জল ফোয়ারা পর্ব-১২

0
196

#জল_ফোয়ারা |১২|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan

১৬.
হেমন্তের পর শীত তারপর বসন্ত, একের পর এক ঋতু যেনো চোখের পলকেই নিজেদের রুপে হাজির। সেই ঘরের চৌকাঠের আলাপনের পর কতোখানি সময় পেরিয়েছে আবার? জানা নেই, শুধু শরীরে শিরশির অনুভুতিতে মনে হয় হয়তো শীত এসেছে কিংবা বাইরের বৃষ্টিতে বর্ষার আগমন ঘটেছে ধরায়। রোহিণীর দিনগুলো এমন অবসাদেই গুচিয়ে যায়, সুফিয়া কামালের সাথে ওর কোথাও একটা খুব মিল! হয়তো দুজনেই ‘তাহারেই পড়ে মনে’ জপতে ব্যস্ত। হাতে থাকা বালাখানার দিকে তাকিয়ে নিজের ফেলে আসা ক্ষনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে লাগলো নিস্তব্ধতায়। এই বালাখানা ওর কাছে অনেকবছর, মুগ্ধর মা যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো তখন এটা ওর হাতে পরিয়ে দিয়েছিলো। বিয়ের প্রস্তাব ফেরত পাঠালেও উনি বালাখানা ফিরিয়ে নেননি, হয়তো এতোগুলো বছরে ভুলেই গেছেন কিন্তু রোহিণী বেশ যত্নেই লুকিয়ে রেখেছে এটা। কেনো? কারণ ও নিজেই জানেনা, হয়তো পছন্দের মুহুর্তগুলো আঁকড়ে রাখার চেষ্টা!

মে একুশ! এই দিন মুগ্ধর বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়েছে, ঘরোয়াভাবে অনুষ্ঠান তাই আশেপাশে ছাড়া কাউকেই বলা হয়নি। মেয়ের পরিবার ওদের বাসায় আসার পর বিয়ে সম্পূর্ণ হবে, স্বাভাবিক নিয়মের ঠিক ব্যতিক্রম। সেই দিনটি আজ থেকে দুদিন পর, ঠিক দুদিন পর ওদের সকল স্মৃতি চিরতরে মুছে যাবে। সেই দিনটি হাসিমুখে কাটানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই, কিভাবে দেখবে নিজের মানুষটাকে অন্যের হতে দেখতে? তাইতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে বেলা চারটায়, বান্ধুবীর বাসায় যাবে বলে মাকে বলে এসেছে কিন্তু মাও হয়তো জানে না ও নিজেকে এতোটাই গুটিয়ে নিয়েছিলো যে বন্ধুমহলও আজ নিতান্ত অতীত। কোথায় যাবে জানা নেই, ব্যাগে খুচরা মিলিয়ে পাঁচশত সত্তর টাকা আছে। টাকাগুলো নেড়েচেড়ে রোহিণী দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো প্লাটফর্মে মানুষ ভর্তি, ছোটবাচ্চারা ছুটাছুটি করছে। অদিতার কথা মনে পড়লো খুব, বাচ্চাটাকে খুব আপন মনে হয়। যদিও অদিতা খুব মিষ্টি করে বলে

“আমি কিন্তু বড় হয়ে গেছি রোহু আন্টি, দেখো চুল বাঁধতে পারি একা একা।”

রোহিণী তবুও হেসে ওর চুল বেঁধে দিতো, এখন ওদের ছোট্ট অদি কি করছে কে জানে! হয়তো নুরের সাথে গল্পে ব্যস্ত, রোহিণী আর মাথা ঘামালো না। প্লাটফর্মে আবারো এনাউন্স হলো ট্রেন আসতে বিশ মিনিট বাকি, রোহিণী বসা থেকে উঠে পাশের দোকান থেকে কলা আর পাউরুটি কিনলো। এই ট্রেনের শেষ ঠিকানা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, হয়তো সেখানেই গিয়েই শেষ হবে ওর গন্তব্যও। প্রায় মিনিট তিরিশেক পর ট্রেন এসে থামলো, রোহিণী কোন দিকে না তাকিয়ে উঠে পড়লো। নিজের নির্দিষ্ট সিটে বসে পড়লো, জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস এসে গায়ে লাগছে। সবাই একে একে ট্রেনে উঠতে লাগলো প্রতিযোগীতা করে, ওর পাশে চেপে বসলো একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা। ট্রেন ছাড়তেই চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, ট্রেন ছুটছে স্টেশন ছেড়ে বহুদুরে। ও নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়ালো কিছু পরিচিত শব্দে…

“আমার জন্য আলো জ্বেলো না কেউ
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ,
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরবো না, না, না~~”

ঠোঁট নাড়ানোতে হয়তো কিছু ফিসফিস শব্দ হয়েছিলো, পাশের মহিলা একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো, ট্রেনের ঝনঝন শব্দ কানে আসতে লাগলো সজোরে তারপর তা ধীরেধীরে মিলিয়ে গেলো। কতোক্ষন এভাবে ঘুমিয়েছে ও জানে না, চোখ মেলতেই দেখলো পাশের ভদ্রমহিলা নেই। সামনে একজন লোক ওর দিকে তাকিয়ে আছে আগ্রহ নিয়ে, ও তার দিকে তাকাতেই লোকটি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বললো

“আর কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন কমালপুর থামবে, আপনি রেডি হয়ে নিন”

লোকটির অযথা আগ্রহে রোহিণী বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলো না, ওড়নাটা ভালো করে টেনে নিজেকে ঢেকে ফেললো। নিজের নেয়া সিদ্ধান্ত কবেই বা ওর পক্ষে কাজ করেছে? সবসময় হিতে বিপরীতই তো হয়েছে। ট্রেন থামতেই বেশ সময় নিয়েই নামলো, বাইরে একটা বসার জায়গা পেতেই বসে পড়লো। ব্যাগে থাকা পাউরুটি কলা বের করে একপ্রকার গি!লতে লাগলো, খাওয়া শেষে পনেরো টাকা দিয়ে একটা পানির বোতল কিনলো। পানি পান করা শেষে বসে রইলো এক জায়গায়, ঘড়িতে টিকটিক কতোখানি সময় চলে গেলো মাঝে। ও একই জায়গায় বসে কি যেনো ভাবছে আর চারপাশে মানুষ দেখছে। হঠাৎ কে যেনো ওর কাঁধে হাত রাখলো,ব্যাগ শক্ত করে চেপে ধরলো। চমকে উঠে পাশে তাকাতেই দেখে মুগ্ধ হাপাচ্ছে। ও হতভম্ব হয়ে দেখতো লাগলো, প্রথমে মনে হলো হ্যালুসিনেশন কিন্তু কাঁধে রাখা হাত দেখে বাস্তব মনে হলো সবকিছু। আরো কিছু সময় যাওয়ার পর মুগ্ধ শান্ত হলো, বেশ কড়া গলায় বললো

“এখানে কি করছো তুমি? মজা পাও এসব করে?”

রোহিণী বিরক্তিতে ফে’টে পড়লো, নিজেকে শান্ত রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে লাগলো, যথাসম্ভব বিরক্তি প্রকাশ না করে বললো,

“আপনি আমাকে এখানে খুঁজে পেলেন কি করে?”

মুগ্ধ কিছুক্ষণ রোহিণীকে নিশ্চুপে দেখলো, সারাদিনের জার্নিতে ও বেশ ক্লান্ত দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এই মেয়েটা সবসময় ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, মাথায় যা আসে তাই করে ফেলে। নিজের সিদ্ধান্তের ফল যে নিজেকেই ভুগতে হয় তার খেয়ালই রাখেনা। মুগ্ধ শিথিল কন্ঠে বললো

“আনিস ওর বোন আর বোনের জামাইকে ট্রেনে উঠিয়ে দিচ্ছিলো, তখন তোমাকে কলা পাউরুটি হাতে বসে থাকতে দেখে। প্রথমে এসে জিজ্ঞেস করবে ভাবলেও পরে কি তুমি কি মনে করো তা ভেবে বাসায় চলে যায়। শেষ বিকেলে হয়তো সৌহার্দ্যর সাথে দেখা হয়েছিলো, কথার ফাঁকে তোমার কথা বলে। সৌহার্দ্য দ্রুত আমার কাছে এসে সব বলে, তোমার নাম্বার যেহেতু আমার কাছে ছিলো তাই ওটা দিয়ে লোকেশন চেক করতেই দেখলাম তোমার লোকেশন চেঞ্জ হচ্ছে। যেহেতু ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলে তাই লাস্ট স্টপ মানে কমলাপুর থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি, বাইক নিয়ে তাই এখানে চলে এসেছি।কিছুক্ষণ খুঁজার পর তোমাকে খুঁজে পেলাম এখানে। নুর যেই ভুলটা করেছে, তুমিও কেনো একই ভুলই করছো রোহিণী?”

রোহিণী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, অস্বাভাবিকভাবে নিজেও শিথিল কন্ঠে বললো

“আপনি এখানে কি করছেন? এখানে আসার মতো ভুল আপনি কেনো করলেন? দুদিন পর আপনার বিয়ে তা ভুলে গেলেন? আপনার হবু বউ হয়তো আপনাকে নিয়ে অনেক সুন্দর গল্প সাজাচ্ছে আর আপনি এখানে অন্যমেয়েকে খুঁজতে এসে-”

মুগ্ধ কথা কা!টিয়ে বললো

“তুমি কোন অন্য মেয়ে না”

রোহিণী হাসলো, কি ছিলো সেই হাসিতে? তিক্ততা, তাচ্ছিল্য নাকি অনেকখানি ক্ষো!ভ?রোহিণী মাথার চুলগুলো ঠিক করে মাথায় ঠিকমতো কাপড় দিলো তারপর মুগ্ধর দিলে না তাকিয়ে বললো

“কে আমি? আপনার জীবনে আমি অন্য মেয়ে নয়তো কি?”

মুগ্ধ কি জবাব দিবে খুঁজে পেলো না। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে হলো কিন্তু শেষমেশ বলা হয়ে উঠলো না। রোহিণী সেই নিশ্চুপতাকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নিলো, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো

“আমার তো বাবা-মা ছিলো, যখন বুঝতে পেরেছেন আমি নেই তখন তাদের কেনো বললেন না? আর ভাইয়া ই বা কেনো আপনাকে বলতে গেলো? নিজেই তো পারতো আমার খোঁজ নিতে”

শেষের কথাগুলো নিতান্তই নিজের কাছেই বললো কিন্তু ভোরের নিস্তব্ধতার কারণে কথাগুলো মুগ্ধ স্পষ্ট শুনতে পেলো। আশেপাশে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে বাড়ি ফেরার জন্য, ও রোহিণীর দিকে একটু চেপে দাঁড়ালো। শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে বললো

“তোমার বাবা-মা কেউ ই জানেনা তুমি হালিশহরে নেই, সৌহার্দ্য ওদের বলেছে তুমি নুরের সাথে আছো। তারা আর খোঁজ নেয়নি। অদিতাকে ফেলে সৌহার্দ্যর আসা সম্ভব হয়নি, আর নুরের অবস্থা তো জানোই। তাই আমি…”

নুরের সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো

“বুঝলাম, খুব বাধ্য হয়েই এসেছেন। দুঃখিত আপনার বিয়ের পূর্বমুহুর্তে আপনাকে এতোটা ঝা!মে*লায় ফেলার জন্য।”

মুগ্ধ ওর পিছু নিতে নিতে বললো

“কোথায় যাচ্ছো এখন?”

রোহিণী একটা বাইকের সামনে দাঁড়ালো, হাত দিয়ে ইশারা করে বললো

“ফেরত নিতে যখন এসেছেন তখন ফিরেই যাই, এমনিতেও সবকিছুর থেকে পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়।”

মুগ্ধ কিছু না বলেই চাবি বের করলো, বাইক স্টার্ট দিয়ে চুপ করে রইলো। রোহিণী সেই নিস্তব্ধতাকে আরো বাড়িয়ে দিলো, বাইকে উঠে বসে পড়লো মুগ্ধর পাশে তবে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে। হাতে থাকা ব্যাগ সামনে ঝুলিয়ে বাইকের পেছনের অংশ শক্ত করে চেপে ধরলো। মুগ্ধ কি ভেবে যেনো বললো

“পরশু আমার বিয়েটা হচ্ছে না, মাকে গতকালই বিয়ের ব্যাপারে না করে দিয়েছি আর ফুফাকে ফোন করেও ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বিয়ে করা সম্ভব নয়!”

কথাগুলো শেষ করে ফ্রন্ট মিররে রোহিণীর দিকে তাকালো, বেশ ভাবলেশহীন ভাবে বসে প্লাটফর্মে মানুষের আনাগোনা দেখছে। মুগ্ধ ভাবলো কথাগুলো হয়তো শুনেনি তাই বাইক চালানো শুরু করলো। সকালের বাতাসে রোহিণীর বেশ শীত লাগলো, ব্যাগটা পাশে রেখে মুগ্ধর দিকে চেপে বসলো। কিছু না ভেবেই দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসলো, ভেবে নিয়েছে মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলে বলবে শীত করছে। প্রায় অনেকটা পথ যাওয়ার পর মুগ্ধ পেট্রোল ঢুকানোর জন্য গাড়ি থামালো, কাজ সেরে রোহিণীকে দেখলো পাশে নেই। আশেপাশে খুঁজতেই দেখলো কিছু দূরে ঝালমুড়ি হাতে মুগ্ধর দিকে এগিয়ে আসছে।

মুগ্ধ বেশ অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো

“এই সাতসকালে ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছে হলো?”

রোহিণী ঝালমুড়ি একমুঠ মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো

“আপনার বিয়ে ভাঙ্গার খুশিতে ঝালমুড়ি খেয়ে সেলিব্রেট করছি, আশেপাশে মিষ্টি পাইনি”

মুগ্ধ জবাবে কি বলবে খুঁজে পেলো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোহিণীর ঝালমুড়ি খাওয়া দেখছে। কিছুক্ষণ পর নিজেই বললো

“আমাকেও একটু দাও তাহলে, আমিও উৎযাপন করি তোমার সাথে।”

রোহিণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো, তারপর কি ভেবে যেনো দুজনেই হেসে উঠলো। মুগ্ধর শরীরে একফালি রোদ আছড়ে পড়লো সযত্নে, রোহিণী তা বেশ আশা নিয়ে দেখলো। ওর জীবনে থাকা ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীতের বিদায়ের সময় এসেছে, ওর মনের আকাশ জুড়ে ছড়াবে ভোরের মিষ্টি রোদ। মনে হলো কেউ বার্তা নিয়ে এসেছে বসন্তের, নতুন অনুভুতিতে নতুন সুচনার!
বাইকের তীব্র গতিতে চলার সাথে সাথে ওরও হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো। হয়তো অনেক কথা বাকি, বাকি অনেক অভিমান। হয়তো শেষ ট্রেনে ওর বাড়ি ফেরা হলো না কিন্তু বাড়ি ফিরছে তো ঠিকই…

১৭.
অদিতার বয়স এখন চার বছর শেষে পাঁচে পা দিয়েছে, স্পষ্ট কথা বলতে শিখে গেছে। এখন আর বাবার জন্য কান্নাকাটি করে না খুব একটা, রোহিণী কিংবা নুর দুজনের সাথেই সারাদিন কেটে যায়। নুর! এই দুএক বছরে ওর আমুল পরিবর্তন হয়েছে, সৌহার্দ্যের কাছে চিঠি লিখা বন্ধ করে দিয়েছে, কল করা বন্ধ করে দিয়েছে। একটা সময় ওদের নিতান্ত একায় কাটানো সময়গুলোতে ভাগ বসিয়েছে অদিতার পড়াশুনার সময়। এই ঠিক এখনই, নুর ওদের আগের বাড়িটাতে অদিতাকে নিয়ে পড়তে বসেছে। অদিতা বসে বসে আকঁছে আর নুর তা দেখে হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতা আকাঁর ফাঁকে বললো

“এটা হচ্ছে দিদা, এটা বাবাই তার হাত ধরে আছি আমি আর তার ঠিক পাশেই তুমি, এটা হচ্ছে রোহু আন্টি। আমরা হচ্ছি হ্যাপি ফ্যামিলি”

অদিতা হাত বাড়িয়ে নিজের আনন্দ প্রকাশ করলো, নুর মাথা নেড়ে বললো

“হুমম হ্যাপি ফ্যামিলি”

অদিতা সোজা হয়ে বসে বললো

“আমি তো এঁকেছি, এবার আমাকে গিফট দাও”

নুর হেসে বললো

“গিফট তো নেই কিন্তু তোমায় আমি একটা গান শোনাতে পারি, শুনবে?”

অদিতা অধীর আগ্রহে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো, অদিতাকে কোল নিয়ে স্বর নামিয়ে গাইতে লাগলো

“তোমাকে না লেখা চিঠিটা ডাকবাক্সের এক কোণে
সাদা খামের না লেখা নাম একেছে তার গানে
সেই চিঠির যতো লেখা থাকে একা একা
সেই গানের না শোনা সুর একা একা আঁকা…”

বাকিটুকু সৌহার্দ্য শুনেনি, একসময়ের প্রিয় গান ওর। মাঝেমাঝে গলা ছেড়ে গাইতো, বন্ধুমহলে তখন সবাই মজা নিতো আর বলতো ‘কাকে বলতে পারছিস নিজের মনের কথা? কে সেই নারী?’ সৌহার্দ্য শুধু হাসতো, তারা হয়তো লক্ষ্যই করেনি কখনো যে নুর আশপাশ থাকলেই গানটা গাইতো ও, মন খুলে গাইতো তখন। নুরের জন্য লিখা প্রথম চিঠিতে ও এই গানের কয়েক লাইন লিখেছিলো, যদিও কোন নাম উল্লেখ করেনি তবুও নুর বুঝে গেছিলো কিভাবে যেনো। সৌহার্দ্য ভেবেছিলো নুর সবাইকে বলে দিবে কিন্তু নুর তেমন কিছুই করলো না। তিনদিন পর সুযোগ বুঝে ওর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো, ছোট ছোট অক্ষরে লিখা

‘এভাবে নাম না উল্লেখ করলে তো মানুষ আরো বুঝে যাবে, ভাইয়ার হাতে পড়লে তো আপনার লিখা চিনেই যাবে। এরচেয়ে ভালো নাম লিখবেন। কাল রাত থেকে অনেক ভেবেছি বুঝলেন তারপর দুটো শব্দই মাথায় এলো *তুষার-শুভ্র*, ভাবলাম আপনাকে তুষার বলে ডাকি। সুন্দর না নামটা? আর আমাকে আপনি শুভ্রি বলে ডাকবেন। কারো হাতে পড়লেও তারা আর বুঝবে না’

একবছর পর্যন্ত ওরা শুধু চিঠিতেই কথা বলেছে, পেন-ফ্রেন্ড বলা যায়। শুরুতেই সৌহার্দ্য মনের ভাব প্রকাশ করলেই ওদের মাঝে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিলো। একবছর আলাদা করে দেখা করা হয়নি, সৌহার্দ্যের জন্মদিনেই নুর ওকে নিজের মনের কথা বলে। তারপর থেকে রোজ দেখা হতো, কথা হতো আর মাঝে চিঠি লিখতো যার সিংগভাগ নুরের লিখা। এভাবেই দিনগুলো তো ভালোই চলছিলো, যদি সেই দিনগুলোতে আবার ফিরে যেতে পারতো!

নুরকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেই সৌহার্দ্য সোজা হয়ে দাঁড়ালো, রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো অদিতা এখনো ছবি আঁকছে। ও কিছু না ভেবেই নুরের পিছু নিলো, এদিক ওদিক খেয়াল রেখে বললো

“অদিতা কে সেটা তুমি জানো”

কথাটা প্রশ্ন ছিলো না বরং নিঃসংকোচ জবাব ছিলো। নুর ওর দিকে একপলক তাকিয়ে বললো

“হুম শর্মি আপুর মেয়ে, যদি আরো গুছিয়ে বলি তবে বর্তমানে আপনার মেয়ে”

আপনি! নুর ইদানীং আপনি বলে ডাকে কেনো যেনো! জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি, নুরের কথা শুনে ওর গলা জড়িয়ে এলো। কাঁপা কন্ঠে বললো

“নুর! তুমি সবকিছু জানো! সবকিছু মনে পড়েছে তোমার তাইনা?”

নুর কথা বললো না, শুধু চোখের কোনে জল জমা হতে শুরু করলো। দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই সৌহার্দ্য বেশ আকুতি নিয়ে বললো

“কেনো বলোনি আমায়, এই স্বাভাবিক আচরণ কেনো করছো? তুমি আমাকে রাগ দেখাবে, আমার চেহারা দেখতে চাইবে না, তোমার চোখে একরাশ ঘৃ!ণা থাকবে এটাই তো আশা করেছিলাম আমি। এমন কিছুই না করে তুমি এতোটা নিশ্চুপ কেনো?”

নুর শুধু ক্লান্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কোনপ্রকার শব্দ ছাড়া, মাঝেমাঝে নিস্তব্ধতাই হয়তো সবচেয়ে বড় শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়…

#চলবে…