জায়া ও পতি পর্ব-০৪

0
14

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৪
#ইসরাত_ইতি

এলার্ট 🚫 আঞ্চলিক স্ল্যাং এবং প্রাপ্তবয়স্ক কথাবার্তা রয়েছে পর্বটিতে। মনকে প্রস্তুত করে পড়বেন।

তিন মামীর ব্যস্ততার অন্ত নেই, জান্নাতের হবু শশুর বাড়ীর মানুষগুলোর মন জয় করবার সর্বোচ্চ চেষ্টা তাদের। পুরুষদের বসানো হয়েছে বারান্দার একপার্শ্বে যেখানে উঠানের দৈত্যাকার নিম গাছটার হাওয়া সরাসরি ঢোকে। মহিলাদের বসানো হয়েছে বিপরীতে।
কুশলাদি বিনিময়ের পরে মোর্শেদুল ইসলামের নির্দেশে জান্নাতকে আনবার তাড়া পরলো।
নরম তুলতুলে গোলাপী শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে কক্ষের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল জান্নাত। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে, শেষ বিকেলে পেছনের ডোবায় রাজহাঁস গুলো স্নান সারতে নেমেছে,সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
পশ্চিম পাড়া থেকে বান্ধবীরা এসেছে তাকে সাহস যোগাতে,
শাহীনুরের নির্দেশে বোঝাচ্ছে তাকে,কান ভরাতে বিবরণ দিচ্ছে পাত্রের,এমন পাত্র আশেপাশের দশ গ্রামেও কারো কপালে জুটবে না।
পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সখীদের দল,সবাই জান্নাতের বিয়ে নিয়ে বড়দের পক্ষে অবস্থান করছে,কেউ একটা নেই জান্নাতের হয়ে কথা বলবার,আশে পাশে, তিন কূলে। শেখ বাড়ি থেকে রুবি আপা এসেছিলো,জান্নাতকে তিনি পড়াতেন। শাহীনুরকে ধরে বললেন,“এটা কেনো করছেন আপনারা? ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর মত নেই,ভয় পাচ্ছে। চেয়ারম্যানের কথায় ধেইধেই করে রাজি হয়ে যাচ্ছেন, বয়স ওর সাতদিন আগে সতেরোতে পরেছে, একটা সতের বছর বয়সী মেয়ে শারীরিক আর মানসিক ভাবে কতটুকু প্রস্তুত থাকে বিয়ের জন্য?”

কথাটা শুনে যেন শাহীনুর খেকিয়ে উঠেছিল,“হ হ, ফরজ কাম,হালাল কাম দেখলেই তোমগো সচেতনতা কুটকুটাইয়া ওডে। আর এট্টুক এট্টুক ছেড়িরা যহন লাংগের লগে ঘুমায় বিয়া ছাড়া তহন? তহন হ্যারা ছোডো থাহে না? ঐ তো দফাদার বাড়ির ছোটো নাতনি কেলাশ এইটে পরে,ঢাকায় গিয়া কি কি রঙ্গ শুরু করছে তা কি শুনিনা? দিন দুনিয়ায় কি চলে সবই দেখতেছি। আমগো জান্নাত ভালো মাইয়া,ভালো থাকতেই বিয়া দিমু, বেশি চোউখ ফুইট্যা গ্যালে হে মাইয়ারা সংসারী হইতে পারে না। আর বিয়ার জন্য উপযুক্ত বয়সই হইতাচে পনের, ষোলো,সতের। এই সময়ে মাইয়াগো রস থাহে, সুবাস থাহে। আঠেরোতে পরলে হে মাইয়া হইয়া যায় শুখা ফুল। শুখা ফুলের দাম কম পুরুষের কাছে।”

শাহীনুরের আক্রমণাত্মক কথাবার্তা শুনে রুবি আর কোনো কথা না বাড়িয়েই চলে গিয়েছিল দুপুরে। শাহীনুর সারাটাদিন রুবিকে আপনমনে বকেছে,“হিংসা,হিংসা, নিজে তো ঘরে আধবুড়ি হইয়া বইস্যা আছে, একটা ঝুনা নাহোইল! অখন আমগো জান্নাতুলের এতো ভালো শশুর বাড়ী দেইখ্যা বুক জ্বলতাছে মাগীর। আইছে সচেতন কথা মারাইতে। যত্তসব!”

বাইরে থেকে মোর্শেদুল ইসলাম আবারও হাক ছাড়লো,“কৈরে মা জান্নাত, আয় এখানে। দ্যাখ তোকে দেখতে এসেছে কারা!”

শাহীনুর এসে ধরলেন জান্নাতের দুই কাঁধ, জান্নাত ক্ষণিকের জন্য মামীর দিকে তাকিয়ে অভিমানে নামিয়ে নিলো চোখ, শাহীনুর সামান্য হেসে বললেন,“সোনা মা আমার! এতো রাগ করে না,সবাই অপেক্ষা করতে আচে।”
শরীরে জোর নেই মেয়েটাকে নিজের শরীরের সাথে পেঁচিয়ে ধরে নিয়ে গেলেন বারান্দায়,জবাও এসে ধরলেন।
বারান্দায় আলোচনার মাঝে একটা অতি সুমিষ্ট কন্ঠ,কম্পিত যার স্বর, বারান্দায় পা রেখেই ক্ষীণ আওয়াজে সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিতেই ফোনের স্ক্রিন থেকে মনযোগী দৃষ্টি সরলো শামির চৌধুরীর,
ঘাড় বাঁকিয়ে এক ঝলক জান্নাতুলের পা-মাথা দেখেই চোখ নামিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
জান্নাতুলকে বসানো হয়েছে তার হবু শশুর শারাফাত চৌধুরীর পাশে। নম্র ভদ্র মেয়েটির লক্ষি বৌ রূপী বেশ দেখামাত্র বিমোহিত হয় ওখানে উপস্থিত প্রত্যেকে। শামিরের মা রিজিয়া বণিকের মনের মধ্যে যতটুকু খচখচানি ছিল তাও দূর হলো,মেয়েটিকে তার ছেলের জন্য পছন্দ হলো দারুণ, শাড়ীতে মেয়েটির রূপ খুলেছে, বৌ মানুষ লাগছে, পরিপূর্ণ নারী লাগছে,মোটেই অল্পবয়সী বাচ্চা মেয়ে লাগছে না।
জান্নাতকে তার শশুর বাড়ীর লোকের সাথে শরবত খেতে হলো,শামির আরো একপলক তাকিয়ে দেখেছে শরবতের গ্লাস ধরে রাখা গোলগাল ফরসা হাতটা কিছুক্ষণ পরপর কাঁপছে।

কথা এগোলেন মোর্শেদুল ইসলাম,“জান্নাত মা,তুই এবার ঘরে যা।”

ভীত হরিণী দুর্বলের মতো ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়,মুখের মলিনতাটুকু ঢাকা পরেছে তার নিষ্পাপ রূপের ঝলকানিতে, দুপুরে মামী কাঁচা হলুদ বাটা আর আতপ চালের গুঁড়া মাখিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছিল বলেই হয়তো মুখটা আরও চকচক করছে।
ব্যস্ত বাবু শামির চৌধুরীর দৃষ্টি স্থির জান্নাতের পদযুগলে,হাত দিয়ে ঘোমটা সামলে ফরসা সুগঠিত পা দুটো শামিরের সামনে থেকে হেঁটে ভেতরে যেতেই শারাফাত চৌধুরী জান্নাতুলের বাবা-মামাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,“বিয়ে তো আমরা আগেই ঠিক করেছি, আজ তো এমনিই একটু আলাপচারিতা করতে এলাম। আপনারা অনুমতি দিলে ছেলে মেয়ে একটু কথাও বলুক আলাদা। সব তো ঠিকই আছে, সন্ধ্যায় কাজী নিয়ে আসবো। অনুমতি আছে?”

জান্নাতের বাবা-মামারা অনুমতি দেওয়ার পূর্বেই পর্দার আড়াল থেকে লাফিয়ে নামলেন শাহীনুর,বললেন,“না না, আমগো জান্নাতুল বড্ড সরল,ও জীবনে কোন সুমত্ত পুরুষের লগে কতা কয়নাই, মাইয়াডা ভয় পাইবে। আপনারা বিয়া পড়ান, যা বলার বিয়ার পর বলুক।”

আসলে শাহীনুর ভয় পাচ্ছে জান্নাতুল পাত্রের সামনে না বেঁকে বসে,তাই তার আপত্তি।

শারাফাত চৌধুরী বললেন,“আমার বড় বৌমা সাথে থাকবে!”

ছোটো ঘুপচি কক্ষের এককোণে বিছানার একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে জান্নাত, মাথায় লম্বা ঘোমটা, বুকের মধ্যে ভয়ংকর উৎকণ্ঠা,তা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটা। সে টের পাচ্ছে একজোড়া রাগী রাগী চোখ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকে দেখছে নির্নিমেষ চেয়ে। ঘরের মধ্যে সুহানাও ছিলো,বসেছে জান্নাতের পাশে, শামির চৌধুরী বসেছে জান্নাতের মুখোমুখি একটা চেয়ারে। সুহানা এবার জান্নাতের থুতনিতে হাত রেখে মিহি গলায় ডাকলো,“জান্নাত?”

_জি।

_কেউ তোমাকে জোর করেছে? জোর করে শাড়ি পরিয়েছে?

শামির একদৃষ্টে নতমস্তকের দিকে চেয়ে আছে, মুখভঙ্গি গম্ভীর তার। রাগ মিশ্রিত কান্না এসে ভিড় করে দু’চোখে জান্নাতের, সপ্তদশী মাথা নিচু করে দু’পাশে মাথা নাড়ে। বুঝিয়ে দেয় কেউ তাকে জোর করেনি।

শামিরের দিকে তাকিয়ে সুহানা বলে,“কিছু বলতে চাও?”
শামির চৌধুরী একপলক আরও একবার জান্নাতের নত মুখশ্রী দেখে শার্টের বুকপকেট থেকে চুপচাপ একটা খাম বের করে জান্নাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলে,“তোমার আশরাফি!”

লোকটার নম্র গম্ভীর স্বরও বড্ড ভারিক্কি শোনায়, জান্নাত এবারও চমকায়,বুক কাঁপে ‌। সুহানা শামিরের হাত থেকে খামটা নিয়ে জান্নাতের কম্পমান হাতের আজলায় লুকিয়ে দেয়। জান্নাত শ্বাস আটকে দেখতে থাকে সেই খাম।

বিয়ের আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছে কাল সকালেই বিদায়। শামিরের মেলা কাজ জমে আছে সদরে। আনন্দে আত্মহারা জান্নাতের মামা মামীরা। কাজীকে ডেকে নিয়ে আসতে বেরিয়ে পরলো চেয়ারম্যানের গাড়ি।
এদিকে তখন জান্নাতের ঘরে জান্নাতের হবু শাশুড়ি রিজিয়া বণিক এসেছেন। নতুন বৌমাকে দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণের মোটা চেইন পরিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের চমকে দিলেন। এবং বিয়ের আগে আগে আরেক দফা জান্নাতুল ফেরদৌসকে যেতে হলো প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্য দিয়ে।
তার শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন,“শরীর খারাপ লাগছে মা?”

কাঁদো কাঁদো স্বর জবাব দেয়,“না।”

রুহি জানতে চাইলো,“তুমি চুলে কি তেল মাখো ভাবী? এতো ঘন আর লম্বা কি করে?”

কাঁদো কাঁদো স্বর জবাব দেয়,“বাড়িতে মামী গাছের নারকেল দিয়ে তেল বানিয়ে দেয়।”
জান্নাতের হবু দাদী শাশুড়ি মায়মুনা বললেন,“সুরা আর রহমান পাঠ কইরা হুনাও।”

জান্নাত শোনালো। শেষে শামা জান্নাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জানতে চাইলো,“আচ্ছা তোমার মাথায় কি উকুন আছে?”
জান্নাত মনে হলো এইবার কেঁদেই ফেলবে,কান্না আটকে জবাব দিলো,“না।”

◻️

বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা,কাজী আসলেন। ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে চলে এসেছে লাগেজ ভর্তি করে উপহার সামগ্রী। সাজানো হবে জান্নাতকে।
চেয়ারম্যান বাড়িতে নৈশভোজের আয়োজন,শাহীন আকন্দের বাড়িতে বিয়ে পড়িয়ে আজ রাতেই তুলে দেওয়া হবে জান্নাতকে ও বাড়িতে,বাসর হবে চেয়ারম্যান বাড়িতে।

শামির চৌধুরী নিজের সাহেবী বেশভূষা পাল্টে গায়ে চাপালো বিয়ে উপলক্ষে সুহানার কিনে আনা সাদা পাঞ্জাবি। গম্ভীর মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লম্বা চওড়া শরীরে সাদা পাঞ্জাবি নতুন বরের। দেখে মা খালারা নজর উতরাতে লাগলেন ছেলের,সুরা পাঠ করে। বর বেশে তৈরি হয়ে শামির মুরব্বিদের সাথে আবারও গেলো আকন্দ বাড়িতে।

জান্নাতকে পরানো হয় একটা টকটকে লাল বেনারসী। যার ওজন বইতেও হিমশিম খাচ্ছে জান্নাতের ছোটোখাটো শরীরটা। এ পাড়া ও পাড়া থেকে সন্ধ্যার পরে তার বান্ধবীরা এসে সাজিয়ে দিতে লাগল তাকে। ফরসা হাতপায়ে আলতা পড়িয়ে দিলো,শামা দেখে নাক কুঁচকে বলেছিলো,“আলতা? কি ক্ষ্যাত! তোমরা এমন করে সাজাচ্ছো কেন ভাবীকে? দেখি আমি সাজিয়ে দিই।”

একটা স্বর্ণের মোটা চেইন,নরম হাতে দুটো মোটা মোটা বালা,কানে ঝুমকা,নাকে পড়িয়ে দেওয়া হলো একটা এক পাথরের হীরার নাকফুল। প্রতিবেশীরা হা করে রইলো এতটুকু দেখেই। শাহীনুর বেশ অহংকারী হয়ে বললেন,“আরে এইয়া তো বীনা প্রস্তুতিতে দিলো,শহরে যাওয়ার পরে জান্নাত আরো পাইবো। দেইখো তোমরা।”
আয়ত, হরিণীর মতো চোখ দুটিতে কাজল পরিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে মনে হলো এক পৃথিবীর মায়া এসে ভর করেছে চোখ দুটোতে,যাকে মায়া করার কেউ নেই। যে কেবল অন্যদের কাছে বোঝা,কারো মায়া নয়। আর যার সাথে বিয়ে হচ্ছে জান্নাতের সে কেমন মায়া করবে? আচমকাই জটিল এক প্রশ্ন এসে হানা দেয় সপ্তদশীর মস্তিষ্কে।
বিয়ে কি জান্নাত তো তা জানে,তবে বিয়ে কি আসলেই সেটা যেটা জান্নাত জানে?

পরশী আড়াল আবডাল থেকে উঁকি মেরে পাত্রপক্ষের লোকজন আর কাজীকে দেখছে,যারা বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার আপুকে ঐ লোক বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে ভাবতেই তার কেমন কেমন লাগছে,আপুকে ঐ লোক বেশি ধমকাবে নাতো?

পেছন থেকে শাহীনুর এসে ধমকায় তাকে,“ঐ ছেড়ি! আধ দামরি মাইয়া ফ্রক পইরা ঘোরতে আচো,তোরে না কইচি ভালো থিরিপিচ পইরা তোর নতুন দুলাভাই আর হ্যার ছোডো ভাইর ধারে যাইয়া গল্প করতে।”
পরশী কপাল কুঁ’চ’কে বলে,“আমি কেনো যাবো সেজে? বিয়ে কি আমার? যত্তসব। সরো তো।”
মাকে মুখ ঝামটা দিয়ে পরশী চলে যায় আপুর কাছে।
জান্নাতের ঘরে তখন সুহানা ছিল,তিনি সব মহিলাকে দেখাচ্ছিল জান্নাতের জন্য কিনে আনা “পয়নামা।” গ্রামে এটাই হয়,কনের জন্য কেনা উপহার সামগ্রী দেখতে আগ্রহী থাকে চাচী শ্রেণীর মহিলারা।
সবকিছু দেখাতে দেখাতে সুহানা জান্নাতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে,“তোমার ইনারের সাইজ কত জান্নাত? বত্রিশ না চৌত্রিশ?”

জান্নাত হতভম্ব হয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। পর পর মাথা নিচু করে বললো,“আমি জানিনা,মামী এনে দেয়।”

সুহানা অবাক হলো না, এতো টুকু মেয়ে, ঘরকুনো মেয়ে বলা চলে, মামী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত,না-ই জানতে পারে।

শাহীনুরকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বললো,“ইনার কি? জান্নাতরে তো আমি বেরা কিন্যা দিই।”

_ওটা বেরা নয়,ব্রা। এখন সাইজ বলুন।

_চৌত্রিশ।

সুহানার আন্দাজ মিলে গিয়েছে, জান্নাতের হাতে একটা বক্ষবন্ধনী ধরিয়ে দিয়ে বলল,“এটা নতুন,গায়ে যেটা আছে খুলে কষ্ট করে এটা পরে নাও।”

লজ্জায় চোখের কোণে জল জমছে মেয়েটার, সবকিছু তেতো লাগছে, ইচ্ছে করছে এক ছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে।
সবাই চলে গেলে কক্ষে থাকল জান্নাতের বান্ধবীরা, জান্নাতের কাঁচুমাচু মুখ দেখে ফুল বললো,“শরম পাইছোস? আরে ছেরী,শরমের কিচু নাই। উনি তোর জা,আর এখন এই টা পইরা নে, দরকার আছে।”

কান্না পাচ্ছে অসহ্য ভয়ে, বান্ধবীদের কথার মানে বুঝতে কষ্ট হয়নি জান্নাতের। তার শুধু গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

সুরভী জান্নাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,“এই ছেরি শোন,আইজ কিন্তু জামাইর লগে থাকতে হইবে। খবরদার রাইতে বেয়াক্কেলের মতো চিল্লাবি না।”

বলেই মুখ টিপে হাসলো সে, জান্নাত ঝাপসা চোখে ওকে দেখলো। এই সেই সুরভী যাকে নবম শ্রেনীতে থাকাকালীন কুয়েত প্রবাসী এক লোকের কাছে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাসর রাতে বরের সোহাগী কামড় খেয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলে কেলেংকারি করা সুরভী আজ বছর ঘুরতেই বাসর রাত নিয়ে জান্নাতকে অভয় দিচ্ছে। মেয়েরা সর্বোত্র নিজেদের অভিজ্ঞতা জাহির করতে পছন্দ করে,সেই অভিজ্ঞতা বাসর রাতের হলেও।
সুরভী জান্নাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে আরো অনেক কিছু বলতে থাকে,যা শুনে জান্নাতের মুখ ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়।
শেষটায় সুরভী বলতে লাগলো,“হোনলাম তোর জামাই নাকি মেজাজী । আরে ডরাইস না,মেজাজী ব্যাডারা বৌ ভালো পায় বেশি,হাঙ্গাদিন চুমাইতে থাহে।”

এবার কান চেপে ধরলো জান্নাত । তখনই তার মামা-বাবা কাজী নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
জান্নাত কবুল বলার আগমুহূর্তেও অসহায়ের মতো,ছলো ছলো চোখে নিজের জন্মদাতার মুখের দিকে চাইলো। তবে মহসিন ভান করলেন যেন তিনি মেয়ের নীরব অনুরোধ শুনতে পাননি, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ কাজী সাহেবের রেজিস্ট্রার খাতাতে, কাজী সাহেব কাবিনের অর্থের সংখ্যা বসাচ্ছিলেন, মোহরানা পাঁচ লাখ টাকা।
রাত নটা নাগাদ বিয়ে সম্পন্ন হলো,শরীয়াহ মোতাবেক জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস হয়ে গিয়েছে শামির চৌধুরী নামের এক লোকের জায়া।
আকন্দ বাড়ি থেকে চেয়ারম্যান বাড়িতে রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ জান্নাতকে নিয়ে যাওয়া হলো,রাতের ভোজনের পরে নব দম্পতিকে বসিয়ে দুধমধু রীতি পালন করা হলো, নীড়া একটা কারুকার্য খচিত আয়না এনে জান্নাতের ঘোমটার নিচে,মুখের সামনে ধরে শামির চৌধুরীকে বললো,“ভাইয়া এটা কে? আয়নায় কাকে দেখা যাচ্ছে?”

ভীত,নত হরিণীর রক্তিম মুখ দেখে সগর্বে,তৃপ্তিতে ফুলে ফেঁপে ওঠে শামির চৌধুরীর পুরুষালি অন্তর, নিখাদ গম্ভীর স্বর জবাব দেয়,“শামির চৌধুরীর স্ত্রীকে।”
হৈ হুল্লোড়, কিছুক্ষণ গানের আসর জমায় উঠতি ছেলেমেয়েদের দল। শামির ওসবে মন না দিয়ে ফোনে অফিসের হিসেব দেখে,তার পাশে চুপচাপ বসে ঝিমুচ্ছিলো জান্নাত, মাথায় লম্বা ঘোমটা।
বাসর ঘর সাজানো সম্পন্ন। সুহানা, শান্তা আর রাজীব মিলে গাঁদা, গোলাপ দিয়ে সাজিয়েছে ঘরটা।
জান্নাতকে যখন বাসর ঘরে আনা হলো তখন মেয়েটা টলছিলো সারাদিনের ধকলে, বাড়ির বড়রা সবাই শুয়ে পরেছে। ছোটোরা জেগে আছে বাসর ঘরে আড়ি পাতবে বলে।
জান্নাতকে খাটের মাঝখানটাতে বসিয়ে রেখে যাওয়ার আগে শান্তা কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,“শোন,কোনো কিছু ভালো না লাগলে ভালো করে ভাইয়াকে অনুরোধ করে বলবি, রাগ কিন্তু বেশি শামির ভাইয়ার, বোকার মতো মুখ ঝামটা দিবি না।”

জান্নাত টলছিলো,ওসব কথা শুনেও শুনছিলো না। ওকে একা ফেলে রেখে সবাই চলে যায়। চেয়ারম্যান বাড়ির এই কক্ষটা এসি নিয়ন্ত্রিত। জান্নাত কখনো ঢোকেনি এ ঘরে,আজ ঢুকলো। দামী দামী আসবাবে ঠাশা,জান্নাত নীড়ার থেকে শুনেছে তার শশুর বাড়ীটা নাকি আরও চকচকে, তার বরের কলঘর নাকি জান্নাতের ঘরের সমান। তার বরের ঘরে সারি সারি করে রাখা কম্পিউটার, ল্যাপটপ-ই দু’টো। দু’টো ফোন,একটা দেড় লক্ষ টাকা দাম।
এসব শুনেও জান্নাতের ভয় করে,এতো কিছুতে সে অভ্যস্ত নয়, সে তো অভ্যস্ত পাঠ্য বইয়ে, স্কুল ব্যাগে, পড়ার টেবিল, দড়ি লাফ আর মাঝে মাঝে মামীর সাথে বসে সিরিয়াল দেখাতে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে জান্নাতের চোখে পানি আসে, আচ্ছা সে তো গাইয়া মেয়ে, কথায় কথায় যদি ও বাড়িতে তাকে অপমান করা হয়? এমনটা জান্নাত সিনেমায় দেখেছে। ঐ লোকটা,না না ঐ লোকটা হবে না, বলতে হবে স্বামী। ঐ স্বামী লোকটা কেন বিয়ে করেছে জান্নাতকে? যার ফোনের দামই দেড় লক্ষ টাকা!
খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হয়,তন্দ্রাভাব কেটে গিয়ে জান্নাত জড়োসড়ো হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে হয় কাঠ কাঠ, মামী চাচীরা সবাই শিখিয়ে দিয়েছে বরের পা ছুঁয়ে সালাম করতে, জান্নাত বলেছিলো পা ছুঁয়ে সালাম করতে নেই। ধ’ম’ক খেয়েছে এটা বলাতে। মামী বলেছে,“সালাম করার নিয়ম নাই জানি। তুই তবুও করবি। উঠতে বসতে সালাম করবি। চাঁদের টুকরা তোর বর, এমন বরের পা ধইরা ঝুইলা থাহা উচিৎ।”

জান্নাত সালাম করবে কি করবে না ভেবে হিমশিম খাচ্ছে, ওদিকে শামির দরজা বন্ধ করে দেয়।
রাতের নিস্তব্ধতা জেকে ধরেছে পরিবেশ, গ্রামগঞ্জে রাত দশটাই মনে হয় নিশুতি রাত। ঘাড় ঘুরিয়ে শামির দেখলো বিছানার ঠিক মাঝামাঝি বসে আছে জান্নাত, নিষ্পলক কিছু মুহূর্ত দেখে শামির হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখে, ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে ওঠে।

বিরক্ত শামির,ফোনটা হাতে নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। এদিকে জান্নাত অনবরত ঢোক গিলতে থাকে,লোকটা তাকে কি করবে? সুরভীর মতো হবে নাকি তার হাল ? কিছু ভাবতে পারছে না সে, মাথা ঘোরাচ্ছে তার। ঠিক সেসময় শামিরের কর্কশ ধমকে কেঁপে ওঠে সে। ফোনে কাউকে গালাগালি দিচ্ছে শামির চৌধুরী।

“ইয়ু আর নাথিং বাট আ লেইমব্রেইন! এতো রাতে ফোন করে জানাচ্ছো! ফাইলগুলো আবার রেডি করবে নয়তো আই উইল কিক ইয়র অ্যাস, ব্লাডি অ্যাস!”

প্রত্যেকটা গালিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে জান্নাত, বিস্ফোরিত হয় নেত্রযুগল, পরক্ষনেই ভয় এসে জড়ো হয় সেখানে। লোকটা কাউকে অসংখ্য গালাগাল দিচ্ছে ইংরেজিতে। এসব গালির অনেকটার অর্থ বুঝতে পারছে না জান্নাত, তার ইংরেজিতে বেসিক খুবই ভালো, ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রে তার বরাবর আশির ঘরে থাকে নাম্বার,তবে ভোকাবুলারি অতটা ভালো নয়।

সে কাঁপছে,মন শরীর সবকিছু কাঁপছে মেয়েটার। ফোন কেটে শামির একটা লম্বা শ্বাস ফেললো, মুহুর্তেই চোখ বড় বড় হলো পরিস্থিতি অনুধাবন করে, বেডরুমে নতুন বৌকে প্রথম রাতেই নিজের আসল রূপটা দেখিয়ে দিলো, আসলে গুরুত্বপূর্ণ দু’টো ফাইল হারিয়ে যাওয়ায় এতোটা রাগ উঠলো যে মেজাজ আর মুখটাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলো না।
তবে শামির এসব পরোয়া করলো না, সারাজীবন যেটা সহ্য করতে হবে সেটা প্রথম রাতেই দেখে নেওয়া ভালো নয় কি?

ফোন কেটে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে শামির। ঘোমটার আবডালে মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শামির কি করলো, দৃঢ় হাতে ঘোমটা তুললো জান্নাতের। তুলেই খানিকটা থমকাল, এতক্ষণ যে যে গালি দিয়েছে ফোনে,এই মেয়েটা ভয় পেয়েছে শুনে, চোখ টলমল করছে মেয়েটার। শামির হঠাৎ এভাবে ঘোমটা তোলায়ও জান্নাত কেঁপে উঠলো, সারাদিনের ধকল,ক্লান্তি,ভয় আর এই লোকটাকে এতো কাছে দেখাতে উৎকণ্ঠায় জর্জরিত জান্নাত মুহুর্তেই জ্ঞান হারিয়ে টলতে টলতে পরে গেল বিছানায়।

চলমান……