জায়া ও পতি পর্ব-০২

0
21

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_২
#ইসরাত_ইতি

লোকটার ধ’ম’ক যেন সমুদ্রের গর্জন। ধ’ম’কটা বড্ড ভারি পরেছে রুপাতলী গ্রামের,রুপাতলী হাইস্কুল থেকে সদ্য এস.এস.সি পরিক্ষা দেওয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসের কাছে।

________

শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাত। এই মুহূর্তে তার ছুট লাগানো প্রয়োজন,তবে কলসি যে খালি হয়েছে, সেটা আবারও ভর্তি করতে হবে। চোখ মুখ খিচিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে জান্নাত, ছুট লাগাবে? নাকি কলসি পূর্ণ করবে? কলসি পূর্ণ করবে? নাকি ছুট লাগাবে?

শামির ধ’ম’কটা দিয়েই মাথা তুলে তাকায় মেয়েটার দিকে। কালো রঙের সুতি ওড়নার ঘোমটার নিচে একজোড়া আয়ত চোখ, সেই চোখের দৃষ্টি নত, থরথরিয়ে কাঁপছে,হাতের কলসটাও কাঁপছে।

ধীরে ধীরে শামিরের তীক্ষ্ম কৌতুহলী দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় মেয়েটার পদযুগলে, সুশ্রী, ফরসা, সুগঠিত পদযুগল। মেয়েটির দৃষ্টিও যেখানটায় নিবদ্ধ।

ভিজে জবজবে হওয়া সাদা-নীল স্ট্রাইপের শার্টটা হিম দিতে শুরু করেছে, বিগড়ে যাওয়া মেজাজ টা ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসতে চাইলো তার সামনে দাঁড়ানো, থরথর করে কাঁপতে থাকা অপরাধীর নত দৃষ্টি দেখে। কিছু মুহূর্তের জন্য শামির আশেপাশেও তাকালো না, ওপাশ থেকে রুহি শামা আর রেজোওয়ানার মেয়ে নীড়া তোয়ালে সাবান নিয়ে ছুটে এসে বলে ওঠে,“কিছু হয়েছে মেজো ভাইয়া?”

শামির জান্নাতের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। নীড়া এসেই জান্নাতকে বলে,“জান্নাতুল ! পানি নিবি?”

_আ-আসলে আমি ওনাকে ভিজিয়ে দিয়েছি।
চোখ মুখ খিচিয়ে মাত্রাতিরিক্ত নম্র, অপরাধীর ন্যায় জবাব টা দিলো।

শামির স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রুহি ঝুঁকে বসে তার শু পরিষ্কার করে দিচ্ছে। নীড়া বললো,“ঠিক আছে রে বাবা, কাদবি নাকি! এই কিছু হয়নি! যা পানি নিয়ে যা।”

হাত পা তখনও কাঁপছে জান্নাতের, শামিরের দৃষ্টি ঘুরেফিরে কালো রঙের ওড়নার নিচে ভীতসন্ত্রস্ত,নত নেত্রজোড়ায় গিয়ে স্থির হচ্ছে। তার তরফ থেকে একটা লম্বা ধ’ম’ক এই মেয়েটা পায়, তবে এই মেয়েটির কম্পিত বিধ্বস্ত অবস্থা শামিরের সে আকাঙ্ক্ষা অনেকটাই হ্রাস করে দিয়েছে।
শুধু গম্ভীর স্বরে বললো,“পানি না নেওয়ার থাকলে এখান থেকে যাও।”

জান্নাত দ্বিধান্বিত,বহু কষ্টে নিজেকে সামলে, পাণ্ডুবর্ণের হয়ে যাওয়া মুখশ্রী আর তীব্র অস্বস্তি নিয়ে কলসি আবারও পূর্ণ করলো চাপকল চেপে। একহাতে ওড়না সামলাচ্ছে, একহাতে চাপকলের হাতল সামলাচ্ছে।
নীড়া বললো,“আজ সন্ধ্যায় আসিস জান্নাতুল, কেমন?”

এক মুহুর্তও দাঁড়াল না জান্নাতুল, দ্রুত মাথা নেড়ে কেমন চোর পালানোর মতন করে পালিয়ে গেলো,পিছু ফেলে গেলো কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ।

ভাইয়ার শু পরিষ্কার করে দিতে দিতে রুহি নীড়াকে বললো,“ভারি মিষ্টি মেয়েটা! কোন ক্লাসে পড়ে?”

_ও এইবার এস.এস.সি পরিক্ষা দিয়েছে।

_কি নাম?

_জান্নাতুল ফেরদৌস।

ভেতর বাড়ি থেকে কানে হেডফোন লাগিয়ে শায়ন এসে শামিরকে অর্ধসিক্ত দেখে অবাক হলো,বললো,“আবার কি হলো! পুকুরে পরে গিয়েছিলে নাকি!”

শামির জবাব দিচ্ছে না, অফিসের একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত,তার ওপর টুকটাক ছোটোখাটো দূর্ঘটনা যা ঘটছে মেজাজ চটে আছে অনেকটাই। দৃষ্টি তার দূর থেকে দূরে সরে যেতে থাকা ছোটোখাটো ভীত অপরাধীর দিকে,কোমরে কলসি নিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছে,ভীত বেড়ালের ন্যায় ধীরতা যার চলনে।

শায়ন হাসতে হাসতে বলল,“ভাইয়া! গোবর লেগেছে, তুমি এমনিতেও গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে চলেছো, অভ্যাস করে নাও।”

_______

নিজের প্লাস্টিকের ব্যাংক টা কেটে চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো জান্নাত, টাকাগুলো ছড়িয়ে গিয়েছে বিছানায়,প্রথমে সে বেশ খুশি হয়েছিলো, ছড়িয়ে থাকা কাগুজে নোট গুলো দেখে টাকার পরিমাণ নিয়ে ছিলো আশাবাদী। তবে সে হতাশ,মাত্র তিনশ’ ছাপ্পান্ন টাকা।

কিন্তু এতো কম থাকার কথা নয়, সে গত দেড় বছর ধরে জমাচ্ছিল। হুট করে মাথায় একটা জটিল চিন্তা আসে,বেশ কয়েকবার সে মামীকে তার ব্যাংকটার কাছে এসে খোঁচাখুঁচি করতে দেখেছে, তবে কি মামী কিছু নিয়েছে? মামীর এধরণের স্বভাব আছে।
তবে এর প্রতিবাদ জান্নাত কখনোই করতে পারবে না,মামা গিয়েছে শহরে,এসে থাপড়ে জান্নাতকে মেরেই ফেলবে তবে।
জান্নাতের মায়ের বারো শতাংশ জমি তিন মামা দখল করে বসে আছে, বিনিময়ে নিয়েছে জান্নাতের ভরণপোষণের দায়িত্ব,এই তো অনেক।

গুটি গুটি পায়ে গিয়ে জান্নাত মামীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,“তোমার ফোনটা একটু দেবে মামী?”

_ক্যান?

_আব্বাকে কল করবো, টাকা চাইবো।

_অহহহ,নে ধর।
অন্যসময় হলে শাহিনুর দিতো না, টাকার কথা শুনেই তার চোখদুটো চকচক করে ওঠে। এও বলে দিলো জান্নাতকে,যেন একটু বেশি টাকা চেয়ে নেয়।

কলটা রিসিভ করলো একজন মহিলা, অশুদ্ধ উচ্চারণে বললো,“হ্যালো কেডা?”

_আব্বা আছে?

_কেডা তুমি?

_আমি জান্নাত।

ওপাশে খানিকটা সময়ের নীরবতা, ধীরে ধীরে বলে,“না বাড়িতে নাই,ফোন ঘরে থুইয়া স-মিলে গ্যাছে।”

_আব্বা এলে বলবেন জান্নাত কল দিয়েছে।

_আচ্চা রাখো।

ফোন কাটে, জান্নাত জানে এই বার্তা আব্বার নিকট পৌঁছাবে না । কারণ আব্বাই চায়না এমন বার্তা পেতে, জান্নাত ধীরে ধীরে বুঝেছে, আব্বা ব্যস্ত তার দুই ছেলেকে নিয়ে। একজনের বয়স দশ, আরেকজনের বয়স সাত।

কল কেটে শুধু ভাবুক হয়ে বসে রয় কিশোরী জান্নাত,খুব শিগগিরই রেজাল্ট বেড়োবে, কলেজে ভর্তির টাকাটা এখন থেকে গুছিয়ে রাখা প্রয়োজন। অথচ তার সামনে পরে আছে মাত্র তিনশ’ ছাপ্পান্ন টাকা।

________

চেয়ারম্যান বাড়ির আঙিনায় সালিশ বসেছে হঠাৎ,গ্রামের একটা জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের সালিশ। শারাফাত চৌধুরী নিজের চেয়ারম্যান ভায়রা ভাইয়ের পাশে বসে গ্রামের কূটনৈতিক আলাপ বেশ উপভোগ করছে । এ বাড়িতে দুপুরে এসেছে রেজোওয়ানার বড় মেয়ে শান্তা আর তার বর রাজীব।
ঘরভর্তি মহিলা,বাচ্চা, রসুইঘরে প্রতিবেশী কিছু মহিলা পিঠাপুলি বানাতে ব্যস্ত।
ছেলেমেয়ে গুলো ব্যস্ত ছাদে আড্ডা দিতে। দুপুরে খাওয়ার পরে শামির চৌধুরীকে পাত্রীর ছবি দেখানো হয়েছে, খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি সে যখন জেনেছে পাত্রী বিসিএসের প্রিপারেশন নিতে চায়,পাত্রীর স্বপ্ন সে চাকুরী করবে।
বাড়ির লোকগুলো চূড়ান্ত রকমের হতাশ। শুধু শামিরের দাদী মায়মুনা নাতীকে সমর্থন করে বলেছে,“মোর নাতি তো ঠিকই কইছে, ওইসব মাইয়া লাগবো না, মাস্টার ফাস্টারের মাইয়া লাগবো না। একটা ভাগচাষীর ঘরতে দেখো,যেন মোর নাতির মন মতো হয়।”

রেজোওয়ানা মায়মুনার জবাবে বলেছে,“কিন্তু তাই বলে চাষীর ঘর থেকে? আপনাদের অবস্থানের সাথে যায়? সবটা তো বিবেচনা করে এগোতে হবে মাঐ মা।”

_হ খুব যায়,চাষীর ঘর থেইক্যাই আনবা। দিল নরম মাইয়া,সব সময় যেন নিজের অবস্থান সম্পর্কে সতর্ক থাহে। সংসারে বৌ মানুষের নিজের অবস্থান জানাডা জরুরি। আইজকাইল তো সব ফরফরানি চু*মারানি! স্বামীর আদর পাইলে এক্কেরে ফরফর কইরা ওড়তে থাহে! আর মাডিতে নামানামির নাম থাহে না।

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শামির, অফিসের দীর্ঘ আলাপ শেষে কান থেকে ব্লুটুথ নামিয়ে রেখে আশেপাশে তাকায়, নীড়া এসেছে গ্রিন টি নিয়ে। খুব ভয় পায় শামির ভাইয়াকে সে,ক্লাস সিক্সে থাকতে শামির ভাইয়ার ল্যাপটপে হাত দেওয়ার অপরাধে ভয়ংকর এক ধমক জুটেছিল তার কপালে, সেই থেকে শামিরকে সমঝে চলে। হাতে চায়ের কাপটা কোনোরকমে ধরিয়ে দিয়ে সে ছাদের একপাশে কেটে পরে। ছাদের একপাশে মাদুর বিছিয়ে নীড়া,রুহি,শামা লুডু খেলছে। আরেকপাশে নীড়ার বড় বোন শান্তা,শামিরের ভাবী সুহানা বসে গল্প করছিল। শায়ন বেড়িয়েছে রেজোওয়ানার ছোটো ছেলে শান্তকে নিয়ে আম বাগান ঘুরতে।

শামির চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির আশপাশটায় নজর বুলাচ্ছিলো যখন,হুট করে মিহি কন্ঠের চাপা হাসির গুঞ্জন কর্ণগোচর হতেই সে বাংলোর ডানপাশে ফাঁকা মাঠটাতে দৃষ্টি রাখে।
জান্নাত আর ওর বান্ধবীরা দড়ি লাফের প্রতিযোগিতা করছে, ওদের আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে উৎসুক কিছু বালিকা।
শামির তীক্ষ্ম দৃষ্টির তোপে পরেছে জান্নাতের ঘর্মাক্ত রক্তাভ মুখমণ্ডল, গতকাল দুপুরের সেই অপরাধী চূড়ান্ত চেষ্টা করছে দড়ি লাফের প্রতিযোগিতায় জিততে, তবে শেষ রক্ষা হলো না, গাঁয়ে পেঁচিয়ে রাখা ওড়না আলগা হয়ে যেতেই সে থামলো,দড়ি ফেলে তৎক্ষণাৎ সামলে নিলো ওড়না,বুক থেকে আলাদা হতে দিলো না সেটাকে সামান্য পরিমাণও।
মেনে নিলো হার,তবে জান্নাতের মুখ হাসিহাসি, ওড়নার কোণে নিজের ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে নিয়ে ওড়না দিয়ে ঘোমটা তুলে দেয় মাথায়।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শামির ভাবুক হয়, তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শান্তার বর রাজীব, শামিরের স্থির দৃষ্টি অনুসরণ করে জান্নাতের দিকে তাকাতেই তার ঠোঁটে ফোটে একপেশে হাসি, বলে,“জান্নাতুল নাম। বেশ ভদ্র মেয়েটি।”

শামির দৃষ্টি সরিয়ে রাজিবের দিকে তাকায়,রাজিব বলে,“তবে ভারি অদ্ভুত আচরণ, আমি প্রথমে ভেবেছি বোবা। কথাই বলে না এই মেয়ে।”

_মেয়েদের বেশি কথা বলা উচিতও নয়। শুধু প্রশ্ন করলে মাথা নেড়ে কিংবা হু হা তে জবাব দেওয়ার মতো বোধ থাকলেই হয়।
দ্বিতীয় বার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জবাব দিলো শামির।

_তবুও, বয়স অনুযায়ী বড্ড চাপা, এই বাড়িতে প্রায়ই আসে। আচ্ছা বাদ দাও, তুমি বলো, পাত্রী পছন্দ হয়নি?

শামির দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবারও অবচেতন মনে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,“না।”

রুহি শামা মেহেদী পরবে হাতে,নীড়া উঠে দাঁড়িয়ে বললো,“দাড়া জান্নাতুলকে ডেকে আনছি। ও পরিয়ে দেয় আমাকে, দারুণ গুণী।”

ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে শামিরের পার্শ্বে দাড়ি হাত নেড়ে হাক ছাড়লো নীড়া,“এইতো মেয়েটা এইখানে, আরে ও জান্নাত, এই শোন! ওপরে তাকা!”

মাঠের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা জান্নাত অবিন্যস্ত দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে খুজে পায় নীড়াকে, পরমুহূর্তেই নীড়ার পার্শ্বে কঠিন সেই লোকটাকে দেখে সংকোচে জড়োসড়ো হয় ছোটো খাটো শরীরটা। দৃষ্টি করে নত, ঐ লোকটা তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে চায়ের কাপ হাতে।

এমন পাথর কঠিন দৃষ্টি জান্নাতের ভালো লাগে না মোটেই, এই লোকটা খুব রাগী জান্নাত শুনেছে পরশীর কাছে, সব্বাইকে ধমকে বেড়ায়, সারাক্ষণ কানে ফোন চেপে ধরে ইংরেজিতে গালাগাল করে কাউকে না কাউকে।

নীড়া বিরক্তি নিয়ে বলে,“আরে ও জান্নাত! এই দেখ না বাবা। ছাদে আয়!”

জান্নাত ক্রমশ চোখ তুলে একটা ঢোক গিলে নেয়,পর পর নীড়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে ডানে বায়ে, এর মানে এখন না,এখন সে যাবে না ছাদে।

_আরে আয়না বাবা। মেহেদী পড়বো। পরে খেলিস!

শামির ওখান থেকে নড়ে না,না তো দৃষ্টি ফেরায়। জান্নাত এবার ছোট করে বললো,“মাগরীবের নামাজের পরে আসবো আপু।”

এমন ভাবে বললো না শামির শুনলো না নীড়া। নীড়া চেচালো,“জোরে বল না বাবা, কি বলছিস?”

এর চেয়ে জোরে কথা বলতে জানে না জান্নাত, চেষ্টা করে বললো,“মাগরীবের নামাজের পরে।”

বলেই ছুট লাগালো বাড়ির দিকে। নীড়া চলে যাওয়ার পরে শামির চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দৃষ্টি দিয়ে রাখলো জান্নাতের প্রস্থানের দিকে। ঠোঁটে তার অস্পষ্ট একপেশে হাসি অথচ কাঠিন্যে ভরা দৃষ্টি।

_________

চেয়ারম্যান বাড়িতে মেহমান আসার পর থেকেই শাহিনুর সময়ে অসময়ে ও বাড়িতে যায়, চেয়ারম্যান গিন্নির কাজ-বাজ হাতে হাতে করে দিতে। আজ সন্ধ্যা নাগাদ বাড়িতে ফিরে দেখলো শাহীন আকন্দ শহর থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছে। দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করছিল সবার, শাহিনুরকে দেখে বললো,“কই গেছিলা? পরশী আর জান্নাত কই?”

_ওরা চেয়ারম্যান বাড়ি, ও বাড়িতে শহুরে মেহমান আসছে,জান্নাতরে নীড়া আইসা ধইরা নিয়া গ্যাছে, মেহেদী পড়ায়া দেওয়ার জন্য।

_অহহ, তয় মাইয়াডারে এতো এ বাড়ি ও বাড়ি যাইতে দিও না। বদনাম হইবার পারে। ভালোয় ভালোয় বিয়া দিতে চাই আমি।

শাহিনুর উৎসুক হয়ে তাকায়,বলে,“ঘটক রোবিউল কিছু জানাইছে?ঐ যে সেনাবাহিনীতে চাকরি করে সেনা পোস্টে। সেই পাত্রের বাড়ি থেকে কিছু জানাইছে?”

_না,তয় ধইরা নাও তারা রাজি না, সরকারি চাকরি পাত্রের, হোউক সেনা পোস্ট, তারা গছবো ক্যান আমাগোরে? পারবা দিতে লাখ টাকার মালামাল? আর জান্নাতের ভাতুরে বাপ তো তার নুতন ঝন্যার আঁচলের তলায় ঢুইক্যা আছে। অজাত শা*লা। ওর তো মাইয়া নিয়া কোনো চিন্তা নাই,ফালায়া রাখছে আমগো ঘাড়ে।

শাহিনুরের উৎসাহ নিভে যায়,এই মেয়েটাকে বিদায় না দিতে পারলে তার শান্তি নেই, ঘাড়ের ওপর উঠে বসে আছে, ইদানিং আবার কান্নাকাটি করছে তাকে কলেজে ভর্তি করাতে হবে, অথচ বাপ নিরুদ্দেশ। ওর মায়ের ঐ চার শতাংশ জমির বিনিময়ে বেশ খরচা করাচ্ছে মামাদের। শাহিনুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসব ভেবে।

মেয়েরা বাড়ির আঙিনায় মাদুর বিছিয়ে গোল হয়ে বসেছে, মাঝখানে চার্জার লাইট। ত্রিশ মিনিট হলো লোডশেডিং। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ির সকলে বাহিরে অবস্থান নিয়েছে। জান্নাত একে একে মেয়েগুলোর হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। সবার হাতে মেহেদি পরাতে গিয়ে তার হাতের বেহাল দশা,টিউবটাতে কিঞ্চিত ত্রুটি থাকায় তার হাত নোংরা হয়েছে। নীড়া তাড়া দিয়ে বললো,“যা হাত ধুয়ে আয়, সৌর বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে ভেতরে। এখন চাপকলে যাসনা,সাপ থাকতে পারে অন্ধকারে ওখানে।”

জান্নাত মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ওড়না দিয়ে নিজেকে ভালো করে আবৃত করে আধো অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে অন্দরমহলে ঢুকেই সরাসরি চলে যায় রান্নাঘরের কলের কাছে। নীড়া যা বলেছিলো সত্যি নয়, বাড়িতে কেবল একটা বাতি জ্বলছে ,তাও অতিথি শালার দিকে। বাকি গুলো নেভানো,তবুও জান্নাতের অসুবিধে হচ্ছিলো না পথ চলতে। হাত ধুয়ে ওড়না দিয়ে মুছে নিতে নিতে ঢুরে দাড়াতেই সে টের পায় এক ছায়ামূর্তি তার পেছনে এসে দাড়িয়ে, সেই কর্কশ, সমুদ্রের গর্জনের মতো স্বর চেঁচিয়ে উঠলো যেন,“এই শামা আমার ল্যাপটপে কে হাত দিয়েছে?”

জান্নাত ঢোক গিলে নিজের মনে হাঁটতে শুরু করে অন্ধকারে,সে তো শামা নয় যে জবাব দেবে, এমনিতেই এই লোকটাকে জান্নাত ভয় পায়, এর চোখের সামনে থেকে কেটে পরার ভীষণ তাড়া তার।

শামিরের লম্বা কদমের কাছে হার মানলো তার মেয়েলি চলন। পেছন থেকে হাতে টান খেলো আচমকা, আবারও সেই সমুদ্রের গর্জন,“স্পিক আপ নয়তো থাপড়ে দাঁত সবকটা ফেলে দেবো! ওটা আমার অফিশিয়াল ল্যাপটপ!”

শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি,জান্নাতের উচিত চেচানো, অথচ গলা দিয়ে শব্দ বেড়োচ্ছে না। অন্ধকারে লোকটা কি তাকে চিনতে পারেনি,হাশফাশ করছে জান্নাত,নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,“আমি শামা নই,আমি জান্নাত। হাত ছাড়ুন আমার। হাত ছাড়ুন।”

বলতে দেরী শামিরের হাত ছাড়তে দেরী নয়। অন্ধকারে ঠিকমতো মুখটা দেখতে পাচ্ছেনা,অথচ মিনিট চারেক আগে শামা এখানে ঘুরঘুর করছিলো।
শামির কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়,মুখে কিছু বললো না। জান্নাত নিজের হাতের কব্জি ছাড়া পেতেই ওখান থেকে ছুটতে ছুটতে বেড়িয়ে যায়।

________

সেরাতের পরে জান্নাত ও বাড়িতে যায়নি। খুব ভীত চিত্তের কিশোরী মেয়েটা অস্বাভাবিক চাপা, প্রাণোচ্ছল তবে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে।
মামা শাহীন আকন্দ গতকাল রাতে তাকে বারন করেছে খুব বেশি পাড়া ঘোরা যাবে না। সে তো খুব বেশি পাড়া ঘোরে না। মামীই না তাকে এখানে ওখানে কাজে পাঠায়! এই যেমন চেয়ারম্যান বাড়িতে মামীই তাকে ঠেলে ঠুলে পাঠায়।

শাহীন গিয়েছে বাজারে,পরশী উঠোনে ধান পাহাড়া দিচ্ছে। জান্নাত চুলায় কচুপাতা সেদ্ধ বসিয়েছে ভর্তা করবে বলে, বাড়িতে মামী নেই। সে গিয়েছে চেয়ারম্যান বাড়িতে।
গরমে চুলার কাছে অতিষ্ট জান্নাত একফাকে এসে ঘরের জালি ফ্যান ছেড়ে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছিল,ঠিক তখনই বাইরে থেকে শাহীনুরের হাক ডাক। জান্নাত ঘাবড়েছে, চুলায় কিছু পুড়লো কিনা তাই ভেবে! নয়তো আজ রক্ষে নেই।

দ্রুত ওড়না নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই শাহীনুর ছুটতে ছুটতে এলো, জান্নাত কৈফিয়ত দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আগেই শাহীনুর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“ওরে জান্নাত,তোর তো কপাল খুলে গ্যাছে রে! চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছি এইমাত্র। পাত্র তোর রেজোওয়ানা চাচীর সেই লম্বা বোনপুত, ব্যাবসা সামলায়, তেলের পাম্প আছে, দুইটা লঞ্চ আছে, জান্নাত তোর তো কপাল খুলে গ্যাছে।”

চলমান……