জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-২৮+২৯

0
17

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৮]

টাইলসযুক্ত শক্ত মেঝের ওপরে শুইয়ে রাখা হয়েছে জয়নবের প্রাণহীন, নিথর দেহ। রূহখানা দেহ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই তরল তাজা মানুষটির পরিচয় বদলে গেলো। এক মুহূর্তেই তিনি সকলের নিকট হয়ে গেলেন মরহুমা, লাশ। নরম তুলতুলে বিছানা থেকে ঠাঁই হলো শক্তপোক্ত মেঝেতে। জয়নবের মুখশ্রী জুড়ে নূরানী ভাব। ঠোঁটের কোণে জ্বলজ্বল করছে জীবন্ত হাসি। সাংসারিক কূটকাচালিতে গা ভাসালেও বেঁচে থাকাকালীন যথেষ্ট পরহেজগার নারী ছিলেন তিনি। দৈনন্দিন রুটিনে নামাজ, রোজা, কোরআন পাঠ কিছুই যেনো বাদ যেতো না।

মেয়েরা মায়ের মরদেহের পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। বশির উদ্দিন কিছুটা দূরে বসে মলিন, বিষণ্ণ মুখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মৃত স্ত্রীর পানে। একসঙ্গে কাটানোর কত বছর পেরোলো দুজনার? সঠিক হিসাব তিনি জানেন না। তবে দেখতে দেখতে যে কয়েক যুগ পেরিয়েছে তা ঠিকই ঠাওর করতে পারেন। বশির উদ্দিনের স্মৃতিপটে এখনো ভেসে ওঠে নববধূ রূপে প্রথম তার বাপের ভিটায় পা রাখা কিশোরী জয়নবকে। পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি, গা ভর্তি গহনা, আলতা রাঙা পা জোড়া মস্তিষ্কে খুব ভালোভাবেই গেঁথে রয়েছে। এইতো সেদিন হাজারটা দুরন্তপনা নিয়ে বাড়ি মাথায় করে রেখেছিল কিশোরী মেয়েটি। সেই দুরন্তপনার জন্য সারাদিন শাশুড়ির অজস্র গালমন্দ শুনে রাতবিরেতে স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে নালিশ করেছে।

বখাটে বশির উদ্দিনের মুখ থেকে জলন্ত সিগারেটটি টেনে এনে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে অভিমানী, চঞ্চল কণ্ঠে বলেছে,“আমনে আর এইসব খাইবেন না কইয়া দিলাম। নরক খাইয়া কী মজা পান?”

যাকে তার বাবা-মা কখনো সিগারেট নিয়ে মুখের উপর কিছু বলতে পারেনি তাকেই কিনা হাঁটুর বয়সী এক বাচ্চা মেয়ে শাসন করতে আসে? ভেবেই মুখ বিকৃত করে ফেলেন তিনি। রাগত স্বরে বলেন,“মুখ খারাপ করবি না কইয়া দিলাম। দুইদিনের ছ্যামড়ি আমারে শাসন করতে আইয়ে? আমার পয়সা দিয়া আমি খাই, তোর বাপের কী?”

“বাপ তুইল্লা কথা কইবেন না কইয়া দিলাম। রাইতে যে দুর্গন্ধযুক্ত মুখ লইয়া আমার ঠোঁডের মধ্যে চুম্মা দেন, কামড় মারেন, তহন? তহন মনে থাহে না?”

মেয়েটির আক্কেল গুড়ুম দেখে দৌড়ে এসে মুখ চেপে ধরে তাকে ঘরে নিয়ে দরজায় খিল আঁটেন বশির উদ্দিন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,“এই ছ্যামড়ি! তোর লজ্জা শরম নাই? বাড়ির মাইনষেরা হুনলে কী ভাববো?”

“কী ভাববো? যেইডা সত্য সেইডাই তো কইলাম।”

“সব সত্য কইতে নাই, এসব শরমের কতা।”

“শরমের কতা?”

“হ।”

“আইচ্ছা কমু না কিন্তু আমনে আর কুনুদিন বিড়ি খাইতে পারবেন না। কিরা কাডেন।”

“একশবার খামু।”

“তাইলে এই মুখ লইয়া আমার কাছে আর আইবেন না। বমি আইয়ে।”

কিশোরী বউয়ের জ্বালায় একসময় বিড়ির নেশা বাধ্য হয়েই ছাড়তে হয় উনাকে। সাথে আরো কত অভ্যাস যে ধীরে ধীরে ত্যাগ করেছিলেন তারও কোনো হিসেব নেই। ভাবতে ভাবতে চোখে অশ্রু জমে বশির উদ্দিনের। নিজের দিকে তাকান। মনোযোগী দৃষ্টিতে দেখেন নিজের চামড়া কুঁচকে যাওয়া কালো হাত দুটো। সময়গুলো কত তাড়াতাড়িই না চলে যায়? সেই তরতাজা জোয়ান মর্দ এখন হয়ে উঠেছে বৃদ্ধ। সামনে পড়ে আছে তারই সঙ্গে জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কাটিয়ে দেওয়া সঙ্গিনীর মৃত দেহ। এরপর কী উনার পালা? নদীর শেষ কিনারায় এসে পৌঁছেছেন কী তবে? হ্যাঁ পৌঁছেছেন। দুনিয়ার জীবনে অন্তিম পর্ব চলছে উনার। স্ত্রী মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা! তারপর উনার এই নিথর দেহের ঠাঁই হবে মাটির নিচে, অন্ধকার কবরে।

চিন্তায় চিন্তায় চোখের পানি আর বাঁধ মানে না বশির উদ্দিনের। কম্পিত কণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে ওঠেন বৃদ্ধ,“আমার মনায় কেমনে ওই আন্ধার কবরে থাকবো? ওর তো আন্ধারে ডর লাগে রে! কেমনে আমার মনায় থাকবো? ও মনা আমারে থুইয়া একলা একলা কেমনে গেলি গা? আমি এই একলা ঘরে কেমনে থাকমু? রাইত বিরাইতে কার লগে পান খাইতে খাইতে গপ্প করমু?”

কথাগুলো বলতে বলতে মেঝেতে শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধ। সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে উনাকে দেখে। এক মৃত স্ত্রীর জন্য শেষ বয়সে এসে এক বৃদ্ধ পুরুষের হাহাকার দেখে। দেখে পুরুষের অপ্রকাশিত শুদ্ধ ভালোবাসা।

বড়ো জাকে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে গোপনে সহ্য করতে না পারা শাহানা, করবীও নিরবে বসে আছেন বিছানার দু ধারে। চোখের কোণে তাদের বাষ্প হয়ে জমে আছে অশ্রুজল। যে মেয়েরা বছরে একবার মাকে দেখতে আসা তো দূরে থাক! মোবাইল ফোনে পর্যন্ত দু মিনিট কথা বলার সময় পেতো না তারাও কি কান্নাটাই না এখন করছে!

তৈমূর নিরবে নিভৃতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সেসব দেখে। আদতে কী অনুভূতি তার প্রকাশ করা উচিত? বুঝতে পারে না। এই মুহূর্ত থেকে মস্তিষ্ক যেনো তার কাজ করছে না। ভুলে বসেছে সকল কিছু। উথমী এসে ঠিক তার পাশটাতেই দাঁড়িয়েছে। জীবনে প্রথম কী কোনো মরদেহ দেখছে? না, ছোটবেলায় আরো একটি লাশ একবার দেখেছিল। তা হলো নিজের নানীর লাশ। তবে স্পষ্ট সেসব মনে পড়ে না উথমীর। নানী যখন মারা গিয়েছিলেন তখন বয়স তার সবে আট। বলতে গেলে বোঝ হওয়ার পর এটাই তার দেখা প্রথম কোনো লাশ।যেই লাশের অধিকারী ভদ্রমহিলার সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই এক বাড়িতে বাস করছে সে। এমনকি গতকাল জেবার ঘরে যাওয়ার আগেও দেখা করে এসেছিল উনার সঙ্গে। অথচ কে জানতো যে ওইটাই তাদের শেষ দেখা, শেষ কথা ছিলো? সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে সেদিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে উথমী। বুক ভার হয় তার, দৃষ্টি হয় ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়েই অবাক হয়ে দেখে মৃত স্ত্রীর জন্য কাঁদতে থাকা কঠোর, শক্তপোক্ত, মুখ ভার করে থাকা লোকটিকে। দেখে মৃত মায়ের জন্য মেয়েদের চোখের পানি। কষ্টে ভেতরটা যেনো ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার। হঠাৎ করেই উথমী অনুভব করে সারা শরীর তার ব্যথায় টনটন করছে। অবশ হয়ে আসছে পা জোড়া। কোনোমতে দরজার সাথে হেলান দিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালায়।

নিচ থেকে ডাক আসতেই সেখানে আর দাঁড়ায় না তৈমূর। ঘোরের মধ্যেই সেখান থেকে প্রস্থান করে অথচ পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীকে একবারের জন্যও খেয়াল করেনি।

সমস্ত অন্ধকার বিলীন হয়ে ধরণীতে ফোটে ওঠে নব্য দিনের আলো। পুবাকাশে সূর্য উদিত হতেই রোজকার মতো অন্তরীক্ষ জুড়ে বিচরণ করতে করতে ডেকে ওঠে এক ঝাঁক পাখি। বাগানের গোলাপ গাছটির বাসি ফুল ঝরে পড়ে তাতে ফোটে ওঠেছে নতুন নতুন বেশ কতক ফুল। বাড়িতে প্রবেশকালে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখে শুধু সেই সদ্য ফোটা ফুলগুলোকে। অথচ কারো একবারের জন্যও দৃষ্টি যায় না অনাদরে পড়ে থাকা বাসি ফুলের দিকে। কষ্ট হয় না তাদের জন্য। জয়নবও সেই ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে গাছ থেকে ঝরে পড়া বাসি গোলাপ ফুল। যার আয়ু ফুরিয়েছে। যে ফিরে গিয়েছে নিজের আসল ঠিকানায়। দুনিয়া তো শুধুই একটি ঠুনকো খেলাঘর। যেথায় মানুষ আসে, জীবন নিয়ে খেলা করে, পাপ পূণ্যের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ফিরে যায় আবারো রবের নিকট।

মসজিদের মাইকের মাধ্যমে জয়নবের মৃত্যুর খবর আর চার দেয়ালের ভেতরে চাপা পড়ে থাকলো না। পাড়া প্রতিবেশীরা জেনে গেলো সেই খবর। বিলম্ব না করে ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়িতে ভিড় জমালো তারা। শুধু শেষবারের মতো এক নজর ভদ্রমহিলাকে দেখার উদ্দেশ্যে। আত্মীয়-স্বজনেরাও শোক সংবাদ জেনে গেলো বাড়ির সদস্যদের ফোনকলের মাধ্যমে।

সময় গড়ালো। সর্বপ্রথম বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো ছোটো কন্যা রেণুকা। এক দৌড়ে ছুটে এসে মায়ের লাশের উপর মাথা ঠুকে বসে পড়ল সে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে দোষারোপ করে বলতে লাগলো,“হায় আল্লাহ! কেনো আমি আমার অসুস্থ মাকে ফেলে কাল বিকেলে চলে গেলাম? কেনো গেলাম? কাল এভাবে চলে গেলে কী আজ মায়ের মরা মুখ এসে দেখতে হতো আমায়? ও আল্লাহ! আমার মায়ের বদলে আমায় কেনো নিয়ে গেলে না তুমি?”

কাঁদতে কাঁদতে বেচারির হেঁচকি ওঠা শুরু হলো। বাকি বোনেরা তাকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তার মধ্য থেকেই এক বয়স্ক মহিলা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙিতে বলে উঠলেন,“আল্লাহর মাল আল্লাহ লইয়া গেছে। কান্দিস না রে রেণু। মরা মাইনষের পাশে বইসা কানতে নাই। আত্মায় কষ্ট পাইবো। মানুষ কী চিরকাল বাইচ্চা থাহে? দোয়া দরুদ পড়, গিয়া কোরআন পড়।”

কোনো কথাই আর রেণুকার শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না। যত বয়স্ক হোক না কেনো, মা তো মা-ই হয়! বাবা- মায়ের মৃত্যুতে কী কোনো আদর্শ সন্তান শান্ত থাকতে পারে? তবে সেই কথাটায় কাজ দিলো। বড়ো বোন বুশরা আলমারিতে রাখা মায়ের কোরআন শরীফ নিয়ে চলে গেলো পাশের ঘরে। তারপর অযু করে শুরু করল কোরআন পাঠ।

বাড়ির পুরুষেরা চলে গেলো জানাজা, কাফন, দাফনের ব্যবস্থা করতে। তৈমূর এহসানকে সঙ্গে নিয়ে গেলো কবর খুদাইয়ের জন্য মানুষ ঠিক করতে। তুরাগ আর বুশরার স্বামী গিয়েছে লাশের জন্য শেষ বাজার করতে। আর বাকিরা গিয়েছে মসজিদ থেকে খাটিয়া আনতে।
___________

আকাশ ভীষণ মেঘলা। ক্ষণে ক্ষণে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ডেকে উঠে জানান দিচ্ছে বৃষ্টির আগমনী সংবাদ। ধূসর মেঘদলের ভিড়ে চাপা পড়ে গিয়েছে শুভ্র মেঘদল। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়েছে। শেষ গোসল শেষে সাদা কাফনে জড়িয়ে খাটিয়ায় করে জানাজা পড়তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জয়নবের প্রাণহীন দেহ। চারিদিকে আগরবাতি আর গোলাপ জলের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে।প্রতিবেশীরা রান্না করে সকলের জন্য দলে দলে দিয়ে গিয়েছে দুপুর আর রাতের খাবার।

জেবা, সূচি দুজনেই রন্ধনশালায় হাতে হাতে কাজ করছে। উথমী নিরবে একপাশে একটি চেয়ারে বসে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝেতে। জয়নবের মৃতদেহ নিয়ে পুরুষেরা বেরিয়ে যেতেই সেই যে এখানে এসে ঘাপটি মেরে সে বসেছে আর তার নড়চড় নেই।

তিথিয়া এসে উঁকি দিলো রন্ধনশালায়। গলা ঝেড়ে বললো,“খাবার বেড়ে ফেলছো?”

ননদের কথায় একবার সেদিকে তাকায় জেবা। আট নম্বর প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে উত্তর দেয়,“হ্যাঁ, আমরা বড়োরা না খেয়ে থাকতে পারলেও বাচ্চারা তো আর পারবে না। তাই ওদের জন্যই বাড়ছি।”

“আর আম্মা? উনার তো দুপুরে খাওয়ার পর ওষুধ আছে। অনিয়মিত হয়ে গেলে পরে আবার সমস্যা দেখা দিবে। ওদিকে বড়ো চাচাকে সেই দুপুরে দেখে এলাম! সকাল থেকে না খাওয়া। চাচীর শোকে শরীর যেনো ছেড়ে দিয়েছে উনার।”

“আম্মা, বড়ো চাচা, ছোটো চাচা-চাচী উনাদের সবার জন্যই খাবার বেড়ে রেখেছি। আপনি বরং ওরি মিলি আর আম্মারটা নিয়ে যান। বড়ো চাচা ওদের সঙ্গে জানাজা পড়ে ফিরলে ঝুমুর আপার কাছে উনার খাবারটা দিয়ে দিবো। উনিই না হয় খাইয়ে দিবেন।”

সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ায় তিথিয়া। আড়চোখে ছোটো ভাইয়ের বউকে একবার দেখে তাদের খাবার ট্রেয়ে করে নিয়ে প্রস্থান করে। সে যেতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় উথমী। মিনমিনে স্বরে জেবার উদ্দেশ্যে বলে, “আমার শরীরটা ভালো লাগছে না ভাবী। আমি ঘরে যাই? এখানে বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব নয়।”

কথাটা শুনতেই বাঁকা দৃষ্টিতে জায়ের পানে তাকায় জেবা। হাতের প্লেট রেখে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে শুধায়,“সেই কখন থেকেই দেখছি কেমন যেনো লাগছে তোমায়। বড়ো চাচীর শোকে হয়তো চুপচাপ আছো ভেবে কিছু আর জিজ্ঞেস করিনি।”—-কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে এসে তার কপালে, গলায় হাত রাখতেই চমকালো সে। পুনরায় বলে উঠলো,“শরীর তো গরম তোমার! জ্বর এসেছে?”

সঠিক উত্তর দেয় না উথমী। ধীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করে, “হবে হয়তো।”

“হবে হয়তো না উথমী। তোমার জ্বর এসেছে। এই জ্বর নিয়েও এভাবে চুপচাপ কেউ বসে থাকে? এখনি ঘরে যাও তুমি। আমি তোমার আর তৈমূরের খাবারটা ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। খাবার খেয়ে জ্বরের ওষুধ সেবন করে বিশ্রাম নিবে, তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

“কাউকে বলবেন না ভাবী। আর এখন আমি খাবো না। গলা দিয়ে খাবার নামবে না। ঘরে যাচ্ছি।”

আর সেখানে দাঁড়ালো না উথমী। ধীর পায়ে রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে গেলো। চিন্তায় ললাটে সরু কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে জেবার। পূর্বের মতো আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দিলো সে। তার মনটাও ভীষণ খারাপ। চারিদিকে এখনো লেগে আছে শোক। সেই শোকের ছায়ায় জেবার শরীরটাও যেনো ভেঙে আসছে। এই মুহূর্তে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুলে হয়তো দুঃখটা একটু কমতো। কিন্তু এখন তা যেনো অসম্ভব। বাড়ির বউদের ক্লান্ত হলে চলে না। তাদের অনেক দায়িত্ব! যেই দায়িত্ব পালনের কাছে সব রোগ শোক নিছকই মামুলি।

অন্দরমহলে আত্মীয়া মহিলারা বসে আছেন। শাহানা, করবীও সেখানেই বসা। আজ দুই জায়ের মধ্যে কোনো মনমালিন্য দেখা যাচ্ছে না তেমন। মনমরা হয়ে মাঝে সাঝে আশেপাশে বসা তাদের বয়সী মানুষদের সঙ্গেই কথা বলছেন উনারা। উথমী তখন অন্দরমহল পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। তাই কোনোদিকে আজ আর তার খেয়াল নেই। উপস্থিত সকলেরই তাকে নজরে পড়ল। একজন বয়স্কা উঁচু কণ্ঠস্বরে শুধালেন,“ওই মেয়েটা কে? দেখে তো বিবাহিতা মনে হচ্ছে। কার বউ?”

করবী উত্তর দিলেন,“কার আবার? আমাদের তৈমূরের বউ। আপনাকে না ফোনে বললাম? ভুলে গিয়েছেন আপা?”

ভদ্রমহিলা হচ্ছেন বশির উদ্দিনের আপন চাচাতো ভাইয়ের বউ। কথাটা মনে করার জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন তিনি। মনে পড়তেই চিকচিক করে উঠলো মুখশ্রী। বললেন,“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। কিন্তু সামনাসামনি দেখিনি তো তাই আরকি চিনতে পারিনি। তা মেজো ভাবী, ছেলের বউ কী আপনার পোয়াতি নাকি? হাঁটা চলা তেমন সুবিধার লাগছে না। দেখে তো পোয়াতিই মনে হচ্ছে।”

শাহানা পুত্রবধূর পানে তাকালেন। ততক্ষণে উথমী বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ির ঘর পেরিয়ে উপরে উঠেছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তরে বললেন,“না না, পোয়াতি হতে যাবে কেনো? সেই কপাল কী আর আমার আছে? সুখবর এলে জানতে পারবে তোমরা। বাড়িতে একজন মারা গেছে। তারপরেও কেউ কী আর স্বাভাবিক থাকতে পারে? তাই হয়তো।”

কথাটা আর এগোলো না। ওখানেই চাপা পড়ে গেলো। অন্য কোনো সময় হলে হয়তো শাহানা কথাটাকে এগিয়ে নিয়ে পুত্রবধূর নামে নিন্দে করতেন কিন্তু এই মুহূর্তে তেমন কিছু করার মানসিকতাই উনার হলো না।

জয়নবের দাফন কার্য সম্পন্ন হয়েছে। স্ত্রীর কবরের পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বশির উদ্দিন। তৈমূর, তুরাগ আর উনার মেয়ের জামাইরা মিলে অতি কষ্টে যেনো বাড়ি পর্যন্ত উনাকে নিয়ে পৌঁছেছে।

চাচাকে একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল তৈমূর। বিছানায় এলোমেলোভাবে উবু হয়ে শুয়ে থাকা স্ত্রীকে দেখে ভ্রু দ্বয় তার কুঞ্চিত হলো। তবে বিছানার দিকে এগোলো না সে। পরিধেয় পাঞ্জাবির হাতায় এখনো লেগে আছে মাটি। শরীরে গোলাপ জলের তীব্র গন্ধ। তাই নিঃশব্দে দরজা আটকে আলমারি থেকে নিজের পোশাক বের করে বাথরুমে প্রবেশ করল তৈমূর।

উথমীর আশেপাশে কোনো খেয়াল নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ব্যথা, মাথা ব্যথা, জ্বরের তীব্রতা তার বেড়ে চলেছে। মিনিট দশেক বাদে তৈমূর ভেজা চুলে বেরিয়ে এলো। সোজা বিছানায় এসে বসলো। স্ত্রীর চুলের ভাঁজে হাত রেখে ডাকলো,“উথমী! ঘুমিয়ে পড়লেন?”

“নাহ।”

“কী হয়েছে? এই অসময়ে এভাবে শুয়ে আছেন যে?”

“কিছু না।”—-বলে কোনোমতে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।

তৈমূর গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো স্ত্রীর ওই শুকিয়ে যাওয়া মুখপানে। চোখেমুখে তার বেদনার ছাপ, মোলায়েম ঠোঁট দুটো লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করেছে, ফর্সা গলায় কামড়ের দাগ সুস্পষ্ট। গতকাল রাতে একে অপরের এতোটা কাছাকাছি আসার পর আর তেমন কথা হয়নি দুজনার। সেসব মনে করে পুলকিত হয়ে লজ্জা পাওয়ার অবস্থাতেও এখন তারা নেই। ভোরের অমন ঘটনায় সবাই যেনো স্তব্ধ হয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে স্ত্রীর কপালে হাত রাখলো তৈমূর। মিলিত হলো দুজনার দৃষ্টি। আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,“শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আপনার! অথচ জিজ্ঞেস করার পর বলেন, কিছু হয়নি?”

স্বামীর স্পর্শে, কোমল কণ্ঠস্বরে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলো উথমী। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুরুষালি বুকে। আলিঙ্গনে জড়িয়ে ক্রমশ শক্ত করল বাঁধন। তৈমূরও বাম হাতে তাকে আগলে নিয়ে ডান হাত দিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করল,“খুব খারাপ লাগছে?”

উত্তর দিলো না উথমী। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। আজ অনেক বছর বাদে চোখের পানির মাধ্যমে কারো সম্মুখে সে প্রকাশ করছে নিজের দুর্বলতা। কঠোর হৃদয়ের অধিকারী মেয়েটিকে এভাবে কাঁদতে দেখে মন খারাপেরা জেঁকে ধরলো তৈমূরকে। স্পর্শ কোমল আর আদুরে হলো। জিজ্ঞেস করল,“বড়ো চাচীর জন্য কষ্ট হচ্ছে?”

“জানি না।”

“তবে?”

“খুব কান্না পাচ্ছে আমার, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। মাথা ব্যথা করছে, শরীর জ্বলছে।”

“এভাবে কাঁদে না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি খাবার নিয়ে আসি, খাবার আর ওষুধ খেয়ে একটা ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘুম থেকে উঠে দেখবেন সব ফুরফুরে।”

উথমীর বাঁধন দৃঢ় হলো। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বললো, “উহু, আপনি কোথাও যাবেন না। প্লিজ এভাবেই আমায় ধরে থাকুন। আপনি ছাড়া আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”

কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না তৈমূর। বাধ্য ছেলের মতো ওভাবেই বসে থাকে সে। কিছুক্ষণের জন্য মেনে নেয় তার এই অমিষ্ট ভাষী স্ত্রীর আবদার।

চলবে _________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৯]

কেউ কারো মৃত্যুতে থেমে থাকে না, থেমে থাকে না সময়। যে যার মতো চলতে থাকে ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে। চলতে চলতে হয়তো একসময় ভুলে যায় সেই মৃত ব্যক্তিকে। শুধু কিছু কিছু মানুষের মস্তিষ্কেই থেকে যায় তাদের স্মৃতি। জয়নবের মৃত্যুর আজ তৃতীয় দিন। অথচ বাড়ির পরিস্থিতি দেখে তা যেনো ঠাওর করাই দুষ্কর। মানুষজন কত শান্ত, স্বাভাবিক! শুধু স্বাভাবিক নেই স্বামী বশির উদ্দিন। অবসরে সময় কাটানো, দুঃখ হলে জড়িয়ে ধরা, পাশ বালিশে মাথা গুঁজে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেওয়া মানুষটির চির বিদায়ে কী আদৌ কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারে? যারা সঙ্গীনিকে ভালোবাসে তারা কখনোই পারে না।

সকালের নাস্তা শেষে অন্দরমহলে এসে উপস্থিত হয়েছে বাড়ির সদস্যরা। গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনার উদ্দেশ্যে তাদের উপস্থিত হতে বলেছে বশির উদ্দিনের তিন কন্যা। বশির উদ্দিন বসে আছেন তাদের মধ্য মণি হয়ে। এই দুদিনের ব্যবধানেই বয়সের ভারে শরীরটা উনার ভেঙে পড়েছে। চোখের নিচে জমেছে কালি।

উপস্থিত নিরবতা ভেঙে মঈনুদ্দিনই প্রথম কথা বললেন,“যা বলার জন্য ডেকেছিস তাড়াতাড়ি বল। এভাবে এতোক্ষণ ধরে বসিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।”

উনার কথায় বুশরা আর রেণুকা একে অপরকে চোখে চোখে কিছু একটা ইশারা করে নিজেদের স্বামীর পানে তাকালো। তারপর সর্বপ্রথম বুশরাই বললো,“আম্মা হঠাৎ করেই মারা গেলেন। আব্বার বয়সও অনেক বেড়েছে। একা একটা মানুষ কীভাবেই বা আর থাকবেন? তাই আমরা বোনেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যতদিন আব্বা বেঁচে থাকবেন ততদিন না হয় আমাদের তিন বোনের কাছেই এক মাস এক মাস করে উনি থাকবেন।”—-এতোটুকু বলেই সে থামলো।

এবার রেণুকা বোনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললো,“হ্যাঁ, বুবুর সঙ্গে আমরা একমত। যত যাই হোক, মেয়ে হই আমরা। আব্বার দায় দায়িত্ব তো আর ছেড়ে দিতে পারি না।”

মেজো কন্যা ঝুমুর আর তিনজনের স্বামী উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে কথাটাকে সমর্থন জানালো। সিঁড়ির রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে এতোক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে ছিলো তৈমূর। শুনছিল তাদের সকল কথা। এবার নিরবতা ভাঙলো সে। বললো,“বড়ো চাচী হঠাৎ মারা গিয়েছেন? প্রায় এক মাসের মতো যে তিনি অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়েছিলেন সে বিষয়টি কী এড়িয়ে যাচ্ছো? নাকি বলতে ভুলে গিয়েছো? ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে যাবতীয় ওষুধসহ সব তো আমরা দুই ভাই মিলেই দায়িত্ব সহকারে দেখেছি! বরং তোমাদের কাছে যখন উনার অসুস্থতার খবর দেওয়া হয়েছে তখন সংসারের বিভিন্ন ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে পুরো ব্যাপারটাই তোমরা এড়িয়ে গিয়েছো। তারপর এলে তো এলে তাও মৃত্যুর আগের দিন। তাছাড়া এতোদিন ধরে এ বাড়িতে থাকতে পারলে এখন কেনো বড়ো চাচা গিয়ে তোমাদের কাছে এক মাস এক মাস করে থাকবে? এ বাড়িতে সমস্যা কী?”

রেণুকা প্রত্যুত্তরে বললো,“এতোদিন আম্মা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এখন তো আর আম্মা নেই। আব্বার খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে দেখভাল কে করবে? খরচাই বা কে চালাবে?”

“এতোদিন খরচা কী তোমরা চালিয়েছো নাকি চাচী চালিয়েছে?”

প্রশ্নটির সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারলো না কেউ। তৈমূর পুনরায় বললো,“বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন সবাই একসঙ্গেই খেয়েছে। বাবাই সব খরচা বহন করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকে সব খরচ চলে আমার আর ভাইয়ার টাকায়। উনাদের যাবতীয় খরচ, দায় দায়িত্ব তো সব আমরাই পালন করে আসছি। এমনকি বড়ো চাচী নিজে রান্না করতেন কখনো? সংসার আলাদা হলেও রান্না করতেন মালতী ফুফু। আর আমার বিয়ের পর থেকে রান্না করে আমার বউ। এমনকি তিনবেলার খাবার সেই তিনতলায় চাচা-চাচীর ঘরে গিয়ে দিয়ে আসতো। ভাবী বাড়িতে থাকলে তিনিই রান্না করেন। এখন শেষ সময়ে এসে তোমরা সেসব অস্বীকার করলে তো আর হবে না। তবুও চাচা যদি তোমাদের সাথে যেতে চায়, প্রতি মাসে মাসে একেক মেয়ের বাড়িতে গিয়ে ভরণপোষণের জন্য পড়ে থাকতে চায় তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই।”

তুরাগও ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বললো,“তৈমূরের সাথে আমিও একমত। এতোদিন সব খরচ চালাতে পারলে বাকি দিনগুলো আমরাই চালাতে পারবো। আমাদের টাকা-পয়সার এতোটাই আকাল পড়েনি যে নিজের চাচার খরচ চালাতে পারবো না। বাকিটা চাচার ইচ্ছে।”

এরপরে আর বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না তিন বোন। মঈনুদ্দিন রয়ে সয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“মান সম্মান বলে একটা ব্যাপার আছে। আমাদের বংশে কেউ কখনো মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকেনি আর আশা করি ভবিষ্যতেও এমনটা কেউ করবে না।”

সবার বিভিন্ন মতামতের পর এবার আর চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না বশির উদ্দিন। মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন,“আমারে লইয়া তগো ভাবতে হইবো না। বাঁচমুই বা আর কয়দিন? বয়স তো কম হইলো না।যতদিন বাঁচি ততদিন এইহানেই থাকমু। এই বাড়িততে কোত্থাও আমি যামু না।”

বাবার কথায় বিরক্ত হলো রেণুকা। যা তার কণ্ঠস্বরেও স্পষ্ট ফোটে উঠলো,“কী যে বলেন না আব্বা! যাই হোক, আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার বয়স হয়েছে। কখন কী হয়ে যায় আল্লাহ ভালো জানেন। তাই আমরা চাইছি এই বাড়ির যতটুকু অংশ আপনার নামে আছে তা আমাদের তিন বোনের মধ্যে ভাগ করে দিন। আপনার জামাইয়ের পরিচিত উকিল আছে, তার সঙ্গে আমরা কথাও বলেছি। যা করার এখনি করতে হবে। নইলে আপনার অবর্তমানে আবার সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।”

এবার সকলের সামনে সবটা সুস্পষ্ট। সম্পত্তি পাওয়ার আশায় তবে বাবার প্রতি হঠাৎ করেই এদের এতো দরদ উথলে পড়ছিল? বশির উদ্দিনও তাদের কথায় হতবাক হয়ে গেলেন। শাহানা মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে বলে উঠলেন,“সম্পত্তি ভাগ হবে মানে? ফুলকুঞ্জে কোনো বহিরাগত ঢুকতে পারবে না। তোদের যখন ইচ্ছে তোরা এ বাড়িতে আসবি, বেড়াবি। কিন্তু এ বাড়ির ভাগ তোদের দেওয়া অসম্ভব।”

ঝুমুর কথার মাঝখানেই বলে উঠলো,“কে বহিরাগত? আমরা এ বাড়ির মেয়ে। আমাদের কী বাপের সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই? আমাদের অধিকার আমরা ছাড়বো না। আপনাদেরটা তো ঠিকই সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন মেজো চাচী। তাহলে আমাদের বেলায় আপনি কেনো কথা বলছেন? আমরা আমাদের ভাগ নিবোই নিবো।”

মুখের উপর এমন জবাব শুনে হতবাক হয়ে গেলেন শাহানা। তেতে উঠলো তিথিয়া। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,“মা মরেছে আজ সবে তিনদিন! এর মধ্যেই এই বাড়ির দিকে নজর লেগে গেলো? তোমরা তো দেখছি খুব লোভী! এই জন্যই চাচার প্রতি এতো দরদ উথলে পড়ছিল তাই না?”

ঝুমুর মুখ বাঁকিয়ে বললো,“তুই চুপ থাক। তুই বুঝি কম লোভী? তোর খবর আমরা জানি না ভেবেছিস? নিজে তো ঠিকই সব কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিয়েছিস। তার উপর বছরের বারো মাসের মধ্যে সাত আট মাসই পড়ে থাকিস বাপের বাড়ি।”

“তাতে তোমার কী? নিলে আমি আমার বাবারটা নিয়েছি কিন্তু তোমাদের বাবার কী কিছু আছে? এই বাড়ি আমাদের বাবার টাকায় করা। বড়ো চাচা তো অনেক আগেই নিজের ভাগের সবকিছু বিক্রি করে খেয়ে ফেলেছেন। শুধু দাদীর কথায় বাধ্য হয়ে আমাদের বাবা ওই তিনতলা বড়ো চাচাকে দিয়েছিলেন থাকার জন্য। তাতেই তা তোমাদের হয়ে গেলো?”

শামীম স্ত্রীর মতামতকে পূর্ণ সমর্থন করে বললো, “একদম। তাছাড়া আপনারা ওই তিনতলার ভাগ নিয়েই বা কী করবেন? তিনতলায় যেতে হলে তো সেই আমার শ্বশুরের গেইট দিয়ে ঢুকে একতলা, দুতলা পেরিয়ে তারপর তিনতলায় যেতে হবে।”

স্বামীর বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হলো তিথিয়া। মুখে ফোটে উঠলো বিজয়ের হাসি। রাজীব তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,“আমাদেরটা আমরা বিক্রি করে দিবো নাকি রেখে দিবো সেটা আমাদের ব্যাপার। আপনি মাঝখানে কথা বলার কে?”

চুপসে গেলো শামীম। অপমানে থমথমে হয়ে গেলো তার মুখশ্রী। তবে থামলো না তিথিয়া। চোখের সামনে স্বামীর অপমান কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এক কথা থেকে শুরু হলো আরেক কথা। ধীরে ধীরে কথায় কথা বাড়লো। উপস্থিত বাকিরা যেনো অতিষ্ঠ হয়ে গেলো এই ঝামেলায়। নিরব বশির উদ্দিন এবার ধমকে উঠলেন,“থাম তোরা। সামান্য সম্পত্তির লাইগা নিজেগো মধ্যে ঝামেলা করতে লজ্জা করে না?”

উনার এক ধমকেই থেমে গেলো হট্টগোল। সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল উনার উপর। উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তিথি ভুল কিছু কয় নাই। এই ফুলকুঞ্জ তৌহিদের নিজের। ওয় পরিশ্রম কইরা টাকা কামাইয়া এই বাড়ি বানাইছে। কিন্তু আমি আমার এতো লম্বা জীবনে কিচ্ছু করতে পারি নাই বরং বাপ-মা, ভাইগো উপরে সারাজীবনই বোঝা হইয়া কাটাইছি। বাপের কাছ থাইক্কা যা পাওনা আছিলাম তার অর্ধেক বেইচ্চা শেষ করছি। এমনকি বাপের ভিটা বাড়িতে ভাইগো পাওনা ভাগও একসময় বেইচ্চা দিছিলাম।যার লাইগা আব্বায় আমার উপর অনেক বেজার আছিলেন। কিন্তু আম্মায় তা পারে নাই। এই বাড়ির কাম শেষে যহন সবাই এই বাড়িত উঠলাম তহন আম্মায় তৌহিদরে অনেক বুঝাইয়া তিনতলা আমার নামে লেখাইয়া নিলেন। আমগো মধ্যে হেয়ই আম্মারে একটু বেশি ভালোবাসতো। আম্মার কোনো কথা ফেলাইতে পারতো না বইল্লা আর না করতে পারে নাই। বাকি যেইটুকু জায়গা জমি আছিলো হেইগুলা তগো তিন বোইনের বিয়াতে বেইচ্চা দিছিলাম। এহন আইয়া ভাগ চাইলেই তো আর হইবো না। বিয়ার পর মাইয়ারা পর হইয়া যায়। তগো নামে ওই তিনতলা লেইখা দিয়া এই বাড়িতে আর ঝামেলা বাড়াইতে আমি চাই না।”

বাবার কথা মোটেও পছন্দ হলো না মেয়েদের। রাগে ফুঁসে উঠলো তারা। বোনেদের মধ্যে রেণুকাই একটু ঝগড়ুটে। সেই বললো,“এটা কেমন কথা আব্বা? কে কী করল, না করল সেসব আমরা শুনতে চাই না। তিনতলা আপনার নামে আছে মানে ওই তিনতলা আপনার। তাই যত তাড়াতাড়ি পারেন আমাদের ভাগ আমাদের বুঝিয়ে দিন।”

“আমার কাছে আর তগো কোনো ভাগ নাই। যা আছিল সব আগেই নিয়া গেছোস। তগো মায়ের গহনাগাটিও ছাড়োস নাই। যেই মানুষটা মইরা গেছে সেই মানুষটার দুই হাতের দুইটা সোনার চুড়ি, কানের দুল আর নাক ফুল লইয়াও কাইল তোরা যা পাড়াপাড়ি করলি এরপর আর কোনো কথাই থাহে না। যা কথা আছিল সব এনেই শেষ। ওই তিনতলা আমি মেজো বউয়ের নামে কাগজে কলমে লেইখা দিমু। এরপর হেয় যারে দেওয়ার দিবো। তোরা না বলে আইজ চইল্লা যাবি হুনলাম? যা গা। আমি মরার আগ পর্যন্ত এ বাড়িত আর আইবি না তোরা। আমি মরলে আইয়া আমারে দেইখা গেলে যাবি আর না আইলে নাই। কিন্তু তারপরেও এনে আর আইবি না। আমি মরার পর এই বাড়ির লগে তগো সব সম্পর্ক শেষ।”—-কথাগুলো বলা শেষ করে আর বসলেন না বশির উদ্দিন। উঠে দাঁড়ালেন। একবার তুরাগ তো আরেকবার তৈমূরের দিকে তাকিয়ে বললেন,“কাইল ভালো দেইখা বাড়িত উকিল লইয়া আইবি। এইডা আমার আদেশ। এই সম্পদের ভার আমি আর লইতে পারতাছি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ভার থাইক্কা আমি মুক্তি চাই।”

তারপর আর কোনোদিকে না তাকিয়ে তিনি আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে চলে গেলেন নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে। মঈনুদ্দিনও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,“বড়ো ভাইজানের সঙ্গে আমি একমত। ভিটে বাড়ির ভেতরে বাড়ির ছেলে ব্যতীত অন্যদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করা উচিত নয়। এতে পরবর্তীতে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। আমার পরিচিত একজন উকিল রয়েছে। আমি না হয় তাকে কাল আসতে বলবো। যা কথার সে এলেই না হয় হবে। ইদের আগে ঝামেলা মিটে গেলেই ভালো হয়।”

অন্দরমহলে শুরু হওয়া প্রসঙ্গ অন্দরমহলেই সমাপ্ত হলো। যে যার মতো চলে গেলো নিজেদের ঘরে। বুশরা, ঝুমুর, রেণুকাও স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘরে গেলো। আজই তারা চলে যাবে নিজেদের বাড়িতে।

সবাই চলে গেলেও সেখানে শুধু রয়ে গেলো তুরাগ তৈমূর আর তাদের স্ত্রীরা। যদিও বা এই পারিবারিক বৈঠকে থাকার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না উথমীর। কিন্তু জেবা জোর করে তাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। জেবার মতে, বিয়ের পর থেকে স্বামীর বাড়ি হচ্ছে মেয়েদের নিজস্ব বাড়ি। তাই এ বাড়ির একজন সদস্য হিসেবে সব কিছুতেই তাদের থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

জেবা আশেপাশে একবার ভালো করে দেখে নিলো। এগিয়ে এসে একটা সোফায় বসলো। তারপর কণ্ঠ নিচু করে বললো,“আপা দুলাভাইয়ের মতিগতিও কিন্তু সুবিধার ঠেকছে না। শুরু থেকেই এই বাড়ির প্রতি তাদেরও লোভ কম নয়। দেখলে না যেই বড়ো চাচা আম্মার নামে তিনতলা লিখে দিবেন শুনলো সেই উনার মুখে কত হাসি?”

তৈমূরের ললাটে ভাঁজ পড়ল। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো,“তো?”

“তো আবার কী? এই বাড়ির ভেতরে চাচার মেয়ে হোক কিংবা আপা! কাউকেই ঢুকানো যাবে না। তাদের কাছে যাওয়া মানে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেওয়া। পরে তোমরাও কিন্তু আর শান্তিতে থাকতে পারবে না তৈমূর। আজ না হয় কাল তোমারও ছেলে-মেয়ে হবে। তাদেরও তো ভবিষ্যৎ আছে নাকি? এদিকে আমাদের জোহান আছে। আপাকে তো আর তোমাদের বাবা কম কিছু দেয়নি। দুলাভাইয়ের ব্যবসার টাকা, বিয়ের সময় গহনাগাটি, ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে আরো কত কী! হিসাব করে দেখতে গেলে পাওনার চেয়েও বেশি নিয়েছে। তাই আর কোনো ছাড় নেই। এখানে আসুক, থাকুক তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই কিন্তু এ বাড়ির ভাগ একদম দিবে না। আম্মার সঙ্গে এ নিয়ে তোমরা কথা বলবে। কোনো ভালো মানুষি দেখানোর প্রয়োজন নেই বলে দিলাম। নইলে পরে এই বাড়ি আর বাড়ি থাকবে না। এমনিতেই এই ধরণের বাড়িতে ডেভেলপারদের নজর থাকে বেশি। তাছাড়া তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে ভালো মিলমিশ আছে, আমাদের দুই জায়ের মধ্যেও ভালো সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক নষ্ট করার সাধ্যি কারো নেই।”

জেবার কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তুরাগ সায় জানিয়ে ছোটো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,“তোর ভাবী কিন্তু ভুল কিছু বলেনি তৈমূর। আম্মা বুবুর প্রতি একটু দুর্বল। তার উপর আমাদের বউদের তো তিনি সহ্যই করতে পারেন না। তাই কথা বললে আজই বলতে হবে‌। চাচা-চাচীর সব খরচ আমরা চালিয়েছি, আম্মার দেখভাল আমরা করি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আত্মীয়তা রক্ষার্থে উপহার সামগ্রী আমরা দেই তাহলে অন্য কেউ কেনো ভাগ নিয়ে চলে যাবে? সংসার থেকে আলাদা হয়েছি সংসারের অশান্তি কমাতে তাই বলে যে সারাজীবন আলাদাই থাকবো এমন তো নয়।”

তৈমূর আর দ্বিমত করল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “হুম, সেদিন সকলের সামনে দুলাভাইয়ের থেকে অমন অপমানজনক কথা শুনেই বুঝেছি। এরপরেও এসব ব্যাপারে আর কোনো কথাই থাকে না। কাল উকিল আসুক, আগে দেখি আম্মা কী বলেন, উনার বিবেক কী বলে তারপর না হয় আমরা বলবো। আজ আপাতত থাকুক। উকিল এলেই তো আর সরাসরি লিখে দেওয়া যাবে না। এর মধ্যে অনেক ঝামেলা আছে।”

স্বামী এবং দেবরের সুবুদ্ধিতে সন্তুষ্ট হয় জেবা। আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নিজেদের ঘরে চলে যায় তারা। উথমী নিরব দর্শকের মতো চুপচাপ সেসব দেখে আর শুনে গেলো। এসব সম্পত্তির প্রতি তার কোনো আগ্ৰহ নেই।
___________

বিকেল পাঁচটা পনেরো মিনিট। অচেনা এক নাম্বার থেকে ফোনকল আসার পর থেকেই রায়হান কবীরের মুখশ্রী থমথমে, বিমূঢ়। কেয়া বেগম থেকে শুরু করে রিনিতা এর মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর দেননি তিনি। কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। বুয়া গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে প্রবেশ করল উৎস। ক্লান্ত দেহ নিয়ে সোফায় বসে পিতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কী হলো আবার? হঠাৎ এই অসময়ে বাড়ি ফিরতে বললে যে?”

কেয়া বেগম ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন ঠান্ডা পানির গ্লাস। উৎস দুই ঢোকে সেই পানি শেষ করে সকল ক্লান্তি দূর করে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় পিতার মুখপানে। রায়হান কবীর মিনমিনে স্বরে বলেন,“ঘণ্টা দেড়েক আগে অচেনা এক নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রিসিভ করে জানতে পারি পুলিশের নাম্বার।”

“পুলিশের নাম্বার? কোন থানা?”

“শহরের বাইরে পড়েছে থানাটা।”

“কী বললো? কেনো ফোন করেছে?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন না রায়হান কবীর। কিছুক্ষণ নিরব থাকেন। তারপর বলেন,“গত পাঁচদিন আগে একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছে তারা। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করানোর পর আজ সেই মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর জানা গিয়েছে মেয়েটির নাম ঊষা আর বাবার পরিচয় হিসেবে তাদের কাছে আমার নাম্বারটা দিয়েছে। পুলিশ বলেছে আজ গিয়ে সনাক্ত করে আসতে। মেয়েটির কন্ডিশন নাকি খুব খারাপ।”—-এতোটুকু বলতে গিয়েই কণ্ঠস্বর ভার হয়ে আসে রায়হান কবীরের।

উনার কথা শেষ হতেই ঢপাস করে বসে পড়লেন কেয়া বেগম। চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো। ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,“কী হয়েছে আমার মেয়ের? হাসপাতালে ভর্তি করেছে, জ্ঞান ফিরেছে মানে? আমায়ও নিয়ে চলো তোমরা।”

উৎস বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,“তুমি তৈরি হয়ে নাও বাবা। আমি শার্টটা বদলে আসি। এখনি আমরা বের হবো। মা বাড়িতেই থাকুক। রিনির শরীর ভালো না। কখন কী হয়ে যায় তার ঠিক নেই। তার উপর তনিও আছে! আমরা আজ দেখে আসি কী হয়েছে। মা না হয় কাল যাবে।”

ছেলের কথাই মেনে নিলেন রায়হান কবীর। স্ত্রীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজেও গিয়ে তৈরি হয়ে নেন।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)