জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-২৪+২৫

0
17

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৪]

স্ত্রীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো তৈমূরের। প্রিয় মুখখানি দেখতে পেয়ে রোদের মতো অধরে তার ঝলমলিয়ে উঠলো তৃপ্তির হাসি। যা দৃষ্টি এড়ালো না উথমীর বরং সেই সুন্দর হাসিতে মুগ্ধ হয়ে তার মন খারাপটাও যেনো মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেলো। সাথে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে উঠলো অনুভূতির দল। তৈমূর কোমল স্বরে তার উদ্দেশ্যে বললো,“গিয়ে তৈরি হয়ে নিন, আমরা বের হবো।”

স্বামীর কথায় অবাক হয় উথমী। শুধায়,“এখনি?”

“হ্যাঁ।”

তাদের কথা শুনে উপস্থিত সকলে চমকায়। রায়হান কবীর দৃঢ় কণ্ঠে জামাতার উদ্দেশ্যে বললেন,“এলেই তো মাত্র আর এখনি কিনা চলে যাবে? তা কিছুতেই হচ্ছে না বাবা। রাতের খাবার না খেয়ে এখান থেকে যাওয়া তোমাদের চলবে না।”

স্ত্রীকে ইশারায় যেতে বলে শ্বশুরের পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তৈমূর। বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলে,“অলরেডি এখন সাড়ে নয়টা বাজে। খেয়েদেয়ে বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই রওনা দিলে এখনি দিতে হবে। দয়া করে আজ আর জোর করবেন না বাবা।”

“কিন্তু তাই বলে না খেয়ে চলে যাবে? তুমি আমাদেরকে জামাই আদরের সুযোগটাই দিচ্ছো না তৈমূর। বিয়ের পর নিয়ম রক্ষার্থে একবার এলেও বেয়াইনের অসুস্থতার কারণে একদিন থেকেই চলে গেলে। তারপর আরেকদিন আসার কথা থাকলেও হুট করে আর এলে না, বদলে ফেললে মত। এদিকে আজ এলেও যাওয়ার জন্য এতো তাড়াহুড়া?”

“আসার মতো সময়ই পাচ্ছিলাম না। তার উপর সাত সকালে ড্রাইভার ছুটি নিয়ে গ্ৰামে চলে গেলো! যার জন্য ড্রাইভারের অভাবে আমাকেই ড্রাইভ করতে হচ্ছে। অফিসের কাজের ব্যস্ততায় উনাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না বিধায় আমিই বললাম, বাবার বাড়ি থেকে এতোটুকু সময় না হয় ঘুরে আসুন। অনেকদিন ধরেই তো যাওয়া হয় না।”

“হ্যাঁ, উথমী সেসব আমাদের জানিয়েছে।”

এরপর আর জামাতাকে জোরাজুরি করতে পারলেন না রায়হান কবীর। তৈমূরের দেওয়া বিভিন্ন বোঝ মেনে নিতে বাধ্য হলেন। কথায় কথায় কেয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার মা কেমন আছেন বাবা?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

“শুনলাম তোমার চাচী অসুস্থ? কী হয়েছে উনার?”

“বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগ জটিলতা শরীরে বাসা বেঁধেছে। হঠাৎ করেই বিছানা থেকে আর উঠতে পারছেন না।”

“ওহ।”

তাদের কথাবার্তার মধ্যেই তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো উথমী। তার উপস্থিতি পেতেই আরো কিছুক্ষণ সকলের সঙ্গে কথা বলে তারপর বিদায় নিয়ে স্ত্রী সমেত শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তৈমূর।

চারিদিকে কৃত্রিম আলোয় রাতের নিকোষ কালো অন্ধকার বিলীন হয়েছে। রাতের আকাশে না তাকালে এখন যে রাত তা যেনো বুঝা বড়োই দুষ্কর। পার্কিং এরিয়াতে রাখা গাড়িটির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হাতের ভারি শপিং ব্যাগটি দেখিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো তৈমূর,“কী আছে এতে? ভারি কেনো?”

“কী আবার? পরীক্ষার খাতা।”

“আজ আপনার সাবজেক্টের পরীক্ষা হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়ে গাড়ির সামনের দ্বার খুলে দিয়ে দাঁড়ায় সে। উথমী স্বামীর পানে একপলক চেয়ে নিরবে উঠে বসে ভেতরে। সেই দরজা আটকে এবার চালকের আসনে এসে বসলো তৈমূর। হাত বাড়িয়ে স্ত্রীর সিট বেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে নিজেরটাও বেঁধে নিলো। তারপর আর বিলম্ব না করে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দক্ষ হাতে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে একসময় আবারো প্রশ্ন ছুঁড়লো,“বাড়িতে কী কারো কিছু হয়েছে?”

গাড়ি ছাড়তেই সিটে হেলান দিয়ে বাইরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো উথমী। স্বামীর করা প্রশ্ন শুনে পাশ ফিরে তাকায় সে। বিলম্ব না করে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে, “এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

“ওখানকার কাউকেই খুব একটা স্বাভাবিক মনে হয়নি।সবার মুখে কেমন এক চিন্তা, বিষণ্ণতা, দুঃখী দুঃখী ভাব। তারপর লিফটে আবার সেই হারুন আঙ্কেলর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি আমায় দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, ঊষার খবরটা শুনেই নিশ্চয়ই এসেছো? প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন আর উনাকে করা হয়নি। তার উপর ফ্ল্যাটে গিয়ে সবাইকে দেখলেও ঊষাকে তো দেখলাম না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বাইরে দৃষ্টি স্থির করে উথমী। কোনো কিছু না লুকিয়েই সবটা জানিয়ে দেয় স্বামীকে,“গতকাল রাত থেকে ঊষাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। ভাবী ওর ঘরদোর তল্লাশি করে যা বুঝেছে, সবকিছু নিয়ে ও বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে। এই নিয়েই বাড়িতে আপাতত শোক সভা চলছে। মা তো মেয়ের জন্য কেঁদে কেটে অস্থির!”

কথাগুলো শুনে ভীষণ আশ্চর্য হয় তৈমূর। সামনে দৃষ্টি স্থির রেখেই বললো,“এই জন্যই তবে কাল বাবা ওভাবে চলে এসেছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“থানায় গিয়েছিল?”

“হ্যাঁ।”

বিপরীতে বলার মতো আর কিছু খুঁজে পায় না তৈমূর। তাই নিরব রয়। তবে খবরটা শুনে তার মুখশ্রীতেও চিন্তার ছাপ সুস্পষ্টভাবে ফোটে উঠেছে। মাথা থেকে কিছুতেই বের হচ্ছে না তা। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কাটলো। মেইন রোডের মাঝখানে আসতেই রাস্তায় জ্যাম বেঁধে থেমে গেলো গাড়ি। উথমী এবার ফিরে তাকালো স্বামীর পানে।

কিছু একটা মনে পড়তেই মোবাইলটা হাতে নিলো তৈমূর। গ্যালারি ঘেঁটে বের করল একটা ছবি। তারপর মোবাইলটি ধরলো স্ত্রীর সম্মুখে। হঠাৎ মুখের সামনে এভাবে আলো পড়ায় ভড়কে গেলো উথমী। ঘাড় সোজা করে সিটে বসলো। তৈমূর বললো,“ভালো করে ছবিটা দেখুন একবার।”

তার হাত থেকে নিজের হাতে মোবাইলটা নিয়ে স্ক্রিনে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকালো উথমী। ছবির মেয়েটিকে দেখে বেশ চমকালো। একবার স্বামী তো আরেকবার মোবাইলের পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল,“এটা তো ঊষা! কিন্তু পাশে বসা এই ছেলেটা আবার কে? আর আপনিই বা এই ছবিটা কোথায় পেলেন?”

“পাইনি, আমিই তুলেছিলাম।”

“আপনি?”

“হ্যাঁ, আপনাকে দেখানোর জন্যই তুলেছিলাম কিন্তু পরে আর দেখানোর কথা মনে ছিলো না। আপনার রাগ ভাঙাতে গিয়েই তো ছবির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম!”

“কোত্থেকে তুললেন? কোথায় পেলেন এদের?পেলেনই যখন কিছু বলতে পারলেন না?”

“অফিসে যাওয়ার সময় জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম তখনি দেখতে পাই ওদের। যেভাবে বারবার একে অপরের গায়ের উপর পড়ছিল তাতে ওদের সম্পর্ক তেমন একটা স্বাভাবিক মনে হয়নি তাই ভাবলাম ছবি তুলে নেই। তাছাড়া এডাল্ট ছেলে-মেয়ে ওরা, পথে ঘাটে কিই বা বলবো? তারপর জ্যাম ছেড়ে দিলে ওরাও চোখের আড়াল হয়ে গেলো।”

বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে উথমীর। ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে, “আবার নতুন আরেকটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল ঊষা? এই ছেলের সঙ্গেই কী তবে পালিয়েছে?”

নানা ধরণের চিন্তা করতে করতে তৈমূরের মোবাইল থেকে নিজের মোবাইলে ছবিগুলো শেয়ারে নিয়ে পাঠিয়ে দেয় ভাইয়ের নাম্বারে। স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে, “মায়ের অতি আদরে এই মেয়ে একদম নষ্ট হয়ে গেছে। নইলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে এমন একটা ছেলের সঙ্গে কেউ চিপকে থাকে? ঘোরাঘুরি করে?”

প্রত্যুত্তর করে না তৈমূর। জ্যাম ছেড়ে দিতেই গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। ডান হাতে স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,“দিন।”

“কী?”

“আমার মোবাইল।”

স্বামীর কথায় পাত্তা দেয় না উথমী। ততক্ষণে মোবাইল হাতে পেয়ে ডাটা অন করে গ্যালারি থেকে সোজা সে চলে গিয়েছে ফেসবুকে। প্রোফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে এক ফাঁকে নিজের আইডি সার্চ করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ঢুকলো তৈমূরের ম্যাসেঞ্জারে। সামনের আয়না দিয়ে স্ত্রীর কাজকর্ম একপলক দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৈমূর। বলে উঠলো,“আমি নিতান্তই ভদ্র সভ্য একজন পুরুষ। যা খুঁজছেন তার কিছুই আপনি চিরুনি তল্লাশি করেও খুঁজে পাবেন না ওখানে।”

স্বামীর মুখেই স্বামীর করা প্রশংসা শুনে মুখ বাঁকিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিলো উথমী। ভার্সিটিতে থাকাকালীন বান্ধবীদের থেকে সে শুনেছিল, পুরুষ মানুষের চরিত্র কেমন তা বুঝা যায় তাদের ম্যাসেঞ্জার চেক করলে। এতোদিন অবশ্য কথাটা তার মনে ছিলো না তবে মোবাইলটা হাতে পেয়ে ঠিকই তা মনে পড়ে গেলো উথমীর। কয়েক মিনিট বাদে তৈমূর পুনরায় বললো,“বলেছিলাম না পাবেন না কিছু? অযথাই চার্জ শেষ করছেন।”

“হৃদিতা কে? অ্যাকাউন্ট থেকে অনেকগুলো অতি রোমান্টিক ম্যাসেজ এসেছে আপনার কাছে। কে ও?”

“ম্যাসেজ রিকোয়েস্টে ঝুলে আছে।”

“কিন্তু আপনি সিন করেছেন সব।”

“আম্মা আর আপার পছন্দ করা মেয়ে।”

“আরো একটা মেয়ে?”

“বিয়ের বয়স হলে আশেপাশে কত মেয়ের আনাগোনা থাকে!”

“ওহ।”

এ প্রসঙ্গে আর স্বামীকে ঘাঁটায় না উথমী। জায়গামতো রেখে দেয় মোবাইল। আয়না দিয়ে স্ত্রীর মলিন মুখশ্রী আড়চোখে দেখে মুচকি হাসে তৈমূর। নিজ থেকেই বলতে থাকে,“আমাদের বিয়ের মাস ছয়েক আগেই এই মেয়ের সন্ধান নিয়ে বাড়িতে হাজির হয় বুবু। আম্মা আবার বুবুর কথাকে সর্বদাই গুরুত্ব দেন। কারণ বুবু হচ্ছে বিচক্ষণ মানুষ। উনি কখনোই আমাদের কিংবা আমাদের পরিবারের কোনো ক্ষতি চান না। তাই বুবুর রসিয়ে কষিয়ে বলা কথা শুনে আম্মা গলে গিয়ে এক ফাঁকে আমাদের কাউকে না জানিয়েই নাকি মেয়েকে দেখতে গিয়ে একেবারে মেয়ে পছন্দ করে আংটিও পরিয়ে দিয়ে আসেন।”

উৎসুক দৃষ্টিতে স্বামীর পানে এবার তাকায় উথমী। তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,“একেবারে আংটি! এতো পছন্দ হয়েছিল?”

“হ্যাঁ, আমি আবার জেনেছিলাম তার সপ্তাহ খানেক পর। বাবা মারা যাওয়ার মাস দুয়েক পর আমি নতুন চাকরি পাই। এরপর থেকেই বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে দেন আম্মা। সরাসরি জানিয়ে দেন, আমার বউ নাকি উনি নিজে পছন্দ করে ঘরে তুলবেন। তারপর থেকেই শুরু হয় বাড়িতে ঘটকের আনাগোনা। কিন্তু পাত্রী নিয়ে তিনি খুবই বিরম্বনায় পড়েন। কাউকে আম্মার পছন্দ হলে বুবুর পছন্দ হয় না, দুজনের পছন্দ হলে পছন্দ হয় না মেয়েদের পারিবারিক অবস্থা,আবার উনাদের সবদিক দিয়ে পছন্দ হলে আমার পছন্দ হয় না। এভাবেই দেড় দুই বছর যাওয়ার পর হাল ছেড়ে দেন উনারা। শেষমেশ ওরির জেএসসি পরীক্ষার সিট যেখানে পড়ে সেখানে গিয়ে কোনো এক অভিভাবকের মাধ্যমে এই হৃদিতার খোঁজ পায় বুবু। এক ফাঁকে সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে গিয়ে নাকি দেখে আসে মেয়েকে। তারপর ওরির পরীক্ষা শেষে আম্মাকে এসে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বুবুই নিয়ে যায় মেয়ে দেখাতে আর সেখানে গিয়ে একপর্যায়ে আম্মারও বেশ পছন্দ হয়ে যায়।”

“বাব্বাহ! তাহলে তো বলতে হয় মেয়েটি দেখতে অত্যন্ত রূপসী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন। এমন মেয়ে ছেড়ে ছেলে আমার কাছে এসেছে বলেই তবে উনাদের এতো রাগ আমার উপরে?”

মুচকি হাসে তৈমূর। প্রত্যুত্তরে বলে,“যা ভাবছেন তেমন কিছু না। আমাদের সমাজে এখনো বেশিরভাগ মানুষ বিয়ের বাজারে অল্প বয়সী কিশোরী মেয়েদেরকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। আর শিক্ষিত, বিশ একুশ পেরিয়ে যাওয়া মেয়েদের দেখে হীন, নিচু দৃষ্টিতে। আমার মা- বোনও সেসব মানুষদের কাতারেই পড়ে। তাদের মন মানসিকতাও ঠিক তেমনি। নিজেরা অল্প বয়সে সংসার জীবনে প্রবেশ করে ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারেনি তাই ছেলের জন্যও তেমন মেয়েই চায়। আমার ভাইয়ের জন্যও এমনি চেয়েছিল কিন্তু শেষমেশ বাবার কারণে ভাইয়ার পছন্দ মোতাবেক ভাবীর সঙ্গেই তার বিয়ে হয়। যার কারণে আম্মা ছিলেন নারাজ। তবে এর শোধও অবশ্য ভাবীর উপরে কম তোলেননি। একসময় এই সাংসারিক অশান্তিতে ধৈর্য হারিয়ে ভাইয়া গিয়ে বাবার সাথে কথা বলে। বাবাই হয়তো আলাদা হওয়ার বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন তাকে। নইলে এসব বুদ্ধি ভাইয়ার মতো মানুষের মাথায় আসার কথা নয়।”

“আপনার বাবা এমন বুদ্ধি দিয়েছে? তাও নিজের ছেলেকে?”

“হ্যাঁ, আমার অবশ্য তাই মনে হয় নইলে বাবা বেঁচে থাকাকালীন আলাদা হওয়ার মতো দুঃসাহস ভাইয়ার হতো না। বাবা আর আম্মাকে প্রচন্ড ভয় পেতো সে।”

“আর হৃদিতা মেয়েটা? সব ঠিক হওয়ার পরেও তার সঙ্গে আপনার বিয়ে হলো না কেনো?”

“মেয়েটা একটু বেশিই ছোটো। আমার থেকে বারো তেরো বছরের ছোটো তো হবেই! সবে কলেজে পা দিয়েছে। অতোটুকু একটা মেয়ে আমার সঙ্গে যায়? ও আমায় বুঝবে? নাকি আমার সংসার বুঝবে? তাছাড়া আমিও কী আর ওকে বুঝবো? এক যুগেরও বেশি দুজনের বয়স থেকে শুরু করে মন মানসিকতার পার্থক্য। অথচ আম্মা এতোকিছু না ভেবে বয়স কম, পারিবারিক অবস্থা ভালো দেখেই বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। আমি আবার এ বিষয়ে জেনেছি আংটি পরিয়ে আসার তিনদিন পর তাও এই মেয়ের এসব আজেবাজে ম্যাসেজ দেখে। প্রোফাইল ঘেঁটে দেখি বাচ্চা একটা মেয়ে কিন্তু কথাবার্তা খুবই পাকা পাকা। যদিও এই বয়সী মেয়েরা একটু বেশিই পাকা আর আবেগ প্রবণ হয় তাই আর রিপ্লাই দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। তবে বাড়িতেও এ বিষয়ে কিছু বলিনি, আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম তারা কখন আমায় জানায়।”

দম ফেলে তৈমূর। কয়েক সেকেন্ড থেমে আবারো বলা শুরু করে,“তারপর আম্মা, বুবু, দুলাভাই সবাই মিলে একদিন একসঙ্গে বসে আমায় সবটা জানায়। বিয়েতে রাজি করানোর জন্য অনেকভাবে বোঝায় কিন্তু মেয়ের বয়স শুনেই আমি সঙ্গে সঙ্গে না করে দেই। এর মধ্যে আবার ভাইয়া নিয়ে আসে আরেক মেয়ের সন্ধান। আম্মাকে ছবি দেখানোর পর উনার খুব পছন্দ হলেও পরবর্তীতে বুবুকে সেই ছবি দেখালে বুবু একটু গড়িমসি শুরু করে। পরে নাকি মেয়ের বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনে রিজেক্ট করে দিয়েছিলেন আম্মা। এরপর টানা তিন মাস আমার জীবনে চললো বিপর্যয়।”

“বিপর্যয়? কেনো?”

“কেনো আবার? সারাদিন অফিস শেষে রাতে বাড়ি ফিরলেই বিয়ে নিয়ে আম্মার চাপাচাপি। ওদিকে বুবুও ফোন দিয়ে বারবার বোঝায়, একবার মেয়ের সঙ্গে তো অন্তত দেখা করে আয়। বুবুর মতে, এই মেয়েকে বিয়ে না করলে আমায় নাকি পস্তাতে হবে। এদিকে আবার আলাদাভাবে ভাই-ভাবীও কল দিয়ে সেই এক কথা, তৈমূর আম্মার ফাঁদে একদম পা দিবে না। জীবন শেষ হয়ে যাবে! এর থেকে আমাদের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গে একবার দেখা করে এসো। এই মেয়েই তোমার জন্য একদম পার্ফেক্ট। উফ! পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর এক কলিগের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করার পর তিনিই পরামর্শ দিলেন, এর হাত থেকে বাঁচতে চাইলে সময় নিয়ে দুই পাত্রীকেই দেখে আসুন। এদের মধ্যে যাকে ভালো লাগবে তাকেই না হয় বিয়ে করবেন আর ভালো না লাগলে বাড়িতে কয়েক মাস আর যাওয়ার দরকার নেই। এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো উথমীর। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এর মধ্যে আমি ছিলাম ভাই-ভাবীর পছন্দের মেয়ে, তাই তো?”

“হুম।”

“ওই হৃদিতার সঙ্গে আমার আগে দেখা করেছিলেন?”

“উহুম, দেখাই করিনি। এর বয়স, ক্লাস আর পাকা পাকা ম্যাসেজ দেখে শুরুতেই বাতিলের লিস্টে রেখে দিয়েছিলাম। দেখাদেখির তো প্রশ্নই ওঠে না। বউ খুঁজেছিলাম, বাচ্চা নয়। ওদিকে আপনাকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ ছিলো না। যাকে দেখিনি তাকে রিজেক্ট করবো কীভাবে? যেই ছবি ভাইয়া এনেছিল সেই ছবি আমাকে আম্মা দেখাননি। কিন্তু বিয়ে না করার চিন্তা-ভাবনা নিয়েই আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তবে কথাবার্তার ঝাঁঝ, রূপ আর ভাই- ভাবীর করা প্রশংসা শুনে মনে হলো বিয়েটা যখন করতেই হবে তখন একে কেনো নয়? তাই ভাইয়ার মতো আমিও শেষ পর্যন্ত আম্মার বিপক্ষে গিয়েই ফরজ কাজটা সেরে ফেললাম। ঠিক করেছিলাম না?”

অধরে অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফোটে ওঠে উথমীর। প্রসঙ্গ বদলে শুধায়,“তা বিয়ের আগে কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলেন? প্রেম করেছিলেন?”

“না, সেসব আমার জীবনে আসেনি।”

“কখনোই না?”

“না।”

“কেনো?”

“একদম ছোটবেলায় তো অসব বুঝিনি। প্রাইমারির গন্ডি পেরোতেই বাবা নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন বয়েজ স্কুলে। যার জন্য প্রেম করার মতো আশেপাশে কোনো মেয়েই ছিলো না। তারপর ওই ধাপ শেষ করে চান্স পেলাম গিয়ে সেই নটরডেম কলেজে। ওখানেও শুধু ছেলে আর ছেলে! আবেগের বয়সে যে প্রেমে পড়ব সেই সুযোগটাও আমার কাছে ছিলো না। তার উপর তখন হোস্টেলে থাকতাম বলে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করাও ছিলো একদম নিষিদ্ধ।”

“ভার্সিটি লাইফ?”

“ইচ্ছে করেনি, ততদিনে ওসব আবেগ আর আমার মধ্যে ছিলো না। কখনো সেভাবে কারো দিকে তাকানো হয়নি। অযথা এসবে সময় নষ্ট করে, পাপ বাড়িয়ে কী লাভ?”

সিটে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে পাশে বসা লোকটির পানে তাকিয়ে আছে উথমী। এই প্রথম উথমীর মনে হলো এই লোকটি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী চমৎকার একজন সুপুরুষ। যার জীবনে মা-বোনের পর সে ছাড়া আর উটকো কোনো নারীর অস্তিত্ব নেই। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক জুড়ে হানা দিলো অতি বিচ্ছিরি একটি কথা,“তুই এই স্বচ্ছ পুরুষটির যোগ্য নস উথমী। এই পুরুষটি তোর থেকেও আরো ভালো, সৎ কোনো নারীকে জীবনে পাওয়ার কথা ছিলো। সেখানে তুই কী তাকে ঠকাসনি?”

দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো উথমীর। চোখ জোড়া বন্ধ করে নিঃশব্দে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে চাইলো সে। দৃষ্টি সরিয়ে স্থির করল কাঁচ নামানো জানালার বাইরে। মস্তিষ্কের সঙ্গে প্রবল লড়াই করতে করতে তার বিরুদ্ধে গিয়েই একসময় মনে মনে বলে উঠলো,“নাহ, আমি ভুল করেছিলাম! আবেগের বশে ভুল মানুষের দিকে একসময় ঝুঁকে পড়েছিলাম। কিন্তু তার জন্য কম শাস্তি তো আর পাইনি? এখন আমার জীবনে তৈমূর ছাড়া আর কেউ নেই, কেউ না। এটাকে ঠকানো বলে না।”

তার বিভিন্ন উদ্ভট সব ভাবনার মধ্যেই গাড়িটা আবারো থেমে গেলো। সিট বেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে এসে উথমীর পাশের দরজাটা খুলে দিলো তৈমূর। বললো,“নেমে আসুন।”

ধ্যান ভঙ হলো উথমীর। ঘোরের মধ্যেই শুধালো, “আমরা কী পৌঁছে গিয়েছি?”

“না, এখনো কুড়ি মিনিটের পথ বাকি।”

“তাহলে?”

“খিদে পায়নি আপনার? আমার তো পেয়েছে। নেমে আসুন। এখানকার রেস্তোরাঁটা খুব ভালো। চলুন রাতের খাবারটা বরং আজ এখানেই সেরে নেই।”

“আপনার মা চিন্তা করবেন না?”

“না, ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি। এতোকিছু না ভেবে নেমে আসুন তো।”

বিপরীতে আর কিছু বললো না উথমী। বাধ্য মেয়ের মতো গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তারপর গাড়ি লক করে তৈমূর সামনে এগোতেই তার পিছুপিছু হাঁটা ধরলো।

চলবে _________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৫]

ঊষা পালিয়ে যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পেরিয়েছে। উথমীর পাঠানো ছবিগুলো নিয়ে তার পরেরদিনই থানায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল উৎস‌। কিন্তু তাতেও বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। ছবির সেই ছেলেটির খোঁজ পেলেও পাওয়া যায়নি ঊষার কোনো খোঁজ। ছেলেটির ভাষ্যমতে, ঊষার সঙ্গে বেশ কয়েকদিন আগেই তার সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে। এরপর থেকে দুজনার মধ্যে হয়নি আর কোনো ধরণের যোগাযোগ।

সে বিষয়ে বেশ কয়েকদিন তদন্ত চললেও ছেলেটির বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্তপোক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় শেষমেশ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। মনের গহীনে সন্দেহ ডানা বাঁধে, তাহলে কী অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো মেয়েটির? হতে পারে।

যে স্বেচ্ছায় হারায় তাকে কী আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব?তাই হয়তো ঊষাকেও আর পাওয়া গেলো না। পুলিশও একপর্যায়ে ওখানেই কেসটার ইতি টেনে দিলো। সাথে অবশ্য বিদ্রুপ করে এও বলে দিয়েছিলেন ওসি সাহেব, “পারিবারিক শিক্ষাই হচ্ছে বড়ো শিক্ষা। যা আপনারা আপনাদের মেয়েকে দিতে পারেননি। নইলে একটি মেয়ের একসঙ্গে এতো ছেলের সাথে কীভাবে সম্পর্ক থাকতে পারে? আর টাকা-পয়সা, গহনা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার দুঃসাহসই বা পায় কীভাবে?”

এতো অপমানের পরে আর কোনো কথাই থাকে না। তৎক্ষণাৎ ছেলেকে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে আসেন রায়হান কবীর। এতো বছরের অর্জিত সম্মান কয়েক মুহূর্তেই নিজের এক অপদার্থ সন্তানের কারণে ধূলোয় মিশে গিয়েছে উনার। বাড়িতে এসেই তিনি ঘোষণা করে দিলেন,“আজ থেকে আমার দুই সন্তান, উৎস এবং উথমী। ওরা ব্যতীত আমার আর কোনো সন্তান নেই। তাই ওই মেয়ের নাম আমি আর কারো মুখে শুনতে চাই না। তার জন্য এখনো যদি কারো মনে কষ্ট থেকে থাকে তাহলে সে যেনো এবাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।”

স্বামীর এই রাগান্বিত স্বরে বলা কথায় কেয়া বেগম যেনো ভয়ে কেঁপে উঠলেন। কথার বিপরীতে আর টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারলেন না তিনি। নিরবে শুধু ফেলে গেলেন চোখের পানি।

রিনিতার শরীরটা দিনদিন খারাপ যাচ্ছে। সংসার সামলে উঠে পুত্রবধূর সেবা শুশ্রূষা করা কেয়া বেগমের পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়ের কথা এখনো তিনি ভুলতে পারেননি। শেষ বয়সে এসে স্বামীর ভয়ে মন খুলে কাঁদতেও পারেন না। কয়েকদিনের ব্যবধানে কঠিন হৃদয়ের এই ভদ্রমহিলার কি একটা অবস্থাই না হয়েছে! না ঠিকমতো খেতে পারছেন আর না পারছেন ঘুমাতে। ছোটো মেয়েটিকে কত আদর দিয়েই না বড়ো করেছিলেন কেয়া? অথচ সেই আদর ভালোবাসাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুদিনের কোনো এক ছেলের ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা বাড়ি ছেড়েই চলে গেলো মেয়েটি? বোকা মেয়ে! এই যুগে এসেও বুঝতে পারলো না বাবা-মা, ভাই-বোন ছাড়া একটি মেয়েকে কেউ বেশি ভালোবাসতে পারে না। এরা ব্যতীত কেউ তার আপন নয়। পরিবার ব্যতীত সকল ভালোবাসায় রয়েছে স্বার্থ।

তনি ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে। খানিক বাদে বাদে আইসক্রিমের দিকে ফিরে ফিসফিস করে কিছু বলছে। কেয়া বেগম কাজের বুয়াকে সঙ্গে নিয়ে এই অসময়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বানাচ্ছেন পিঠেপুলি। রায়হান কবীর বাড়িতে নেই। হয়তো সঙ্গীদের নিয়ে গিয়েছেন কোথাও হাঁটতে।

কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। বুয়া ছুটে এসে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে প্রবেশ করল উৎস এবং রিনিতা। অফিস থেকে হাফ বেলা ছুটি এনে স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল উৎস। সেখান থেকেই সবে ফিরলো তারা। বাবা-মাকে একত্রে ফিরতে দেখে দৌড়ে গেলো তনি। তৎক্ষণাৎ মেয়েকে কোলে তুলে নিলো উৎস। আদুরে গলায় শুধালো,“আমার তনি মা খেয়েছে?”

“হুম, দাদী খাইয়ে দিয়েছে।”

“দুষ্টুমি করেছে দাদীর সাথে?”

“উহু করেনি, তিপস এনেছো?”

“হুম এনেছি, তোমার আম্মুর কাছে।”

বাবার উত্তর শুনে মায়ের পানে তাকায় তনি। রিনিতা ততক্ষণে গিয়ে বসেছে সোফায়। বাবার কোল থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে চলে আসে তনি। আলতো করে ছোট্ট হাতটা মায়ের গর্ভের উপর রেখে মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়,“আম্মু ডাকতাল কবে বের করে দিবে বাবুকে?”

মেয়ের কথায় আপনাআপনি ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে ওঠে রিনিতার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,“এইতো আর কয়েকদিন পর।”

“এখন বের করলে কী হবে?”

“বাবুর কষ্ট হবে, এই নাও তোমার চিপস। তোমার জ্যান্ত আইসক্রিমকে নিয়ে দাদীর ঘরে গিয়ে খাও।”

মুহূর্তেই চিপস দিয়ে মেয়েকে ভুলিয়ে ধীরে সুস্থে ঘরের পথে পা বাড়ালো সে। বাইরে থেকে এসেছে, পোশাক বদলে হাত-মুখ ধুতে হবে তো?
_________

দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভোগার পর সকাল থেকে সুস্থতা অনুভব করছেন জয়নব। টানা তিনদিন বাঁচা মরার অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে পড়ে থেকে গতকাল রাতেই সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। সেই সংবাদ শুনে মেয়ে, মেয়ে জামাই, নাতি-নাতনি থেকে শুরু করে উনার বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজনেরা ভিড় জমিয়েছে ফুলকুঞ্জে।

দুদিন আগেও নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত লোকজনের সাড়াশব্দ না পাওয়া বাড়িটিতে আজ যেনো কোথাও পা ফেলার জো নেই। জয়নব নিজ ঘরের বিছানায় অর্ধ শোয়া অবস্থায় বসে আছেন। অল্প কয়েকদিনেই যেনো শরীরটা উনার বুড়িয়ে গেছে। উনার ঠিক পাশেই বসে আছেন বড়ো মেয়ে বুশরা, ছোটো জা করবী আর মেঝেতে নাতনিকে নিয়ে বিছানো মাদুরে বসা ছোটো মেয়ে রেনুকা এবং ছোটো ভাইয়ের বউ বিলকিস।

মালতী ফুফু এসে বাকিদের চা বিস্কুট আর জয়নবের হাতে ফলের বাটি এবং গ্লুকোজের গ্লাসটি ধরিয়ে দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“তুরাগ বাবায় আমনেরে সবগুলা খাইতে কইছে। আমি এক ঘণ্টা পর আইয়া খালি বাডিগুলা লইয়া যামু।”

নিজের কথা শেষ করে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন তিনি। জয়নব তৎক্ষণাৎ পিছু ডাকলেন, “এই মালতী! হুন না।”

পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ালেন মালতী ফুফু। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে পিছু ফিরে তাকালেন। জয়নব মৃদু হেসে বললেন,“আমার না পোলাও গোশ খাইতে মন চাইছে। তুরাগের বউয়ের পোলাও গোশ রান্ধা অনেক স্বাদ হয়! সেই তৈমূরের বিয়ার সময় খাইছিলাম। একটু গিয়া কবি আইজ একটু রান্না করতো? রাইতে খামু।”

কথার পিঠে তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিতে পারলেন না মালতী ফুফু। রেণুকা চোখমুখ কুঁচকে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনি পোলাও মাংস খাবেন আম্মা? শরীর তো আপনার আরো খারাপ করবে। এখন এসব খাওয়ার দরকার নেই। একেবারে সুস্থ হয়ে তারপর না হয় খাবেন।”

মেয়ের কথায় মুখখানি মলিন হয়ে গেলো জয়নবের। আহত স্বরে বললেন,“এমন করোস ক্যান রে রেণু? অনেকদিন ধইরাই খাইতে মন চাইতাছিল কিন্তু মুখে তেমন রুচি পাইতাছিলাম না। এহন মুখে রুচিও আছে আবার আইজ তুরাগরাও আইছে। খাই না? সুস্থ হওয়া পর্যন্ত বাঁচমু না মরমু তার কোনো গ্যারান্টি আছে?”

রেণুকা হয়তো আরো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু মালতী ফুফু তাকে আর বলার মতো কোনো সুযোগ না দিয়ে নিজেই বললেন,“আমি বড়ো বউরে গিয়া কইতাছি। মনের ইচ্ছা পূরণ করতে হয়। হাছাই তো, কাইল কে বাঁচবো আর কে মরবো তার কোনো হিসাব আছে? আমনে বরং এই ফল আর শরবত খাইয়া শেষ করেন বড়ো ভাবী। আমি যাইয়া কইতাছি।”

কথাটি শুনে পূর্বের ন্যায় আবারো ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ঝলমলিয়ে উঠলো জয়নবের। মালতী ফুফু সেখান থেকে চলে এলেন নিচে।

অন্দরমহল জুড়ে দৌড়াদৌড়ি করছে বাচ্চারা। সোফায় বসে গল্প করছে জয়নবের মেজো মেয়ে ঝুমুর, ভাইয়ের দুই ছেলের বউ আসমা, শেফা এবং মা-মেয়ে শাহানা, তিথিয়া। অবশেষে রাগ, অভিমান ঝেড়ে ফেলে স্বামী সন্তান নিয়ে গতকাল রাতেই বাপের বাড়িতে এসেছে তিথিয়া। স্বামীর পরামর্শে মা, ভাইয়ের সঙ্গে মিটিয়ে নিয়েছে সকল ভুল বোঝাবুঝি। বাড়িতে আসা সব পুরুষদের নিয়ে তুরাগ গিয়ে বসেছে দুতলার ছোট্ট ড্রয়িং রুমটায়। সেখানেই বিকেলের চায়ের সঙ্গে মেতে উঠেছে তাদের আড্ডা।

উথমী তখন সবে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। রাস্তার জ্যামের কারণে ফিরতে ফিরতে আজ তার আধ ঘণ্টা দেরি হয়েছে। তিথিয়া ভাইয়ের বউকে দেখতেই মুখ বাঁকিয়ে মায়ের পানে তাকিয়ে ইশারা করল। মেয়ের ইশারায় পুত্রবধূর পানে তাকালেন শাহানা কিন্তু উচ্চস্বরে কিছু বলার সাহস পেলেন না। এতোগুলো মানুষের সামনে খারাপ শাশুড়ির তকমা পাওয়া বড়োই বেমানান। তাই সাবলীলভাবে জিজ্ঞেস করলেন,“আজ ফিরতে এতো দেরি হলো যে?”

শাশুড়ির প্রশ্নে পথিমধ্যেই থেমে দাঁড়ালো উথমী। উত্তর দিলো,“রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো।”

সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্রুপের সুরে ভেসে এলো তিথিয়ার করা মন্তব্য,“সত্যিই জ্যাম ছিলো নাকি বাড়িতে এতো মানুষ দেখে কাজ করার ভয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে ছিলে?”

কথাটায় ভীষণ বিরক্ত হলো উথমী। অপমানজনক কথাবার্তার কারণে ননদ নামক ভদ্রমহিলাকে এখন আর সহ্য হয় না তার। তাই সৌজন্য না দেখিয়ে সোজাসাপ্টা জবাবে বললো,“নিজের সংসার ফেলে দুদিন পরপর বাপের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকার মেয়ে আমি নই। আপনার বিশ্বাস না হলে নিজে একবার যাতায়াত করে দেখুন।”

কথাটা শেষ করে আর সেখানে দাঁড়ালো না সে। দ্রুত হেঁটে চলে গেলো ঘরে। তিথিয়ার মুখশ্রী অপমানে হয়ে গেলো থমথমে। মুখ বাঁকিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো, “দেখলে কেমন তেজ মেয়ের?”

তার কথায় সায় জানালো সকলে। আসমা ফোড়ন কেটে বললো,“হ্যাঁ দেখলাম। আমরা তো আমাদের শাশুড়ি, ননদের চোখের দিকে তাকানোর সাহসটাই পাই না আর এ একেবারে মুখে মুখে তর্ক করে গেলো?”

আসমার কথায় উৎসুক হয়ে উঠলো মা-মেয়ে। শাহানা অসহায়ের মতো মুখ করে বললেন,“কী আর বলবো মা? সবই আমার কপাল। ছেলে আমার শিক্ষিত মেয়ে ঘরে এনেছে, কিছু বলাও যায় না। মুখের উপরই ঠাস ঠাস করে জবাব দিয়ে দেয়।”

ঝুমুর আড়চোখে চাচীর পানে তাকিয়ে শুধালো, “তৈমূর যেই ভদ্র, শান্তশিষ্ট ছেলে! আপনি শুরুতে বাঁধা দিলে এমন মেয়ে কী আর আনতে পারতো বাড়িতে? দোষ তো আপনারই মেজো চাচী। বিয়ের আগে যাচাই-বাছাই করে নিবেন না?”

“আর যাচাই-বাছাই! তৈমূ নিজে নিজে এসব করার ছেলে? সারাজীবন তো আমার ছেলে ওর বাপের মতো লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। এই মেয়েকে ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব তুরাগের বউয়ের কাজ।”

মুহূর্তেই জমে উঠলো গল্পের আসর। এক কথা দুকথা থেকে শুরু হলো বাড়ির বউদের দোষ গুণ খোঁজার কাজ।

সন্ধ্যার জন্য নাস্তা তৈরি করছে জেবা। তার হাতে হাতে সাহায্য করছে করবীর পুত্রবধূ সূচি। মালতী ফুফু উপর থেকে সোজা এলেন রন্ধনশালায়। জেবার উদ্দেশ্যে বললেন,“বড়ো ভাবী তোমার হাতের পোলাও গোশত খাইতে চাইছে গো বউ।”

সিঙ্গারায় আলুর পুর ভরছিল জেবা। কথাটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। ভাবুক হয়ে বললো,“এখন পোলাও গোশত?”

“এহন না, রাইতে খাইবো।”

“ওদিকে আম্মা তো বলে গেলেন সাদা ভাত, মাছ, মুরগি আর ডাল রাঁধতে। তাছাড়া গরুর গোশতও তো ফ্রিজে নেই। জোহানের বাবাকে কাল সকালে বাজারে পাঠাবো ভেবেছিলাম।”

“কী কমু কও? কত্তগুলা দিন অসুখে ভুইগা মানুষডা খাইতে চাইলো, না খাওয়াইলে কেমনে হয়? মানুষের হায়াত মউত তো আর বইল্লা কইয়া আহে না।”

মাথা নাড়ায় জেবা। এই মুহূর্তে কী করবে বুঝতে পারে না সে। সূচি সিঙ্গারা ভাঁজতে ভাঁজতেই বলে উঠলো, “এক কাজ করুন ভাবী, শুধু বড়ো চাচীর জন্য না হয় পোলাও গোশত রান্না করে দিন আর বাকিদের জন্য যা যা বলা আছে তাই রাঁধবেন। আমরা তো আছিই, একসঙ্গে করতে করতে সব সেরে ফেলবো।”

“হ্যাঁ তাই ভাবছি, মানুষটা খেতে চেয়েছে যখন। কিন্তু গরুর গোশত?”

“আমি বরং আপনার দেবরকে বলে আসি, ও গিয়ে না হয় নিয়ে আসবে।”

সায় জানায় জেবা। সূচি আর দাঁড়ায় না সেখানে।খুন্তিটা মালতী ফুফুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় স্বামীর খোঁজে।

বাইরের পোশাক বদলে হাত-মুখ ধুয়ে সোজা নিচে নেমে রন্ধনশালায় প্রবেশ করল উথমী। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে অধরে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে প্রশ্ন করল,“নাস্তা বানাচ্ছেন আপনারা?”

কথাটি শুনে তার দিকে ফিরে তাকালো সবাই। ছোটো জাকে দেখে মুচকি হাসলো জেবা। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কখন ফিরলে?”

“এইতো কিছুক্ষণ আগে।”

“ইদানিং কাজের চাপ বেড়েছে মনে হয়?”

“হ্যাঁ, কিছুটা।”

“তা একটু বিশ্রাম নিতে পারতে, আমরাই তো এদিকটা সামলে নিচ্ছিলাম। সারাদিন খাটাখাটুনির পর আগুনের তাপ সহ্য হবে?”

অধরে হাসি ফোটে উঠলো উথমীর। শুরু থেকেই মেয়েটির আচার ব্যবহারে মুগ্ধ সে। এই বাড়িতে এসে স্বামীর পরে এই মানুষটিকেই সে পেয়েছে যে কিনা তার সঙ্গে কখনোই কোনো খারাপ আচরণ করেনি। কথার বিপরীতে হেসে বললো,“সমস্যা নেই, অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।”

আড়চোখে একবার তাকে দেখে রান্নায় মন বসালো জেবা।
চাকরি আর সংসার দুটো একসঙ্গে সামলানো মোটেও সহজ নয়। পুরুষ যেমন অফিসে যাওয়ার আগে সম্মুখে সাজানো খাবার, গোছানো জামা-কাপড় পায়! এমনকি বাড়ি ফিরে হাতের নাগালে পেয়ে যায় সমস্ত কিছু তেমন করে একটা নারী সেসব সুবিধা পায় না। চাকরি করতে হলে নিজের সমস্যার সমাধান তার নিজেকেই করতে হয়। নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে করতে হয় সংসারের চিন্তা। তাদের ক্লান্তি নেই, তারা হাসিমুখেই ঘরে বাইরে করতে পারে অসাধ্য সাধন!
__________

রাতে তৈমূরের ফিরতে ফিরতে বেজে গেলো নয়টা। বাড়িতে সকলের আসার খবর পেয়ে আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিসের কাজ সেরে চলে এসেছে সে। অন্দরমহলে প্রবেশ করতেই দেখা পেয়ে গেলো মা আর বোনের। সঙ্গে করে নিয়ে আসা ফলমূল, মিষ্টান্ন এবং বাচ্চাদের জন্য ফাস্টফুডগুলো সেন্টার টেবিলের উপর রেখে মায়ের দিকে একবার তাকালো। বললো, “বড়ো চাচীর ঘুমের ওষুধটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেটা নিয়ে এসেছি।”

“আচ্ছা, এখানে রেখে দে। আমি কাউকে দিয়ে না হয় উনার ঘরে পাঠিয়ে দিবো।”

মাথা নাড়ায় তৈমূর। শাহানা পুনরায় বলেন,“ঘরে যা। হাত-মুখ ধুয়ে আয়। আমি ওদের খাবার বাড়তে বলি।”

“সবে নয়টা বাজে আম্মা, এতো তাড়াতাড়ি খাবো না। পরে সবার সাথে একসাথে বসবো।”

ছেলের কথাতেই সায় জানালেন শাহানা। তৈমূর ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই তিথিয়া প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তোর হাতের প্যাকেটে কী আছে? ঘরে নিয়ে যাচ্ছিস যে? বউয়ের জন্য আবার আলাদা করে কিছু নিয়ে এসেছিস নাকি?”

বড়ো বোনের কথায় ভড়কে গেলো তৈমূর। আমতা আমতা করে বললো,“আলাদা করে আবার কী নিয়ে আসবো? আমারই প্রয়োজনীয় কিছু।”

“খাবারের ব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু?”

“হ্যাঁ, দোকান থেকে ওসব কেনার সময় এক্সট্রা ব্যাগ এনে কিছু ফাইল ভরেছিলাম এতে। যাতে আনতে সুবিধা হয়। দেখবে?”

সঙ্গে সঙ্গেই দেখার জন্য সেদিকে উঁকি দিলো তিথিয়া। এতে যেনো বেশ নারাজ হলেন শাহানা। ধমকের সুরে বলে উঠলেন,“বললো তো দরকারি জিনিস আছে, তোর তাতে কী? এতো প্রশ্ন করতে হবে কেনো? তুই ঘরে যা তো বাবা।”

মায়ের ধমকে নড়েচড়ে উঠলো তিথিয়া। মুখ ভোঁতা করে বসে রইলো। তৈমূর চলে গেলো ঘরে।

রাতের রান্নাবান্নার আয়োজন সব শেষ। শাশুড়ির থেকে স্বামীর ফেরার সংবাদ শুনে বোতল ভর্তি ঠান্ডা পানি নিয়ে ঘরে চলে এলো উথমী। গোসল সেরে সবে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে তৈমূর। স্ত্রীকে দেখতেই ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে উঠলো তার। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো সে। বললো,“চোখ দুটো একেবারে গর্তে পড়ে গিয়েছে।বাইরে থেকে ফিরেই রান্নাঘরে দৌড় দিয়েছেন তাই না?”

অপ্রস্তুত হলো উথমী। স্বামীর হাত থেকে ভেজা তোয়ালেটা নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রত্যুত্তর করল,“বাড়িতে এতো মানুষ! বউ হয়ে বিশ্রাম নেই কী করে?”

“সর্বপ্রথম নিজের কথা ভাবা উচিত। অসুস্থ হয়ে পড়লে কী হবে? অফিস, কাজকর্ম বাদ দিয়ে আমার পক্ষে তো আর স্ত্রী সেবা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া বাড়িতে এখন বউদেরও অভাব নেই। তারাই করে নিতো।”

উত্তর দিলো না উথমী। নিরবে তোয়ালে মেলে দিয়ে ঘরে আসতেই নজরে পড়ল ছোটো টি টেবিলের উপর রাখা একটি ব্যাগ। গত সপ্তাহেই একপ্রকার জোর করে স্বামীকে নিয়ে ডাবল বেডের সোফা আর এই টি টেবিলটা পছন্দ করে কিনে এনেছিল সে। তারপর থেকে এখানে রাখা চেয়ার-টেবিলের জায়গায় ঠাঁই পেয়েছে সেই সোফা সেট। আর পুরোনো সেই চেয়ার- টেবিল রেখে আসা হয়েছে স্টোর রুমে।

সোফায় বসে ব্যাগটা খুলতেই ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো উথমীর। একে একে ভেতর থেকে বের করল দুটো মিডিয়াম সাইজের কন্টেইনার। তার মধ্যে একটাতে রাফায়েলো কেক আরেকটাতে রসমালাই। সেগুলোর দিকে দৃষ্টি রেখেই সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“এসব কী ভুল করে উপরে নিয়ে চলে এসেছেন? কিন্তু ভুল কীভাবে হয়? বাকি প্যাকেটগুলো তো ঠিকই নিচে রেখে এসেছেন। মালতী ফুফুকে দেখলাম নিয়ে যেতে।”

ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ারের সাহায্যে চুল শুকাচ্ছে তৈমূর। স্ত্রীর করা প্রশ্নটি শুনতেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,“ভুল করে নয় বরং ইচ্ছে করেই।”

“ইচ্ছে করে?”

“হ্যাঁ, এগুলো আপনার জন্য।”

“আমার জন্য?”——কণ্ঠস্বরে তার বিষ্ময়।

“কেনো? সব তো আপনার পছন্দের।”

“হ্যাঁ, তাই বলে আবার আলাদা? কেউ জানলে কী ভাববে বলুন? সবার জন্য একসঙ্গে আনলেই তো হতো।”

“আলাদা না এনে সবার জন্য একসঙ্গে আনলে ওখানে গিয়ে খেতে পারতেন আপনি? আম্মা এসব খান না। মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে ওই জিলাপি, পিঠা, সেমাই আর পায়েসটাই যা খান। বাকি যারা আছে তারা কেউ না খেয়ে থাকে না। ওহ হ্যাঁ, তাদের জন্যও মিষ্টি আনা হয়েছে। ওইসব আনতে গিয়েই তো এগুলো চোখে পড়ল। অফিস শেষে তো গাড়ি থেকে আর নামাই হয় না। আজ গেলাম তাই ভাবলাম নিয়ে যাই।”

কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই আশ্চর্য হলো উথমী। এই সামান্য যত্নটাই যেনো তার সকল ক্লান্তি দূর করে দিয়ে জায়গা করে নিলো ভালো লাগা, আনন্দের। নিজেকে এই মুহূর্তে এসে তার মনে হতে লাগলো গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। এই ছোট্ট একটা জীবনে তৈমূরের মতো একজন স্বামী থাকলে প্রত্যেক নারীর জীবনই হয়ে ওঠে স্বর্গীয়, আনন্দের আর না থাকলে হয় দীর্ঘশ্বাস, আফসোস।

পকেটে হাত গুঁজে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে থামলো তৈমূর। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার স্ত্রীর পানে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বললো,“আমি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসি। আপনি বরং দরজাটা আটকে দিন। বাড়ি ভর্তি মানুষ, কে কখন ঘরে ঢুকে পড়ে ঠিক নেই। প্রাইভেসির দফারফা হয়ে যাবে।”

বিপরীতে কিছু বললো না উথমী। তৈমূর বেরোতেই দরজা আটকে দিলো সে। সেই যে বাবা এসেছিল তার পছন্দের রসমালাই নিয়ে তখনি কথার ছলে নিজের পছন্দের খাবারের কথা বলে বসেছিল স্বামীকে। অথচ সেই সামান্য একটা কথা কিনা এতোদিন ধরে মনে রেখে দিলো লোকটি? চোখ জোড়া ভিজে উঠলো উথমীর। হঠাৎ করেই বড়ো ভাইয়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জেগে উঠলো। ভাগ্যিস ভাইয়ের কথায় বিয়েটা করেছিল সে! নইলে জানতো কীভাবে? সব ভালোবাসা বিষাদ বয়ে আনে না। কিছু ভালোবাসা বয়ে আনে স্বস্তি, মানসিক শান্তি আর ছোটো ছোটো বিষয়ে প্রায়োরিটি।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)