#জলফড়িং
#Roja_islam
#part ২০
বাতাসে মৃদুমন্দ শীতের গন্ধ পাওয়া যায়। দিন’টাও আজ ভীষণ সুন্দর না গরম না শীত, ঠাণ্ডা পরিবেশ। এমন দিন গুলো যেন এমনিতেই সুন্দর! এ-র মধ্যে আজ প্রাণপুরুষের দেখা পাবে ইরা’র অন্তঃকোণে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো প্রজাপতি’র মেলা। ফুরফুরে মেজাজে ক্যাম্পাসে ঢুকে আড্ডায় মেতে ও। কথা ছিলো রাদ বাস থেকে নেমে ওকে ম্যাসেজ করবে রেস্টুরেন্টের জন্য বেরুনোর কথা জানাতে।
অবাক কাণ্ড ইরা’কে হতবিস্মিত করে ইরা ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর আধঘন্টা’র মাথায় রাহাতের সঙ্গে আড্ডায় ব্যাস্ত ইরা’র চক্ষু নিবদ্ধ হয় এক সুদর্শন পুরুষের আদলে। কী আকর্ষণী হাঁটার ভঙ্গি। গ্রে কালার টি-শার্ট এ-র উপর কালো শার্ট-প্যান্ট, হাতে রোলেক্সের ঘড়ি, পায়ে দামী সু পরিহিত দীঘল ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে রাদ ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এদিকেই জোড়ালো পায়ে এগিয়ে আসছে। বলাবাহুল্য, ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে রাদ’কে।
সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো চমকে উঠলো ইরা। ধ্বক করে উঠলো ছোট্ট বক্ষঃস্থল। ঘেমে উঠলো মুষ্টিবদ্ধ হাত জোড়া। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে নিতে চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘঠিয়ে রাদ একদম ওর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যায়ে চমকে উঠলো ইরা’র সম্মুখে বসা রাহাত নিজেও। কিয়ৎকাল রাদে’র দিকে অপলক আহাম্মকের মতো চেয়ে রইলো। ইরা বিমূঢ়, চূড়ান্ত অবাক। ক্যাম্পাসের ভেতরে এভাবে রাদ কেন ওর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো? বিস্মিত, হতভম্ব দুইজোড়া চক্ষুদ্বয় পাত্তা না দিয়ে রাদ ইরা’র সম্মুখে বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে রাহাতের উদ্দেশ্যে ভরাট গলায় বলল,
—” হ্যালো, রাহাত কেমন আছো! ”
রাহাত আকাশ থেকে টুপ করে পরলো। তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। কোনরূপ বনিতা ছাড়া নম্রমুখে বলল,
—” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া আমি ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন! ”
রাদ সালামের জবাব নিলো সাবলীলভাবে। বিনয়ী গলায় শুধালো,
—” ভালো আছি। কী হালচাল? ”
রাহাত হাল্কা হেসে বলল,
—” আপনাকে দেখে হালচাল একদম ভালো হ’য়ে গিয়েছি ভাইয়া, এতদিন তো শুধু ফোনেই কথা হতো। ”
—” এখন থেকে শুধু ফোনে নয়, রোজ সরাসরি কথা হবে। ঠিক আছে! ”
দু’জনের কথোপকথনের মধ্যে বিস্মায়াবিষ্ট, হতবাক ইরা স্তব্ধ বসে রইলো স্তিমিতনেত্র জোড়া মেলে। রাদে’র বাড়িয়ে রাখা হাতটা ধরা উচিৎ কী না এ-ই মুহূর্তে ও সেটাই ভাবছে। এবং কিয়ৎকাল নিস্তব্ধ থেকে কেমন ঘোরের মধ্যেই রাদে’র বলিষ্ঠ হাতের গ্রিপে নিজের নরম হাত’টা রাখলো। তৎক্ষনাৎ রাদ শক্ত করে ওর নরম হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। এবং হাল্কা টেনে নিজের সঙ্গে, পাশাপাশি দাঁড় করালো। এবং রাহাতের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে গেলো। ইরা তখনও যেন ঘোরের মধ্যে আছে। সেকেন্ড মিলি সেকেন্ড যেন হাওয়ায় ভাসলো। অত্যন্ত স্পীডে যেন অতিবাহিত হচ্ছে সময়। রাদে’র কড়া পার্ফিউমের ঘ্রাণ, পুরুষালী সঙ্গ, মাতোয়ারা হচ্ছে মন। তিন বছরের প্রেমের হাওয়ায় ভেসে বেরিয়েও রাদ’কে খুব কম কাছে পেয়েছে ইরা। ফলাফল প্রাণপুরুষের সান্নিধ্যে পেলে সেকেন্ড গুলো যে কখন মিনিটে, মিনিট গুলো যে কখন ঘণ্টায় গড়িয়ে যায় টের-ই পায়না মেয়ে’টা। রাদ রাহাতের থেকে বিদায় দিয়ে যখন এগিয়ে চলল ক্যাম্পাস থেকে বেরুবে বলে। কী বুঝে যেন ইরা’র বিহ্বলিত, ঘোরলাগা মুখে দুর্বোধ্য দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কাপালে ভাজ ফেলে মোলায়েম গলায় বলল,
—” আর ইউ ওকে? ”
প্রখর ঘোর হতে ছিঁটকে বেরুলো ইরা। লম্বাটে ছেলেটার পাশে ও নিতান্তই লিলিপুট। ঘাড় উঁচিয়ে রাদে’র আকর্ষণীয় গোলগাল মুখশ্রী’তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ক্ষীন আওয়াজে বলল,
—” তুমি সত্যি আমার ক্যাম্পাসে ঢুকে আমার হাতে হাত রেখে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছো? ”
রাদে’র কোপালের প্রগাঢ় ভাজ গুলো মসৃণ হ’য়ে এলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে স্মিত হাসলো। হাঁটতে হাঁটতে সহসা শুধালো,
—” ভয় পাচ্ছো আদিত্য ভাইয়া দেখে ফেলবে? ”
ইরা রাদের হাসিতে গোলে ক্ষীর হ’য়ে গেলো। ঘোরের মধ্যেই মাথা দুলিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
—” হু! ‘
—” আচ্ছা ইরা! বিয়ে করবে আমাকে এক্ষুণি? ”
বিস্ফোরিত ইরা দাঁড়িয়ে পড়লো খোলা মাঠের মধ্যেখানেই। বিমূঢ় অক্ষিজোড়া মেলে স্থির চেয়ে রইলো প্রাণপুরুষের অবিচল সুশ্রী মুখশ্রী’তে। ওর এহেন বিহ্বলিত দৃষ্টি দেখে রাদ ভ্রঁদ্বয় নাচিয়ে উৎসুক গলায় শুধালো,
—” কী? ”
—” তুমি সত্যি ইরানী’র রাদ তো? ”
এপর্যায়ে রাদ শব্দ করে হেসে ফেললো। খোলা মাঠে সে-ই হাসি প্রতিধ্বনি হলো। ইরা নিজেও স্মিত হাসলো। দু’জন প্রেমিক প্রেমিকা হাতে হাত রেখে নতুন এক দুনিয়ায় হেঁটে এগুচ্ছে। এ-ই দুনিয়ায় ওরা ছাড়া কেউ নেই। কেউ না। ওরাই ওদের রাজা রাণী। ওরাই ওদের মর্জির মালিক।
_________
তিন বছরে আজ প্রথম ইরা রাদে’র সঙ্গে নিজের ক্যাম্পাসে মুখোমুখি কথা বলল। এবং এ-ই প্রথম রাদে’র বিশেষ পছন্দের বাইকে বসার সুবর্ণ সুযোগ পেলো। ইরা বাইকে উঠার পর, একটু একটু করে বুঝতে পারলো রাদ আজ কেন মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলো দেখা করবে বলে। এবং যতবার ও বুঝতে পারছিলো এ-র পেছনে লুকায়িত কারণ’টা বারবার ওর চক্ষুকোল ভরে উঠছিলো। একটা মানুষের কতরূপ থাকে যানা নেই সহজ সরল ইরা’র। ওর ছোট্ট দুনিয়ায় খুব অল্প মানুষ দেখেছে জীবনে। এ-র মধ্যে বেষ্ট ওর বড় বাবা এবং রাদ এটা অবিশ্বাস্য হলে-ও কঠোর সত্যি। এ-ই দু’টো মানুষ কখনো ওর মনের বিরুদ্ধে কিছু করেনি। এ-ই দু’টো মানুষের কাছে ওর দুষ্টুমির ছলে বলা কথা গুলোরও ভীষণ মূল্য আছে। ওর চোখের একফোঁটা পানি ওদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ দৃষ্টি করে। আবার ওর একটু হাসি ওদের উৎসাহ দেয়। এ-ই দু’টো মানুষ কখনো ওর মনের বিরুদ্ধে কিছু চায়নি ওর নিকট, না আশা করে।
ইরা’র এখনো মনে পড়ে যখন প্রথম বার রাদ ওর মধ্যে বিয়ে নিয়ে কথোপকথন হয়েছিলো। ইরা ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। দ্বিতীয় বার যখন একি বিষয় নিয়ে কথা উঠলো এড়িয়ে যাওয়া’র সুযোগ ছিলো না ব’লে ইরা সাফ সাফ বলেছিলো,
—” আমি তোমাকে বিশ্বাস করি রাদ। নিজের থেকে-ও বেশী, আমি জানি পরিবারের মতে কিংবা বিরুদ্ধে তোমাকে আমি বিয়ে করি তুমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আমাকে ভালো রাখবে। কিন্তু আমি হয়তো ততটা ভাগ্যবতী, সহসী নই। তা-ই পরিবার’কে আমার গোপন সম্পর্কের কথা বলতে পারবোনা। কিন্তু তুমি একবার বললে তোমার হাত ধরে আমি এক কাপড়ে বাসা ছেড়ে চলে আসতে পারবো। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, সত্যি বলছি বিশ্বাস করো। ”
এহেন বাণীতে রাদ ছিলো সেদিন স্তব্ধ। এবং ইরা সেদিন এ-ই কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলো রাহুলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা’র জন্য। কিন্তু রাদ এ-ই সম্পর্কে অবগত ছিলো না। ইরা কখনো বলেনি এ-ই বিষয়ে। বাবা ভাই’কে ছোট ও করতে চায়নি রাদে’র সম্মুখে। তবুও রাদ যেন ইরা’র মনের গহীন অব্ধি পড়ে নিয়েছিলো। ওর প্রাণপুরুষ বুঝতে পেরেছিলো এভাবে ইরা ওর হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এলে যত সুখেই রাখুক না কেন? ওর ইরানী মন থেকে কখনো সুখী হতে পারবে না। ইরা’কে বিস্মিত করে রাদ কখনো পালিয়ে যাওয়ার বিষয়’টি সহজ সমাধান ভেবেও মুখ ফুটে ভুলেও উচ্চারণ করেনি। বরং বারবার বাসায় জানানো’র জন্যেই ঝামেলা করেছে। কী করে ওর মনের খবর টের পেয়েছিলো সে-সময় রাদ’কে জানে! একেই বলে দু’টো মনের মিল অথবা রাদ নিজেও হয়তো এভাবে বিয়ে করতে চায়নি!
আজ’কে রাদে’র এ-ই অদ্ভুত কাণ্ডের কথা কী বলবে। তখন সম্পর্কে’র বছর গড়িয়েছিলো সবে। এক নির্ঘুম রাতের ফোনালাপের মধ্যেই দুষ্টুমির ছলে বিয়ের আগে রাদে’র সঙ্গে বাইকে করে ঘুরাঘুরির ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলো ইরা। সে-ই কবেকার কথা ওর নিজে-ই তো মনে পড়তো না আজকের দিন’টা না এলে। কিন্তু যার মনে রাখার সে ঠিক মনে রেখেছে। ইরা নিজেকে ধাতস্থ করতে পারলো না। নৈশব্দ্যে গুমোট কান্নায় ভেঙে পড়লো আনন্দিত আপ্লুত মন’টা।
সকাল দশটায় মোটামুটি ফাঁকা রাস্তায় টেনে বাইক চালাতে ব্যাস্ত রাদ। নিজেও বুঝি একটুখানি আবেগে ভেসে গিয়েছে? এমন একটা দিনের অপেক্ষা বুঝি ওর ও ছিলো? একটু প্রশান্তি নিশ্বাস ফেলছিলো বুঝি ছেলেটা? কে জানে! রাদ ধরে ফেলার আগে ভেজা চক্ষুদ্বয় আলতো হাতে মুছে নিলো। স্নিগ্ধ হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দু-পাশে হাত মেলে দিলো। উফফ, এতো শান্তি! রাদে’র ঘোর ভাঙলো ওর কাণ্ডে। বিগলিত হেসে নরম গলায় বলল,
—” হ্যাপি?”
—” ভীষণ! আচ্ছা স্যার, তাহলে তোমার সব মনে থাকে?”
—” সব মনে থাকে ম্যাডাম। কাল বিয়ে’টা হতে দাও শুধু আরও অনেক কিছু মনে পড়ে যাবে।”
ইরা আকাশ থেকে টুপ করে পড়লো যেন ধরনীর বুকে। হতবিহ্বল গলায় শুধালো,
—” কাল বিয়ে মানে, কার বিয়ে? ”
রাদ চক্ষুদ্বয় উলটে বলল,
—” অবশ্যই আমাদের বোকা মেয়ে। তোমার এক্সাইটেড হওয়া উচিৎ। এ বিগ সারপ্রাইজ ওয়েটিং ফর ইয়ু ইরানী! ”
কিয়ৎকাল নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেলো ইরা। এ-ও সম্ভব কাল বিয়ে! হন্তদন্ত, আর্ত গলায় শুধালো,
—” প্লিজ রাদ বলো না! নাহ বললে আমি শান্তিতে থাকতে পারবো না। ”
রাদ হেসে ফেললো। বলল,
—” আমার বোকা ইরাণী। ব’লে দিলে কী আর সারপ্রাইজ থাকবে? ”
ইরা ঠোঁট উলটে আহ্লাদি গলায় শুধালো,
—” তাহলে কাল বিয়ে এটুকুই বা কেন বললে। এখন আমার সব জানতে ইচ্ছে করছে। ”
এপর্যায়ে রাদ একটা লম্বা নিশ্বাস টেনে নিয়ে চিন্তিত গলায় আওড়াল,
—” আমি নিজেও জানিনা কিভাবে কী করবো। শুধু একটু জানি কাল আমাদের বিয়ে!”
বিদুৎস্পৃষ্টের ন্যায় ইরা’র শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। কাল আমাদের বিয়ে। রাদে’র সঙ্গে ওর বিয়ে’টা একটা কল্পনার স্বপ্ন যেটা কখনো পূর্ণ হবে না বলেই ভাবতো। সত্যি কী তবে স্বপ্ন দেখে যেতে হয়। রাদে’র কথা মতো স্বপ্ন ঠিক একদিন পূর্ণ হয়! ইরা একটু হাসলো। ধুম করে রাদে’র পিঠে চুমু খেলো মিষ্টি হেসে বলল,
—” স্বপ্ন সত্যি একদিন পূর্ণ হয়! ”
পিঠে নরম অধরের স্পর্শ পেয়ে রাদ চমকে উঠেলো। প্রিয় নারীর এটুকু স্পর্শ যেন ভেতরে তোলপাড় দৃষ্টি করে দিলো। ও বাঁক ফিরে অবাক চক্ষুদ্বয় বিদ্ধ করলো ইরানী’র হাস্যোজ্জ্বল শ্যাম মুখে। ইরা’র চক্ষুদ্বয় হতে আনন্দ উপচে পড়ছে। রাদ আরও একবার ঠান নিলো যে করেই হোক সকলের স্বপ্ন পূর্ণ করতে হবে ওকে। কাল যে করেই হোক ইরা’র পরিবার’কে মানাতেই হবে বিয়ের জন্য।
________
ঘন্টা খানিক বাইকে ঘুরাঘুরি করার পর। রাদ ইরা’কে নিয়ে একটি খোলা আম বাগানে এলো। বিশাল আম বাগান। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত আম বাগান। মাটিতে সচ্ছ সবুজ ঘাস। একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এখানে থাকা কর্মিরা সাধারণ মানুষ’কে যদিও ভেতরে ঢুকতে দেয় না। কিন্তু অবাক কাণ্ড রাদ ইরা’কে কেউ কিছু বলল না। এতে বিস্মিত ইরা সাহসা বলল,
—” তোমার পরিচিত ওরা? ”
রাদ ইরা’র হাত ধরে বাগানের গহীনে ডুবে যেতে যেতে সাবলীলভাবে আওড়াল,
—” এটা তোমার শাশুড়ী’র আম বাগান! এ-ই বাগানের টাকায় বেঁচে আছি। ”
ইরা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলল,
—” এটা সত্যি তোমাদের? আমি ফুফির বাসায় যাওয়ার পথে অনেক দেখেছি কিন্তু ভাবিনি কখনো..! ”
ইরা থেমে গেলো। রাদ ওর অসম্পূর্ণ কথা সম্পূর্ণ করে দিলো,
—” ভাবোনি এটা তোমার হবু শাশুড়ী’র হবে তাই তো? আমিও কখনো ভাবিনি ফেইসবু’কের অপরিচিত একটা মেয়ে আমার হৃদয়ের রানী হ’য়ে আবে। জীবন আনপ্রেডিক্টেবল! ”
প্রায় ২০/২৫ মিনিট হাঁটার পর রাদ একটা মাচায় গিয়ে বসলো। ইরা ঘুরেঘুরে চঞ্চল চোখে আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে ভাবছে। আমি নিজেও তো ভাবেনি। অনলাইন টিচার’কে মন দিয়ে ফেলবো। লজ্জায় ইরা’র শ্যাম গাল দুটু ভারী হ’য়ে গেলো অকারণে। রাদ ইরা’কে লজ্জা দিতে-ই মূল্যত পুরনো কথা উঠিয়েছে। ইরা সর্বদা লাজুক স্বভাবের নয় কখনো লজ্জাবতী তো কখনো প্রাণখোলা প্রজাপতি। এ-ই দু’টোর মধ্যে লজ্জাবতী মেয়ে’টাকে রাদের একটু বেশী-ই পছন্দ। এবং আজ ওদের প্রেম প্রেম খেলার শেষ দিন। ও মন ভরে প্রেয়সীর ব্যাকুল লজ্জান্বিত রূপ দেখতে চায়। ভেবে-ই হাল্কা হেসে দুষ্টু গলায় বলল,
—” তো ম্যাডাম এবার কিছু নিয়ে আসেননি আমার জন্য? ”
ইরা’র ঘোর ভাঙলো। যেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে পড়েছে। সেভাবেই এগিয়ে এসে রাদে’র পাশে বসলো। অতঃপর ব্যাগ থেকে ছোট ছোট কাপ ক্যাক বের করে রাদে’র সম্মুখে বারিয়ে দিলো। রাদ নির্বিঘ্নে ক্যাক হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলো। ইরা একটু হাসলো, তৃপ্তির হাসি। রাদ আচমকা উচ্ছ্বসিত গলায় শুধালো,
—” এ-ই মজার কাপ ক্যাক এখন রোজ খাওয়া যাবে ভাবতেই ভালো লাগছে। ”
ইরা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রাদে’র জ্বলজ্বলে মুখে। আচমকা শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসলো রাদ নিজেও। ইরা হাসতে হাসতে বলল,
—” সকালে কিছু খাওনি তা-ই না? ”
—” উহু, জানাই ছিলো ম্যাডাম খালি হাতে দেখা করতে আসবে না। কিন্তু, কিন্তু রাতে এতো বলার পড়েও না ঘুমিয়ে এসব বানালে এখন কী শাস্তি দেওয়া যায় তোমাকে সেটা বলো? ”
ইরা’র মুখে অন্ধকার নেমে এলো। দমে না গিয়ে ভেঙ্গচি কেঁটে বলল,
—” না নিয়ে এলো তো বলতে আমি আগের মতো ভালোবাসি না তোমাকে। ”
রাদ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ভরাট গলায় শুধালো,
—” আমি কখনো এভাবে বলিনা। ”
—” তুমি বলো। লাস্টবার বলেছিলে রেস্টুরেন্টে যখন গিয়েছিলাম, আমার মনে আছে। ”
রাদ একটু হেসে বিগলিত গলায় শুধালো,
—” সকল সমস্যার সমাধান হচ্ছে বিয়ে। উইল ইউ ম্যারি মি ইরাবতী! ”
তৎক্ষনাৎ ইরা’র সম্মুখে ভেসে উঠলো একটা চকচকে হিরের আন্টি। মিষ্টি রোদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে নিখুঁত আন্টির কারুকাজ, হিরের পাথর গুলো। ইরা বিস্ফোরিত ঘোলা দৃষ্টি রাদে’র শ্রান্ত মুখে নিবদ্ধ করে স্তব্ধ বসে রইলো, বিন্দুমাত্র নড়ার শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হলো না, মুখে রা ফুটলো না। এভাবে গার্লফ্রেন্ডের হাতের বানানো কাপ ক্যাক খেতে খেতে কেউ প্রপোজ করতে পারে জানা ছিলো না। ইরা’র বিমূঢ় দৃষ্টি দেখে রাদ একটু হাসলো৷ সুন্দর নিখুঁত হাসি। পুনরায় নরম, কোমল গলায় বলল,
—” তোমার উত্তর কী সেটা আমি জানি। বাট ইট উয়িল বি আওয়ার এনগেজমেন্ট। এনগেজমেন্ট ভ্যানুটা ঠিকঠাক আছেনা। একদম নিরিবিলি…! ”
রাদ আর বলতে পারলো না ইরা ওর বক্ষঃস্থলে ঝাপিয়ে পড়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে রাদে’র শার্ট। রাদ ওকে জোড়ালো গলায় আঁটকালো না আজ কাঁদতে। ইরা’কে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে নিজের সঙ্গে শুধু সর্বদার মতো আদ্র গলায় বলল,
—” কেঁদ না তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না। ”
কিয়ৎকাল পর নিজে-ই ইরা’কে বুক থেকে তুলে। ওর নরম হাত’টা হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে সুন্দর করে আন্টি’টা পরিয়ে দিলো এনগেজমেন্ট ফিংগারে। পার্ফেক্ট সাইজ হয়েছে, শ্যামবর্ণ হাতের সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আন্টি’টা। ইরা’র মনে হলো কেঁদে ও সুন্দর পরিবেশ’টা নষ্ট করে ফেললো কী। অর্থাৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির ভঙ্গিতে আওড়াল,
—” কাল সারপ্রাইজে’র কথা বলে আজকেই একটা দিয়ে দিলে। তা-ও এভাবে খেতে খেতে..! ”
রাদ শব্দ করে হেসে ফেললো। দুষ্টু গলায় বলল,
—” কাপ ক্যাক গুলো ভীষণ মজা আমি কী করবো.. ”
হঠাৎ থেমে গিয়ে রাদ ইরা’র মুখ’টা আঁজলায় ভরে মুক্তার মতো অশ্রু গুলো মুছিয়ে দিলো যত্ন করে। কাজল লেপ্টে গিয়েছে চোখে। ঠিক করে দিলো প্রেয়সীর কাজল। ইরা চোখ বন্ধ করে আছে রাদে’র গরম নিশ্বাস পুড়িয়ে দিচ্ছে ওর ভেতর অব্দি। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কম্পন। এভাবে কত সময় ছিলো জানা নে-ই। রাদ দেখে যাচ্ছিলো একদৃষ্টিতে ইরা’র সরল মুখ’টা। আর ইরা চক্ষুদ্বয় মুদে অনুভব করছিলো রাদ’কে। ইরা’র কম্পিত ঠোঁট টানছিলো ভীষণ রাদ’কে। ইরা নিজেও বুঝি অপেক্ষায় ছিলো প্রাণপুরুষের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের জন্য। কিন্তু ওকে লজ্জায় ডুবিয়ে হঠাৎ রাদ অন্যরকম গলায় বলল,
—” আমি অপেক্ষা করবো ইরানী এখন না। ”
কথা’টা বলে রাদ সময় নিয়ে ইরা’র কপালে চুমু খেলো। ইরা’র সম্পূর্ণ শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। গাল দু’টো জমে গেলো রক্তির আভায়। এহেন লজ্জা এ-ই জীবনে পায়নি মেয়ে’টা। রাদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো এ-ই লজ্জাটুকুই সে দেখতে চেখেছিলো প্রেয়সীর শ্যাম মুখশ্রী’তে। বক্ষঃস্থলে আপন মনের বেসামাল, অস্থির তোলপাড় লুকিয়ে মনকুঠুরিতে প্রখর ভাবে এঁকে নিলো ইরা’র লজ্জান্বিত মোহনীয় সৌন্দর্যের এক অন্য রূপ। যে-ই রূপ দেখার অধিকার এক মাত্র রাদে’র!
চলবে!