জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-০২

0
23

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব: ০২]

প্রভাতের আলোয় আলোকিত ধরণী। রজনীর আঁধারে বিলীন হয়ে যাওয়া সকল কোলাহল প্রভাতের কিরণের সাথেই জাগ্ৰত হয়ে উঠেছে ‘ফুলকুঞ্জে’। মায়ের কক্ষ দ্বারে মিনিট দশেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে তৈমূর। চোখেমুখে তার একরাশ লজ্জা, চিন্তা ও জড়তা। ভেতরে প্রবেশ করবে কি করবে না সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ভুগছে ছেলেটা। তার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ করে পেছন থেকে শোনা গেলো পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর,“একি তৈমূর! এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে তাকায় তৈমূর। দৃষ্টিগোচর হয় ভাবী জেবাকে। হাতে তার খাবারের ট্রে। আরেকটু সামনে এগিয়ে এসে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,“আম্মার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো?”

“হ্যাঁ, গতকাল তো দেখা করতে পারলাম না। এমনকি বেরোনোর সময় এতো করে ডাকার পরেও আম্মা দরজা খুললেন না। তাই….”

“তো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

প্রশ্নটির সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারলো না তৈমূর।
তার অব্যক্ত কথাটা যেনো সহজেই বুঝতে পেরে গেলো জেবা। খাবারের ট্রে টা দেবরের হাতে তুলে দিয়ে বললো,“সবেমাত্র সকাল আটটা বাজে। এখন আর দেখা করার প্রয়োজন নেই। নাস্তা সেরে তারপর এসে দেখা করে যেও।”

“আম্মা নাস্তা করবেন না?”

“আম্মার নাস্তা আপা নিয়ে গিয়েছেন আম্মার ঘরে। এতো চিন্তা করো না। আমাদের উপর রেগে থাকলেও আপার উপরে কিন্তু উনি রেগে নেই। তাই ঠিক সময় মতো উনি খেয়ে নিবেন।”

নিশ্চিন্ত হয় তৈমূর। জেবা পুনরায় শুধায়,“তা ঘুম ভেঙেছে উথমীর? রাতেও মেয়েটার খাওয়া হয়নি। কী একটা অবস্থা বলো তো? বিয়ে বাড়ির সব কাজ একা হাতে সামলাতে গিয়ে আমিও ওর খাওয়ার কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। এভাবে হয় কিছু? আম্মা না হয় রাগ করেছেন কিন্তু আপা, চাচীরা কেনো এলেন না বলো তো?নামেই সব আপনজন।”–বলতে বলতে আরো অনেক কিছুই বললো সে।

সেসব কোনো কথাই শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না তৈমূরের। প্রশ্ন করল,“কাল রাতে উথমী খায়নি? সেই যে ও বাড়ি থেকে এ বাড়িতে এলো তারপর থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি?”

“না, এতক্ষণ ধরে আমি কী বললাম তোমায়? আচ্ছা ঘরে যাও তবে। দুজনে একসাথে নাস্তা করো গিয়ে।” —-কথাটা শেষ করে স্থান ত্যাগ করল জেবা।

পুবের জানালা দিয়ে সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে বিশাল কক্ষটিতে। কোমরে ওড়না বেঁধে বাসি ঘর পরিষ্কার করতে ব্যস্ত উথমী। মাথার উপরের বিশাল ফ্যানটি বন্ধ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা খোলা চুলগুলো থেকে ঝরে পড়ছে পানি। ঘর পরিষ্কার করে ময়লাগুলো ঝুড়িতে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। মনোযোগী দৃষ্টিতে পুরো ঘরটা ভালো করে এবার পর্যবেক্ষণ করল।

দক্ষিণের বারান্দার প্রবেশ দ্বারের পাশ ঘেঁষে একটি বুকশেলফ। তাতে বিভিন্ন বইয়ের সমাহার। তার পাশেই একটি টেবিল আর চেয়ার। যার উপর ল্যাপটপসহ আরো অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা। উথমী বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বুকশেলফটির দিকে। তারপর পা বাড়ালো বারান্দার পথে। কিন্তু তার আর যাওয়া হলো না। সেখানেই থেমে যেতে হলো। ভেতরে এসে প্রবেশ করল তৈমূর। জাগ্ৰত স্ত্রীকে দেখতেই মুচকি হেসে বললো,“সুপ্রভাত মিসেস।”

প্রত্যুত্তর করল না উথমী। বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্বামী নামক ভদ্রলোকের পানে। আপাদমস্তক পরখ করে দেখতে লাগলো। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে লোকটিকে মনে হচ্ছে শরতের একগুচ্ছ কাশফুল। কপাল ছুঁইছুঁই এলোমেলো চুলে লাগছে কোনো এক স্নিগ্ধ পুরুষ। চোখের চিকন ফ্রেমের চশমাটার জন্যে মুখশ্রী জোরে ফোটে উঠেছে গাম্ভীর্য। যার মধ্যে ঠোঁটের মুচকি হাসিটা উথমীর কাছে খুবই বেমানান লাগলো। মনে হলো, লোকটি যেনো একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাসছে। তার ভাবনার মধ্যেই টেবিলের উপর খাবারের ট্রে টা রাখলো তৈমূর। মাথা তুলে তাকালো স্ত্রীর পানে। দৃষ্টিগোচর হলো মেয়েটির পলকহীন আঁখি, যা তার দিকেই নিবদ্ধ। এমন বেপরোয়া চাহনিতে অপ্রস্তুত হলো তৈমূর। হালকা কেশে মনোযোগ ঘুরানোর চেষ্টা চালিয়ে জিজ্ঞেস করল “অমন করে কী দেখছেন?”

লোকটির প্রশ্নে হতচকিত হলো উথমী। দৃষ্টি সরিয়ে শুকনো ঢোক গিললো। যথেষ্ট গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে সহজভাবে উত্তর দিলো,“আপনাকে।”

আচমকা এমন উত্তরে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো তৈমূর। অপ্রস্তুত ভঙিমা কাটিয়ে জোরপূর্বক ঠোঁটের কার্নিশে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,“তা দেখে কী মনে হলো?”

উত্তর দেওয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো উথমী। মুখশ্রী আরো গম্ভীর করে বললো,“আহামরি কিছু মনে হয়নি তবে আপনার হাসিটা অসহ্য, অসুন্দর। এভাবে আর আমার সামনে একদম হাসবেন না।”

কথাটা শেষ করে হাত ধুয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো উথমী। খাবার দেখেই ঘুমন্ত খিদেটা আবারো জেগে উঠেছে তার। বাড়িতে আজ নাস্তা হিসেবে রান্না হয়েছে ভুনা খিচুড়ি। তার সাথে ঝোল ঝোল মুরগির মাংস। খাবারটি উথমীর প্রিয়। মুরগির জায়গায় কড়কড়ে ইলিশ ভাজা হলে ব্যাপারটা হয়তো আরো জমে যেতো। এক লোকমা খাবার মুখে তুলে তৃপ্তি সহকারে চিবিয়ে গলাধঃকরণ করেই স্বামীর পানে তাকালো উথমী। লোকটিকে পূর্বের ন্যায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,“কী ব্যাপার? এখনো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? খাবার তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেতে বসুন।”

তার কথায় নড়েচড়ে উঠলো তৈমূর। নিরবে হাত ধুয়ে এসে নিজের জন্য রাখা প্লেটটি তুলে নিলো হাতে। টেবিলে চেয়ার সংখ্যা একটি হওয়ায় গিয়ে বসলো বিছানায়। স্ত্রীর বলা পূর্ববর্তী কথাটি যে ঠিক কতটা তার উপর প্রভাব ফেলতে পেরেছে তা যেনো বুঝা বড়োই দায়। এর মধ্যেই খাওয়া শেষ হলো উথমীর। অবশেষে তার পেট মহাশয় শান্ত হলো। তৈমূর চুপচাপ নিজের মতো করে খাচ্ছে। তবে সেদিকে বিশেষ পাত্তা দিলো না উথমী। গতকালের সকল লাজ লজ্জা, জড়তা রাতের আঁধারের সাথে সাথেই যেনো বিলীন হয়ে গেলো তার মধ্য হতে। বুকশেলফের দিকে তাকিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আপনি কী খুব বইপ্রেমী মানুষ মিস্টার?”

বিপরীত পাশ হতে তার প্রশ্নের কোনো উত্তর এলো না। তাতেও যেনো উথমীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। ব্যঙ্গ করে বললো,“আমার আবার বই পড়তে একদম ভালো লাগে না। বই দেখলেই মনটা ছটফট করে। খুব ঘুম পায়। মানুষ কীভাবে যে এতো বই পড়ে কে জানে? তা আপনার চোখের এই দুরাবস্থা কী এ কারণেই হয়েছে মিস্টার বিন?”

শেষাংশ কথাটি শুনে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৈমূর। হাত ধুয়ে টেবিলে রাখা ট্রেয়ের উপর গুছিয়ে রাখলো এঁটো প্লেটটি। তারপর ফাঁকা চেয়ারটি টেনে বসে পড়ল তাতে। মুখশ্রী তার পূর্বের ন্যায় অত্যন্ত গম্ভীর হলেও বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই সে বিপরীতে বলে উঠলো,“তৈমূর। আমার নাম ইয়ামুর হাসান তৈমূর। দয়া করে কোনো আজেবাজে নামে ডাকবেন না।”

ভ্রু কুঁচকে স্বামীর পানে তাকায় উথমী। সন্দেহ নিয়ে শুধায়,“মিস্টার বিন নামটা কী আপনার কাছে আজেবাজে নাম বলে মনে হয়?”

“উহুম তা মনে হবে কেনো? তবে আমার নাম তো আর মিস্টার বিন নয়।”

“তাও অবশ্য ঠিক, তৈ মূ র সা হে ব।”—-নামটা একটু টেনেই উচ্চারণ করল উথমী।

মেয়েটির এমন আচরণে মুচকি হাসলো তৈমূর।
বললো,“বই পড়তে ভালো লাগে না। কাউকে পড়তে দেখলেও ভালো লাগে না তাহলে শিক্ষক হলেন কীভাবে? কেই বা আপনাকে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ চাকরি দিয়ে দিলো, বলুন তো?”

কপালে ভাঁজ পড়ল উথমীর। চোখমুখ কুঁচকে বললো,
“অবশ্যই নিজের যোগ্যতায় পেয়েছি। আপনার কী মনে হয়? উপরমহলে বসে থাকা মানুষরা আমার শ্বশুর হয় যে এমনি এমনি আমায় শিক্ষা ক্যাডার বানিয়ে দিবে?”

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায় তৈমূর। মুহূর্তেই হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা মলিন হয়ে যায় উথমীর। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। পূর্ণ এবং গাঢ় দৃষ্টি স্থির করে তাকায় সামনে বসা শ্যামবর্ণের পুরুষটির পানে। ভেতরে ভেতরে কথাগুলো গুছিয়ে নিতে একটু সময় নেয়। তারপর সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে,“আপনার মা গতকাল থেকে ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। আমায় নাকি উনার একদম পছন্দ নয়। এমনকি আপনার বড়ো বোনেরও আপনার মায়ের মতো একই অবস্থা। তাহলে এই বিয়েটা কেনো হলো তৈমূর সাহেব? বিয়ের আগেই বা আমাদের কেনো জানাননি এসব? আপনার কী মনে হয় না আপনি এবং আপনারা আমায় ঠকিয়েছেন? আমি কিন্তু প্রথমেই বিয়েটা করতে চাইনি তৈমূর সাহেব। তা তো আমি আপনাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারপরেও এতো কাহিনী কেনো?”

সোজা হয়ে মুখোমুখি বসলো তৈমূর। ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তার মুখশ্রী। শীতল কণ্ঠে উত্তর দিলো,“ভালো লেগেছে তাই।”

“ভালো লেগেছে?”

“হ্যাঁ, সংসার তো আপনি আমার সাথে করবেন তাহলে কে মেনে নিলো? কে পছন্দ করল?কে অপছন্দ করল? তাতে আপনার কী? আমি তো আপনাকে খুব পছন্দ করি।”

“আপনার মা-বোন আমায় অপছন্দ করেন। আপনার বড়ো বোনের আচরণ তো গতকাল সবার সামনেই দেখলাম। আর আপনার মা যে ভবিষ্যতে এ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করবেন না তার কোনো গ্যারান্টি আছে আপনার কাছে?”

নিঃশ্চুপ তৈমূর। তৎক্ষণাৎ উত্তর দেওয়ার মতো সহজ কিছু খুঁজে পেলো না। তার নিরবতায় সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উথমী। ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে,“কোনো উত্তর নেই, তাই না? আসলে বিয়েটা আপনার কাছে ছেলেখেলা। ভাই-ভাবী জোর করল তাই মেয়ে দেখতে চলে গেলেন। মেয়ে সুন্দর, মেয়ের রূপ আছে আর সেই রূপের মোহে পড়েই কোনো কিছু বিবেচনা না করে বিপরীত মানুষটির মতামতের তোয়াক্কা না করেই বিয়ে করে নিলেন? হাহ্ পুরুষ মানুষ! এ মোহ যখন কেটে যাবে তখন ছেড়ে দিতেও এরা দুবার ভাববে না।”

কথাটা বলতে বলতেই ঘোলাটে হয়ে এলো উথমীর দৃষ্টি। গভীর কোনো কিছু ভাবতেই মুচড়ে উঠলো বুক। স্ত্রীর এহেন কথাটা যেনো মস্তিষ্ক জুড়ে আঘাত হানলো তৈমূরের। শীতল কণ্ঠে বললো,“বিয়ে হচ্ছে দুই ধরণের। এক. অ্যারেঞ্জ আর দুই. লাভ। একে অপরের মধ্যে চেনা, জানা, বোঝাপড়ার পর হয় প্রণয় আর তারপর তা রূপ নেয় বিয়েতে। যাকে বলে লাভ ম্যারেজ। আর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হচ্ছে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে বিয়ের আগে দেখা হয় রূপ আর যোগ্যতা। ছেলেপক্ষ দেখে মেয়ের রূপ, মেয়ের স্বভাব, গুণাবলী, চরিত্র ইত্যাদি। কনেপক্ষ দেখে ছেলের যোগ্যতা, চাকরি, স্যালারি। আপনার পরিবার, আপনার বাবা, ভাই ঠিক তাই করেছেন। সবকিছু বিবেচনা করেই উনারা আমার হাতে আপনাকে তুলে দিয়েছেন। তার বিনিময়ে আমি তাদের কথা দিয়েছি আপনাকে সুখে রাখার, সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করার। কথা যখন দিয়েছি সেহেতু কথা আমি রাখবোই। তবে আপনার রূপ দেখেই যে আমি সবাইকে তোয়াক্কা করে আপনাকে বিয়ে করেছি এটা সত্য নয় উথমী।”

“তাহলে সত্যটা কী?”

“আপনি একজন বোঝদার, পরিপক্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক নারী। বিয়ে করার জন্য এর থেকে বড়ো কোনো কারণ ছিলো না।”

লোকটির কথায় অবাক হয় উথমী। দৃষ্টিতে জমা হয় তীব্র সন্দেহ। তার এহেন দৃষ্টিতে ভেতরে ভেতরে হতাশ হয় তৈমূর। বাহ্যিকভাবে নিজের গম্ভীরতা বজায় রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলে,“পৃথিবীর প্রতিটি সম্পর্কেই কিছু না কিছু জটিলতা রয়েছে। তবে সবচেয়ে জটিলতার সম্পর্ক কী জানেন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। বিয়ের আগে চুটিয়ে প্রেম করা সহজ কিন্তু সংসার করা খুব কঠিন। প্রেমিক/ প্রেমিকা হওয়া সহজ, হাত ধরাধরি করে অলিগলি পার্কে ঘুরে বাদাম খাওয়া সহজ কিন্তু স্বামী-স্ত্রী হয়ে একে অপরের ভরসার স্থানে গিয়ে পুরো জীবনটা পার করে দেওয়া কঠিন। যোজন যোজন দূরত্বে থেকে মুঠোফোনে প্রেমময় কয়েকটা বাক্য বলা সহজ কিন্তু একই ছাদের নিচে একই বিছানায় থেকে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেওয়া কঠিন। আর এই কঠিন কাজগুলো করা সবার পক্ষে সম্ভব নয় উথমী। এর জন্য প্রয়োজন হয় ধৈর্যের। লাগে সহ্য করার ক্ষমতা। একটা মানুষের চোখে কিন্তু দীর্ঘদিন ভালো থাকা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের মন, চাহিদার বদল হয়। তাই এসবকিছু মোকাবেলা করার জন্য জীবনে একজন বোঝদার সঙ্গীনির প্রয়োজন হয়। ওই আধ ঘণ্টার কথোপকথনে আমার আপনাকে সঠিক বলেই মনে হয়েছে তাই বিয়ে করে নিয়েছি। এতে অন্যায় কিছু তো দেখছি না। তবে আপনাকে একটা সিক্রেট বলবো উথমী?”

“কী সিক্রেট?”

“মানুষের চোখ, কথাবলার ভঙ্গি দেখেই আমি তাদের ভেতরটা চিনতে পারি। যা আমার আম্মাজান পারেন না। খুব অল্প বয়সে আমার আম্মার বিয়ে হয়েছিল আমার বাবার সাথে। নিজেকে বুঝার আগেই সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে উনাকে। দুনিয়া চেনার বয়সে চিনতে হয়েছে সংসারের মানুষদের। জানতে হয়েছে তাদের পছন্দ অপছন্দকে। এদিকে বছর চারেক আগে বাবার মৃত্যু। যে শোকটাও হয়তো এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। চোখের সামনে জীবনসঙ্গী হারানোর কষ্ট যে খুব মারাত্মক উথমী। তার উপর পারিবারিক আরো জটিলতা তো রয়েছেই। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?”

বিপরীতে উপরনিচ মাথা নাড়ায় উথমী। কিছুক্ষণ আগের সেই কাটকাট জবাব দেওয়া কণ্ঠস্বর রোধ হয়। নরম হয় হৃদয়। মুখশ্রীতে স্পষ্ট হয় প্রবল অপরাধবোধ। যা চোখের আড়াল হয় না তৈমূরের। পুনরায় বলে, “আপনি একজন মানুষ। আর একজন মানুষ কখনোই সকলের পছন্দের তালিকায় থাকতে পারে না। পৃথিবীতে এমন অনেকে থাকবে যারা আপনাকে অপছন্দ করবে, অহেতুক ঘৃণা করবে। আবার এমন অনেকে থাকবে যারা আপনাকে কারণে অকারণে পছন্দ করবে, ভালোবাসবে। তাই কখনো কারো কথা মনে নিয়ে কষ্ট পাবেন না। আমার পরিবারের কথায় তো একদমই নয়। আমি চাই না আমি ব্যতীত কারো কথায় আপনি গুরুত্ব দিন। আর একটা অনুরোধ, আমার মাকে কখনো অসম্মান করবেন না উথমী। নিজের মা ভাবতে না পারলেও সে আপনার জীবনসঙ্গীর জন্মদাত্রী মা। এতটুকু কারণে তো সম্মান করাই যায়, তাই না?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় উথমী। কণ্ঠস্বর আরেকটু খাদে নামিয়ে তৈমূর বলে,“আপনি বোঝদার, শিক্ষিত নারী। আপনার কাছে এতটুকু আশা কী আমি করতে পারি না?”

উথমী খেয়াল করল লোকটির কথা খুবই গোছালো এবং সাবলীল। যা তার ওই পাষণ্ড হৃদয়ে সৃষ্টি করেছে দুর্বলতা। তলিয়ে দিয়েছে ঘোরের এক অতল গহ্বরে।প্রশ্নের বিপরীতে সে ছোট্ট করে জবাব দিলো,“হু।”

স্ত্রীর মুখ থেকে নিঃসৃত এই একটি শব্দেই তৈমূরের অধরে ফোটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। কক্ষ ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো,“বসুন আপনি। আমি গিয়ে আপনার কাছে কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
____________

বিছানায় আধশোয়া হয়ে পান চিবোচ্ছেন শাহানা।উনার পাশেই বসে আছে বড়ো কন্যা তিথিয়া। নিজের মতো করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা। শাহানা চুপচাপ মনোযোগ সহকারে শুনছেন সেকথা। কিন্তু হঠাৎ করেই উনার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। সাথে থেমে যায় তিথিয়ার কণ্ঠনালী। দরজায় টোকা পড়ে। বাহির থেকে ভেসে আসে পুরুষালি কণ্ঠস্বর,“আম্মা! ভেতরে আসবো?”

ছোটো পুত্রের কণ্ঠস্বর পেতেই নড়েচড়ে ওঠেন শাহানা। চোখেমুখে ছাপিয়ে ওঠে অভিমান। চুপচাপ ঠাঁয় বসে থাকেন নিজ স্থানে। মায়ের থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে তিথিয়া অনুমতি দিয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠে,“হুম আয়।”

বড়ো বোনের অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। মাকে সালাম দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। শাহানা তাকালেন না পুত্রের পানে। মনে মনে সালামের জবাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলেন। মায়ের পানে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো তৈমূর। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস। কিছুক্ষণ নিরব থেকে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“আমার উপর রেগে আছেন আম্মা?”

এবারো মুখ দিয়ে টু শব্দটি করলেন না শাহানা। মায়ের নিরবতায় বরাবরের মতোই হতাশ হলো তৈমূর। শীতল কণ্ঠে বললো,“রাগ করার কারণ কী এই বিয়েটা? কিন্তু আম্মা, আপনিই তো চেয়েছিলেন আমি যাতে বিয়ে করে সংসার করি। আপনার জন্য বউমা নিয়ে আসি। তাহলে এখন আপনিই কেনো এমন করছেন? কেনো একবারও নিচে নামলেন না? জানেন আম্মা, ওদিকে এই ব্যাপারটা নিয়ে সবাই কত কথা বলছে?”

মৌন ব্রত ভঙ্গ করে এবার কথা বললেন শাহানা,“যে মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিস তাকে আমি এ বাড়ির বউ হিসেবে মানি না। শুরুতেই আমি এ সম্বন্ধে না করে দিয়েছিলাম। তারপরেও তুই আমাকে অমান্য করে সেই মেয়েকেই বিয়ে করে আনলি?”

“অপছন্দ হওয়ার কারণ কী? সম্বন্ধটা ভাই-ভাবী এনেছে তাই?”

“মায়ের কাছে কৈফিয়ত চাইছিস?”

“কৈফিয়ত চাইবো কেনো? আপনি অযথাই…”

হাত উঁচিয়ে পুত্রকে থামিয়ে দিলেন শাহানা। রূষ্ট কণ্ঠে বললেন,“আমায় বুঝিয়ে লাভ নেই তৈমূ। আমি যখন একবার না বলেছি সেটা আর কখনোই হ্যাঁ তে রূপান্তরিত হবে না। আসলে তোরা দুই ভাই একরকম। তোদের কাছে মায়ের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দামই নেই। তোর বড়ো ভাই কয়েক বছর আগে যেই কাজটা করেছে তুইও আজ সেই কাজটাই করলি। আমার অবাধ্য হলি।”

“ভুল বুঝছেন আম্মা। এতোগুলো বছরে না ভাইয়া কখনো আপনার অবাধ্য হয়েছে আর না আমি কখনো আপনার অবাধ্য হয়েছি। বরং আপনিই চিরকাল আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন আমাদের উপর। ভাইয়া ভাবীকে ভালোবাসতো। তা আপনাকে জানানোর পরেও আপনি অযৌক্তিক একটা কারণে বিয়েতে অমত করেছিলেন। একবারও ভাইয়ার কথা ভাবেননি। নেহাৎ বাবা ছিলেন বলে তখন ভাইয়া ভাবী এক হতে পেরেছে। তারপরের কথাগুলো আর নাই বলি। আমার বেলায় অন্তত এমন করবেন না আম্মা। আমি ভাইয়ার মতো স্বার্থপর হয়ে বাড়ি ত্যাগ করতে পারবো না।”

পুত্রের কথাটুকু শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন শাহানা। তিথিয়া রাগত স্বরে বলে উঠলো, “দেখলেন আম্মা দেখলেন? বিয়ের এক রাত পেরোতে না পেরোতেই ও আপনার মুখে মুখে তর্ক করছে? বললাম না আপনাকে? নতুন আরেকটা কাল নাগিনী এসেছে বাড়িতে। ওই মেয়েই ওর কান ভাঙিয়েছে।”

“দেখো বুবু, একদম বাজে কথা বলবে না। তুমি আমাদের বড়ো বোন। তোমার উচিত ছিলো আম্মাকে বুঝিয়ে সব ঠিক করা কিন্তু তা না করে তুমিই এসব আজেবাজে কথা বলছো?”—-কঠোর স্বরে কথাটা বলে উঠলো তৈমূর।

ভাইয়ের এমন আচরণে চমকায় তিথিয়া। ধমকের সুরে বলে,“আমি আজেবাজে কথা বলছি? আমি? তোর এতোটা অধঃপতন হয়ে গেছে যে তুই আমার মুখের উপর কথা বলছিস?”

“আমি তো বলতে চাইনি বরং তুমিই বাধ্য করছো। দয়া করে আমার আর আম্মার কথার মাঝখানে একদম আসবে না।”

বিপরীতে কড়া কিছু বলতে চাইলো তিথিয়া কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলেন শাহানা। রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে মায়ের উদ্দেশ্যে পুনরায় তৈমূর জিজ্ঞেস করল,“সত্যিই আপনি নিচে যাবেন না? পুত্রবধূর মুখ দেখবেন না?”

“না।”

“তাহলে আর কিই বা করার আছে আমার? আপনার কাছে আপনার ছেলের থেকে যদি আপনার জেদটাই বড়ো মনে হয় তাহলে আপনাকে আর আসতে হবে না নিচে। বসে থাকুন ঘরে। আমি না হয় সবার দৃষ্টিতে ছোটোই হলাম তাতে আপনার কী?”—কথাগুলো বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তৈমূর। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেলো মায়ের ঘর থেকে।

এদিকে হতবাক, হতভম্ব হয়ে পুত্রের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন শাহানা।

চলবে ______

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)