#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২২]
“যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে মিফসা। আমি মেনে নিয়েছি আমি ভুল করেছি। তোমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে মারাত্মক ভুল করেছি। যে ভুলের জন্য আমি অনুতপ্ত। বিশ্বাস করো মিফসা, তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। একদম ভালো নেই। আবার কী ফিরে আসা যায় না?শেষ একটা সুযোগ অন্তত দাও।”
প্রকৃতির খেলা বুঝা বড়োই দায়। কখন কোথায় গিয়ে যে মানুষ থেমে যায় তা যেনো তাদের নিজেরই অজানা। আকাশে মেঘ জমেছে। চোখ ধাঁধানো রোদ হয়েছে বিলীন। বৃষ্টি নামবে কী? বুঝে উঠতে পারে না উথমী। সামনে আকুল হয়ে বসে থাকা পুরুষটিকেও আজ আর সে বুঝে না। বুঝতে চায় না। অলস ভঙিতে প্রত্যুত্তর করল,“কে ফিরবে? আমি? কিন্তু ছেড়ে তো আপনি গিয়েছিলেন।”
সচকিত হয়ে উঠলো বর্ষ। কথার জালে আজ সে ফেঁসে যাচ্ছে। সামনে বসে থাকা এই মেয়েটিকে কিছুতেই যেনো পুরোনো মেয়েটির সঙ্গে আর মেলাতে পারছে না। কাঁচুমাচু মুখ করে বললো,“ভুল করেছি আমি। ক্ষমা করা যায় না?”
“তা অবশ্য যায়। বাবা বলেন, ভুল করলে মানুষকে ক্ষমা করতে হয়।”
জ্বলজ্বল করে ওঠে তার আঁখি যুগল। আমোদিত হয়ে বলে,“তাহলে ফিরে এসো।”
“কিন্তু আপনি তো ভুল করেননি। করেছেন ছলনা, বিশ্বাসঘাতকতা। আর বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান, মন নিয়ে খেলা মানুষদের কখনোই ক্ষমা করা যায় না। যায় না নতুন করে সুযোগ দেওয়া। উথমী একবার যেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সেদিকে আর ভুল করেও তাকায় না।”
থামে উথমী। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস টেনে পুনরায় বলে, “আমি বিবাহিত বর্ষ। অন্য একজন পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী। তাই স্বামী ব্যতীত পরপুরুষকে নিয়ে ভাবা আমার সাজে না। এটা অন্যায়। মারাত্মক অন্যায়।”
বুক কেঁপে ওঠে বর্ষর। অসাড় হয়ে আসে দেহ। চাপা আর্তনাদ করে বলে ওঠে,“এসব মিথ্যে, ইচ্ছে করে তুমি আমায় মিথ্যে বলছো।”
“আপনি আমার এমন কেউ নন যে আপনাকে আমার মিথ্যে বলতে হবে। যার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে ফোনে কথা বলেছিলাম সে আমার স্বামী।”
“তুমি না আমায় ভালোবাসতে? আমাকে পাওয়ার জন্য কত আর্তনাদ করেছিলে? এই তোমার ভালোবাসার নমুনা? কী করে পারলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে? কষ্ট হয়নি? সে যখন তোমায় স্পর্শ করে তখন মনে পড়ে না আমায়?”
“না পড়ে না, আপনি আমার অতীত। অপ্রিয়, তিক্ত, ভুল অতীত। আমি অপ্রিয় কিছুই মনে রাখি না। যারা আমার জীবন থেকে চলে যায় আমি তাদের ভুলে যাই।”
বার কতক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ষ। মাথাটা তার ভার হয়ে এসেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফে হওয়ার পরেও ফর্সা মুখশ্রীতে ঘাম জমেছে। সেসব দেখেও উথমীর আজ কোনো মায়া কিংবা সহানুভূতি হলো না। বললো,“বর্ষার একদিনে তুমি আমার সকল অনুভূতিকে পায়ে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিলে। কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলে, আমাকে তোমার পরিবার মানবে না। আমার প্রতি তুমি আর আগের মতো টান অনুভব করো না। এককথায় আমি তোমার যোগ্য নই। অথচ সত্যি তো ছিলো এই যে, তুমি অন্য নারীর মোহে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিলে। তাই আমায় মিথ্যে অভিযোগে ছেড়ে দিয়েছিলে। সেদিন আমি ভেবেছিলাম ভালোবাসা মিথ্যে, ভেবেছিলাম পুরুষ মানুষ ভালোবাসতে জানলেও বদলায় তাদের ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম, তোমায় চিনতে যেভাবে ভুল করেছিলাম ঠিক সেভাবেই আমার ভাবনাগুলোও ছিলো ভুল। সব পুরুষ নয় বরং তোমার মতো নষ্ট, চরিত্রহীন পুরুষদের ভালোবাসাই বদলায়।”
উথমী আজ থামে না। মনের গহীনে পুষে রাখা পুরোনো ক্ষত আজ নিরাময় করতে চায় সে। পুনরায় বলে,“যার জন্য আমায় ছেড়েছিলে আজ সেও বুঝি ছেড়ে চলে গিয়েছে তোমায়? নইলে তো তোমার মতো পুরুষ ফিরে আসার মানুষ নয়। তবে ফিরে আসার সকল পথ বন্ধ। মানুষ চিরকাল একা থাকে না। যেমন একা থাকে না পথিকের আশায় অপেক্ষারত রাস্তাটি। আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। তোমার কষ্ট, হাহাকার দেখে আমার ভালো থাকার চাহিদা এই মুহূর্ত থেকে বেড়ে গিয়েছে। ধন্যবাদ আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তুমি ছেড়েছিলে বলেই তো জীবনে সঠিক মানুষের দেখা পেয়েছি। যেই মেয়েকে অযোগ্য বলে মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে গিয়েছিলে আজ সেই মেয়েকেই তোমার থেকেও কোনো এক যোগ্য পুরুষ ঠাঁই দিয়েছে নিজের বুকের বাগিচায়। আর কখনো আমার সামনে এসো না। গা রি রি করে ওঠে ঘৃণায়।”
কথা শেষ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উথমী। কোনো দিকে না তাকিয়ে উঁচু শিরে বেরিয়ে এলো সেই ক্যাফে থেকে। আজ অনেক বছর পর তার খুব শান্তি লাগছে। জীবনের কোনো এক বাঁকে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা বিষাদ, অবসন্নতা দূর হয়েছে। হাতের ইশারায় একটি রিক্সা ডেকে তাতে উঠে পড়ে উথমী। চালককে ঠিকানা জানিয়ে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় খোলা আকাশের পানে। সন্তুষ্ট চিত্তে বিড়বিড় করে বলে,“আজ দিনটি সুন্দর। আমার সব মন খারাপ আজ থেকে অন্য কারো। আর ভালো থাকা শুধুই আমার নিজের।”
_________
তখন বিকেল চারটা। এই অবেলায় সদর দরজা খুলে বাইরে বড়ো কন্যাকে দেখে ললাটে ভাঁজ পড়ে কেয়া বেগমের। এক মুহূর্তও দেরি না করে এলোমেলো শব্দে প্রশ্ন ছুঁড়েন,“তুই? এখন? হঠাৎ এখানে?”
প্রশ্ন শুনে বিরক্তবোধ করে উথমী। আপাদমস্তক মাকে পর্যবেক্ষণ করে চমকায়। মলিন, শুকিয়ে যাওয়া মুখশ্রী দেখে কিছু একটা আঁচ করে উনাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর হাতের ব্যাগগুলো সোফায় রেখে বসে। দরজা আটকে কেয়া বেগম এগিয়ে এসে আবারো প্রশ্ন ছুঁড়েন,“কী রে? প্রশ্নের উত্তর দিলি না যে? জামাই বাবা কোথায়?তুই কী একাই এসেছিস? হঠাৎ করে না জানিয়ে চলে এলি যে?”
“বাবার বাড়ি আসতে হলে কী এখন থেকে সময় নির্ধারণ করে সবার অনুমতি নিয়ে আসতে হবে নাকি? এ নিয়ম আবার কবে থেকে চালু হলো? কই বাবা তো জানালো না।”
থমথমে হয়ে গেলো কেয়া বেগমের মুখশ্রী। আমতা আমতা করে বললেন,“তোদের ভালো কিছু বলাও যায় না, সবসময় কথার উল্টো মানে খুঁজিস।”
“তোমার মুখের অবস্থা এমন কেনো? ঠিকমতো ঘুম, খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না? চোখের নিচেও তো অশ্রু শুকিয়ে আছে। কেঁদেছো কেনো?”
মেয়ের কথায় বিষ্ময়ে ছেয়ে গেলো কেয়া বেগমের মুখশ্রী। আপনাআপনি হাত চলে গেলো নিজের চোখে। আঁচল দিয়ে মুখখানা মুছতে মুছতে প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা চালিয়ে বললেন,“অশ্রু না, ঘাম।”
উথমী আর কথা বাড়ায় না। নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। যেতে যেতে বললো,“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। খুব খিদে পেয়েছে, খাবার দাও।”
ছোটো কন্যার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ভুলে বসেছিলেন কেয়া বেগম। বড়ো কন্যার কথায় যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি। আর দেরি না করে দ্রুত পা চালিয়ে এগোলেন রান্নাঘরের পথে।
আলমারিতে রেখে যাওয়া পোশাক বের করে পরনের পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে বাইরে এলো উথমী। এর মধ্যেই তনির মাধ্যমে সবার কান পর্যন্ত পৌঁছে গেলো উথমীর আগমনী সংবাদ। ঘর থেকে বের হতেই মেয়েটা তার হাত ধরে টানতে টানতে বললো,“কই ছিলে তুমি? আসো নাই ক্যানো?”
মুচকি হেসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো উথমী। সঙ্গে আনা চিপস, চকলেটের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাল টেনে বললো,“পাকা বুড়ি একটা! কেমন আছিস?”
“বালো।”
তাদের কথার মধ্যেই ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে এলো রায়হান কবীর, উৎস, রিনিতা। সোজা এসে সোফায় বসতে বসতে চিন্তিত স্বরে মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন রায়হান কবীর,“তুই? সব ঠিকঠাক আছে তো মা?”
বাবার চিন্তিত মুখশ্রী দেখে মৃদু হেসে নিজেও বসে পড়ল উথমী।আশ্বস্ত করে বললো,“হ্যাঁ সব ঠিকঠাক।”
ড্রয়িং রুমে সকলের উপস্থিতি টের পেয়ে এখানেই মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে এলেন কেয়া বেগম। সেন্টার টেবিলের উপর সেগুলো রেখে স্বামীর পানে তাকিয়ে বললেন,“কীসের ঠিকঠাক? হঠাৎ করেই বাড়ি চলে এসেছে। কেনো এসেছে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কোনো উত্তরই দিলো না। শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা হলে তা তো বলবে, নাকি? আর ঝামেলা হলেই চলে আসতে হবে? মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারলো না?”
উনার কথায় যেনো উপস্থিত সকলেই বিরক্ত হলো। উৎস কড়া বাক্যে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,“তুমি আগে আগে এতো বেশি চিন্তা করো কেনো? যখন ইচ্ছে আসতেই পারে, তোমার কী তাতে? সমস্যা হলেও তো গিয়ে মিটিয়ে দিয়ে আসতে পারবে না।”
গতকাল রাত থেকেই ছেলের মেজাজ ঠিক নেই। সকাল থেকে একেবারে ব্যবহারটাও কেমন অপরিচিত হয়ে গিয়েছে। তাই আর বিপরীতে কিছু বললেন না তিনি। রায়হান কবীরও কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন স্ত্রীর পানে। চাপা স্বরে বললেন,“মেয়েটা অনেকদিন পর এসেছে একটু শান্তি দাও। আগ বাড়িয়ে আজেবাজে চিন্তা করার স্বভাবটা আর গেলো না তোমার।”
আড়চোখে মাকে দেখে নিয়ে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে বড়ো ভাইয়ের পানে তাকায় উথমী। সন্দিহান কণ্ঠে শুধায়,
“তোমাদের তো হাবভাব ভালো ঠেকছে না। গতকাল হুট করেই বাবা ওখানে গেলো আবার রাতেই তোমার ফোন পেয়ে চলে এলো। তোমাকে দেখেও তো ঠিক লাগছে না ভাইয়া। কিছু হয়েছে?”
কারো কাছ থেকে প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর আসে না। ভেসে আসে শুধু বাবার দীর্ঘশ্বাস। আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে ভাবীর পানে তাকায় উথমী। ইশারায় একই প্রশ্ন শুধায়। রিনিতা মুখে কিছু বলে না, শুধু মাথা নাড়ায়। তন্মধ্যে চকলেট বের করে খেতে খেতে ছোট্ট তনি বলে ওঠে,“তুমি দানো না? ছুটু পুপি তো হারিয়ে গেছে। তাই দাদী অনেক কান্না করেছে। বাবা, দাদু তো খুঁজতে গেছিল।”
ভাতিজির কথায় মুখশ্রী গম্ভীর হয় উথমীর। এই মুহূর্তে কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত বুঝতে পারে না। পূর্বের ন্যায় আবারো তাকায় সকলের মুখপানে। রায়হান কবীর এবারও উত্তর দেন না। নিচু করে নেন মাথা। কেয়া বেগম আঁচলে মুখ গুঁজেন। উথমী জিজ্ঞেস করে,“তনি কী বলছে এসব? ঊষা কোথায়?”
রিনিতা উত্তর দেয়,“জানি না। গতকাল সকালে ভার্সিটি যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তারপর আর ফেরেনি। তোমার ভাইয়ের কথায় ওর ঘর তল্লাশি করে দেখি পোশাক আশাক কিচ্ছু নেই তারপর আজ সকালে থানায় গিয়ে ওরা ডায়েরী করে এসেছে।”
স্ত্রীর কথা শেষ হতেই উৎসও বলে উঠলো,“সঙ্গে করে আমার এতোদিনকার গাড়ির জন্য জমানো টাকা- পয়সা, মায়ের গহনাগাটিও চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। কতটা নেমকহারাম হলে নিজের পরিবারের সঙ্গে এমনটা করতে পারে একটা মেয়ে?”
বিষ্ময়ে ছেয়ে যায় উথমীর মুখশ্রী। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে,“কী বলছো? ও পালিয়ে গেছে?”
“তো আর কী? এসব নিয়ে তো মানুষ পালায়ই। শুধু পালায়নি চুরিও করেছে।”
বারবার মেয়ের নামে এই চুরির অপবাদ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন কেয়া। না চাইতেও চোখ জোড়া উনার ভিজে উঠেছে। তাও দৃষ্টির আড়াল হলো না উথমীর। একে একে সমস্ত ঘটনাই শুনলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। অসহায় কণ্ঠে বললো,“এতো বড়ো ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর তোমরা আমায় একটাবার জানানোর প্রয়োজনবোধ করলে না? আমি আজ না আসলে তো জানতেই পারতাম না। এতোটা পর হয়ে গিয়েছি তোমাদের?”
রিনিতা ননদের উদ্দেশ্যে বললো,“ভুল বুঝো না উথমী। হঠাৎ করে এমন অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা ঘটে গেলো সেই চিন্তায় তোমাকে জানানোর কথা মাথায় আসেনি। তার উপর শরীরটাও আমার ভালো না তা তো তুমি জানো, তাই না? নইলে আমিই তোমায় জানাতাম।”
রায়হান কবীরও পুত্রবধূর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন, “কাল ফোনে খবরটা শোনার পর আমিও বেশ অবাক হয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে তোকে জানানোর কথা মাথায় আসেনি। ওদিকে তোর সংসার আছে, পাশাপাশি আবার চাকরি করিস। তার মধ্যে এসব জানলে কতটা চিন্তা করতি? এদিকে আবার বিয়ের বছরও পেরোয়নি, জামাই বাবা আর তোর শাশুড়ি জানলে কতটা লজ্জায় পড়তে হবে বল তো?”
বাবা ভুল কিছু অবশ্য বলেনি। তাই আর এ ব্যাপারে মন খারাপ করল না উথমী। শুধু বললো,“মাকে আমি আগেই জানিয়েছিলাম, ওর কোনো ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক চলছে। কিন্তু মা তো সেসবে পাত্তাই দিলো না। সর্বদা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বৈষম্য করে গেলো। আমরা ভুল করলে তা ভুল নয় বরং অন্যায় আর ছোটো মেয়ে অন্যায় করলেও তা ভুল। সেই শাস্তিই এখন ভোগ করতে হচ্ছে। সময়মতো শাসন করলে আজ এই অবস্থা হতো না। আল্লাহ জানেন কি অবস্থায় আছে মেয়েটা। খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়লে?”
তার কথায় নড়েচড়ে উঠে বাপ-ছেলে। রায়হান কবীর প্রশ্ন ছুঁড়েন,“কোন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো? কবে থেকে?”
“কবে থেকে তা জানি না। ছেলেকেও চিনি না। আমার বিয়ের আগে একবার রাস্তায় দেখেছিলাম ওদের। হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতে ছেলেটির সঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছিল। তারপর বাড়ি এসে জিজ্ঞেস করায় অস্বীকার করে। মাকেও জানিয়েছিলাম, বিয়ের পর যখন প্রথম এসেছিলাম তখন। থাক বাদ দাও এসব। এতো ঘেঁটে এখন আর লাভ নেই।”
প্রসঙ্গ বদলে যায়। উৎস সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“তা থাকবি তো কদিন? কলেজ খোলা?এখান থেকেই করবি না হয়। তৈমূর জানে তুই যে এখানে?”
“হুম জানে, উনার ড্রাইভার হঠাৎ করেই আজ সকালে বাবার অসুস্থতার জন্য ছুটি নিয়েছে। রোজ রোজ তো উনিই আমায় কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তারপর নিজে অফিস যান। আর কলেজ শেষে গাড়ি পাঠিয়ে দেন কিন্তু ড্রাইভার ছুটি নেওয়ায় একটু চাপে পড়ে গেছেন। সকালে পৌঁছে দিতে পারলেও অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় আর নিতে আসতে পারেননি। আবার অতোদূর আমায় একা একাও যেতে দিবেন না। তাই উনিই ফোন করে বললেন এখানে চলে আসতে। রাতে এসে নিয়ে যাবে। কয়েকদিন আগে আসার কথা থাকলেও তো আর শেষমেশ আসতে পারিনি তাই আর না করিনি, চলে এসেছি।”
কেউ আর এ বিষয়ে তেমন ঘাঁটায় না। তনি এতক্ষণে চলে গিয়েছে কোথায় যেনো। রিনিতার শরীরটাও তেমন ভালো না। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেও চলে গিয়েছে ঘরে। খেতে খেতে বাবা ভাইয়ের সঙ্গে টুকিটাকি কথা চলছে উথমীর। ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে মায়ের পানে তাকাচ্ছে। জীবনের এতোগুলো বছর পেরিয়ে এসে এই প্রথমই যেনো মাকে কাঁদতে দেখছে সে। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হতে দেখছে।
_________
মায়ের সঙ্গে মনের দূরত্বটা ঠিক কবে থেকে শুরু হলো তা উথমীর অজানা। বোঝ হওয়ার পর থেকেই সে দেখে এসেছে মায়ের কাছে বাকি দুই সন্তানের মতো তেমন গুরুত্বপূর্ণ সে নয়। বরং তার ব্যাপারে মা যেনো একটু বেশিই উদাসীন। একবার স্কুলে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল ঊষা। তখন সে কীসে পড়ে?উমম হবে হয়তো সিক্সে আর উথমী পড়ে ক্লাস নাইনে। ততদিনে স্কুল, কলেজের গন্ডি পার করে ফেলেছে উৎস। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে বাস শুরু করেছে সুদূর কুমিল্লায়।
বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে আঘাত নিয়ে ধরা পড়ে যায় ঊষা। তার হাঁটু আর কনুইয়ের ক্ষত দেখে চিন্তিত হন কেয়া বেগম। বকাঝকা করে একপর্যায়ে শুধান,“সত্যি করে বল কীভাবে ব্যথা পেয়েছিস?”
ছোটবেলায় মাকে ভীষণ ভয় পেতো ঊষা। সে ভয়েই নিজের দোষ গোপন রেখে কোনো কিছু না ভেবেই বলে দিয়েছিল,“আপু ফেলে দিয়েছে।”
এ কথাটা শুনে কি রাগটাই না হয়েছিল কেয়া বেগমের! সত্য মিথ্যা যাচাই না করে সবে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা বড়ো মেয়েকে স্টিলের স্কেল দিয়ে ইচ্ছেমতো পিটিয়ে তারপর থেমেছিলেন। তখন রায়হান কবীর ছিলেন অফিসে। রাতে বাড়ি ফিরে মেয়ের এমন মুমূর্ষু অবস্থা দেখে স্ত্রীর সঙ্গে অনেক রাগারাগী করেছিলেন! একপর্যায়ে সেই রাতেই ছোটো মেয়েকে দাঁড় করিয়ে তার পেট থেকে বের করেছিলেন সত্য কথা। এরপর প্রায় সপ্তাহ খানেক জ্বরে ভুগতে হয়েছিল উথমীকে। সে খবর শুনে বাড়ি ফিরে আসে উৎস। লেখাপড়া লাটে তুলে অসুস্থ বোনের শিয়রে বসে থাকে।
অমন একটা ঘটনা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। উথমীও ভুলেনি। তারপর থেকে মায়ের সঙ্গে কথা একদম কমে যায় তার। মামীর কাছ থেকে একবার শুনেছিল, ঊষার জন্মের পর থেকে মা নাকি তাকে একদম পছন্দ করেন না, ভালোবাসেন না। এ কথা শুনে কতই না কেঁদেছিল ছোট্ট মেয়েটি! তখন বাবা তাকে বোঝান, সান্ত্বনা দেন। আশ্বস্ত করে বলেন,“মাও তোকে ভালোবাসে, অন্যের কথায় কান দেয় না মা। মানুষ তো কত কথাই বলে।”
“তাহলে সবসময় মা আমায় বকে কেনো? খাইয়ে দেয় না কেনো?”
মেয়ের প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর দিতে পারেননা রায়হান কবীর। তবে একসময় গিয়ে সবই বুঝতে পারে সে। উত্তর পেয়ে যায় সকল প্রশ্নের।
তখন উথমীর বয়স সবে দুই বছর। দুই সন্তান আর স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন কেয়া। তন্মধ্যে তৃতীয়বারের মতো অপ্রত্যাশিত প্রেগন্যান্সির সংবাদ পেয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি। একদিকে ভাড়া বাসায় থাকেন অন্যদিকে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে সংসারের কাজ আর দুধের মেয়েকে সামলাতে সামলাতেই দিন যায় উনার। সেখানে আরেক সন্তানের আগমনী সংবাদে দিগ্বিদিক ভুলে বসেন তিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক, মানসিক অসুস্থতা বাড়ে। সংসারের কাজ থেকে নিতে হয় বিরতি। সেই মুহূর্তে বাড়িতে কাজের জন্য নতুন লোক রাখা বাড়তি খরচ। মায়ের কাছে নিজের সমস্যার কথাটা জানাতেই মা ছোটো মেয়েকে পাঠিয়ে দেন বড়ো মেয়ের কাছে। কলি তখন ম্যাট্রিক পাস করে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতে তার জন্য খোঁজা হচ্ছিল বিয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র। বড়ো মেয়ের এমন দুর্দশা মেনে নিতে না পেরে সংসারের কাজকর্মে নিপুণ কলিকেই সেখানে পাঠানো ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাননা কেয়া বেগমের মা।
কলি বরাবরই বড়ো বুবুর বিশাল ভক্ত। কয়েকদিনের মধ্যেই গোটা সংসারের দায়িত্ব থেকে শুরু করে বড়ো বোনের সেবা-যত্ন এবং তার বাচ্চাদের দেখভালের দায়িত্বও নিয়ে নেন নিজ কাঁধে। যথাযথভাবে পালন করেন নিজ দায়িত্ব। রায়হান কবীর শালীকার দায়িত্ববোধ দেখে নিজের বোনের মতোই স্নেহ করতেন তাকে। মাঝে মধ্যে হয়তো করতেন রসিকতা। প্রেগন্যান্সির সময় নারীরা বিভিন্ন মানসিক অবসাদে ভুগে। কেয়া বেগমও ভুগছিলেন। তার মধ্যেই প্রতিবেশীদের প্ররোচনায় মনের মধ্যে উনার নোংরা সন্দেহ ডানা বাঁধে। ধীরে ধীরে বিরক্ত হয়ে ওঠেন সকল কিছুর উপর। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট হতে থাকে। প্রায়সই বিভিন্ন কারণে শুরু করতেন ঝগড়া। একসময় জন্ম হয় ঊষার। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে মেয়ে নিয়ে তিনি চলে যান বাপের বাড়ি। কয়েক মাস ওখানে থাকার পর রায়হান কবীর উনাকে ফিরিয়ে আনেন বাড়ি। ততদিনে উথমী হয়ে গিয়েছে চরম খালা ভক্ত। সবকিছুতেই তার খালামণিকে চাই। এটা যেনো কিছুতেই সহ্য হয় না কেয়ার। মনের গহীনে থাকা সন্দেহ রূপ নেয় ঘৃণায়। ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পায় বাইরে। এ নিয়ে অবশ্য কম ঝামেলা হয়নি। বোনের নামে অপবাদ দিতেও ভুলেননি তিনি। সকলের সামনে নোংরা ভাষায় গালাগালি পর্যন্ত করেছিলেন। সেখান থেকেই সম্পর্কগুলো নষ্ট হওয়া শুরু। সেই যে মিথ্যে অপবাদ মাথায় নিয়ে কলি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তারপর আর কখনো মুখোমুখি হননি বড়ো বোনের। এমনকি নিজের বিয়েতেও আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন একসময়ে অতি ভালোবাসার বড়ো বুবুকে। কেয়া যেনো কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না এসব ঘটনা। সংসার আর ছোটো কন্যার প্রতি ধ্যান দিতে গিয়ে ভুলে বসেন উনার যে আরো একটি কন্যা রয়েছে। কিছু হলেই উনার সব রাগ এসে পড়ে উথমীর উপর।
শেষমেশ বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে মানসিক চিকিৎসা করান রায়হান কবীর। একসময় সব ঠিক হলেও হয় না দুই বোনের সম্পর্ক। কলি আর কখনো মুখোমুখি হননি উনার। এমনকি কেয়া বেগমকে ক্ষমা চাওয়ার সেই সুযোগটাও দেননি। ততদিনে উৎস বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। মায়ের ধমকে কেঁপে উঠার মতো ছেলে সে নয়। তাই ছেলের প্রতি যত্নটাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় কেয়ার। এই ছেলেই তো উনার বৃদ্ধ বয়সের শেষ ভরসা!
চলবে ________
#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৩]
অধিকাংশ বাঙালি মায়েরাই নিজের প্রত্যেক সন্তানের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে পারেন না। কাউকে অগাধ ভালোবাসলে কাউকে করেন অবহেলা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য। কেয়া বেগমও সেই অধিকাংশ মায়ের কাতারেই পড়েন। যিনি নিজের তিন সন্তানকে সমান ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করতে পারেননি, হতে পারেননি আদর্শ মা।
একসময় পরিবার থেকে শারীরিকভাবেও উথমীর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এইচএসসি শেষে এডমিশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চান্স হয় সুদূর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাড়ির সবার কাছে এ খবর পৌঁছাতেই কেয়া বেগম সর্বপ্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলে ওঠেন,“মেয়ে মানুষের অতো দূরে পড়তে যেয়ে কাজ নেই। দিনকাল ভালো নয়। কখন কোন বিপদ আপদ ঘটে যাবে তার ঠিক নেই। তখন তো আবার আমাদের ঘাড়ে এসেই পড়বে। এর থেকে আশেপাশের কোথাও ভর্তি হতে বলো।”
মায়ের কথায় মন খারাপ হয় উথমীর। অসহায় দৃষ্টিতে বড়ো ভাইয়ের পানে তাকায়। বোনের চাহনিতে সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উৎস। ওদিকে রায়হান কবীরও স্ত্রীর কথায় মৌন সম্মতি জানান। ভুল কিছু বলেননি তিনি। গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে উৎস। বাবা-মায়ের মনোযোগ নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে, “আশেপাশে বলতে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পরীক্ষা দিলো তিন জায়গায়। তার মধ্যে এক জায়গায় হলো না, আরেক জায়গায় হলেও ভালো একটা সাবজেক্ট পেলো না। আর এখানে চান্স হয়েছে, ভালো সাবজেক্ট পেয়েছে তাহলে এগুলো ছেড়ে ন্যাশনালে যাবে কেনো?”
ছেলের কথায় বিরক্ত কেয়া বেগম। বললেন,“ওসব তুই বুঝবি না।”
“যা বোঝার সবই বুঝেছি মা। চান্স না হলে অন্য কথা ছিলো কিন্তু চান্স যখন হয়েছে তখন ছাড়বে কেনো? আমার পরিচিত অনেকে রয়েছে যারা চবিতে পড়ে। ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখি ভালো কোনো লেডিস হোস্টেল পাওয়া যায় কিনা। ভর্তি করিয়ে ওখানেই না হয় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে আসবো। আর হলের সিট পেলে তো কথাই নয়। মানুষ কী লেখাপড়ার জন্য দূরে যাচ্ছে না? আমিও তো গিয়েছি।”
“তুই চুপ থাক, ও আর তুই এক নস। আমি যা বলেছি তাই হবে। লেখাপড়া করার হলে বাড়ি থেকেই করুক।”
মায়ের কথায় গুরুত্ব দিলো না উৎস। বাবার উদ্দেশ্যে বললো,“মায়ের কথা ধরে লাভ নেই। তুমি কী বলো বাবা?”
“কী যে বলবো বুঝতে পারছি না। এতো দূর কীভাবে পাঠাই?”
“এতো চিন্তা করে লাভ নেই, কত মেয়েই তো পড়ছে বাবা। অযথা ওকে আটকে রেখে তো আর লাভ নেই। লেখাপড়ায় ভালো ও, করছে যখন করুক। মানুষ বিদেশ চলে যাচ্ছে আর ও তো এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাচ্ছে।”
বিভিন্ন যুক্তি তর্কে বাবার মন বদলাতে সক্ষম হলেও মাকে কিছুতেই যেনো মানাতে পারলো না উৎস। শেষ পর্যন্ত রায়হান কবীর রাজি হন। মেয়েকে সময়মতো সেখানে নিয়েই ভর্তি করান। পজিশন ভালো হওয়ায় ভাগ্যক্রমে শুরুতেই হলের সিট পেয়ে যায় উথমী। এভাবেই মায়ের সঙ্গে তার যা অল্পস্বল্প কথা হতো তাও যেনো কমে গেলো। দুই ইদ ছাড়া তেমন একটা বাড়িতে ফেরাও আর হতো না মেয়েটার।
ক্যাম্পাস জীবনটা উথমীর বেশ ভালোই কাটছিল। সঙ্গে জোগাড় হয়ে গিয়েছিল বেশ কয়েকজন বান্ধবী। তাদের মারফতে হঠাৎ করেই একদিন ক্যান্টিনে বর্ষের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় উথমীর। একই ডিপার্টমেন্টে তার বছর তিনেকের সিনিয়র ছিলো বর্ষ। সাথে ছিলো মেধাবী, মিশুক, আড্ডাবাজ একটি ছেলে। সেই সুবাদেই শিক্ষক থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে তার মুখটা ছিলো বেশ পরিচিত।
সেখান থেকেই চেনাজানার পর প্রায়শই দেখা হতো দুজনার। ছোটো থেকেই উথমী ছিলো নম্র-ভদ্র, শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে। মানুষকে অসম্মান করা কিংবা ঝগড়া করা তার স্বভাব বহির্ভূত। তাই সিনিয়র হিসেবেই ছেলেটিকে সে সম্মান করতো। দেখা হলে সালামও দিতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে সিনিয়রদের দেখেও সালাম না দেওয়া হচ্ছে চরম বেয়াদবি। আর সেই বেয়াদবির শাস্তি হিসেবে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাই হয়তো কারো জন্য মাটি হয়ে যেতো। যা খুব ভালো করেই জানা ছিলো উথমীর।
মাঝেমধ্যে নিজ থেকে এসেই তার সঙ্গে কথা বলতো বর্ষ। কখনো বা বুঝিয়ে দিতো পড়া। এভাবেই দিনে দিনে সিনিয়র জুনিয়রের সম্পর্কটা রূপ নেয় বন্ধুত্বে। উথমীর তখন মনে হতো, বর্ষ নামক পুরুষটি খুবই চমৎকার। যার কথাবার্তা গোছালো, আচার ব্যবহার খুবই নমনীয় এবং সে দেখতেও সুন্দর। সেই ভাবনার জের ধরেই একসময় তাদের মধ্যে আদান প্রদান হয় ফোন নাম্বার। কতশত রাত জেগেই না দুজনে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছে তার হিসেব নেই।
উথমীর জীবনে বর্ষ ছিলো একমাত্র মানুষ যার সঙ্গে সে মন খুলে কথা বলতে পেরেছে, যার সামনে প্রাণ খুলে হাসতে পেরেছে। বাবা-মায়ের কড়া নিয়মে, শাসনে বড়ো হওয়া মেয়েটিই যেনো এই পুরুষটির কারণে হয়ে উঠেছিল চঞ্চলা এক রমণী। আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল প্রেম নামক বিচ্ছিরি একটি শব্দে।
তার মাস ছয়েক পরেই ক্যাম্পাসে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে প্রেম নিবেদন করল বর্ষ। যা ছিলো উথমীর ভাবনারও বাইরে, ছিলো অতি বিষ্ময়কর একটি ঘটনা। পূর্বে কেউ কখনো এভাবে তাকে ভালোবাসি বলেনি। তাই আর না করতে পারলো না মেয়েটি। কারণ ততদিনে যে ছেলেটা তার মনের একাংশ দখল করে নিয়েছে। এরপরের সময়গুলো ছিলো একেবারে স্বপ্নের মতো। সেই ভালোবাসার চক্করে পড়ে বন্ধু- বান্ধবের সংখ্যা দিন দিন কমলো। এমনকি কমলো বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ। বাড়িতে গেলেও বারবার ছটফট করতো উথমীর মন। ফোনে ফিসফিস করে কথা হতো রাতের পর রাত।
ততদিনে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে উৎস। এক বছরের মাথায় পদোন্নতি পেয়ে বেতনও তার বৃদ্ধি পেয়েছে। ছেলের বিয়ের সময় হয়েছে বুঝতেই বাবা-মা খোঁজ শুরু করলেন যোগ্য পাত্রীর। কিন্তু এই খোঁজাখুঁজির সমাপ্তি ঘটিয়ে হুট করেই একদিন নিজের মৃত বন্ধুর মেয়ের কথা বাড়িতে জানান রায়হান কবীর। তাকেই পুত্রবধূ বানানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু কেয়া বেগম কিছুতেই রাজি হন না স্বামীর প্রস্তাবে। ভাইয়ের মেয়েকে উনার আগে থেকেই পছন্দ। সে বিষয়ে স্বামীকে আগেও একবার জানিয়েছিলেন তিনি কিন্তু রায়হান কবীর তেমন একটা গুরুত্ব দেননি তখন। তবুও স্ত্রীকে নানাভাবে রাজি করিয়ে মেয়ে দেখানোর নাম করে নিয়ে গিয়ে ওখানেই কাজী এনে ঘরোয়া ভাবে ছেলের সঙ্গে রিনিতার বিয়ে দিয়ে দেন রায়হান কবীর।
রিনিতার ছবি বিয়ের দুদিন আগেই বাবা দেখিয়েছিলেন উৎসকে। সবকিছু বলেছিলেনও বটে। সেসব শুনে আর ছবি দেখে উৎসেরও মেয়েটিকে বেশ মনে ধরেছিল তাই আর দ্বিমত করতে পারেনি সে।
এ নিয়েও বাড়িতে কম ঝামেলা হয়নি। বিয়ের প্রথম দুই বছর দুই চক্ষে যেনো পুত্রবধূকে সহ্য করতে পারেননি কেয়া। কিন্তু তাতেও টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি রিনিতা। চমৎকার, সাংসারিক, মিশুক প্রকৃতির মেয়ে হওয়ায় বরাবরই মন দিয়ে সংসার করে গিয়েছে সে। এরপর যখন তনির জন্ম হলো তখনি যেনো তার শাশুড়ির মনটা গললো।
ছেলের সঙ্গে ভাতিজির বিয়ে দিতে না পারার দুঃখ তখনো ভুলতে পারেননি কেয়া। তার মধ্যেই আবার সেই ভাই নিজের ছেলের জন্য উনার কাছে উথমীর বিয়ের সম্বন্ধ পাঠায়। ভাইয়ের কথা ফেলতে পারেন না তিনি। প্রস্তাবে রাজি হয়ে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন।
বাবা রায়হান কবীর এই প্রথম স্ত্রীর মতের বিরুদ্ধে আর যেতে পারেন না। কেয়া বেগমের বাপের বাড়ির অবস্থা তখন বেশ ভালো। ভাই প্রবাসে গিয়ে অনেক উন্নতি করে একেবারে চলে এসেছে দেশে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে ভালো জায়গায়। ছেলেটাও লেখাপড়া শেষে ভালো চাকরি করছে। তার উপর নিজেদের চোখের সামনে বড়ো হওয়া ছেলে! মেয়ে বিয়ে দিলে নিশ্চিত সুখেই থাকবে।
সেমিস্টার শেষে বাড়িতে বেড়াতে এসে নিজের বিয়ের খবর শুনে যেনো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল উথমীর। বিষ্ময় নিয়ে শুধালো,“আমার অনুমতি ছাড়াই কিনা তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করেছো?”
বরাবরের মতো এবারো মেয়ের কথায় গুরুত্ব দেন না কেয়া বেগম। ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,“তোর আবার কীসের অনুমতি? সজল ভালো ছেলে। তোর মামা নিজে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এখানে অনুমতি, মতামত নেওয়ার তো কিছু দেখছি না।”
“আমি এখন বিয়ে করবো না মা। লেখাপড়াটা অন্তত শেষ হোক।”
“সমস্যা নেই, আপাতত কাবিনটা করে রাখবো। লেখাপড়া শেষে একেবারে যখন বাড়ি ফিরবি তখন ধুমধাম করে তুলে দিবো।”
মায়ের কথার বিপরীতে আর কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারে না উথমী। তবে এ নিয়েও অবশ্য কম ঝামেলা হয়নি বাড়িতে। দশ কথায় রা না পারা এই মেয়েটিই একসময় পরিবারের সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করে বিয়েটা আটকায়। বড়াই করে বর্ষের কথা জানায় সবাইকে। ততদিনে বর্ষ লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পেয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে ঢাকা। দুজনার মধ্যে যা কথা হতো তাও ওই যান্ত্রিক ফোনের মাধ্যমেই হতো। রায়হান কবীর মেয়ের কাছ থেকে সবটা শুনে শেষমেশ রাজি হন। মেয়েকে জানিয়ে দেন,“তাকে বাবা-মায়ের মাধ্যমে আমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বল।”
মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় উথমী। টানা চারদিনের চেষ্টায় বর্ষর সঙ্গে দেখা করতে সক্ষমও হয়। কিন্তু ততদিনে এই বর্ষ আর আগের বর্ষ নেই। পুরুষ মানুষ নাকি বদলায়, বদলায় তাদের ভালোবাসা। এতোদিন কথাটা শুনে এলেও সেদিন নিজ চোখে তা দেখেছিল উথমী। বাড়ির পরিস্থিতি জানানোর পরেও বর্ষর মুখশ্রীর ভাবভঙ্গি বদলালো না। মুখের উপরেই সে বলে দিলো,“আমি এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই মিফসা। নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমার আরেকটু সময়ের প্রয়োজন।”
“বাবার সঙ্গে কথা বলতে তো আপত্তি নেই, তাই না? বিয়ের কথাবার্তা বলে আপাতত সব ঠিক করে রাখো। বিয়েটা না হয় আমার গ্ৰাজুয়েশন শেষ হলেই করলাম। ততদিন তো পরিবারের চাপ থেকে অন্তত বাঁচতে পারবো।”
তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো না বর্ষ। নিরব রইলো কিছুক্ষণ। কিছু একটা মনে মনে গুছিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমায় ভুল বুঝো না মিফসা। তুমি নিজের পরিবারের ঠিক করা ছেলেকেই বরং বিয়েটা করে নাও।”
চমকায় উথমী। শুধায়,“এ কী বলছো?”
“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। তাই তুমি সত্যিই বিয়েটা করে নাও, সুখে থাকবে।”
“কী বলছো এসব? তুমি না আমায় ভালোবাসো?”
“এটাকে ভালোবাসা বলে না মিফসা, আবেগের বশে তোমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি রিয়েলাইজড করছি, ইউ আর নট মাই টাইপ। কেমন যেনো অদ্ভুত, অসামাজিক মেয়ে। তুমি আমায় বুঝো না, আমি কী চাই তা বুঝো না। দুই বছরের সম্পর্কেও আমাদের মধ্যে বিশাল এক দূরত্বই রয়ে গেছে, তার উপর আমার পরিবারও তোমায় মানবে না। অনেকদিন ধরেই কথাটা বলবো বলবো ভেবেও বলা হচ্ছিল না। যদি তুমি কষ্ট পাও? কিন্তু এখন সেই সময়টা এসে গেছে, আমাদের এই ঝুলন্ত সম্পর্কটার এখানেই ইতি ঘটানো উচিত। আমাকে ভুলে যাও মিফসা।”
কথাটা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় বর্ষ। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সম্মুখে। উথমী ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কানের কাছে বারংবার বাজতে থাকে সেসব কথা। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কত আকুতি মিনতিই না করেছিল মেয়েটি! কিন্তু প্রতারকের মন কী আর সহজে গলে? বর্ষের মনও গললো না। চলে গেলো মাঝ রাস্তায় মেয়েটিকে একা রেখে। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরে উথমী। কাউকে আর কিছু জানায় না। টানা তিনদিন জ্বরে ভুগে পড়ে থাকে বিছানায়। বাড়িতে অনেকবার সকলে এ নিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না সে। কেয়া বেগম হয়তো কিছু একটা আঁচ করতে পারেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বোঝানোর বদলে বিদ্রুপ করে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন,“নেচে নেচে ওই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল না? সেই হয়তো কিছু বলেছে। আমি তো আগেই বলেছিলাম, ওই ছেলে তোমার মেয়েকে কখনোই বিয়ে করবে না। সে তোমার মেয়েকে নাচাচ্ছে। এখন মিললো তো কথা?” এতোটুকু বলেই থামেন তিনি। কিছু একটা ভেবে পুনরায় মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়েন,“সত্যি করে বল, ও কী কিছু করেছে তোর সঙ্গে? এখনকার এসব সম্পর্ক তো আবার ভালো না।”
মায়ের করা কুৎসিত মন্তব্যে শরীরটা যেনো জ্বলে উঠলো উথমীর। নিজের উপরই নিজের ঘৃণা জন্মালো। মা হয়ে মেয়ের সম্পর্কে কী করেই বা এমন সব কথা বলতে পারেন একজন নারী? ভেবে পায় না উথমী। একপর্যায়ে গিয়ে সে বুঝতে পারে, আদরের ছোটো বোনটাও যে চরমভাবে তাকে হিংসে করে। মায়ের কানে তার নামে মিথ্যে অপবাদ রটিয়ে বিষিয়ে দেয় মন। সেই থেকেই বাড়িতে থাকা উথমীর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুরু হয় কথায় কথায় তাকে উদ্দেশ্য করে মা-বোনের খোঁচা মারা কটু কথা, খোটা দেওয়া। তাও সব বাবা, ভাইয়ের আড়ালে।
শেষ পর্যন্ত সজলকে আর বিয়ে করেনি উথমী। আর না যোগাযোগ করেছে বর্ষের সঙ্গে। ছেলেটির এক বন্ধুর মারফতে জানতে পেরেছিল পরিবার থেকে তারই পছন্দের কোনো এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে বর্ষর। সেসব শুনেও আর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না উথমী। ছেলেটা তার জীবনে এসে এই শিক্ষাটা অবশ্য ভালো করেই দিয়ে গিয়েছিল যে, মানুষকে সহজে ভালোবাসতে নেই, বিশ্বাস করতে নেই, আর না আছে হারামে স্বস্তি। মানুষ গিরগিটির মতো বারংবার মন বদলায়।
তারপর টানা তিন বছরের চেষ্টায় অনেক কষ্টে মুভ অন করেছে উথমী। নিজেকে আজ এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। যেখানে সে কারো উপর নির্ভরশীল নয়, যেখানে সে আর সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে না, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করে না তার মন। সে কঠোর এক নারী। যে এখন নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মুখ বুঁজে মেনে নেয় না কোনো অন্যায়। কিন্তু এই তিন বছরে কথায় কথায় মা-বোনের খোঁচা, অপমান, বিদ্রুপ সে ভুলে না। সবই খুব ভালো করে মনে আছে, মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। তবে তার উপর করা এই অত্যাচার কিছুটা লাঘব হয়েছিল চাকরিতে উর্ত্তীণ হওয়ার পর।
___________
রাত সাড়ে নয়টা। তৈমূর শ্বশুরবাড়িতে এসে পৌঁছেছে মিনিট দশেক আগে। ড্রয়িং রুমে উৎস এবং রায়হান কবীরের সম্মুখে বসে কথা বলছে। বাইরে থেকে ভেসে আসা স্বামীর কণ্ঠস্বর শ্রবণাতীত হতেই কান খাড়া হয়ে উঠলো উথমীর। ঘর থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে সামনে পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলো মায়ের। অপ্রস্তুত হলেন কেয়া বেগম। বললেন,“জামাই এসেছে।”
“হুম, গলার আওয়াজ পেয়েছি।”
“আজ রাতটা থেকে গেলে হয় না?”
“না।”
“কেনো? জামাইকে বলে দেখ। তুই বললে ঠিক রাজি হবে।”
“রাজি করাতে চাইছি না। বাড়িতে শাশুড়ি মা একা, চাচী শাশুড়িও অসুস্থ, বিছানা থেকে নামতে পারেন না। তার উপর কলেজে পরীক্ষা চলছে। এই মুহূর্তে বাবার বাড়িতে বেড়ানো সম্ভব নয়।”
“ওহ।”—-চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান কেয়া।
তৎক্ষণাৎ মাকে পিছু ডাকে উথমী,“ঊষার জন্য কী তোমার অনেক চিন্তা হচ্ছে মা?”
প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকান কেয়া। মুচকি হাসে উথমী। বলে,“একদিন এক ছেলেকে ভালোবাসার অপরাধে মানসিকভাবে কত অত্যাচারই না আমায় করেছিলে মা! নোংরা নোংরা কথা বলেছিলে, এমনকি ছোটো বোনটাও তোমার সাথে সায় দিয়ে কত কথাই না আমায় বলেছে! কখনো তাকে শাসন করে বলোনি, বড়ো বোনকে সম্মান কর। মেয়েকে নিয়ে তোমার খুব অহংকার ছিলো। অথচ আজ সেই মেয়েই মানসম্মান ডুবিয়ে কিনা চলে গেলো? তোমার শিক্ষা তো ভুল প্রমাণ হয়ে গেলো মা।”
মেয়ের কথায় অবাক হন কেয়া বেগম। আহত স্বরে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে,“উথমী!”
“যত যাই হোক, বোন তো! সুস্থভাবে যেনো বাড়ি ফিরে আসে এটাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।”
“ওসব এখনো ভুলিসনি?”
“উহু, আপন মানুষদের দেওয়া আঘাত কখনো ভুলা যায় না। শৈশবে সামান্য আদর, ভালোবাসা পাওয়ার ব্যাকুলতা ভুলা যায় না। জ্বরের দিনে মায়ের যত্ন পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ভুলা যায় না। নিজের প্রতিটি মুহূর্ত নষ্ট করে দেওয়া মানুষদের কাজকর্মও ভুলা যায় না। তবে আমি একদিন খুব আদর্শ মা হবো দেখো। প্রত্যেক সন্তানকে সমানভাবে ভালোবেসে বুঝিয়ে দিবো মা মানেই ভালোবাসা, মা মানেই মমতাময়ী। মায়েরা কখনো নিকৃষ্ট হতে পারে না। তাদের কখনো ঘৃণা করা যায় না।”
“আমি কখনোই তোকে কষ্ট দিতে চাইনি মা, আমি সত্যিই তোকে খুব ভালোবাসি।”
“এসব মায়া কথা আর বিশ্বাস করি না। তোমার ভালোবাসা পাওয়া নিয়েও এখন আর ভাবি না। যখন প্রয়োজন ছিলো তখনি তো বাসতে পারোনি।” —নিজের কথা শেষ করে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো উথমী।
কেয়া বেগম সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভেজা চোখে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের সূচালো কথায় বুকটা যেনো উনার ভারি হয়ে আসছে। বুকের উপর হাত রেখে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এই মুহূর্তে এসে কী উনি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন? উনার কী অনুশোচনা হচ্ছে?
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)