জুলিয়েট পর্ব-০৯

0
1018

#জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

৯.

দেলোয়ার দরজা খুলেই হতভম্ব হয়ে গেল।দরজার অন্য পাশে শোহরাব দাঁড়িয়ে আছে।সেটা হতভম্ব হওয়ার মতো কিছু না।হতভম্ব হওয়ার বিষয় হলো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে মানুষটি।যার হাত আপাতত শোহরাবের হাতের মুঠোয় বন্দি।মেয়েটা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার।অথচ সেই শক্ত বন্ধন ছাড়িয়ে নেওয়া তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

শোহরাব কোনো দিকে না দেখে তাকে টানতে টানতে ঘরের ভেতর আনলো।মেয়েটা নিজের হাত টানতে টানতে পুনরায় চেঁচিয়ে উঠল,’ছাড় বলছি।আমি আমার বাড়িতে যাব।ছাড়।’

শোহরাব বিরক্ত হলো।পেছন ফিরে বলল,’চুপ করো তো।কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যাননি ভালো লাগে না।বিয়ে হয়েছে,এখন আবার বাপের বাড়ি কি?যতোসব আজগুবি কথাবার্তা!’

রাগে,ক্ষোভে,যন্ত্রনায় রূপসা সমস্ত শরীর অদৃশ্য অনলে জ্বলে যাচ্ছিলো।দুই কদম সামনে যেতেই সে এক ঝাড়ায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিকট শব্দে চিৎকার করল,’ছাড়! আমি যাবো না।আমি আমার বাসায় যাবো।’

সে বলার পরে এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না।দিশাহীন হয়ে দিগবিদিক ছুটে যায়।শোহরাব বড় বড় কদম ফেলে তার কাছে গেল।গিয়েই তার দু’টো হাত শক্ত করে চেপে ধরল।রূপসা মাটির দিকে ভর ছেড়ে দিয়ে কেমন অদ্ভুত স্বরে বলল,’একটু মায়া করুন।আমি আর নিতে পারছি না।’

বাড়ির সদস্যরা ততক্ষণে ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।সানজানার কপালে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম এসে জমেছিল।সে দ্রুত ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে সেটা মুছে নিলো।মেঝ ভাইয়া যে একটা ভয়ংকর আকাম ঘটিয়েছে,সেই ধারণা তার সাথে থাকা মেয়েটা কে দেখামাত্রই স্পষ্ট হয়েছে।সানজানা এই ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ভেবেই কয়েক দফা শিউরে উঠলো।বাবা যদি জানে এই কথা,তবে মেঝ ভাইয়ার কেচাপ বানাবে।আর যদি জানে,সানজানা তাকে সাহায্য করেছে….

সানজানা আঁতকে উঠে একটা ঢোক গিলে।না না।সে আর ভাবতেই পারছে না কিছু।

সবার আগে নিচে নামলো তৌকি।চোখ কপালে তুলে আশ্চর্য হয়ে বলল,’এসব কি শোহু?তুমি আরিবার মিস কে এভাবে ধরে রেখেছো কেন?’

রূপসার সমস্ত শরীর তখন ক্লান্ত হয়ে মাটির দিকে নুয়ে পড়ছিলো।শোহরাব একটানে তাকে সোজা করে দাঁড় করালো।রূপসা ক্লান্ত স্বরে চেঁচালো,’ছাড়ড়ড়।আমি বাবার কাছে যাবো।’

শোহরাব একহাতে তার হাত,অন্য হাতে তার বাহু চেপে ধরল।তারপর সামনে ফিরে একেবারে নির্বিকার হয়ে বলল,’আমি আর রূপসা বিয়ে করেছি।রূপসা এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে।’

তৌকি আহাম্মকের মতো তার কথা শুনে।রূপসার চোখ ততক্ষণে পানিতে টইটম্বুর।তৌকির মনে হলো এই অশ্রুতে জেদ মিশে আছে।চাপা ক্ষোভে ফেটে পড়লে যেমন করে আমাদের চোখ ভিজে উঠে,এই মেয়েটাও তার ব্যতিক্রম না।দীর্ঘসময়ের ধস্তাধস্তিতে মেয়েটার সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে আসছিলো,ক্লান্তিতে বুজে আসছিলো চোখ।রূপসা তবুও ভাঙা স্বরে চেঁচালো,’দোহাই লাগে! আমি আর নিতে পারছি না এসব।’

শোহরাব কপাল কুঁচকে বলল,’অদ্ভুত তো! এই গালি দিচ্ছ,এই আবার অনুরোধ করছো।হয় পুরোটা সময় গালি দাও।নয়তো পুরোটা সময় অনুরোধ করো।’

রূপসা মুখ শক্ত করে বলল,’তুই একটা কুত্তা।’

‘আর তুই কুত্তি।আয় এবার।’

সে তাকে টেনে নিয়ে গেল দোতালার সিঁড়ি পর্যন্ত।রূপসা দোতালার রেলিং খাঁমচে ধরে জোর গলায় বলল,’আমি যাবো না।যাবো না মানে যাবো না।না,না,না।।’

শোহরাব স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।অত্যন্ত গম্ভীর চাহনি।জলদগম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,’চলো আমার সাথে।’

‘না।হাত ছাড়।’

শোহরাব পেছন ফিরে।আচমকাই রূপসাকে বাড়াবাড়ি রকমের অবাক করে দিয়ে সে তাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয়।সানজানার চোয়াল ঝুলে গেল।সে মুখে হাত চেপে শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে সবটা দেখে গেল।তানিয়া ততক্ষণে দোতালার সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।আরিবা তার পেছনে।মায়ের শাড়িটা খাঁমচে ধরেই আরিবা বলল,’মা! শোহু মিস কে কোলে নিল কেন?’

তানিয়া এক হাতে মেয়ের মুখ চেপে ধরল।কিছুটা ধমক দিয়ে বলল,’চুপ আরু।এখন কোনো কথা বলো না।’

রূপসা দুই দিকে হাত পা ছুঁড়ে বলল,’নামা।নিচে নামা আমাকে।ধরে একটা চড় দিব।কু’ত্তার বাচ্চা।ছাড়।’

শোহরাব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’বাড়াবাড়ি করছো রূপসা।’

‘তুই করছিস বাড়াবাড়ি।জোর করে বিয়ে করেছিস।কু’ত্তা কোথাকার।’

জোহরা তিন দিন যাবত মাথা ব্যথায় অস্থির ছিলেন।বাইরের চিৎকার চেঁচামেচি শুনেও তিনি উঠে আসার জোর পেলেন না।কিন্তু মেয়েলি কন্ঠটা কেমন পরিচিত মনে হতেই তিনি ধড়ফড় করে উঠে বসলেন।তার মাথায় সবার আগে কুচিন্তাই এলো।তবুও তিনি সেটা ঝেড়ে ফেলে দরজার দিকে ছুটে গেলেন।যেতে যেতে একবার দোয়া করলেন,তিনি যেটা ভাবছেন সেটা যেন সত্যি না হয়।

দরজা খোলার পর যেই দৃশ্য তার চোখে পড়ল,সেই দৃশ্য দেখে জোহরা পলক ফেলতেও ভুলে গেলেন।কেবল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালেন।
তার ছেলের কোলে একটি মেয়ে।মেয়েটি তার পরিচিত।আরিবার মিস।তাকে পড়াতে আসতো।বিকেল চারটার দিকেই আসতো।মুখে একটা ভদ্রতা সুচক হাসি লেপ্টে থাকতো।আজ সেই মুখে হাসি নেই।চোখ দু’টো পানিতে ভেজা।কন্ঠ বসে গেছে।দীর্ঘসময় চিৎকার করার পর কন্ঠস্বর যেমন ভাঙা ভাঙা শোনায়,অনেকটা তেমনই শোনাচ্ছিলো তার কন্ঠ।

শোহরাব কোনো দিকে তাকালো না।সোজা ঘরে গিয়ে ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো।রূপসা গলা ছেড়ে বলল,’আল্লাহ তোর বিচার করবে।ছাড় আমাকে।’

শোহরাব ছাড়লো না।তবে কোল থেকে নামিয়ে টানতে টানতে আলমারি পর্যন্ত নিয়ে এলো।আলমারির তাকে তার টাই রাখা ছিলো।সে সেখান থেকে দু’টো টাই হাতে নিয়ে রূপসাকে খাটে নিয়ে বসালো।রূপসা আঁতকে উঠে বলল,’তুই কি করবি আমার সাথে?’

টান টান মুহূর্ত।পরিবেশ গম্ভীর।অথচ শোহরাবের হাসি পেলো।সে একগাল হেসে রূপসার হাত বাঁধতে বাঁধতে বলল,’আমি?আমি তোমায় আদর দিবো।’

রূপসা হাতটা নিজের দিকে টেনে এনে বলল,’তুই একটা শু*য়োর।আল্লাহ তোকে জীবনেও মাফ করবে না।’

‘আচ্ছা।’

‘আমি তোকে একটুও পছন্দ করি না।’

‘আচ্ছা।’

দ্বিতীয় টাই টা তার পায়ের দিকে এগিয়ে নিতেই রূপসা ছটফট করে উঠল।শোহরাব তার দুই পা চেপে ধরল শক্ত করে।কালো রঙের টাইটা পায়ের টাকনু স্পর্শ করতেই আচমকা রূপসা বাচ্চাদের মতো ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।তেজ,দম্ভ,রাগ সবকিছুই কেমন উবে গেল এক লহমায়।পরাজিত সৈন্যের ন্যায় বার বার কেবল শ্বাস টানতে টানতে বলল,’দোহাই লাগে।আমার সাথে এই কাজ করবেন না।আমি আজ পর্যন্ত আপনার কোনো ক্ষতি করিনি।’

শোহরাব তার পা দু’টো বাঁধামাত্র উঠে দাঁড়ালো।একবারে নির্লিপ্ত চাহনি।মাথার চুলে হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’চুপচাপ বসে থাকো তুমি।আমি আসা পর্যন্ত এভাবেই বসে থাকো।বাপরে বাপ! কান দু’টো ঝাঁজরা হয়ে গেছে আমার!’

___

জোহরা কপালে হাত চেপে বললেন,’এসব কি?তানিয়া! এসব কি হচ্ছে?আমার ছেলে এসব কি করছে?’

তানিয়া শ্বাশুড়ির কাছে ছুটে গেল।তার একটা হাত ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,’মা! আপনি শান্ত হন।আপনার মাথা ব্যাথা আরো বাড়বে।’

জোহরা কেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।চারদিক দেখে বলেন,’কিভাবে শান্ত হবো তানিয়া?তোমার মেঝ দেবর বাড়িতে মেয়ে তুলে এনেছে।তাও জোর জবরদস্তি করে।তোমার শ্বশুরকে আমি কি জবাব দিবো?’

দরজা খোলার শব্দ কানে যেতেই জোহরা চুপ হয়ে গেলেন।পাশ ফিরে দেখলেন,শোহরাব খুব স্বাভাবিক ভাবে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।বেরিয়ে আসা মাত্রই সে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করল।জোহরা একটা শুকনো ঢোক গিলেন।ক্ষণিক বাদেই ছেলের কাছে দৌড়ে গিয়ে বললেন,’এসব কি শোহরাব?তুমি ঐ মেয়েকে এভাবে বাড়ি এনেছো কেন?’

শোহরাব শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বলল,’বিয়ে করেছি।তো বাড়ি আনবো না?’

জোহরা তব্দা খেয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলেন।বিস্ফারিত চোখে সামনে দেখে বললেন,’বিয়ে করেছো মানে?’

‘মানে কবুল বলে বউ বানিয়েছি।’

জোহরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,’আমাকে আর কতো জ্বালানোর পর তুমি শান্তি পাবে শোহরাব?’

শোহরাব দায়সারা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে।চোখে মুখে কোনো বিকার নাই।জোহরা মাথায় হাত চেপে বললেন,’আমি আর নিতে পারছি না।আর পারছি না আমি।’

তিনি মাথায় হাত চেপে টলমলে পায়ে তার ঘরে চলে গেলেন।যেতে যেতে তানিয়া কে বললেন,’তানিয়া! আমার আইসব্যাগটা আমার ঘরে দিয়ে এসো তো।আমি নয়তো পাগল হয়ে যাবো।’

তানিয়া বোকার মতো শুধু মাথা নাড়লো।জোহরা খাতুন ঘরে গিয়েই দরজা ভিড়িয়ে রাখলেন।আরিবা মায়ের হাতের বাঁধন ছেড়ে সামনে এগিয়ে গেল।তারপর শোহরাবের দিকে দেখে ঠোঁট গোল করে বলল,’শোহু! মিস কাঁনছে কেন?’

শোহরাব মাথা নামিয়ে তার দিকে তাকালো।তারপর একটানে তাকে কোলে নিয়ে তার গালে একটা হাত রেখে বলল,’হোম ওয়ার্ক করে নি ঠিকঠাক।তাই বকুনি দিয়েছি।এজন্য কান্না করছে।’

‘মিসেরও হোম ওয়ার্ক আছে?’

আরিবার কন্ঠে স্পষ্ট বিস্ময়।শোহরাব হেসে বলল,’হুম।আছে।’

‘আমি মিসের কাছে যেতে চাই।’

শোহরাব বড় বড় চোখ করে বলল,’পাগল নাকি?তোর মিস এখন বিষ হয়ে আছে।সাপের মতো ফণা তুলে বসে আছে।গেলেই ছোবল মারবে।এখন যাস নে।’

সানজানা ভাইয়ের কাছে ছুটে এসে বলল,’শোহু! তুমি এটা কি করলে?বাবা তো তোমার পিন্ডি চড়াবে।’

শোহরাব গালভর্তি হাসে।কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলে,’তোর বাপ কে আমি ভয় পাই না।’

অথচ বলতে বলতেই তার কন্ঠ দুর্বল হয়ে এলো।সানজানা বলল,’এখনই তো ভয়ে কাঁপছো।বাবা এলে কি করবে?’

শোহরাব বিরক্ত হয়ে বলল,’চুপ কর তো তুই।এতো কথা বলিস না।মাথা ধরছে আমার।’

সে আরিবা কে নিয়ে বসার ঘরের দিকে চলে গেল।যেতে যেতে রাশভারি গলায় বলল,’দরজা খুলিস না সানজু।এরপর কিছু হলে আমায় দোষ দিবি না বলে দিলাম।’

সানজানা দোতালার করিডোরে সটান দাঁড়িয়ে থাকে।মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে।মেঝ ভাইয়ার পরিণতি নিয়ে সে যতোটা না চিন্তিত,তার চেয়ে বেশি চিন্তিত নিজের পরিণতি নিয়ে।আরিবার বইয়ের ভাঁজে চিরকুট রাখতো সে।এই কথা যদি বাবা জেনে যায়।নাহ্।আর ভাববে না সে।বাবা জানলে নির্ঘাত তার গলা চেপে ধরবে।বলবে-‘টিউশন করতে আসা একটা ভালো বাড়ির মেয়ের সাথে এসব অসভ্যতা করেছো তোমরা?’

সানজানা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়ায়।বিয়ে টা কি ধীরে সুস্থে করতে পারতো না মেঝ ভাইয়া?এখন যদি বাড়িতে পুলিশ আসে?এসে যদি জিজ্ঞেস করে চিঠিটা কে দিলো?তখন তো সানজানা ধরা পড়ে যাবে।এরপর তো বাবা নাচতে নাচতে সানজানাকে পুলিশের হাতে তুলে দিবে।

সে মাথায় হাত চেপে ধপ করে ফ্লোরে বসে গেল।না,না।এটা হতে পারে না।এতো অল্প বয়সে সানজানা জেলে যেতে পারে না।
.
.
.
.
কানের কাছে একটা মশা প্যা পু শব্দ করে উড়ে গেল।অর্ক বিরক্ত হলো ভীষণ।কপাল কুঁচকে সে কেবল হাত ঝেড়ে মশাটা উড়িয়ে দিলো।তবুও সেটা ঘুরে ফিরে কানের কাছে এসে ডানা ঝাপটাচ্ছিলো।

রক্তে লোহিত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক পরিমানে বেড়ে যাওয়াকে বলে ইরিথ্রোসাইটোসিস বা পলিসাইথেমিয়া।আর অস্বাভাবিক কমে যাওয়াকে এনিমিয়া।মানবদেহে অতিমাত্রায় লোহিত রক্তকণিকা ক্যানসারের কারণ।

অর্ক মন দিয়ে পড়ছিলো।তবে মশার উৎপাতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করা সম্ভব হচ্ছিল না।বার বার লাইন হারিয়ে যাচ্ছিলো।অর্ক বইয়ের লাইনে আঙুল চেপে আওয়াজ করে পড়ে যাচ্ছিল।
শতাব্দী দরজায় উঁকি দিয়ে বলল,’ভাইয়া!’

অর্ক চোখ দু’টো পাতার ভাঁজে এটে ধরে বলল,’কি?’

‘মশা কামড়ায়?কয়েল জ্বালাবো?’

অর্ক চোখ মেলে।দুই দিকে মাথা নেড়ে বলে,’নাহ্।ঐটা রাতে ঘুমানোর সময় ব্যবহার করবো।’

শতাব্দী পা টিপে টিপে ভাইয়ের কাছে এসে বসলো।অর্ক কড়া গলায় বলল,’পড়ছি আমি।এই সময় ডিস্টার্ব করিস না।’

‘উহু।ডিস্টার্ব করবো না।শুধু তোমার পাশে বসে থাকবো।’

অর্ক আবার পড়াশোনায় মন দেয়।
মানবদেহে লোহিত রক্তকণিকা আর শ্বেত রক্তকণিকার অনুপাত ৬০০:০১।

শতাব্দী গালের নিচে হাত রেখে অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’রূপম ভাইয়াকে বলবে পরের বার বাড়ি এলে যেন কয়েল নিয়ে আসে।রোজ রোজ বিস্কুট নিয়ে আসে কেন?এতো বিস্কুট কে খায়?’

অর্ক কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।শতাব্দী দমে গিয়ে বলল,’এভাবে তাকাও কেন?ভুল তো কিছু বলি নি।’

‘তুই যে ফকিন্নি,সেটা রূপমের সামনে প্রমাণ করিস না।’

শতাব্দী একটু মনঃক্ষুন্ন হলো।ভাইয়া এমন করে বলল কেন?সে কি আসলেই ফকিন্নি?সে বিষন্ন মুখে বলল,’আচ্ছা ভাইয়া,আমার চেহারা কি খুব খারাপ?’

‘তোর চেহারা দেখার টাইম আমার নাই শতাব্দী।সামনের সপ্তাহ থেকে আমার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল।তুই এখন যা।’
শতাব্দী গেল না।কেবল দু’জনের দূরত্ব কিছুটা বাড়িয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।

জীবন আসলে বড্ড অবিবেক।শতাব্দীর অন্তত এমনই মনে হয়।জীবন একেক জনের জন্য একেক রকম।মানুষের জীবন কতো আনন্দের হয়।অথচ তাদের জীবনটা কতো আলাদা।আনন্দের আ টাও নেই।শুধু আছে অনেকগুলো বিশালাকার শূন্য।যেই শূন্য গুলো সহ্য করে নিয়ে শতাব্দীদের বলতে হয়,’আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’
অথচ তারা একটুও ভালো নেই।

ভালো থাকার দু’টো ধরণ আছে।একটা হচ্ছে অর্থবিত্তের দিক দিয়ে ভালো থাকা।অন্যটা হলো মনের দিক থেকে ভালো থাকা।অর্থবিত্তের দিক দিয়ে তো তারা ভালো নেই।সেটা চোখ খুললেই দেখতে পাওয়া যায়।
তবে যেটা দেখতে পাওয়া যায় না,তা হলো মনের দিক থেকেও শতাব্দী ভালো নেই।এতো অভাব অনটনও শতাব্দী হাসি মুখে মেনে নিত,যদি না তার একটা সুন্দর পরিবার থাকতো।কিন্তু দুঃখের বিষয়,স্রষ্টা তাকে একটি সুন্দর পরিবার দেন নি।বাবা! আহ,শব্দটা শুনলেই আপনাআপনি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে।বাবাকে নিয়ে বলতে গেলেই শতাব্দীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়।ভেতর থেকে এক আকাশ বিতৃষ্ণা বাদে আর কিছুই আসে না।
.
.
.
.
রাজিব সাহেব চিন্তিত হয়ে ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পায়চারি করছিলেন।এক ফাঁকে আবার রূপসার নম্বরে ফোন দিলেন।নাহ্।এখনো ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে।

জেসমিন দুয়ারে দাঁড়িয়ে বললেন,’আপনি বসুন না দয়া করে।আপনি নিজেও তো অসুস্থ।এতো চিন্তা করলে তো নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবেন।’

রাজিব বললেন,’চিন্তা করবো না বলছো?সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা এখনো বাড়ি আসে নি।উল্টা পাল্টা চিন্তায় আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।’

জেসমিন দুই দিকে মাথা নেড়ে জড়ানো স্বরে বলল,’না না।এসব বলবেন না।কিচ্ছু হবে না।কোনো বন্ধুর বাসায় গিয়েছে হয়তো।’

‘বন্ধুর বাসায় গেলে ফোনটা কেন বন্ধ?’

‘চার্জ শেষ হয়ে গেছে হয়তো।’

‘বন্ধুর থেকে চার্জার নেওয়া যেতো না?’

জেসমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,’হয়তো মনে নেই আরকি।’

‘নিজেকে স্বান্তনা দেওয়া বন্ধ করো জেসমিন।তুমি খুব ভালো করেই রূপ এতো লা পরোয়া মেয়ে না।’

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই রুপম হন্তদন্ত পায়ে ঘরে এলো।
রাজিব বললেন,’রূপম?তোমার দিদিয়ার হোস্টেলে গিয়েছিলে?’

রূপম তড়িঘড়ি করে বলল,’গিয়েছিলাম।সে নাই সেখানে।’

রাজিব সাহেব দুইবার শ্বাস টানলেন।বললেন,’তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো রূপম?’

রূপম নিজের ঘরের দিকে ছুটতে ছুটতে বলল,’থানায় যাচ্ছি।মিসিং ডায়রি করতে।’

বলেই সে এক প্রকার দৌড়ে দৌড়ে নিজের ঘরে গেল।গিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে নিল।ঘর থেকে বের হতেই রাজিব তার পথ আটকে দাঁড়ালেন।রূপম তাকে পাশ কাটাতে কাটাতে বলল,’পরে কথা বলব।এখন আমার সময় নাই।’

রাজিব তার একটা হাত চেপে ধরলেন।রূপম শুধু চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো।

‘তোমার মাথা খারাপ রূপম?থানা পুলিশ জানালে জল কতোদূর গড়াবে।তুমি জানো?’

‘তো?কি করব এখন?জল গড়ানোর ভয়ে হাতে চুড়ি পরে বসে থাকবো?’

‘চুড়ি পরতে হবে না।থানা পুলিশ পর্যন্ত যাওয়ার আগে আরেকটু খুঁজে দেখো।’

রূপম দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’অনেক খুঁজেছি।পাই নি।তুমি তোমার মান সম্মানের ভয়ে বসে থাকো।আমার বোনের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।তুমি থাকো তোমার মান সম্মান নিয়ে।যত্তোসব!’

রূপম হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।চিনচিন বুকের ব্যাথা নিয়ে রাজিব সাহেব সোফায় গিয়ে বসলেন।জেসমিন তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো।রাজিব সাহেব পুরো গ্লাস খালি করেন নি।একটু গলা ভিজিয়ে নিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,’আমার ছেলে আমার সাথে কেমন আচরণ করে তুমি দেখেছো?’

জেসমিন প্রতিউত্তর না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন।আজ তিনি রূপমের কাজে সন্তুষ্ট।কিসের এতো লোক লজ্জা শুনি?সবার আগে রূপসার নিরাপত্তা।তারপর বাকি সব।লোক জানলে জানুক।জেসমিন শুধু চায় মেয়েটা সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে আসুক।আর কিচ্ছু না।
.
.
.
.
রাত নয়টা।অর্কিড প্যালেসের বসার ঘর তখন মানুষে ভর্তি।মারুফ সাহেবের দুই বোন স্মৃতি আর মেঘা একটু আগে বাড়িতে এসেছে।জোহরা তাদের ফোন দিয়ে সব খুলে বলতেই তারা তাদের সব কাজ ফেলে এখানে ছুটে এসেছে।

স্মৃতির চোখে মুখে তখনও বিস্ময়।এখানে আসার পর যা যা দেখছেন,পুরোটাই তার স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।শোহরাব নাকি একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছে।আসার পর মেয়েটির সাথে তার দেখা হয়েছে।দেখা হয়নি ঠিক।তিনি মেয়ে টি কে দেখেছেন।অথচ মেয়েটি তাকে দেখেনি।মেযেটির তখন জ্ঞান ছিলো না।স্মৃতির ভীষণ মায়া হলো তাকে দেখে।কি মিষ্টি একটা মুখ!

মেঘা অবশ্য তার মতো চুপচাপ নেই।আসার পর থেকে সে শোহরাবের উপর চড়াও হচ্ছে।শোহরাব তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।মেঘা বলল,’ঐ মেয়ের বাপ তোকে জেলের ভাত খাওয়াবে।’

শোহরাব ত্যাড়ামি করে বলল,’আমার কোনো সমস্যা নেই।জেলের ভাতও খারাপ না।’

মেঘা কর্কশ গলায় বললেন,’তুই খেয়েছিস জেলের ভাত?’

‘নাহ্।শুনেছি।’

‘তোকে আমি থাপ্পড় দিবো শোহু।’

‘আসার পর অলরেডি দু’টো দিয়েছো।পিঠে।’

মেঘা ধৈর্যহারা হয়ে বললেন,’তোর বাপ আসুক।এরপর দেখি তোর কি অবস্থা হয়।’

শোহরাব পুরো বিষয়টাই তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিলো।অথচ মনে মনে বাবার বিষয়টা নিয়ে সে চিন্তিত।বাবাকে সে ভয় পায় না ঠিক।তবে বাবার মুখের উপর কাটকাট কথাও বলতে পারে না।বাবা এখনো শহরে নেই।দুই তিনদিন পর আসবে।বাবা আসার পর পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সে জানে না।তবে রূপসা কে সে কিছুতেই ছাড়ছে না।এই নিয়ে সে বদ্ধ পরিকর।
.
.
.
.
রাত একটু গভীর হয়েছে।বসার ঘরের গুঞ্জন একটু কমে এসেছে।জোহরার ঘরে তখন তার দুই ননদ বসেছিল।জোহরা বিকেল থেকেই স্বামীর ভয়ে তটস্থ হয়ে ছিলেন।স্মৃতি আর মেঘা তাকে ভরসা দিলো।বড় ভাইয়া না আসা পর্যন্ত তারা এই বাড়িতেই থাকবে।

ফাহিম দাঁড়িয়েছিল গেস্ট রুমের বারান্দায়।হঠাৎই কেউ তার ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করলো।ফাহিম চমকের পিলে পেছন ফিরল।এগিয়ে এসে দেখলো শোহরাব ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে।তার মুখে রাজ্য জয়ের হাসি।

ফাহিম এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।তার মুখ প্রতিক্রিয়া হীন।শোহরাব হাত পা ছড়িয়ে খাটে শুয়ে কেবল মাথা তুলে তার দিকে তাকালো।ফিচেল হেসে বলল,’ডেয়ার ডান ফাহিম।আই ডিড ইট।’

ফাহিম চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকালো।তার এ মুহূর্তে সবকিছু ভোঁতা ভোঁতা লাগছে।সে আস্তে করে খাটের এক কোণায় বসে বলল,’তুই জাস্ট একটা সস্তা ডেয়ারের জন্য ঐ মেয়েকে এভাবে বিয়ে করে নিয়েছিস?’

‘হ্যাঁ।তো?তুই বলেছিলি রূপসা কোনোদিন আমাকে পাত্তা দিবে না।বিয়ে করা তো দূরের ব্যাপার।’

‘পাত্তা তো এখনো দিচ্ছে না।’

‘কিন্তু বিয়েটা তো হয়ে গেছে।’

ফাহিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।ফ্যাকাশে মুখে কেবল বলল,’তুই রূপসা কে একটুও পছন্দ করিস না শোহরাব?’

শোহরাব পেটে হাত চেপে খিলখিল করে কিছুক্ষণ হাসলো।তারপর চোখ খুলে গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’পাগল নাকি?রূপসার নাম আর বাড়ির এড্রেস বাদে আমি আর জানি টা কি?ভালোবাসা এতো সোজা নাকি?হ্যাহহ্।’

চলবে-