জারুল ফুলের কাব্য পর্ব-৩৪+৩৫

0
16

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৪]

গাছের ডালে ঘুঘু ডাকছে। চাপা ফুলের ভারে জমিন ধারণ করেছে হলুদ বর্ণ। বাচ্চাদের হৈচৈ শব্দে চারিদিকে উৎসব উৎসব ভাব। গতকাল রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই নাস্তা সেরে ভাইদের সঙ্গে কোরবানির পশু দেখতে গিয়েছিল তৈমূর। তুরাগ আর এহসান মিলে বেশ কিছুক্ষণ আগেই সেই পশু নিয়ে বাড়িতে ফিরলেও ধারালো ছুরি, চাপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তৈমূরের হয়ে গেলো দুপুর। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই সর্বপ্রথম ফজলুলের হাতে সেসব ধরিয়ে দিয়ে সোজা অন্দরমহল পেরিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল সে। বিছানার পানে দৃষ্টি যেতেই ভীষণ অবাক হলো।

বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে ঘুমন্ত তনি। তাকে দেখে তৈমূরের মুখশ্রী বিষ্ময়ে ছেপে গেলো। ভুল দেখছে না তো সে? তনি এখন এখানে? এলো কোত্থেকে? প্রশ্নটি মাথায় নিয়ে ছোটো ছোটো কদম ফেলে বিছানায় এসে বসলো সে। তখনি বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো উথমী। দরজার শব্দে সেদিকে ফিরে তাকালো তৈমূর। সামনের রমণীকে দেখে পল্লব জোড়া কেঁপে উঠলো তার। উথমীর পরনের মেরুন রঙের শাড়িটা বেশ এলোমেলো। ব্লাউজের একাংশ ভেজা। চুল থেকে টুপটাপ গড়িয়ে পড়া পানির ফোঁটাগুলো রোধ করতে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আমতা আমতা করে বলে উঠলো, “এভাবে দেখা বন্ধ করুন। আমার লজ্জা লাগছে।”

তবুও তার থেকে দৃষ্টি সরালো না তৈমূর। শুধালো, “আপনি! কখন এলেন?”

“এই তো আধ ঘণ্টা আগে।”

“একা একা এতোটা পথ এসেছেন তাও সঙ্গে একটা বাচ্চা নিয়ে?”

“হ্যাঁ।”

“জানালেন না কেনো?”

“সারপ্রাইজ!”

“হ্যাঁ?”

তৈমূরের মুখখানা দেখে হাসলো উথমী। শাড়ির কুচি ঠিক করে এগিয়ে এসে গা ঘেঁষে পাশে বসলো। মুখের দিকে তাকিয়ে শুধালো,“কেনো? আপনি সারপ্রাইজড হননি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছি! অনেক হয়েছি! তা তনিকে সাথে নিয়ে এলেন যে? আসতে দিলো সবাই?”

“শুরুতে অবশ্য একটু গড়িমসি করেছে কিন্তু অনেক বোঝানোর পর শেষমেশ রাজি হয়েছে। গতকালই তো ঊষাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে। ওকে এ অবস্থায় দেখে বাচ্চা মানুষের খারাপ লাগতে পারে। মানসিক বিকাশেও হয়তো সমস্যা হতে পারে। তাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।”

থামলো উথমী। এবার ভ্রু কুঁচকে শুধালো,“তা আপনি এতো বেলা কোথায় ছিলেন?”

অধরে হাসি ফোটে উঠলো তৈমূরের। উথমীর বাহু ধরে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। চোখ বন্ধ করে থুতনি ঠেকালো উন্মুক্ত ঘাড়ে। প্রশ্নটির উত্তর না দিয়ে শুধালো,“চুলে কী শ্যাম্পু ব্যবহার করেন আপনি? এতো মিষ্টি সুঘ্রাণ কেনো বলুন তো? কই আমি ব্যবহার করলে তো এমন সুঘ্রাণ ছড়ায় না।”

“এভাবে যে আমায় ধরে আছেন তা আপনি গোসল করেছেন? মনে তো হচ্ছে না।”

“একদম ঠিক ধরেছেন। শেষ গোসল করেছিলাম গতকাল রাতে।”

কথাটা শুনতেই নড়েচড়ে উঠলো উথমী। বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস চালিয়ে নাক ছিটকিয়ে বলে উঠলো,“ছাড়ুন আমায়। মাত্র গোসল করে এসেছি আর আপনি গোসল না করেই আমায় ধরে বসে আছেন?”

ঘাড়ে চুমু দিয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তৈমূর। পকেটে হাত গুঁজে তনির দিকে একপলক তাকিয়ে বিদ্রুপ করে বললো,“ঠিকমতো হাত-পা ধোয় না আবার একদিন সঠিক সময়ে গোসল করে কি ভাব!”

“এই এই কী বললেন আপনি? ইনডিরেক্টলি আমায় অপরিষ্কার বললেন?”

“মেয়েদের সাথে ঝগড়া করি না।”

“আমি ঝগড়া করছি?”

“আপনি যতই চান না কেনো? আমি কিন্তু উত্তেজিত কোনো উত্তর দিচ্ছি না ম্যাডাম। অলমোস্ট চার চারদিন ধরে বউ ছাড়া আছি। ঝগড়া করে মুড নষ্ট করার মানেই হয় না।”

আর কথা না বাড়িয়ে নিজের পোশাক নিয়ে বাথরুমে ঢুকল তৈমূর। উথমী হা হয়ে বসে রইলো সেখানে। দিনে দিনে লোকটা অতি চালাক হয়ে যাচ্ছে। নিজে শুরু করে নিজেই সেফ জোনে চলে গেলো? ঘন ঘন কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রাগ দমন করে উঠে দাঁড়ালো উথমী। ঘুমন্ত তনির কপালে চুমু দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানলো। বাথরুমের দরজায় টোকা মেরে বললো,“সবার জন্য আনা শাড়িগুলো কী করবো? আপনি দিয়ে আসবেন নাকি আমি দিয়ে আসবো?”

ভেতর থেকেই তৈমূর উত্তর দিলো,“আপনি দিয়ে আসুন। আর বুবুরটা কিন্তু আম্মার হাতেই দিবেন। উনি পরে না হয় দিয়ে দিবে।”

“ঠিক আছে।”—-কথাগুলো শুনে আর সেখানে দাঁড়ালো না উথমী। শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

যোহরের নামাজ আদায় শেষে বিছানায় বসে পান খাচ্ছেন শাহানা। তখনি দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করল উথমী। শাহানা দ্বিতীয় পান পাতায় খয়ের দিতে দিতে একবার মুখ উঁচিয়ে তাকালেন। তারপর পূর্বের মতো নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে শুধালেন,“কী দরকার?”

হাতের পাঁচটা ব্যাগের থেকে দুইটা ব্যাগ বিছানার উপর রাখলো উথমী। বললো,“আপনার আর আপার জন্য ইদের পোশাক ছিলো।”

হাত থেমে গেলো শাহানার। একপলক ব্যাগগুলোর দিকে তাকালেন তিনি। মেয়েদের পোশাক আশাকের ব্যাপারে তৈমূরের তেমন একটা ধারণা নেই। মায়ের জন্য বরাবরের মতো সে নিজে পছন্দ করে শাড়ি কিনলেও বাদবাকি মেয়েলি পোশাক তিথিয়াই কেনে। তৈমূর শুধু টাকাটা এনে তুলে দিতো মায়ের হাতে। আর শাহানা সেই টাকা পাঠাতো তিথিয়াকে। তিথিয়া নিজেদের জন্য কেনাকাটার সময় বাপের বাড়ির মেয়েদের জন্যও কিনে আনতো পোশাক। আর তারপর শাহানা সেসব নিজ হাতে সবার হাতে তুলে দিতেন। এমনটা গত ইদেও হয়েছিল অথচ এতো তাড়াতাড়ি সব বদলে গেলো? ছেলে একবারও এ বিষয়ে উনাকে জানায়নি পর্যন্ত? ভেবে ভেবে অবাক হন শাহানা। তবে মুখে তা প্রকাশ করেন না। ছোট্ট করে বলেন,“আচ্ছা।”

“শুধু আচ্ছা? আগে দেখুন আপনার পছন্দ হয় কিনা। আমি নিজে গিয়ে সব কিনে এনেছি।”

বিপরীতে কড়া কিছু বললেন না শাহানা। আগামীকাল ইদ। তাই আজ আর কারো মনে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে উনার হলো না। হাতের পানটা মুখে পুরে ব্যাগগুলো থেকে একে একে বের করলেন সব পোশাক। দুইটা ব্যাগে মোট চারটা শাড়ি দেখে ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকালেন। বললেন,“শাড়িগুলো বেশ সুন্দর হয়েছে কিন্তু দুই ব্যাগে দুটো দুটো করে চারটে কেনো?”

“আপনার দুইটা আর আপার দুইটা। সবার জন্য দুটো দুটো করেই এনেছি।”

কথাটা শুনে আঁতকে উঠলেন শাহানা। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলেন,“মাথা কী গেছে? দেখেই বুঝা যাচ্ছে শাড়িগুলো অনেক দামি! রোজার ইদেও সবার জন্য কতগুলো টাকা খরচা করে কেনাকাটা করল তৈমূ। আবার এই ইদেও? কোরবানির ইদে কে কেনাকাটা করে শুনি? বয়স তো কম হলো না অথচ এখনো সংসার কীভাবে করতে হয় সেসব বোঝো না? দুই ভাই মিলে কোরবানি দিচ্ছে। তাতেও অর্ধেক টাকা তৈমূকে দিতে হচ্ছে। বাজার-সদাই, গাড়ি খরচ, ড্রাইভারের বেতন, সংসারের খরচ এসব তো বাদই দিলাম। টাকা কী গাছে ধরে? তৈমূ ছেলে মানুষ। ও সংসারের কী বুঝে? ও বললেই তোমাকে এতো খরচ করতে হবে? এখনই যদি সঞ্চয় করা না শেখো তাহলে কবে শিখবে?”

ধমকের সুরে বলা কথাগুলো শুনে নড়েচড়ে উঠলো উথমী। আমতা আমতা করে বললো,“ভুল বুঝছেন। আপনার ছেলে আগে টাকা পাঠিয়ে তারপর সবার জন্য কেনাকাটার কথা বলেছিল। আমি না করি কীভাবে? আর চারটে শাড়ির মধ্যে দুটো আপনার ছেলের টাকায় কেনা আর বাকি দুটো আমার টাকায়। আপনাদের সাথে এটা আমার প্রথম ইদ। তাই আমারও কিছু দেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল আপনাদের। এই জন্যই আরকি।”—-বলে থামলো সে।

কিছুটা নরম হলেন শাহানা। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এখানে এসে বসো।”

বিষ্ময় নিয়েই বিছানায় এসে বসলো উথমী। শাড়িগুলো ব্যাগে ভরলেন শাহানা। আওয়াজ একটু নামিয়ে বলতে লাগলেন,“সংসারের খেলা খুবই জটিল। মেয়ে মানুষ ছাড়া যেমন কোনো সংসার হয় না তেমনি গোটা একটা সংসার টিকে থাকে একমাত্র মেয়ে মানুষের কারণে। আবার একটা সংসার ধ্বংসও হয় সেই মেয়ে মানুষের কারণেই। পুরুষ রোজগার করতে জানলেও সংসার করতে তারা জানে না। তাছাড়া সারাজীবন মানুষের কিন্তু একরকম চলে না। আজ রোজগার আছে কাল কিন্তু নাও থাকতে পারে। তখন কী করবে? কীভাবে চলবে? নিজেদের তো একটা ভবিষ্যৎ আছে নাকি? বিপদে পড়লে কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। তাই এখনি সঞ্চয় করার চেষ্টা করো। অযথা খরচ করা ভালো নয়। শুরুতেই তোমায় চাকরি করতে মানা করেছি কারণ মেয়ে মানুষের চাকরি করা আমার পছন্দ না। এমন তো না যে স্বামী ভালো রোজগার করে না, খরচ দেয় না, সংসার চলে না তাই চাকরি করবে? স্বামী ভালো হলে, রোজগার ভালো হলে সংসার ফেলে ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চাকরি করার কী প্রয়োজন? বর্তমান জামানার মেয়েদের আর বেশি সুখ সহ্য হয় না। শাশুড়ি কিছু বললেই ভাবে তাদের খারাপ চাইছে। এবার যা করার করেছো কিন্তু এমন ভুল যেনো আর কোনোদিন না হয়। রোজগার করলেই দু হাত দিয়ে উড়াতে নেই। ভবিষ্যৎ বাচ্চাকাচ্চার জন্য জমিয়ে রাখতে হয়। বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করা অতো সহজ নয়। তাদের পেছনে অনেক খরচা আছে। শখ করে এনেছো তাই বেশি কিছু বললাম না। যাও বাকিদেরটা তাদের হাতে দিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, স্বামীর টাকা পয়সার হিসাব রাখা শেখো। না পারলে নিজের মায়ের কাছ থেকে শিখে এসো।”

মুখ ভার করে কথাগুলো শুনে প্রস্থান করল উথমী।

হঠাৎ করেই তনির ঘুমটা ভেঙে গেলো। আলস্যে শোয়া থেকে উঠে চোখ ঘষে ফ্যালফ্যাল নয়নে সারা ঘরে দৃষ্টি বুলিয়ে অবাক হলো সে। এটা আবার কোন জায়গা? তার স্পষ্ট মনে আছে, বাবাকে টাটা করে সে ফুপির সাথে গাড়িতে উঠে বসেছিল। তারপর গাড়িটা ছেড়ে দিলো। চলন্ত গাড়িতে ফুপি তাকে দুটো চিপস খাওয়ালো, পানি খাওয়ালো। কিন্তু তারপর? তারপর আর কিছুই মনে নেই তার। সম্পূর্ণ নতুন, অপরিচিত জায়গায় নিজেকে একা আবিষ্কার করতেই ভয় পেয়ে গেলো বাচ্চা মেয়েটি। চোখে পানি জমলো, ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে খুব।

বারান্দা থেকে টব হাতে ঘরে প্রবেশ করতেই বিছানার উপরে বসা জাগ্ৰত তনিকে দৃষ্টিগোচর হলো তৈমূরের। তৎক্ষণাৎ দরজার বাইরে টবটি রেখে এসে কোমল স্বরে শুধালো,“ঘুম ভেঙেছে তোমার?”

অপরিচিত ঘরে এবার পরিচিত মুখশ্রী দেখে ভয় কিছুটা কমলো তনির। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করল,“পুপি কই?”

বাচ্চাটিকে ভালো করে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো তৈমূর। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু, ঠোঁট উল্টে কথা বলার ধরণ দেখেই মেয়েটি যে ভয় পেয়েছে বুঝে গেলো সে। তাই মিষ্টি হেসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,“ফুপি বাড়িতেই আছে। ভয় পেয়েছো তুমি?”

উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো তনি। অধরের হাসি বজায় রেখেই ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার মুখটি মুছিয়ে দিলো তৈমূর। তারপর ঘরের বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বললো,“ভয় নেই সোনা। এটা তো তোমার ফুপিরই বাড়ি। বাড়িতে আরো অনেক মানুষ আছে। চলো তোমায় দেখিয়ে আনি।”

নিচে এসে নিজ দায়িত্বে জেবা, করবী, মালতী ফুফুর হাতে ব্যাগ তিনটি ধরিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো উথমী। ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই তাকে পেছন ডাকলো জেবা,“উথমী!”

ডাক শুনে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে গেলো উথমী। পিছু ফিরে তাকালো। জেবা শুধালো,“তনিকে গোসল করিয়েছো?”

“আসার আগে মা করিয়ে দিয়েছে। পথে তো গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই ঘুম এখনো ভাঙেনি।”

“আচ্ছা, ওর খাবার আমি বেড়ে রেখেছি। ঘরে যাচ্ছোই যখন সাথে করে নিয়ে যাও। খাবার খাইয়ে জোহানের কাছে দিয়ে যেও। বাচ্চা মানুষ একা থাকলে বিরক্ত হয়ে যাবে।”

জায়ের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে রন্ধনশালায় প্রবেশ করল উথমী। তনিকে কোলে নিয়ে সর্বপ্রথম মায়ের ঘরে এসে উপস্থিত হলো তৈমূর। মালতী ফুফু তখন শাহানার দুপুরের খাবারটা বিছানায় রেখে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দ্বারে পা বাড়িয়েছেন। তৈমূর উনাকে দেখেই বলে উঠলো,“আমার ঘরের সামনে একটা টব রেখে এসেছি ফুফু। টবের নিচে ছিদ্র হয়ে গিয়েছে। গাছে পানি দিলেই মেঝে ভিজে যায়। ওইটা সঙ্গে করে নিয়ে যান তো। সদর দরজার বাইরে রেখে দিলেই হবে।”

“আইচ্ছা।”—-বলেই প্রস্থান করলেন তিনি।

ছেলের কণ্ঠস্বর শুনে সম্মুখে তাকালেন শাহানা।ভাতের প্লেটে হাত দিতে গিয়েও গুটিয়ে নিলেন তা। কয়েকদিন ধরে দুপুরের খাবারটা তিনি ঘরে বসেই খাচ্ছেন। নিচে গিয়ে খেয়ে আবার ভরা পেটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসা বড়োই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। যদিও তুরাগ উনাকে বেশ কয়েকবার নিচের ঘরে শিফট হতে বলেছিল কিন্তু এই সিদ্ধান্তে উনি নারাজ। যৌবনে এই ঘরেই স্বামীর সঙ্গে কতশত মুহূর্ত কাটিয়েছেন তিনি। শ্বশুর-শাশুড়ি আবার থাকতো নিচ তলায়। সেই থেকে এই ঘরেই শান্তিবোধ করেন শাহানা। যদিও উঠানামায় একটু কষ্ট হয় তবুও এতেই তিনি সন্তুষ্ট। শুধালেন, “খাওয়া শেষ?”

“না, পরে খাবো। ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছে। অপরিচিত জায়গা হওয়ায় বেচারি ভয় পাচ্ছিল তাই ভাবলাম বাড়ি ঘুরে দেখাই।”

ছেলের কথায় শাহানার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো তৈমূরের কোলে চুপটি করে বসে ফ্যালফ্যাল নয়নে উনার পানে তাকিয়ে থাকা তনির দিকে। বাচ্চা মানুষ শাহানার বরাবরই পছন্দের। সবার সঙ্গে যেমন তেমন আচরণ করলেও বাচ্চাদের সঙ্গে উনার আচরণ খুবই নমনীয়। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখতেই অধরে এক চিলতে হাসি ফোটে উঠলো শাহানার। হাত বাড়িয়ে বললেন, “মাশাআল্লাহ! ভারী মিষ্টি মেয়ে তো! ছোটো বউয়ের ভাইয়ের মেয়ে বুঝি? দে দেখি আমার কোলে।”

“হ্যাঁ, ওর নাম তনি। খেতে বসেছেন আগে খেয়ে নিন। কোলে পরে নেওয়া যাবে।”

কথাটায় মোটেও সন্তুষ্ট হলেন না শাহানা। জিজ্ঞেস করলেন,“খেয়েছে ও?”

“না, বললাম না মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে।”

“তাহলে নিচে নিয়ে খাইয়ে দিতে বল। খাওয়া শেষে দিয়ে যাস।”

প্রত্যুত্তরে আচ্ছা বলে তনির দিকে তাকালো তৈমূর। তার বাম হাতটি নাড়িয়ে বললো,“ইনিও সম্পর্কে তোমার দাদী হয়। দাদীকে সালাম দাও।”

বাধ্য মেয়ের মতো হাত নাড়িয়ে সালাম দিলো তনি। শাহানাও সালামের জবাব নিলেন। তারপর মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে সামনে এগোতেই উথমীর মুখোমুখি হলো দুজন। তাদের দেখেই এগিয়ে এলো উথমী। বললো,“কোথায় ছিলেন? আমি ওর জন্য খাবার নিয়ে ঘরে এসে দেখি ও নেই।”

“ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তাই ওকে নিয়ে আম্মার ঘরে গিয়েছিলাম।”

কথাটি বলে তনিকে উথমীর কোলে তুলে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো তৈমূর। আর উথমী তাকে নিয়ে চলে গেলো ঘরে।
______________

অন্যদিনের তুলনায় আজকের দিনটি ভীষণ সুন্দর। রমণীরা কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পায়েস, সেমাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন সব মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারের আয়োজন করেছে। বাড়ির পুরুষেরা গিয়েছে ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে।

মালতী ফুফু মেঝেতে বসে শিল পাটায় গরম মশলা বাটছেন। আদা, রসুন গতকাল রাতেই জেবা বেটে রেখেছে। শাহানা, বশির উদ্দিন আবার ব্লেন্ডারে বাটা মশলা দিয়ে রান্না তরকারি খেতে পারেন না। যার কারণে শিল পাটায় বাটা মশলা দিয়েই এ বাড়িতে সব রান্না হয়‌।

তনি সেন্টার টেবিলের উপর বসে পায়েস খেতে খেতে শরীর মাখিয়ে ফেলেছে। মুখ থেকে শুরু করে পোশাকের অবস্থা তার খুবই করুণ। ভাতিজির এমন অবস্থা দেখে হতাশার শ্বাস ফেললো উথমী। ক্লান্ত স্বরে বললো,“মাত্র তোকে গোসল করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে আনলাম আর তুই সব নষ্ট করে ফেললি?”

ফুফুর কথায় পাত্তা দিলো না তনি। আপনমনে বসে সে খাচ্ছে। সাথে চামচে একটু পায়েস তুলে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“হা করো।”

কথার বিপরীতে উথমী চোখ রাঙানি দিতেই চামচটা নিজের মুখে পুরে নিলো তনি।শাহানা সেসব দেখলেন। ধীর পায়ে হেঁটে এসে বসে পড়লেন সোফায়। তনির পক্ষ নিয়ে বললেন,“বাচ্চা মানুষ এমন একটু আধটু অকাজ করেই। তোমার উচিত হয়নি এখনি ওকে নতুন পোশাক পরিয়ে দেওয়া। ওরা ফিরলে না হয় পরিয়ে দিতে।”

“গোসল সেরে ইদের দিন নতুন পোশাক না পরলে হয়?”

“বললাম না বাইরে যাওয়ার সময় পরিয়ে দিতে হয়। এতো বয়স হলো অথচ বাচ্চা কীভাবে সামলাতে হয় তাও জানে না।”

মাত্র একদিনের ব্যবধানেই তনির সাথে ভীষণ সখ্যতা গড়ে উঠেছে শাহানার। এমনকি গতকাল রাতে উনার ঘরে, উনার সাথেই ঘুমিয়েছে তনি। শাশুড়ির সাথে কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে রন্ধনশালার দিকে এগিয়ে গেলো উথমী। তনি এবার চামচটা শাহানার দিকে বাড়ালো। অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“তুমি খাও।”

হাসলেন শাহানা। বললেন,“না, তুমি খাও। আমি পরে খাবো। আরেকটু দিবো তোমায়? সেমাই খেয়েছো?”

মাথা নাড়ালো তনি‌। সায় জানালো,“তেমাই দাও।”

সেই ভোর থেকে চুমকিকে নিয়ে বিভিন্ন সব রান্নাবান্নার আয়োজন সেরে গোসল করে এসে সোফায় বসলেন কেয়া। রিনিতা ডাইনিং এর চেয়ারে বসা। ঘরে একা একা তার ভালো লাগে না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেছে সে। যা বুঝলো মেয়েটা বেশ ভালোই আছে ওখানে। তাই নিশ্চিন্ত মনে বসে বসে সে সেমাই খাচ্ছে। চুমকি ধরে ধরে ঊষাকে এনে সোফায় বসালো। উৎফুল্ল হয়ে বললো,“আপারেও নতুন কাপড় পরাইয়া লইয়া আইছি। ঘরে গিয়া দেহি একলা একলা বইয়া রইছে। আমি তৈরি হইতে কওয়ার পরে কয়, আমারে এইসব কাপড়ে মানাইবো না। এইডা কোনো কথা খালাম্মা?”

কেয়া বেগম মেয়ের পানে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। বললেন,“মাশাআল্লাহ! মানাবে না কেনো? জামাটা অনেক সুন্দর। সাথে এই জামা পরে আমার মেয়েকেও অনেক সুন্দর লাগছে। কী বউমা! সুন্দর লাগছে না?”

শাশুড়ির কথায় ননদের পানে একপলক তাকায় রিনিতা। সায় জানায়,“আমাদের ঊষা তো এমনিতেই সুন্দর মা। সবকিছুতেই ওকে সুন্দর লাগে।”

মা, ভাবীর কথায় মলিন হাসলো ঊষা। তারা যে তার মন রাখার জন্য মিথ্যে বলছে তাও সে খুব ভালো করেই জানে। কারণ আয়নাতে নিজেকে দেখেছে সে। মুখের এতো বিশ্রী দাগের সাথে এই সাজ যে বড্ড বেমানান।

চলবে__________

#জারুল_ফুলের_কাব্য
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৫]

ধরণীতে রজনীর আঁধার নেমেছে। সেই আঁধারের সাথে পাল্লা দিয়ে তৈমূরের সারা দেহ ব্যথায় অসাড় হয়ে আসছে। শরীর থেকে বের হচ্ছে উত্তাপ। আধ বেলা কসাইয়ের কাজ শেষে গোশত বিতরণ করতে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতেই মেতে উঠেছিল সে আড্ডায়। তারপর তনিকে নিয়ে আবারো বাইরে ঘুরতে যাওয়ায় বাড়ি ফিরতেও বেশ দেরি হলো তার। যার জন্য সামান্য বিশ্রামের অবকাশটুকুও সারাদিন পায়নি বেচারা।

ক্লান্ত, ব্যথাতুর শরীর নিয়ে বালিশে মাথা রাখতেই ঘরে প্রবেশ করল উথমী। সোজা বিছানার কাছে এসে হাত বাড়ালো স্বামীর দিকে। স্ত্রীর বাড়ানো হাত দেখে ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো তৈমূরের। শুধালো,“কী?”

মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেলো উথমীর। বাম হাতটি কোমরে গুঁজে বললো,“আমার ইদের সালামি কোথায়? সকালে যে এতো সুন্দর করে ইদ মোবারক বললাম, কই সালামি তো দিলেন না?”

হাসি পেলো তৈমূরের কিন্তু সে হাসলো না। বিছানার অপরপাশে একটু চেপে গিয়ে বললো,“বসুন।”

উথমী বসলো। তৎক্ষণাৎ নিজের হাতটা স্ত্রীর কোলে রাখলো তৈমূর। চোখ বন্ধ করে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,“হাতটা খুউব ব্যথা করছে উথমী। একটু টিপে দিন না।”

প্রত্যুত্তরে হাঁ, না কিছুই বললো না উথমী। বাধ্য স্ত্রীর মতো টিপতে লাগলো স্বামীর হাত। চোখ খুলে তাকালো তৈমূর। কণ্ঠে সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আসলেই কী আপনি ব্যথা কমানোর জন্য টিপছেন নাকি আমায় উত্তেজিত করছেন?”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো উথমী। আমতা আমতা করে শুধালো,“উত্তেজিত করছি মানে?”

“তাই তো মনে হচ্ছে। বিশ্বাস করুন এখনো পর্যন্ত একটা টিপও আমার হাতে লাগেনি। মনে হচ্ছে আপনার নরম হাত দিয়ে আপনি আমায় সুরসুরি দিচ্ছেন।”

কথাটা শুনেই ঠান্ডা মেজাজের মেয়েটি রেগে বোম হয়ে গেলো। ঝামটা মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ ফুলালো,“আপনি একটা যাচ্ছে তা পুরুষ মানুষ। সালামিটা দিয়ে দিন চলে যাচ্ছি।”

“কোথায় যাবেন?”

“নিচে।”

“লাভ কী? সেই তো রাত গভীর হলে আবারো আমার বুকের মাঝেই চলে আসতে হবে।”

কটমট করে স্বামীর পানে তাকায় উথমী। তার চাহনিতে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না তৈমূর। শব্দ করে হেসে উঠলো। লোকটির হাসিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। কয়েক মুহূর্তেই রাগ উধাও হয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেলো তার মুখশ্রীতে। মিনমিনে স্বরে কপোট রাগ দেখিয়ে বললো,“এভাবে হুটহাট আমার সামনে হাসতে আপনাকে নিষেধ করেছি না? আপনি কিন্তু আমার কোনো নিষেধাজ্ঞা শুনছেন না তৈমূর সাহেব।”

“হাসি এলে হাসবো না?”

“না।”

“এতোটাই অপ্রিয়?”

“উহু তা নয়।”

“তবে?”

অপ্রস্তুত হলো উথমী। চোরা চোখে পুরুষালি মুখশ্রীতে একপলক তাকিয়েই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। এক হাতের তালুতে অন্য হাতের আঙুল ঘষতে ঘষতে শুকনো ঢোক গিললো। কোনো কিছু না ভেবেই নিঃসংকোচে বলে উঠলো,“আপনার হাসি সুন্দর! একটু বেশিই।”

“সে কি! এতোদিন না কুৎসিত ছিলো?”

“মিথ্যে ছিলো।”

“মিথ্যে?”

“হু।”

“কেনো?”

“যাতে হুটহাট আমার সামনে আর এভাবে না হাসেন।”

“কেনো কেনো?”

“প্রেমে পড়ার ভয়ে।”

“তা, পড়েছেন?”

“না।”

“তবে?”

“ভালোবেসেছি।”

প্রিয় নারীর সহজ স্বীকারোক্তিতে ভড়কে গেলো তৈমূর। সে জানে মেয়েটি তাকে ভালোবাসে কিন্তু সরাসরি নিজ মুখে যে সে সত্যটা স্বীকার করবে তা অবশ্য কখনো ভাবেনি তৈমূর। তবে মনের গহীনে ভালোলাগাটা তার বৃদ্ধি পেলো। হেঁচকা টানে নিজের বুকের উপর এনে ফেললো মেয়েটিকে। জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে শুধালো,“তা কবে কবে ভালোবাসা হলো?”

“জানি না।”

“আরেকটি মিথ্যে?”

“মানুষের জীবনে বসন্তের ভালোবাসা কখন আসে তা কেউ আগে থেকেই বুঝতে বা জানতে পারে না। তা জানা, বুঝা যায় ধীরে ধীরে।”

উথমী থামলো। পরক্ষণেই উদাস মনে বললো, “আপনি আমার জীবনের দ্বিতীয় বসন্তের ভালোবাসা তৈমূর সাহেব। অথচ আমি ভেবেছিলাম, মানুষ দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে পারে না। কারো জীবনে দ্বিতীয় বসন্ত আসতে পারে না। কিন্তু আমার জীবনে এসেছে। আমি এও ভেবেছিলাম যে আমার ভাগ্য খারাপ। সেই ভাগ্যের জেরেই যদি বিয়ের পর সুখী হতে না পারি? সেও যদি বর্ষের মতো হয়? তখন আমার কী হবে? ডিভোর্সী তকমা গায়ে লাগিয়ে বাড়িতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এই বর্ষ অধ্যায় নিয়েই উঠতে বসতে কম অপমান তো আর আমি সহ্য করিনি! দু দু বার মরতে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারিনি। সাহসে কুলায়নি। কিন্তু ডিভোর্সী হয়ে ফিরে গেলে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না আমার কাছে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত থাকায় বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলাম না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পাত্রদের প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু আপনি সেই সুযোগটাই আমায় দিলেন না। বিয়ের পর বাড়িতে পা রেখে যখন আপনার মা-বোনের বিয়ে মেনে না নেওয়ার কাহিনী শুনলাম তখন তো আমি ভেবেই নিয়েছিলাম এই সম্পর্ক, সংসার বেশিদিন টিকবে না। শুরু হওয়ার আগেই এর সমাপ্তি নিশ্চিত।‌”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো উথমী। মিনমিনে স্বরে ফের বললো, “সেই প্রস্তুতি নিয়েই দিন পার করছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা সত্যিই ভুল প্রমাণিত হয়ে গেলো। আমি এখন বিশ্বাস করি, আপনি আমায় কখনো ছাড়বেন না। ধোঁকা দিবেন না। ধোঁকা আপনার সাথে যায় না। আপনার সাথে এসব শব্দ বড্ড বেমানান।”

মুহূর্তেই বুকটা হো হো করে উঠলো তৈমূরের। মেয়েটির মুখ থেকে নিজের দুঃখের এবং তাকে ভালোবাসার কথা শুনে মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে ভেতরে। স্ত্রীর কপালে চুমু খেলো তৈমূর। দেহ দুটির মধ্যকার সকল দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে বললো, “অতীত ভুলে যাওয়াই উত্তম উথমী। অতীত মনে রাখলে বর্তমান, ভবিষ্যৎ কখনোই উপভোগ করতে পারবেন না।”

প্রত্যুত্তর করল না উথমী। বিড়াল ছানার মতো গা ঘেঁষে নিশ্চিন্তে শুয়ে রইলো সে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল তৈমূর,“তনি কোথায়?”

“আপনার মায়ের কাছে।”

“ওখানে কী করে?”

“জানি না। গতকাল দুপুরে খাওয়ার পর এসে তিনি নিজের সাথে তনিকে নিয়ে গেলেন। তারপর কী হলো কে জানে? দুজনের মধ্যে একেবারে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কাল রাতেও উনার কাছেই ঘুমিয়েছে। আবার আজ রাতেও নাকি উনার কাছেই ঘুমাবে। আজ সারাদিনও শুধু দাদী দাদী করেই পিছু পড়েছিল। আমার দুষ্টু ভাতিজিকে আপনার খিটখিটে মেজাজের আম্মা কী জাদু করেছে বলুন তো? যেই মেয়ে আমার মায়ের কাছেই দুদণ্ড শান্তিতে বসে না, সে কিনা এখানে এসে এতো বাধ্য হয়ে গেলো?”

“আম্মা যার সাথে যেমনই হোক না কেনো, বাচ্চাদের কাছে তিনিও একটা বাচ্চা। বাচ্চাদের খুব ভালোবাসেন। শুধু তনি কেনো? জোহান, ওরি, মিলি থেকে শুরু করে ঝুমুর, রেণুকা বুবুদের ছেলে- মেয়েরাও ছোটো থাকতে আম্মার জন্য পাগল ছিলো। বাচ্চাদের একটু আলাদা ভাবেই ট্রিট করেন তিনি। একবার আমাদের বাচ্চাটা হয়ে যাক তখন ভালো করে বুঝবেন।”

বাচ্চার কথা শুনতেই লজ্জা পেলো উথমী। মুখ লুকিয়ে পড়ে রইলো স্বামীর বুকে। যা এই প্রথম দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো তৈমূরের। এভাবেই সময় গড়ালো। পিনপতন নিরবতার মধ্যেই নড়চড় হলো তৈমূরের। মাথা উঠিয়ে পার্শ্ব বালিশের নিচ থেকে একটি সাদা খাম বের করে স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলো। উথমী সোজা হয়ে শুয়ে খামের থেকে নজর ঘুরিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তৈমূরের পানে। তৈমূর সেই দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসলো। কোমল স্বরে বললো,“সালামি।”

অধরে তৃপ্তির হাসি ফোটে উঠলো উথমীর। খাম খুলতে খুলতে খোঁচা দিয়ে বলে উঠলো,“দিনদিন আপনার কিপটামি স্বভাবটা কমছে।”

কথাটা গায়ে মাখলো না তৈমূর। গালের সাথে গাল ঘষে বললো,“আমার সালামি কোথায়? দিন।”

“আপনারও লাগবে?”

“অবশ্যই। পুরুষ বলে কী সালামি পাবো না?”

“আচ্ছা আমার থেকে অর্ধেক দিয়ে দিবো না হয়।”

“টাকা লাগবে না। খামের সবটাই আপনার।”

“তাহলে?”

“সালামি হিসেবে আপনাকে চাই। দ্রুত কয়েকটা চুমু দিয়ে দিন তো।”

বাঁকা দৃষ্টিতে লোকটির পানে তাকিয়ে মুখ বাঁকালো উথমী। অবাধ্য স্বরে বললো,“পারবো না। গতকাল রাতেও দিয়েছি। আজ সকালেও দিয়েছি। আমার কাছে আপনার আর কোনো সালামি পাওনা নেই। চুপ করে ঘুমান।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে খামটি নিজের বালিশের নিচে ঢুকিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করল উথমী। তৈমূর শুধু স্ত্রীর কার্যকলাপ চেয়ে চেয়ে দেখলো। শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে নিজেও শুয়ে পড়ল।

শাহানার ঘরে ডিম লাইটের আলো জ্বলছে। ঘরে স্বল্প আলো থাকলেও রাতের নিদ্রায় কিছুতেই তিনি যেতে পারেন না। তবে পাশে তনি আর জোহান থাকায় এই সাময়িক অসুবিধাটাও শাহানা মন থেকে মেনে নিয়েছেন।

গতকাল দাদীর গল্প শুনে ঘুমিয়েছে তনি! কথাটা শুনেই মায়ের বারণসত্বেও রাতের খাবার খেয়েই আজ বালিশ নিয়ে দাদীর ঘরে চলে এসেছে জোহান। শাহানার একপাশে তনি আরেকপাশে জোহান শোয়া। মাঝখানে শুয়ে তিনি গল্প বলছেন। রূপকথার গল্প। যেখানে বাঘ, রাক্ষস থেকে শুরু করে রাজা রাণী সবার ঠাঁই পেয়েছে একসাথে। যা শাহানার নিজের তৈরি। ছেলে-মেয়েরা ছোটো থাকতে তাদেরকেও তিনি এসব গল্প বলেই ঘুম পাড়িয়েছেন, খাইয়েছেন। ওদিকে জোহান আর তনি সেসব শুনে কখনো বা খিলখিলিয়ে হাসছে আবার কখনো বা ভয়ে কেঁপে ওঠে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকাচ্ছে।
___________

বাইরে এখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। চারিদিকের বিভিন্ন মসজিদ থেকে একত্রে ভেসে আসছে মোয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি। সেই ধ্বনিতেই রায়হান কবীরের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। শোয়া থেকে উঠে বসে আজানের জবাব দিলেন। পাশে শোয়া ঘুমন্ত স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে ডাকলেন, “উৎসর মা! আজান দিয়েছে। ওঠো! নামাজ আদায় করে তারপর না হয় ঘুমিও।”

স্বামীর ডাকে ঘুমটা হালকা হয়ে গেলো কেয়া বেগমের। আড়মোড়া ভেঙে সময় নিয়ে উঠে বসলেন। এসব হচ্ছে তাদের নিত্যদিনের রুটিন। বিয়ের পর থেকেই ফজরের সময় যে আগে জাগনা পায় সেই অপরজনকে ডেকে ওঠায় নামাজ আদায়ের জন্য।

ঘরের আলো জ্বেলে ওযু করার উদ্দেশ্যে বাথরুমের পথে এগোলেন রায়হান কবীর। দরজা খোলার শব্দে দাঁড়িয়ে গেলেন পথিমধ্যে। প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কই যাও?”

স্বামীর প্রশ্নে পিছু ফিরে তাকালেন কেয়া। বললেন, “তুমি অযু করে এসো। আমি বরং এই সুযোগে একটু ঊষাকে দেখে আসি।”

“এখন যেতে হবে না। ও ঘুমাচ্ছে। একেবারে নামাজ পড়ে তারপর যেও।”

দ্বিধান্বিত মনে স্বামীর কথাই মেনে নিয়ে আর বাইরে গেলেন না কেয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে চলে এলেন অযু করতে।

ইদ এলেই ব্যস্ত, জনবহুল শহর হয়ে যায় একেবারে মরুর মতো ফাঁকা। চারিদিকে তখন থাকে না কোনো কোলাহল, ভিড়। জ্যাম রাস্তা হয়ে ওঠে জনমানবশূন্য। নামাজ শেষে কিছুক্ষণ তেলাওয়াত করলেন রায়হান কবীর। উনার তেলাওয়াত সুমধুর।ছোটোবেলায় মক্তবে প্রৌঢ় হুজুরের কাছ থেকে শিখেছিলেন। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর তেলাওয়াত খুব পছন্দ কেয়ার। মাঝে অবশ্য অনেক খারাপ সময় দুজনে পার করে এসেছেন তবে সেসব এখন অতীত।

পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে স্বামীর তেলাওয়াত শুনে শরীরে যেনো প্রাণ ফিরে এলো উনার। মনটা হালকা হয়ে গেলো। শুধালেন,“চুলায় চায়ের পানি বসাবো? চা খাবে?”

মাথার টুপি খুলে বিছানায় বসলেন রায়হান কবীর। অসম্মতি জ্ঞাপন করে বললেন,“এখন খাবো না। ভালো করে আগে দিনের আলো ফুটুক।”

মাথা নাড়িয়ে ঘর থেকে বের হলেন কেয়া বেগম। গন্তব্য ছোটো মেয়ের ঘর।

সারা ফ্ল্যাট জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঊষার ঘর জুড়ে চোখ ধাঁধানো অন্ধকার। জানালার পর্দা টেনে দেওয়া। কেয়া বেগমের স্পষ্ট মনে আছে ঘরে তিনি ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। জানালাটাও কিছুটা খোলা ছিলো। ইদানিং রাতবিরেতে খুব লোডশেডিং হয়। তখন চারিদিকে কি ভ্যাপসা গরম! অথচ এখন জানালা বন্ধ? ঊষার কী তবে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মাঝ রাতে? হতে পারে। তাই আর ভেতরে প্রবেশ করলেন না কেয়া। দোরগোড়া থেকে ফিরে এলেন। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক। ঘুমালে শরীর ভালো থাকে।

ধীরে ধীরে পুবাকাশ রক্তিম হয়ে উঠেছে। সূর্যোদয়ের সময় হয়েছে। ধরণীর অন্ধকার কেটে আলো ফোটছে চারিদিকে। বাড়িতে সকলেই আজ উপস্থিত। রিনিতা ড্রয়িং রুমে এসে একটি চেয়ার টেনে বসেছে। রায়হান কবীর চা নিয়ে চলে গিয়েছেন খোলা বারান্দায়। কেয়া দুধ জ্বাল দিচ্ছেন পুত্রবধূ আর কন্যার জন্য। কলিং বেল বাজার শব্দে ওখানেই হাতের কাজ থামিয়ে দিলেন তিনি। চুলার তাপ কমিয়ে চলে এলেন দরজা খুলতে।

দরজা খুলতে না খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করল চুমকি। তাকে দেখে অবাক হলেন কেয়া। প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“তুই? কাল না তিনদিনের ছুটি নিয়ে গেলি?”

“নিছিলাম কিন্তু দেশের বাড়ি আর যাই নাই।”

“সেকি কেনো?”

“এমনেই যাই নাই। তাই চইল্লা আইলাম। আগে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়া নেই খালাম্মা। তারপর বাসন মাইজা রুডি বেলমু।”

“আচ্ছা।”—-বলে পূর্বের মতো রান্নাঘরে চলে গেলেন কেয়া। চুমকি চললো ঝাড়ু নিয়ে ঘরগুলো পরিষ্কার করতে।

ট্রেতে করে দুই গ্লাস গরম দুধ এনে টেবিলের উপর রাখলেন কেয়া বেগম। পুত্রবধূর দিকে একটি গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,“বাড়িটা একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তনি থাকলে এতক্ষণে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো।”

মুখ ভার করল রিনিতা,“তা ঠিক বলেছেন মা। ওর কথা খুব মনে পড়ছে। রাতে ফোন করেছিলাম উথমীকে। বললাম ভিডিও কল দাও কিন্তু তনি এলোই না। সেই যে কাল সকালে মেয়েটার সাথে কথা হয়েছিল। শুনেছি উথমীর শাশুড়ির সাথে নাকি তার খুব ভাব জমেছে।”

মৃদু হাসলেন তিনি। তাড়া দিয়ে বললেন,“নাও দুধটুকু তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও দেখি। তোমার জন্য চুলায় ভাত বসিয়েছি। ভাত হলে ভাত খেয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করবে।”

শাশুড়ির কথা মেনে নিয়ে দুধের গ্লাসে চুমুক বসায় রিনিতা। তৎক্ষণাৎ ভেতর ঘর থেকে ভেসে আসে মেয়েলি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার,“খালাম্মা! ভাবী! হায় আল্লাহ! রক্ত!”

চুমকির চিৎকারে উৎস, রায়হান কবীর দৌড়ে আসে বাইরে। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে চিৎকারের স্থান বুঝতেই প্রবেশ করল ঊষার ঘরে। দরজার সম্মুখে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে চুমকি। চোখ দুটো কুটোর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ফুলের ঝাড়ুটা পড়ে আছে মেঝেতে। কেয়া বেগম ঝাঁঝালো কণ্ঠে পেছন থেকে বলে উঠলেন,“এভাবে চিৎকার করলি কেনো? ঊষা অসুস্থ জানিস না?”

কোনো উত্তর দিলো না চুমকি। তাতে বিরক্ত হলেন কেয়া। উৎস বললো,“দরজার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? সরো সামনে থেকে।”

ধমকে কেঁপে উঠলো চুমকি। সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে সকলেই ভেতরে প্রবেশ করল। পুরো ঘরে ভালো করে তাকাতেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো সবার। সাদা টাইলসযুক্ত মেঝেতে যেনো রক্তের বন্যা! বিছানার একপাশে এলোমেলো অবস্থায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ঊষা। হাত থেকে এখনো রক্ত ঝরছে। এমন দৃশ্য দেখে মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো সকলের। কেয়া দৌড়ে গেলেন মেয়ের কাছে। গালে আলতো করে চাপড় মারতে মারতে ডাকলেন,“ঊষা! এই ঊষা! তোর হাত কেটেছে কীভাবে? এতো রক্ত বের হচ্ছে কেনো?”

রায়হান কবীর ধীর কদমে এগিয়ে এসে বসে পড়লেন বিছানায়। চোখে ঘোলাটে দেখছেন তিনি। কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,“আমার মেয়ে! এ কী করেছে ও? ঊষা ওঠ মা!”

নিষ্প্রাণ দেহে পড়ে থাকা বোনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উৎস। মাথা তার কাজ করছে না। কর্ণে এসে শুধু বাড়ি খাচ্ছে বাবা-মায়ের ভারাক্রান্ত কণ্ঠস্বর। চুমকির কান্না। তার মধ্যেই শুনতে পেলো স্ত্রীর অশান্ত স্বর,“হায় আল্লাহ! একি অবস্থা? ওর হাত কেটে গেলো কীভাবে? আর তুমিই বা এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো তনির বাবা? দ্রুত হাসপাতালে ফোন করে এম্বুল্যান্স ডাকো। দেরি হয়ে গেলে অঘটন ঘটে যাবে।”

কথাটি মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই হুঁশ ফিরে পেলো উৎস। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে সেও অশান্ত হয়ে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে হন্তদন্ত হয়ে বাইরের দিকে ছুটতে ছুটতে বললো,“এম্বুল্যান্স! হ্যাঁ হ্যাঁ এম্বুল্যান্স। এম্বুল্যান্সে ফোন করতে হবে।”

চলবে__________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)