জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-১০+১১

0
16

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১০]

আকাশে আঁধারিয়া মেঘ জমেছে। সেই মেঘের আড়ালে বসে লুকোচুরি খেলছে সূয্যিমামা। প্রকৃতি জুড়ে কেমন এক মন খারাপের গন্ধ। সেই মন খারাপটাকে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর করতে সকাল থেকেই একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে ছোট্ট তনি। ড্রয়িং রুমের সোফায় তাকে নিজের পাশে বসিয়ে বৃদ্ধা আঙুলের ক্ষত স্থানটিতে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে বাবা উৎস। বাম পাশে বসে তার কান্না থামানোর প্রয়াস চালাতে ব্যস্ত দাদা রায়হান কবীর। মা আর দাদী দুজনেই চিন্তিত, থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বিড়ালছানা আইসক্রিমের সাথে খেলতে গিয়েই তার ধারালো নখের আঁচড় খেয়ে ঘটে গিয়েছে এই অঘটন।

কেয়া বেগমের চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম শাড়ির আঁচলে মুছে অভিযোগের সুরে পুত্রের উদ্দেশ্যে বললেন,“আমি আগেই নিষেধ করে দিয়েছিলাম, বাড়িতে এসব বিড়াল পোষার প্রয়োজন নেই। ছোটো একটা বাচ্চা আছে। কিন্তু না আমার কথা শোনার তো প্রয়োজনই মনে করে না কেউ। এখন দেখ কি একটা অবস্থা! বাড়িতে বসে না থেকে ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যা। বড়ো কোনো কিছু হওয়ার আগেই ইনজেকশন দিয়ে নিয়ে আয়।”

দাদীর মুখে ইনজেকশনের নাম শুনে কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেলো তনির। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠা শুরু হয়ে গেলো তার। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললো,“না আমি ইনদেকতন দিব না! পাপাআআ!”

প্রত্যেক বাবার মতো উৎসরও মেয়ের কান্না কিছুতেই সহ্য হয় না। বুকটা তার কেঁপে ওঠে। ব্যান্ডজ করা শেষে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো সে। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে,“ঠিক আছে আম্মু, আমরা ইনজেকশন দিবো না। এবার তুমি কান্না থামাও দেখি।”

বাবার গলা জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ায় তনি। মায়ের উদ্দেশ্যে এবার উৎস বলে,“কিছু হবে না মা। চিন্তা করো না। বিড়ালকে বাড়িতে আনার আগেই ভ্যাট দেখিয়ে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল । ওই বিড়ালের কামড়ে বা খামচিতে বেশি হলে র’ক্ত বের হবে এছাড়া আর তেমন কিছুই হবে না।”

পুত্রের কথায় নিশ্চিন্ত হন কেয়া বেগম। রিনিতা এগিয়ে আসে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয় মেয়ের মুখশ্রী। মায়ের স্পর্শ পেতেই তনি নাক টেনে অভিযোগের সুরে বলে,“আমি আইতকিরিমের সাথে কথা বলবো না। ওর সাথে আড়ি।”

সেন্টার টেবিলের কাছে গোল গোল চোখে তনির পানে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্যাও ম্যাও করে নিজের ভেতরকার আহাজারি প্রকাশ করছে অবুঝ প্রাণীটি। সেদিকে একবার তাকিয়ে স্বামীর কোল থেকে মেয়েকে নিজের কোলে তুলে নিলো রিনিতা। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে এসে তার পায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো আইসক্রিম। উপরের দিকে মাথা তুলে পূর্বের ন্যায় চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। ততক্ষণে কান্না থেমে গিয়েছে তনির। একনাগাড়ে কাঁদার ফলে নাকের ডগা আর গাল দুটো তার পাকা টমেটোর মতো লাল টুকটুকে বর্ণ ধারণ করেছে।

মেয়েকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে রিনিতা বললো,“ও তো এখনো অনেক ছোটো আম্মু। খেলতে গিয়ে ভুল করে আঁচড় লেগে গিয়েছে। তাই বলে তুমি ওর সঙ্গে রাগ করে থাকবে? তুমি যখন একেবারে ছোটো ছিলে তখন তোমার বড়ো ফুপির চুল ধরে কত টেনেছো, খামচি দিয়েছো। তখন কী তোমার বড়ো ফুপি তোমার সাথে রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল? নাকি আমি করেছি? তাছাড়া দোষ তো তোমারই। আমি কতবার করে বলেছি ওর নখগুলো কেটে দেই। কিন্তু তুমিই তো কাটতে দাওনি।”

“নক কাটলে ও ব্যতা পাবে।”—নিষ্পাপ তার কণ্ঠস্বর।

“নখ কাটলে কেউ ব্যথা পায়?ওর দিকে একবার দেখো তো, তুমি ব্যথা পেয়েছো বলে ও কেমন অস্থির হয়ে গিয়েছে। কীভাবে তোমায় ডাকছে। ইচ্ছে করে দিলে কী এমন করতো?”

বাম হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে আইসক্রিমের পানে তাকায় তনি। দৃষ্টিগোচর হয় ছোট্ট ছানার অসহায় মুখখানি। রায়হান কবীর এগিয়ে এসে পুত্রবধূর কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নিলেন নাতনিকে। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,“যা হওয়ার হয়ে গেছে। এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। চলো রাজকুমারী, আমরা গিয়ে কার্টুন দেখি।”

“না কাটুন দেকব না। বড়ু পুপির সাতে কথা বলবো।”

“আচ্ছা আচ্ছা, বড়ো ফুপির সাথেই কথা বলবো। এখন চলো।”—-বলতে বলতেই ঘরের দিকে পা বাড়ালেন রায়হান কবীর। উনাদের পিছু পিছু দ্রুত গতিতে ছুটলো আইসক্রিমও।

সকাল আটটা বেজে দশ মিনিট। রন্ধনশালায় চুলার আঁচে দাঁড়িয়ে রুটি ছ্যাঁকছে উথমী। খানিক বাদে বাদে ললাট বেয়ে কপোলে এসে ঝরে পড়া ঘামের ফোঁটা ওড়নার আঁচলে অযত্নে মুছে নিচ্ছে। বাহিরে ভ্যাপসা গরম। রোদের তীব্রতায় চারিদিক ছারখার। আজ ফুলকুঞ্জ জুড়ে প্রবল নিস্তব্ধতা। হইচই করে বাড়িটিকে মাতিয়ে রাখা বাচ্চারা ফিরে গিয়েছে বাবা-মায়ের সাথে নিজেদের বসতিতে। বিকেলে তুরাগরা বিদায়ের পর সন্ধ্যা নামতেই নাস্তা সেরে তিথিয়াও স্বামী সন্তান নিয়ে চলে গিয়েছে বাড়ি। সেই থেকে আর নিচে নামেননি শাহানা। রাতের খাবার, সকালের চা মালতী ফুফুই দিয়ে এসেছেন উনার ঘর পর্যন্ত।

টেবিল পরিষ্কার করে সেথায় জগ ভর্তি পানি রেখে পুনরায় রান্নাঘরে এলেন মালতী ফুফু। বললেন,“সেই সকাল থাইক্কা তো একলা একলাই সব করলা। এহন ঘরে যাও। তৈমূ বাবা তো আবার আফিস যাইবো। যাও ঘরে যাও।”

“আরেকটা রুটি বাকি আছে।এটা বরং ছ্যাঁকে নেই?”

“ওইডা আমি ছ্যাঁইকা দিতাছি। তুমি যাও তো। তৈমূ বাবার কি না কি লাগে দেহো গিয়া।”

বিপরীতে আর দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ পেলো না উথমী। মালতী ফুফুর সাথে খুন্তিটা হাতবদল করে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালো। তখনি ভেতরে প্রবেশ করলেন জয়নব। তাকে দেখতেই মুচকি হেসে বললেন,“আরে ছোডো বউ যে! তা সকাল সকাল এইহানে যে? রানতে আইছো বুঝি?”

সৌজন্য হেসে মাথা নাড়ায় উথমী। মালতী ফুফু তৃপ্ত কণ্ঠে উনার প্রশ্নের জবাবে বলে উঠলেন,“হ গো ভাবী। সেই ভেইন্না বেলায় রান্নাঘরে ঢুকছে। এই গরমের মধ্যে রুডি, দুই পদের ভাজি সব বউমায় একলা হাতে বানাইছে। এই দেহেন।”

সঙ্গে সঙ্গেই উঁকি দিয়ে তা দেখলেন জয়নব। বললেন, “তা ভালা করছো। বাড়ির বউয়ের কামই হইলো রান্ধন বাড়ন করা। আমরাও এককালে করছি তবে তুমগো মতো এমন গ্যাসের চুলা আছিলো না। লাকড়ি দিয়া মাডির চুলায় রানছি। তা বউ আমারেও দুইডা রুডি বানাইয়া দেও তো। দুইডা হইলেই চলবো। তোমার চাচা শ্বশুর আবার ভেইন্না কালের নাস্তা বাজারেই সাইরা আহে। আমি একলা মানুষ। দুইডা রুডি হইলেই হইয়া যায়।”

চাচী শাশুড়ির কথায় অপ্রস্তুত হেসে মাথা নাড়ায় উথমী। মুখের উপর চেয়েও না করতে পারে না। মালতী ফুফু এতে বিরক্ত হয়ে বলেন,“আটার কাই তো শেষ। আচ্ছা আমি বানাইয়া দিতাছি।”

প্রস্তাবটা মোটেও পছন্দ হলো না জয়নবের। নাকোচ করে দিয়ে বললেন,“এতো জীবন তো তোর হাতেই খাইলাম। এবার নতুন বউয়ের হাতের তৈরি খাওন খামু। কী বউ খাওয়াইবা না? নাকি আমি নিজেই বানাইয়া লমু?”

“না না আমিই নতুন করে বানিয়ে নিবো। আপনি এখান থেকে আপনার প্রয়োজন মতো নিয়ে যান। এগুলো মাত্রই তৈরি করা হয়েছে।”

সন্তুষ্ট হলেন জয়নব। ‘আচ্ছা’ বলে এগিয়ে গিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত স্টিলের প্লেটটি নিয়ে তাতে গুনে গুনে চারটি রুটি তুলে নিলেন। আর সাথে নিলেন ছোটো ছোটো দুটো বাটি ভর্তি দু পদের তরকারি। কাজ শেষ হতেই বড়ো বড়ো কদম ফেলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। মালতী ফুফু উনার কান্ড দেখে মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “দুইডা কইয়া চাইরডা লইয়া গেলো। বয়স বাড়ার পরেও মাইনষে এতো খায় কেমনে?”

গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে তৈমূর। কয়েকদিনের ব্যবধানেই তার এই সাদাসিধে কক্ষটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। কক্ষের আনাচে কানাচে, বিছানায় মেয়েলি ঘ্রাণের সাথে সাথে ড্রেসিং টেবিলের উপরে অস্তিত্ব বজায় রেখে স্থান পেয়েছে মেয়েলি সব সাজসজ্জার জিনিসপত্র। হেয়ার ব্যান্ড, লিপস্টিক, কাজল থেকে শুরু করে নাম না জানা আরো কত কি! চিরুনিতে ঝুলছে সুদীর্ঘ বেশ কয়েকটি চুল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিরুনি হাতে নেয় তৈমূর। চুলগুলো ফেলে দিয়ে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে নেয় নিজের চুল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করার পর কোনো এক ড্রয়ারের এককোণে পড়ে থাকা হাত ঘড়িটি খুঁজে পেয়ে প্রশান্তির শ্বাস ছাড়ে। আলমারি থেকে কাপড় বের করতে গিয়েও ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে বেচারাকে। মেয়ে মানুষের এতো এতো কাপড়ের মধ্য থেকে নিজের কাপড় বের করা কী চারটে খানি কথা?

এই মুহূর্তে এসে তৈমূর খুব করে উপলব্ধি করছে, বিয়ে করা সহজ হলেও বিয়ের পরবর্তী জীবনগুলো কাটানো বড়োই কঠিন এবং এডভেঞ্চার টাইপ। নইলে কী আর নিজের এই সাজানো গোছানো, ছিমছাম ঘরটায় হুট করে এক রমণীর আগমন ঘটে এতোটা পরিবর্তন ঘটে?

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তীব্রতাও বেড়েছে। গরমের চোটে পরনের পোশাকটাও ঘামে ভিজে গিয়েছে উথমীর। জয়নব যেতেই নতুন করে আটার ডো বানিয়ে আবারো সে তৈরি করে নিয়েছে কয়েকটা রুটি। হাত দুটো ধুয়ে নিতেই বাহির থেকে হাঁক ডাক এলো,“নাস্তা কী এখনো তৈরি হয়নি? এই মালতী! নাস্তা দে। খাওয়ার পর আমার আবার ওষুধ আছে। ওদিকে তৈমূও তো আফিস যাবে।”

ভেসে আসা কথাগুলো শ্রবণাতীত হতেই এটা যে শাশুড়ি মায়ের কণ্ঠস্বর তা চট করে বুঝে গেলো উথমী। সেই ডাক শুনে মালতী ফুফু দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন বাহিরে। সেখানে যাওয়ার পর দুজনার কী কথা হলো শোনা গেলো না কিছুই। আঁচলে হাত মুছে একে একে খাবারগুলো নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো উথমী। ততক্ষণে শাহানা এসে চেয়ার টেনে বসেছেন। ছোটো পুত্রবধূকে পরিবেশন করতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে শুধালেন,“তৈমূ কই?”

প্রশ্নটি ছুঁড়তে না ছুঁড়তেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো তৈমূর। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,“সুপ্রভাত আম্মা। কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

“সকালে নিচে নামলেন না যে? আপনার কী শরীর খারাপ?”

“এমনিই নামিনি। চিন্তা করিস না। খেয়ে নে।”

মায়ের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে থেমে যায় তৈমূর। এবার তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো স্ত্রীর পানে। ছোটো ছোটো চুলগুলো ঘোমটা ভেদ করে ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে কপালে আর গালে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই আর না আছে স্বামীর পানে। সে নিজের মতো করেই রুটি দেওয়া শেষ করে তরকারি দিচ্ছে স্বামীর পাতে। খেতে খেতে সেই দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হলো শাহানার। ভেতরে ভেতরে চরম বিরক্ত হলেন। গলা ঝেড়ে ভারিক্কি কণ্ঠে বলে উঠলেন,“এগুলো কী বানিয়েছিস মালতী? বাড়িতে কী লবণ ছিলো না? তরকারিতে লবণ হয়নি কেনো? হলুদের পরিমাণও তো বেশি দিয়ে ফেলেছিস। এসব কী খাওয়া যায়?”

ললাটে ভাঁজ পড়ল মালতী ফুফুর। শাড়ির আঁচলে হাত কচলাতে কচলাতে বললেন,“আইজকার রান্না তো নতুন বউ করছে মেজো ভাবী। আর লবণ, হলুদ তো ঠিকই আছে। নামানোর আগে আমিই তো খাইয়া দেখলাম।”

মায়ের অভিযোগ শোনামাত্র তৈমূরও খাবারটা চেখে দেখলো। তারপর বললো,“সব তো ঠিকই আছে আম্মা। খেতেও ভালো হয়েছে।”

মুহূর্তেই মেজাজটা তুঙ্গে উঠে গেলো শাহানার। রাগত স্বরে বললেন,“আমি কী তবে মিথ্যে বলছি? বউয়ের জন্য মাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চাইছিস এখন?”

মা-ছেলের মধ্যে তর্কাতর্কি পছন্দ হলো না উথমীর। কথায় কথা বাড়ে। সকাল সকাল ঝামেলা তার একদম ভালো লাগে না। মিহি স্বরে তাদের মধ্যেই বলে উঠলো,“সবার টেস্ট তো আর এক নয়। আমি আমার টেস্ট অনুযায়ী লবণ দিয়েছিলাম। পরেরবার না হয় ভুল শুধরে নিয়ে আপনাদের টেস্ট অনুযায়ী দিয়ে দিবো।”

“মুখে মুখে কথা বোলো না। রুটিটাও তো গোল হয়নি। এতো ধিঙি মেয়ে অথচ কাজকর্ম কিছুই পারে না। মা কী সংসারের কাজ না শিখিয়ে শুধু নষ্টামিটাই শিখিয়েছে?”

শেষার্ধ কথাটায় চমকালো, থমকালো উথমী। মুহূর্তেই সকল কোমলতা রূপ নিলো কঠোরতায়। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“শুধু ঘর সংসার কেনো? ঘর সংসার থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, শিক্ষা-দিক্ষা সবকিছুই আমার মা আমায় শিখিয়েছেন। আর হ্যাঁ, আপনি নষ্টামির কী দেখলেন? কী নষ্টামি করেছি আপনাদের সঙ্গে? মুখে যা এলো তাই বলে দিবেন? কান খুলে শুনে নিন, একদম আমায় দুর্বল মনে করে যা তা বলার চেষ্টা করবেন না। আপনার অপমান কিন্তু আমি কিছুতেই মুখ বুজে সহ্য করবো না। যে রুটি ছিঁড়েই খেতে হবে সেই রুটি গোল হলো কী হলো না তা দেখতে হবে কেনো?”

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন শাহানা। রাগে রীতিমতো কাঁপছেন তিনি। পুত্রের উদ্দেশ্যে তেজদীপ্ত হয়ে বলে উঠলেন,“তোর সামনে দাঁড়িয়ে তোর মায়ের সাথে কেমন আচরণ করছে দেখছিস না তুই?এই দিন দেখার জন্য পেটে ধরেছিলাম তোকে? পারিবারিক শিক্ষাহীন একটা মেয়েকে ভদ্রবাড়ির বউ করে এনেছিস। এখনি মুখে মুখে তর্ক করে, ভবিষ্যতে আর কী করবে কে জানে?”

মা বউয়ের কথা কাটাকাটির মাঝখানে নিজেকে বড়োই অসহায় মনে হচ্ছে তৈমূরের। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখেমুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুললো সে। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“চুপ থাকুন উথমী। বড়োদের মুখে মুখে কথা বলা উচিত নয়। ঘরে যান। এদিকটা মালতী ফুফু দেখে নিবেন।”

কথাটা শুনেও না শোনার ভান ধরে রইলো উথমী। শাশুড়ির শেষার্ধ কথাটাও তার পছন্দ হয়নি। তাই রাগের পারদ বৃদ্ধি পেলো। যথাযথ উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত মন মস্তিষ্ক যেনো কিছুতেই শান্তি পাবে না তার। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলতে লাগলো,“আমার শিক্ষা নিয়ে কথা বলার আপনি কে? আপনার নিজেরই তো পারিবা….”—–বাকি কথাটুকু আর সমাপ্ত করা হলো না তার। পথিমধ্যেই থেমে যেতে বাধ্য হলো।

তৈমূর ধমক দিয়ে বলে উঠলো,“কথা বলতে নিষেধ করেছি না আপনাকে? তারপরেও এতো কথা কীসের? ঘরে যান। অসহ্যকর একটা। কথার জোরে কে কীভাবে কার উপরে থাকবে সেসবের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বাড়িতে?”

তার ধমকে উপস্থিত সকলে তটস্থ হয়ে গেলো মুহূর্তে। সহসা সে রাগে না। উঁচু গলায় কারো সাথে কথাও বলে না। যা সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত শাহানা। তাই তিনিও নিরব রইলেন। রাগ দমানোর জন্য বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মায়ের উদ্দেশ্যে এবার কড়াকড়ি ভাবে বললো,“কথার মধ্যেও একটা লিমিট থাকা উচিত আম্মা। মুখে যা আসলো তাই বলে দিলাম এমনটা করা উচিত নয়। এটা কখনোই সম্মান বয়ে আনে না।”

তারপর না খেয়েই হাত ধুয়ে বসা থেকে উঠে গেলো তৈমূর। কারো থেকে বিদায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে না করে গটগট হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে বেশ কয়েকবার পিছু ডাকলেন শাহানা কিন্তু মায়ের ডাক পরিপূর্ণভাবে অগ্ৰাহ্য করল সে।

ছেলের এই হুট করে ওঠা রাগ আর অবাধ্যতায় নিরাশ হলেন শাহানা। পুত্রবধূর পানে তাকিয়ে ক্ষীপ্রতার সহিত বললেন,“তোমার জন্য আমার ছেলেটা না খেয়ে চলে গেলো। তোমার জন্য মায়ের অবাধ্য হয়ে গেছে আমার ছেলে। জীবনেও ভালো হবে না তোমার।”—-বলতে বলতে না খেয়ে তিনিও স্থান ত্যাগ করলেন।

পূর্বের স্থানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো উথমী। ঘুম থেকে সেই ভোরে উঠে ঘামে ভিজে এতো এতো রান্না যেনো বৃথা হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তেই। বেশ কিছুক্ষণ ভেবেও খুঁজে পেলো না নিজের যথাযথ কোনো দোষ। অন্যের খারাপ কথার বিপরীতে প্রতিবাদ করাটাই কী তবে অন্যায়?

মালতী ফুফু এগিয়ে এলেন। এঁটো প্লেটগুলো একজোট করতে করতে তাড়া দিয়ে বললেন,“বসো এনে। খাইয়া নাও তাড়াতাড়ি। বেলা বাড়তাছে, আবার দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে হইবো।”

“খাবো না আমি। আপনি খেয়ে বাকিসব রেখে দিন।”

“স্বামীর ঘর করতে হইলে এসব ছোডোখাডো ব্যাপার স্যাপার এড়াইয়া যাইতে হয়। সে তুমি যত্ত বড়ো শিক্ষিত মাইয়াই হও না ক্যান। কথায় কথায় চোপা করলে শাশুড়ির চোখেও খারাপ হইবা, স্বামীর চোখেও খারাপ হইবা। সংসার জীবন তো পার কইরা আইছি তাই সবই বুঝি। মাইনষের কথায় খাওনের উপর রাগ করতে নাই। তুমি খাইলেও কারো কিছু আইবো যাইবো না আবার না খাইলেও কারো কিছু আইবো যাইবো না। কেউ মুখের সামনে নিয়া কইবো না, খাইয়া লও। আর না অসুখ হইলে সেবা যত্ন করবো। বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মধ্যে বিস্তর ফারাক। বুঝলা? তবে তৈমূ বাবা খুবই ভালা মানুষ। একেবারে মেজো ভাইজানের লাহান। কিন্তু মা ভক্ত আরকি। মায়েরে মেলা সম্মান করে। তাই শাশুড়ির মন যোগাইয়া চলার চেষ্টা করবা। নাও এহন খাইয়া লও।”

নিরবে কথাগুলো শুনলো উথমী। গভীর এক ভাবনায় মগ্ন হয়ে নিজের কথাতেই অনড় রইলো। তারপর বড়ো বড়ো কদম ফেলে এগিয়ে গেলো নিজ কক্ষের দিকে।

চলবে _______

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১১]

রাত নয়টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ছুটির দিনের জমে থাকা কাজগুলো করতে করতে শরীরে যেনো জং ধরে গিয়েছে তৈমূরের। হাতের আঙুল আর ঘাড়ে করছে টনটনে ব্যথা। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখতেই ভীষণ অবাক হলো সে। অফিস টাইম শেষ হয়েছে আরো এক ঘণ্টা আগে। অথচ সেদিকে কিনা কোনো খেয়ালই ছিলো না তার?

সকালে নাস্তার টেবিলে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি মনে পড়তেই অপ্রত্যাশিত এক দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এলো তৈমূরের। সারাদিনে একবারও ফোন করে নেওয়া হয়নি বাড়ির কারো খোঁজ। হুট করে রেগে যাওয়াটা কী তবে উচিত হয়নি তার? বুঝতে পারছে না তৈমূর। টেবিলের উপর থেকে প্রয়োজনীয় কিছু ফাইল ব্যাগে ভরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতেও পেরোবে ঘণ্টা। তার মধ্যে রাস্তায় জ্যাম থাকলে তো আর কথাই নেই।

বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে পড়ছে বাজ। কখন নামলো এই অবাধ্য বৃষ্টির ধারা? সেসবও জানা নেই তৈমূরের। আজ কী তবে একটু বেশিই আনমনা ছিলো সে? কে জানে? বেশি কিছু আর না ভেবে অফিস থেকে বেরিয়ে দ্রুত হেঁটে গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার ইঞ্জিনে স্টার্ট দিলো। তৎক্ষণাৎ বৃষ্টির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে ছুটে চললো গাড়িটি।

বৃষ্টির সাথে কারেন্টের যেনো রয়েছে গভীর এক শত্রুতা। নইলে বৃষ্টি আসতে না আসতেই কেনো পুরো ধরণীকুলকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে চলে যায় সে?

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখে রাতের খাবার সেরে ঘরে চলে গিয়েছে বাড়ির প্রবীণরা। এতক্ষণে হয়তো কেউ কেউ নাক ডেকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্নও হয়ে পড়েছে। পুরো বাড়ি জুড়ে এখন শুধু নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারে ঘেরা। এই নিস্তব্ধতাকেই সঙ্গী করে খোলা বারান্দায় এক এলোকেশী বসে আছে। জোরে জোরে বাজ পড়ার শব্দেও যেনো টনক নড়ছে না তার। সকালের সেই ঘটনার পর থেকে একবারের জন্যও ঘর থেকে আর বের হয়নি উথমী। এমনকি মালতী ফুফুর ডাককেও অগ্ৰাহ্য করে জেদ চেপে ধরে বসে ছিলো ঘরে।

বৃষ্টির দিনে রাস্তা থাকে ফাঁকা। সেই ফাঁকা রাস্তার কারণেই এক ঘণ্টার রাস্তা মাত্র চল্লিশ মিনিটেই পাড়ি দিয়ে এলো তৈমূর। গেইট দিয়ে ভেতরে যখন তার গাড়িটি প্রবেশ করল তখন হাতঘড়িতে দশটা বেজে এক চল্লিশ মিনিট। গাড়ির ভেতর থেকে এক্সট্রা ছাতা নিয়ে নেমে গেলো সে। অর্ধ নামানো জানালার কাঁচে মাথা ঝুঁকে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললো,“আজ রাতে আর বৃষ্টি থামবে বলে মনে হয় না আশফাক। তুমি বরং গেস্ট রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো। কাল সকালে একেবারে আমায় অফিসে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি চলে যেও।”

তার কথার পৃষ্ঠে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় আশফাক। আশানুরূপ সাড়া পেয়ে বিশাল ভবনটির দিকে এগিয়ে যায় তৈমূর। মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে কলিং বেলে চাপ দেয়। পরপর বেশ কয়েকবার বাজানোর পর অবশেষে ভেসে আসে পরিচিত, বিরক্তিমাখা কণ্ঠস্বর,“খুলতাছি, খুলতাছি। একটু সবুর করো বাপ।”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই কলিং বেল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ধৈর্য ধরে দাঁড়ায় তৈমূর। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির তেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেলী ফুলের গন্ধে মাদকতা ছড়িয়ে গিয়েছে চারিদিকে। তার খানিক বাদে সদর দরজাটা খুলে গেলো। দৃষ্টিগোচর হলো দরজার ওপাশে মোমবাতি হাতে দাঁড়ানো মালতী ফুফুকে। মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। শুধালো,“কারেন্ট কখন গিয়েছে?”

দরজা লাগিয়ে তার হাত থেকে ভেজা ছাতাটা নিজ হাতে নিয়ে নিলেন মালতী ফুফু। উত্তর দিলেন,“গেছে তো নয়ডার আগে। মনে হয় না আইজকা রাইতে আর আইবো।”

“ওহ, তাহলে আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন ফুফু।”

“রাতের খাওন খাইবা না তুমি?”

“না, বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।”

“বাহির থাইক্কা?”—-বলেই ভ্রু কুঁচকে নিলেন তিনি।

বিস্তারিত বলার প্রয়োজন মনে করল না তৈমূর। শুধু বললো,“হ্যাঁ, আম্মা খেয়েছেন?”

“হ খাইছে, এতক্ষণে মনে হয় ঘুমাইয়াও গেছে। তোমার লাইগ্গাই বইসা আছিলাম। খাওনের পর তো আবার সব ফিরিজে রাখতে হইবো।”

“রেখে দিন তবে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।”—–কথাটা বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় সে।

“মায়ের কথা জিগাইলা কিন্তু বউয়ের কথা তো জিগাইলা না। বিয়া যে করছো সেইডা কী ভুইলা গেছো নাকি?”

পেছন থেকে বলা মালতী ফুফুর কথাটি শুনতেই পথিমধ্যে থেমে যায় তৈমূর। কুঞ্চিত হয় ভ্রু দ্বয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে শুধায়,“ভুলবো কেনো? উনি খাননি?”

“না খায় নাই। তুমি রাগ দেখাইয়া সকালে যে চইল্লা গেলা তার লাইগা মেজো ভাবী তোমার বউরেই খারাপ কথা হুনাইছে। সেই রাগে আর জিদ্দেই সকাল থাইক্কা না খাওয়া। কতবার ডাকলাম কিন্তু একবারও নিচে নামলো না। এই যুগের মাইয়া মাইনষের রাগ মানেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ কইরা দিয়া ঘরে বইয়া থাকা। কেডায় হেগো বুঝাইবো? এইডা বাপের বাড়ি না যে রাগ কইরা না খাইলেই মুখের সামনে কেউ খাওন আইনা ধরবো। তুলোধোনা কইরা খাওয়াইয়া দিবো।”—-বলেই মুখ বাঁকালেন তিনি।

একনাগাড়ে বলা কথাগুলো শুনে থমকে গেলো তৈমূর। ভেতরটা অস্থিরতায় ফেটে পড়ল। মেয়েটিকে সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতি মনে করেছিল। অথচ সেই বুদ্ধিমতি মেয়েই কিনা রাগ করে সারাটাদিন না খেয়ে কাটিয়ে দিলো? কার উপর তার এতো রাগ? তৈমূরের উপর? সকালের ঘটনায় কী তবে কষ্ট পেয়েছে সে? নাকি রাগ করেছে?

ভেজা ছাতাটা রেখে এসে পূর্বের ন্যায় তাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ললাটে ভাঁজ পড়ল মালতী ফুফুর। শুধালেন,“তুমি এহনও দাঁড়াইয়া আছো ক্যান? ঘরে গিয়া তাড়াতাড়ি কাপড় বদলাইয়া হাত-মুখ ধৌ। নইলে অসুখ বিসুখ হইবো।”

“ফুফু! উনার খাবারটা একটু বেড়ে দিন তো। একেবারে খাবারটা সঙ্গে নিয়েই উপরে যাবো।”

“তুমি নিয়া যাইবা?”

“হ্যাঁ দিন।”

মালতী ফুফু আর দেরি করলেন না। কথা মোতাবেক মোমের আলোতেই খাবার বেড়ে ট্রেতে সাজিয়ে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে তুলে দিলেন তৈমূরের হাতে। সাথে দুটো মোম আর দেশলাই কাঠির বাক্সও দিয়ে দিলেন। তৈমূর সেটা নিয়ে আবারো উনাকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ে চলে এলো কক্ষে।

কক্ষ জুড়ে চাপা নিস্তব্ধতা। চাপিয়ে রাখা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল তৈমূর। মোবাইলের আলোয় খুঁজে টেবিলের উপর খাবারের ট্রে টা রেখে মোম জ্বালালো। সঙ্গে সঙ্গেই পুরো ঘরটায় অন্ধকার কেটে গিয়ে ধারণ করল হলুদ বর্ণ। পরিধেয় পোশাকের ভেজা অংশগুলো এতক্ষণে শরীরেই শুকিয়ে গিয়েছে। তাই আর দেরি করল না তৈমূর। আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করল। পোশাক বদলানোর জন্য এলেও একেবারে গোসল সেরে তারপরেই বেরিয়ে এলো। ঘরটা পূর্বের ন্যায় এখনো ফাঁকা। তোয়ালের সাহায্যে ভেজা চুল মুছতে মুছতে চারিদিক অবলোকন করল তৈমূর। কাঙ্খিত ব্যক্তিটিকে দেখতে না পেয়ে ললাটে ভাঁজ পড়ল। চিন্তিত এবং গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলো,“উথমী! কোথায় আপনি? উথমী! শুনছেন?”

এতো ডাকাডাকির পরেও বিপরীত পাশ থেকে এলো না কোনো সাড়াশব্দ। চিন্তা বাড়লো তৈমূরের। দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো খোলা বারান্দার দিকে। সেদিকেই কয়েক কদম এগিয়ে গেলো সে। তৎক্ষণাৎ ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে এলো উথমী। মুখোমুখি হলো দুজনে।পিঠ পর্যন্ত ঘন কালো চুলগুলো মেয়েটার এলোমেলো। ওড়নার একপাশ ভেজা, সাথে হাত দুটোও। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মুখটাও কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। তার অনুভূতিহীন আঁখি যুগলে দৃষ্টি স্থির করে তৈমূর প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এই ঠাডা পড়া বৃষ্টির মধ্যে আপনি বারান্দায় গিয়ে বসে ছিলেন কেনো? ভয়ডর বলে কিছু নেই?”

প্রশ্নটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলো উথমী। স্বামীকে পাশ কাটিয়ে প্রবেশ করল কক্ষের ভেতরে। ওড়না দিয়ে হাত দুটো মুছে ভেজা ওড়নাটা অযত্নে মেঝের একপাশে ফেলে রেখে আলমারি খুললো নতুন আরেকটি ওড়না বের করার উদ্দেশ্যে। শীতল দৃষ্টিতে সেসব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো তৈমূর। এগিয়ে গিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে অনুতপ্ত হয়ে বললো,“স্যরি।”

এবার সকল নিরবতা ভেঙে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো উথমী, “কেনো?”

“সকালের ঘটনার জন্য।”

কথাটায় আবারো নিরব হয়ে গেলো উথমী। সরে গিয়ে বসলো বিছানায়। কিন্তু স্ত্রীর মান অভিমানের খেলায় তৈমূর দমলো না। কীভাবে মেয়েদের রাগ ভাঙাতে হয় সেসব সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা না থাকলেও একটু চেষ্টা তো করাই যায়। টেবিল থেকে খাবারের ট্রে আর মোমবাতি নিয়ে স্ত্রীর মুখোমুখি বিছানায় এসে বসলো তৈমূর। মোমবাতিটা রাখলো বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে। তারপর খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললো,“সারাদিন খাননি কেনো?”

“এমনিই।”

“এমনিই? এমনি এমনি কেউ না খেয়ে থাকে? সত্যি করে বলুন খাননি কেনো? এভাবে না খেয়ে থাকলে তো শরীর খারাপ করবে।”

প্রত্যুত্তর করল না উথমী। বরং তার চোখেমুখে ফোটে উঠলো বেজায় বিরক্তি। যা সহসাই টের পেলো তৈমূর। শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখের সামনে এক লোকমা খাবার ধরে বললো,“দেখি হা করুন।”

আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো উথমী। কঠোর স্বরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বললো, “খাবো না আমি। সরুন এখান থেকে।”

“কেনো খাবেন না? খাবারের সাথে আবার কীসের এতো রাগ? নাকি আমার উপরের রাগটাই খাবারের উপর দেখাচ্ছেন? এটা কিন্তু ঠিক নয়।” তারপর করুণ সুরে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,“আপনি কী শুধুই রেগে আছেন নাকি অভিমানও করেছেন উথমী?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর পানে তাকায় উথমী। স্বামীর করুণ চাহনি দেখতেই মনে মনে আওড়ায়,“যে বুকের বা পাশে আস্ত এক গাণিতিক যন্ত্র পুষে, সে কীভাবে বুঝবে সঙ্গিনীর রাগ, দুঃখ, অভিমানের ভাষা? যে সারাজীবন মুখস্থ করে এসেছে মৌল, বিবর্তন, তত্ত্বসহ প্যাঁচানো সব অংকের সূত্র, সে কীভাবেই বা বুঝবে সাহিত্যের কাব্য কথা?”

মনে মনে সেসব আওড়ালেও মুখ ফোটে বলে না কিছুই। তার নিরবতায় হতাশ হয় তৈমূর। রাগ প্রকাশ না করে এমন শান্তশিষ্ট থাকা মেয়ে মানুষ বড়োই বিপদজ্জনক। বুকের ভেতরে রাগ, দুঃখ, অভিমান পুষে রেখে বসে থাকলে সঙ্গী সেসব নিরাময় করবে কী করে? পুনরায় তাগাদা দিয়ে বললো,“অনেক রাত হয়েছে উথমী। খেয়ে নিন। খুব ক্লান্ত লাগছে আমার। সকাল সকাল উঠতে হবে তো?”

“আমি তো আপনাকে ঘুমাতে নিষেধ করিনি। ঘুমান আপনি। আমার ব্যাপারে আপনার না ভাবলেও চলবে।”

কথাটা বলে বিছানা থেকে উঠে যেতে নিলো উথমী। তৎক্ষণাৎ নিজের বাম হাত দিয়ে তার ডান হাতটা টেনে ধরে তাকে আটকে দিলো তৈমূর। আচমকাই ঘটিয়ে ফেললো একটি অপ্রত্যাশিত কাজ। নিজের শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা চুম্বন বসিয়ে দিলো স্ত্রীর কপোলে।

এমন কান্ডে চমকালো, থমকালো উথমী। দাঁড়িয়ে গেলো দেহের সমস্ত লোমকূপ। ভেতরটা ধক করে উঠলো। সাথে হয়ে গেলো বাকরুদ্ধ। ফ্যালফ্যাল নয়নে সামনে বসে থাকা অত্যন্ত হাবাগোবা দেখতে ভদ্রলোক নামক অভদ্র লোকটির পানে তাকিয়ে স্বীয় হাতটি ঠেকালো চুম্বনকৃত স্থানটিতে। তার এহেন হাবভাবে চমৎকার হাসলো তৈমূর। সুযোগের সৎ ব্যবহার করে হাতে ধরে রাখা লোকমাটি স্ত্রীর মুখে ঠুসে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,“আমার বাবা বলতেন অন্যের উপর রাগ করে না খাওয়া মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মানুষ। এরা অন্যের উপর রাগ করে মন মস্তিষ্কেও অশান্তি সৃষ্টি করে আবার নিজের পেটসহ গোটা দেহকেও কষ্ট দেয়। অথচ আপনাকে আমি চতুর এক নারী মনে করেছিলাম উথমী। সে যাই হোক, আরেকবার খাবো না খাবো না করলে কিন্তু আপনার খবর আছে।”

চোখমুখ কুঁচকে নিলো উথমী। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখের খাবারটুকু ভালো করে চিবিয়ে গিলে ফেললো। তেজি কণ্ঠে শুধালো,“কী খবর করবেন আপনি? হ্যাঁ? হুমকি দিচ্ছেন আমায়?”

“হুমকি দিবো কেনো? বউকে কী হুমকি দেওয়া যায়? তবে মনে রাখবেন বাসর রাতটা এখনো বকেয়া হিসেবে তুলে রাখা আছে। আর হ্যাঁ, এই বকেয়া জিনিসটা কিন্তু আমার একদম পছন্দ নয়। বাকির কাজ ফাঁকি। এখন আপনি যদি আমার অবাধ্য হন তাহলে তো সেই বকেয়া আমায় দ্রুতই আদায় করতে হবে। তাই না?”

লোকটির কথায় চরম আশ্চর্য হলো উথমী। সাদাসিধে দেখতে এই মানুষটির মনে মনে এতোটা? দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“আমি আপনার এসব হুমকি ধামকিকে ভয় পাই না। যা করার করে নিন।”

কথার ফাঁকে আরেকটি লোকমা স্ত্রীর মুখে ঠুসে দিয়ে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো তৈমূর। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আদর, ভালোবাসা চাইছেন? তা এটা সরাসরি বললেই তো হতো। আপনি বললে কী আমি দিতাম না? এতো নাটকীয়তার কী প্রয়োজন ছিলো উথমী?”

“আমি নাটক করছি? আমি? আমার রাগকে আপনার নাটক মনে হচ্ছে তৈমূর সাহেব! সত্যি সত্যিই আপনি লাগামহীন অসহ্য একটা পুরুষ মানুষ। আপনার সাথে কোনো কথা নেই।”

“আচ্ছা আমি অসহ্যই। এবার দ্রুত খাওয়া শেষ করুন। অলমোস্ট বারোটা বেজে গিয়েছে।”

“আর খাবো না।”

“তো কী খাবেন? আরো চুমু? নাকি অন্যকিছু?”

রাগ তড়তড় করে বৃদ্ধি পাচ্ছে উথমীর। তার সেই রাগত মুখশ্রী দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ মজা পেলো তৈমূর। বিপরীতে আর কোনো বাক্য বিনিময় না করে হাস্যোজ্জ্বল মুখেই খাইয়ে দিতে লাগলো স্ত্রীকে। উথমীও আর বাঁধ সাধলো না। কে জানে কখন আবার বেফাঁস কিছু বলে ফেলে লোকটা?

প্লেট ফাঁকা হতেই হাত ধুয়ে এঁটো প্লেটটা ট্রেতে করে টেবিলের উপর রেখে দিলো তৈমূর। তারপর মোম নিভিয়ে সোজা বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই শক্ত হাতে পূর্বের ন্যায় এখনো একই জায়গায় পেত্নীর মতো বসে থাকা স্ত্রীকে হেঁচকা টানে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে জড়িয়ে নিলো বাহুডোরে। তৎক্ষণাৎ ব্যথায় ‘আহ সূচক’ শব্দ করে উঠলো উথমী। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“এই লোহার মতো শক্ত হাত দিয়ে আমায় আর একদম এভাবে টানা হেঁচড়া করবেন না। ছাড়ুন।”

কথাটা শুনেও না শোনার ভান ধরে রইলো তৈমূর। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেই স্ত্রীর মাথাটা চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। সিঁথিতে আলতো করে চুমু দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নিরব রইলো। চুলের ভাঁজে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,“রাগ, অভিমান থেকে শুরু করে যা করার সব আমার উপর করবেন। তা না হয় আমি মেনে নিবো। কিন্তু আমার পরিবার অথবা খাবারের উপর এসব চলবে না উথমী। বলেছিলাম না আপনাকে?”

“হ্যাঁ এখন সব দোষ তো আমার। আর আপনার মা যে নোংরা নোংরা কথা বললো? অযথা ঝামেলা করল? তখন তো কিছু বললেন না? বরং আমি প্রতিবাদ করার সঙ্গে সঙ্গে আমায় ধমকালেন। মা ভক্ত পুরুষ মানুষ। আগে জানলে কখনোই আপনাকে বিয়ে করতাম না।”

বাহিরে বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। ইট পাথরের তৈরি দেয়ালের ভেতরে বৃষ্টির শব্দ শোনা না গেলেও ক্ষণে ক্ষণে বাজ পড়ার বিশ্রী ভয়ার্ত শব্দটা ঠিকই শোনা যায়। তবে তৈমূরের শ্রবণালী দিয়ে শুধুই খেলা করছে স্ত্রীর অভিমানী কথা আর নিঃশ্বাসের শব্দ। সেই শব্দেই বুক ভারি হয়ে আসে তার। এবার আর প্রত্যুত্তর করার মতো খুঁজে পায় না যুক্তি সংগত কোনো বাক্য। তাই চুপ থাকে। মেয়েটির খোলা চুলের ভাঁজে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বুঁজে নেয় নিজ আঁখি যুগল।
____________

পুরো শহরতলীকে বর্ষার জলে ভিজিয়ে দিয়ে শেষরাতে বিদায় নিয়েছে বৃষ্টি কন্যা। সেই সাথে বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে বাড়ির গৃহিণীদের কাজকর্ম। বারান্দার আনাচে কানাচে থেকে শুরু করে টবে জমে আছে বৃষ্টির পানি। কিছু কিছু টব উল্টে পড়ে ভেঙে গিয়েছে গাছগুলোর ডালপালা। কাজের ছুটা বুয়া দুটো আসতে এখনো ঢের দেরি। তাই ভোর জাগা পাখি ছোট্ট মেয়েটাকে শ্বশুরের কোলে চাপিয়ে দিয়ে পুরোনো কাপড় দিয়ে মেঝের পানি মুছছে রিনিতা।

“ইশ! কী একটা অবস্থা হয়েছে? সন্ধ্যাতেই যদি সবগুলো টব ভেতরে এনে রাখা হতো তাহলে আর এমন হতো না।”

শাশুড়ির কথায় মাথা তুলে তাকায় রিনিতা। সায় জানিয়ে বলে,“তা ঠিক কিন্তু বিকেলে কী রোদ ছিলো দেখেননি আপনি? কে জানতো যে রাতে এমন ঝড় বৃষ্টি হবে? তার উপর রাত বিরেতে আপনার নাতনির না ঘুমানোর পায়তারা। এসবের জেরে সব ভুলে গিয়েছি মা।”

পুত্রবধূর কথার বিপরীতে মাথা নাড়ান কেয়া। ভেতরের দিকে হাঁটা ধরে চিৎকার করে ডাকেন, “ঊষা! এই ঊষা! সারাক্ষণ ঘরে বসে মোবাইল নিয়ে মুচকি মুচকি হাসা ছাড়া কী আর কোনো কাজ নেই তোর? একটু তো ভাবীর হাতে হাতেও সাহায্য করতে পারিস নাকি?”

ঘুম থেকে উঠে এখনো ব্রাশ করা হয়নি ঊষার। বিছানা থেকে শুরু করে মাথার চুল, সবই তার এলোমেলো।পড়ার টেবিলে মোবাইল হাতে বসে আছে সে। মায়ের কথাটি শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই যেনো বিরক্ত হলো। শুনেও না শোনার ভান ধরে পূর্বের ন্যায় বসে রইলো। মেয়ের এমন খামখেয়ালিপনায় রাগ হলো কেয়ার। গলার আওয়াজ বাড়িয়ে পুনরায় বললেন,“ডাকছি যে শুনছিস না? কী করছিস ঘরে বসে?”

মায়ের কণ্ঠে রাগের আভাস পেয়ে এবার আর ঝুঁকি নিলো না ঊষা। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ঘরের বাহিরে। কণ্ঠে অঢেল বিরক্তি ঢেলে শুধালো,“সকাল সকাল এভাবে চেঁচামেচি করছো কেনো?”

নাতনিকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিলেন রায়হান কবীর। স্ত্রীর উচ্চবাচ্যে এতক্ষণ তেমন কোনো গুরুত্ব না দিলেও মেয়ের কথায় উনার ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,“দিনদিন তোর আচরণে যেনো একটু বেশিই বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে? তা কী এমন মহান কাজকর্ম করছিস যে মায়ের কথায়ও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিস?”

বাবার কণ্ঠস্বর পেতেই মুহূর্তের মধ্যে ভাবভঙ্গির বদল হলো ঊষার। দরজা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু তা আর বলার মতো সুযোগ পেলো না। রায়হান কবীর ধমকের সুরে বললেন,“যা গিয়ে তোর ভাবীর কাজে সাহায্য কর।”

বাবার ধমকে কেঁপে উঠলো ঊষা। মিনমিনে গলায় বললো,“ভার্সিটিতে যেতে হবে বাবা। ইম্পর্ট্যান্ট একটা ক্লাস আছে।”

গরম চোখে মেয়ের পানে তাকান রায়হান কবীর। তারপর যেতে যেতে বলেন,“তাহলে ফিরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করিস। কথা আছে।”

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)