জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-১২+১৩

0
18

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১২]

আকাশ ফকফকা পরিষ্কার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের উত্তাপ। ধীরে ধীরে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। গতকাল রাতে বৃষ্টির সাথে আগমন ঘটা শীতল হাওয়া আর ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটার বিলুপ্তি ঘটেছে সূর্যের দাপটে। রাস্তায় ধূলো উড়ছে, সাথে বেঁধেছে বিশাল এক জ্যাম। সেই জ্যামেই আটকে পড়েছে তৈমূর। গাড়িতে বসে খানিক বাদে বাদে ব্যস্ত দৃষ্টি স্থির করছে হাতঘড়ির পানে। বাড়ি থেকে তার অফিসের দূরত্ব ঘণ্টা খানেকের পথ। জ্যাম লাগলে তো আর কথাই নেই। চাকরির শুরুতে অবশ্য তৈমূর চেয়েছিল অফিসের কাছাকাছি কোথাও থাকতে কিন্তু শাহানার এতে ছিলো ঘোর আপত্তি। কিছুতেই অতোদূর ছেলেকে ছাড়বেন না, করবেন না নিজের থেকে আলাদা। সন্তানদের প্রতি উনার এই টানটা সবসময়ই একটু বেশি। তাই অগত্যা মায়ের কথায় হার মেনে নিয়ে রোজ রোজ এভাবেই বাড়ি থেকে অফিস আর অফিস থেকে বাড়িতে যাতায়াত করতে হয় তাকে।

একটু পরপর চালকের আসনে বসা ড্রাইভার আশফাক কাঁচ নামিয়ে ঘাড় বের করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। বিড়বিড় করে উদ্ধার করছে ট্রাফিক পুলিশের গোষ্ঠী। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তৈমূর। কাঁচ নামিয়ে সুদীর্ঘ শ্বাস টেনে পাশের সিট থেকে তুলে নিলো একটি ফাইল। কিন্তু তাতে আর মনোযোগ বসাতে পারলো না সে। শ্রবণালীতে এসে বাড়ি খেতে লাগলো কারো প্রাণোবন্ত হাসির জোয়ার। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে চোখের চশমাটা ঠিক করে জানালার বাহিরে দৃষ্টি রেখে হাসির উৎস খোঁজার চেষ্টা করল তৈমূর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা মিললো হুড নামানো রিক্সায় বসা এক জোড়া কপোত কপোতীর। কিন্তু এই হুড নামানোর কারণেই চেহারা তাদের অস্পষ্ট।

দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তৈমূর। হতাশ কণ্ঠে বললো,“মেইন রাস্তা দিয়ে না এলেই পারতে আশফাক। এখন এই জ্যাম কখন ছাড়ে কে জানে? এই জ্যামের কারণে অফিস পৌঁছাতে তো দেরি হবেই তার সঙ্গে আজও বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।”

“প্রথমে তো রাস্তা ঠিকই ছিলো স্যার। এভাবে জ্যাম পড়বে কে জানতো? সব দোষ এই বাস ড্রাইভারদের। শালারা প্যাসেঞ্জার ওঠানোর জন্য যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে দেয়।”—–বলতে বলতেই সুযোগ মতো একটু একটু করে গাড়িটা সামনে এগিয়ে নেয় আশফাক।

তৈমূর আর প্রত্যুত্তর করে না। একপল বাহিরে তাকিয়ে জানালার কাঁচ ওঠানোর উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়। পরিচিত কিছু দেখলো মনে হওয়ায় পুনরায় আবারো তাকালো সেদিকে। গাড়ির পাশে দাঁড়ানো একটি সিএনজি। তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা হুড নামানো রিক্সাটির হুড এখন তোলা। যার ফলে রিক্সায় বসে থাকা সেই কপোত কপোতীর মুখশ্রী এবার সুস্পষ্ট।

অল্প বয়সী, হ্যাংলা পাতলা ছেলেটিকে চিনতে না পারলেও পাশে বসে হাসতে হাসতে ছেলেটির গায়ের উপর ঢলে পড়া মেয়েটিকে চিনতে তেমন অসুবিধে হলো না তৈমূরের। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে পরপর তিনবার মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছে তার। বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,“উথমীর ছোটো বোন ঊষা না এটা? ও এখানে কী করছে?”

নানা ধরণের ভাবনা ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে তাদের কয়েকটা ছবি তুলে নিলো তৈমূর। তারপর আবারো গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো দুজনকে। ডাকবে কী ডাকবে না? সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ভুগতে ভুগতে রাস্তার জ্যামটা ছেড়ে দিলো। এই অতিষ্ঠ করা জ্যাম থেকে মুক্তি পেয়ে একে একে গাড়িগুলো সামনের পথ ধরে ইতোমধ্যে চলা শুরু করে দিয়েছে। আশফাক গাড়ি চালাতে চালাতে প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠলো,“উফ অবশেষে ছাড়লো তবে!”

সাথে হয়তো আরো কিছু বললো কিন্তু সেসব তৈমূরের শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে তাকিয়ে রইলো ফেলে আসা পথের দিকে। ততক্ষণে রিক্সাটাও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে দৃষ্টির আড়ালে।

উথমীর মনটা আজ ফুরফুরে। সকাল সকাল আজ আর কারো নিকট হতে কোনো কটু বাক্য শুনতে হয়নি তাকে। পড়তে হয়নি কারো রোষানলের খপ্পরে। পুত্রবধূর রান্নার কোনো দোষ না ধরে নিরবে সকালের নাস্তা শেষ করেছেন শাহানা। তারপর ছেলেকে বিদায় জানিয়ে বসেছেন অন্দরমহলে।

গতকাল বাবার নাম্বার থেকে পরপর তিনবার ফোনকল এসেছিল উথমীর নাম্বারে। কিন্তু সেই কল আর রিসিভ করা হয়নি তার। এমনকি ফিরতি কলটাও দেয়নি মেয়েটি। ছোটো থেকে বাবার সাথে তেমন একটা সখ্যতা না থাকলেও মেয়ের মুখ দেখেই মেয়ের মন খারাপ বুঝে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলো রায়হান কবীরের। যা উথমীর অজানা নয়। শাশুড়ির কটু বাক্যে তার অতোটা খারাপ না লাগলেও স্বামীর অমন আচরণ, খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়াই তার রাগ, অভিমান আর মন খারাপের প্রধান কারণ। কীভাবে ওই মন খারাপ নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতো উথমী? যদি বুঝে যেতো বাবা? কী হতো তখন? জানে না সে। তবে বাবা যে ভেতরে ভেতরে দুঃখের অনলে জ্বলতেন তা ঠিকই উথমী জানে। তাই আর সাতপাঁচ না ভেবে কল দিলো বাবার নাম্বারে। সেকেন্ড দুয়েকের মধ্যেই তা রিসিভও হয়ে গেলো কিন্তু উনাকে কিছু বলতে না দিয়েই উথমী ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,“আসসালামু আলাইকুম বাবা। হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দিচ্ছি, ধরো।”

কথাটা শেষ হতেই বিচ্ছিন্ন হলো দু ধারের সংযোগ। হুট করে মেয়ের চঞ্চল কণ্ঠে আশ্চর্য হলেন রায়হান কবীর। তার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মেয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে এলো ভিডিও কল। চটজলদি রিসিভ করতেই দেখতে পেলেন মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী। স্লান হেসে শুধালেন,“কেমন আছিস মা?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো বাবা? নাস্তা করেছো?”

মেয়ের প্রশ্নে অধরের হাসিটা চওড়া হলো রায়হান কবীরের। উত্তর দিলেন,“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় তোর মা সকাল সকাল এক হাঁড়ি ল্যাটকা খিচুড়ি রেঁধেছে। তাই আচার দিয়ে খেলাম। তা তুই খেয়েছিস?”

খিচুড়ি শব্দটা শুনেই জিভে পানি চলে এলো উথমীর। যদিও আচারের সাথে খিচুড়ির কম্বিনেশনটা ভীষণ অপ্রিয় কিন্তু খিচুড়ি তার বরাবরই প্রিয়। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ খেয়েছি।”

“জামাই কোথায়?”

“অফিসে।”

“এতো শুকিয়ে গিয়েছিস কীভাবে? ঠিকমতো খাওয়া- দাওয়া করিস না নাকি?”

“সেসব ছাড়ো। বাড়ির সবাই কেমন আছে? আর তনি বুড়ি? ও কোথায়?”

“কোথায় আবার? ড্রয়িং রুমে নিজের খেলনা ঘোড়ায় চেপে কার্টুন দেখছে। গতকাল সকালে বিড়াল ছানার খামচি লেগে উনার আঙুল কেটে গিয়েছিল। তারপর থেকেই বড়ো ফুপির সাথে কথা বলার জন্য কী বায়না! তাই তোকে ফোন করেছিলাম কিন্তু তুই তো আর ধরলিই না।”

থতমত খেয়ে গেলো উথমী। আমতা আমতা করে বলে ফেললো মিথ্যা,“একদম খেয়াল করিনি বাবা। আমি তো নিচে ছিলাম। সারাদিন আর মোবাইল ধরা হয়নি। সেই রাতে গিয়ে কল লিস্ট চেক করে দেখি এই অবস্থা। তখন কী আর কল দেওয়া যায়? তুমি তো আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়ো।”

“ওহ, আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তোর ভাইকে আরো গিয়ে বললাম তৈমূরকে যাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করে তুই ঠিক আছিস কিনা।”

এভাবে আরো অনেকক্ষণ বাবা-মেয়ের মধ্যে চললো অসংখ্য কথাবার্তা। একপর্যায়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলো রিনিতা। শ্বশুরের থেকে মোবাইলটা চেয়ে নিলো নিজ হাতে। তারপর সেখান থেকে দূরে সরে গিয়ে স্ক্রীনে দৃষ্টি স্থির করে অভিযোগের সুরে বললো, “শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দেখছি সবাইকে ভুলে গিয়েছো উথমী? ব্যাপার কী হ্যাঁ?”

ভাবীকে দেখে ঠোঁটের কার্নিশের হাসিটা চওড়া হলো উথমীর। বললো,“বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি সপ্তাহ খানেকও হয়নি। আর তুমি বলছো ভুলে গিয়েছি?”

“সপ্তাহ পেরোয়নি বলে তুমি একটু যোগাযোগ করবে না? সে যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আবারো এখানে আসতে হবে।”

“কেনো ভাবী? কারো কিছু হয়েছে? কই বাবা তো কিছু বললো না।”

“না, কারো কিছু হয়নি কিন্তু তুমি তোমার প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র এখানেই রেখে গিয়েছো। গতকাল তোমার আলমারি আর টেবিল গোছাতে গিয়ে পেলাম। সময় করে একদিন এসে নিয়ে যেও।”

“কলেজের নাকি?”

“হয়তো, তবে খুলে দেখা হয়নি।”

“কী এক ঝামেলা বলো তো? ব্যাগ তো তোমরাই গুছিয়ে দিয়েছিলে। আমারো আর ধরা হয়নি। এখন আবার যেতে হবে!”

“বেশ তো বিয়ে করবো না, বিয়ে করবো না বলে বাড়ি মাথায় তুলেছিলে। এখন স্বামীকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছে না বুঝি? তা তৈমূর সাহেব কী এমন জাদু করল আমার ননদিনীকে?”—-দুষ্টুমির ছলে কথাটি বলে ভ্রু নাচালো রিনিতা।

সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা পেলো উথমী। লাজুক হেসে বিদায় জানিয়ে কেটে দিলো কল। ননদের এমন আচরণে বেশ মজা পেলো রিনিতা। দম ছেড়ে শ্বশুরের হাতে মোবাইল দিয়ে প্রস্থান করল।

অন্দরমহলে বসে পান চিবোতে চিবোতে দুই জা জয়নব এবং শাহানা মিলে গল্প করছেন। দুপুরের রান্নার সময় হয়ে এসেছে। জেবা, তিথিয়া না থাকলে বাড়িতে পাঁচজনের রান্না মালতী ফুফু একাই করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে বেশি একটা রন্ধনশালামুখো হন না শাহানা। তিনবেলার রান্না থেকে শুরু করে ঘরদোর পরিষ্কার মালতী ফুফু একা হাতেই করেন।

উথমী নিচে নেমে আজ আর কোনোদিকে তাকালো না। তাদের সামনে দিয়েই নিঃশব্দে রন্ধনশালার পথে হাঁটা ধরলো। তা আর দৃষ্টি এড়ালো না শাহানার। খুক খুক করে কেশে ভারি কণ্ঠে বললেন,“তৈমূ ঝাল মশলা কম খায়। ওর জন্য আলাদাভাবে রান্না করবে। আর আমার জন্য পাতলা ডাল, ঝাল ঝাল আলু ভর্তা সাথে ডিম ভাজি করলেই চলবে। দুপুরে আজ আর বেশি কিছু খাবো না।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই জয়নবও তাল মিলিয়ে বললেন,“আমার আর তোমার চাচা শ্বশুরের জন্যও পাতলা ডাল, ভর্তা, ডিম ভাজি করলেই চলবে।”

শাশুড়ি এবং চাচী শাশুড়ির নির্দেশনা চুপচাপ শুনে প্রস্থান করল উথমী। প্রত্যুত্তর করার মতো কোনো ধরণের ইচ্ছেই হলো না তার।
_________

পুব আকাশে বিবর্ণ মেঘ জমেছে। সূর্য ডুবেছে অনেক আগে। বাহিরে বইছে তুমুল হাওয়া। আকাশে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবহাওয়ার এমন অবস্থা দেখে আজ আর কোনো ভুল করল না রিনিতা। খোলা বারান্দার টপগুলো একে একে সব সুরক্ষিত স্থানে রেখে নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেললো।

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পিতার সম্মুখে থিতু হয়ে বসে আছে ঊষা। মুখশ্রীতে কেমন ছটফটে, চোরা চোরা ভাব। পিতা রায়হান কবীর এতক্ষণ ধরে বসে মেয়ের সেই হাবভাবগুলোই দেখছেন।কিছু সময় পর নিরবতার অবসান ঘটিয়ে শুধালেন,“সারাদিন কোথায় ছিলি?”

ছোট্ট, সাধারণ একটি প্রশ্ন অথচ এই প্রশ্নটিই ঊষার মনের ভয়টা তড়তড় করে বৃদ্ধি পাইয়ে দিলো। এসির হাওয়ায় পুরো ঘর বরফের ন্যায় ঠান্ডা হওয়ার পরেও কপালে আর নাকের ডগায় তার ঘাম জমেছে। আমতা আমতা করে উত্তর দিলো,“কোথায় আবার? ভার্সিটিতে ছিলাম।”

“ওহ, তা কী কী ক্লাস হলো আজ?”

“ম্যানেজমেন্ট হয়েছে। ইংলিশও হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু স্যার হুট করেই ক্যান্সেল করে দিয়েছিলেন।”

“সারাদিন ধরে কী এই একটা ক্লাসই হয়েছে? বাড়ি ফিরতে এতো দেরি হলো কেনো?”

“ফ্রেন্ডদের থেকে কিছু নোটস কালেক্ট করার ছিলো। তার উপর বাংলা ডিপার্টমেন্টে কনসার্টও ছিলো তাই আসতে একটু।”—-ইনিয়ে বিনিয়ে এতটুকু বলেই থামলো সে। তারপর সরাসরি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভঙিতে শুধালো,“হঠাৎ এসব প্রশ্ন করছো যে? তুমি কী আমায় সন্দেহ করছো বাবা?”

মেয়ের প্রশ্নে মুখভঙ্গি বদলালো রায়হান কবীরের। রূষ্ট কণ্ঠে বললেন,“লেখাপড়ায় তুই এতো মনোযোগী যে রোজ রোজ সময়মতো ক্লাসে যাস, নোটস সংগ্রহ করিস। আবার সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে দরজা আটকে কোনো প্রকার শব্দ না করেই লেখাপড়া করিস। তারপরেও দু দুটো সাবজেক্টে ফেইল আসলো কীভাবে মা?”

পিতার ধমকের সুরে বলা কথায় কেঁপে উঠলো ঊষা। গোপন কথা জানলো কী করে বাবা? ভাবতেই ভয়টা তার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো। উনার চিৎকারে ভেতর থেকে দৌড়ে এলেন কেয়া বেগম। উদ্বেল হয়ে শুধালেন,“এই সন্ধ্যায় এমন করে মেয়েটার উপর চেঁচাচ্ছো কেনো তুমি? কী হয়েছে? কী করেছে ও?”

স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আরো রাগান্বিত হলেন রায়হান কবীর। এই স্ত্রীর অতি আশকারাতে ছোটো কন্যাকে কখনোই তিনি শাসন করতে পারেননি। সবসময় তার সকল দোষ ঢেকে দেওয়ার জন্য হাজির হয়ে যেতেন এই ভদ্রমহিলা। আজকেও তেমনটাই হলো। তাই স্ত্রীর পানে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তোমার কী মনে হয় আমি এমনি এমনি ওর উপর চেঁচাচ্ছি? তোমার এই আহ্লাদের কারণেই মেয়েটার আজ এতো অধঃপতন। থার্ড সেমিস্টারে দু দুটো সাবজেক্টে ফেইল করার পরেও একটাবার আমায় সেকথা বলেনি ও। উল্টো ফোর্থ সেমিস্টারের জন্য দু’মাস আগে কতগুলো টাকা নিয়েছে। টাকা কী গাছে ধরে? বড়ো দুই ছেলে-মেয়ে তো ঠিকই পাবলিক থেকে গ্ৰাজুয়েশন শেষ করেছে। তবে ও কেনো পারলো না? ওদের যা দিয়েছি তার থেকে বেশি ওকে দিয়েছি। তারপরেও কিছু বলিনি। তোমাদের কথায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছি।অথচ তোমার মেয়ে কিনা সেমিস্টারে ফেইল করে বাবার টাকা নষ্ট করছে?”

কথাগুলো শুনে ভীষণ অবাক হলেন কেয়া বেগম। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছোটো কন্যার পানে। বুকে হাত রেখে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে রায়হান কবীর পুনরায় বললেন,“শোনো উৎসর মা! মেয়ের ব্যাপারে এতোকাল তুমিই যখন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছো তাহলে তোমাকেই শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, গরীব ঘরে জন্মেছিলাম আমি। দিনমজুরের ছেলে হওয়ায় জীবনটা অনেক কষ্টে কেটেছে। লেখাপড়াটাও অনেক কষ্টে করেছি। তাই এতো টাকা পয়সা আমার নেই। অসৎ পথে টাকার পাহাড় গড়ার অনেক সুযোগ থাকলেও কখনো সে পথে পা বাড়াইনি শুধুই সৃষ্টিকর্তার ভয়ে। অর্ধেক জীবনের সঞ্চয় আর অফিস লোনের মাধ্যমে এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা তোমাদের জন্য কিনেছিলাম। তাই তোমার ছোটো মেয়ের বিলাসীতার পেছনে এতো এতো টাকা খরচা করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। এবারের সেমিষ্টারেও পাস করতে না পারলে অথবা ভালো সিজিপিএ না পেলে ওর লেখাপড়া এখানেই বন্ধ। তখন ভালো কোনো ছেলে খুঁজে ওকে বিয়ে দিয়ে দিও।”

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে প্রস্থান করলেন রায়হান কবীর। বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে নানা ধরণের চিন্তা ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলো ঊষা। বাবা তার এক কথার মানুষ। সত্যিই যদি তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়?

কেয়া বেগম মেয়ের হাতের কব্জি টেনে ধরে নিজের দিকে ঘুরালেন। শুধালেন,“কী বলে গেলো তোর বাবা? সত্যি সত্যিই তুই এভাবে টাকা পয়সা নষ্ট করছিস?”

তৎক্ষণাৎ সঠিক কোনো জবাব দিতে পারলো না ঊষা। তাকে নিরুত্তর দেখে হাতটা ছেড়ে দিলেন কেয়া বেগম। হতাশাগ্রস্থ দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে বসে পড়লেন সোফায়। এই মেয়েটিকে জন্মের পর থেকেই খুব আদরে বড়ো করেছিলেন তিনি। বাকি ছেলে- মেয়েদের থেকে ওর প্রতিই উনার টান ছিলো একটু বেশি। আর ওই কিনা এমন সব কাজ করেছে? ভাবতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো উনার। নতুন একটি প্রশ্নের উদয় হলো, এতকালের সব শিক্ষা দিক্ষা কী তবে ভুল ছিলো? মেয়েটিকে সত্যিই কী তিনি মানুষ করতে পারলেন না?
_______

টেবিলে রাতের খাবার পরিবেশন করছে উথমী। মালতী ফুফু খাওয়ার জন্য শাহানাকে ডাকতে গিয়েছেন। সন্ধ্যায় বয়ে যাওয়া সেই ঝোড়ো হাওয়া থেমে গিয়েছে, আকাশের বিদ্যুৎ চমকানো এখন আর নেই। মেঘ কেটে গিয়ে পূর্ণ চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে ধরণীতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহানা এসে চেয়ার টেনে বসলেন। হাত ধুয়ে ভাত মাখিয়ে খেতে লাগলেন মনোযোগ সহকারে। উথমীও নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে বসার জন্য চেয়ার টানলো। তৎক্ষণাৎ পুত্রবধূর পানে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি বসছো কেনো?”

“না বসে খাবো কীভাবে? তাই বসছি।”

“স্বামীকে রেখেই খেয়ে ফেলবে? এসব ছোটোখাটো নিয়ম কানুনও শেখোনি? এখন খাওয়া চলবে না। একেবারে তৈমূর এলে ওর খাওয়া শেষে তারপর খাবে।”

এমন নিয়মে ভীষণ অবাক হলো উথমী। বললো,“এটা আবার কোথাকার কোন নিয়ম? এমন নিয়মতো শুনিনি কখনো। আমার খিদে পেয়েছে আর আমি খেতে পারবো না? স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে অভুক্ত হয়ে বসে থাকবো?”

“মুখে মুখে কথা বলবে না একদম। এগুলো হচ্ছে সামাজিক নিয়ম। ছোটো থেকেই আমার মা, দাদী, ভাবী এমনকি বিয়ের পর শাশুড়িকেও এসব নিয়ম-কানুন পালন করতে দেখে এসেছি। তাদের দেখাদেখি আমিও করেছি। তাই আমার কথার উপর কথা বলবে না। স্বামীর জন্য যদি কিছু সময় অপেক্ষাই না করতে পারো তাহলে কীসের বউ তুমি?”

কথাটা চরম গায়ে লাগলো উথমীর। ভেতরে ভেতরে প্রবল ক্রোধে জ্বলে উঠলো। তবুও বাহ্যিকভাবে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস চালিয়ে সশব্দে টেবিলের উপর প্লেটটা রেখে স্থান পরিত্যাগ করল। কিন্তু সেসবে কোনো ভাবান্তর হলো না শাহানার। বরং আড়চোখে পুত্রবধূর প্রস্থান দেখে নিয়ে পুনরায় তিনি খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।

চলবে _________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৩]

ঘড়ির কাঁটায় দশটা ছুঁইছুঁই। অপেক্ষার প্রহর যেনো আজ কিছুতেই শেষ হচ্ছে না উথমীর। খিদের জ্বালায় পেটের অবস্থা তার করুণ। চোখে দেখছে সর্ষে ফুল। বিয়ের আগে সাড়ে নয়টার মধ্যে খাবার খেয়ে বিছানায় যাওয়া ছিলো তার রোজকার রুটিন। অথচ বিয়ের পর থেকে সব নিয়মকানুনগুলো যেনো ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। এমনকি সামান্য এই খাবার খাওয়া নিয়েও কেউ এতো নিয়মকানুন আরোপ করে? ভাবনাগুলো মাথায় আসলেই ভীষণ রাগ হয় তার। আর সেই রাগ, জেদের কারণেই শাশুড়ির নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় না খেয়ে মুর্তির ন্যায় বসে থাকে সোফায়।মনে মনে হাজারটা কটু বাক্য আওড়াতে থাকে স্বামী নামক মানুষটির উদ্দেশ্যে। উথমীর ধারণা মতে, এই লোকটি খুবই অসহ্যকর। বিয়ের পর ঠিকই তো বড়াই করে কত কথাই না বলেছিল, অথচ শেষমেশ হলো কী? কয়েকদিন অতিক্রম হতে না হতেই সেই কথার খেলাপ করে বসলো?

রাগে রীতিমতো কান্না চলে এলো উথমীর।অশ্রু জমলো চোখে। আশেপাশের সবকিছুই হয়ে উঠলো আবছা। বিড়বিড় করে নিজেই নিজের উদ্দেশ্যে বললো,“ভালো মানুষদের জীবনে শুধু পদে পদে দুঃখ, কষ্টই থাকে। মানুষ যেভাবে পারে সেভাবেই তাদের উপর জুলুম করে, নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয়। তুইও ভালো মানুষরে উথু। একটু বেশিই ভালো মানুষ।”

তার এই আহাজারির মধ্যেই কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। নড়েচড়ে উঠলো উথমী। ঘড়িতে একপলক চোখ বুলিয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে চললো সদর দরজা খুলতে। মালতী ফুফু আজ আর জেগে নেই। এতক্ষণে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন উনি।আজ আগেভাগেই উনাকে খাইয়ে দাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে উথমী। সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে নিজ কাঁধে।

দরজা খুলে সম্মুখে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত এবং অতি আকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে। পরনের ব্লেজার ঝুলছে তার বা হাতের ভাঁজে। দেহের জলপাই রঙের আয়রন করা টানটান শার্টটার অর্ধভাগ ঘামে ভেজা। গাড়ি থেকে নেমে সদর দরজা পর্যন্ত আসতে না আসতেই এতোটা ঘেমে যায় কীভাবে একটা মানুষ? পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিষ্পলক দৃষ্টিতে লোকটিকে দেখতে দেখতে এসব কথাই ভাবছিল উথমী। ততক্ষণে ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো তৈমূরের। স্ত্রীর দৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করে ক্লান্ত স্বরে বলে উঠলো,“দেখা শেষ হয়েছে? এবার কী আমি ভেতরে প্রবেশ করতে পারবো? যদি একটু প্রবেশের জায়গা দিতেন।”

নড়েচড়ে উঠলো উথমী। ধ্যান ভঙ হলো তার। দরজা আগলে এতক্ষণ যে সে দাঁড়িয়ে ছিলো বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। সাথে নিজের প্রতি নিজেই চরমভাবে রূষ্ট হলো। এভাবে এতক্ষণ কিনা হাবার মতো একজন পুরুষের পানে চেয়ে ছিলো সে? ছিঃ! যতোই লোকটি তার স্বামী হোক না কেনো তাই বলে এভাবে? দ্রুত সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো। ভেতরে প্রবেশ করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো তৈমূর,“ব্যাপার কী? আপনি এখনো জেগে আছেন যে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা আটকায় উথমী। উত্তর দেয়, “কোনো ব্যাপার না। স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছি আরকি।”

“স্ত্রীর দায়িত্ব?”—-প্রশ্নটির মধ্যে প্রকাশ পায় একরাশ সন্দেহ।

“হুম, তার আগে বলুন আপনার ফিরতে এতো দেরি হলো কেনো? কোন দেশ স্বাধীন করতে গিয়েছিলেন?”

গলার টাই আলগা করতে করতে স্ত্রীর কথা বলার ধরণে মুচকি হাসলো তৈমূর। জবাব দিলো,“অফিসের কাজ করে প্রমোশন পাওয়ার স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়েছিলাম।”

“প্রমোশন?”

“উহুম, মজা করলাম। আসলে ছুটির দিনে জমে থাকা কাজগুলো শেষ করতে গিয়েই ফিরতে দেরি হচ্ছে। ওদিকে সামনে আবার ইদ আসছে, তখনও বেশ কিছুদিনের ছুটি পড়বে। ততদিন বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হবে।”

কথাগুলো শুনে রাগের পারদ নিমিষেই গলে গেলো উথমীর। অপ্রস্তুত ভঙিতে মাথা নাড়িয়ে তাড়া দিয়ে বললো,“আচ্ছা ঘরে যান তবে। বাহিরের পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার বাড়ছি।”

কথাটা বলে ডাইনিংয়ের দিকে হাঁটা ধরলো উথমী। তৎক্ষণাৎ তাকে বাঁধা দিয়ে পেছন থেকে বলে উঠলো তৈমূর,“আমি খেয়ে এসেছি। খাবার বাড়ার প্রয়োজন নেই।”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ায় উথমী। পিছু ফিরে শুধায়,“খেয়ে এসেছেন?”

“হ্যাঁ, আপনি খেয়েছেন?”

এই মা-ছেলের কিছু কর্মকাণ্ডে চেয়েও যেনো নিজের রাগটাকে সংযত রাখতে পারে না উথমী। গলে যাওয়া রাগের পারদ নিমিষেই বরফের ন্যায় শক্ত রূপ ধারণ করল। ভারিক্কি কণ্ঠে বললো,“না খাইনি। আপনাদের বাড়িতে নাকি স্বামীর আগে স্ত্রী খেতে পারে না?”

“কে বললো এসব?”

“কে আবার? আপনার মা বলেছে। এরপর থেকে খেয়ে আসুন বা যাই করুন আপনার মাকে অবশ্যই জানিয়ে দিবেন নয়তো উনার বিভিন্ন নিয়মের যাঁতাকলে আমায় পিষ্ট হতে হচ্ছে। আর কারো যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”—-রাগে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলে প্রস্থান করল উথমী।

হুট করে রাগান্বিত হয়ে যাওয়া স্ত্রীর প্রস্থান অসহায় দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো তৈমূর। বোধগম্য হলো না ব্যাপারটা। বিয়ের আগে অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে রাতের খাবারটা সে বাইরে থেকেই খেয়ে আসতো। তাই অভ্যাসবশত আজকেও বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছে। তবে বাড়িতে যে স্ত্রী তার জন্য না খেয়ে বসে বসে অপেক্ষা করবে এমনটা যেনো তার ভাবনা বহির্ভূত ছিলো। নইলে কী আর এমনটা জানার পরেও এমন ভুল কেউ করে? কেউ করতে পারলেও তৈমূরের মতো পুরুষ কখনোই তা পারতো না। নিজের এই অপরাধবোধে অনুশোচনা হলো তৈমূরের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।

উথমীর রাগ আর অভিমান বরাবরই একটু বেশি। তবে সেই রাগ কিংবা অভিমান নিতান্তই চাপা ধাঁচের।অন্যদের মতো ভাঙচুর করা অথবা কারো উপর চিৎকার চেঁচামেচি করতে সে পারে না। পারে না ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে। আত্মসম্মানে বড্ড লাগে। তবে সেই রাগের জের ধরে নিজের উপর পাষণ্ডের মতো অত্যাচার, জুলুম অবশ্য ঠিকই চালাতে পারে। এই যেমন না খেয়ে থাকা, কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া, আবার ইচ্ছেমতো ঝাল খেয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে দেয়া। এখন এই অপশনগুলোর মধ্যে তিন নাম্বারটাই সে বেছে নিলো। শুকনো মরিচের গুঁড়া আর গুটি কয়েক কাঁচামরিচ একত্রে ভাতের সাথে পিষে পাষাণ নারীর ন্যায় গলাধঃকরণ করতে লাগলো। ঝালে তার জিভ জ্বালা করলেও কিছুতেই থামালো না সে নিজের কাজ। ইতোমধ্যে ডাগর ডাগর চোখ দুটো লালাভ হয়ে ধারণ করেছে পিশাচিনীদের রূপ। ঠোঁট দুটো হয়ে গিয়েছে টমেটোর মতো টসটসে। একসময় প্লেটের পুরো খাবারটা শেষ করে তবেই সে উঠলো। টেবিলের সব গোছগাছ করে আলো নিভিয়ে হাঁটা ধরলো ঘরের দিকে।

ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাচ্ছে তৈমূর।কিছুক্ষণ পরপর তাকাচ্ছে দরজার পানে। স্ত্রীর আসার অপেক্ষা করছে। মেয়েটি রেগে আছে কিনা কে জানে? কোথায় বিয়ের পর মানুষ একে অপরকে প্রেম নিবেদন করে, দু চারটে দুষ্টু মিষ্টি কথা বলে, সময় সুযোগ পেয়ে বউকে বুকে টেনে আদর করতেও ভুলে না। অথচ তৈমূরের ভাগ্যে সেসব কিছুই জুটছে না। বউয়ের রাগ ভাঙাতে আর বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গিয়েই সময়টা তার হেলায় কাটছে। অথচ ছোটো ছোটো না করে সঠিক সময়ে যদি মা তার বিয়ে দিয়ে দিতো তাহলে এতোদিনে হয়তো পেছনে বাবা বাবা বলে ডাকার মতো একটা চৌবাচ্চাও হয়ে যেতো তার। ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈমূর।

তখনি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল উথমী। নিঃশব্দে দরজা আটকে চলে এলো পালঙ্কের কাছে। বিছানার কুঁচকানো চাদরটা টানটান করে বিছিয়ে এবার হাত দিলো বালিশে। তৎক্ষণাৎ দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে বালিশটা তার থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে সেখানেই বসে পড়ল তৈমূর। স্বামীর এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো উথমী। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে শুধালো,“কী হচ্ছে?”

“অসভ্যতা।”

“কিহ!”

“স্যরি উথমী। আমি জানতাম না আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জানলে কখনোই এমন গুরুতর অপরাধটা করতাম না। আপনি কী রাগ করেছেন আমার উপরে?”

“না করিনি। এসব আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সরুন এখান থেকে।”—–উথমীর সোজাসাপ্টা জবাব।

“আপনি নিজেই তো আমার ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত মানুষের কাছে কী ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকে? আ’ম স্যরি উথমী। আর কখনো এমনটা হবে না।”

“বারবার স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। বলছি তো রাগ করিনি।”

“তাহলে চোখ এভাবে লাল হয়ে আছে কেনো? ঠোঁটই বা ফোলা কেনো? বাড়িতে প্রবেশকালে তো সব স্বাভাবিকই ছিলো।”

ভড়কে গেলো উথমী। ইতস্তত করে বললো,“খেতে গিয়ে ঝাল মরিচে কামড় লেগেছে তাই এমন অবস্থা। সামান্য বিষয় নিয়ে কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে ফেলার মেয়ে আমি নই।”

“হ্যাঁ আপনি শুধু গোপনে রাগ করে নাওয়া খাওয়া ভুলে যাওয়ার মতো মেয়ে।”

“কী বললেন?”—চোখ রাঙিয়ে তাকালো উথমী।

উথমীর জায়গা থেকে উঠে নিজ জায়গায় গিয়ে বসলো তৈমূর। চোখের চশমাটা খুলে বেড টেবিলের ওপর রেখে বালিশে মাথা গুঁজে বললো,“লাইট নেভান। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।”

প্রত্যুত্তর করল না উথমী। নির্দেশ মোতাবেক চুপচাপ নিজের বালিশ ঠিক করে আলো নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে এসে শুয়ে পড়ল। তার মিনিট দুয়েক অতিক্রম হতে না হতেই আলগোছে নিজের হাতটা তার উপরে রাখলো তৈমূর। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্ত্রীকে আবদ্ধ করে নিলো নিজ বন্ধনে। এমন কাজে নড়েচড়ে উঠলো উথমী। ভেজা জিভ দিয়ে নিজের শুষ্ক ওষ্ঠ জোড়া ভিজিয়ে শুধালো,“কী করছেন?”

“কিছু না।”

“ছাড়ুন তবে।”

তৎক্ষণাৎ টুস টাস শব্দ করে তার কপালে, দুই গালে এবং থুতনিতে পরপর চুম্বন বসিয়ে দিলো তৈমূর। ফিসফিস করে বললো,“উহুম, ছাড়বো না। শুভ রাত্রি। দোয়া করি সকালে যেনো সুন্দর, ঠান্ডা একটা মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে উঠতে পারেন।”

কথা শেষ করে তার গলায় নাক ঘষে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করে নিলো তৈমূর। স্বামীর এমন কাজে পুরো দেহখানা শিরশির করে উঠলো উথমীর। শুকনো ঢোক গিলে কপালের ঘাম মুছে বেশ কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল,“এই লোকটা দেখতেই ভদ্র, সভ্য। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আস্তো একটা বদমাইশ।”
_________

দিন যায় রাত আসে আবার রাত যায় নতুন আরেকটি দিন আসে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আজকের দিনটি শুরু হলো আর পাঁচটা দিনের মতোই। সকাল সকাল গৃহিণীরা ঢুকলো রান্নাঘরে, চাকুরিজীবীরা তৈরি হতে লাগলো কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরে তৈরি হচ্ছে স্কুলের জন্য।

সারা ফ্ল্যাট জুড়ে একপ্রকার ছোটাছুটি চলছে জেবার। এইতো দৌড়ে গিয়ে রুটি ছ্যাঁকছে, তো এই আবার গিয়ে খুঁজে দিচ্ছে ছেলের মোজা। তার মধ্যেই আবার অন্য ঘর থেকে এলো তুরাগের ডাক,“জোহানের আম্মু! এই জোহানের আম্মু! আমার টাই টা একটু বেঁধে দিয়ে যাও না।”

স্বামীর ডাকে বিরক্ত হলো জেবা। ওখান থেকেই সাড়া দিয়ে বললো,“বয়স তো কম হলো না অথচ এখনো কিনা টাই বাঁধার জন্য আমায় লাগে? আসছি!”— তারপর ছেলের হাতে ছেলের মোজা ধরিয়ে দিয়ে এবার ছুটলো ছেলের বাপের কাছে।

টাই হাতে বিছানায় বসে আছে তুরাগ। স্ত্রীকে আসতে দেখেই দাঁত কপাটি বের করে বোকা হাসলো সে। জেবা এগিয়ে এসে তার টাইয়ে হাত লাগালো। বাঁধতে বাঁধতে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,“রোজ রোজ এই টাইয়ের বাহানা দিয়ে বিরক্ত করতে লজ্জা করে না? ছেলেটাকে তৈরি করে দিয়ে নিজেও তো তৈরি হতে পারো। আমার কাজটা একটু কমাতে পারো। কিন্তু তা তো আর করবে না।”

স্ত্রীর রাগমিশ্রিত কথাতেও পূর্বের মতোই মুখশ্রীতে ঝরঝরে হাসিটা লেপ্টে থাকে তুরাগের। দুই হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে স্ত্রীর।এটা তার রোজকার অভ্যাস। স্বামীর এমন কান্ডে অভ্যস্ত জেবা। তাই কৃত্রিম রাগটা আর ধরে রাখতে পারলো না। টাই বাঁধা শেষ করে মুচকি হেসে আলতো করে বুকে কিল বসিয়ে দিয়ে বললো,“আহা ছাড়ো তো। পাশের ঘরে ছেলে আছে। যখন তখন চলে আসতে পারে। আয়হায়! ওদিকে তো আমার রুটি পুড়ে যাচ্ছে!”

তুরাগ স্ত্রীর কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে ছেড়ে দেয় তাকে। জেবা লাজুক হাসে। কাজের বাহানায় ছুটে যায় রান্নাঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যে টেবিলে নাস্তা বাড়ে। স্বামী, সন্তানের জন্য টিফিন বক্স রেডি করে আলাদা আলাদা ব্যাগে ভরে সযত্নে রাখে ড্রয়িং রুমের সোফায়। চেঁচিয়ে ডাকে,“জোহানের বাবা! জোহানকে নিয়ে খেতে এসো তাড়াতাড়ি।”

স্ত্রীর বলা কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে তুরাগ। গল্প করতে করতে শুরু হয় তাদের নাস্তা পর্ব। নাস্তা সেরে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তাকে ছুটতে হবে আবার অফিসে।

অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার বদলে ঘর জুড়ে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু খুঁজছে তৈমূর। সেই খোঁজাখুঁজির চক্করে ড্রেসিং টেবিলের জিনিসপত্রের অবস্থা নাজেহাল। বিছানায় গোছানো বালিশগুলোও হয়ে গিয়েছে অগোছালো। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ করে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেলো বেচারা। তৎক্ষণাৎ ব্যথায় আহ সূচক শব্দ করে উঠলো। ডান হাতের সাহায্যে ব্যথার স্থান ঘষতে ঘষতে আবারো খোঁজায় মনোযোগ দিলো।

দরজার সাথে হেলান দিয়ে পুরো দৃশ্যটাই এতক্ষণ ধরে অবলোকন করছিল উথমী। কিন্তু এভাবে স্বামীকে আঘাত পেতে দেখতেই নড়েচড়ে উঠলো সে। দ্রুত হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল। শুধালো,“কী খুঁজছেন এভাবে?”

“আমার চশমা! কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। একটু খুঁজে দিন না। আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।”

কথাটায় ভড়কে গেলো উথমী। নিজের হাতে থাকা চশমাটার দিকে একবার তো আরেকবার তৈমূরের পানে তাকায়। চশমা না পেয়ে তৈমূরের কেমন অবস্থা হয় তা দেখার জন্যই দুষ্টুমির ছলে চশমাটা লুকিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু লোকটার এমন অবস্থা দেখে মজার বদলে ভীষণ অবাকই হলো সে।জিজ্ঞেস করল,“চশমা ছাড়া কী আপনি কিছুই দেখতে পান না তৈমূর সাহেব?”

“পাই তবে অসুবিধে হয়। সব ঘোলাটে লাগে। একটু খুঁজে দিন না।”

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। এগিয়ে গিয়ে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে চশমাটা পরিয়ে দিলো তৈমূরের চোখে। মুহূর্তেই আশেপাশের সবকিছু
স্পষ্ট হয়ে উঠলো তৈমূরের নিকট। চশমা পেয়ে অধরে ফোটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,“এইতো আমার চশমা! আহ এবার সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তা কোথায় পেলেন?”

“কোথায় পেলাম সেটা বড়ো কথা নয়‌। বড়ো কথা হচ্ছে, আপনি তো কানা তৈমূর সাহেব। উথমীর জামাই কানা!”—বলেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল উথমী।

অধরের হাসিটা বিলীন হয়ে মুখশ্রী থমথমে হয়ে গেলো তৈমূরের। একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দুঃখে ভরা মুখের পানে তাকিয়ে রইলো। উথমী পুনরায় বললো,“আমি তো এতোদিন ধরে ভাবতাম আপনি অল্প কানা তাই হয়তো চশমা পরেন। কিন্তু আপনি তো পুরো কানা! চশমা ছাড়া একদম অচল। চশমা না থাকলে তো আমায়ও চিনতে পারবেন না। তখন আমার কী হবে?”

“এমন করে বলছেন কেনো? আমি মোটেও কানা নই। শুধু চশমা ছাড়া সবকিছু ঘোলাটে দেখি। ইটস্ নরমাল।”

“এটা আপনার কাছে নরমাল?”

“অবশ্যই‌।”

“শেষমেশ কিনা কানা ছিলো আমার ভাগ্যে? হায় আল্লাহ! এ কী হলো আমার সাথে?”

“ভুঁড়িওয়ালা, মাথায় টাক, বয়স্ক লোক যে ছিলো না তার জন্য শোকরিয়া আদায় করুন। একটা মেয়ের ভাগ্য কতটা ভালো হলে তৈমূরের মতো স্বামী পায় বলুন তো? ইউ আর সো লাকি গার্ল উথমী।”

ভ্রু কুঁচকায় উথমী। সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়,“নিজের প্রশংসা নিজে করছেন?”

“মোটেও না। আপনাকে সত্যের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছি।”

“এ্যা এসেছেন মহা সত্যবাদী পুরুষ।”

নিঃশব্দে হাসে তৈমূর। গলার টাই বাঁধতে বাঁধতে শুধায়,“সুন্দর লাগছে না আমায়?”

“না।”

“আবার মিথ্যে বলছেন?”

“তা এতো সাজগোজ কার জন্য? সুন্দর কোনো কলিগ আছে নাকি অফিসে?”

“আছে তবে সবগুলোই বিবাহিত, কারো কারো বাচ্চাও আছে। তবে আপনার মতো সুন্দর নয়।”

শেষের কথাটায় খানিকটা লজ্জা পেলো উথমী। প্রসঙ্গ বদলে বললো,“সামনের শনিবার থেকে আমার ছুটি শেষ। ওদিকে ভাবী ফোনে বললো, বাড়িতে নাকি প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ফেলে এসেছি। ওগুলো নিয়ে আসতে হবে। শুক্রবার তো আপনার অফিস বন্ধ তাই যদি ওইদিন গিয়ে নিয়ে আসতাম তাহলে ভালো হতো।”

“শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আম্মাকে বাড়িতে রেখে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। কাল বৃহস্পতিবার, হাফ ডে। কাজের প্রেশার কম। চাইলে কালই যাওয়া যায়। বিকেলে বের হলাম। তারপর আপনার যা যা প্রয়োজন সবকিছু নিয়ে একেবারে রাতে চলে এলাম।”

কথাটা পছন্দ হলো উথমীর। স্বামীর কথায় সায় জানিয়ে বললো,“ঠিক আছে তবে।”

মুচকি হাসে তৈমূর। অফিস ব্যাগ হাতে নিয়ে স্ত্রীকে বিদায় জানায়,“আল্লাহ হাফেজ।”

“সাবধানে যাবেন। আর সময়মতো খেয়ে নিবেন। আল্লাহ হাফেজ।”

মাথা নাড়ায় তৈমূর। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)