গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
২.
বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে আরো অনেক আগে।এখন একদম অস্ত যাওয়ার পথে।সুবাস মিত্র সড়কের চার নম্বর লেনের সরু গলিতে তখন স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেরা ক্রিকেট খেলছিলো।রূপসা রিকশা থেকে নেমেই সবার প্রথমে সেদিকে তাকালো।
রূপম একটা নীল রাঙা শার্ট পড়ে বল হাতে দাঁড়িয়েছিল।রূপসা তাকে দেখলো,কিন্তু ডাক দিলো না।রূপমকে বেশ মনোযোগী দেখাচ্ছে।সে এখন বল করবে।প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান সাবধানী চোখে তাকে দেখছে।রূপম একটা শ্বাস ফেলে।তারপর তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় বল হাতে ছুটে যায়।রূপসা তার অগোচরেই তার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।তার হাত দু’টো বুকে বাঁধা।তার মন বলছে এই বলেই অপরপক্ষ ধরাশায়ী হবে।
নির্ভুল অনুমান।বল ছোঁড়ার পর সেকেন্ডের মাথায় কড়কড় শব্দ তুলে তিনটে স্ট্যাম্পের তিনটেই মাটি থেকে উঠে এসে ধুলোর উপর গিয়ে পড়ল।রূপম এক সেকেন্ড সেই দৃশ্য দেখলো।তারপর শূন্যে লাফ দিয়ে দুই হাত তুলে চেঁচালো,’ইয়েসসসসস!’
সে পেছন ফিরলো।ফিরতেই রূপসার সাথে তার চোখাচোখি হলো।রূপম চমকিত।বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে যায়।অস্ফুট বুলি আওড়ায়,’দিদিয়া! তুমি?’
রূপসা হেসে ফেলল।রূপমের কাঁধে হাত রেখে বলল,’কি রে ছোট! ক্রিকেটার হবি নাকি বড়ো হয়ে?’
রূপম লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল।অত্যাধিক নিচু স্বরে বলল,’এমন কিছু না দিদিয়া।’
‘বাড়ি আসবি কখন?’
‘মাগরিব পড়ে।’
রূপসা নিচু স্বরে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’
সে দুই কদম সামনে এগোয়।আবার কি মনে হতেই পেছন ফিরে বলে,’ছোট! রাতে কি খাবি?ডালভুনা নাকি মাছভাজি?’
রূপম নিরাসক্ত সুরে বলে,’একটা হলেই হলো।তুমি রাধলে সবই স্বাদ লাগে।’
রূপসা পেছন ফিরে না।ঠোঁটে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে বাড়ির রাস্তায় পা বাড়ায়।আজ বৃষ্টিতে সে সামান্য দেরি করে ফেলেছে।বাড়ি গিয়েই তাকে ঝটপট কিছু একটা রান্না করতে হবে।
সে বাড়িতে এসেই প্রথমে তার ঘরে গিয়ে ব্যাগ রাখে।তার ধীর পায়ে রাজিব সাহেবের ঘরের দিকে যায়।
রাজিব হাসান তখন টান টান হয়ে শুয়েছিলেন।তার পাশে জেসমিন,আধশোয়া হয়ে ছিলো বোধহয়।তার চোখ মুখ দেখে মনে হলো তিনি ভীষণ ক্লান্ত।ক্লান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।কয়েক রাত ধরেই তিনি সজাগ।
রূপসা একবার গলা খাকারি দিলো।চাপা স্বরে বলল,’মণি! তুমি ঘুমিয়ে যাও।আর জেগে থেকো না।’
জেসমিন ধড়ফড়িয়ে উঠলেন।রূপসা ছুটে এসে তার পিঠে হাত বুলায়।মাথা নিচু করে বলে,’ভয় নেই।আমি এসেছি।আমি রূপসা।’
জেসমিন বোকার মতো চেয়ে থাকলেন।ক্ষণিক বাদে রূপসার একটা হাত ধরে বললেন,’রূপ! তুমি আজ হোস্টেলে থাকো নি?’
রূপসা দুই দিকে মাথা নাড়ল।
‘পরীক্ষা পিছিয়েছে মণি।রূপম ফোনে বলল তোমার নাকি শরীর ভালো নেই।তাই চলে এলাম।শোনো মণি,এই কয়দিন আমিই রান্নাবান্না করবো।’
জেসমিন দুই দিকে মাথা নাড়লেন।বিরোধ করে বললেন,’প্রয়োজন নেই রূপ।আমি তো আছিই।’
রূপসা এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে।যেতে যেতে স্বাভাবিক গলায় বলে,’তুমি বিশ্রাম করো মণি।আমি দেখছি সবটা।’
সে রান্নাঘরে এসেই সবার আগে চুলটাকে খোঁপা করে নিলো।রূপমের মাছ ভাজা খুব পছন্দ।খাবারের মেন্যুতে ডালভুনা আর মাছভাজা দু’টোই রাখলে কেমন হয়?সে ব্যস্ত পায়ে কেবিনেটের দিকে এগিয়ে যায়।
রূপম এসে তার পেছনে দাঁড়ালো।কিন্তু ডাক দিয়ে তার মনোযোগ নষ্ট করলো না।রূপসা নিজেই তাকে দেখলো।রূপমের মুখে তখন একটা অমায়িক হাসি লেপ্টে ছিলো।রূপসা হাসি মুখে বলল,’কিরে ছোট?অকারণে হাসছিস কেন?’
রূপম মুখের হাসি আগের মতো রেখেই জবাব দেয়,’তুমি বাড়ি এসেছো তাই।’
‘আমি বাড়ি এসেছি বলে খেলাধুলাও মাঝপথে ছেড়ে দিলি?’
রূপম জবাব দিতে গিয়ে কিছুটা লজ্জা পেল।কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তারপর বলল,’ঐ আরকি।তুমি বাড়ি আসলে বাড়িটা খুব ভরা ভরা লাগে দিদিয়া।’
জেসমিন শাড়ি ঠিক করতে করতে রান্নাঘরে এলেন।রূপসা তখন চুলোতে কড়াই বসিয়েছে মাত্র।জেসমিন এগিয়ে এসে বললেন,’দাও রূপ।আমাকে দাও।আমিই পারবো।তুমি কিছুক্ষণ খাটে গিয়ে শুয়ে থাকো।’
রূপসা বিরক্ত হলো ভীষণ।
‘মণি! তোমাকে বলেছিলাম শুয়ে থাকতে।উঠে এসেছো কেন?’
‘আমার শুয়ে খাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না।আমি পুরোপুরি সুস্থ।’
রূপসা মুখ গম্ভীর করে তার কথা শুনে।তারপর চাপা স্বরে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।তুমিই রান্না করো।আমি পাশ থেকে সব এগিয়ে গুছিয়ে দিবো।’
জেসমিনের মুখের হাসি চওড়া হলো।তিনি আঁচলটা কোমরে গুঁজে বললেন,’আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি পাশে দাঁড়াও।আমার কিছু লাগলে তোমায় বলবো।’
জেসমিন কেটে রাখা পেঁয়াজের কিছুটা গরম তেলে ছেড়ে রূপমের দিকে ফিরে বললেন,’রূপম! তুমি কি খেতে চাও বলো।আজ তোমাদের দু’জনের পছন্দেই সব রান্না হবে।’
রূপম নাক ছিটকে বলল,’আমি কিছুই খেতে চাই না।’
তার কন্ঠে তাচ্ছিল্য ছিলো।সাথে ছিলো খানিকটা বিদ্রুপের আভাস।জেসমিন ব্যাথাতুর চোখে তার দিকে তাকালেন।রূপম ততক্ষণে হনহন করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।রূপসা চোখ ঘুরিয়ে দু’জনের মুখ দেখল।তারপর ধিমি আওয়াজে বলল,’মণি তুমি থাকো।আমি একটু আসছি।’
***
‘রূপম! এ্যাই রূপম।’
রূপসার কন্ঠ চওড়া শোনাচ্ছে।রূপম গায়ে মাখলো না।চেয়ার টেনে টেবিলে বসে বলল,’জ্ঞান ঝাড়িস না দিদিয়া।জ্ঞান আমার ভালো লাগে না।’
রূপসা তার মাথায় চাটি মেরে বলল,’তুই মণির সাথে এতো বাজে আচরণ করিস কেন?এগুলো একদমই ঠিক না।’
‘তো কেমন আচরণ করবো তার সাথে?তাকে আমার অসহ্য লাগে।’
‘কেন অসহ্য লাগে?সে তোর কোন বাড়া ভাতে হাত দিয়েছে?’
রূপম চোখ তুলে রূপসার দিকে তাকালো।একেবারে টকটকে লাল চোখ।রূপসা অবাক হয়ে বলল,’মণির সাথে তোর এতো রাগ?’
রূপমের দৃষ্টি স্থির।চোয়াল শক্ত করে বলল,’তোর ঐ মণি,আমার মায়ের সংসারে ভাগ বসিয়েছে।তাকে আমার ঘেন্না লাগে।’
‘রূপম! বাবা বিয়ে করেছে তাকে।’
‘সেজন্য বাবাকেও ঘেন্না লাগে।’
রূপম গজ গজ করে বলল,’বাবার কি দরকার ছিলো আরেক বিয়ে করার?আমাদের দু’জনকে দেখে কি বাবা সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো না?জেসমিন কে বিয়ে করার কি দরকার ছিলো?বাবা আসলে কোনোদিন মা কে ভালোই বাসে নাই।এটাই আসল কথা।’
বিরক্তিতে রূপসার ললাট কুঞ্চিত হয়।
‘বড্ড বাজে বকিস তুই রূপম! তুই আর কখনো এভাবে মণির সাথে কথা বলবি না।যদি বলিস,তবে আমি আর এই বাড়িতে আসবো না।’
রূপসা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।অথচ রূপম বসে রইল থম মেরে।তারপর বইয়ের ভাঁজ থেকে একটা ছবি বের করে জড়ানো সুরে বলল,’মা! এরা সবাই তোমাকে ভুলে গেছে।কিন্তু আমি ভুলিনি।বিশ্বাস করো মা।রূপম তোমাকে এখনো ভালোবাসে।’
.
.
.
.
‘মেয়েদের সাইন্স বুঝি না আমি।সুন্দর ছেলেরা এদের চুমু খেলেও এরা সেটাকে ফ্লার্ট বলে উড়িয়ে দেয়।আর আমরা যারা চোরের মতো চেহারা নিয়ে ঘুরি,তারা এদের দিকে একবার তাকালেই সেটা ধ/র্ষ/ন ইভটিজিং কতোকিছু হয়ে যায়।’
নাফি কথাটা বলল প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত মেজাজে।কিন্তু বসার ঘরে থাকা সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল।এতো মানুষের হাসিতে তার বিরক্তি আরো বাড়লো।তৌকি পর্যন্ত তার কথায় হাসছে।নাফি ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,’তৌকি চুমু খেলেও সেটা সয়ে নেয়া যায়,কিন্তু আমি নাম জিজ্ঞেস করলেই সেটা হয়ে যায় হেনস্তা।মেয়েদের জাতটাই এমন।’
তৌকি সোফায় পা তুলে বলল,’মেয়েদের সাথে যেচে পড়ে কখনো কথা বলবি না।এতে তারা নিজেদের খুব সুপিরিয়র ভাবে।’
‘আর মেয়েটা যদি রীতিমতো আমায় এড়িয়ে যায়?তখন কি করবো?’
তৌকি ঘাড় ঘুরায়।তার পাশাপাশি বসার ঘরের সবাই সিঁড়ির দিকে চোখ নেয়।শোহরাব দাঁড়িয়ে আছে গা ছাড়া ভঙ্গিতে।সবার নজর তার দিকে পড়তেই সে ধুপধাপ করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলল,’আর যখন কোনো মেয়ে অকারণেই ভাব দেখায়,তখন তাকে কি করা উচিত তৌকি?’
সে হেঁটে এসে ডান দিকের সোফায় গা ছেড়ে বসলো।নাফি বলল,’তুমি তো নায়ক,ভাই।তোমার মুখে এসব কথা মানায় না।’
শোহরাব শুধু তাচ্ছিল্য করে হাসে।তারপর পায়ের উপর পা তুলে সবার আড্ডায় যোগ দেয়।নাফি বলল,’কি শোহরাব ভাই?তোমার বিয়ের প্রস্তুতি কতো দূর?মেয়ে নাকি একটা দেখেছিলে?’
শোহরাব ঠোঁট গোল করে বলল,’দেখেছি।তবে বিয়েটা হচ্ছে না।’
‘সেকি! কেন?’
শোহরাব একটু ঝুঁকে বসলো।দুই হাতের আঙুল আড়াআড়ি করে বলল,’আমার আসলে ঐ টাইপের মেয়ে ভালো লাগে না।আমার খুব সরল সোজা মেয়ে পছন্দ নাফি।এই ধরো কিছুটা যত্নশীল,কিছুটা কোমল,আর অনেক বেশি স্বচ্ছ।জিনিয়া ওয়াজ নট দ্যাট টাইপ।’
তৌফ বলল,’মেঝো ভাইয়া! এই যুগে ওমন মেয়ে তুমি পাবে না।খামোখা বসে না থেকে যাকে পাচ্ছো,তার সাথেই বিয়ে করে নাও।’
শোহরাব ঠোঁট বাকা করে হাসল।সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজে কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল,’আছে তৌফ।অবশ্যই আছে।আমি দেখেছি বলেই জানি।বানিয়ে বানিয়ে কথা বলি না আমি।’
তৌফ চঞ্চল হলো সহসা।
‘মেঝো ভাইয়া! তুমি কাউকে পছন্দ করো?’
চোখ খুলল শোহরাব।অস্পষ্ট হেসে বলল,
‘পছন্দ নাকি জানি না।তবে বিয়ে করলে তাকেই করবো।এইটুকু নিশ্চিত।’
বসার ঘরের মানুষরা গোল গোল চোখ করে তাকে দেখে।সানজানা শুধু দুরুদুরু বুকে তার দিকে তাকায়।মেঝো ভাইয়া যেই পাগলামি শুরু করেছে,সেটার শেষ কোথায় সানজানা জানে না।কিন্তু সে এইটুক জানে ভাইয়া ভীষণ একরোখা।সে যা বলে,তাই করে।সানজানার অবশ্য এতে আপত্তি নেই।হবু ভাবিকে তার বেশ মনে ধরেছে।কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।হবু ভাবির তার ভাইকে মনে ধরেছে বলে মনে হচ্ছে না।সানজানা মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকায়।বিকেল চারটা বাজতে আর পাঁচ মিনিচ বাকি।একটু পরেই রূপসা আসবে আরিবাকে পড়াতে।
__
রোজিনার টিউশন শেষ করে বের হতে হতে তিনটে চল্লিশ বেজে গেল।রূপসা তাড়াতাড়ি রিকশা ডাকে।সে আজ দেরি করতে চাইছে না।আরিবাদের বাসায় রোজ সে পাঁচ মিনিট পরে যায়।
এতে পুরো দোষ তার না।আরিবাদের বাড়ি অব্দি রিকশা চলে না।মূল সমস্যা সেদিকে।হাঁটতে হাঁটতে রূপসার পা ভেঙে আসে।সে রিকশায় উঠেই কপালের ঘাম মুছে বলল,’একটু দ্রুত চলুন মামা।দেরি হচ্ছে আমার।’
এতো তাড়াহুড়োর পরেও রূপসা তিন মিনিট দেরি করে অর্কিড প্যালেসে পা রাখলো।বসার ঘরে আসতেই তার পা থামলো।যেই হম্বিতম্বি করে সে ভেতরে এসেছিলো,এতো মানুষের উপস্থিতি টের পেতেই সেটা উধাও হয়ে গেল।
তৌফ আর তার বন্ধুরা বসার ঘরেই ছিলো।সাথে আবার সানজানা,শোহরাব,আরিবা,আরিয়ান,আয়রা সবাই ছিলো।তাকে দেখতেই সবার গুঞ্জন থেমে গেল।
একরাশ অস্বস্তিতে রূপসার শরীর ঝিম ঝিম করে উঠলো।সে কেমন জড়োসড়ো হয়ে আরিবাকে খোঁজার চেষ্টা করলো।আরিবাকে খুঁজতে গিয়েই শোহরাবের সাথে তার চোখাচোখি হলো।এক পলকের দেখা যাকে বলে।রূপসা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিল।
সানজানা বলল,’যাও আরু।মিস এসেছে তোমার।পড়াশোনা করে তারপর এসো।’
আরিবা মুখ লটকে তার পড়ার ঘরের দিকে হেঁটে গেল।মিস সবসময় এতো আগে আগে আসে কেমন করে?মিস কি অসুস্থ হয়ে এক দুইদিন কামাই করতে পারে না?আরিবা একটা দিনও তার হোমওয়ার্ক থেকে নিস্তার পায় না।
সে তার ঘরে যেতেই রূপসা এক প্রকার ছুটতে ছুটতে তার ঘরে গেল।গিয়েই সবার আগে দরজা বন্ধ করলো।আরিবা অবাক হয়ে বলল,’দরজা বন্ধ করেছো কেন মিস?’
রূপসা তপ্তশ্বাস ছাড়ে।মাথা নেড়ে বলে,’নিচ থেকে অনেক শব্দ আসছে তো।তাই।’
সে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো।মাথাটা ধরে আছে।এমন কেন হচ্ছে তার সাথে?সে একটা সাধারণ মানুষ।দেখতেও সাধারণ,চালচলনেও সাধারণ।আর টাকা পয়সায় আরিবাদের ধারে কাছেও নেই।তাহলে তাকে কেন এ জাতীয় সমস্যায় পড়তে হবে?
বিষয়টা বিরক্তিকর।রীতিমতো বিরক্তিকর।এই বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক শুধুমাত্র টিউশন দিয়েই।ঐ লোক কেন তার সাথে কথা বলতে চায়?এই বড়লোকদের সাথে রূপসার কোনো কথা নেই।
প্রায় ঘন্টাখানেক নির্বিঘ্নে আরিবাকে পড়ানোর পর কেউ একজন দরজায় এসে ধাক্কা দিলো।আরিবা কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে একটা গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে ভেসে এলো,’আরু! আমি শোহু।দরজা খোলো।’
রূপসার হৃদস্পন্দনের মাত্রা বাড়লো অস্বাভাবিক গতিতে।সে আঁতকে উঠে তটস্থ হয়ে বসলো।তার শরীর ক্রমশ শীতল হয়ে আসছে।সে চোখ মুখ খিঁচে অনুনয় করল,’প্লিজ আল্লাহ,প্লিজ।আর ঝামেলায় ফেলো না তুমি আমায়।প্লিজ।’
আরিবা উঠে গিয়ে দরজা খুলল।শোহরাব কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখলো।তারপর ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
রূপসার সমস্ত মনোযোগ আরিবার খাতায়।সে ঠিক করেছে সে চোখ তুলবে না।তুললেও সাহস হারাবে না।তার কি দোষ?সে আরিবাকে পড়াতে আসে।পড়ানো পর্যন্তই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ।যতো ঝামেলা করার,সব ঐ লোক করছে।রূপসা কেন ভয় পাবে?সে একটুও ভয় পাবে না আজ থেকে।
শোহরাব ঘরে এলো।এসেই কলার উপরে তুলে বলল,’আরু! যাও তো।নিচ থেকে চাচ্চুর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।’
আরিবা দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল।রূপসা পাথরের মতো স্থির বসে থাকলো।পরে একটা বড়ো করে শ্বাস নিলো।শোহরাব চেয়ার টেনে ঠিক তার মুখোমুখি বসলো।রূপসার চোখ তখনও আরিবার নোটখাতার ফকফকে কাগজের দিকে নিবদ্ধ।
‘মিস রূপসা!’
একেবারে পুরু কন্ঠ।রূপসা নিরুত্তর।একহাতে শুধু পরনের জামা খাঁমচে ধরলো।
শোহরাব দ্বিতীয় বার ডাকলো,
‘মিস রূপসা!’
‘কি?’
অত্যন্ত কর্কশ কন্ঠ।শোহরাবের মুখ কুঁচকে এলো।
‘অদ্ভুত! প্রথমবারেই কেউ কারো সাথে এভাবে কথা বলে?’
রূপসা প্রতিউত্তর করে না।কটমট চোখে শুধু চোখ তুলে তাকায়।তার মেজাজ গরম হচ্ছে সময়ে সময়ে।
শোহরাব জলদগম্ভীর স্বরে বলল,’রূপসা! আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে।’
‘কিন্তু আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।’
রূপসা এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।শোহরাব খুব শান্ত চোখে তার দিকে তাকালো।অথচ রূপসাকে দেখালো এলোমেলো,খুব বেশি অশান্ত।
সাইড ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে সে কিছুটা উঁচু স্বরে বলল,’আমি এই বাড়িতে আরিবাকে পড়াতে আসি।আরিবা আর তার মা বাবা ছাড়া এই বাড়িতে আর কারোর আমার সাথে কোনো কথা থাকার কথা না।আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না।’
শোহরাব তীক্ষ্ণ চোখে তার অস্থিরতা অবলম্বন করে।তারপর দুর্বোধ্য হেসে বলে,’আচ্ছা।বুঝেছি।এবার তুমি আমার কথা শোনো।’
‘অদ্ভুত তো।বললাম না আমার কোনো কথা নেই।’
শোহরাব চোখের দৃষ্টি আগের তুলনায় আরো বেশি শীতল করলো।রূপসার মনে হলো সেই শীতল চাহনিতে তার পুরো শরীর জমে যাচ্ছে।সে তবুও ভয় পেল না।ভয় পেলে মানুষ দুর্বল ভাবে।জগতে সবাই দুর্বলদেরই আঘাত করে।রূপসা দুর্বল না,অবলাও না।সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’আপনি বললেন না চিঠিতে,যে আমার কি আপনাকে ফাতরা মনে হয় নাকি?আজ বলছি।জ্বী।আমার আপনাকে ওমনই মনে হয়।লজ্জা থাকলে আর সামনে আসবেন না কোনোদিন।’
সে কথা শেষ করে দম ফেলল না।তার আগেই বড়ো বড়ো পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।শোহরাব নির্বিকার হয়ে তার প্রস্থান দেখে।সে বেরিয়ে যেতেই সামান্য হাসে।তারপর সামনে থাকা পেপার ওয়েটটা হাতে তুলে দেয়ালে ঝুলানো পিকচার ফ্রেমের দিকে ছুঁড়ে মারে।
মূহুর্তেই কাঁচ ভাঙার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ ঘরজুড়ে প্রতিধ্বনি হলো।শোহরাব টেবিলে একটা থাবা বসিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে,’এতোদিন অনেক ভালো ব্যবহার করেছি।কিন্তু তুমি হচ্ছো একটা ত্যাড়া মেয়ে।তুমি আমার ভালো মানুষি ডিসার্ভই করো না।যেটা তুমি ডিসার্ভই করো না,সেটা কেমন করে তোমায় দেই বলো তো?’
চলবে-