জায়া ও পতি পর্ব-০১

0
25

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_১
#ইসরাত_ইতি

◻️
বারো শতাংশ বিস্তৃত একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির নাম “কমলা রঙের রোদ”। বাড়ির কর্তা শারাফাত চৌধুরী বড্ড শখ করে এই বাড়িটা বানিয়েছেন। খানদানি বংশ, জেলা শহরে রড সিমেন্টের বিজনেস, তিন তিনটে ফিলিং স্টেশন, দু’টো লঞ্চ, ওনাদের বহুমুখী ব্যবসা। অর্থবৈভব আল্লাহ দিলে যথেষ্ট রয়েছে তাদের। তিন পুত্র এবং দুই কন্যা নিয়ে একটি প্রকৃত সুখী পরিবার শারাফাত চৌধুরী এবং তার স্ত্রী রিজিয়া বণিকের। বড় ছেলে রাজন বিয়ে করে সুখে সংসার করছে,ছোটো ছেলে শায়ন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে কুয়েটে। দুই মেয়ে রুহি এবং শামা। রুহি অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে, শামা ক্লাস টেনে পড়ছে।

বৃদ্ধা মা এবং পাঁচ পাঁচটি সন্তান, এবং স্ত্রীকে নিয়ে সুখ শান্তিতে ভরপুর একটি পরিবার। তাই বলে অশান্তি যে নেই এমনটা কিন্তু নয়। এই বাড়ির মানুষগুলোরও দুশ্চিন্তা, মাথাব্যথারও একটা কারণ রয়েছে,সেটা হলো এই বাড়ির মেজো ছেলে শামির চৌধুরী। আঠাশের গুরুগম্ভীর স্বভাবের, উগ্র মেজাজের একজন পুরুষ। পেশা,বাড়ির ব্যবসা দেখেন তিনি। বৈবাহিক অবস্থা: কয়েকমাস আগে সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। তার প্রধান সমস্যা হচ্ছে তার মেজাজ, যার ভয়ে বাড়ি থেকে শুরু করে কর্মস্থলে সবাই তটস্থ থাকে সর্বদা। স্ত্রীর সাথে ডিভোর্সের প্রধান কারণও এই মেজাজ। এমনকি তার জীবনে রোজ যতগুলো দূর্ঘটনা ঘটে, সবকিছুর কারণ এই মেজাজ। কিন্তু এর কোনো বিহিত নেই, মেজাজ তাকে নিয়ে অধঃপতনে চলে গেলেও তিনি মেজাজ পরিত্যাগ করবেন না। শামির চৌধুরীর জন্য কিছুদিন হয় পাত্রী দেখছে বাড়ির সবাই। উঠেপড়ে লেগেছে দ্বিতীয় বিয়ে করাতে।
ডিভোর্সী, কুমারী,সব ধরণের পাত্রী দেখা হচ্ছে,তবে কিছুতেই কোনো সুরাহা হচ্ছে না, কারণ, শামির চৌধুরীর বিশাল বড় লিস্ট এবার, মনঃপুত পাত্রী না হলেই সেটা বাদ। যেমন, কোনো পাবলিক অথবা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মেয়েকে তিনি বিয়ে করবেন না, তিনি কোনো চাকরিজীবী মেয়ে বিয়ে করবেন না, তার লিস্টের এই দু’টো কারণ দেখে তাকে কিন্তু কিঞ্চিত নারীবিদ্বেষী চেতনার মানুষ বলে ধরে নেয়া যায়, কিন্তু না, এটা ভুল। সে কিঞ্চিত নয়,পুরোটাই সমকালীন নারীবাদী চেতনার নারীদের বিদ্বেষী এক পুরুষ।
গলা উঁচিয়ে কথা বলা, পুরুষের থেকে এক লাইন বেশি পা ফেলা, স্বাবলম্বী হতে চাওয়া,পোশাকের স্বাধীনতা চেয়ে রাস্তায় গলাফাটানো কিংবা স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বলা মেয়েদের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা তার। বন্ধুদের ডিভোর্স, নিজের ডিভোর্স,বা আশেপাশের হালচাল দেখে শামির বাড়িতে এবার সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে, পাত্রী হতে হবে পায়ের পাতায় দৃষ্টি রেখে কথা বলা মেয়ে, যে কখনও প্রয়োজন ব্যাতীত স্বামীর মুখের দিকে না তাকায়,চোখে চোখ রেখে কথা বলা তো দূরে থাক।

রিজিয়া বণিক ছেলের এই ধরণের খামখেয়ালি ব্যবহারে দিনকে দিন অতিষ্ট,এতো আধুনিক একজন ছেলে হয়েও চিন্তাভাবনা এতটা রুক্ষ কি করে হয় তিনি বুঝতে পারেন না।

“স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বলবে না,এমন মেয়ে আছে আজকাল? এমন মেয়ে কে হাতে গড়ে? কোন ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয় এমন মেয়ে?”

শাশুড়িকে সকালের চা টা দিতে দিতে প্রশ্নটি করে রিজিয়া। শামিরের দাদী মায়মুনা খানম পঁচাশি বছরের একজন বৃদ্ধা। বয়স পঁচাশি হলে কি হবে? মস্তিষ্ক আর মুখের ধার একজন হাট্টাগাট্টা মধ্যবয়স্ক মহিলার। জিহ্বা তো নয়,যেন চাবুক। স্বভাবে মাইমুনা যেমন ধার্মিক তেমন গালিবাজ। পাঁচ ওয়াক্ত নিয়ম করে সিজদা দেওয়ার পাশাপাশি বরিশালের বিখ্যাত আঞ্চলিক গালি গুলো নিয়মিত চর্চা করেন তিনি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ বাড়ির বড় বৌ মানে রাজনের স্ত্রী সুহানা এবং রুহি শামা তার গালাগালির শিকার হয়।

মাইমুনা চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে রিনরিনে গলায় রিজিয়ার প্রশ্নের জবাব দেয়,“কেন পাওয়া যাইবো না এমন মাইয়া? তোমরা খোজবা শহরে,পাইবা বা*ল? মোগো গেরামে হাতান দিয়া খোজলেই পাবা। শামির ঠিকই আছে, শিক্ষিত বৌ দিয়া অয় কি? কিছু অয়? বৌ মাইনষের কাম খালি স্বামীর লগে শোয়া আর সংসার করা, এই দুইটার লগে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নাই। শিক্ষা ছাড়াই আমি আটচল্লিশ বছর এই কাম করছি। তারপর তো তোমার শশুর মইরা গেলো।”

শাশুড়ির গা জ্বালানো আজেবাজে কথায় অভ্যস্ত রিজিয়া,আশির পর থেকে এই অভ্যাস হয়েছে মাইমুনার,তাকে শোধরানো যায়না।

শাশুড়ির ঘরে চা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে রিজিয়া নিজের ঘরে ঢুকে ড্রয়ার খুলে একটা ছবি নিলেন, দিনের শুরুতেই এটা একটা জরুরী কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানিং, শামিরের জন্য পাত্রীর ছবি নিয়ে সকাল সকাল তার রুমে যাওয়া, সারাদিন তো শামির বাড়িতে থাকে না,থাকে অফিসে।

দরজায় নক করতেই ঘুম ঘুম গম্ভীর রুক্ষ স্বরে আওয়াজ আসে,“এসো।”

রিজিয়া বেগম ঘরে ঢুকে দেখলেন,গোটা ঘরটা অগোছালো। অ্যাশট্রে ভর্তি হয়ে আছে,ছাই ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। রোজ চুপচাপ হজম করেন তিনি এই দৃশ্য,আজও করলেন। ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি, হাতের ছবিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,“এটা দেখ!”
সাদা শার্টের একেবারে টপ বোতাম টা লাগিয়ে নিতে নিতে শামির আয়না থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মায়ের হাতের ছবিটা একপলক দেখে জলদগম্ভীর স্বরে মা’কে বললো,“ডিটেইলস বলো। সময় নেই।”

রিজিয়া তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগলো,“মেয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী…!”

_কোথায় পড়ছে?

_একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে।

_ক্যানসেল।

রিজিয়া কন্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বললেন,“এটা কেমন খামখেয়ালি আচরণ? ভালো মেয়েরা ভার্সিটিতে পড়ে না?”

_পড়ে। অবশ্যই পড়ে, তবে আমার কপালে যে খারাপ মেয়েটাই জুটবে না তার গ্যারান্টি কি? আমি কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।

_এমন বাছাবাছি করলে মেয়ে কোথায় পাবো?

মায়ের দিকে সম্পূর্ণ ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় শামির,বলে,“খুজতে থাকো, সময় লাগিয়ে খুঁজতে থাকো, শুধু একটাই কথা, আমি একটা বৌ চাচ্ছি,যে আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলবে না, লেখাপড়া না জানলেও চলবে তার, ক্লিয়ার?”

_আচ্ছা এমন করলে হয়? তোর বোনদের তো এসব ভার্সিটিতেই পড়াবি, আর তোর মেয়ে হলেও কি এমন করবি?

_কথা হচ্ছে আমার বৌয়ের বিষয়ে, আমার বোন এবং মেয়ের বিষয়ে নয়। আমি যেমন বৌ চাই,তেমনই চাই!

নির্বাক দাঁড়িয়ে রয় রিজিয়া, শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় শামির, দূর্ঘটনাবশত দরজা থেকে কিছুটা দূরে সেন্টার টেবিলের সাথে পা লেগে হোঁচট খেতে নিলে নিজেকে সামলে নেয় সে।
আর আজ এটাই ছিলো তার আজকের দিনের মেজাজ খারাপ হওয়ার প্রথম কারণ। এক লাথিতে সেন্টার টেবিলটাকে ঘরের এককোণে পাঠিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় শামির।
রিজিয়া ছেলের কর্মকাণ্ড চুপচাপ দেখে। এই ছেলের সংসার হবে এই জনমে? কোনো মেয়ে থাকবে এই ছেলের সাথে? আছে এমন মেয়ে এই গ্রহে?

_______

সকালের নাস্তার টেবিলে শামির বাদে বাড়ির সবাই উপস্থিত। রাজন অফিসে যাবে বলে তৈরি হয়ে খেতে বসেছে, শামির আর রাজন দুইভাই বাড়ির ব্যাবসা দেখে একসাথে। শায়ন,রুহি,শামা তিনজন ঘুমঘুম চোখে এসে খেতে বসেছে। রাজনের স্ত্রী সুহানা সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে, সুহানা উচ্চশিক্ষিত,বড় ঘরের মেয়ে, বিয়ের পর গৃহিণী পেশাটাকেই সানন্দে গ্রহণ করেছে।

রিজিয়া বেগম শুরুতেই কথাটা তুললেন, বাড়ির সবার সামনে শারাফাত চৌধুরীকে বললেন,“এটাও ক্যানসেল করেছে। এবার রেজোওয়ানা বুবুকে বলি তাদের আশেপাশে কোনো মেয়ে থাকলে, বুবু একবার বলেওছিল একটা মেয়ে আছে, খুবই যোগ্য…”

_গ্রামের মেয়ে?
নাকমুখ কুঁচকে শামা বলে ওঠে।

বড়দের মাঝে কথা বলায় শারাফাত শামার দিকে একপলক রাগী দৃষ্টি দিয়ে রিজিয়াকে বলে,“বলো। আর কি করবে! তোমার ছেলের তো কোনো আপত্তি নেই।”

মাইমুনা বেগম শামাকে বলে ওঠে,“ঐ ছেড়ি! গেরামের মাইয়া তো কি হইছে? আমি আর তোর মাও তো গেরামের মাইয়া।”

এইবার রিজিয়ার দিকে তাকায় তিনি, আদেশের সুরে বলে,“হোনো বৌ। এইবার শামিরের জন্য বৌ আনবা ছোডোখাডো। বেশি যেন লম্বা না হয়। আরে বৌ মানুষ থাকবো ছোডোখাডো, গোলগাল, পুতুলের নাহান নরম, তালগাছের মতো লম্বা মাইয়া মানুষরে বৌ বৌ লাগে না।”

কথাটি বলেই তিনি রাজনের বৌ সুহানার দিকে আড়চোখে তাকায়। সুহানা বেশ লম্বা একটা মেয়ে, ব্যক্তিগত ভাবে মাইমুনার সুহানাকে পছন্দ না ,কথাটা সুহানাকে খোঁচা মেরে বলতে চাইছেন তিনি। বরাবরের মতো সুহানা বুঝতে পেরেও গায়ে মাখলো না। সে এই বাঁচাল বুড়ির কথা গায়ে মেখে অশান্তি করে না কখনো।

মাইমুনা বলতে থাকে,“লম্বা বৌ দিয়া কি করুম? আমগো ঘরের খুডি দিমু? বৌ আনলে ছোডোখাডোই আইনো, শামিরের কোমর পর্যন্ত হইলেও সমস্যা নাই। এমনেও থাকবো তো আমার নাতির পায়ের নিচে।”

শারাফাত খেতে খেতে মাকে থামিয়ে দিয়ে রিজিয়ার দিকে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে বলে ওঠে,“তুমি রেজোওয়ানা আপার সাথেই কথা বলো,এক কাজ করো আগামী তিন-চার দিন পর তো সবাই আমরা যাচ্ছিই, তখনই না হয় দেখবো গিয়ে।”

_____

“মা মরলে বাপ হয় তাঐ”
এই কথাটা তোর সাথে মিলে গিয়েছে রে জান্নাত। তোর বাপ এখন তোর তাঐ। মেয়েটারে মামার ঘাড়ে ফেলে রেখে বুইড়া বয়সে সংসার পেতেছে । একটা টাকাও দিয়েছে এখনো?”

পিরিয়ডের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিছানায় ছটফট করছিল জান্নাত। মামীর চেঁচামেচিতে উঠে বসে। আজ মামীর কথাগুলো যথেষ্ট অমায়িক ঠেকছে জান্নাতের কাছে। সারাদিনে মোটে এটুকুই শুনিয়েছে আজ সে। অবশ্য ইদানিং মামী একটু কম কথা শুনিয়ে পারে জান্নাতকে। কারণ জান্নাতের মামার সাথে পরামর্শ করে জান্নাতের জন্য পাত্র খুঁজছে, ধীরে সুস্থে জান্নাতকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন তিনি। এখন একটু কোমল আচরণ করাটাই সমীচিন।

সদ্য এস.এস.সি পরিক্ষা দিয়ে উঠলো জান্নাতুল ফেরদৌস, ফলাফল এখনও দেয়নি। ছোটো থেকে মামা বাড়িতেই মানুষ। মা মরেছে তার যখন ছবছর বয়স তখন। তারপর থেকে ঘুরে ঘুরে তিন মামার কাছে মানুষ সে। নবম থেকে দশম শ্রেণী কাটিয়েছে বড় মামা শাহীন আকন্দের বাড়িতে। জান্নাতের তিন মামাই চাষাবাদ করে খায়, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জান্নাতের মতো একটা জলজ্যান্ত বোঝার স্থান দেওয়ায় জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস তার তিন মামা এবং তিন মামীর প্রতি বরাবর কৃতজ্ঞ। তাই তাদের ছোটোখাটো কথা জান্নাতুল গায়ে মাখে না। সতের বছরের জীবনে এতটুকু বুঝ তার আছে বৈকি। আর রইলো বাকি আদর ভালোবাসার কথা? ওসব ছাড়াই জান্নাতুল সতের বছর দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছে।

________

হেমন্তের শুরু, ধান পেকেছে, বিশালাকার আঁটা মাথায় তুলে চাষারা ছুটছে বাড়ির দিকে, ভর সকালের কড়া রোদের আক্রোশের শিকার হবার আগেই। তারা খুব সকালে আসে, সকাল ন’টার আগে ধান কেটে চলে যায় সূর্য বেশি ক্ষেপে যাওয়ার আগেই।
হাইওয়ে ধরে নির্দিষ্ট গতিতে ছুটছে লাল টয়োটা, ড্রাইভিং সিটে বসে আছে শামির, মুখভঙ্গি গম্ভীর,মেজাজ বিগড়ানো, তবে ড্রাইভিংয়ের হাত সাবধানী তার।
বাড়ির সকলে যেতে যেতে হাই-ওয়ের দুধারে ধানের ক্ষেতে দৃষ্টি দিয়ে গ্রামের এই নৈস্বর্গিক দৃশ্য উপভোগ করছে। গন্তব্য তাদের রুপাতলী গ্রাম। শামিরের খালা রেজোওয়ানা বেগমের বাড়ি।

রুপাতলী গ্রামের চেয়ারম্যানের স্ত্রী রেজোওয়ানা, ছোটো বোন রিজিয়াকে এই হেমন্তে ঘটা করে নিমন্ত্রণ করেছিলেন নতুন চালের পিঠাপুলি খাওয়াতে,সেই সাথে শামিরের জন্য একটি মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন তিনি, রেজোওয়ানা ফোন করে শারাফাতকে বলেছে স্বপরিবারে এসে যেন মেয়েটিকে দেখে, এভাবে ফোনে ফোনে তো পাত্রী দেখা সম্ভব না, তাছাড়া শামির খুঁতখুঁতে ছেলে, স্বচক্ষে পাত্রী দেখে তবেই পছন্দ করুক।

রুপাতলীর চেয়ারম্যান মোর্শেদুল ইসলামের বাংলো বাড়ির ঠিক সামনে এসে লাল টয়োটা থামে। দূর দূর থেকে গ্রামের সহজ সরল লোকগুলোর দৃষ্টি আটকায় এই শহুরে মেহমান গুলো। তবে সাহস করে চেয়ারম্যান বাড়ির গেটের কাছে কেউ আসে না, শহুরে মানুষদের ভয় পায় এই সরল চিত্তের লোকেরা, এরা দূর থেকেই কৌতুহল মিটিয়ে নেয়।

বাড়ি থেকে রেজোওয়ানা বেগম ছুটে বেড়িয়ে এসে বোনের পরিবারকে স্বাগত জানায়, বহুদিন পরে এসেছে সবাই, আবেগতাড়িত হয়ে বোন আর বোনঝিদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন খানিকক্ষণ। ভেতর বাড়ি থেকে কেয়ারটেকার রা এসে গাড়ি থেকে লটবহর নামিয়ে নেয়। চেয়ারম্যান মোর্শেদুল ইসলাম এসে তাড়া দিয়ে সবাইকে নিয়ে যায় বাড়ির ভেতরে। শায়ন,রুহি,শামা এসেই ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে ব্যস্ত। খালুজানের আদেশ পেতেই ছুটলো ভেতরে।

শামির চৌধুরী প্যান্টের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, সবাইকে বললো সে কিছুক্ষণ পরে যাবে ভেতরে, আশপাশটা ঘুরে দেখবে, বহুদিন পরে এসেছে তাই।
রেজোওয়ানা বোনের মেজো ছেলেকে দেখে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদেহী সুপুরুষ জোয়ান ছেলে, বিশ্রী মেজাজ টা যদি একটু কমাতে পারতো এই ছেলে হতো আকাশের চাঁদ। কিন্তু সব মানুষ নিখুঁত নয়, সৃষ্টিকর্তা একটা না একটা ঘাটতি রেখেই দেন, যেমনটা এই ভয়ংকর বদমেজাজি শামির ওরফে শামির চৌধুরী।

_______

সকাল সকাল গোসল করে জান্নাত বেড়িয়েছে। লাল সবুজ রঙের গামছা জড়িয়েছে লম্বা দীঘল কালো ভেজা চুলে। সকাল সকাল মামীর উঠোন নিকোতে উত্তর পাড়ার ডোবা থেকে নরম কাঁদা তুলতে হয়েছিল, গা ঘিনঘিনে হয়ে যাওয়ায় পুকুরে গিয়ে দুইটা ডুব দিয়ে এসেছে।
হ্যাঁচকা টানে চুল থেকে আধ ভেজা গামছা খুলে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দেয়, অনেকক্ষণ যাবত চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে হৈচৈয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। জান্নাতের মামা শাহীন আকন্দের টিনের বাড়িটা চেয়ারম্যানের বাংলো থেকে খানিকটা দূরেই,বলতে গেলে প্রতিবেশী তারা। মাঝখানে আঠাশ শতাংশ জমির একটা প্লট ব্যাবধান।
জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জান্নাত তার মামাতো বোন পরশীকে বললো,“কি হচ্ছে রে ও বাড়িতে? শান্তা আপার শশুর বাড়ির লোক এসেছে বুঝি? অতগুলো গাড়ি কাদের?”

_না, রেজোওয়ানা চাচীর বাপের বাড়ির লোক।

_তুই কিভাবে জানলি?

_আরে এই মাত্র ওদের বাড়িতে মায়ের সাথে গিয়েছিলাম আমি, রেজোওয়ানা চাচী ডেকেছিল মাকে মাছ কেটে দিতে। জানো জান্নাত আপু, একটা খুব রাগী রাগী লোক দেখলাম স্যুট ব্যুট পরে আম বাগানের ওপাশে ঘোরাঘুরি করছে, ফোনে কাকে যেন বলছে “এই! বাঞ্চোদের মতো কথা বলে আমার মাথা খাবে না বলে দিলাম।”

লোকটা ইংরেজিতেও কথা বলে। আচ্ছা আপু,শহরের লোকেরাও গালি দেয়?”

জান্নাত সামান্য হেসে পরশীর গাল টিপে দিয়ে বলে,“গালি খারাপ লোকেরা দেয় পরশী।”

জান্নাতের বড় মামী শাহিনুর এলেন ছুটতে ছুটতে, তাড়াহুড়ো লাগিয়ে বললেন,“এই জান্নাত। আমি আজ সারাদিন চেয়ারম্যান বাড়িতে থাকবো। তুই একটু ও বাড়ি থেকে টিউবওয়েলের পানিটা এনে রাখ।”

মুখ শুকনো করে জান্নাত আওড়ায়,“ও বাড়িতে শহুরে মেহমান যে!”

_তো কি হয়েছে? তোকে খেয়ে ফেলবে? গা-মাথায় কাপড় দিয়ে যা। যা তাড়াতাড়ি।

_______

চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারি ঘরে হৈচৈ হচ্ছে, কতদিন পরে সবাই একসাথে হয়েছে, ঝিম ধরা দুপুরে পেয়ারা মাখা খেতে খেতে সবাই গল্পগুজব করছিলো। সেখানে অনুপস্থিত ছিলো শামির চৌধুরী। আড্ডায় কথা হচ্ছিল শামিরের জন্য রেজোওয়ানার পছন্দ করা মেয়েকে নিয়ে, মেয়ে এই গ্রামের হাওলাদার বাড়ির মেয়ে, এইবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, বাবা পেশায় শিক্ষক। রেজোওয়ানা ঠিক করেছে কাল রিজিয়াকে নিয়ে গোপনে দেখিয়ে আনবেন মেয়েকে।
শারাফাত আপত্তি তুলে বললেন,“এভাবে তাদের অযথা বিব্রত করার মানে নেই রেজোওয়ানা আপা।”

রেজোওয়ানা বললেন,“আরে বিষয়টা গোপন থাকবে শারাফাত। তুমি চিন্তা করো না।”

কথায় কথায় প্রত্যেকেই পাত্রী দেখা নিয়ে যার যার অভিমত রাখে। বাইরে থেকে তখন শামিরের গুরুগম্ভীর হাক ডাকে থামে আলোচনা।

শামিরকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসতে থাকে রুহি শামা, এবং রেজোওয়ানার ছেলে শান্ত। তবে সে হাসি অপ্রকাশিত। নয়তো মেজো ভাইয়ার এক চ’ড়ে দাঁত কমপক্ষে পাঁচটা খুলে পরবে।

দামী শু’তে কিছুটা গোবর লাগিয়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে শামির। বাংলো থেকে কিছুটা দূরে হাঁটতে বেরিয়েছিল, ভুল কথা, একটা সিগারেট খেতে বেরিয়েছিলো। হঠাৎ ফোনে অফিশিয়াল কল এলে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল যখন, বেখেয়ালে গোবরে পা দিয়ে ফেলেছিলো। তবে গোবরের সাথে তো মেজাজ দেখানো যায়না, গোবরের মালিক গরু,আর গরুর মালিক উত্তর পাড়ার শাহজাহান মিয়ার ওপর উগ্র মেজাজের রাগটা ঝেড়ে বাড়িতে এসে হাকডাক শুরু করে দিয়েছে। মেজাজ তুঙ্গে তার, সামলানো দায় হবে সবার।

_______

চেয়ারম্যান বাড়ির গেটের কাছে এসে জান্নাতের দেখা হয় এই বাড়ির ঠিকা ঝি লাইজু খালার সাথে। লাইজু জান্নাতকে দেখতে পেয়েই তার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে চওড়া হেসে বললেন,“পানি নিতে আইছো রে জান্নাত?”

জান্নাতের হাতে কলসি,মাথা নেড়ে জবাব দেয়। লাইজু কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বলে,“তোর মামী বেয়াক্কেল মাতারি। এমন বারন্ত মাইয়ারে কেউ এ বাড়ি ও বাড়ি পাঠায় একামে ওকামে? লোকজন এখনই কুনজর দিতে শুরু করছে। আচ্ছা হোন, গতর ঢাইকা যা ভালো কইরা, শহর দিয়া জুয়ান জুয়ান পোলা আইছে। ভালো কইরা ঢাইকা যা।

জান্নাত নিজেকে ওড়না দিয়ে ভালো করেই ঢেকে রেখেছিল, লাইজুর কথায় আরেকবার ঢাকলো। লাইজু হাসতে হাসতে বলল,“যা হইতাছোস দিন দিন। এক্কেবারে মায়ের মতো। কপালডা মায়ের মতো না হইলেই হয় অখন।”

স্বভাবে বাঁচাল লাইজু বিড়বিড় করতে করতে চলে যায়, জান্নাত পা রাখে গেটের ভেতরে। ওড়নার ঘোমটাটা টেনে পারলে চোখ দু’টোকেই ঢেকে নেয়, ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে যায় চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারি ঘরের পাশের চাপকলে। তাড়াহুড়ো করে কলসিতে পানি ভরে কোমরে তুলে এদিক সেদিক না তাকিয়ে হনহনিয়ে চেয়ারম্যানের আঙিনা পেরোতে নিলে হঠাৎ খুব শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে হুমরি খেয়ে পরে যেতে নেয় জান্নাত।
কিছু বুঝে উঠতেও পারেনি জান্নাত,কলসি থেকে ততক্ষণে পানি ছলকে ছলকে পরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে পুরোটা। জান্নাত একটা ঢোক গিললো, ঘোমটায় তার চোখ ঢাকা বিধায় দেখতে পারলো না মানুষটার মুখ। খুব বেশি কৌতুহল জেঁকে ধরলে কম্পিত হাতে ঘোমটা কিছুটা সরিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই বিস্ফোরিত হয় নেত্রদ্বয়। অতি লম্বা অচেনা এক লোক নিজের ভেজা শার্ট হাত দিয়ে ঝারতে ঝারতে জান্নাতের দিকে না তাকিয়ে ভারিক্কি ধমক দিয়ে বলে,“হোয়্যাট দ্য হেল ইজ দিজ!”.

বলতে বলতে সে ভারিক্কি আওয়াজের লোক তাকায় জান্নাতের দিকে। জান্নাত চোখে চোখ মেলায়না, অকস্মাৎ দৃষ্টি নত করে নিজের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে টের পায় তার ছোটোখাটো শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। লোকটার ধ’ম’ক যেন সমুদ্রের গর্জন। ধ’ম’কটা বড্ড ভারি পরেছে রুপাতলী গ্রামের,রুপাতলী হাইস্কুল থেকে সদ্য এস.এস.সি পরিক্ষা দেওয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসের কাছে।

চলমান….