। তবে ধীরে ধীরে সময়ের পাল্লায় দ্বার প্রান্তে বদলে যায় সমস্তটা। ভাইয়ের জীবনের গাঢ় আঁচ ওর জীবনেও প্রখর ভাবে পড়েছিলো যে! যদি-ও সম্পূর্ণ ঘটনাটি কাকতালীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো।
_______
তখন ইরা সবে ইন্টার এক্সাম শেষ করেছে। পড়াশোনা’টা বরাবরই আদি’র ভয়ে কোনও রকম সামলেছে ও। এদিকে আদি, রাহুল দুর্দান্ত স্টুডেন্ট। সে-ই দিকে দেখতে গেলে। ওরা দুই’বোন বিশ্বফাঁকিবাজ। মীতি, ইরা দু’জনেই একমাত্র আদি’র ভয়েই বই নিয়ে বসে। আদি’র সম্পূর্ণ উল্টো ছিলো রাহুল! রাহুল’কে দু’বোন কখনো ভয় পেতনা। এ-র কারণ রাহুল কখনোই ওদের ধমক দিয়েও কথা বলতো না। দুইবোনের সকল অন্যায় আবদার ছিলো রাহুলের নখপ্রান্তে। প্রাণখোলা, চঞ্চল স্বভাবের রাহুল উচ্চবাচ্য পছন্দই করতোনা। স্বভাবসুলভ হাসি মুখে বোনদের অন্যায় আবদার সামলাতো। আদি’র ক’ঠো’র শাসন থেকে যথাসম্ভব বাঁচাত। শাসন ও করতো প্রয়োজনে তবে সেটা একদমই ভিন্নভাবে। যেন বোনেরা ক’ষ্ট না পায়!

বাসায় সকলের আদরের এ-ই চার সন্তান। পড়াশোনায় এগিয়ে পিছিয়ে থাকলেও পরিবারের সকলের মতো এ-ই চার সন্তানের মধ্যেও ছিলো গভীর মিলমিশ। আদি, রাহুল ছিলো ভাই কম বেষ্টফ্রেন্ড বেশি। তবে আজমল খাঁন বরাবরই ইরা’কে নিজের গভীর আদর, আহ্লাদের, মুড়িয়ে বটবৃক্ষের ছায়াতলে লুকিয়ে রাখতেন। সে-ই আদর থেকেই আদি’কে কিঞ্চিৎ উপেক্ষা করে ইরা যা খুশি করে ফেলতো। ওর সকল আবদার কেউ না কেউ পূর্ণ করেই দিতো। যদি-ও অনেক সময় কেউ-ই রাজি হতো না। তখন একমাত্র বড়বাবাই ছিলো ওর একমাত্র, শেষ মাত্র ভরসা। যেখান থেকে ইরা কখনো খালি হাতে ফিরেনি।

পড়াশোনায় যদি-ও ওতটা ভালো ছিলোনা ইরা। তবে একবারে খারাপও না। ফলস্বরূপ ইন্টার শেষ করা মাত্র ইরা’র মনে হলো ও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। আসলে কলেজ বান্ধবীরা অনেকেই ইতিমধ্যে ঢাকা চলে গিয়েছে এডমিশন কোচিং এর জন্য। সেই দেখেই ইরার চঞ্চল মনেও স্বপ্ন বুনলো সে-ও ঢাকা পড়েব। পড়তে পারবে নাকি সেটা কথা না। ও চেষ্টা করবে। মন শান্তি সব শান্তি এমনই একটা ফিলিংস ছিলো ওর৷ সাথে ছিলো একরাশ হাড়কাঁপানো উত্তেজনা! ঢাবিতে পড়বে ভাবতেই চঞ্চল মন উড়ি উড়ি!

যথারীতি খাওয়াদাওয়া শেষে রাতে সকলে যখন এক সাথে ড্রইংরুমে বসে আড্ডায় মশগুল। হাড়কাঁপানো উত্তেজনা সহিত ইরা’র সে-ই আবদার পেশ করা হলো। শুনে আজমল খাঁন বাদে ওর বাবা সহ, সর্বদা গম্ভীরমুখো আদি রাহুলসহ সবাই কিঞ্চিৎ হেসে ফেলল। ইরা প্রথমে স্তব্ধ হলো, পরপর নিশ্চুপ হয়ে গেলো! স্পষ্ট বুঝা গেলো মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে।

বরাবরই আত্মীয় স্বজনরা খোঁচায় ইরা, মীতি পড়াশোনায় ভালো না বলে। বিশেষ করে ইরা’র ফুপি। ইরা শ্যামলা বলেও নানান কথা শুনতে হতো তাকে। “পড়াশোনায় ভালো না তার উপর যেই চেহারা! কে বিয়ে করবে এই মেয়ে’কে ইত্যাদি ইত্যাদি!” এসব কটুবাক্য খুব একটা গায়ে মাখতো না সকলের আদরের ইরা। কেননা ও জানে ওকে আদর, ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। শুধু শুধু অন্যের কথায় কান কেন দিবে ইরা? কিন্তু সেদিন প্রিয় মানুষগুলোর তাচ্ছিল্য হাসি দেখে স্তব্ধ ইরা তৎক্ষনাৎ দৌড়ে রুমে ঢুকে গেলো। ওর বুক ভারী হ’য়ে আসছিলো সবার হাসিতে। রুমে ঢুকে দু’হাতে মুখ চেপে চিৎকার করে কেঁদে চক্ষুদ্বয় লাল করে মুখ ফুলিয়ে ফিলেছিলো কাঁদতে কাঁদতে। ওর বাঁধভাঙা কান্না শুনে পরিবারের সকলের বুকে দগ্ধ সৃষ্টি হয়। নিজেদের হাসিতে সকলেই স্তব্ধ!

আজমল খাঁন তখন সবাইকে বকাবকি করে ইরা’কে সামলায়। এহেন কাণ্ডে আদি’র সঙ্গে রাহুল নিজেও নিস্তব্ধ হয়েপড়েছিলো। লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলো রাহুল হেসে ফেলায়! ফলস্বরূপ বোনের সম্মুখে দাঁড়ানোর সাহস হয়নি আর। ফলস্বরূপ বোন’কে মানাতে ছুটে যেতে পারেনি তৎক্ষনাৎ। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে কালকে একটা ব্যাবস্থা করে দিবে। মেয়েটা চেষ্টা করতে চাইছে ক্ষতি কী তাতে? করুক না একটু চেষ্টা অনেকে তো সেটুকুও করে না। ভাগ্যক্রমে পরদিন রাহুলের আগে আদি-ই গম্ভীরমুখে ধমকে নিয়ে যায় নিজের সঙ্গে, গিয়ে ইরা’কে একটা কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসে।

ইরা পুরোটা সময় মন খারাপ করেই ছিলো। কিন্তু যখন বাসায় ফিরলো বিষয়টি বোধগম্য হলো ও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারবে। কিন্তু ওর চঞ্চল বাচ্চাসুলভ মন বুঝেওনি বিষয়টি স্বপ্ন বোনার মতো সোজা নয়। ক’ঠো’র চেষ্টা করতে হবে। আদিও ওকে বুঝিয়ে বলেছিলো। মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে এবং সে-ও ইরা’কে হেল্প করবে। সেদিন ইরা’র চক্ষে শ্রেষ্ঠ মানুষটি ছিলো আদি৷

এরপর আদি এবং আজমল খাঁন ছাড়া ইরা সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। কেননা ওর উপর হেসেছিলো ওরা। মাঝখানে ভর্তি কোচিং এ ভর্তি করিয়ে আদি হিরো হয়ে গিয়েছিলো ইরা চক্ষে, নিজের অজান্তেই! আদি আসলে সর্বদা হামকি ধমকি দিলেও ইরা’র চঞ্চল পদার্পণ বাড়ি জুড়ে, ওর মিষ্টি খিলখিল হাসির গুঞ্জন এগুলোই পছন্দ করতো। ইরা রাহুলের জন্যেই বাড়িটিতে অন্য এক প্রাণ খেলা করতো। সেখানে ইরা’র মন খারাপ মানে বাড়িটিতে সকলের বিষণ্ণতা তা-ই তো সকলের আগে সে-ই ইরা’র ইচ্ছাটি পূর্ণ করেছিলো। কিন্তু এই ইচ্ছে-ই যে শেষ পূর্ণতা ও বুঝিনি। ওর থেকে ইরা’কে জীবন এবং মরন দু’টোই কেঁড়ে নিবে সেটাও কী আদি উপলব্ধি করতে পেরেছিলো? কিভাবে করবে ভবিতব্য যে উপলব্ধি টুকু করা যায় না! তাহলে আদিও হয়তো ইরা’র মতো কাউকে ভালোবাসার ভুল করতোনা!
________

যেই এডমিশন কোচিং এ আদি ইরা’কে ভর্তি করিয়েছিলো। কোচিংটি ছিলো রাজশাহী শহরের বেষ্ট এডমিশন কোচিং। ইরা যে-দিন প্রথম ক্লাস ছিলো। আদি-ই ওকে দিয়ে এসেছিলো অরিয়েন্টেশন ক্লাসের জন্য। সেদিন’ই মূলত প্রথম দেখা হয় ওর প্রাণপুরুষের সঙ্গে। সম্পূর্ণ ফর্মাল লুকে অত্যান্ত স্মার্ট, খানদানি একটা ভাবভঙ্গি ছিলো রাদের মধ্যে। যেটা ওকে সবার থেকে না চাইতেও আলাদা আকর্ষণ করছিলো, নজর কাড়ছিলো। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত রক্ষনশীল পরিবারের আদুরে ইরা, কালো চুড়িদার পরনে একদম সাধারণ লুকে। কিন্তু রাদ ছিলো ওর শিক্ষকের স্থানে। এবং ইরা ছিলো স্টুডেন্টর স্থানে। তখন রাদের সঙ্গে ওর কখনো আলাদা করে কথা হবে সেটুকুও কস্মিনকালে ভাবেনি ইরা। বরং স্যার হিসেবে রাদ’কে ভিষণ ভালো লাগে ইরা’র। যদি-ও তখন প্রাণপুরুষের ব্যাক্তিত্ব’টাই মন ছুঁয়ে গিয়েছিলো ইরা’র অন্যকিছু নয়। এর একটি মাত্র কারণ রাদ কর্কশ স্বভাবের ছিলো না। ছিলো ওর ভাই রাহুলের মতো নরম, কোমল ব্যাক্তিত্বের সহজ মানুষ! যদি-ও ইরা’র ভাবনাটা ভুল ছিলো রাদ অনেকটা সহজ মানুষ হলেও সে গম্ভীর এবং রহস্যময় সুপুরুষ! যা-ই হোক সেদিন রাদ অনেক মোটিভেট করে সাবলীল, সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছিলো সবার সঙ্গে। উৎসাহী করছিলো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে। সেদিনটি একদম সাদামাটা কেঁটে যায়। আহামরি কিছুই ছিলো যেন। তবে এখন সেই দিনটির কথা ভাবলে অনেক কিছু ইরা’র অভ্যন্তরীণে। কেননা চিরজীবন সঙ্গীর দেখা ও সেদিনই পেয়েছিলো। যার কাছে নিজের ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা সমর্পণ করেছে ইরা।
___________

ফকফকা দিন গুলো সুন্দর অতিবাহিত হচ্ছিলো নতুন এক চেষ্টা সহিত! এরপর দু’দিন লাগাতার ক্লাস করার পর। ইরা জানতে পারলো রাদ আসলে কোচিং এর টিচার নয়। সে-ও এখানে এডমিশন কোচিং করেছে এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। বর্তমানে মাস্টার্স করছে পাশাপাশি ভালো জবও করে৷ সে সবাইকে মোটিভেট করতেই অরিয়েন্টেশন ক্লাসের জন্য এসেছিলো। ইরা কিঞ্চিৎ অবাক হলে-ও তেমন ভাবনার কিছুই ছিলো না বিষয়টি তার নিকট! আপন ভাবনায় বিভোর ছিলো ইরা! ওর আপন জগত যেখানে তার প্রিয় পরিবার ও সে ছাড়া কেউ ইম্পর্ট্যান্ট ছিলো না তখন তার নিকট!
_________

এডমিশন কোচিং এ চক্ষু ঘুরালেই সকলের এক অদম্য আগ্রহ, আশা, ভরসা, স্বপ্ন চক্ষে বিঁধে। কত কত স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বাঁচে চক্ষে লাগে। দিনরাত এক করে কেউ নিজের স্বপ্ন, কেউ মা-বাবার স্বপ্ন, কেউ বা ভালো একটা ভার্সিটিতে পড়াশোনার জন্যেই লড়াই করে থাকে। চকচক চক্ষে অক্লান্ত পরিশ্রম করে স্টুডেন্টরা। রঙিন চক্ষে থাকে হাজার স্বপ্ন। কারো বা এ-ই একটি মাত্র পরিক্ষায় বাকি জীবনটা নির্ধারিত। ইরা এখানে এসেছিলো শুধু মাত্র মনের শান্তি এবং একটু চেষ্টা করতে! কিন্তু এখানে আসার পর স্যার’দের আপ্রাণ চেষ্টা, উৎসাহ মূলক বানি। সকলের অদম্য চেষ্টা, আগ্রহ দেখে ওর সাধারণ চেষ্টা, আগ্রহ বিদ্যুৎ গতিতে বেড়ে গেলো। সৎ সঙ্গেই এটা সম্ভব হয়েছিলো। সহপাঠীদের দেখে ইরা নিজের মধ্যেও কনফিডেন্স পায়, ওর মধ্যেও অদম্য ইচ্ছে জাগে চেষ্টা, সুফলে দেখিয়ে দেওয়ার। ওর উপর তাচ্ছিল্যের, আদি’র বাঁকা হাসির জবাব দেওয়ার। কথায় আছেনা অসৎসঙ্গে সর্বনাশ সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস…। তাই হয়েছিলো ছোট্ট সবার আদুরে অবুঝ মেয়েটার সঙ্গে! ইরা এবার সত্যিই ধৈর্যের সঙ্গে পড়াশোনায় মনোযোগি হয়। দিনরাত এক করে পড়াশোনা করে ও। এ-র মধ্যে কয়েকজন ফ্রেন্ড ওকে একটি গ্রুপ চ্যাটে এড করে ফেইসবুকে। সেখানেই ইরা রাদের আইডি পায়। রাদ সহ ঢাকা ইউনিভার্সিটির অনেক স্টুডেন্ট, জুনিয়র স্টুডেন্টদের কোনও সমস্যা হলে হেল্প করতো। রাদের আইডি পেয়ে একপল না ভেবেই ইরা রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে দিয়েছিলো সেদিন। আইডিও ঘাটাঘাটি করে একটু-আধটু একদম সাদামাটা, নির্ভেজাল ওয়াল রাদের। যেন কোনও সাদাকালো দুনিয়ায় ঢুকে গিয়েছে ইরা। তবে একটি বন্ধুর আবাদ বিচরণ ছিলো ওয়াল জুড়ে! বন্ধুটি আর কেউ নয় কাশিশ। সে-ই একমাত্র বন্ধু যাকে ছাড়া হয়তো রাদের কখনোই চলে না।
_______

দিনকাল এভাবেই যাচ্ছিলো। রাদ ইরার রিকুয়েষ্ট ঝুলিয়ে রেখেছিলো। যদি-ও এ-ই বিষয়টি ইরা’র মনেও ছিলো না। তবে গ্রুপে প্রায় দেখতো রাদ এটা ওটা সাজেশন দিচ্ছে। ইরাও নিরবে সেগুলো লুফে নিতো।

তন্মধ্যে বাসার সকলে ইরা’র পড়াশোনার হাল দেখে বিস্মায়াবিষ্ট। তেমনি পুলকিত, আনন্দিত ওরা কস্মিনকালেও ভাবতেই পারেনি ইরা এতটা সিরিয়াস হয়ে পড়াশোনায় মননিবেশ করবে। রাহুল তো একদিন ডিনারে বসে সকলের সম্মুখে কৌতুহলী গলায় আওড়েই ফেলল,

—” বোন তুই যেভাবে পড়ছিস, মনে হয় আমাদের দুই ভাইয়ের রেকর্ড ও ভেঙ্গেই ফেলবি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে!”

ইরা মুখ ভেঙচিয়ে প্রতুক্তি করে,

—” আমি স্পেশাল বুঝলি। যেটা কেউ পারেনা সেটা এ-ই ইরা’র কাজ, খুব তো হেসেছিলে তখন আমি কিছু ভুলিনি। দেখিয়ে দিব এ-ই ইরা কী জিনিস।”

আজমল খাঁন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে গর্বের সঙ্গে গলা উচিয়ে সায় দিয়ে বললেন,

—” একদম আম্মা, আমি জানতাম, আমার মা সব পারবে। ইন শা আল্লাহ্! তোদের নজর না লাগলেই হলো। ”

আজমল খাঁনের কথায় বাড়ির সকলেই ইরা’র দিকে নজর বুলায়। আজিম খান অভিব্যাক্তি প্রকাশ না করলে-ও অত্যান্ত খুশি তিনি মেয়ের অক্লান্ত চেষ্টা দেখে। উনিও চান উনার মেয়ে দেখিয়ে দিক, সকলের মুখ বন্ধ করে দিক। কিন্তু উনি কিছুটা আদির মতো গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ফলশ্রুতিতে মেয়ে’কে কখনো উৎসাহ মূলক বানি শোনাতে পারেনা বড় ভাইয়ের মতো। এ-নিয়ে অভ্যন্তরে কিঞ্চিৎ আফসোস হলে-ও মেয়ের জন্য বড় ভাইয়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখেই উনি নিশ্চিত বড়ভাই আছে মেয়ের পাশে সর্বদা।

ইরা’র কনফিডেন্স বড়বাবার সহজ কথায় দ্বিগুণ প্রখর হয়। উনিই একমাত্র ইরা’র সাপোর্টার যেন। ইরা উজ্জ্বল মুখে প্রাণখোলা হেসে ভাইয়ের দিক তাকায়।

রাহুল সেরেন্ডারের ভঙ্গিতে সাবাসি দেয় বোন’কে। বিগলিত হাসে বলে,

—” উহুম, উহুম, নজর না লাগুক কারোর!”

ইরা ভাব নিয়ে বলল,

—” কারোর মানে! বলো তোমাদের নজর না লাগুক!”

সেদিন আদি ইরা’র কথা শুনে আড়ালে লুকিয়ে একটু মুচকি হেসেছিলো। অবচেতন মনেই বিড়বিড়িয়ে আওড়িয়েছিলো,

—” আসলেই তুমি স্পেশাল ইরাবতী! স্পেশাল বলেই পাথরের বুকে ফুল ফুটিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখো তুমি!”

চলবে,