জায়া ও পতি পর্ব-৩১

0
205

#জায়া_ও_পতি
#পর্ব_৩১
#ইসরাত_ইতি

পায়ের প্রকট ব্যথাটা তেমন আর নেই শামিরের এই একমাসে। তবে পায়ের গোড়ালি থেকে এমন ভাবে হাড় বেকেছে আর ভেঙেছে যে হাঁটতে গেলে যথেষ্ট হ্যাপা পোহাতে হয়। ক্র্যাচে ভর করেও খুব একটা বেশি হাঁটে না শামির। অবশ্য বেশ ক’দিন ধরে তিন বেলা নিচে নামে সিঁড়ি বেয়ে, খাবার টা খেতে। ঘরে বসে খাবার খেতে ইচ্ছে করে না তার।
শরীরের অন্যান্য ঘা শুকিয়েছে কদিন হলো, হাতের আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ খুলেছে। মোটামুটি সুস্থ সে বাকিসব দিক থেকে, তবে পায়ের দুশ্চিন্তায় ভাটা পরছে সেসব। অত তেজী আর খেপাটে লোকটা মনমরা হয়ে থাকছে বেশিরভাগ সময়।

আজ খাবার টেবিলে মাইমুনা আর শামির বসে আছে। রান্নাঘরে ছিলো জান্নাতুল। কলিজা ভুনায় লবণ কম হয়েছে তাই সামান্য লবণ ছিটিয়ে নতুন করে গরম করতে গিয়েছে সেটা। শামির হাতে পরোটা নিয়ে বসে আছে, অপেক্ষমাণ সে।

এই একমাসে জান্নাতের স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছে, যেভাবে স্বাস্থ্য ভেঙেছিল, পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের দরুণ দ্রুত তা গড়েছে। বরং আরেকটু মোটা হয়েছে, ঠিক শামিরের মনের মতো। পরোটা হাতে নিয়ে শামির আড়চোখে সেটাই লক্ষ্য করছিলো। তার ঘোর কাটে মাইমুনার রিনরিনে আওয়াজে, জান্নাত কলিজা ভুনা নিয়ে এলে ওর ভেজা চুল দেখে মাইমুনা মস্করা করে বসলেন,“কিরে তোর চুল ভিজা ক্যান?”

জান্নাত ঘোমটার নিচে তার ভেজা চুলে হাত বোলায়। সকাল বেলা বাইরের বাগানে আছাড় খেয়ে পরে গায়ে কাদামাটি লাগিয়েছিল বিধায় গোসল করেছে। নিচু স্বরে দাদী শাশুড়িকে বললো,“কাদা লেগেছিল গায়ে।”

মাইমুনার চোখ চকচক করছে, হাসতে হাসতে বলে,“আরে ঢং করিস না মা’গী। সবাইরে বুঝাও তোগো মধ্যে দ্বন্দ্ব, আসলে তোগো খাতার নিচে ভালোই পিরিত আছে তাই না রে?”

জান্নাত শামির দু’জনে দুজনের দিকে হঠাৎ দৃষ্টি দিলো। দৃষ্টিতে দৃষ্টি এভাবে মিলে যেতেই দু’জনেই চোখ নামিয়ে নিল একইসাথে। গলা খাঁকারি দিয়ে জান্নাত এগিয়ে এসে শামিরের প্লেটে কলিজা ভুনা তুলে দিতেই শামির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,“তুমি খাবে না?”

চামচ হাতে ধরে থাকা হাতটা মৃদু কাঁপল হঠাৎ। জান্নাত পিছিয়ে গিয়ে চুপচাপ মাথা নাড়ে। শামির বললো,“তো বসো?”

_পরে। আপনি খান।

শামির কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে ওপরে উঠলো, দোতলায় যাওয়ার আগে আরো দু’বার বলে গেল জান্নাতকে খাওয়ার কথা। শামির চলে যেতেই জান্নাত চুপচাপ বসলো। মাইমুনা ওর উদাসীনতা তখন থেকে লক্ষ্য করছে তার ঝাঁপসা চোখে, দুদিন ধরে বৃদ্ধা মানসিক ভাবে খানিকটা সুস্থ্য। কথাবার্তা এলোমেলো বলেন না। জান্নাতকে হঠাৎ বলে উঠলেন,“কত পুরুষ আছে খাইয়া লইয়া উইঠ্যা যায়, বৌ কি দিয়া খাইলো না খাইলো, আদৌও খাইলো কিনা, হ্যা দিয়া হ্যাগো কোনো মাথাব্যথা নাই। আমার খারাপ নাতিডা এই দিক দিয়া ভালো আছে তাই না বল?”

জান্নাত তপ্ত শ্বাস ফেললো দাদী শাশুড়ির কথায়। কাঁপা হাতে পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে অস্ফুটে বললো,“জি আপনার নাতী এই একটা দিক দিয়ে ভীষণ চমৎকার আছে।”

__________

একটা সুসংবাদ আছে। পায়ের অপারেশন করাতে সুদূর ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রয়োজন নেই শামিরের। সামনের মাসের শুরুতেই ঢাকায় আসবে সিঙ্গাপুর থেকে একজন অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞ। ওনাকে কন্ট্রাক্টে আনা হবে দেশের ত্রিশটা মেজর ও ব্যয়বহুল অপারেশনের জন্য। শেরেবাংলা হাসপাতালের অর্থপেডিক বিভাগের প্রধানের সহায়তায় সুযোগটা লুফে নিলো শামির, খরচটা তুলনা মূলক বেশি হলেও নিজের নামে বুকিং দিলো অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

সামনের মাস পর্যন্ত অপেক্ষা। ততদিনে সার্বিক সুস্থতা আর মানসিক প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিয়েছেন ডক্টর। মানসিক প্রস্তুতি শামিরের বেশ ভালোই আছে, সুস্থ তো তাকে হতেই হবে, নিজের এই দশা তার কখনোই কাম্য নয়, আর না সে চায় তার বৌটাকে হাতছাড়া,কাছ ছাড়া করতে।

ঘড়িতে সময় দেখে শামির ক্র্যাচে ভর করে উঠলো। সময় সকাল দশটা, ব্রেকফাস্ট সেরেছে দীর্ঘক্ষণ আগেই। এখন তার একটু হাঁটাচলা করার সময়। হাঁটাচলা বলতে ঐ বারান্দা আর বেলকোনি। এর বেশি আর দূরে যায়না সে। আশেপাশে জান্নাত নেই, ওকে খুজে না পেয়ে শামির মৃদু শ্বাস ফেলে। তবে দীর্ঘশ্বাসের কারণ টা স্পষ্ট নয় শামিরের কাছে। সে কি মন খারাপ করছে? নাকি কষ্ট পাচ্ছে? নাকি মেয়েটার প্রতি রাগ বাড়ছে?
ইদানিং জান্নাতকে ঘিরে নিজের অনুভূতি গুলো বড্ড অস্পষ্ট শামিরের কাছে। আগে হলে শামির এক কথায় “রাগ করতো।” ইদানিং সে বুঝতে পারে না, এই অল্প স্বল্প দূরত্বে তার এতো চিনচিনে ব্যথা হয় কেন? কেন পুরুষালি রাগ আসে না! কেন ঐ মেয়েকে একটা ঠাস করে থাপ্পড় মেরে নিজের কাছে বসিয়ে রাখতে পারে না ! শুধু গোপনে হুটহাট এভাবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! কেন?

বাইরে কোথাও থেকে শামার খিলখিল হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। কাকে যেন বলছে,“তুমি হারবে ভাবী দেখো।”

শামির ক্র্যাচে ভর করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বেলকোনিতে, তার শান্ত দু চোখের দৃষ্টি রাখে বাইরের বাগানে। ছাতিম গাছের নিচে একটা দৃশ্য দেখে সে, জান্নাত দড়ি লাফ খেলছে এই ভর সকালে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুজেছে মেয়েটা। শামা পাশে দাঁড়িয়ে গুনছে কয়টা লাফ দিলো তার মেজো ভাবী।

বেশ ফুরফুরে মেজাজ জান্নাতের, গুনে গুনে একশো পঞ্চাশটা লাফ দিয়ে থামলো। একটু বিরতি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“আরেকবার আরেকবার।”

শামিরের নির্বাক চাউনী! না রাগ আসছে না তার। শুধু একটু কপাল কুঁচকে ভাবলো, একটু বেশি বেশিই করে ফেলছে না মেয়েটা? ব্লিডিং শেষ হয়েছে পনেরো দিন হয়নি আর এখনি এতো লাফালাফি? সব বুঝি মনের আশ মেটাতে? শামিরকে দেখিয়ে মজা নিতে? সেজন্য যেটুকু আক্কেল ছিলো সব জলাঞ্জলি দিলো?

এবারো মৃদু শ্বাস ফেলে শামির। থাক, যা ইচ্ছা তাই করুক। বকবে না শামির। পরে আবার আন্দোলন করবে,“আমার দড়িলাফ খেলার স্বাধীনতা আপনি কাড়তে পারেন না। আপনি আমার স্বামী, আমার ভালোমন্দ নিয়ে ভাববেন আপনি, তবে অসুস্থ শরীরে আমি দড়িলাফ খেলবো কি খেলবো না সেটা ঠিক করার আপনি কেউ না। আমার স্বাধীনতা চাই। দড়ি লাফ খেলার স্বাধীনতা।”

তবে আজ এই বাড়াবাড়ির জন্য যদি চেগিয়ে পরে মেয়েটা, যদি একটুও উহু আহু করে শামিরের সামনে, তবে শামিরও প্রস্তুত। এমন একটা চ’ড় মারবে যে এই মেয়ে নিজের নামটাই ভুলে যাবে, নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা তো দূরে থাক! তখন শামির নতুন করে শেখাবে নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা।

হঠাৎ কল আসে শামিরের ফোনে, দৃষ্টি জোড়া স্ক্রিনে রাখতেই দেখলো সুপ্তি ভাবীর কল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাড়াহুড়ো করে সুপ্তি বললো,“শামির ভাই কি ফোন করেছিলেন আমাকে? দুঃখিত আমি পেশেন্ট দেখছিলাম।”

_না ঠিক আছে ভাবী দুঃখিত বলার কিছু হয়নি। ফোন করেছিলাম একটা কাজে, ঐ যে বলেছিলাম ম্যারেজ কনসালটেন্টের কথা? আপনি খোজ নিয়েছিলেন?

ওপাশে সুপ্তি বেশ খানিকটা সময় চুপ করেই থাকে, তারপর সামান্য হেসে কন্ঠে ভীষণ আন্তরিকতা নিয়ে শামিরকে বলে,“খোজ করিনি আসলে। তবে ভাই আমার মনে হয়না আপনাদের অমন কাউকে প্রয়োজন।”

অবাক হবার সুরে শামির বলে,“তা কেনো?”

_কারন এই নিয়ে বহুবার আমাকে আপনি তাড়া দিলেন। আপনার মধ্যে প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করছে এবার নিজের বিয়েটা টিকিয়ে রাখার জন্য । ভাই আপনি নিজেই বুঝতে পেরেছেন সমস্যা যেটা হচ্ছে সেটার সমাধানও আছে। এতটুকু যখন বুঝতে পারছেন তখন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় পক্ষ না ঢুকিয়ে দু’জন দু’জনকে সময় নিয়ে বুঝুন। পৃথিবীর কোনো ম্যারেজ কনসালটেন্টের সাধ্যি নেই আপনাদের থেকে বেশি বোঝার, একটু চেষ্টা করুন। দেখুন আমি জানি আপনি নিজের ভুল গুলো বুঝতে পারেন…..

_নেই। আমার কোনো ভুল নেই। এটাই আমি ম্যারেজ কনসালটেন্ট নিয়ে বসে ঐ মেয়েটাকে বোঝাতে চাই!

সুপ্তিকে থামিয়ে দিয়ে বাচ্চাসুলভ জেদী গলায় শামির বলে উঠলো । ওপাশে হেসে ফেললো সুপ্তি। পর পর বললো,“আচ্ছা আচ্ছা আপনার ভুল নেই। তবুও ওর সাথে মাথা ঠান্ডা করে বসে আলোচনা করুন। ভুল যখন নেই সেটা ঠান্ডা মাথায় কথার মারপ্যাঁচে ফেলে মেয়েটাকে বুঝিয়ে দেয়া উচিত তাইনা ? অযথা কেন খেপবেন বাচ্চা মেয়েটার ওপর? হিতে বিপরীত হয় না এতে? এক কাজ করুন, আজ রাতেই বসুন। কিছু সুন্দর মুহুর্ত কাটাতে কাটাতে ওর সামনে নিজেকে মেলে ধরুন। আপনি ফেইল করলে আমরা আছি। এরপর ঐ স্বেচ্ছাচারী পিচ্চি মেয়েটাকে দড়ি বেঁধে ম্যারেজ কনসালটেন্টের কাছে নিয়ে যেতে আমরা আপনাকে সাহায্য করবো। নিশ্চিত থাকুন।”

কল কেটে দেয় সুপ্তি কথাগুলো শেষ করে। শামির ফোন নিয়ে চুপচাপ চেয়ে থাকে বাগানে দাঁড়িয়ে চুলের খোঁপা বাঁধতে থাকা জান্নাতের মুখের দিকে।

সুন্দর মুহুর্ত? এই মেয়ের সাথে? শেষ কবে সুন্দর মুহুর্ত কাটিয়েছে শামির? মনেই নেই তার। সুস্থ্য হবার পরে ইদানিং কখনো রাতে চাহিদা জাগলেও ঘুরেও তাকায়না শামির। মনে পরে জান্নাতের ওকে নিয়ে ধারণা করা কথা গুলো। শামিরের চাহিদা নিয়ে কতবার খোঁচা মেরেছে। নিজেকে ছোটো মনে হয় খুব শামিরের, অথচ শামির জানে চাহিদার বাইরে শামির কত কারণে জান্নাতকে ছুতো , কত পবিত্র কারণেও। সেসব বুঝতে ব্যর্থ মেয়েটা, শামির বোঝাতে ব্যর্থ। এই যে দু’জনের বোঝাবুঝির অপারগতা,এটাই কি শুধরে নেওয়া উচিত ঠান্ডা মাথায়? কিন্তু মাথা ঠান্ডা থাকে না কেন শামিরের? তবে কি দোষ বেশি শামিরেরই?

________

রুহী-তন্ময়ের বিয়েটা দু’পক্ষের লোক যখন ধীরে ধীরে একজন দু’জন করে মেনেই নিয়েছে তখন এই বিয়েটাকে অনুষ্ঠান পাতিয়ে ধুমধাম করে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়াটাকেই সমীচিন মনে করলো দুই বাড়ির অভিভাবক শারাফাত চৌধুরী আর মোশাররফ হাওলাদার। সেদিন সন্ধ্যায় নতুন বেয়াই বাড়িতে অসুস্থ শারাফাত চৌধুরীকে দেখতে এসে চা খেতে খেতে মোশাররফ হাওলাদার নিজেই কথাটা তুলেছে। সবার মনে রুহী তন্ময়ের ওপর রাগ যা আছে,সেসব কিছুদিনের জন্য পাশে সরিয়ে রেখে এটুকু করা উচিত। দশ কথার এক কথা সমাজে টিকতে হলে হারটা মুরব্বিদের মানতেই হয় শেষমেশ, জিতে যায় প্রেমীরা। কিছুই বলা যায়না!

দুজন অভিভাবক তাদের ছেলেদের নিয়ে বসে আলোচনা করে খুব দ্রুত একটা রিসেপশনের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাড়ির লোকজন সেটি নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত। অবশ্য শামির এখনো নিমরাজি এসব নিয়ে, রুহী তন্ময়ের সাথে এ যাবত সহজ হয়নি সে। তবে শারাফাত আর রাজনের সিদ্ধান্তেও আপত্তি তোলেনি।

বিকেলে সুহানা গিয়ে শামিরের ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। ভেতরে উঁকি দিতেই শামির বলে,“এসো ভাবী। কিছু বলবে?”

মিনমিনে স্বরে সুহানা বললো,“আজ না জান্নাতের তানিয়া আপুর চেম্বারে যাওয়ার কথা? ও যাবে না? ওর মনে নেই?”

মুখভঙ্গি গম্ভীর শামিরের, বললো,“নেই হয়তো। তা থাকবে কেন? গিয়ে দেখো গড়গড় করে বলে দেবে আমি শেষ ধমকটা কখন দিয়েছি, অথচ নিজের ভালোর কথা ভুলে যায়। পই পই করে হিসেব রাখে শামির চৌধুরীর দোষ‌।”

সুহানা হেসে ভেতরে ঢুকতেই কোথাও থেকে জান্নাত ছুটে এসে রুমে ঢুকলো। বড় জা কে দেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“আজ তানিয়া আপুর কাছে যেতে হবে ভাবী।”

_হুম সেজন্যই এলাম। আর শামির ভাইয়া শোনো,আজ জান্নাতকে নিয়ে একটু বাজারে ঢুকবো। তুমি আর বাবা অসুস্থ, তোমার ভাইয়া সময় পায়না, শায়ন ছুটি পায়নি। এই মাসে বাড়ির কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হবে। ড্রাইভারকে দিয়ে এসব হয়না ভাইয়া। লিখে দিই রাঁধুনির পণ্য,নিয়ে আসে বসুন্ধরার। দোকানদার যা বুঝিয়ে দেয় আর কি। আর স্বর্ণকার পট্টিতেও তো একটু যেতে হবে, রুহীর গয়না গুলো আনবো। নিয়ে যাই জান্নাতকে?

জান্নাত মুখটা অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এক কোণে। শামির আড়চোখে ওকে একপলক দেখে সুহানাকে বললো,“যাও। এমন স্বাধীনতাই তো চায় উনি। আমি খোঁড়া মানুষ, যে নিজেই স্বাধীন ভাবে হাঁটতে পারিনা, আমি কে বাঁধা দেওয়ার?”

ভেতরে ভেতরে শ্বাস ফেলে জান্নাত। এই লোক শোধরাবেই না কখনো? অনুমতি দিলেও দু কথা শুনিয়ে নিজের বুক ঠান্ডা করে। এ কেমন শান্তি পুরুষ মনের? কি শান্তি পায় এই লোকটা এভাবে কথা শুনিয়ে?

যে শোধরাবে না বলে পণ করেছে তাকে আর বুঝিয়ে বুঝিয়ে মুখে ফ্যানা তুলে লাভ কি? জান্নাত হাল ছেড়ে দিয়েছে মনে মনে, পুরোপুরি ভাবে।

সুহানা জান্নাতকে রেডি হতে বলে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। জান্নাত একপলক শামিরকে দেখে। লোকটা গোল গোল চোখে জান্নাতকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। জান্নাত গিয়ে সুতি শাড়িটা পাল্টে একটা মেরুন রঙের মনিপুরী শাড়ি পরে নেয়। শামির বিছানায় বসে চুপচাপ দেখতে থাকে জান্নাতের সাজগোজ, কপালে সুক্ষ্ম রেখা দৃশ্যমান হয়েছে তার। এতো সাজে কেন এই মেয়ে? বাজারে কাকে দেখাবে এই সাজ? কই শামিরের সামনে তো এভাবে সেজে আসতো না কখনো!

শুধু সাজগোজ নয়, শামিরের প্রতি কোনো ধরণের আগ্রহই দেখাতো না এই মেয়ে, একটু চেষ্টাও করতো না শামিরকে মুগ্ধ করার। সে তো শামির নিজে নিজে মুগ্ধ হতো। সম্পর্কে এই মেয়ের কোনো এফোর্ট ছিলো? অথচ বড় বড় “বাতেলা” আর সবসময় “ভিক্টিম কার্ড প্লে” করার চেষ্টা করে।

“আরে তোকে জোর করেছে এই শামির চৌধুরী বিয়েতে? তোর হাত পা বেঁধে কবুল বলিয়েছে? না তো! বিয়েতে মত না থাকলে পালিয়ে যেতি কোথাও ! অসহায় হয়ে বিয়েতে মত দিয়ে এতো নাটক কেনো? অতটা কচি খুকি তো তুমি ছিলে না জান্নাতুল ফেরদৌস যে জানতে না বিয়ের পর কি কি হতে পারে তোমার সাথে! তোমাদের গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের বিবাহিত জীবন সম্পর্কে তুমি বেশ ভালোই অবগত ছিলে।”

ইদানিং একা একা,মনে মনে জান্নাতের সাথে কথা বলার রোগ ধরেছে শামিরকে। এভাবেই অনেক কথা বলে।

জান্নাত সাজগোজ কিছুই করলো না হঠাৎ কি মনে করে, লিপস্টিক লাগাতে গিয়েও লাগায়না। আয়নার ভেতরে পোটকা মাছের মতো ফুলে থাকা শামিরের মুখটা দেখে মলিন হেসে একটা স্কার্ফ বের করে নেয় জান্নাত ওয়্যারড্রব থেকে। শাড়ির ওপরে হিজাব বেঁধেছে সে। দেখতে খুবই সুন্দর আর মার্জিত লাগছে।

শামির জান্নাতের কান্ড দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, তবে মুখে কিছুই বলে না। জান্নাত পার্সটা হাতে তুলে নিয়ে নিচু স্বরে “আসছি” বলে বেরিয়ে যায়।

_______

তানিয়া জান্নাতের চেকআপ করে মিষ্টি করে হেসে বলে,“আজ একটু সুন্দর লাগছে। গায়ে রক্ত আছে মনে হচ্ছে,যেসব খাবার খেতে বলেছি খাবে তিনবেলা। আর ভালো কথা, যে কন্ট্রাসেপটিভ পিলটা সাজেস্ট করেছি ওটা খাচ্ছো তো?”

জান্নাত জবাবে মাথা নিচু করে দু’পাশে মাথা নাড়ে।

_কেন ?

_উনি অসুস্থ! প্রয়োজন নেই।

অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় জান্নাত। তানিয়া কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে জান্নাতের মুখের দিকে,পর পর বলে,“থাকতে চাচ্ছো না ওর সাথে?”

জান্নাত চমকে উঠে তাকায়। জবাব দেয় না। তানিয়া মৃদু হেসে বলে,“ওকে তোমাদের পার্সোনাল বিষয়ে কথা না বলি ‌। তবে সংসার করতে গেলে ঐ কন্ট্রাসেপটিভ পিলটা ছাড়া আর কিছু নিবে না ঠিক আছে? ওটা অনেকটা কম ক্ষতিকর। তবে ভালো হতো শামির কোনো ব্যবস্থা নিলে। কিন্তু পুরুষ মানুষ এসব ব্যাপারে বড্ড অলস হয়। এরা বুঝতে চায়না কন্ট্রাসেপটিভ পিল একটা মেয়ের জন্য কতটা ক্ষতিকর। আই উইশ শামির একটু রাগী হলেও এসব বুঝবে,ওকে একটু খুলে বলো বিষয়টা। এসব নিয়ে তো আমি কথা বলতে পারি না তাইনা? চেনা জানা না থাকলে বলতাম।”

জান্নাত চুপচাপ শুনলো তানিয়ার “দাম্পত্য এবং স্বামী স্ত্রীর যৌনজীবন” নিয়ে বিস্তর পরামর্শ মূলক আলোচনা, ছাড়া পেল আধাঘণ্টা পর। ওখান থেকে বেরিয়ে জান্নাত আর সুহানা সোজা চলে গেল স্বর্ণকার পট্টিতে। রুহীর গয়না গুলো তখনো প্রস্তুত হয়নি । ম্যানেজার বললেন আধাঘণ্টা অপেক্ষা করতে। সুহানা তখন জান্নাতকে বললো,“চলো জান্নাত, ততক্ষণে আমরা বটতলা মোড় থেকে হেঁটে আসি। ওখানে এতো ভালো পাঁপড় আর ফুসকা পাওয়া যায়। খুব মজা খেতে। চলো যাই।”

জান্নাত কেন জানি উদ্দীপনা খুঁজে পাচ্ছে না নিজের জীবনের এই হঠাৎ আসা স্বাধীনতায়। মুখটা থেকে তার মলিনতা সরেই না, চোখের সামনে শুধু অসুস্থ মানুষটার চেহারা ভাসে, যে পছন্দ করে না জান্নাতের উড়ে বেড়ানো। জান্নাত তো এই স্বাধীনতা কখনো চায়নি যে লোকটা অক্ষম হয়ে বিছানায় পরে থাকবে আর সে দুনিয়া চষে আনন্দ নেবে। জান্নাত কি চেয়েছে সেটা শুধু জান্নাত জানে,ঐ লোকটা কখনো জানবে না, জানলেও বুঝতে চাইবে না।

জায়ের সাথে গিয়ে পাঁপড় আর ফুসকা খেয়ে যখন জান্নাত গাড়ির কাছে এলো তখন হঠাৎ করে পা থামলো তার একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে জান্নাত খুব কমই পরেছে, কারণ বাইরের দুনিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ খুব কম হয়েছে শহরে এসে।
রাস্তার এক পাশে এক লোক অস্থায়ী দোকান বানিয়ে আম বিক্রি করছে। জান্নাত আর সুহানা যখন তার পাশ থেকে যাচ্ছিল তখন লোকটা হঠাৎ বলে উঠল,“আপা আম নিবেন?”

ওরা মাথা নেড়ে সামনে যখন দুকদম দিলো, হঠাৎ একপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা উঠতি বয়সী ছেলের মধ্যে থেকে একজন নিচু স্বরে খিকখিক করে বলে উঠলো,“আপাদের সাথে আম আছে। তাই তোমারটা নেবে না মামা।”

আচমকা পা থামলো জান্নাত আর সুহানার। মুখ কেমন ফ্যাকাশে হলো এই বিশ্রী অভিজ্ঞতায়। তৎক্ষণাৎ ঘুরে তাকিয়েই দেখলো সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কথাটা কোন ছেলে বলেছে সেটা বোঝার সাধ্যি নেই জান্নাত আর সুহানার। জান্নাত রক্তশূন্য মুখে তাকিয়ে রয় ফোন টিপতে থাকা ছেলেগুলোর মুখের দিকে। হঠাৎ করে শামিরের বলা সেদিন রাতের কথাটা প্রতিধ্বনিত হয় তার কানে,“বাইরে যাওয়ার খুব শখ না? একবার বাইরের দুনিয়ায় পা রেখে দেখো জান্নাতুল ফেরদৌস, বুঝতে পারবে কিসব থেকে তোমাকে সরিয়ে রেখে আগলে রেখেছি। বুঝতে পারবে তখন তোমার স্বামী তোমাকে কত বিশ্রী জিনিসের সংস্পর্শ থেকে বাঁচায়। অবশ্যই বুঝতে পারবে। বাইরের দুনিয়াটা ঠিক কিরকম,সেটা বাইরের দুনিয়ায় পা রেখেই বুঝতে পারবে তুমি।”

চলমান….