জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৮+৯

0
21

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৮]

পুরোনো একটি দিনের সমাপ্তি ঘটে সূচনা ঘটলো নতুন আরেকটি দিনের। ফজরের নামাজ শেষে আজ অনেক দিন পর কোরআন পাঠ করল উথমী। ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরে টেনে নিলো নিঃশ্বাস। কয়েক মুহূর্তে ভেতরের সকল সংশয়, দুঃখ, কষ্ট মিলিয়ে গিয়ে বুকের ভেতরে ঠাঁয় পেলো এক ছটা প্রশান্তির।

বাড়ির সকলে এতক্ষণে জেগে উঠেছে। নিচ থেকে ভেসে আসছে হাঁড়ি পাতিলের টুং টাং শব্দ। কান পেতে সেসব শুনলো উথমী। ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ডায়ে বায়ে না তাকিয়ে প্রবেশ করল রন্ধনশালায়। চুলার পাশে সারি সারি কয়েকটা চায়ের কাপ সাজানো। চামচের সাহায্যে মেপে ঝেঁপে একেকটায় চিনি দিচ্ছে জেবা। উথমী এসে তার পাশে দাঁড়ালো। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো,“শুভ সকাল।”

আচমকা কথাটা শুনে কিঞ্চিৎ চমকালো জেবা। চামচ নাড়ানো থামিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করল, “শুভ সকাল।”

মুচকি হাসলো উথমী। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো সকলের কর্মকাণ্ড।পিঁড়িতে বসে বঁটির সাহায্যে আলু কাটছেন মালতী ফুফু। রুটি বানানোর জন্য সিঙ্কের উপর একটি বাটিতে আটার ডো তৈরি করে রাখা। জেবা আড়চোখে তার মুখভঙ্গি পরখ করে নিয়ে শুধালো,“তৈমূর ফিরেছে?”

“না।”

“তাহলে সকাল সকাল রান্নাঘরে যে? খিদে পেয়েছে? কিন্তু নাস্তা তৈরি হতে তো বেশ কিছুটা সময় লাগবে। চা দিচ্ছি বিস্কুট দিয়ে খেয়ে পেটকে একটু সান্ত্বনা দাও।”

“খিদে পায়নি। ঘরে একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছিল না তাই চলে এসেছি।”

“ওহ, তা সব ঠিকঠাক আছে?”

প্রশ্নটা বুঝলো না উথমী। যার ধারা মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো স্পষ্টভাবে। জেবা তা দেখলো না। তার দৃষ্টি এখন চায়ের পাতিলে। উত্তর না পেয়ে পুনরায় শুধালো, “কী হলো?”

“হ্যাঁ ঠিক আছে।”

“ঠিক থাকলেই ভালো। আর ঠিক না থাকলে নিজ দায়িত্বে সব ঠিক করে নিবে বুঝেছো?”

“কোন ব্যাপারে বলছেন ভাবী?”

কপালে ভাঁজ পড়ল জেবার। পিছু ফিরে ফের তাকালো জায়ের পানে। জিজ্ঞেস করল,“এতক্ষণ না বুঝে উত্তর দিয়েছো?”

“হু।”

“তোমার আর তৈমূরের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা সেটাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“ওহ।”

“নাও এদিকে এসো দেখি। কিছু কাজকর্ম শিখাই তোমায়।”—-বলে মুচকি হাসলো সে।

উথমী এগিয়ে এসে আবারো পাশে দাঁড়ালো। বাড়ির কে কয় চামচ চিনি খায় চায়ে সবটা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,“মনে থাকবে?”

“হুম থাকবে।”

“গুড, আমি এ বাড়ির বউ হয়ে আসার পরেরদিনই কিন্তু আমার শাশুড়ি আর ননদ মিলে আমায় এই হেঁশেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। রান্নাবান্না আমি বিয়ের আগেই থেকেই পারতাম। মায়ের থেকে শিখেছি। কিন্তু এই চা বানাতে গিয়েই পড়েছিলাম ফ্যাসাদে। কেউ চায়ে চিনি বেশি খায় তো আবার কেউ চিনিই খায় না। আবার কারো দুধ চা ছাড়া চলেই না। কেউ বা রঙ চায়ে অভ্যস্ত।কাকে কী জিজ্ঞেস করবো তখন অতকিছু আর মাথায় ছিলো না। তো শেষমেশ নিজের মতো করেই চা বানিয়ে খাওয়ালাম সকলকে। সকলেই ছোটো খাটো ভুলগুলো কে শুধরে দিলো কিন্তু আমার শাশুড়ি ননদ তা না করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেদিন আমায় চরম অপমান করলেন। এমনকি সকলের সামনে এও বলে দিলেন, মা কী কাজের কাজ কিছু শিখিয়ে পাঠায়নি? শুধু প্রেম করতেই শিখিয়েছিল? কি লজ্জাজনক কথা! ভাবতে পারছো? তোমার ভাসুরও সেদিন চুপ ছিলো। কোনো প্রতিবাদ করেনি। শুধুমাত্র শ্বশুর মশাইয়ের কারণে রক্ষা পেয়েছিলাম।তবে তোমার ভাগ্যটা ভালো। আমার মতো জা পেয়েছো বলেই তোমাকে এমন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। নিজে খারাপ সময় পার করে এসেছি তাই অন্য কেউও আমার মতো এমন পরিস্থিতিতে পড়ুক তা আমি চাইনি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উথমী। মৃদু হেসে বলে,“আপনি সত্যিই খুব ভালো। ভালো মানুষদের চোখ দেখলেই চেনা যায়। কিন্তু আফসোস আপনার শাশুড়ি আর ননদ আপনায় বুঝলো না।”

“আপনার শাশুড়ি ননদ আবার কী? আমাদের শাশুড়ি, ননদ বলো মেয়ে। আর হ্যাঁ সুন্দর করে আম্মা আর আপা বলে সম্বোধন করবে, ঠিক আছে?”

“হুম ঠিক আছে ভাবী।”

প্রত্যুত্তরে শব্দহীন হাসে জেবা। গল্পের তালে তালে রান্নার কাজে হাত চালায়।

বেলা বাড়তেই সূর্য পুব আকাশে নিজের তেজ নিয়ে প্রকোপ হলো। তার সাথে সাথে ‘ফুলকুঞ্জের’ সদস্যরাও এসে খাবার টেবিলে উপস্থিত হলো। বশির উদ্দিন সকালের নাস্তা বাড়িতে করেন না। বাজার থেকেই করে আসেন। তাই আজ মঈনুদ্দিনও ভাইয়ের সঙ্গ দিয়েছেন। সকাল সকাল তার সাথে চলে গিয়েছেন বাজারের পথে। তিথিয়া ছেলে-মেয়েদের আগে-ভাগে খাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে স্বামীকে নিয়ে খেতে বসেছে। খাবার পরিবেশনে জেবার হাতে হাতে সাহায্য করছে উথমী। সেসব কর্মকাণ্ড আড়চোখে দেখে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন শাহানা। তুরাগ খেতে খেতে মায়ের পানে বারবার তাকাচ্ছে। কিছু বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে মন। বিয়ের পর থেকে মায়ের সাথে কথা বলতে গেলেই তার ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি হয়। কে জানে কখন না আবার কটু কথা বলে দেন মা?

মুখের খাবার শেষ করে পানি পান করল তুরাগ। গলা ঝেড়ে বললো,“আমরা আজ চলে যাবো আম্মা।ভাবছি দুপুরের পরপরই রওনা দিবো।”

খেতে খেতেই গম্ভীর দৃষ্টিতে বড়ো পুত্রের পানে তাকান শাহানা। তবে বিনিময় করেন না কোনো বাক্য। তৈমূর শুধায়,“এতো তাড়াতাড়ি? তুমি না বললে আরো সপ্তাহ খানেক ছুটি আছে?”

“তা তো আছেই কিন্তু ওদিকে জোহানের স্কুল থেকে টার্ম পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। এই সময় বেশিদিন লেখাপড়া থেকে দূরে থাকলে চলবে? তাই আজই ফিরে যাবো। কাল থেকে আবার টিউটর ওকে পড়াতে আসবেন।”

“ওহ।”

“তা তোর ছুটি কবে শেষ?”

“সপ্তাহ খানেক পর তবে কাল থেকেই ভাবছি আবার নিয়মিত হবো।”

”কাল থেকে?”

“হ্যাঁ, অযথা বাড়িতে বসে থেকে লাভ কী? তার উপর ভাগের কাজগুলো জমে আছে। তাই আর ছুটি কাটাতে চাচ্ছি না।”

ছোটো ভাইয়ের কথার বিপরীতে মাথা নাড়ায় তুরাগ। কথার ফাঁকেই উথমীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,“তোমার ছুটি কবে শেষ উথমী?”

সবে ভাসুরের প্লেটে আরেকটা রুটি দিচ্ছিল উথমী। আচমকা প্রশ্নে কিছুটা হতচকিত হলো। কৃত্রিম হেসে প্রত্যুত্তরে বললো,“পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছিলাম। সবে সপ্তাহ পেরোলো।”

“তাহলে তো এখনো অনেকদিনের ছুটি বাকি! বেশ ভালো।”

করবীও এখানেই উপস্থিত আছেন। সকলের সাথে বসে নাস্তা করছেন। পাশাপাশি চুপচাপ শুনছেন তাদের কথা। এবার তিনি মুখ খুললেন। আগ্ৰহ নিয়ে শুধালেন,“কীসের ছুটি? তুমি কী চাকরি করো নাকি?”

প্রশ্নটির বিপরীতে উথমীর উত্তরের অপেক্ষা কেউ করল না। জেবা নিজেই বলে উঠলো,“হ্যাঁ, আমাদের নতুন বউ বড়ো চাকরি করে। সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক সে।”

কথাটা শুনে বেশ খুশি হলেন করবী। যা উনার মুখশ্রীতে সুস্পষ্টভাবে ফোটে উঠলো। তবে এই একই কথা শ্রবণাতীত হতেই বজ্রাসনের ন্যায় মায়ের পানে তাকায় তিথিয়া। শাহানাও তাকান মেয়ের পানে। দৃষ্টি দিয়েই মা- মেয়ের মধ্যে কথার আদান প্রদান হয়। পরক্ষণেই সবার মাঝখানে বিদ্রুপের সুরে তিথিয়া বলে ওঠে,“চাকরি করা মেয়ে? তা বউ চাকরি করবে নাকি সংসার?”

মেয়ের কথায় সায় দিয়ে এবার শাহানাও বললেন, “চাকরি আর সংসার কখনো একসঙ্গে হয় না। তাছাড়া এ বাড়ির বউয়েরা বাড়ির বাইরে গিয়ে কখনো ওসব চাকরি বাকরি করে না।”

হঠাৎ এমন আক্রমণাত্মক কথায় ভড়কে যায় উথমী। মা-বোনের এমন আচরণে তৈমূর আর তুরাগও ভারি অবাক হয়। করবীর মুখশ্রী স্বাভাবিক। জায়ের কথার বিপরীতে বলেন,“চাকরি করতে যোগ্যতা লাগে। যা এ বাড়ির বউয়েদের ছিলো না। তাই বলে যে অন্য কেউও করতে পারবে না এমন নিয়ম তো কখনো শুনিনি মেজো বুবু।”

কথাটা শুনতেই মেজাজটা চরম খারাপ হলো শাহানার। ছোটো জাকে উনি বরাবরই অপছন্দ করেন।ভদ্রমহিলা মন মানসিকতা, আচার-ব্যবহারের দিক থেকে যেনো একটু বেশিই এগিয়ে গিয়েছেন। শাহানার মতে, এসব মেয়ে মানুষ একদম সুবিধার নয়। এসব নারীর জন্যই অন্য নারীদের ঘর ভাঙে। যদিও উনার এই ধারণা সম্পর্কে একমাত্র তিথিয়াই অবগত। তাই মা রেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে বলে উঠলো,“যাই বলুন না কেনো ছোটো চাচী। একসঙ্গে কখনো দুটো কাজ হয় না। একটা সংসার সামলানোর জন্য কী কম ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়? এর মধ্যে ও চাকরি করবে কখন আর সংসারই বা করবে কখন? কই আমি তো চাকরি করি না। বরং এতোগুলো বছর ধরে মন দিয়ে সংসার করে যাচ্ছি। তাতে কী মহাদেশ অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে?”

ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন করবী। সঙ্গে সঙ্গেই খোঁচা মেরে বলে উঠলেন,“চাকরি তাও আবার তুই? মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই তো তোর মা তোকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। কত করে নিষেধ করলাম তোর মাকে, কিন্তু কী করল? সেই সৌন্দর্যের দোহাই দিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলো? শেষমেশ পরীক্ষাটা তো আর দিতে পারলিই না বরং তার আগেই পোয়াতি হয়ে বসে রইলি। শোন তিথি, ওই নাইন পাস লেখাপড়ায় ভালো চাকরি বাকরি করা সম্ভব নয়। আর সংসার? সারাক্ষণ তো তুই বাপের বাড়িতেই পড়ে থাকিস। সংসার আবার কখন করিস রে?”

কথাগুলো বোমার ন্যায় বিস্ফোরিত হলো খাবার টেবিলে। হতভম্ব হয়ে গেলেন শাহানা। রাগে ফুঁসছে তিথিয়া। কড়া কোনো উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তৈমূর বলে উঠলো,“আহা! এই সামান্য বিষয়ে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটির প্রয়োজন আছে? খাও তো চুপচাপ।”

সবাই তার কথায় থামলেও শাহানা থামলেন না। ছেলের উদ্দেশ্যে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন,“শোন তৈমূ, আমি সাফ সাফ তোকে বলে দিচ্ছি। এ বাড়ির বউ হয়ে থাকতে হলে চাকরি করা যাবে না। অমতে গিয়ে বিয়ে করেছিস বলে যে তোদের সবকিছুই আমি মেনে নিবো এমনটা হবে না।”

“এখন এসব থাক। ব্যাপারটা নিয়ে না হয় পরে ঠান্ডা মাথায় কথা হবে আম্মা।”

“এখনি যখন উঠেছে তাই এখনি আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। এরপর এ নিয়ে আর কোনো কথাই হবে না। আমার কথাই শেষ কথা।”

জেবা আর তুরাগ থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহানার পানে। কিছু বলার জন্য সাহস পাচ্ছে না। উথমী এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনলো। তবে এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না। বললো,“চাকরি হাতের মোয়া নয় যে যখন ইচ্ছে গিয়ে করলাম আবার অন্যের কথায় তা ছেড়ে দিলাম। আমি যে চাকুরিজীবী মেয়ে তা জেনেই আমাকে বিয়ে করে এ বাড়িতে আনা হয়েছে। তাছাড়া বিয়ের পর যে চাকরি ছাড়তে হবে এমন কোনো কথাও তো হয়নি। হলে অবশ্য কোনোভাবেই এ বিয়ে আমি করতাম না। তাই আমার উপরে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার একদম চেষ্টা করবেন না। আমার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত আমি নিবো। অন্য কেউ নয়।”—–একদমে কথাগুলো বলে গটগট হেঁটে স্থান ত্যাগ করল উথমী।

নতুন বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলো। স্ত্রীর যাওয়ার পানে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তৈমূর। এই ব্যাপারটা নিয়েও যে সামনে বড়ো কোনো সমস্যা আসতে চলেছে তা সহাস্যেই টের পেলো। তবে ঘটনাটি এখানেই থেমে গেলো করবীর কথায়। খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে তিনি বললেন,“আমি আর তোদের চাচাও আজ চলে যাবো। তুরাগরা যেহেতু যাচ্ছে তাই ওদের সাথেই না হয় বেরিয়ে পড়বো। তিথিরা কবে ফিরছিস?”

“ওরির বাবার রেস্তোরাঁ খোলা। মানুষের উপর ব্যবসা ছেড়েছুড়ে তো আর এখানে বসে থাকা যায় না তাই আজই ও ফিরে যাওয়ার কথা বলছিল।”

“ওহ, সবার দেখি একদিনেই ফেরার সময় হয়ে এসেছে। ভালো ভালো।”—কথাটা সমাপ্ত করে চলে গেলেন তিনি।
_________

ঘরে এসে দরজা আটকে বসে রইলো উথমী। রাগের চোটে নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটাহাঁটি করতে করতে বিড়বিড় করে বলছে,“পেয়েছেটা কী সবাই? আমি কী হাতের পুতুল? যখন যা ইচ্ছে বলবে আর আমি চুপচাপ মেনে নিবো? একদমই না। বাড়ির সবাই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে দিয়ে দিলো। শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই ননদ শাশুড়ির বিয়ে মানবো বলে চিৎকার চেঁচামেচি। বিয়ের তৃতীয় দিন সকলের সামনে অপমান। এখন আবার চাকরি ছাড়তে হবে? ছাড়বো না আমি। রাত দিন পরিশ্রম করে পরীক্ষা দিয়ে, ভাইবা দিয়ে তারপর চাকরি পেয়েছি। অন্যের কথায় কেনো ছাড়বো?”

আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলের পাশে রাখা বড়ো বড়ো লাগেজগুলো এনে বিছানার উপর তুললো। বিয়ে হয়েছে সপ্তাহ হতে চললো অথচ নিজের জিনিসপত্রগুলোই এখনো ঠিকঠাকভাবে গোছগাছ করা হয়নি উথমীর। পড়ে আছে ব্যাগ বন্দি হয়ে। লাগেজগুলো খুলে ভেতর থেকে একে একে সবকিছু বের করল উথমী। আলমারির দরজা খুলতেই চরম বিরক্ত হলো। তৈমূরের পোশাকে ভর্তি আলমারি। নেই কোনো ফাঁকা জায়গা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুহূর্তেই সেসব ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

নাস্তা সেরে ঘরে এসে বসলেন শাহানা। উনার পিছুপিছু ভেতরে প্রবেশ করল তিথিয়াও। এসেই রাগে গজগজ করতে করতে বলে উঠলো,“আমি বলেছিলাম না আম্মা? ওসব শহুরে বয়স্ক মেয়ে আর যাই পারুক না কেনো সংসার তারা করতে পারবে না। আসতে না আসতেই আপনার মুখে মুখে তর্ক? এখনি এমন করলে ভবিষ্যতে কী হবে আল্লাহ ভালো জানেন। আর তৈমূকে দেখেছেন? বউয়ের চ্যাটাং চ্যাটাং কথার বিপরীতে কিছু বললো না। একটা ধমকও তো দিতে পারতো নাকি?”

কথাগুলো যেনো আগুনের মধ্যে ঘি ঢালার মতো হয়ে গেলো। শাহানার রাগটাকে আরো বৃদ্ধি করল। নানা চিন্তা ভাবনায় অতিষ্ট হয়ে উঠলেন মুহূর্তেই। তিথিয়া মায়ের পাশে এসে বসলো। পুনরায় বললো,“এখন তো আপনাকে একা এখানে রেখে যেতেই আমার ভয় লাগছে। একা পেয়ে কিনা কী বলে আপনাকে? কাল থেকে তৈমূর অফিস খোলা। বড়ো চাচীও এ মুখো তেমন একটা হন না। বাড়িতে শুধু আপনি আর ওই মেয়ে। উফ চিন্তায় চিন্তায় তো আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি আম্মা।”

কথাটা শাহানাও বেশ কিছুক্ষণ ভেবে দেখলেন। কড়া মেজাজে বললেন,“কী করবে সে? ভয় পাই আমি? এটা আমার স্বামীর বাড়ি। টানা পঁয়তাল্লিশ বছর সংসার করেছি। সেখানে দুদিনের মেয়ে এসে আমার উপরে ছুড়ি ঘুরাবে? আমিও দেখে নিবো। তুই যা। আমায় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

মায়ের কথাগুলো মোটেও পছন্দ হলো না তিথিয়ার। ভেবেছিল মা হয়তো তাকে যেতে বাঁধা দিবে। শামীমকে বুঝিয়ে হয়তো আরো কিছুদিনের জন্য রেখে দিবে। কিন্তু কিছুই হলো না। তবে আগুনে ঘি ঢেলে তেজটা যে বাড়িয়ে দিতে পেরেছে এতেই সে চরম খুশি।

চলবে _______

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৯]

নাস্তা সেরে নিচে বসে বড়ো ভাইয়ের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা চলছিল তৈমূরের। কথা শেষে উপরে উঠে নিজ কক্ষের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েক মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পেলো না তৈমূর। এ অসময় ঘরের দরজা আটকে কী করছে মেয়েটা? মায়ের কথায় রাগ করেছে কী? নানা ধরণের দুশ্চিন্তা নিয়েই দরজায় কড়া নাড়লো তৈমূর। একবার দুবার, বেশ কয়েকবার। তারপর আরো কয়েক সেকেন্ড তাকে বাইরে অপেক্ষা করিয়ে ভেতর থেকে দরজা খুলে গেলো। দরজা খোলা পেতেই দ্রুত হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। পুরো কক্ষটি পর্যবেক্ষণ করে ভীষণ অবাক হলো। লাগেজ আর জামা কাপড়ে এলোমেলো হয়ে আছে বিছানা। আলমারির দরজাগুলো হাট করে খোলা। তৈমূরের গুছিয়ে রাখা পোশাকগুলোর অবস্থাও করুণ।

দরজা খুলে দিয়ে আবারো নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলো উথমী। তৈমূর প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এগুলোর এমন অবস্থা করেছেন কেনো?”

“দেখছেন না গুছাচ্ছি।”

“এভাবে অগোছালো করে?”

“হ্যাঁ, এদিকে একটু আসুন তো।”

স্ত্রীর ডাকে এগিয়ে আসে তৈমূর‌। তৎক্ষণাৎ তার হাতে কয়েকটি শাড়ি ধরিয়ে দেয় উথমী। বলে,”আপনি হচ্ছেন পুরুষ মানুষ। আর পুরুষ মানুষ এতো পোশাক দিয়ে কী করে, বলুন তো?”

“নারীরা যা করে, তাই।”

“তাই বলে এতো? যাই হোক,এই ভাঁজ করা শাড়িগুলো সুন্দর করে ওই হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখুন তো।”

বাধ্য স্বামীর মতো স্ত্রীর দেওয়া কাজটি করতে লাগলো তৈমূর। তার ফাঁকে ফাঁকে উথমীর হাবভাব বোঝারও চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না। ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আম্মার কথায় কী আপনি রাগ করেছেন?”

“না তো।”

“সত্যি বলছেন?”

“মিথ্যে বলার তো কোনো প্রয়োজন দেখছি না।”

মাথা নাড়ায় তৈমূর। শাড়িগুলো ঠিকঠাক করে রেখে বিছানার একপাশে জায়গা করে বসে পড়ে। অমন একটি ঘটনার পরেও যে তার স্ত্রী রাগ করেনি ব্যাপারটা যেনো কিছুতেই বিশ্বাস হলো না তৈমূরের। তবে কিছু বললো না। মনের কথা মনে চেপে রেখে চুপ রইলো। কিছুক্ষণ সমান তালে চললো নিরবতা। সব জামা কাপড় গোছগাছ করে আলমারিতে রেখে বিছানা খালি করল উথমী। লাগেজগুলো খাটের নিচে ঢুকিয়ে এবার গেলো ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে। এই পুরোটা সময় নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে দেখে গেলো তৈমূর।

ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই বদলে গেলো ঘরের পরিবেশ। সব গোছগাছ শেষে ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে এসে বিছানায় বসে পড়ল উথমী। ঘরে এসি চলার পরেও এই স্বল্প কাজেই যেনো সে হাঁপিয়ে উঠেছে। তার এই ক্লান্তি দেখে খাটের পাশের ছোট্ট টেবিল থেকে পানির গ্লাসটি এনে তার সম্মুখে ধরলো তৈমূর। গ্লাসটি দেখে আর বিলম্ব না করে অর্ধেকটা পানি এক নিঃশ্বাসে পান করল উথমী। দম ছেড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললো,“ধন্যবাদ।”

প্রত্যুত্তরে চুপ থাকে তৈমূর। গ্লাসটি যথাস্থানে রেখে এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে। চেয়ার টেনে ল্যাপটপ খুলে বসে। পেছন থেকে হুট করেই উথমী ডাকে,“শুনুনু তৈমূর সাহেব।”

“বলুন।”

“আমি কিন্তু কোনোভাবেই চাকরিটা ছাড়বো না। বিয়ের আগেও আপনাকে এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম।”

“আমিও স্পষ্ট করেই বলেছিলাম এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”

“কিন্তু আপনার মা-বোনের চরম আপত্তি রয়েছে।এতো এতো নিয়ম কানুন, পছন্দ-অপছন্দ আমার মোটেও ভালো লাগছে না। আমার ক্ষেত্রে উনাদের এমন আচরণের কারণ কী আমার বয়স? উনারা কী আপনার জন্য কোনো স্কুল, কলেজে পড়ুয়া মেয়ে আনতে চেয়েছিল? যদি তাই চেয়ে থাকে তাহলে করে নিতেন। আমাকে মাঝখানে টেনে এনে এতো ঝামেলার কী প্রয়োজন ছিলো?”

“তার উত্তর শুরুতেই দিয়েছি।”

“উত্তর দিলেই তো হবে না। কয়েকদিন পর যখন ছুটি শেষ হয়ে যাবে তখন তো আমায় রোজ নিয়ম মাফিক কলেজে গিয়ে ক্লাস করাতে হবে। তখন কিন্তু আজকের মতো কিছু বলতে এলে আমি মানবো না।”

“আচ্ছা।”

এর বিপরীতে আর কিছুই বলার থাকে না উথমীর। তবে সব বিষয়কে এতো সহজভাবে নেওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই লোকটাকে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয় সে। তাই থম মেরে ওখানেই কিছুক্ষণ বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে হুট করেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। কখনো বা সিলিং এর পানে আবার কখনো বা তৈমূরের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। একসময় বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। আর তারপর নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বেরিয়ে চলে যায় নিচে।
__________

দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে জোহানকে তৈরি করে দিলো জেবা। তুরাগ তৈরি হয়ে এতক্ষণে চলে গিয়েছে নিচে। ড্রাইভারের সাহায্যে ব্যাগপত্রগুলো উঠিয়ে রাখছে গাড়িতে। মায়ের হাত থেকে ছাড়া পেতেই দৌড়ে দাদীর ঘরে চলে এলো জোহান। শাহানা তখন অলস দেহখানা নিয়ে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। নাতির শব্দ পেতেই তৎক্ষণাৎ উঠে বসলেন তিনি।

পুত্রবধূকে দু চোখে সহ্য করতে না পারলেও ছেলের ঘরের নাতি উনার চোখের মণি। আর জোহানেরও যেনো সব আবদার তার দাদীর কাছে। ঘরে এসেই বিছানায় উঠে পা ঝুলিয়ে বসলো সে। শাহানা তার গাল টেনে জিজ্ঞেস করলেন,“কী ব্যাপার দাদু? এ অসময় আমার কাছে যে? আর এভাবে এতো সাজুগুজু করেছো কেনো?”

“কেনো আবার? তুমি জানো না? আজ বাবাই, আম্মু আর আমি তো বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। তাই তো তোমার থেকে বিদায় নিতে এলাম।”

“জানতাম তো। তা এখনি চলে যাবে?”

“হ্যাঁ, আম্মুর রেডি হওয়া শেষ হলেই চলে যাবো। তুমি নিচে চলো।”

নাতির জোরাজুরিতে দ্বিমত করতে পারলেন না শাহানা। বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলেন নিজের আলমারির দিকে। আলমারির দরজা খুলে ভেতর থেকে একটা ছোটো বাক্স বের করে তার থেকে বের করলেন কচকচে হাজার টাকার একটি নোট। এগিয়ে এসে জোহানের পকেটে গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,“এই টাকা দিয়ে তোমার যা ইচ্ছে তাই কিনে খেও। ঠিক আছে?”

চোখ দুটো চকচক করে উঠলো জোহানের। প্রত্যেকবার দাদার বাড়ি এলেই দাদী তার পকেটে এমন হাজার টাকার নোট গুঁজে দিয়ে এই এক কথাই বলে। তৎক্ষণাৎ দাদীকে জড়িয়ে ধরলো জোহান। আনন্দিত চিত্তে বললো,“তুমি খুব ভালো দাদী। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”

মুহূর্তেই আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠলো শাহানার মন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,“চলো এবার নিচে যাই।”

“চলো।”

যেতে যেতে দাদী নাতির মধ্যে চললো আরো অনেক কথাবার্তা। বড়ো ভাই আর ভাবীর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন মঈনুদ্দিন। যোগ দিলেন তুরাগ আর তৈমূর দুই ভাইয়ের কথোপকথনের মধ্যে।

তৈরি হয়ে সবে সিঁড়ি বেয়ে নেমে অন্দরমহলে পা রেখেছে জেবা।তখনি শাশুড়ির সাথে তার চোখাচোখি হলো। ঠোঁটের কার্নিশে ফোটে উঠলো কৃত্রিম হাসির রেখা। এগিয়ে এলো আরো সম্মুখে। কোমল স্বরে বললো,“আমরা তবে আসছি আম্মা। নিজের যত্ন নিবেন। কোনো অসুবিধা হলে কিন্তু তুরাগ আর তৈমূরকে জানাবেন। তাছাড়া এখন থেকে আর আপনি একা নন। আপনার জন্য আপনার ছোটো পুত্রবধূ তো রেখেই যাচ্ছি।”

মুখশ্রী গম্ভীর করে রাখলেন শাহানা। কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন,“আমার নাতিকে দেখে রেখো।পারলে ওর পরীক্ষা শেষে আবার দিয়ে যেও।”

শাশুড়ির কথার বিপরীতে মাথা নাড়ায় জেবা। শাহানা আর কথা বাড়ান না। নাতিকে সঙ্গে নিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে চলে যান বাইরে। তখনি রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে আসে উথমী। জেবাকে দেখতেই পেছন থেকে বলে ওঠে,“এখনি রওনা দিবেন নাকি ভাবী?”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই সেদিক পানে ফিরে তাকায় জেবা। উত্তর দেয়,“হ্যাঁ এখনি বের হবো।”

কথাটা শুনে মন খারাপ হলো উথমীর। চুপসে গেলো মুখশ্রী। তার দিকে এগিয়ে এলো জেবা। মন খারাপ বুঝতে পেরে বললো,“ফোন নাম্বার তো দিয়েই গেলাম। যখন ইচ্ছে ফোন করবে আমায়। এখানে কোনো সমস্যা হলে তৈমূরকে জানাবে। একদম লজ্জা পাবে না। তৈমূর তোমার স্বামী। স্বামীর কাছে কোনো লজ্জা নেই। আর চিন্তা নেই আমিও ফোন করে খোঁজ খবর নিবো।”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় উথমী। জেবা পুনরায় বলে, “মেয়েদের একটু মানিয়ে চলতে হয়, জানো তো? আজ সকালে যেভাবে আম্মার মুখের উপরে কথা বলে দিলে সেসব আর কখনো করবে না। সবসময় সব জায়গায় প্রতিবাদ চলে না। কিছু কিছু সময় উত্তর জেনেও চুপ থাকতে হয়। মন দিয়ে সংসার করো। মালতী ফুফু আছেন। উনাকে আমি সব বলে দিয়েছি। তোমায় সব বুঝিয়ে দিবেন উনি। ঠিক আছে?”

“হুম।”

মুচকি হেসে উথমীর গালে হাত রাখলো জেবা, “তাহলে চলি এবার। ভালো থেকো।”—-বিদায় নিয়ে এগোলো সদর দরজার দিকে। উথমীও আর সেখানে দাঁড়ালো না। তার পিছু পিছু সদর দরজা পর্যন্ত এসে থেমে গেলো।

মাকে দেখতেই তুরাগ এসে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। তারপর একে একে জেবা, জোহান, মঈনুদ্দীন, করবী তারাও উঠে পড়ল গাড়িতে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চলতে শুরু করল গাড়িটি। চলন্ত গাড়ির খোলা কাঁচ দিয়ে মাথা বের করে হাত নাড়ালো জোহান। নাতির কান্ডে মুচকি হেসে নিজেও হাত নাড়িয়ে বিদায় জানান শাহানা। কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানে। মনে মনে সকলের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ প্রার্থনা করে বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ান। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সময় চট করে দেখা হয়ে যায় ছোটো পুত্রবধূর সঙ্গে। হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা মুহূর্তেই মলিন হয়ে ওঠে উনার। মেয়েটিকে সময়ে অসময়ে সামনে দেখতে পেলেই ভেতরে ভেতরে চরম বিরক্তবোধ করেন তিনি। এখনো তেমনটাই করলেন। তারপর মুখ বাঁকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন সেখান থেকে।

উথমী নিরবে শুধু দেখলো ভদ্রমহিলার মুখভঙ্গি। তবে বিশেষ পাত্তা দিলো না। দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে।

বাড়ির সম্মুখ ধরে ইটের বাঁধাই করা একটি রাস্তা গিয়ে থেমেছে গেট পর্যন্ত। তার দু ধারে অসংখ্য ফুলের গাছ। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে যত্নে এবং পরিচর্যায় বাড়ন্ত গাছে ফোটা সুন্দর ফুলগুলোও‌ নেতিয়ে পড়েছে। সেই নেতানো ফুলগুলোই পরম যত্নে ছুঁয়ে দিলো উথমী। নাসারন্ধ্র দিয়ে শুঁকে নিলো ঘ্রাণ। ছোটো ছোটো কদম ফেলে চারিদিক দেখতে দেখতে উপভোগ করতে লাগলো প্রকৃতি। চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই শুধু সবুজ আর সবুজ। সেই সবুজের মধ্যেই রং বেরঙের নাম না জানা কতশত ফুল! উথমীর নিকট মনে হলো এ যেনো বাড়ি নয়, প্রকৃতির এক লীলাভূমি। বাড়ির পেছনের দিকে বিশাল বড়ো বড়ো গাছ। গাছের ডালে বাস করা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত প্রকৃতি।

গন্ধরাজ আর বেলী ফুলের গন্ধে মো মো করছে চারিদিক। গেটের পাশ দিয়ে লতা ছড়ানো মাধবীলতা গাছটি আগেই নজরে পড়েছিল উথমীর।তবে ভেতরটা যে এতোটা সুন্দর তা যেনো কল্পনাই করতে পারেনি সে। হাজারি গোলাপ গাছটায় ফুলে ফুলে ভরা। সেদিক পানে দৃষ্টি পড়তেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেলো তার ভেতরে। হাত বাড়ালো ফুলগুলো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু তার আগেই এক পুরুষালি হাত তার হাতের উপর দিয়ে গিয়ে গাছ থেকে ছিঁড়ে নিলো দুটো লাল রঙের ফুল। খানিকটা ভড়কে গেলো উথমী। তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে তাকালো। দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত মুখশ্রী।

তৈমূর হাতের ফুলগুলো থেকে একটা স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথায় ঘোমটা দেওয়া ওড়নাটা সরিয়ে খোঁপা করা চুলগুলো একটানে খুলে ফেলে কানে গুঁজে দিলো অবশিষ্ট ফুলটি। কাজটি হয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে দ্রুত পায়ে সরে দাঁড়ালো। আকস্মিক ঘটনায় বোকা বনে গেলো উথমী। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো।

স্ত্রীর এমন চাহনিতে মনে মনে হাসলো তৈমূর। সাথে মেয়েটির সৌন্দর্যের প্রশংসাও করল বটে। তবে সামনা সামনি কিছুই যেনো বুঝতে দিলো না তাকে।অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে শুধালো,“তা এখানে কী করছেন ম্যাডাম?”

“তেমন কিছু না, দেখছিলাম জায়গাটা। আপনি কী করছেন?”

“আপনাকে দেখছিলাম।”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকালো উথমী। ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো,“কী?”

“আপনাকে দেখেই এসেছি।”

“ওহ।”

ছোট্ট করে কথাটি বলে পুনরায় বাগান দেখায় মনোযোগ দিলো উথমী। বাড়িটির বা পাশে যেতেই নজরে পড়ল ফুলে ফুলে ভর্তি জারুল আর কৃষ্ণচূড়া গাছটির। গাছের নিচে অবস্থানরত সবুজ জমিনটা এখন বেগুনী আর লাল রঙেদের দখলে। দৃশ্যটি দেখে মুহূর্তেই চকচক করে উঠলো উথমীর আঁখিদ্বয়।উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“বাহ! এখানে তো দেখছি জারুল আর কৃষ্ণচূড়া গাছও রয়েছে? সত্যি বলতে আপনাদের বাড়িটা কিন্তু অনেক সুন্দর।”

এতক্ষণ স্ত্রীর দিকেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো তৈমূর। আচমকা স্ত্রীর এমন ছটফটে, প্রাণবন্ত আচরণে সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গাছের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “হুম, গাছটি আমার বাবার নিজ হাতে লাগানো। কৃষ্ণচূড়া আম্মার প্রিয় ফুল ছিলো বিদায় গ্ৰাম থেকে এনে লাগিয়েছিলেন গাছটি।”

“আর বাকিগুলো?”

“বাকিগুলো বলতে যার যখন যা ইচ্ছে হয়েছে তাই এনে লাগিয়েছে। আর এই জারুল গাছটি কলেজের এক বৃক্ষপ্রেমী স্যারের থেকে আমি উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। তবে সেই স্যার তার বছর দুয়েক পরেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন কিন্তু উনার দেওয়া এই গাছটি ঠিকই রয়ে গেলো। প্রতিবছর সময় মতো ফুল দিচ্ছে, ফল দিচ্ছে।”

কথাটা শুনে সাময়িক মন খারাপ হলো উথমীর। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,“তা এতো বড়ো বাগানের যত্ন নেয় কে? আপনি?”

“না, যত্ন নেওয়ার সময় কোথায়? এর জন্য আলাদা লোক রাখা আছে। বাড়ির ওপাশেই উনার থাকার জায়গা। বাগান পরিচর্যা, গেইট পাহারা দেওয়াই উনার কাজ। তবে জায়গাটা সবচেয়ে সুন্দর লাগে সকালে। নতুন নতুন ফুল ফোটে।”

চুপচাপ মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শোনে উথমী। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে এবার তাকে তাড়া দেয় তৈমূর,“সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। একটুপর আজান হবে। এবার ভেতরে চলুন।”

ভেতরে যাওয়ার কথা শুনে মলিন হয়ে গেলো উথমীর মুখশ্রী। দ্রুত পায়ে গাছের দিকে যেতে যেতে বললো,
“দাঁড়ান সঙ্গে করে কয়েকটা ফুল নিয়ে নেই।”—- তারপর ছয় পাপড়ি বিশিষ্ট কয়েকটা বেগুনী রঙের ফুল তুলে নিলো হাতে। সামনে এসে হাত উঁচিয়ে বললো,“ফুলগুলো কি সুন্দর! তাই না?”

“হুম, একদম আপনার মতো।”—কথাটা বলেই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো তৈমূর। উথমী অবাক চাহনিতে লোকটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুটা পথ এগিয়ে পথিমধ্যে থেমে গেলো তৈমূর। পিছু ফিরে ফের বললো,“কী হলো? দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আজকে কী বাগানেই রাত্রিযাপন করার ইচ্ছে জেগেছে?”

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোধক জবাব দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে তৈমূরের পায়ে পা মিলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল উথমী।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)